স্মৃতির বিদ্যালয়
জয়তী ব্যানার্জী
"মুছে যাওয়া দিনগুলি
আমায় যে পিছু ডাকে "_____
জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়, সেই লাল সাদা, কত কত লাল সেনা চলেছে সমরে ।আজ আমরা পায়ে পায়ে চল্লিশ, পেরিয়ে ৪৫ এ।১৯৭৯; সেই কবেকার কথা ।তোমার কথা লিখতে বসে গভর্মেন্ট গার্লস____ সবকিছুই যে গুলিয়ে যায়। ১৯৭৯--- কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় বা এর শেষ, কোনই যে আদি অন্ত নেই। মাইলের পর মাইল পার হয়ে এসে আজ আমরা লক্ষ্য যোজন দূরে তোমার থেকে ।তবুও কি আমরা ভুলতে পেরেছি। গেট দিয়ে ঢুকেই ঢালাও পিচ রাস্তা, ডানদিকে বকুল গাছ, কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে সাইকেল স্ট্যান্ড আর অপূর্ব সুন্দর পদ্মপুকুর। তুমি আমার জীবনের অনেকটা। কি করে ভুলবো তোমাকে। জীবনের অনেকটা বললেও বোধহয় কম বলা হবে ।তুমি যে আত্মার আত্মীয়, তোমার কাছেই হাতে খড়ি, পথ চলার পাঠ শিক্ষা--- রবীন্দ্রনাথ- নজরুল- জীবনানন্দ। তোমার কাছেই শিখেছি হাসি-ঠাট্টা গান গল্পের জীবনে বড় হয়ে ওঠার চাবিকাঠি। তুমি শিখিয়েছ কত গান, কত নৃত্য নাট্য, বই পোকা হওয়া, শ্রুতি নাটক, পথচলা; সর্বোপরি মানুষ হওয়ার শিক্ষা। মনে পড়ে সেই টিফিন ঘরের বারান্দা, মনে পড়ে কিৎকিত্ খেলার কোর্ট ,আমলকি গাছের তলায় স্লিপ ,আরো কত কিছু।সেই ১৯৭৯ সাল --একরাশ খুদে খুদে লাল পিঁপড়ের দল বকুলতলা পেরিয়ে মায়ের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল তৎকালীন সময়ের জলপাইগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের গৌরব জলপাইগুড়ি গভমেন্ট গার্লস স্কুলে ।সেই শুরু তারপর আর থেমে থাকেনি বা পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রোদ্দুর রানীদের।
হ্যাঁ---- রোদ্দুর; ১৯৮৯ সালে আমরা মাধ্যমিক দিয়েছিলাম ৩০ জন। সেই ৩০ জনকে নিয়েই আমাদের 'রোদ্দুর পরিবার'। প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী আমরা ।বিশাল বিদ্যালয় ,বিশাল তার কলেবর; প্রথম দিকে কেমন যেন একটা ভয়- ভয়, গুরু গুরু ভাব, কিন্তু আস্তে আস্তে সব গেল কেটে ____আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা সরিয়ে নতুন সূর্যের আলো এসে পড়ল আমাদের গায়ে।
লাল ফিতে সাদা মোজা
স্কুল স্কুল ইউনিফর্ম
ন'টার সাইরেন আর সিলেবাসে মনোযোগ কম ---
পড়া ফেলে এক ছুট
ছুটে রাস্তার মোড়---
----- সাইকেলের ভিড়ে সব লাল পিঁপড়েরা এভাবেই যে মিশে যায়......
এভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে রঙ্গমঞ্চের কুশিলব রা। সে সময় সরকারি বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা ঘটক। অসম্ভব নজর কাড়া ব্যক্তিত্ব। প্রথম শ্রেণীতে 1979 সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রায় ৬০০ ছাত্রী তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তার থেকে সুযোগ পায় মোটে ৩০ জন। তখন অবশ্য এই বিপুল সংখ্যার অনুপাতটা বোঝার মত বয়স বা পরিস্থিতি কিছুই ছিল না। তবে এখন যখন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই বিষয়টা গল্পের আকারে প্রকাশ পায় তা যেন এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় আবার গর্বেরও বটে। কতখানি আধুনিক মনস্ক ছিলেন ওই দিদিমণি সেই সময় ছাত্রীদের পরীক্ষার সাথে সাথে বাবা-মায়েরও ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য পরে শুনেছি অনেক সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু একটা কথাই এখন মনে হয় উনি কতখানি তখনকার সমাজ ব্যবস্থা থেকে এগিয়েছিলেন এবং আমাদের জলপাইগুড়ির মতো একটা মফ:স্বল শহরে এই ব্যবস্থা কার্যকরী করেছিলেন।
সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে ছিলেন অর্চনা রায়, অর্চনা ভট্টাচার্য অর্চনা সরকার ----কি দারুন নাম! একটু বড় হয়ে বুঝতে পারতাম সবার নামই অর্চনা। যেন নিজেদেরকে অর্চিত করেছেন আমাদের মানুষ গড়ার কাজে। প্রথম শ্রেণীতে এই তিন দিদি আমাদের পড়াতেন। শুধু তো পড়া নয় সারা বছর ধরে চলছে ইন্দিরা দি ওরফে ইন্দিরা সেনগুপ্তর হাত ধরে কত সেনা চলেছে সমরে, একটু বড় হতেই পিংপং বল নিয়ে ইন্দিরা দির তত্ত্বাবধানে এক সম্মিলিত প্রয়াস---- "হাট্টিমাটিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম ,তাদের খাড়া দুটো শিং।"এভাবেই দিন ঘুরে মাস, মাস ঘুরে বছর , আর আমরাও সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বড় হতে থাকলাম.. একটু বড় হতেই মনে পড়ে খেলার দিদি চম্পা দির বাঁশি বাজিয়ে সকলকে মাঠে ডেকে নেওয়া। আর আমরাও কোন সময় দোতলার ক্লাস আবার কোন সময় বা তিন তলার ক্লাস থেকে কালো প্যান্ট আর সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি পড়ে লাইন করে নেমে আসতাম ,সে এক দেখার মত দৃশ্য ।তখন তো আর এখনকার মত সকলের হাতে মুঠোফোন ছিল না। কিন্তু আজ যখন একলা বসে দিনান্তে চলে স্মৃতি রোমন্থনের পালা ,তখন যেন চলচ্চিত্রের মতোই ছবিগুলো পরপর চলতে থাকে ,ক্যামেরাবন্দি হয় মানষ রিলে । কোনো SLR বা DSLR, Nokia, Sumsung এর মুঠোফোনে নয়। এই যে সত্যিই আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সবকিছু গুছিয়ে বলতে গেলে হয়তো বা কালি কলম সব ফুরিয়ে যাবে, তবুও গল্প বলা শেষ হবে না। শেষ হবে না স্মৃতি রোমন্থন এর পালা। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান___ প্রতিবছর বিদ্যালয়ের মাঠেই মার্চের শুরু কি ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু তার প্রস্তুতির পর্ব চলত ২৬ শে জানুয়ারির পর থেকেই। এখন তো আবার সব স্কুলের জিরো পিরিয়ড। সেখানে নাচ-গান শেখানো হয়, অন্য সময় হলে তাতে নাকি পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আমরা কিন্তু এসব জানতাম না। দিনের শেষে দুটি তিন পিরিয়ড ধরে চলতো রিহার্সাল । সেসব দিনের যেকোন ভাগ হয় না ।এখনো বোধহয় বিল্ডিংয়ে কান পাতলে ভেসে আসে সেই মিষ্টি মধুর গলা-----
"......বেলা বয়ে যায়
ছোট্ট মোদের পানসি তরী
সঙ্গে কে কে যাবি আয়। "
শুধু কি নাচ আর গান, সব সময় পড়াশোনাতেও কিন্তু সবার সেরা। এখনো বোধহয় গভর্মেন্ট গার্লস স্কুল আমাদের সেই সময়কার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। আমরা ১৯৮৯ তে ৩০ জন মাধ্যমিক দিয়েছিলাম ,তার মধ্যে ১৭ জন স্টার অর্থাৎ এখনের ভাষায় ৭৫% এর উপরে নাম্বার আর সকলেই ফার্স্ট ডিভিশন অর্থাৎ ৬০% এর ওপরে....এখন হয়তো কালের নিয়মে এটা খুবই নগণ্য কিন্তু সেই সময় এটা বলার মতোই বিষয় ছিল।
