স্মৃতির বিদ্যালয়
অনিতা নাগ
আজ যা’কে আগলে নিয়ে বাঁচা, দিন ফুরোলেই তা স্মৃতি হয়ে যায়। যা ভালোলাগার, ভালোবাসার তাকে আগলে রাখি আপন অন্তরে। জীর্ণ মলিন যা কিছু, তা হারিয়ে যায় কালের নিয়মে।
ছোটবেলায় পাড়ার এক প্রাইমারী স্কুলে বাবা নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। উপেন্দ্র বিদ্যাবিথী। একটা একতলা বাড়ীর কয়েকটা ঘরে ক্লাস হতো। পাশেই ছিলো আমার পিসিমার বাড়ী। দাদু রোজ টিফিনের সময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেন। দাদুকে দেখেই আমার পেট ব্যথা শুরু হতো। দাদু রোজ আদরের নাতনিকে ছুটি করিয়ে নিয়ে আসতেন। বাড়ীতে রোজ মা'র কাছে বকা খেতাম। মা দাদুকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন সবটাই আমার দুষ্টুমি। দাদুকে সে'কথা বিশ্বাস করানো যায় নি। এমনই ভাষা ভাষা কিছু স্মৃতি সেই স্কুলকে ঘিরে। সেই স্কুলের একটা ছবিও নেই আমার কাছে। গুগলেও সেই স্কুলের কোনো চিহ্নও নেই। মনের মাঝে রয়ে গেছে আধা অন্ধকার ক্লাসরুম, বড়দিদিমণি, দোলা দিদিমণি,টিফিনের ঘন্টা। বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রাইজ নেওয়া! ওই টুকুই। তারপর যাত্রা শুরু নতুন স্কুলে, নতুন আলোয়। সেই আলোয় আজও পথচলা। সেই আলো এতো গভীর যে পথ হারানোর ভয় নেই।
আমার স্বল্প শিক্ষিতা মা তার স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন এই যাত্রাপথ। মনে আছে সে বছর শহরের তিনটে নামকরা স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এই স্কুলের পরীক্ষা ছিলো সবার শেষে। স্কুলে ঢুকেই চমক। বিশাল মাঠ। খেলার জন্য দোলনা, শ্লিপ, আরো কতো কিছু। কতো বড় স্কুল বাড়ী। বড় বড় ঘর। বড় বড় জানলা। কতো আলো! কি সুন্দর বসার ডেস্ক। তাতে ব্যাগ রাখার জায়গা। কি লিখেছিলাম মনে নেই। তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিয়ে মাঠে গিয়ে অনেকক্ষণ খেলা করেছিলাম, সেটা মনে আছে। আমার বাবা, মা, আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে তিনটে স্কুলেই ভর্তির পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছিলাম। আমার তো পছন্দ শেষের স্কুলটি। পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেলো অনেকে এই স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। একসাথে আসা যাওয়ার সুবিধা। সেই প্রথম মেয়ে প্রাইভেট বাসে করে স্কুলে যাবে। সঙ্গী থাকলে নিশ্চিন্ত। ভর্তি হলাম সেই স্কুলে। যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। বাগবাজার বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয়। ক্লাস ফোর। সকালে স্কুল। বাড়ীর সামনে থেকে ৩০এ বাসে করে আসা যাওয়া। কালিচরণ ঘোষ রোড থেকে বাগবাজার। দূরত্ব নেহাত কম নয়। সেই প্রথম পাড়ার গন্ডীর বাইরে বেরুনো। মফ কালারের র্স্কাট, সাদা টপ। সাদা মোজা, কালো জুতো। দুটো কলা বিনুনি। একেবারে টিপটপ।
নতুন বই হাতে এলে যেমনটা হয়, প্রথমে মলাট দেখে মুগ্ধ। বারবার নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া। তারপর একটা করে পাতা উল্টে, উল্টে চমকের পর চমক। এ’ও অনেকটা সেইরকম। বিরাট গেট পেরিয়ে স্কুলে ঢোকা। সামনে অতন্দ্র প্রহরী মহেন্দ্রদা, স্কুলের দ্বাররক্ষক । গেটের পরেই টানা বারান্দা। একপাশে অফিসরুম, বড়দির ঘর, তারপর ক্লাসরুম। ডানদিকে বড় হলঘর। বারান্দার গেট পেরিয়ে মাঠ। মাঠে প্রার্থণা হতো। প্রার্থনায় একেক দিন একেকটা গান হতো। তারপর লাইন করে ক্লাসে যাওয়া। মাঠে কতোরকম খেলার ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে বারান্দার একদিকে ক্লাসরুম, ল্যাবোরেটরী,কমনরুম। অন্যদিকে টিচার্স রুম, লাইব্রেরি। এতো কিছু স্কুলে থাকে! সেই বিস্ময়ের আবেশ আজো ও রয়ে গেছে মনে। বড় বড় ক্লাসরুম। কতো আলো! সেই আলো তখন থেকেই ঘিরে আছে আমাকে। অন্ধকারকে বড় ভয় আমার। যেখানে যতো অন্ধকার, সব আলোয় ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
