নিবন্ধ
পিতা
জয়তী ব্যানার্জী
ন সত্যম্ দান মনৌ
বা যজ্ঞাশ্চপ্ত দক্ষিণা:
তথা বল করা: সীতে!
যথা সেবা পিতুর্হিতা--
_____ রামায়ণ (অযোধ্যা কান্ড) .
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
অর্থাৎ হে সীতে! পিতার সেবা করা এতই কল্যাণকর যে- তাহা সত্য, দান ,সম্মান ,প্রচুর দক্ষিণা সহ যজ্ঞ থেকেও বলকারী!
হিন্দু শাস্ত্রমতে, যিনি জন্মদান, সম্প্রদান, রক্ষা ,আশ্রয়দান এবং অভিভাবক বা গুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত হন--- এইসব অর্থে পঞ্চপিতা বা সপ্তপিতা বিবেচনা করা হয়। আবার যার পরিকল্পনা কার্যক্রম আদর্শ কোন বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করে তিনিই পিতা। বিশেষ করে যার আদর্শিক নেতৃত্বে কোন জাতি গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র স্বাধীকার এর মাধ্যমে স্বনামে প্রতিষ্ঠা পায়। পিতা --পরম পিতা বা জগত পিতা।
কবি বলেছেন_____
"তুমি আমাদের পিতা,
তোমায় পিতা বলে যেন জানি,
তুমি কোরোনা কোরোনা রোষ"।
পিতাই এক এবং অদ্বিতীয় পরম সত্তা। সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের পরম নিয়ন্ত্রক ।একেশ্বর বিশ্বাসী ধর্মে আরাধনার সত্তা।
পিতা একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে বা যেকোনো ধরনের সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন ।তিনি যেকোনো সন্তানের পুরুষ জন্মদাতা। মাতা পিতার বিপরীত লিঙ্গ ।পিতার বিভিন্ন শব্দ হল অর্থাৎ প্রতিশব্দ হলো ---
জনক ,আব্বা ,বাবা ,জন্মদাতা ইত্যাদি।
সংসার প্রান্তরে আমাদের জীবনের চাকা গড়িয়ে চলে। কেন্দ্রগত শূন্যস্থানটিই যে চাকা নির্ভরতা সেই বোধটুকু যেন থাকে। সেইটাই হল বিশ্বাস--- যা চোখে দেখা যায় না. এটা এক আত্মগত অনুভূতি ।এই কেন্দ্রে আছে পিতা--- হিব্রু ভাষায় পিতা শব্দের অর্থ দরজা। এই সংসার নামক বস্তুতে একটা চাকা গড়িয়ে চলেছে। মাঝখানে একটা গোলাকার বেড়। সেখান থেকে চারপাশে ছড়িয়ে গেছে ত্রিশটি স্পোক বা দন্ড ।কেন্দ্রের ওই শূন্য গোলাকার অংশটাই কিন্তু সব---- চাকার সমস্ত আকার ,উৎস, শক্তির নির্ভর স্থল।
ওই শক্তি না থাকলে যে চাকাটার ই কোন অস্তিত্ব থাকবে না, আর চাকাটা রয়েছে কিসের ওপর--- মাটিতে, যে মাটি থেকে কুম্ভকার তৈরি করেন বিশাল এক জ্বালা_____ ভেতরটা শূন্য, কিছুই নেই , অথচ ওই শূন্যস্থান টুকুই জ্বালার ;সব জ্বালার প্রয়োজনীয় অংশ। ওই শূন্যতা টুকুর জন্যই জ্বালার নির্মাণ। এখন একটা ঘর, তার একটা জানালা ।একটাই দরজা ,আবার জানালা একটা না বলে দুটো বলাই যায়। শূন্যস্থান অথচ ভয়ঙ্কর প্রয়োজনীয়। দরজা না থাকলে যেমন ঘরে ঢোকাও যাবে না, বেরোনো যাবে না। জানালা না থাকলে বাতাস আসবে না ।ঘর হয়ে যাবে কফিন।
ওই শূন্যস্থান ই হল দর্শনের প্রেক্ষিতে শক্তি আর আমাদের আপামর জনসাধারণের কাছে তার পরিব্যপ্ত রূপই হল----
পিতা স্বর্গ: পিতা ধর্ম:!