তারপর আবার প্রজাতন্ত্র দিবস---- জানুয়ারি মাসের ১০-১২ তারিখ থেকেই শুরু হয়ে যেত পুলিশ ভ্যানে করে প্যারেড গ্রাউন্ডে প্র্যাকটিসে যাওয়া। অন্যান্য স্কুল থেকেও সব আসতো ....দারুন মজা কিন্তু আমাদের রাগী দিদিমণিদের চোখ এড়িয়ে মাছি পালানোর জো থাকত না। এত কিছুর পাশে সাইন্স এক্সিবিশন, বইমেলা ,সেমিনার কিন্তু চলছে। প্রথম পুরস্কার তো আমাদের স্কুলের বাধা। স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমাদের খুদে বিজ্ঞানীদের দল তাদের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়ে মাঝে মাঝেই হানা দিত সেমিনার বা বিভিন্ন ধরনের কর্মশালাতে।
তোমাকে নিয়ে তো গল্পের শেষ নেই গভমেন্ট গার্লস। টিফিন ঘরের বারান্দাটা বড্ড টানে গো। আমরা ৩০ জন একসাথে বসেই টিফিন খাব ,টিফিন বক্স হয়তো সকলের নেই। কারো হাতে ঢাকনা, কারো হাতে বক্সের ভেতরের ছোট বক্স ,এরকম আরো সরঞ্জাম ।শুকনো টিফিন হলে শাড়ির আঁচল। কিন্তু টিফিন ঘরে দিদিমণিদের চোখ রাঙানীর মুখোমুখি তো হওয়া যাবে না ,এমনই ছিল বন্ধুত্ব এর বন্ধন।
খুব মনে পড়ে সেই দিনটার কথা ।এখন আর মনে নেই, কোন ক্লাস ।খুব সম্ভব ক্লাস নাইন---- আগের দিন ভূগোল ক্লাস না করে আমরা সবাই মিলে মাঠে খেলছিলাম, আর তাতে নেমে এলো খাঁড়া। পরের দিন স্কুলে ঢোকার সাথে সাথেই শমন। রাগী রাগী চোখে দিদিমণি এসে বললেন, "আজকে সাদা কাগজের মধ্যে ১০৮ বার লিখতে হবে আমরা আর কোনদিন ক্লাস ছেড়ে খেলতে যাব না "--আবার সেটা বড় দিদিমণিকে দিয়ে সই করাতে হবে। এখন এই প্রাপ্ত বয়সে যখন আমাদের পরের প্রজন্ম বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করে এসেছে, সেই সময় ব্যাপারটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। কিন্তু সেই সময় এটা ছিল একটা tough job . আমাদের সময় ক্লাস টেনের ইংরেজি বইতে সুধা চন্দ্রের একটা পাঠ্য ছিল। সেই সুবাদে আমাদের ইংরাজি দিদিমণি অনুভা দি আমাদের লাইন করে সিনেমা হলে এই সিনেমাটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সিনেমাটার নাম এখনো মনে আছে 'নাচে ময়ূরী '-----ওনার আত্মজীবনী নিয়ে তৈরি। সেই সময় তো এখনকার মত সিনেমা বা দূরদর্শন বা মোবাইল এত সরগড় ছিল না, তাই ওটাই ছিল আমাদের কাছে একটা উৎসব।
এগুলো তো সবই স্কুলের ঘেরা টোপের কাহিনী, এবার আসি সেই ১৯৭৯ সালে যাদের হাতে হাত রেখে আমাদের সেই ৩০ জনের পথচলা শুরু হয়েছিল। এত বছর পরেও তা কিন্তু অমলিন ।আজ আর আমরা বন্ধু নই, আমরা এখন একটা পরিবার ---'রোদ্দুর পরিবার'। যার ডালপালা সুদূর আমেরিকা থেকে ইউরোপ সর্বত্রই ছড়িয়েছে। আজ হয়তো অনেকের মনে হবে অন্তর্জালের যুগে এটা হয়তো কোন বড় বিষয় নয়, কিন্তু আমরা যে সময় বড় হয়েছি সেই সময় সেটা কিন্তু ভাবনারই বিষয় ছিল। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ ___আমরা তো জানি না ----কিভাবে তাকে ধরে রাখতে হয়, তাদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করে নিতে হয় , শুধু জানি মা বাবার সঙ্গে যেমন কোন ভদ্রতা নেই, কোন আনুষ্ঠানিকতা নেই, তাদের সাথে যোগাযোগ তৈরি করে নিতে হয় না; আমাদের বন্ধুত্ব ও তাই।
আমাদের সবচেয়ে বড় পাওনা হলো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ও জানে ,আমরা হলাম সেই--- যারা শিখেছিল----
"জীবন যদি জীবন্ত হয়
জয়কে তুই আপন কর ,
স্বর্গ যদি কোথাও থাকে
নামাও তাকে মাটির প'র"
আজ আমরা সকলেই স্বস্ব ক্ষেত্রে সু প্রতিষ্ঠিত ।তবুও যেন কিসের গন্ধে ,কিসের টানে, বারবার ফিরে ফিরে যাই সেই পদ্মপুকুর, বকুলতলা ,সাইকেল স্ট্যান্ডে ।আজও যখন নিজের কর্ম ক্ষেত্রে যাওয়ার সময় দেখি লাল সাদা ইউনিফর্ম পড়ে ছোট ছোট মেয়েরা যাচ্ছে, মনটা যেন ছুটে চলে যায় সেই স্কুলের মাঠে ।স্পষ্ট দেখতে পাই ইন্দিরা দির হাতে ড্রাম আর আমরা গাইছি:
" শতফুল বিকশিত হোক
যত আগাছা নির্মূল হোক,
মোরা যুবকেরা সকলেরই সূর্য ,
যেন আট'টা ন'টা
পৃথিবীতে আনবোই
নতুন এক বসন্ত"।।
No comments:
Post a Comment