সকালের বড়দি ছিলেন পূর্ণিমা দি। আর ছিলেন সীমা মিস, গীতা মিস। দুই বোন। আমাদের সাথে একই বাসে যেতেন দু'জনে। আর কারুর কথা তেমন করে মনে পড়ে না। ফাইভ থেকে দুপুরে স্কুল। যখন ক্লাস সিক্স তখন আমরা নতুন বাড়ীতে চলে যাই। একা স্কুল যাওয়া শুরু হয়। দুপুরের বিভাগে গিয়ে পেলাম আমাদের বড়দিকে, শ্রীমতি অণিমা মুখোপাধ্যায়। কি যে মানুষ ছিলেন! ছাত্রীদের জন্য, স্কুলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। কোমল, কঠোরের এমন মিশ্রন বড় একটা দেখা যায় না। সৌম্য মূর্তি। ছোট করে কাটা চুল, সাদা শাড়ী, সাদা ব্লাউজ। এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। দিদির দুই মেয়ে আমাদের স্কুলেই পড়তো। দু'জনেই সিনিয়র। বড়দির মেয়ে বলে কোনো বাড়তি সুবিধা নিতে দেখিনি। রোজ নিয়ম করে বড়দি সব ক্লাস ঘুরে দেখতেন। উঁচু ক্লাসে বড়দি ইংরাজী পড়াতেন। সে অভিজ্ঞতা চিরদিনের। স্কুল মানে কি শুধুই পড়াশোনা? না, একেবারেই তা নয়। পড়ার সাথে সাথে কতো কিছু যে পেয়েছি, কতো কিছু যে শিখেছি তার হিসেব নেই। এই পাওয়া গুলো তখন বোঝার বুদ্ধি ছিলো না। প্রথম শিখেছি সকলকে সম্মান করতে, সকলকে ভালোবাসতে। আজ বুঝি সেটা জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। পড়াশোনার সাথে শিখেছি নাচ, গান, ব্রতচারী, সেলাই আরো কতো কিছু। শিখেছি চরকা কাটতে। শিখেছি ধূপ তৈরী করতে, মোমবাতি তৈরী করতে। অনেক কিছু শিখেছি দেখে দেখে। শিবানীদি কি ভালো আল্পনা দিতেন। প্রতিবছর সরস্বতী পূজোর আগের দিন দিদি গেটের সামনে আল্পনা দিতেন। কোনো অনুষ্ঠান এলেই ঝর্ণাদি নাচ শেখাতেন। দিদির বিষয় ছিলো ভূগোল। কিন্তু কি ভালো নাচতেন। গাইড করতাম। ক্যাম্পে যেতাম হৈ হৈ করে। দুষ্টুমিও কম করিনি। আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো। সবকিছুতে সবার আগে যাওয়া চাই। সে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড হোক বা সরস্বতী পূজোর নেমন্তন্ন করতে যাওয়া। বন্ধুদের টিফিন চুরি করে খেয়েছি! বৃষ্টিতে জুতো মোজা ভিজিয়ে রেনি ডে’র আবদার করেছি। বৃষ্টিতে ক্লাসে জানলা দিয়ে জল আসায় কমন রুমে ক্লাস করার আবদার করেছি। এমন কতো কিছু।
জীবনের অপরাহ্নে এসে নিজের যে একটা স্কুলবেলা আছে তাই তো ভুলতে বসেছিলাম। নানান সম্পর্কের জালে কোথায় হারিয়ে গেছে জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলো। সম্পর্কের নানান রসায়ন মেলাতে মেলাতে নিজেকে খুঁজে দেখার সময় কোথায়! এখন তো তাল মিলিয়ে ছুটে চলা। তবু সেই শিকড় আজো আঁকড়ে বেঁধে রেখেছে। পথ হারাতে দেয় না। আঁধার আসে, বিপদ আসে, হতাশা আসে। জীবন যে বড় জটিল। আজও সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে উঠার মনের শক্তিটুকু সেই ছোট্টবেলায় পাওয়া। সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ভীড়ে আলো হয়ে রয়েছে আমার বিদ্যালয়। জীবনের সেই প্রিয় দিনগুলো আজ স্মৃতির অলিন্দে বন্দী। কখনো কোনো দমকা বাতাসে সেই অলিন্দ খুলে যায়। দেখতে পাই দু বিনুনি বাঁধা সেই মেয়েটাকে। হেসে খলখল, গেয়ে কলকল। সবাই মিলে টিফিন খাওয়া। লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্লাস সিক্সেই গোগ্রাসে শরৎচন্দ্র পড়া। মনে আছে লাইব্রেরীর শিপ্রাদি কেমন করে সবরকম বই পড়ার অভ্যেস করিয়েছিলেন। এমন অনেক স্মৃতি। ক্লাস ফোর থেকে হায়ার সেকেন্ডারি, জীবনের অনেকটা সময় এই বিদ্যালয়ে কেটেছে। আজো বাগবাজার স্ট্রীট দিয়ে যাওয়ার সময় স্কুল বাড়ীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। সেই লম্বা কড়িডোর। সেই আলো ঘেরা ক্লাসরুমের সারি! তবে বদলে গেছে অনেককিছু। আগের সেই কৌলিন্য আজ অনেকটাই ম্লান।
যখন মেঘ জমে মনে, দিশাহারা লাগে তখন কানে ভেসে আসে রবিঠাকুরের সুর। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই মাঠের একদিকে সব দিদিরা, অন্যদিকে হাত জোড় করে সকলে গেয়ে চলেছি
“অমনি করে আমার এ হৃদয় তোমার নামে হোক-না নামময়
আঁধারে মোর তোমার আলোর জয় গভীর হয়ে থাক্ জীবনের কাজে”।।
আঁধারকে জয় করার মন্ত্রকে আগলে রাখি বড় সাবধানে। হঠাৎ দু'চোখে অকাল বর্ষণ নামে। মনে মনে প্রণাম জানাই আমার বিদ্যালয়ের সক্কলকে।
No comments:
Post a Comment