Sunday, June 2, 2024


 

হয়ত গল্প নয় 

পরশ
অনিতা নাগ 

বড় আনমনা আজ মন। একেকদিন এমন হয়। যতো বয়স বাড়ছে শ্যামলী কেমন পিছিয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেরই অবাক লাগে। ক্লান্ত অলস দুপুরে আজকাল টুপ করে হারিয়ে যায় নিজের ছোটবেলায়। এই এক রোগে ধরেছে তাকে। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। তবে বেশ লাগে ছোটবেলার দিনগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে। আজকাল আর কাকে বলবে যে তাদেরও একটা ছোটবেলা ছিলো! এক্কা দোক্কা, চু কিতকিত, কতো রকম খেলা ছিলো।  মা কাকীমার শাড়ী দিয়ে প্যান্ডেল করে রবীন্দ্রজয়ন্তী ছিলো। বাবার আদর ছিলো, শাসন ছিলো, সোহাগ ছিলো। এখন সব অন্যরকম।

আনমনা মন দূরে কোথায় ঘুরে বেড়ায়।  কানে আসে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ক্রিং ঘন্টি।

সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেই শ্যামলী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতো। এক হাতে সাইকেল অন্য হাতে বাজারের থলেটা সামলে বাবা আসতেন। দোহারা গড়ন, মাজা গায়ের রঙ। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট। জুতোটা  কেমন ছিলো ঠিক ঠাওর করতে পারে না শ্যামলী। বয়স যে বাড়ছে বেশ টের পায়। প্রায়ই ভুল হয় আজকাল নানান ব্যাপারে। আজকাল সব একটু গুলিয়ে যায়। ঠাকুমার আওয়াজে মা ব্যাস্ত হতেন। খোকা বাজার এনেছে বৌমা। বাজার নামিয়ে, সাইকেল রেখে উঠোনের কলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে যেতেন বাবা। নিজের জামাকাপড় পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখে শুরু হতো বাড়ীর সকলের খোঁজ খবর নেওয়া। সকলের খবর নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চায়ের কাপ আর কাগজ নিয়ে বসতেন। শিপ্টিং ডিউটি ছিলো। শ্যামলীর তখন সকালে স্কুল। রাতের ডিউটি থাকলে বাবার সাথে দেখা হতো স্কুল থেকে ফেরার পর। বেশ মনে পড়ে স্কুল যাবার আগে হরলিক্স এর জন্য কেটলীতে জল বসিয়ে দিতেন বাবা। ড্রেস কেচে ইস্ত্রি করে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতেন।  রোজকার বাসের ভাড়া ২০ পয়সা আর কোনো কোনো দিন টিফিনের জন্য ১৫ পয়সা দিতেন। ১০ পয়সার একটা ক্রিমরোল আর পাঁচ পয়সার একটা গোপাল ভোগ। সে’দিনটা খুব স্পেশাল হয়ে যেতো।  একটা দিনের কথা আজও মনে আছে।  সালটা ১৯৭১। শ্যামলীর তখন ক্লাস ফোর।নকশাল আন্দোলন চলছে। প্রায়ই গন্ডগোল লেগে থাকতো। একদিন স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার সময় কোনো গন্ডগোলে সব গাড়ী চলাচল  বন্ধ হয়ে যায়। অসহায় অবস্থা।  তখন না ছিলো ফোনে যোগাযোগের সুবিধা,  না কিছু।  সবাই হাঁটছে। বাড়ী ফিরতে হবে। সকলকে জিজ্ঞেস করতে করতে শ্যামলীও পা মেলালো সেই দলে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ প্রহরা। কি করে যে বাড়ী ফিরেছিলো ভাবলে এখনো অবাক লাগে। ফিরে শোনে বাবা সাইকেল নিয়ে মেয়েকে খুঁজতে বেড়িয়েছেন। ফিরে এসেছে সে খবর বাবাকে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। অনেক পরে ক্লান্ত, শ্রান্ত বাবা ফিরলেন। রাস্তায় পুলিশের কাছে  হেনস্থার শিকার হয়েছেন। তার থেকেও বড় যন্ত্রণা মেয়েকে খুঁজে পাননি৷ বাড়ী ফিরে মেয়েকে দেখে বাবা  কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। শ্যামলীকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সে’ কথা মনে হলে আজও চোখ ভারী হয়ে আসে শ্যামলীর। বাবাকে বসতে দেখেছে খুব কম। সারাদিন কতো যে কাজ করতেন। সব কাজ ছিলো বড্ড পরিপাটি। সংসারের যাবতীয় খুঁটিনাটিতে যেমন নজর ছিলো তেমনি নজর ছিলো শ্যামলীদের তিন ভাইবোনের পড়াশোনার ব্যাপারে। স্কুলের খাতায় মলাট দেওয়া থেকে হোমওয়ার্ক করানো, সবটাই তার দায়িত্ব ছিলো। তার সাথে অফিস, পরিবার, পাড়া, আত্মীয় সবটা সামলাতেন। একটাই সখ। বই পড়া। দুটো লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন। খুঁটিয়ে কাগজ পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ বড় প্রিয় ছিলো। বাবার কন্ঠে ‘কর্ণ কুন্তি সংবাদ’ ‘দেবতার গ্রাস’ শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। চোখ বন্ধ করলে আজো কানে বাজে  ‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেলো ক্রমে, মৈত্র মহাশয় যাবে সাগর সঙ্গমে তীর্থ স্নান লাগি’।  কর্ণ কুন্ত সংবাদ আবৃত্তি করতে করতে বাবার গলা বুজে আসতো কান্নায়। আজো সেই অনুভব ছুঁয়ে থাকে শ্যামলীকে। শ্যামলীর এখন ৬২। বাবা চলে গেছেন দীর্ঘ ১৭ বছর। তবু সবটা ছবির মতো দেখতে পায় শ্যামলী।

