স্মৃতির বিদ্যালয়
মিষ্টু সরকার
স্কুল স্কুল স্কুল
আমারে মেয়ে বেলা
ভালোবাসার বাড়ি
রামধনুর মেলা
স্কুল স্কুল স্কুল
আমার সব পাওয়া
হাতবাড়ালেই
ছোঁয় হাতের মায়া ।
তোমার পথে, ভালবাসার স্রোতে ভাসতে নোঙর বেঁধেছি। নোঙর বেঁধেছি সেই ঘাটে যেখানে প্রকৃতির নিবিড় পাঠের সঙ্গে লাল_সাদায় মোড়া আমাদের আজন্ম লালিত শৈশব মুখরিত হয় স্কুল স্কুল গন্ধের হাতছানিতে ' বাণীদীপ' হয়ে ।পড়ি বন্ধুত্বের প্রথম পাঠ। শরৎ ভোরের শিউলির মতো পদ্ম পাতায় জমা হয় এক একটি লাল_সাদা প্রাণ যা আহ্বান করে এক কর্মযজ্ঞের, তা 'বিদ্যামৃতম্' আর তা সম্পৃক্ত হয় এক বহমান জীবন যজ্ঞে।
শৈশবের সেই নিবিড় পাঠই বুঝি নিজেকে
বোঝার আগেই আমাদের বেঁধে রেখছে।
"সেই থেকে রয়ে গেলাম তোমার বাড়ি
যেখানে শুধুই ভাব, নাইতো আড়ি ।
তাই আজ পর্যন্ত যেখানেই যাই আমাদের একটাই পরিচয় "আমরা লাল সাদা" । নচিকেতা চক্রবর্তী_র সেই গানটা " লাল ফিতে সাদা মোজা স্কুল স্কুল ইউনিফর্ম" যেটা শুনতে শুনতে নস্টালজিক হয়ে ভাবতাম যে গানটা আমাদের স্কুলকে উপলক্ষ করেই লেখা, আর এখনো তা ভাবতে ভালোই লাগে। এক সময় সেই লাল সাদার ওপর আঘাত এলো, শত আঘাত মেনেও এই লাল সাদার সম্মান ক্ষুণ্ন হতে দেয়নি স্কুলের ছাত্রী ও শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মচারীরা। হাতে হাত মিলিয়ে ফিরিয়ে এনেছে লাল সাদার গৌরব। আমাদের প্রিয় মাধবী_দি দিয়েছিলেন আমাদের অভয়।
জলপাইগুড়ি পোস্ট অফিস মোড় পার করে ডান হাতে গান্ধী স্ট্যাচু রেখে বাম দিকে কিছুটা গেলেই আমাদের প্রিয় স্কুল বাড়ি। বড়ো সবুজ রঙয়ের রাধাচূড়া ছাওয়া গেটটা পেরোলেই আমাদের সেই বকুলে, মাদারে, কৃষ্ণচূড়ায়, ঝুমকো-জবায় ঘেরা স্কুল বাড়িটি যেখানে আমাদের বাল্যস্মৃতির শৈশব মুখ ঢেকে আছে । শীতকালে মালিভাইয়ের হাতের পরিচর্যায় গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে হেসে উঠতো, কতো নাম না জানা গাছের নাম জেনেছি, কাছ থেকে চিনেছি সব। গোটা স্কুল বাড়িটাই যেনো আমাদের প্রকৃতি শিক্ষার প্রথম পাঠ। আম, লিচু তাল, সবেদা, কামরাঙা, জামরুল, গোলাপজাম, পানিয়াল, আমলকী কি ছিলোনা সেখানে। আর ছিলো তাদের সাথে, তাদের ঘিরে আমাদের প্রতিদিনের নানা খেলা, কত কথা, গল্প , ঘটনার সাক্ষী এরা। যেমন আমাদের মনের কুলুঙ্গিতে পরতে পরতে সাজানো আছে সব ঠিক--ভুল ভালোলাগা -- মন্দলাগা, পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব ।
স্কুলে ঢুকতেই নিচু ছাদের সামনের দিকে বড় বড় করে লেখা রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়, আমাদের সমস্ত আবেগ যেন ওখানে উছলে পড়ে । বর্ষার দিনের প্রার্থনার লাইনে ভেতরের ওই জায়গাটুকুতে আমাদের ঠিক সংকুলান হয়ে যেত । পতাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট বেদীটি পেরিয়ে সামনের মাঠটিতে আমাদের সবাইকে নিয়েই যে কোনো আয়োজনই সম্পূর্ন হয়ে যেতো। তারপর যবে আমরা বড় হয়ে গেলাম তখন ছোটবেলার জামার মতো সব কেমন যেন আমাদের থেকে ছোটো মনে হতে লাগলো। এবার পা রাখছি হলের ভেতরে, ঢুকতেই