`সেই গ্রাম সেই পথ....`
মাটির পথ ছেড়ে এসেছি ২৪ বছর আগে
বটু কৃষ্ণ হালদার
আজ দুজনের দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে/ তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি/ আমার এ পথ আঁধারেতে আছে ঢেকে।
হ্যাঁ,সে পথ হল আমার সবুজ ঘেরা গাঁয়ের মেঠো পথ। সালটা ২০০০, আমি সবুজে ঘেরা গায়ের মেঠো পথ মাড়িয়ে জেটিঘাটে এসে নৌকায় চাপলাম। মাধ্যমিক দিয়ে চলে এলাম কলকাতায় উচ্চ শিক্ষার জন্য। পিছনে পড়ে থাকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব,গাছপালা,পুকুরপাড়, আর মেঠো পথ। ওই মেঠো পথ ধরে আমার প্রিয় বন্ধু সালমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। আমার প্রিয় বর্ষাকালে সেই পথ কাদা হয়ে থাকতো। স্কুলে যাওয়ার সময় এক হাতে চটি আর এক হাতে প্লাস্টিক কাগজের মধ্যে ভরা থাকতো স্কুলের বই। অনেক জায়গায় ছোট ছোট নুড়ি কাঁকরে ভরা থাকতো। সুন্দরবনের নদী সংলগ্ন এলাকায় আমার বাড়ির জন্য গ্রামের রাস্তা বালি ও মেশানো থাকতো। তাই বৃষ্টির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় শুকিয়ে যেত। সেই রাস্তার মধ্যে দিয়ে যখন বিকেল বেলা দৌড়ে খেলতে যেতাম নুড়ি,কাঁকড় খোয়াতে পা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরে পড়ত বুঝতে পারতাম না। খাল কেটে যখন সেই রাস্তায় মাঠে ফেলা হতো তখন অন্ধকারে চলতে গিয়ে কাঁদার মধ্যে পা ঢুকে যেত। পা বের করলে চটি কাদার মধ্যে আটকে থাকতো। আবার তাকে ভয়ের করে পুকুরে পা ধোয়ার নাম করে জলে ঝাঁপ দিতাম।
আমি তখন ক্লাস সেভেনে কিংবা এইটে পড়ি। বাজারের পাশে দিদিমনির বাড়িতে ইংরেজি বিষয়ে টিউশনি পড়তে যেতাম। একদিন সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হয়েছে। সেদিন ফুল থেকে নিরুর ভিডিও হলে চারটের শো ভিডিও দেখলাম। বাড়িতে না ফেরার জন্য বাবা বকবেন, তাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বাড়িতে গিয়ে বলব পরীক্ষা এসে গেছে দিদিমণি স্কুলের পরে পড়তে যেতে বলেছে তাই একেবারে পড়ে ফিরছি। তারপর পড়তে গেলাম। বৃষ্টি হওয়ার জন্য দিদিমণি সন্ধ্যে আটটায় ছেড়ে দিল। তখনকার সময়ে সন্ধ্যে আটটা মানে গ্রামের দিকে অনেক রাত। তার উপর বর্ষাকাল তাই বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। রাত জেগে টিভি দেখার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। বলতে গেলে গ্রামের সব বাড়িতে কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি টিউশনি দিয়ে বের হয়ে বাজারে গিয়ে দেখলাম প্রায় সব দোকান বন্ধ।শুধু আমাদের পাড়ার অনিল কাকা র দোকান তখনও খোলা। একটু ভরসা পেলাম। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, `কাকা কখন বাড়ি যাবে`। বললো, `ও তুই। একটু দেরি হবে যে। তুই এগোতে থাক আমি তোর পিছনে পিছনে আসছি।` বললাম, `আচ্ছা`।
আমি নদীর পাড়ে উঠে, এগোতে থাকলাম বাড়ির দিকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকারে কোথায় পা ফেলছি তার হদিস ছিল না। কখনো কখনো মাটিতে পা ঢুকে জল ছিটকে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে।