`সময়ের পথে....`
সেই প্রিয় পথ
বিশ্বজিৎ সাহা
ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটা ছুঁই ছুঁই।রোজকার ব্যস্ততাময় স্কুল শেষে আমি তখন বাড়ির পথে। রোজ শহরের মূল সড়ক ধরেই বাড়ি ফিরি।সে পথে আমার স্কুল থেকে বাড়ির দুরত্ব মেরেকেটে পাঁচ কিমি। স্কুল সংলগ্ন ভাংনী মোড়ে এসে কি মনে হল, হটাৎ গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন করে শহরের ব্যস্ত রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরলাম। এই গ্রাম্য রাস্তাটি ধরে ভাংনী মোড় থেকে ভাংনী মন্দিরের পাশ ঘেঁষে আমার বাড়ি অব্দি আসা যায়।
শহর যেখানে তার সীমানা শেষ করে , সেখানেই আমাদের বাড়ি। আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে খানিকটা শহরের বিপরীতে গেলেই সবুজে মোড়া গ্রাম , গ্রাম্য পথ তার সহজাত সব গুণ নিয়ে বিরাজমান।আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে এই গ্রামের সুড়ি পথ ধরে ঘুরে , এই গ্রামের সব খেলার মাঠ-জমিতে খেলে, এই গ্রামের সব পুকুর-ডোবায় স্নান করে।এই পথটি সর্বত্র আমার ছেলেবেলাকে ধারণ করে আছে।শৈশবের সেই মধুমাখা দিনগুলো মিশে আছে এই পথের ধূলিতে।
পূর্বে এই গোটা রাস্তাটি ছিল মাটির ।দুপাশে সবুজ ঘাসের মাঝে কোনো রমণীর মাথার সিঁথির মত পথ বয়ে যেত।বর্তমানে রাস্তায় পিচের আস্তরণ পড়েছে।
পথে প্রথমে চোখে পড়লো একদল কচিকাঁচা সদ্য কাটা ধানক্ষেতে ব্যাট বলে মত্ত।জমির যে জায়গাটাতে ওরা পিচ বানিয়েছে সেটুকু ছাড়া বাকি মাঠটির ইতিউতি কেটে নেওয়া ধানের অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে । থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।শীতের প্রায় প্রতিটা বিকেল আমাদের কাটতো এই গ্রামের এমনি কোনো মাঠে। খালি পায়ে ধানের গোড়ার খোঁচার সেই মধুর ব্যাথাটা অনুভবে ফিরে এলো। দেখতে পারছিলাম আমার ছেলেবেলার বন্ধু অমিত আমার দিকে বল নিয়ে এগিয়ে আসছে, দেখতে পাচ্ছিলাম কে আগে ব্যাট করবে তা নিয়ে আমাদের হট্টগোল, দেখতে পাচ্ছিলাম খেলা শেষে জমির আলে বসে আছে রতন, অভিজিৎ, পিন্টু, বাপ্পা , গোরাদের।কে বলে সময়ের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে না!স্মৃতির ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে আরো খানিকটা এগোলাম।
না আর এগোতে পারলাম না। যন্ত্রযান কোনো এক মন্ত্রবলে দাড়িয়ে গেল।যেখানে দাড়ালাম সেখানে দুদিকে আদিগন্ত বিস্তৃত জমি।মাঝে নতুন পিচ ঢালা রাস্তা যেনো তার কপালে কাটা কালো তিলক। ইতি-উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছগুলো হাত তুলে দাঁড়িয়ে। যেন করার কিছু নেই, তাই চুপচাপ ওভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো অপেক্ষা করছে নতুন কোনো বর্ষার, হয়তো অপেক্ষা করছে তার কোটরের নিবাসী কোনো কপোত- কপোতির ঘরে ফেরার।
