Tuesday, July 2, 2024


 

স্কুলের সেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠার দিন গুলো

                    কবিতা বণিক

শৈশব, কৈশোর থেকে যৌবনে  পদার্পনের  এক সুমধুর স্মৃতি স্কুল জীবন। বাড়িতে বা  বাইরে স্কুল ড্রেসের ছেলেমেয়েদের দেখলে  এখনও নিজেদের সেই সোনালি চঞ্চল  মধুর স্মৃতি, সরণী বেয়ে চলে আসে।  কত না খেলার -ধরণ, খুনসুটি ইত্যাদি। কাগজের টুকরোয়  চোর, ডাকাত, পুলিশ ইত্যাদি লিখে চোর-পুলিশ খেলা, আবার ওই চোর, ডাকাত লেখা কাগজ বন্ধুদের জামার পেছনে  সেফ্টিপিন  দিয়ে আটকে  মজা দেখা। খাতার পেছনে কাটাকুটি খেলা , কুমির ডাঙা খেলা, তেঁতুল, পুতুল দিয়ে বন্ধুত্ব পাকা করা  ইত্যাদি অনেক স্মৃতি ভেসে আসে। গেম টিচারের শেখানো  খেলা আজও  বাচ্চাদের সাথে খেলতে , শেখাতে  ভালো লাগে। খো খো , কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, রুমাল চোর  ইত্যাদি।  টিচারদের বলতে শুনেছি — ছেলেমেয়েরা  কেমন চোখের সামনে বড় হয়ে যায় ! “ তখন এর মানে বুঝিনি । আজ বুঝি  কালিদাস রায়ের সেই  ছাত্রধারা কবিতার লাইন — কৈশোরের কিশলয় / কর্মে পরিনত হয় /  যৌবনের শ্যামল গৌরবে। 

                              আমার  শৈশবে  কোন এক শীতের সকালে  বাবার  হাত ধরে  শিলিগুড়ির  “ বাণীমন্দির রেলওয়ে হায়ার সেকেন্ডারি  স্কুলে” ভর্তি হয়ে এলাম। বাড়ির  খুব কাছেই  সোজা রাস্তার ওপর  স্কুল ।  রাস্তার  মাঝখানে  গোল হয়ে একটা চঞ্চল নদী বয়ে গেছে।  নাম তার পঞ্চানই।  কিছু উঁচু  ক্লাসের বন্ধুদের সাথে  আমার স্কুলে যাওয়া আসা ঠিক করে দিয়েছিলেন  আমার মা ।  স্কুলে  যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে   রাস্তার থেকে সামান্য দূরে উঁচু পাড় থেকে নদী দেখতাম।  এদিক থেকে নদীতে নামা সম্ভব নয়। নদীর বয়ে চলা দেখতে ভারি ভাল লাগত।  নদীও যেন আমাদের বন্ধু ছিল।  কিছুদূর গিয়ে নদীটাকে আর দেখা যেত না। এমনি একদিন নদীর সাথে খেলতে খেলতে  স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা স্কুলের ঘন্টা শুনে  ছুটতে ছুটতে স্কুলে পৌঁছলাম। এদিকে আমি রাস্তায় পড়ে গিয়ে  আমার হাঁটু দুটো ছড়ে গিয়েছিল।  ক্লাস বসে  গিয়েছে। আমি ক্লাসে সোজা ঢুকছি। দিদিমণি দাঁড়াতে বলে বললেন - ক্লাসে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয়।  বল, দিদিমণি আসব ?  আমি এস বললে তবেই আসবে কেমন? “  সেদিনেই টিফিন  সময়ে  আমাকে এক জায়গায় বসে থাকতে দেখে  দিদিমণি এসে আমাকে কোলে নিয়ে বললেন , “ ব্যথা করছে? টিফিন খেয়েছ ? “ আমি  ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। আমাকে টিচারস রুমে নিয়ে গিয়ে লাল ওষুধ দিয়ে ব্যণ্ডেজ বেঁধে দিলেন।

                           আমার জীবনের প্রথম পরীক্ষা সেদিন। বাইরে  বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের স্কুলের বাউণ্ডারী ওয়ালটা বেশ ছোট।  রাস্তাটা দেখা যায়।  জানালা দিয়ে দেখি আমার এক বন্ধু  তার ছাতা মাথায় নিয়ে  বলছে— আমার ছাতা আছে। বাড়ি যাবি? না হলে ভিজে যাবি কিন্তু ! “  শোনা মাত্র পরীক্ষার খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।  দিদিমণি স্নেহভরে বললেন — কোথায় যাচ্ছ? “ বললাম, বাড়ি। - কেন? বললাম - বৃষ্টি পড়ছে যে !  আমার তো ছাতা নেই তাই ওর ছাতায় যাব। “  দিদিমণি — পরীক্ষা দেবে না?  বললাম— লিখেছি তো!  দিদিমণি — কই? আমায় তো দাওনি !  দাও দেখি খাতাটা। “  খাতা দেখে  বললেন —আরও তো  কোশ্চেন সব বাকি আছে   সব লেখ  তবে তো বাড়ি যাবে!  আমি তোমার বাবাকে বলেছি তিনি  ছাতা নিয়ে আসবেন।  সব লেখা হয়ে গেলে খাতাটা আমাকে দিয়ে যাবে কেমন? বাড়ি নিয়ে যেও না।  আর শোন, ক্লাসে ঢোকার সময় যেমন পারমিশন নিতে হয় তেমনি ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় ও বলবে, দিদিমণি বাইরে যাব ?  যাও নিজের জায়গায় বোস। “  পরীক্ষার  মানেটা হয়তো একটু বুঝেছিলাম। 

