মুজনাই
অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১
গল্প
ফোনে চার্জ ছিল না..
পর্ণা চক্রবর্তী
বাইরেটা যত নিস্তব্ধ হয়ে উঠছিল তত বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল ওদের দুজনের। একজন জানলায় দাঁড়ায়, অন্যজন ফোন দেখে । দুজন উৎকর্ণ হয়ে শোনে রাস্তা থেকে আসা বিভিন্ন শব্দ। কেউ কি গেটটা খুলল? ওই তো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । গেটের ধার ঘেঁষে ফুটপাতে দাঁড়ানো বিরাট ঝাঁকড়া গাছটা শীত আসছে বলে রোজ অজস্র পাতা ঝরিয়ে রাখে। হীমকালে ও সমর্পণে থাকে রিক্ত ,নিঃস্ব হয়ে। আগামী মধুমাসে আরো সবুজ সুগন্ধিত হয়ে ওঠার জন্য গাছটার যেন নিঃশ্চুপ এক সাধনা।
ঝরা পাতার ওপর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসছে না আলতো পায়ে …?
দুটো মানুষ ছুটে যায় , দরজা খোলে, না কেউ নেই তো, শুনশান রাস্তা। আশেপাশের বাড়িগুলো ঝিমোচ্ছে।
আকাশে আজ অনেক তারা । অন্যদিন হলে ছাদে উঠে নতুন কোনো তারা খুঁজত দুজনে মিলে কিন্তু আসল সঙ্গীই তো নেই,একজন মাথা হেলিয়ে আকাশ দেখে আর ভাবে। অন্যজন তাঁকে ডাকে,”ভেতরে চলো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
আবার একজন জানলায় মুখ ঠেকিয়ে বাইরে দেখে আর অপর জন মোবাইল। ক্লান্তি শরীরকে জাপটে ধরেছে। বুড়ো চোখে ঘুম নামতে গিয়েও নামতে পারেনা। বুকটা আবার ধড়াস করে ওঠে একটা আওয়াজে। রিকশা এসে থেমেছে।তবে কি এলো এতক্ষণে? আবার দরজা খোলে, নাহ্ পাশের বাড়ি।
রাত আরেকটু বেড়েছে।ছোটো শহর তলী, রাত এখানে তাড়াতাড়ি নামে।
দুটো প্রৌঢ় মানুষ বোবা হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। একজন বাবা আর আরেকজন মা। ওদের বুকের ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা একটা ভয় হাত পা ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিশাল হতে থাকে ক্রমশ। উৎকণ্ঠায় ওদের গলা শুকিয়ে আসছে । রাত হলেই ইদানিং একটু করে ঠান্ডা পড়া শুরু হয়েছে। তবুও বাবার কপালে ঘাম জমছে। মা মনে করার চেষ্টা করেন ,”আজকে সব ওষুধ গুলো ঠিক করে খেয়েছি
তো ?” বুকটাতে কেমন চাপ লাগে, ভালো করে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা শরীরটা।
“ তুমি খাবে চল।”
বাবা মাথা নাড়ছেন, “না না আগে বাড়ি ফিরুক তারপর। তুমি বরং একটু শোয় গিয়ে ,ও ফিরল পরে ডেকে দেব।”
“আর ঘুম! “ মা আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ান।
বাবা লাস্ট পাঠানো মেসেজটা ভালো করে পড়েন। মেয়ে লিখছে ট্রেনের কি গণ্ডগোল ,কোথায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।অনেক ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। লিখেছে,ফিরতে দেরি হবে চিন্তা করোনা।
আবার পড়েন। চিন্তা হবে না? দু ঘন্টার বেশি হয়ে গেল ফোনটা সুইচ অফ বলছে
“ হ্যাঁ গো ফোনের সুইচ তো অফ বলছে , চার্জ নেই না কি?” মা জানলা থেকে একটু সোফায় গিয়ে বসেছেন বাবার কথা শুনে কি একটা ভাবলেন তারপর বললেন
“ লাস্ট যখন কথা হলো ,চার্জ কম এমন একটা কি বলেছিল।সেতো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।” দুজনে আবার দুজনের দিকে তাকায়।কেমন লাগে শরীরটা। কিচ্ছু ভালো কথা মনেই আসে না।
বড্ড ভয় করে ,মাথা ঘোরে। সেই কখন বিকেলে দুটি মুড়ি আর চা খেয়েছিলেন দুজনে। বারোটা বাজতে চলল,পেট খালি। বাবা উঠে এক গ্লাস জল খান, টিভিটা চালিয়ে, আওয়াজ আস্তে করে খানিক দেখেন আবার উঠে পড়েন।
“একটু শান্ত হয়ে বসো তো।
অসুবিধা কিছু হয়েছে,ঠিক চলে আসবে।” ভীষণ অস্থির মনটাকে সামলাতে সামলাতে মা বলে ওঠেন। “কিন্তু এত রাতে স্টেশনে রিকশা অটো কিছু পাবে? হেঁটে আসবে?”