কিছুটা এগিয়ে সুইস গেট ( আমাদের খালের সঙ্গে নদীর সংযোগস্থল, রাস্তা কেটে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো,তার দুটো মুখ আছে যা লোহার গেট দিয়ে ঢাকা থাকে। জোয়ার ভাটা খেললে খালের জল নদীতে চলে যায়, আবার নদীর জল খালে ঢকে। উপরে দুদিকে লোহার রডের মাঝে গোল চাকতি থাকে, সেটি কে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢাকনা উপরে তুলতে হয় আবার নিচে নামাতে হয়) পেরোলে খালপাড়ের রাস্তা ধরে বাড়ি পৌঁছতে হবে। গেটের ঢাকনা খোলা হু হু করে জল নদীতে ছাড়া আছে। বিকট আওয়াজ। যেতে যেতে নদীর ত্রিকোণ বাঁধের দিকে তাকালাম, কারণ সেখানে শ্মশান। কোন মরা আসেনি সেদিন, চিতার আগুন জ্বলছে না। মরা এলে কম সে কম আগুন ও লোকজনের হল্লা শুনতে পাওয়া যেত। সুইস গেট পার করে রাস্তায় ঢুকবো। এমন সময় দমকা হাওয়া পিছন থেকে ধাক্কা মারলো। ছিটকে গিয়ে বাঁধ বরাবর পিছনে হড়কে খালের জলে পড়ে গেলাম। মাথায় তখনও প্লাস্টিকে মোড়া বই আর অন্য হাতে জুতো। দুটো হাত তখন গৌরাঙ্গের মতো উপরে তোলা। কোন প্রকারে পাড়ের ঝোপঝাড় হাতড়ে উপরে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলতে লাগলাম। আর মুখে মনে মনে হরে কৃষ্ণ হরে রাম বলতে থাকলাম।
চলছি তো চলছি, কোথায় পা পড়ছে তা বুঝতে পারছি না। রাস্তার একটা কুকুরও দেখতে পেলাম না তারাও কোথাও নয় কোথায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি একা হেঁটে চলেছি।দুই একটা বাড়িতে তখনো আলো নেভেনি। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই এক দৌড়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনো মা বাবা আর ঠাকুমা জেগে আছে আমার জন্য। মা একটু জল গরম করে আমাকে ধুইয়ে দিলো। ভাত খেতে বসতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমার পিছনটা চিরে গেছে। জ্বালা করছে,ব্যথা করছে। তারপর মা আর ঠাকুমাকে সব ঘটনা বলি। বাবা বকাবকি করেনি। ভাত খেয়ে সোজা ঠাকুরমার কাছে ঘুমিয়ে পড়লাম।
যে রাস্তার মাটি নিয়ে চাম গুলতি বানিয়েছি, যে রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে খালে গিয়ে পড়েছি, যে রাস্তায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল খেলেছি, যে রাস্তার পাড়ে খেজুর গাছে উঠে খেজুর পারতে গিয়ে পড়ে গেছি, রাস্তার পাড়ে বুনো হাবড়ি গাছের ফল নিয়ে গাড়ি গাড়ি খেলেছি, সেই রাস্তা এখন কেমন আছে জানিনা। রাস্তার পাড়ে খালের জলে সাঁতার কাটতাম বন্ধুবান্ধব মিলে, দিন দুই বেলা মাছ ধরতাম জাল ফেলে, তার জল ছুঁয়ে দেখিনি বহুবছর।
কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকি। সব সময় গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনা। তবে গ্রামের সেই মেঠো পথ এখন কংক্রিটের জঙ্গলে আবদ্ধ। বর্ষায় হাঁটলেও মাটি লাগেনা পায়ে। রাস্তার মাটি ঢাকা পড়ে গেছে আধুনিকতার বিলাসিতায়। বাড়িতে গেলে রাস্তায় বসে পাড়ের মাটিতে পা ছুঁয়ে বসে থাকি। আর দেখি হারিয়ে যাওয়া মাটির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম গঞ্জের মেলবন্ধন ও আত্মিকতা ও হারিয়ে গেছে সময়ের তালে তালে। গ্রাম থেকে যখন আবার কলকাতায় ফ্রি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার শৈশব হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাড়ার সঙ্গী সাথী ভাই বোন মা-বাবারা এই রাস্তায় হেঁটেছে দৌড়িয়েছে খেলেছে। মনে হয় তারাও যেন খেজুর গাছ, বাবলা গাছ, অর্জুন গাছের ফাঁক দিয়ে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। আর বলছে ফিরে আয় দাদা ফিরে আয়। সময়ের সাথে সাথে জীবন থেকে যেমন হারিয়ে যায় আনন্দ, খুশি, উৎসব তেমনই হারিয়ে গেছে মেঠো, গাছ-গাছালি দাপিয়ে বেড়ানো শৈশব।
No comments:
Post a Comment