                             বছর দুয়েক পর একদিন স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফিরছি ।  স্কুলের গেটের কাছেই  দুটো মেয়ে আমাকে খুব মেরে পালিয়ে গেল। আমি কাঁদছি। হঠাৎ আমার ক্লাস টিচার দিদিমণি  আমাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - কি হয়েছে? “ বন্ধুরা মেয়েদুটোর নাম বলে বলল ওরা মেরেছে।  কিন্তু কেন মারল তা বুঝলাম না। হয়তো দিদিমণি বুঝেছিলেন।  পরদিন ক্লাসে রোলকল শেষে  ওই দুজন মেয়েকে ব্রেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।  শুধু তাই নয় প্রত্যেক  ক্লাসের টিচারদেরকেও বলে দিয়েছিলেন যেন তারা ব্রেঞ্চ থেকে না নামে।  ছুটির পর তাদের টিচারস রুমে ডাকা হয়েছিল।  আমার সেদিন ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর থেকে  ওরা খুব শান্ত হয়েই থাকত। আমার সাথে  আর কোনদিনই ওরা কথা বলেনি। 

                              আমাদের  মেয়েদের  ক্লাস সিক্স থেকে সেলাই  শেখানো হতো। যারা একেবারেই পছন্দ করত না  তারা বেশির ভাগ ক্লাসে থাকত না। দিদিমণির চুলের মুঠি ধরে ট্যানার ভয়ে। আমি মন্দের ভালো, ভয়ে ভয়ে  কোনরকম করতাম।  অথচ আজ সেই দিদিমণির জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়।  সেদিন যা শিখতে পারিনি ভাল করে , আজ তাই পাকা বুদ্ধিতে অনেক কাজ করতে পারি। 

                             একটা মজার ঘটনা বলি। তখন আমি ক্লাস সেভেন।  আমাদের ক্লাসের বাউণ্ডারী ওয়ালের বাইরে  জানালা  বরাবর একটা ছোট্ট  মন্দির আছে।  আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলেন কমল স্যার। য়্যা বড় বড় চোখ আর হাতে লাঠি।  এমন কোন ছাত্রছাত্রী নেই  যে এনাকে  ভয় পায় না। হঠাৎ দেখি স্যার জানালা দিয়ে ওই মন্দিরটাকে দেখছেন।  আমরাও দেখলাম ক্লাস নাইনের  ছেলেরা মাথা নীচু করে হাতে তালি দিয়ে  “ হরেকৃষ্ণ”  মন্ত্রে  মন্দির প্রদক্ষিণ করছে। জানলাম এর পরের ক্লাসটা ওদের কমল স্যারের ইংরেজি ক্লাস।  পড়া তৈরি না হওয়ায় ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছে। 

                             রেলের স্কুল বলে ল্যাবরেটারি  খুব  আনন্দ করে ব্যবহার করতে পারতাম। স্যার , দিদিমণিরা  ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, জিওগ্রাফির সব আ্যপারেটাস ক্লাসে এনে দেখাতেন বোঝাতেন।  ক্লাস নাইন থেকে ল্যাবরেটারিতে গিয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতাম।  সেখানেও নানান ঘটনা। কোনটা   খুব মজাদার, কোনটা যন্ত্রণার এমনি অনেক অভিজ্ঞতার  দিন ছিল সেগুলো।  কারও হাতে এ্যাসিড পরে যাওয়া, প্যান্ট  পুড়ে যাওয়া   ইত্যাদি সব  নানান ঘটনা।

                           এবার আসি প্রথম বসন্তে। সরস্বতী পূজো। আমরা ক্লাস নাইন। আমাদের স্কুলের টিচার নিজেই প্রতিমা তৈরি করেছিলেন । শান্তিনিকেতনের ছাত্রী কিনা! স্যার আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন। যা এখনও আমি সেসব কাজ করে আনন্দ পাই।  মাটির গ্লাসকে খড়িমাটি দিয়ে রঙ করে  তাতে আলপনা,  চালন, কুলোয় আলপনা  নানান কাজে আমাদের গ্রুপ ভাগ করে দিয়েছিলেন। সেই  প্রথম আবীর দিয়ে আলপনা দেওয়া শেখা । পূজোর পরে খিচুড়ি, তরকারি, পায়েস, চাটনি, মিষ্টি খাওয়া হল।  তারপর স্যার আমাদের নিয়ে বসলেন অন্ত্যাক্ষরী খেলায়।  দর্শকাসনে ছিলেন অন্য টিচাররা ও সব স্টুডেন্টসরা ।  এছাড়াও লাইব্রেরিয়ান, ল্যাবরেটারিয়ান, দপ্তরীরা, সবাই উপস্হিত। সেদিন পেয়েছিলাম  অন্য এক বন্ধু মারফত প্রথম বসন্তের রঙীন এক পত্র। কিন্তু ফল হল উল্টো।  আমি ভয়ে লজ্জায় আবীর রাঙা হয়ে উঠেছিলাম।  সেদিন পত্রবাহক আমার সেই শত কুটি করা পত্র তার হাতে  ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল — অসম্ভব এ অসম্ভব। 


No comments:

Post a Comment