শহর ও গ্রাম : এক অদৃশ্য কাঁটা তারের বেড়া
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আপনি মন্দিরের ওপরে উঠুন বাবু, সেখান থেকে ভালো ছবি তুলতে পারবেন।
পিছনে ফিরে দেখলাম আশি উর্ধ একজন বয়স্ক মানুষ, তার দুই চোখে জলের ধারা।
জলপাইগুড়ির ঐতিহাসিক বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ীতে চলছে মনসাপূজার মেলা রাজবাড়ীর দুর্গোৎসবের মতোই জনপ্রিয় এই মনসাপূজা। রাজবাড়ী দিঘির ধারেও শিবের মন্দির সংলগ্ন অম্বিকা মায়ের মন্দিরেও মা মনসার মূর্তি রয়েছে। সেখানেও চলছে মনসাপূজা। বৈকুন্ঠপুরের প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেন বৈকুন্ঠ দেব অর্থাৎ দেবাদিদেব মহাদেব বা শিব। শিবের মানস কন্যা পদ্মাই হলেন মা মনসা। প্রায় পাঁচ'শ বছর ধরে শ্রাবণী সংক্রান্তিতে এই পুজো হয়ে আসছে। মহাদেবের বড়ো কন্যা নেতা। এই মন্দিরে তাঁর বিগ্রহ ও সাড়ম্বরে পুজো করা হয়।
শহর, শহরতলী এবং দূর দুরান্ত গ্রাম থেকে মানুষ আসেন এই মেলায়। প্রায় সাত দিন ধরে চলে এই মেলা তবে তিন দিন খুবই জমজমাট থাকে এবং ভিড় উপচে পড়ে।
দূর্গা দেউল সংলগ্ন মনসা মন্দিরের চাতালের ওপরে বেহুলা লখিন্দরের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। মনসা মঙ্গলের গানের তালে তালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠান। শ'য়ে শ'য়ে মানুষের ভিড় ঠেলে মন্ডপে উঠে দেখলাম আমি ছাড়া সবারই চোখে জল। তারা সবাই আবেগঘন মুহুর্তের আবেশে ডুবে রয়েছেন। আমি গোটা কয়েক ছবি তুলে নামতেই দেখা হল মন্দিরের পুরহিত শিবু ঘোষালের সাথে। তিনি জানালেন আজ এখানে উপস্থিত সকলেই বেহুলা লখিন্দরের বিয়ে উপলক্ষে পাত পেড়ে খেয়েছে। ভিড়ের মধ্যে একজন বলে উঠলো, "আপনারা শউরে বাবু এর মর্ম বুঝিবেন না হয়।"
ইতিমধ্যে এককাপ ধূমায়িত চা আমার সামনে চলে এসেছে। সেটা কার ঈশারায় বলতে পারব না। ধীরে ধীরে মেলায় জনসমাগম হচ্ছে।চলছে আদর্শলিপি, বর্ণ পরিচয় ধারাপাত থেকে ঘর গৃহস্থালীর নানান সামগ্রী। জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর যে দিকটায় জনশূন্য এবং হোয়াইটওয়াস করা হয় না, সেখানে একটা চেয়ারে বসে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন আমরা নিয়ম মেনে মনসা পুজোর উপোস করি। কিন্তু শহরের মানুষ আজ বেশি করে বিরিয়ানি খাবে। সব থেকে বড়ো কথা শিবচতুর্দশীর দিন "রাজি বিরিয়ানির " দোকানে রাত ১২ টায়ও একবার বিরিয়ানির হাঁড়ি চাপাতে হয়। আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ভদ্রলোক বললেন আমরা গ্রামের মানুষ টেলিভিশন দেখি না। কারণ টেলিভিশন বড়ো লোকের। টেলিভিশনের খবরে কখনো দ্রব্য মূল্য নিয়ে খবর হয় না। অনেক জটিল কুটিল গল্প নিয়ে ধারাবাহিক আর দামী দামী ভোগের জিনিসপত্রের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের খবরে আমাদের মতো গরীব মানুষের কি লেনা দেনা? এই যুদ্ধ চলাকালীন বাজারের পঁচাত্তর টাকার ছাতুর প্যাকেট নব্বই টাকা হয়ে গেল। সরষের তেলের প্যাকেট কেউ নিচ্ছে একশো দশ টাকা তো কেউ নিচ্ছে একশো চল্লিশ টাকা। কেউ জানতে চায় না জিনিসপত্রের দাম এমন উর্ধমুখি কেন। কেন এক দোকানের ৩৫ টাকার জিরের গুড়ো অন্য দোকানে ৪৯ টাকা। আমরা সারাদিন ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গতর খাটিয়ে ৩০০ টাকা পাই। ঢেকি শাক রান্নার জন্য তেল জোটে না। ছেঁকা পলকা, সিদ্ধ খাই। আমরা চায়ের পাতা সিদ্ধ করে সেই ঝোল দিয়ে ভাত খাই। আর শহুরে বাবুরা চা পাতার নির্জাস থেকে তৈরি ফেস ওয়াস দিয়ে মুখ পরিস্কার করে। শহরে শপিং মলগুলোতে ভোগ্যপণ্য উপছে পড়ছে। আমরা মেলায় কেনাকাটা করি। এই মেলাই আমাদের মল। আমি অবাক হয়ে তার গ্রাম শহরের এই অদৃশ্য কাঁটা তারের বেড়া নতুন করে উপলব্ধি করলাম। মন্দিরে গান গেয়ে চলছে , "মাঝ রাতে কাল নাগিনী দংশায় লখিন্দরে রে...." জানি না কখন যেন আমারও চোখের পাতা ভিজে উঠেছে।
No comments:
Post a Comment