আমার শহর
অনিতা নাগ
ট্রেনের ফার্ষ্টক্লাস কুপে তখন তারা দু'জন। দুর্রন্ত গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। জম্মুতাওয়াই এক্সপ্রেস। জানলায় চোখ রেখে আনমনা সেই মেয়ে। বহুদিনের বহু বাধা পার হয়ে তাদের বিয়ে। কতো লড়াই, কতো বিরোধ, কতো বাধা। শেষ পর্য্যন্ত জয়ী হয়েছে তাদের ভালোবাসা। এখনো স্বপ্নের মতো লাগে। হাতের শাঁখা-পলা, সিঁথির সিঁদুর মনে করিয়ে দেয় আজ এটাই সত্যি। আজ তারা দুজন চলেছে তাদের জীবনের নতুন সফরে। তার প্রিয় শহর কলিকাতা থেকে অনেক দূর, সুদূর উত্তরপ্রদেশের এক ছোট জনপদে। হ্যাঁ, তখন সেই শহরের নাম ছিলো কলিকাতা। তখনো পিনকোড যোগ হয় নি। বাড়ীর ঠিকানায় বড় বড় করে লিখত কলিকাতা।
অন্য শহর সম্বন্ধে অতো জানা ছিলো না সেই মেয়ের। জানার ইচ্ছেও ছিলো না। তার প্রিয় সেই শহরে প্রাণ ছিলো, গান ছিলো, খোলা হাওয়া ছিলো। পাড়ায় কাকা, জেঠা, দাদুরা ছিলেন। জেঠী, কাকী, ঠাম্মারা ছিলেন। শাসন ছিলো, সোহাগ ছিলো। গাদী, পিট্টু খেলা ছিলো, তেঁতুল চুরি করে খাওয়া ছিলো। দাদাদের সাথে সূতোয় মাঞ্জা দেওয়া ছিলো, লাটাই ধরা ছিলো, তুবড়ির মশলা করা থেকে পোড়া বাজি তুলে এনে সেই মশলা দিয়ে ছূঁচো বাজি করে পোড়ানো, সবটা ছিলো। দুর্গা পূজোর প্যান্ডেলের বাঁশ পড়লেই সব খেলা ভুলে প্যান্ডেল তৈরী দেখা ছিলো, বাঁশ ধরে দোল খাওয়া ছিলো। আরো কতো কিছু ছিলো কলিকাতা শহরে। ভাদ্রের এমন দিনে শরতের আকাশ সেদিন’ও এমন আলো হয়ে থাকতো, কখনো এক পশলা মেঘ এসে ভিজিয়ে দিতো চারদিক। শরতের আকাশে তুলোর মতো মেঘ জমতো। ছোটবেলায় ভূগোলে অনেকরকম মেঘের কথা পড়েছিলো। এই তুলোট মেঘের কথা কখনো ভুল হতো না সেই মেয়ের।
কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। নিমেষে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে শহর থেকে গ্রাম। সবুজ গালচের মতো শষ্যক্ষেতকে পিছনে ফেলে ছুটে চলছে ট্রেন। ট্রেন যতো এগোচ্ছে ততো দূরে চলে যাচ্ছে তার শহর কলিকাতা। আজন্ম লালিত পালিত এখানে। তার প্রাণের শহর। বাংলা তার প্রাণের ভাষা। প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। তিনিও তো রয়ে গেলেন আলমারীর তাকে। পড়ে রইলো হারমোনিয়াম, ঘুঙুর, প্রিয় গল্পের বই, রয়ে গেলেন মা, বাবা, বন্ধুরা।
ট্রেনের কুপে কেউ বিরক্ত করার নেই। একটা রঙচঙে ট্রাঙ্ক, তিনটে সুটকেস, একটা হোল্ডঅল, জলের জায়গা, এই সব নিয়ে সেই মেয়ে চলছে নতুন সংসার সাজাতে। পথটা অনেক দূর তার শহর থেকে। ক্রমশঃ তার শহর দূরে সরে যাচ্ছে। কতো শহরকে ছুঁয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। নতুন নতুন শহর। নতুন ভাষা। যতো দূরত্ব বাড়ছে তার শহর থেকে, ততোই সেই মেয়ের বুকের মধ্যে উথাল পাথাল করছে। তার প্রিয় শহর, হাওড়া ব্রীজ, গঙ্গা, তাদের বাড়ীর ছাদ সব যেনো জড়িয়ে ধরছে সেই মেয়েকে। সন্ধ্যেবলায় তুলসীতলায় প্রদীপ হাতে তার মা’র চেহারাটা সামনে এসে দাঁড়ালো। কতো কথা হুড়মুড় করে জড়িয়ে ধরলো সেই মেয়েকে। নতুন সংসারের স্বপ্ন আর দু'চোখে হাজার প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে চললো নতুন যাত্রাপথে। শুরু হলো সেই মেয়ের জীবনের নতুন পর্ব।
সেই প্রথম তার নিজের শহর থেকে দূরে যাওয়া সেই মেয়ের। নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলা। মনে পড়ে প্রথম যখন তার শহরে ফিরলো সেই মেয়ে খড়্গপুর আসার পরে অপেক্ষা আর শেষ হয় না। তারপর ট্রেনের জানলা দিয়ে হাওড়া ব্রীজ দেখে সে কি আনন্দ। তার প্রিয় শহরকে যেনো নতুন করে পেয়েছিলো।
তারপর দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে। ততোদিনে কতো পালাবদল ঘটেছে প্রিয় শহরের। কলিকাতা থেকে কলকাতা হয়েছে। পিন কোড যোগ হয়েছে। হারিয়ে গেছে পোষ্টকার্ড, ইনল্যান্ড এর রূপকথারা। হারিয়ে গেছে ট্রাঙ্ককল, টেলিগ্রামের জমানা। ল্যান্ডফোন প্রায় অবলুপ্তির পথে। নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলা। চৌত্রিশ বছর পর যে শহরে ফিরলো সেই মেয়ে, তা একেবারে আমূল বদলে গেছে। বদলটা এতো বেশী যে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিলো সেই মেয়েকে। সেই বদলে যাওয়া শহরে কেটেও গেলো বেশ অনেকগুলো বছর। ইচ্ছে হলেও জায়গা বদলের উপায় নেই। সবই আছে, তবু আজ ভালোবাসার শহরে দম বন্ধ হয়ে আসে। কান পাতলে নিঝুম রাতে কল্লোলিনীর কান্না শোনা যায়। গুমরে কাঁদে আজ তার ভালোবাসার শহর কলকাতা। এতো জাঁকজমক, এতো আভরণের আড়ালে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। চারদিকের কংক্রীটের ভীড়ে আকাশকে ছুঁতে পারেনা। কল্লোলিনী আজ নিজেকেই চিনতে পারে না। বদলে যাওয়া জীবনের চাপে, রঙ মেখে, সঙ সেজে সে বয়ে নিয়ে চলে আমার ভালোবাসার শহরকে। যা হারিয়ে যায় তাকে সযতনে আগলে রাখে সেই মেয়ে। কল্লোলিনীর কানে কানে বলে ভালো থেকো আমার প্রিয় শহর। জগত সভা আবার তোমার আলোয় আলোকিত হবে একদিন। সেই অপেক্ষায় থাকে সেই মেয়ে।
No comments:
Post a Comment