১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। সেই সময় আমার বাবার কর্মস্থল কলাইকুন্ডা তে ছিলাম। বাবা ভারতীয় বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। যুদ্ধের সাইরেন, যুদ্ধবিমানের ওঠানামা, কামান, ট্যাংক মাটিতে গর্ত খোঁড়া, বালির বস্তা, সবকিছুর পর যুদ্ধ শেষে, বাবা স্থির করলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছেলেমেয়েকে আর চাকরিস্থলে রাখবেন না। আমাদের নবদ্বীপ শহরে এনে ভর্তি করালেন নবদ্দীপ হিন্দু স্কুলে। ১৯৬৬ সালে আমি ভর্তি হলাম প্রথম শ্রেণীতে আর আমার দাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আমরা তখন ভালো বাংলা জানতাম না। হিন্দি শুনে অভ্যস্ত ছিলাম। তাই ভর্তির পূর্বেই একজন শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। যিনি আমার মায়েরও শিক্ষক ছিলেন। সবাই তাকে বুড়ো মাস্টারমশাই বলতো। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। একটা ছোট বেড়ার ঘরে থাকতেন সপরিবারে। আমি চটের উপর বসে ওনার কাছে আদর্শ লিপি, নামতা, যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ শিখেছিলাম। উনি পাঠ্য-পুস্তকের অনেকটা শেষ করিয়ে মা-বাবাকে বলেছিলেন প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে- আমাকে যেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি নেওয়া হয়। বাড়িতে এই আলোচনা আমার কানে এলো। কিন্তু আমার দাদা বেঁকে বসলো। সে ছোট বোনের সঙ্গে একসাথে কিছুতেই পড়বে না। আমি প্রথম শ্রেণীতে থেকে গেলাম। এই বিদ্যালয়টি শহরের সবচেয়ে পুরনো বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয় সবাই খুব ভালবাসতেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠলাম। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষক আমাকে স্টেজে তুলে দিলেন। আমার প্রথম স্টেজে ওঠা। আমার পা কাঁপছিল। এই বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কথা আমার এখনো মনে আছে, তিনি সিন্ধু বাবু। পুরো নাম আমরা জানতাম না। কাউকে কোনদিন বকতেন না। একবার আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন মরুভূমিতে জল নেই, গাছ নেই, এত কষ্ট তবু সেখানে মানুষ থাকে কেন? মাস্টার মশাই উত্তরে বলেছিলেন- যেহেতু সেটা তাদের জন্মভূমি বা মাতৃভূমি। কথাটা এখনো মনে পড়ে।তৃতীয় শ্রেণীতে একজন নতুন ছাত্র ভর্তি হল। শিক্ষকরা ছেলেটির উপর ভীষণ গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। তৃতীয় শ্রেণীতে আমি প্রথম হতে পারলাম না। বিদ্যালয়ের উপর এত অভিমান হল যে আমি চতুর্থ শ্রেণীতে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। নতুন বিদ্যালয় আমার পরীক্ষা নিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক সুনীল মাস্টার মশাই। অংক, বাংলা, ইংরেজি থেকে প্রশ্ন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়টির অনেক অবদান আছে আমার জীবনে। সারা বছরে তিনবার পরীক্ষা হতো। এখানে প্রার্থনা সভা থেকে শিখেছিলাম গীতার শ্লোক-
Tuesday, July 2, 2024
আমার বিদ্যালয়
মাধবী তালুকদার
यदा यदा हि धर्मस्य ग्लानिर्भवति भारत ।
अभ्युत्थानमधर्मस्य तदात्मानं सृजाम्यहम् ॥
परित्राणाय साधूनां विनाशाय च दुष्कृताम् ।
धर्मसंस्थापनार्थाय सम्भवामि युगे युगे ॥
ভবসাগর তারণ কারণ হে ...।
গানটি গাওয়া হত। আর সবশেষে জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে...।
এ বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমার প্রথম আবৃত্তি করা। মাস্টারমশাইরা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে সব বিষয়ের ক্লাসের সাথে শনিবার দিন একটা বিশেষ ক্লাস হোতো। সেখানে প্রথম আমি তরু মাস্টারমশাইয়ের মুখে মহাভারতের- ভীমকে বিষের নাড়ু খাওয়ানোর গল্প শুনি। উনি এত সুন্দর করে গল্প শোনাতেন যে আমার মনে হতো আমি স্বয়ং গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। এইভাবে রামায়ণ, মহাভারত দুটি মহাকাব্য জেনেছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম ধর্ম শাস্ত্র পরীক্ষা হবে। আমি প্রথমবার মৌখিক আদ্যপরীক্ষা দিতে গেলাম। কলকাতা থেকে একজন স্বামীজি এসেছেন পরীক্ষা নিতে। পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিছুদিন পর জানলাম আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে পুরস্কার নিতে কলকাতায় যেতে হবে। এক শীতের ভোরে দুজন শিক্ষক আমাদের নিয়ে কলকাতায় বালিগঞ্জে এলেন। বিশাল স্টেজ। আমরা প্রাইজ নিয়ে আবার রাতে ট্রেনে বাড়ি ফিরে এলাম। এ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এক অভিজ্ঞতা। এইভাবে পাঁচবার আমি ধর্মশাস্ত্র পরীক্ষায় কৃতী ছাত্রী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি। বহু মূল্যবান পুস্তক এখনো আমার কাছে আছে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুনীল ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে একদিন বললেন- 'তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করলে তোমার রেজাল্ট ভালো হবে, তোমার বিদ্যালয়ের গর্ব হবে, তোমার বাবা-মার গর্ব হবে।' কথাটি মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজো আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের এই কথাই বলি। এই পরীক্ষার সুবাদে আমি পূর্ণাত্মানন্দজী মহারাজের দেখা পাই। উনি আমার ডায়েরীতে লিখে দিয়েছিলেন-
বরদা যদি মে দেবী
দিব্য জ্ঞানম্ প্রদোচ্ছ মে।
আরো একটি লিখে দিয়েছিলেন। সংস্কৃত শ্লোকটি মনে নেই তবে অর্থটা এখনো মনে আছে। যাহা আমাকে অমৃত দানে অসমর্থ তাহালইয়া আমি কি করিব। এই বিদ্যালয়ে আমি প্রত্যেক পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছিলাম। আর প্রথম হওয়ার জন্য জ্ঞান, শক্তি, সাহস, সবই আমার শিক্ষকদের অবদান। প্রিয় বিদ্যালয়, প্রিয় শিক্ষকদের আমার অন্তরের অনেক শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণাম জানাই।
No comments:
Post a Comment