ছাদের সিঁড়িতে বসে নিজের মনে গান করতেন বাবা। মা কতো সময়ে  রাগ করতেন।  কথা ভুল করলে যে! আহা, সুর ভুল হলো যে! বাবা বলতেন ওই বেশ হলো। কখনো নিজেকে জাহির করতেন না। কঠোর পরিশ্রম আর সততা এই মূলধণ নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিলেন জীবনটা। প্রিয় নায়ক উত্তম কুমার। প্রিয় লেখকের তালিকা দীর্ঘ।  হেমন্ত মুখার্জীর সব গান মুখস্ত। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের মধ্যে প্রিয় ছিলো শ্যামা।   গাছের নেশা ছিলো। কতে রকমের ফুল ছিলো ছাদবাগান জুড়ে। চুপিসারে এই ভালোলাগা গুলো শ্যামলীকে  জড়িয়ে রেখেছে সেই ছোট্টবেলা থেকে। 

বছরে, দু’বছরে একবার বাইরে যাওয়া হতো। তখন তল্পিতল্পা, লটবহর নিয়ে হাওয়া বদলে যাওয়া। এখনকার মতো ছিমছাম সখের বেড়ানো নয়। সতরঞ্চিতে বেডিং গোছাতেন বাবা। সাথে রাজ্যের বাসনকোসন।  প্রায় পুরো সংসারটাই সাথে যেতো। ভারী মজা হতো কিন্তু। বেড়ানোর কথা মনে হলেই বাবার কথা আজও বড্ড মনে হয় শ্যামলীর। এখন কতো আরামে ঘুরতে যাওয়া। হরিদ্বার যাওয়ার কথা মনে পড়ে। কোনো স্টেশন এলেই বাবার নামা চাই।  মা রাগ করতেন।   বাবা খাবার আনা, জল আনার ছুতোয় নেমে স্টেশনে ঘুরে আসতেন। বড্ড মনে পড়ে সে'সব কথা শ্যামলীর।  মনে আছে কেদারনাথে হেঁটে উঠেছিলেন। মা আর হাঁটতে পারছিলেন না।  তবু সাহস দিয়ে সাথে নিয়ে হেঁটেছিলেন। ঘোড়ায় গেলে মা’র পুণ্যি যদি কম হয়ে যায়!  কি সহজ বিশ্বাস!  নিঝুম দুপুরে কান পেতে থাকে শ্যামলী। কানে ভাসে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘন্টির আওয়াজ। মনে হয় ছুট্টে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। চমক ভাঙে মুঠোফোনের  আওয়াজে। স্মৃতির সরণি থেকে ফিরে আসে বাস্তবের আঙিনায়। ম্যাডাম ওটিপি টা বলুন। এখন এক ক্লীকেই জিনিষ বাড়ীতে এসে যায়। থলে ভরে বাজার করার দিন আর নেই বললেই চলে। কাজ সেরে শ্যামলী ফেরে নিজের দুনিয়ায়। এসিটা কমিয়ে দেয়। আজ বড্ড গরম। গরমের দুপুরে বাবা খালি গায়ে তাকিয়াটা মাথায় দিয়ে মেঝেতে শুতেন। একটা হাতপাখা থাকতো সাথে। তখন মুঠোফোন ছিলো না। সোশ্যাল মিডিয়া ছিলো না। কিন্তু ছিলো অনেক কিছু। একসাথে গল্প ছিলো,  ছুটির দিনে বাবা মা’র  সাথে আত্মীয়দের বাড়ী যাওয়া ছিলো। আস্তে আস্তে দিন গড়ালো। ছোট মেয়েটি ক্রমশঃ বড় হলো। তখন তার আলাদা জগত। বাবার শাসনে বিরক্ত হতো শ্যামলী। শ্যামলী তখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।  প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক জানতে পেরে বাড়ী থেকে বেরোনো বন্ধ হয়েছিলো শ্যামলীর। শ্যামলীর তখন রাজ্যের রাগ ওই লোকটার উপর। তখন মোটে সহ্য করতে পারতো না বাবাকে। আবার এই লোকটাই পরিস্থিতির সাথে আপোষ করে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিদায় আশির্বাদের সময় বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। শ্যামলীও তখন হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। জীবনটা যদি ফ্ল্যাশ ব্যাকে খানিকটা পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতো তো বেশ হতো। সবটা আবার সাজিয়ে নেওয়া যেতো মনে মতো করে। বিয়ের পর থেকে যোগাযোগ ঐ চিঠিতে। তখন দূরভাষ ছিলো না।  