ধোঁয়াটে কুয়াশার আলগা পরত সর্বত্র। যেনো নেশাতুর হয়ে আলতো করে ছুঁয়ে রয়েছে চরাচরকে। তার স্থবিরতা যেন কোনো প্রাচীন ঋষির ধ্যানমগ্নতা।
জমির বর্ণ বেশিরভাগ জায়গায় হলুদাভ। কোনো কোনো জায়গায় কেটে নেওয়া ধান এখনো জমিতে অপেক্ষমান।কোথায় আবার ধান তোলার পর পড়ে রয়েছে ধানের নেরা। কোথাও জমি সদ্য কর্ষণ করা হয়েছে, নতুনের আশায় বুক বেঁধেছে সে।
দূরে একটি ট্রাক্টর একটি জমিতে অনবরত একই পথে আবর্তিত হচ্ছে।বিরাম নেই, গতিপথের পরিবর্তন নেই। যেন আমাদের পৃথিবীর মতোই কালের নিয়মে সেও বাধা ।তার যান্ত্রিক শব্দ মিশে যাচ্ছে বাতাসে।
খানিকটা দূরে ঘন বাঁশঝার। কমে আসা আলোতে তার রং সবুজ থেকে কালো ঠেকছে।সেই বাঁশবন থেকে ভেসে আসছে পাখপাখালির কিচিরমিচির। কোনো লয় নেই, তাল নেই ,তবু তা মধুর।ঘটমান বিশ্বের বহমান জীবন থেকে অনেক দূরে নিজেদের মত করে নিজেদের নিয়ে মত্ত ওরা।
দূরে কে যেন শুকনো পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। তার কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া হেলতে দুলতে আকাশ পানে পাড়ি দিচ্ছে। কোনো তাড়া নেই তার। এভাবেই বিলীন হয়ে যাবে সে।
গ্রামের কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কিছু গানের কলি। অনেকটা দুর থেকে আসছে বলে তার প্রাবল্য চরাচরের সঙ্গে মানানসই ।
আরো খানিকটা এগোতেই পৌছালাম মাষানপাঠে। এই এলাকাটির চারধারে পুকুর, মাঝে এই ছোট্ট মাষান মন্দির।আর এই মন্দিরের ঠিক পেছনে একটা সুবিশাল বট গাছ।এই পুকুরগুলোতে ছেলেবেলায় দাপাদাপি করে বেড়াতাম।।মনে পড়ছিল এই গ্রামের মাঠে ফুটবল খেলা শেষে দল বেঁধে নেমে যেতাম পুকুরে, সেখানেও ফুটবল নিয়ে একপ্রস্থ খেলা চলতো আমাদের।
খুব ছোট্টবেলায় বর্ষাকালে বৃষ্টি একটু বেশি হলেই আমরা সদলবলে উপস্থিত হতাম এই পুকুরধারে । তখন জলের তোরে কোনটা জমি আর কোনটা পুকুর ঠাহর করা দুষ্কর ছিল। দুপাশে জলাভূমির মাঝে শুধু জেগে থাকতো সেই পথটি।বয়সে বড় ছেলেরা জাল নিয়ে লেগে পড়তো। আমি অপেক্ষা করতাম একটা রূপচাঁদা মাছের জন্য।সবাইকে বলে রাখতাম কারো জালে সেই রঙিন মাছটি উঠলে যেন আমায় দেয়। তারপর কচুপাতায় জল নিয়ে তাতে মাছটি রেখে ছুট দিতাম বাড়ির পথে। পুরানো বোতলে জল ভরে ছেড়ে দিতাম সেই রঙিন রূপচাঁদা মাছ। তারপর রোজ নিয়ম করে তাকে খেয়ে দিতাম, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম সেই ছোট প্রাণটির দিকে।সেই বোতলে তার হুটোপুটিতে দোলা লাগলো আমার কচি মনে।
স্মৃতিতে ভির করলো আজ সেই ছেলেবেলা।
সবটা মিলে একটা আচ্ছন্নতা আবেশে জড়িয়ে নিয়েছিল আমায়। কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে তো!
সুবাসিত সন্ধ্যার ঘ্রাণ নিতে নিতে তাই এবার এগিয়ে চললাম, সময়ের দিকে।
No comments:
Post a Comment