স্মৃতির ঘরে বিদ্যালয়
রীনা মজুমদার
স্কুল বেলা জীবনের শ্রেষ্ঠ বেলা। জীবনের শুরু, পড়াশোনার আঁতুড়ঘর প্রাথমিক স্কুল। বাড়ির কাছেই ফালাকাটা যাদবপল্লী প্রাইমারী স্কুল।
বাবা ভর্তি করে দিল ওয়ানে, শুরুর দিনটি সবার কাছেই বিশেষ দিন। বাবা বলেছিল একটা আসন নিয়ে যেতে হবে স্কুলে, ক্লাস টু থেকে ক্লাসরুম। মা একটা বস্তা কেটে সুন্দর চারকোনা আসন বানিয়ে ,সঙ্গে স্লেট পেন্সিল আর দুটো বই নিয়ে, দুরু দুরু বুকে আর দু'এক জন পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে চলে গেলাম। বিদ্যালয়ের উঠোন জুড়ে বিশাল এক কদম গাছের তলায় ওয়ানের ক্লাস। পাখি উড়ে বসছে, তাকিয়ে আছি, দেখছি, খেলছি বেশ মজাতেই প্রথম দিনটি কেটে গেল। বর্ষায় টপ টপ করে কদম ফুল পড়ত, সেই মজাতে খেলতাম ফুল দিয়ে।
এখন বুঝি, রোজ তো তাই হয় না!
একদিন একজন মাস্টার মশাই মাথাটা টেনে "অ আ গুলো না লিখলে শেখা হবে!" ভয়ে সেই বোধহয় জীবনের প্রথম শুরু, পড়তে হবে লিখতে হবে।
পরে জেনেছিলাম, তিনিই আমাদের হেড মাস্টার মশাই শ্রী রাধাপদ মাস্টার মশাই। মনে আছে খুব ভালো বাসতেন।
একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে, তখন ক্লাস ফোর, ফাইনাল পরীক্ষা। বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ছোড়দা বলল, একদিন পর তো অংক! অংক করতে ভালই লাগত। বললাম হ্যাঁ, 'নে এই প্রশ্নটা রাতে সবগুলো করবি, দ্যাখ পারিস কিনা! কোনো টা না পারলে বলিস বলে দেব।'
একদিন পর অংক পরীক্ষায় বসে দেখি ছোড়দা যে প্রশ্ন পেপার দিয়েছিল! হুবহু একই।
আসলে আমাদের পাড়ার মানে (সারদা নন্দ পল্লী প্রাইমারি স্কুলেও পরীক্ষা চলছিল। একমাত্র অংক প্রশ্ন পত্রটিই নাকি একই জায়গা থেকে কেনা ছিল। যেদিন বাংলা পরীক্ষা ছিল সেদিন পাড়ার স্কুলে অংক ছিল। ছোড়দা স্কুল থেকে ফেরার সময়, বাচ্চাদের পরীক্ষা হয়ে গেছে দেখে একজনের থেকে চেয়ে নিয়ে আমাকে দিয়ে ছিল জাস্ট প্র্যাকটিস করাতে। ছোড়দাও অবাক! বলেছিল "হাসতে হাসতে পুরো ফুল নম্বর পাবি তো!"
হ্যাঁ পেয়েছিলাম অংকে একশো তে একশো। মনে পড়ে এমন সব সুখস্মৃতি, মজার সব ঘটনা।
এগিয়ে চলাই জীবন। শুরু হবে এবার আরেক স্কুল। ভর্তি করে দেবে বাবা গার্লস হাই স্কুলে।মাঝের কটা দিন মাসি- পিসির বাড়িতে যাব না তাই কখনো হয়! আমাদের সময় তো ফাইনাল পরীক্ষার পর এই আনন্দটাই ছিল সবচেয়ে বড় পাওয়া!
গিয়েছিলাম পিসির বাড়িতে, দুদিন পরই চলে আসতে হয়েছিল কারণ সেবার থেকেই প্রথম শুরু হল এডমিশন টেস্ট নিয়ে ভর্তি। আবার পরীক্ষা! মন খারাপ হয়ে গেল, বসলাম নতুন স্কুলে পরীক্ষা দিতে। সবার প্রথমে আমার নাম উঠেছে। খুব ভালো লেগেছিল, বাবাও খুব খুশি, মনে পড়ে সে সব সময়ের দিনগুলো।
একটা করে বছর পেরিয়ে ক্লাসরুম পাল্টে যাওয়া। নতুন নতুন বন্ধু হতে শুরু করল। মনের কথা বলা, টিফিনে ছুটোছুটি আর খেলা সে এক অনন্য সুন্দর মুহূর্ত নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলার স্কুল বেলা শ্রেষ্ঠ বেলা।
খুব ভালো লাগত, মনে পড়ে মৈত্রী দিদিমণির কথা। অংক ক্লাস নিতেন, অংক পারতাম বলে আমাকে খুব ভালো বাসতেন। আর মনে পড়ে আরতি দিদিমণির কথা.. একবার নাটক হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' মাখনের ভূমিকায় আমি। তখন থেকে আজও আমাকে মাখন বলেই ডাকেন। আমি তখন হয়তো সিক্সে, এক অদ্ভুত কান্ড হয়ে ছিল নাটকের সময়। স্টেজের সামনে যেমন পেছন দিকেও তেমন ভীড় হয়েছিল। নাটক শুরু হয়ে গেছে, মাখনের পার্ট শুরু হবে কিন্তু আমি পোশাক পরে ক্লাসরুম থেকে আরতি দিদিমণির হাত ধরে বেরিয়ে এসে আর তো ভীড়ে স্টেজে ঢুকতে পারছি না! তখন আরতি দিদিমণি আমাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে সবার মাথার উপর দিয়ে স্টেজে ঢুকিয়ে দিয়ে ছিলেন।
এমন সব স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো কেটেছে বিদ্যালয়ে, কোনদিন চেষ্টা করেও মোছা যাবে না। ছিলেন যেমন ভয়ের তেমনই স্নেহময়ী বড়দিদি মণি শ্রীমতী শ্রদ্ধেয়া মায়া বোস।
পরবর্তীতে ফালাকাটা বয়েজ হাই স্কুলে দুবছর একাদশ দ্বাদশ শ্রেণী। সেখানে পেয়েছি শ্রদ্ধেয় শ্রী নীরদ বরণ রায় হেড স্যারকে। তাঁরা যেন বিদ্যালয় ও ছাত্র- ছাত্রীদের মধ্যে এক ভালোবাসা ও আদর্শের বন্ধন গড়ে তুলতেন। যা আমাদের চলার পথে ঠিক - বেঠিকের হাতে খড়ি দিয়েছেন, যেমন বাড়িতে মা- বাবা।
আর বিদ্যালয় থেকে বন্ধুদের ভালোবাসা ও একে অপরকে নিয়ে পথ চলার মধ্যেও অনেক কিছু শিখেছি। স্কুলে প্রাণ ছিল আনন্দ ছিল।
জীবনের শুরু থেকে বিদ্যালয় আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সময়। আজও মনে হয়... প্রাইমারী স্কুলে কদম গাছ আর গার্লস স্কুলে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে " জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে..."
No comments:
Post a Comment