তখন বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্তর গ্রামে থাকা কর্তার চাকরীর সুবাদে। বছরে একবার কি দু'বার দেখা হতো। দূরত্ব যেনো মানুষটাকে আরো কাছে এনে দিয়েছিলো। জন্মদিনে আর বিয়ের তারিখে তাদের মঙ্গলকামনায় পূজো দিয়ে আশির্বাদী ফুল পাঠাতেন। আমৃত্যু তাতে ছেদ পড়েনি। চলে যাবার আগে যেবার শেষ দেখা হলো, ফেরার সময় এগিয়ে দিতে এসে মাথায় হাত দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।  শ্যামলী সেই আশির্বাদ আগলে রেখেছে পরম সংগোপনে। হয়ত ডাক আসছে টের পেয়েছিলেন!  ঠিক এক মাস পর  চলে গেলেন চির ঘুমের দেশে।   শ্যামলী পারলো না ধরে রাখতে। যে মানুষটা তার জীবন জুড়ে রয়েছে, আগুনের লেলিহান শিখায় তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখলো।  আর কোনোদিন ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। আর কেউ এমন করে আগলে রাখবে না।দাদারা গঙ্গায় অস্তি ভাসিয়ে দিলো। প্রবহমান পুণ্য সলিলে মিশে গেলেন বাবা। যে বাবা বিশ্বাস করতেন গঙ্গার জলের স্পর্শ শুদ্ধ করে দেয় সব কালিমা। সেই পুণ্যসলিলা গঙ্গায় মিশে গেলেন বাবা। আর কোনোদিন তাকে দেখতে পাবে না। হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে শ্যামলী। দূর থেকে বাবার গলা ভেসে আসছে  ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নেই তার ক্ষয় নেই’।  অন্তর থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি তখন মনে মনে গেয়ে চলেছে তার বাবার প্রিয় গান ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে ……’।

কেটে গেছে দীর্ঘ ১৭টা বছর। দীর্ঘ সময়। আজো সেই মানুষটা আলো হয়ে আগলে রয়েছেন শ্যামলীকে। সেই আলো দেখা যায় না, তার পরশটুকু ছুঁয়ে থাকে৷  নতুন কোথাও বেড়াতে গেলে তাকে মনে পড়ে। ভালো বই পড়তে পড়তে তাকে মনে পড়ে। ভালো রান্না হলে তাকে মনে পড়ে। জন্মদিনে মনে পড়ে। সুখে মনে পড়ে, দুখে মনে পড়ে। নিঃসঙ্গ মুহুর্তে তাকে মনে পড়ে।  স্মৃতিরা ভীড় করে আসে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে কান্না। শ্যামলীর  চমক ভাঙে কর্তার ডাকে। বিকেল গড়িয়ে গেলো যে! চা করবে না! আনমনা মনকে চোরকুঠুরিতে লুকিয়ে রাখে শ্যামলী।  মনে মনে বলে ভালো থেকো বাবা। দূর থেকে বাবা হাত নাড়েন। 

ক্রমশ  দূরে মিলিয়ে যায় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ক্রিং ঘন্টার শব্দ। পরশটুকু আগলে রাখে শ্যামলী পরম সংগোপনে, আদরে আর যত্নে।

No comments:

Post a Comment