Sunday, June 2, 2024


 

নিবন্ধ 


পিতা  নোহ্ সি
  কবিতা বণিক


“ ওরে বাবা ! “  “ বাবা গো ! “  দুঃখে, কষ্টে, বিপদে- আপদে এই শব্দ কয়েটি  উচ্চারণ করেন না এমন মানুষ বিরল। কথায় আছে বাবা যদি সন্তানের হাত ধরে থাকে তবে সন্তানের পড়ে যাবার ভয় থাকে না।  পিতা বা  বাবার নিঃশব্দ স্নেহ, জীবন উজার করে ভালবাসা একমাত্র সন্তানই বুঝতে পারে। সন্তানকে সুখী দেখতে সন্তানের সুপ্রতিষ্ঠার জন্য বাবার চেয়ে বড় ভূমিকার কারও হয় না।  যদিও মা, বাবা মিলিত ভাবে করেন কিন্তু আসল চাবিকাঠি বাবার হাতেই  নিঃশব্দে ঘোরে। সিঙ্গল মাদার রাও খুব ভাল সন্তান তৈরি করেন ঠিকই। বাবার শূন্যস্হান  শিশু মনের গভীরে কিভাবে ক্রিয়া করে  তা  পরবর্তীতে সমাজ টের পায়।  সম্পূর্ণ রূপে শরীর , মনের পুষ্টি হয় না। কারন শিশুর কাছে বাবা ও মা দুজনই  মূল্যবান । দুজনকেই তার চাই। 
              আকাশকে পিতা বলে জানি। মাটি আমাদের মা। মাটিতে শুধু পা দুটো থাকে আমাদের।  আর পিতা সমস্ত  শরীর জুড়ে  জড়িয়ে থাকেন।  মাটির ওপরে যা কিছু শুন্য তাই আকাশ।  কারণ আকাশ অর্থে শূন্য । তার কোন আকার  নেই, রং নেই। শুধুই ব্যপ্তি।  আকাশের গায়ে কোন দাগ লাগে না। মাটি থেকে অনন্ত পর্যন্ত যে আকাশ তাকে বলি মহাকাশ।  আমরা শূন্য ঘট, পটের ভিতর টাকে বলি ঘটাকাশ, পটাকাশ। জীব , জন্তু, গাছপালা, ফাঁকা ঘটে, পটে , কলসীতে  সর্বত্রই  আকাশ আমাদের পিতৃস্নেহে জড়িয়ে রেখেছেন। তাঁর স্নেহে যে প্রাণের আনন্দানুভূতি, এই আনন্দস্বরূপ পরমপিতা  বা পরমাত্মার সাহায্যে সমস্ত জীবকুল জীবিত এবং কর্ম্যক্ষম।  
               আকাশ বা পিতা নিরহঙ্কার । তাঁর কোন চাহিদা নেই। তিনি না শুষ্ক না জলীয় । পিতৃ স্নেহস্পর্শে শুধুই আনন্দ দান করেন। “ রসো বৈ সঃ “  তিনি আনন্দ স্বরূপ। প্রতিদানে  তাঁর কোন  চাহিদা নেই। নির্মল স্বচ্ছ, দাগহীন আকাশ স্বরূপ  আমাদের পিতা। পিতারূপে যাকে সংসার জীবনে পাই সেখানেও নিঃশব্দে , নীরবে স্নেহের পরশ দিয়ে যান। জনক ছাড়া ও আত্মিক সম্বন্ধ স্হাপনে যিনি পিতা তাদের কাছে যে শিক্ষা, সাহায্য, আশীর্বাদ, সাহস পাই  তা জীবনের অমূল্য পাথেয়।  পিতার কোনরকম প্রত্যাশা হীন  স্নেহ আশীর্বাদ আমাদের জীবনের ভরসার স্হল।  কবির ভাষায়  পিতার সম্বন্ধে বলতে পারি            “ তুমি থাক , যেথায় সবাই
                    সহজে খুঁজিয়ে পায় নিজ নিজ ঠাঁই।।”
আমাদের সংসারে দেখি মা যখন নিজে দুরন্ত  সন্তানদের  শান্ত করতে পারেন না  তখন বাধ্য হন পিতার হাতে সঁপে দিতে।  পিতা সযত্নে সেই সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনেন।  ভুলোক থেকে দ্যুলোক সবখানে এই নিয়ম প্রযোজ্য। মা সন্তুষ্ট হলে পিতা যেমন প্রসন্ন হন ঠিক তেমনি পিতা সন্তুষ্ট হলে  মা খুব প্রসন্না হন।  পিতা তাঁর সমস্ত গুণ উজার করে পুত্র বা শিষ্যের  মধ্যে সঞ্চারিত করেন ।  গুরুগৃহেও পিতৃতুল্য  গুরুর পরিচয়  পুত্রসম শিষ্যের গুণরাশির মাধ্যমে  অনেক বেশি হয়। পিতার পরিচয়ে যেমন পুত্রের পরিচয় হয়  তেমনি সুযোগ্য পুত্রের পরিচয়ে পিতার পরিচয় হয় খুব সম্মানের।  সংস্কৃতে একটা কথা আছে “ পুত্রাদিচ্ছেদ পরাজয়ম।” অর্থাৎ পুত্র বা শিষ্যের বিজয় যদি বাবা অথবা গুরুর পরাজয় হয় তা খুবই গৌরবের। শাস্ত্রের কথায়  “ পিতৃদেব ভব।” অর্থাৎ পিতাকে দেব স্বরূপ ভাববে।  আরও পাই। “ পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম /  পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরী প্রীতিমাপন্নে / প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা! “ 
পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে সন্তুষ্ট  করলে সব দেবতারা সন্তুষ্ট হন।  
                  যজুর্বেদের একটি মন্ত্র —
ওঁ পিতা নোহ্ সি  পিতা নো বোধি নমস্তেস্তু। মা মা হিংসীঃ বিশ্বানি দেব  সবিতর্দুরানি  পরাসুব যদভদ্রং তন্ন আসুব ।  নমঃ শম্ভোবায় চ  ময়োদ্ভবায় চ  নমঃ  শঙ্করায় চ ময়োস্করায় চ  নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ  ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
  ব্রহ্মোপসনার  মন্ত্র এটি।  অর্থাৎ  তুমি আমাদের পিতা, পিতার ন্যায় আমাদিগকে  জ্ঞান শিক্ষা দাও।  তোমাকে নমস্কার। আমাকে মোহ পাপ হইতে রক্ষা করো। আমাকে পরিত্যাগ করিও না।  আমাকে বিনাশ করিও না। হে দেব ! হে পিতা !  পাপ সকল মার্জনা করো।  যাহা কল্যাণ  তাহা আমাদের মধ্যে প্রেরণ করো।  তুমি যে সুখকর, কল্যাণকর, সুখ - কল্যাণের আকর । কল্যাণ ও কল্যাণতর।  তোমাকে নমস্কার।।
                  ধর্মের ঈশ্বর বা পিতা ভুবন সৃষ্টির পরে ছেড়ে যাননি ভুবনকে । উৎসের  সাথে সাদা সংপৃক্ত । তাই মহাবিশ্বের চেতনার আদি উৎসের  সঙ্গে  আমাদের সুর মেলাবার ক্ষমতা আমাদের প্রত্যেকেই আছে।  যখন মিলে যায় সেই সুর  সেই ইচ্ছে তখনই প্রতিভাত হয় অরূপের বাণী— যেন নির্বানহীন আলোকদীপ্ত তাঁরই ইচ্ছে খানি।

No comments:

Post a Comment