মেহগনি রংয়ের ছোটো ছোটো চেয়ার গুলি, লম্বা কাঁচের আলমারিতে রাখা সরস্বতী ঠাকুর তার বাম দিকে প্রার্থনা সভার সামনে দিয়ে উঠে গেছে পালিশ করা কাঠের রেলিং, হাতে হাতে সেটি ধরে উঠে যাও বাম দিকে প্রত্যেক তলার দেয়ালের ওপর টাঙানো ছবি, ওপরে ডানদিকে সারি সারি ঘর, ওগুলো আমাদের পড়ার ঘর। বাম দিকে রইল আমাদের লাইব্রেরী, প্রচুর বই ঠাসা, সুন্দর ভাবে গোছানো। আমরা লাইব্রেরী ক্লাসে সই করে দিদিমণির থেকে হাতে হাতে তুলে নিচ্ছি পছন্দের বই। আরও ওপরে তিনতলায় উঠলে আমাদের প্রিয় হলঘর কতো অনুষ্ঠান, বন্ধুদের সাথে কতো ফাঁকা ক্লাস, কতো অনুশীলনের স্মৃতির পাতা যে খাতা হয়ে জমে উঠেছে সেখানে।
সেই জানালার বাইরে দিয়ে দেখা যায় শিশুনিকেতনের সবুজ মাঠ, এই শিশুনিকেতন বেসিক স্কুলে ও আমাদের সময়ের জলপাইগুড়ির প্রায় বন্ধুদের শৈশবকাল আটকে আছে। সারি সারি গাছের ছায়া ঘেরা বাড়ি, সবুজমাঠ, রেলগাড়িটি চলুক আর নাই চলুক আমাদের সমস্বরে কু-ঝিক-ঝিক তাকে ব্যস্ত করে তুলতো ।
আমাদের লাল সাদা বাড়িটির চারতলার ছাদে আমাদের যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিলো। আর তিনতলায় আমাদের বড় ক্লাস ঘর গুলোতে সব্বার জন্য আলাদা বসবার জায়গা, সেগুলোকে জোড়া লাগিয়ে জোড়া লাগিয়ে ক্লাসে বসেছি, দুষ্টুমি করবার অভিপ্রায়ে, সামনে উঁচু জলচৌকিতে বসে আছেন আমাদের প্রিয় কোনো দিদিমণি, সবুজ জানালার সাদা পর্দা গুলো তে হওয়ায় আর সেই সাথে আমাদের মন। আমরা হয়তো কিছুই শুনছি না, শুধু শোনার ভান করছি। দিদিদের স্নেহমাখা কপট বকা-ঝকা সেই যুগের আমাদের ভাবাতো না, আমরা জানতাম আমরা যা দুষ্টুমি করছি এটা তার পাওনাগণ্ডা। তখনকার আমাদের কাছে ও আমাদের অভিভাবকের কাছে আমাদের ওভার-সেন্টিমেন্টের চেয়ে শিক্ষকদের অনুশাসন অধিক গুরুত্ব পেতো। এই জন্যই হয়তো আজও আমাদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক অটুট। আমাদের সায়েন্স রুমে রাখা কঙ্কাল টাও যেনো মুচকি হেসে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতো। তার চারপাশে আরও কতো বিষয় ভিত্তিক রুম আর সবশেষে হোস্টেল। আমরা যে সবসময় দুষ্টুমি করতাম তা নয় আমরা পড়াশোনাও করতাম কখনো কখনো গভীর মনোযোগের সাথে।
পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটির আগের অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব , সরস্বতী পুজোর দ্বায়িত্ব থাকতো নির্দিষ্ট কোনো ক্লাসের ওপর থাকতো, সাথে দিদিমনিরাও সাহায্য করতেন। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে বড়ো হয়ে ওঠার প্রাগ মুহূর্তে ক্লাস নাইনের ওপর থাকতো সরস্বতী পুজোর দ্বায়িত্ব।আমাদের সব কাজে এগিয়ে আসতে, দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখিয়েছে এই স্কুল বাড়ি ও তার বাসিন্দারা।
