স্মৃতিকথা
শ্রদ্ধায় স্মরণে আমার বাবা...
রীতা দত্ত ভদ্র
বাবা মানেই তো মাথার ওপর বটগাছের সেই শান্ত ছায়া, নিশ্চিন্ত আশ্রয়। সেই ছায়াটা যখন মাথার ওপর থেকে সরে যায় তখনই জীবনের চড়া রোদের আঁচটা বুঝি অনুভব করা যায়। এ কোনো আপ্ত বাক্য নয়, এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। বাবার স্মৃতি বলতেই মনে পড়ে, সেই প্রজাপতি ওড়া রঙিন দিন, সেই মায়াময় উঠোন, বারান্দা আর রাশি রাশি হাসি খুশি।
বাবার কথা বলতে গেলে তার শুরু কোথা থেকে করবো জানি না,, তবে স্মৃতির জালে অষ্টেপৃষ্ঠে আমায় জড়িয়ে আছেন, আমার সেই দীর্ঘদেহী আপন ভোলা সহজ সরল বাবাটি। জীবনকে যিনি অযথা জটিল করে নেন নি কখনও বরং নিজের স্বভাব সুলভ সরলতায় কঠিন সমস্যাকেও সহজতর করে নেবার চেষ্টা করেছেন সবসময়। সংসারের দায়ভার পালনের জন্য সৎ ভাবে অর্থ উপার্জন আর পরিবারের মানুষগুলোকে মায়ার বাঁধনে বেধে রাখাটাই ছিল বুঝি আমার বাবার একমাত্র কর্তব্যকর্ম।
সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব মায়ের কাঁধেই ছিল আর আমরা ভাই বোনেরা আমাদের মায়ের তত্ত্বাবধানে বেশ কড়া শাসনেই বড়ো হয়েছি।
তাই বলা যায় বাবা ছিলেন আমাদের যেন কিছুটা মরুদ্যান স্বরূপ। কোনো কারণে মায়ের মেজাজ যখন বেশ উত্তপ্ত এবং আমরাও তটস্থ আসন্ন ঝড়ের অপেক্ষায়, তখন একমাত্র ভরসা বাবা, তিনি যদি সেই মুহূর্তে বাড়িতে চলে আসেন,এই ভেবে।
সংসারের দায়ভার পালনের জন্য সৎ ভাবে অর্থ উপার্জন আর পরিবারের মানুষগুলোকে মায়ার বাঁধনে বেধে রাখাটাই ছিল বুঝি আমার বাবার একমাত্র কর্তব্যকর্ম। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব মায়ের কাঁধেই ছিল আর আমরা ভাই বোনেরা
মায়ের তত্ত্বাবধানে বেশ কড়া শাসনেই বড়ো হয়েছি। তাই বলা যায় বাবা ছিলেন আমাদের যেন কিছুটা মরুদ্যান স্বরূপ।
বাবা ফিরে আসলেই আমরা ঝড়ের দাপট থেকে তখনকার মতো রেহাই পাবো। কেননা ছেলেমেয়েদের বকাবকি করার ব্যাপারটা বাবার একেবারেই তার পছন্দ ছিল না। আর তিনি ভাবতেই পারতেন না তাঁর ছেলেমেয়েরা এমন কিছু অন্যায় করছে বা করতে পারে যাতে তাদের এতটা শাসন করবার প্রয়োজন হবে। সংসারের বড়ো সিদ্ধান্তগুলো মা কখনোই একা নিতেন না। বাবার মতামতটাই প্রাধান্য পেত। আসলে মা খুবই হিসেবী, সংসারী, বুদ্ধিমতী এবং গুনী মহিলা ছিলেন। নিজের সবটুকু দিয়ে তিনি সংসারকে আগলে রাখতেন। তাঁর সুনিপুন গৃহিনীপনাতেই বোধকরি আমাদের পরিবারে শান্তির কোনো অভাব ছিল না। তাই অসময়ে হঠাৎ করে মায়ের চলে যাওয়াতে আমরা সবাই যেন অনাথ হয়ে পড়েছিলাম।
আমরা খুব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। আর বাবা তো তখন একেবারেই দিশেহারা। আমরা ভাইবোনেরা যখন শুধুমাত্র বাবার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম তখন সেই সাংসারিক ব্যাপারে নিতান্তই অনভিজ্ঞ, মানুষটি যে কী ভীষণ অসহায় ছিলেন, তা আজ বুঝতে পারি। তবুও নিজের মতো করেই তিনি সংসারটাকে আগলে রাখতেন। তাঁর সুনিপুন গৃহিনীপনাতেই বোধকরি আমাদের পরিবারে শান্তির কোনো অভাব ছিল না। তাই অসময়ে হঠাৎ করে মায়ের চলে যাওয়াতে আমরা সবাই যেন অনাথ হয়ে পড়েছিলাম।
