`অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন`
এ পথ গেছে কোন খানে...
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
দশটা চুয়াল্লিশ মিনিটের আপ বনগাঁ লোকালের সাথে ডাউন ট্রেন শিয়ালদহ গামি ট্রেনের ক্রসিং হতো গোবরডাঙা স্টেশনে । আর সেই ট্রেনেই আসতেন সব স্যারেরা। আসতো সব সহপাঠী। একঝাঁক বন্ধু বান্ধবীরা। আমরা সাত জনের একটা টিম ছিলাম।ছাত্র সংসদের পত্রিকা সম্পাদক ক্ষীরোদ ঘোষ ছিল আমাদের টিম লিডার। ছিল রীতা বসু, অর্চনা ঘোষ, কৃষ্ণা মিত্র, স্নিগ্ধা দে, সুভাষ দাস। আমরাই ছিলাম কলেজের শেষ কথা। স্নিগ্ধা সব পরীক্ষায় প্রথম হতো। আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম সোয়া এগারোটায় কলেজ গেটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করবার জন্য । শুধু গেটের মধ্যে প্রবেশ করত না তপন, রাজেন আর সোমনাথ। ওরা বসতো বিশ্বনাথদা'র চায়ের দোকানে। সবাই বলতো ওরা তিন জনই বছর চারেক আগে পাশ আউট। স্রেফ রাজনীতি আর এই পথটার টানে রোজই কলেজে আসতো।
কলেজের সেই পথটা আজও আমাকে খুব টানে। রেললাইন পার হওয়ার পরই যেন একটা ছাত্রদের মিছিল। কেউ গাইছে গান, কারো মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ আবার কারো বা সদাই মনে জিজ্ঞাসা, "আচ্ছা রবি ঠাকুরের মেজবৌদির নাম কি ছিল রে ? "
টাউন হলের মোড়টা ঘুরলেই একটা নীল আকাশ। আর তার দিগন্ত জোড়া উড়ন্ত রঙিন কার্পেট। এক বর্ণিল সাগরে ডুব দিতেই সার সার পাম গাছ মধ্যপ্রদেশ বের করে দাঁড়িয়ে আছে। কলেজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই লোহার ফেন্সিং এর মধ্যে নানা রঙের ফুলের বাহার। গেটের মধ্যে অজস্র ছোট বড় রঙিন পাতাবাহার নানা রঙের ফুলের গাছকে পাহারা দিচ্ছে এক আগুন ঝরানো কৃষ্ণচুড়া।
চলাই জীবন আর থেমে যাওয়াই মরণ। জীবন নদীর গা ঘেঁষে ঠিক কবে থেকে আমার পথ চলা শুরু হয়েছিল তা সঠিক ভাবে বলতে পারব না। আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে একটা লম্বা পথ প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে মৃত্যুর দুয়ার অবধি। একটা করে দিন এগিয়ে চলে, আশা থেকে উত্তরণ এর দিকে এগিয়ে চলতে থাকে জীবন। এই পথের গুঢ় রহস্য ঠিক কবে থেকে বুঝতে শিখলাম বলতে পারিনা। কিন্তু হঠাৎই অনুভব করলাম এই পথ চলায় আমার চিরস্থায়ী সাথী কেউই হবেনা। কিছু দূর গিয়ে লতার মতো কাউকে নির্ভর করি,তাকে একান্তই আপন ভেবে এগিয়ে চলি। যে হাতটা ধরি সেই হাতটা অদৃশ্য আর একটা হাত এসে ছাড়িয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। একটা পথ আমাকে আজ জীবনের প্রান্ত দেশে এনে দাঁড় করিয়েছে। তার সাথে আমার কলেজের পথ অর্থাৎ গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের প্রবেশ পথের কোনো মিল নেই।
সেই পথে বনগাঁ, চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর থেকে বন্ধুরা যেমন আসতো, ঠিক তেমনি ভাবে আসতো অশোকনগর, হাবড়া, মছলন্দপুরের বন্ধুরা। এখন হঠাৎ কখনো সেই পথে গেলে এস ওয়াজেদ আলীর আঁকা ছবি চোখে পড়ে। চেনা মুখগুলো আর নেই। বদলে গেছে চুলকাটার ডিজাইন। উধাও হয়েছে বেল বটম প্যান্ট। রবীন্দ্র সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে চটুল হিন্দি গানে।
প্রচন্ড গ্রীষ্মের দাবদাহেই হোক বা অবিশ্রান্ত বর্ষায় কিম্বা হালকা শীতের দিনে এই পথের রঙ বদলে যেত। পথের ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য ছোটো বড়ো দোকান। ছিল বহু রঙ বেরঙা ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক টাউন হল। কলেজ জীবনে দুই চোখের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। ক্লাসরুমে শব্দেরা আকার নিত।বাইরে রিমঝিম ভরা দুপুর। কলেজ গেটের বাইরে পড়ে থাকত দীঘল বর্ণময় সাপের মতো আঁকাবাঁকা নিরব নিস্তব্ধ এক পথ। চোখে স্বপ্ন, মনে ইচ্ছা আর অদম্য সাহসকে ভর করে তিলে তিলে এগিয়ে চলছিল জীবন। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির দুরত্বে সব আশা বোধ করি দুরাশায় রূপ নেয়। যদিও এটা একান্তই আমার মত। সব পথই যেন এগিয়ে চলেছে 'টাওয়ার অব সাইলেন্সের" দিকে। যেখানে গুমরে মরে হাজার না বলা কথারা। তাই কবিগুরুর ভাষাতেই বলতে চাই, " কোন দুরাশার সন্ধানে তা কে জানে তা কে জানে।.... এ পথ গেছে কোনখানে তা কে জানে তা কে জানে। "
No comments:
Post a Comment