`পথে যেতে যেতে....`
বাসে পাশে
লিপিকর
একই সময়ে একই এলাকার কর্মালয় থেকে মুক্তি মেলে দুজনের, প্রত্যহ না হউক, প্রায়শ:ই প্রত্যাবর্তনের পথে চারিচক্ষুর মিলন ঘটে, আলাপচারিতার সৌজন্য পার হয় দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, দশকও বা। দেখা হইলে সমাজের অব্যবস্থা, দুর্নীতি, বাসচালকের রূঢ়তা, কন্ডাক্টরের খুচরো-না-দিবার-অনাবশ্যক-কলহ ইত্যাকার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্যেই সাধারণত: বাস আসিয়া পড়ে। “কেমন আছেন?”, “কতক্ষণ?” ইত্যাদি আলাপচারিতার মাঝেই একদিন মেয়েটির কপালে রক্তিম শৃঙ্খল চোখে পড়ে, আরও সময় বহিলে ছেলেটির কেশরাশি একটু ঈকটু করিয়া শ্বেতাভ ও হ্রস্ব-সংখ্যক হইতে থাকে। বাসে উঠিয়া মেয়েটি সম্মুখের কোনো একটি আসনে গিয়া বসিয়া পড়ে, ছেলেটি পশ্চাতের গবাক্ষের নিকটস্থ একটি বিশেষ আসনের দিকে ধাবমান হয়, পাইলেই ব্যাগ হইতে কোনো একটি রহস্যকাহিনী নিষ্কাশন করিয়া তাহাতে ডুবিয়া যায়, সমস্তদিনে ঐটুকুই তাহার বিনোদন, অবকাশ, মুক্তি, সে একটি বাস ছাড়িতেও এজন্য দ্বিধা করে না। মেয়েটিও বসিবার স্থান না পাইলে অধিকাংশ সময়ে ভীড় বাস ছাড়িয়া থাকে, গদির মোহমার্গে তাহারা একই পথের পথিক।
দীর্ঘ সহযাত্রায় তাহারা পরস্পরের বাসস্থানের অঞ্চল সম্বন্ধে জানিয়াছে। প্রভাতে আপিস যাইবার কালে তাহাদের গৃহত্যাগে যে দুই ঘণ্টার ফারাক, তাহাও কথোপকথনে প্রকাশ পাইয়াছে। ফিরিবার সময়ে মেয়েটির গন্তব্য আগে আসে, চারিচক্ষু মিলিত হইলে দুজনেই সামাজিকতা রক্ষার মুখব্যাদান করিয়া থাকে, ঐটুকুই।
ক্যালেন্ডার উঠিয়া সবকিছু কম্পিউটার-চালিত হইয়া গেল ক্রমে-ক্রমে, মনিব পরিবর্তন না করিয়াও শুধু একই কর্মাবাসে থাকিবার নিমিত্ত ছেলেটিকে যে পরিমাণ শ্রম করিতে হইল শেষ কয়েক বৎসর, তাহাতে চাহিলে উচ্চতর বেতনের চাকুরি জোগাড়ও হয়তো করিয়া ফেলা সম্ভব হইত। কিন্তু অতীত লইয়া ভাবিয়া সবকিছুর সামাধান হয় না, ছেলেটির দীর্ঘ কর্মজীবন সমাপন হইবার উপক্রম হইয়াছে। ক্লান্তিকর দৈনন্দিনতার বাকী দিনগুলি যখন কমিতে কমিতে অঙ্গুলির কড়ে গণিবার উপযুক্ত হইল, তখন একদিন বাসে দুইজনের দেখা হইল। এখন বাসের আসনবিন্যাস পালটাইয়াছে, কোথাও বসিয়াই ছেলেটি সুখে বই পড়িতে পারে না, আজ সে মেয়েটির পার্শ্বে উপবেশন করিয়া মেয়েটির সঙ্গে গল্পে ইচ্ছুক হইল। দেখা গেল, মেয়েটিও কথাবার্তায় উৎসুক। ছেলেটি মেয়েটিকে আশু অবসরের বার্তা জানাইতে সে উপযাচক হইয়া ছেলেটির দুরভাষ সংখ্যাটি চাহিয়া লইল, শীঘ্রই মেয়েটির একমাত্র পুত্রের বিবাহ, ছেলেটিকে সে অনুষ্ঠানে সপরিবারে আসিতে হইবে। ছেলেটি আর তাহাকে বিব্রত করিতে চাহিল না এই বলিয়া যে, সে জীবনেও দার পরিগ্রহ করে নাই, বরাবরই সে একলা থাকে। মেয়েটি সংখ্যা টিপিয়া মিসড কল দিয়া কহিল, “আমার ফোন নাম্বার-টাও নিয়ে রাখুন।”, ছেলেটি নিজ যন্ত্রের পর্দায় সেটি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী নামে সেভ করবো?”
এক প্রৌঢ় ও এক প্রৌঢ়া সহসা আবিষ্কার করিল, তিন দশকের সহযাত্রায় প্রায়-প্রাত্যহিক প্রতীক্ষার অব্যক্তিগত আলাপে তাহারা পরস্পরের নামটুকুও জানিয়া উঠিতে পারে নাই।
No comments:
Post a Comment