ছুটির দিনে আমরা নতুন জামা, অপটু হাতে শাড়ি পড়ে যেতাম । সে যে কি এক অনাবিল আনন্দ তার এখন বলে বোঝাতে পারবো না।বাইরের যেকোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে আমরা সবসময় অগ্রগণ্য। আমি সাধারণ স্টুডেন্ট হলেও আমাদের জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের স্কুলের নাম অগ্রগণ্য ছিলো। আমাদের টিফিন ঘরের মাসিদের অবদানও আমাদের জীবনে কম নয় । সেই দাঁড়িয়ে লম্বা লাইন দিয়ে নিচু থেকে উঁচু ক্লাসের টিফিন নেওয়া, আর এই একই সময় সবার সাথে সবার দেখা আর গল্প সবটাই হতো। তাদের হাতের রান্না করা প্রিয় পদগুলি খিচুড়ি, আলুকাবলি আরও কতো কিছুর স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। আমরা প্রতিটি স্টুডেন্ট খেলাম কিনা সেই ব্যাপারেও খেয়াল রাখতেন আমাদের শিক্ষিকারা।
আমাদের প্রিয় শিক্ষিকাদের, আমাদের টিফিনের মাসিদের, বৌ মাসি যিনি আমাদের হাজারো ঝক্কি ঝামেলা পোহাতেন,অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই আজ এই পৃথিবীতে নেই কিন্তু তাদের স্নেহমাখা মুখগুলি আমাদের মনের ভেতর রয়ে গেছে গভীর যত্নে।
আর স্কুল বলতে যাদের ছাড়া বাকি জীবনটা ভাবাও যায় না, তারা প্রিয় বন্ধুরা। আমরা একে অপরের
অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত জুড়ে হাসি কান্না মেখে ভালো আছি। আর কোনো সম্পর্ক ও যদি সময়ের স্রোতে ভেসে যায় তবু অর্থ থাকবে আমাদের এই বন্ধুত্ব, যা আমাদের এই স্কুল বাড়ি দিয়েছে।
অসুখ কেড়ে নিয়েছে আমাদের সদ্য আঠেরোতে পা দেওয়া বন্ধু শ্রীময়ীকে, যে ঘটনা আমরা কখনোই ভুলতে পারিনি।
যতো ভালো কথাই বলিনা কেনো সবার সঙ্গে, মনটা চায় খুনসুটি বন্ধুদের সঙ্গে।
যা কিছু ভালো বলো ভালো করো মনটাই পড়ে থাকে কবে একসাথে হবো, ঝগড়া, হৈ হৈ, বকবকম, চিৎকারের অদ্ভুতসব দাবী দাওয়ায় ভরে উঠবে আসর। এযেন ঘরে পড়ার সেই জামাটির মতো। শত শত দামী পোশাক যার কাছে হার মানে, তার আদর আরামের কাছে। এ আরাম প্রাণের নিভৃতে লুকিয়ে থাকা এক অমোঘ চালিকাশক্তি যা আমাদের নিয়ে যায় এক আনন্দলোকে। যেখানে আছে শুধুই নিরন্তর নিখাদ ভালোবাসার প্রশ্রয়। যা মালা হয়ে দুলতে থাকে গলায় । আর সেই মালার প্রিয় লকেটটি আমাদের প্রিয় লাল সাদা বাড়িটি আমাদের স্কুল, যার পোশাকি নাম রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় ।
শুধু আমাদের না প্রত্যেকটি মানুষের শৈশবে বাঁধা পড়ে আছে এই গভীরে। আজ আমরা যারা শৈশব কাটিয়েছি জলপাইগুড়ি Govt Girls' High school এ কেটেছে যাদের শৈশব তারা হয়তো একটু বেশি নস্টালজিক হয়ে পড়েছি। কারণ আমাদের সেই লাল সাদা বাড়ি যা আমাদের অমলিন শৈশব কৈশোরের একমাত্র সাক্ষী তার ৭৫ বছরের জন্মদিন পার হয়ে গেল। তার ৭৫ বছরের জন্মদিনের সাক্ষী আমরা । এমন দিন তো বারবার আসে না। তাই এটুকু বেশি মানা নেই। এই একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেন যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস নির্মল করে দেয় আর সেই বন্ধুত্বকে জয়ের মালা পরানোর দিন।
এই ভালোবাসায় রাখি একটা জীবন ,
পাই যেন ডাক মনে চিরন্তন
ভালোথাক শৈশবের কচি মুখগুলি
ভালোথাক নিখাদ ভালোবাসার প্রাণগুলি
জীবন মাঝে এসে এই ভিক্ষা চাই
বন্ধু আর বন্ধুত্বে চির সবুজ হোক সবাই।
No comments:
Post a Comment