আমরা ভাইবোনেরা যখন শুধুমাত্র বাবার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম তখন সেই সাংসারিক ব্যাপারে নিতান্তই অনভিজ্ঞ, মানুষটি যে কী ভীষণ অসহায় ছিলেন, তা আজ বুঝতে পারি। তবুও নিজের মতো করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, ছেলেমেয়েদের যত্নের কোনো ত্রুটি তিনি করেন নি। তাই জীবনের অনেকটা পথই কেটেছে বাবার স্নেহ-ভালোবাসার সাহচর্যে। মায়ের আশীর্বাদ তো মাথার ওপর ছিলই। মায়ের শেখানো জীবন-পাঠ জীবনে চলার পথে আজও পাথেয় হয়ে রয়েছে।
আমি প্রথম সন্তান বলে বাবার আদর আহ্লাদ ছোেটাবেলায় একটু বেশিই পেয়েছি। আমার মনে আছে, আমি বাবার কোলে চড়তে খুব ভালোবাসতাম এবং অনেকটা বড়ো হয়ে যাবার পরেও (স্বাভাবিক কোলে চড়ার বয়স পেরিয়ে গিয়েও) বাবা আমায় কোলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তো এইরকমই কোনো এক শীতের সকালে বাবা আমায় বেশ করে চাদর দিয়ে ঢেকে নিয়ে কোলে করে সকাল বেলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় পাড়ার ডাক্তার জেঠুর সঙ্গে দেখা। উনি দেখেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠলেন, "কী হলো, জ্বর বুঝি?" আসলে তিনি ভেবেছিলেন এই বয়সের কেউ যখন কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ায় সে তখন নিশ্চয়ই সুস্থ নয়। অন্য সবাই এই নিয়ে বেশ হাসাহাসিও করেছিল বেশ মনে আছে। এরপরও বাবা আমায় কোলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।
প্রতিবছর নতুন ক্লাসে ওঠার পর book list মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের বই কিনে আনা তারপর খুব যত্নে তাতে মলাট দিয়ে আঠা লাগিয়ে সুন্দর করে নাম লিখে দেওয়া, পরীক্ষার সময় বেশ কয়েকটা কলমে কালি ভরে দিয়ে কোনটা কেমন লিখছে পরখ করে নেওয়া, স্কেল পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স ইত্যাদি সব প্রয়োজনীয় জিনিস আগে থেকে গুছিয়ে দেওয়া এসব তো অতি যত্নে খুব নিষ্ঠা ভরে করে গেছেন বাবা সবসময়। শুধু কী তাই? রাতে যখন পড়তাম, সারাদিন পরিশ্রমের পরেও পাশে বসে বাতাস করতেন হাত পাখা দিয়ে আর জিজ্ঞেস করতেন মশা কামড়াচ্ছে কিনা।বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার সময় ও এ নিয়ম বহাল ছিল।
কত সময় এই সব বিষয় নিয়ে কত রাগ হয়েছে, বিশেষ করে পরীক্ষার পর বেশ আশ মিটিয়ে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাবো সেটা যখন হতো না তখন রাগ হতো বৈকি! কিন্তু এ নিয়ে বাবার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উনি ওনার সময় মতো ডাকতেই থাকতেন।" ও বুড়ি ওঠ! বেলা হলো কত। উঠে পড় এবার"! আজ শুধু দীর্ঘশ্বাস, হায়! একবার ও কী আর কোনো দিনই সেই আজন্ম পরিচিত ডাকটা শুনতে পাবো না!
২০০৬ সালে চলে গেছেন আমাদের বাবা! কতদিন হয়ে গেলো সময়ের হিসেবে কিন্তু বাস্তবটাকে কিছুতেই ঠিকঠাক মেনে নিতে পারি না এখন ও। আজ ও মনে হয় ও বাড়িতে গেলে নিশ্চয়ই রাস্তা থেকেই বরাবরের মতো দেখতে পাবো বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন খবরের কাগজ কিংবা কোনো বই হাতে, আমাকে দেখতে পেয়েই ব্যস্তসমস্ত হয়ে একগাল অনাবিল হাসিতে মুখ ভরিয়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিচ্ছেন তিনিই.... আমার বাবা। বাবা ই আমার খোলা আকাশ, আমার শৈশবের গোলাপি বাগান আমার শ্রদ্ধা, আমার ভালোবাসা ।
No comments:
Post a Comment