আমার বিদ্যালয় : ফিরে দেখা
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
১৯৯১ সাল। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার শহরের সবচেয়ে নামী সরকারি মেয়েদের স্কুল সুনীতি একাডেমীতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম আমি। নব্বই দশকের সেই সময়ে মেয়েদের জন্য এই উচ্চবিদ্যালয়টিতে সুযোগ পাওয়া ছিল দারুণ গর্বের ব্যাপার। আজকের লটারি পদ্ধতির বদলে দস্তুরমতো এন্ট্রান্স টেস্ট হত তখন এবং তা নিয়ে উন্মাদনাও ছিল সাংঘাতিক। আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী তারা প্রধানত নার্সারি স্কুল হিসেবে পড়াশোনা করতাম সারদা শিশুতীর্থে। সারদা শিশুতীর্থে চতুর্থ শ্রেণি অবধি পড়ার ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা দ্বিতীয় শ্রেণির পরেই তাঁদের মেয়েদের সুনীতি একাডেমীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসাতেন, নয়তো, পুনরায় পঞ্চম শ্রেণির প্রবেশিকা দিয়ে ওই স্কুলে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়া যেত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির প্রবেশিকার আসন সংখ্যা নেহাতই নগণ্য হওয়ায় তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির চাপ ছিল পাহারপ্রমাণ। দ্বিতীয় শ্রেণির শুরুতেই স্কুল ও বাড়ি দু’তরফেই সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি আরম্ভ হত আদাজল খেয়ে এবং একেবারে ফল বেড়োনোর পর তার সমাপ্তি। সৌভাগ্যক্রমে, সারদা শিশুতীর্থ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি সম্পূর্ণ করে তৃতীয় শ্রেণিতে একবারেই সুনীতি একাডেমীতে সুযোগ পেয়েছিলাম আমি এবং তারপর দশ দশটি বছর কেটে গেছিল যেন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই। প্রায় দুই যুগ পরে এখন ফিরে দেখলে ঠিক যেন একটা অলীক স্বপ্নের মতো মনে ওই সময়টাকে, কী এক আশ্চর্য জাদুবলে আমার আজকের আমিটার জমি কত অনায়াসে নিঃশব্দে তিল তিল করে তৈরি করে চলেছিল যে।
আমাদের স্কুলে প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি একজন ছাত্রীর সর্বাত্মক মানসিক এবং চারিত্রিক উন্নতির দিকেও সমান নজর রাখা হত। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলার বাঁধন যদিও ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তার প্রয়োগটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে সে বিষয়ক কোনও চাপই অনুভূত হত না। সমস্ত সময়টাই কাটত নিয়ম মেনে, অথচ আনন্দ করে। ফলে নিয়মিত স্কুলে যেতে ভাল লাগত, পড়াশোনাটা হত স্বচ্ছন্দে। সহপাঠীরা সবাই ছিল বন্ধু, পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অস্বাস্থ্যকর কোনও প্রতিযোগিতা ছিল না, তাই বিদ্যালয়ের একটি মুহুর্তও বোঝা বলে মনে হত না। আমাদের সময়ে শ্রেণির পরীক্ষা হত বছরে দু’বার, ষাণ্মাষিক এবং বার্ষিক। তবে নীচু ক্লাসে কখনও কখনও ষাণ্মাষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্লাস টেস্ট নিয়ে তার নম্বর যোগ করেও ফল বেড়িয়েছে। তাছাড়া ক্লাসেও নিয়মিত পড়া করে আসতেই হত। ফলে পড়াশোনার অভ্যাসটা শুরু থেকেই হয়ে পড়েছিল নিয়মিত। স্কুলেই এত ভাল পড়ানো হত যে বাইরে আর কোথাও পড়ার দরকার পড়ত না। আমি নিজেই অষ্টম শ্রেণির আগে বাইরে কারুর কাছে পড়িনি, তাও শুধু অঙ্ক বিষয়টাই পড়েছি। আমাদের স্কুলে হাউস সিস্টেম ছিল, মানে স্কুলের সব ছাত্রীকেই ছটির মধ্যে যেকোনও একটি হাউস বা গ্রুপের সদস্য হতে হত। এটা তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরুর দিন শ্রেণি শিক্ষিকাই জানিয়ে দিতেন। রাসমণি, গার্গী, নিবেদিতা, লক্ষীবাই, দুর্গাবতী ও মীরাবাই এই ছয়জন মহিয়সী ভারতীয় নারীর নামে হাউসগুলি নামাঙ্কিত ছিল এবং মাথার চুলে বাঁধার ফিতের রঙ দিয়ে এই হাউস চেনা যেত। আমার হাউস ছিল রাসমণি এবং এই হাউসের ফিতের রঙ ছিল সাদা। তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরুর দিন আমাদের ক্লাস টিচার নমিতা দিদিমণি সকলের হাউস ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমি এই রাসমণি হাউসেরই সদস্য ছিলাম।