এই যে নির্ভরতা এই যে বিশ্বাস___ এর একমাত্র আধারই বোধ হয় পিতা ।এই বিশ্বাস ভরসা যা চোখে দেখা যায় না--তা এক আত্মগত অনুভূতি। সংসার যে গাড়ির টায়ার---- ভেতরের বাতাস টুকুই তার শক্তি। ভাল্ভ খুলে দিলেই তা ফুস করে বেরিয়ে যাবে ।মিশে যাবে প্রকৃতিতে। সেই বিশ্বাস আর নির্ভরতা হলো সংসার রূপী জীবন টায়ারের বাতাস- চালিকাশক্তি। যে কিনা সংসারের অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলকে ধরে রেখেছে। অথচ দিন শেষে তার প্রাপ্য অভিযোগ আর অভিযোগ।
পিতা নামক ব্যক্তিত্বটাই কিন্তু একটা thankless job.. কারণ সব কিছুর মূলে থাকা সত্ত্বেও সে বুঝি নিঃস্ব ।সে যে রানার । রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে ....রানার ছুটেছে ...বুঝি ভোর হয় হয়...., তার কাঁধে টাকার বোঝা তবু সেটাকে যাবে না ধরা।
তাইতো ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে যদি আমরা পরমপিতা মানি তাহলে হয়তো পিতারূপী ব্যক্তিত্ব সংসারের হাল কিছুটা আত্মস্থ করতে পারবে। কারণ সে তো তখন উৎসর্গীকৃত ।একটা কথা আছে না "বাবারও বাবা আছে"----- সত্যি বোধ হয় তাই ,পিতা যে সংসারের লাঙ্গল ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন তাকে শুধু তো মান্যতা নয়---- তার কাছে সমর্পণ। তার কাছে গিয়ে সাত্ত্বিক রঙে চুবিয়ে নিতে হবে মনকে ,যেখানে রজ:গুণের সিকি ভাগকেও প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। সৎ অসতের নির্লিপ্ত পরপারে তার অবস্থান ।তাকে নিয়ে বিচার --সে তো ফুতকারে উড়ে যাওয়া ।তার মাধ্যমেই আমরা জ্ঞানের আলো জ্বালবো। বিষয় থেকে মতান্তরে অবিষয়ে প্রবেশ করব।
প্রাণ মন খুলে গাইবো
"ভবেরে ____সেই যে পরমানন্দ, যে জন জানে পরমানন্দ ময়ী রে...."
পিতার স্বগোতোক্তি ---
পুত্র যখন পিতার হাত ধরে সেটা আলগা হতে পারে কিন্তু পিতা যে পুত্রের হাত ধরবে সে হাত কখনো আলগা হবে না।
এই পিতাই তো
"পিতরি প্রীতি- মা পণ্ণে
প্রীয় -ন্তে সর্বদেবতা"_____
এ তো সেই উপনিষদের দর্শন অনুভূতি ,সত্য ,পথ ,লয় -বিলয়।
"প্রনবো ধনু:শরো
হাত্যা ব্রম্ভ অলক্ষ্য মুচ্যতে
অপ্রমত্তেন বেদ্ধ বং
শরোবত্তর্ন্ময়ও ভবেত্"_____
অর্থাৎ ব্রহ্মই হলো পরম পিতা। ওম্কার ই ধনু, জীবাত্মা ই বাণ এবং ব্রম্ভ উক্ত বাণের লক্ষ্য ।অপ্রমত্ত হয়ে সেই লক্ষ্যকে ভেদ করতে হবে, লক্ষ্যভেদের পর শবের মতোই তন্ময় হয়ে অর্থাৎ ব্রহ্মের সাথে একাত্মীভূত হতে হবে ।ব্রহ্মের অনুভূতি , ব্রহ্মের স্থিতি হলে কি হবে -----জ্ঞানী ঋষিদের কথায়, দুটো শিং বেরোবে কি? না দুটো চোখ বেরোবে---
নতুন দৃষ্টির সঞ্চার হবে। সেই সঞ্চারিত আলোয় স্নাত পিতার দৃষ্টিতে থাকবে____ সন্তানের জন্য, জগতের জন্য, প্রেমের চোখ ;যে নতুন হৃদয়ের সঞ্চারনা হবে, তা হবে প্রেম পূর্ণ। গঠিত হবে এক আনন্দের শরীর। 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি' যে অনন্ত আকাশে আমাকে ছো মেরে নিয়ে যাবে উদার মুক্তির পথে ।আমরা যে হৃদয়ঙ্গম করতে পারব----
আনন্দই ব্রহ্ম ,আর ব্রহ্মই যে কিনা পরম পিতা ।বিশাল আঁধার। যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত ।যেন----
"আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিন- রজনী কত অমৃতরস
উথলি যায় অনন্ত গগনে...."
কিন্তু আজ যে আবার happy mothers day, Happy fathers day,.... এর যুগ। তাই বলে কি আমরা শুধু একদিনই পিতাকে অভিভাবক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করব? না তা কখনোই নয়.. পিতা আমাদের সাধারণ চোখে জন্মদাতা হলেও
যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছেন ____
"মাতা গুরুতর ভূমে:
খত্ পিতোত্তরা স্তথা"
অর্থাৎ,
মা পৃথিবীর থেকে ভারী কিন্তু পিতা আকাশ থেকেও উচ্চতর।
No comments:
Post a Comment