সুনীতি একাডেমী ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোচবিহার শহরের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর সহধর্মিণী মহারানি সুনীতিদেবী ছিলেন এই বিদ্যালয়ের মূল চালিকাশক্তি, প্রেরণা ও হৃৎপিণ্ড। বিদ্যালয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর সক্রিয় প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ ও যোগদান ছিল নিরন্তর। কোচবিহার রাজপরিবার চরিত্রগত দিক দিয়ে অত্যন্ত আধুনিক, যেকোনরকম সামাজিক গোঁড়ামিবর্জিত এবং খোলামেলা উদারমনোভাবাপন্ন ছিল এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া হিন্দুসমাজের শাসন ছিঁড়ে বেড়িয়ে এসে গড়ে তোলা ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতিদেবীর বিবাহসূত্রে এই পরিবারে সংযুক্তি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র প্রথাগত ডিগ্রিসর্বস্ব একমুখী পড়াশোনা নয়, সার্বিকভাবে ছাত্রীদের চারিত্রিক ও মানসিক গুণগত মানের উন্নতিও প্রথম থেকেই ভীষণভাবে কাম্য ছিল। আমাদের সময়েও বিষয়গত ও ব্যবহারিক পড়াশোনার সাথে সাথে হাউস সিস্টেমের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক নানা গুণের বিকাশসাধনে বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রতি শনিবার নিয়ম করে শেষ পিরিয়ডে এই হাউসের আসর বসত ও দিদিমণিদের উপস্থিতিতে হাউসের প্রায় সকলেই নাচ গান আবৃত্তি নাটক বিতর্ক ইত্যাদি কোনও না কোনও বিষয়ে সোৎসাহে যোগদান করত। এছাড়া প্রতি বছর নিয়ম করে স্কুলের বিশাল হলঘরে জমজমাট বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো হতই। অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে সরস্বতী পুজো আর স্পোর্টস ছিল অন্যতম। সারা বছর ধরে এই দুটো দিনের অধীর প্রতীক্ষা থাকত আমাদের। এর বাইরে নেতাজীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষেও খুব বড় করে বেশ ক’দিন ধরে স্কুলে অনুষ্ঠান হয়েছিল মনে পড়ে। শহরের অন্যান্য বহু বিদ্যালয়ের সক্রিয় স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে আলো ঝলমলে ওই সোনার দিনগুলো এখনও কী ভীষণ জীবন্ত হয়ে জেগে আছে মনের মণিকোঠায়।
একটি বিদ্যালয়কে দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে তার মূল যে চালিকাশক্তি, তা হল তার সুযোগ্য অনন্য সাধারণ শিক্ষিকাবৃন্দ। আমি স্কুলে ঢোকার কয়েক বছর পর থেকেই প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছি ভূপালী দিদিমণিকে। ভূপালী দিদিমণি ইংরাজীর শিক্ষিকা ছিলেন, যদিও স্কুলের প্রশাসনিক ব্যস্ততার চাপে বিশেষ ক্লাস নিতে পারতেন না। ফলে ইংরাজীর ক্লাস সাধারণত নিতেন কনকদি। আমাদের সময় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরাজী পড়ার নিয়ম ছিল, ফলে এই বিদেশি ভাষাটা আমাদের শিখতে হয়েছিল খুব দ্রুত। কনকদি এক্ষেত্রে শুধু একজন দারুণ শিক্ষিকাই নন, বিষয়ান্তরে না গিয়েও আশ্চর্য সাবলীলভাবে এমন কিছু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সোশ্যাল এটিকেট বা সামাজিক আদবকায়দার শিক্ষা দিতেন, যেটা ক্লাস বা বোর্ডের পরীক্ষায় নয়, কিন্তু পরবর্তী জীবনে কাজের ক্ষেত্রে সফট স্কিল আয়ত্ত করতে প্রভূত সাহায্য করেছিল। এর বাইরে শিক্ষিকাদের মধ্যে আর যে একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আমাদের বাংলার শিক্ষিকা সুমনা দিদিমণি। সুমনাদি সম্ভবত আমাদের চার পাঁচ বছর পড়িয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই বিষয় হিসেবে বাংলার প্রতি এক আশ্চর্য গভীর অনুরাগ সৃষ্টি করিয়ে দিতে পেরেছিলেন যা ব্যক্তিগতভাবে সত্যিই আমার এক চিরকালীন অমূল্য প্রাপ্তি।
আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিদ্যালয় ছেড়েছি ২০০০ সালে। আজ ২০২৪। সেই দশ বছরের স্কুলশিক্ষা তারপরের চব্বিশ বছরের বাস্তব জীবনে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলেছে তার চুলচেরা বিচার করতে বসলে আজ কেবলমাত্র একটিই কথা মনে হয়, যেমন ভিত্তি, তেমনই ইমারত। বিদ্যালয় থেকে পাওয়া সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে আজ আমাকে এই আজকের আমি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে বলে আমি মনে করি, তা হল নিজের জীবনে স্বেচ্ছায় যেকোনও চয়েস বেছে নেওয়ার দুঃসাহসী আত্মবিশ্বাস। চিরকালই আমার পছন্দের বিষয় ছিল বাংলা ইংরাজী এবং অঙ্ক, অর্থাৎ ভাষা ও বিজ্ঞান এই দুই ধারারই মূল বিষয়গুলি। প্রথমে অঙ্ক নিয়ে পড়ে ও পেশাগতভাবে সেই ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কাজ করলেও একদিন সাহিত্যের জগতে পুরোপুরিভাবে আসার ইচ্ছেটা ছিলই। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত হঠকারী মনে হলেও নিজের ওপর অসীম বিশ্বাসে ভর করেই শেষমেষ আজ এ জগতে প্রবেশ করেছি আমি, এবং, স্বীকার করতে একবিন্দুও দ্বিধা নেই যে এই সাহসের বীজটুকু কিন্তু লুকিয়ে আছে আমার সেই বালিকাবেলার শিকড়েই, যার অন্তর্নিহিত অসীম শক্তিই নির্ভয় হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আজ আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আর, এখানেই বোধ হয় আমার জীবনে আমার বিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
No comments:
Post a Comment