প্রশ্নটা নিবিড় অন্ধকারের মতো ওদের মুখের সামনে ঝুলে থাকে। পরস্পরকে কি বলবে, কি বললে একটু স্বস্তি পাওয়া যায় সে সব খুঁজতে খুজতে মা কেঁদে ওঠেন।
“ বড্ড চিন্তা হচ্ছে ,এত রাতে কাকে ফোন করব?” বাবা মাথা নাড়েন, “আরেকটু দেখি।”
“কী দেখব? বললাম তো,” বাবা ভাবছেন, “পুলিশের কাছে যেতে হবে। কী করবে ওরা ? যদি অ্যাক্সিডেন্ট কিছু হয় …আর যদি একলা মেয়েটাকে এত রাতে কেউ ….”।
চোখের সামনে একটা রক্তাক্ত দুমড়ে যাওয়া চেহারা ভেসে ওঠে। বাবা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন।
“ কী সব ভাবছি দূর!”
“কত বললাম, তুই অফিসের কাছে ভাড়া নিয়ে থাক। রোজ এতটা যাতায়াত.?” মার গলাটা কাঁপছে।
মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো । নামকরা কলেজে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়ল ,ভালো রেজাল্ট করল। আইটি সেক্টরে ওর অফিস। বহুজাতিক কোম্পানি,তাদের ভালো মাইনে। মেয়েটা যে কি খুশি। কত কষ্ট করে বাবা ওকে পড়িয়েছেন। প্রথম দিকে জমি, মায়ের গহনা এসব বেচতে হয়েছে। পরে মেয়ে লোন নিয়ে আরো পড়ল। চাকরি করে একটু একটু করে লোনও শোধ করছে। বাবা মাও খুব খুশি। অতি সাধারণ অবস্থা ,সাধারণ চাকরি বাবার। পৈতৃক বাড়িটা ছিল তাই। বাবার ইচ্ছা অবসর নেওয়ার পর আরো কোনো কাজ করবেন । ওই টুকু মেয়ে কত পারবে। মেয়ে বলল “না,আর না। এবার আরাম করবে অনেক কষ্ট করেছ।” বাবার মুখটা আলোয় ভরে যায় ,”আমার মেয়ে,বড্ড ভালো।” বাবা মাকে সব আনন্দ দিতে চাইবে, নিজেদের যেসব শখ আহ্লাদ মেটাতে পারেন নি ওরা, সেগুলো উজাড় করে দেবে।
“তুই বিয়ে করবি না ?”
“এখন কি, দাঁড়াও, আগে একটু জমিয়ে নি।”
“আর জমিয়েছিস, যা তোর খরচের বহর।”
মা হাসেন। রোগা,যত্নহীন ফ্যাকাশে চেহারা স্বর্গীয় সুষমায় ঝলমল করে ওঠে।
রাত আরো নিশুত হলো।
মা মরিয়া হয়ে বলেন,”চলো স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াই ,না হলে পুলিশের কাছে চলো। আর পারছি না।” ডুকরে কান্না আসে। সেক্টরে ফাইভে সেদিনকে একটা লোক এক তরুণীর সাথে..
কাগজে খবর বেরিয়েছিল।
“আচ্ছা ও যখন মেসেজ করল তখন কি ট্রেনে উঠে পড়েছে?”
বাবা তাকিয়ে আছেন…বলতে পারছেন না ।
“ আর তোমাকে তো তার আগে ফোন করেছিল তখন কি ও ট্রেনে ?”
“না,না ট্রেনের গণ্ডগোলের কথা তো পরে জেনেছে। চার্জ নেই তেমনই বলল মনে হয় … কি জানি মনে পড়ছে না কিছু।” খুব অসহায় লাগে মায়ের।
পাশের ঘরে এক অসুস্থ বৃদ্ধা ঘুমোচ্ছেন বলে ,মা চিৎকার করে কাঁদতে পারছেন না। চোখ বুঁজলে কালো, কালো কতগুলো এলোমেলো ছবি আসছে।
আচ্ছা যদি ফাঁকা ট্রেনে মেয়েটা কে একলা পেয়ে… এমন তো চারপাশে কত হচ্ছে।একের পর এক সার দিয়ে আসতে থাকে ভয়াবহ সব ছবি। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন ।বাবা দরজা খুলে একফালি বারান্দাতে বসে থাকেন চুপ করে । আকাশে জ্বলজ্বল করছে একটা তারা। আজকে কোন একটা গ্রহের যেন পৃথিবীর খুব কাছে আসার কথা। নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না বাবার । ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। গেটের পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকা গাছটাকে বড্ড রোগা দেখাচ্ছে। সেই ছোটো থেকে কেমন ধীরে ধীরে বড় হলো। কত ফুল ফুটতো । এখন কেমন ন্যাড়া হয়ে গেছে। গাছটাকে দেখে মায়া লাগে বাবার। কি যেন নামটা .…..গাছের নামটাও বাবার মনে পড়ে না।” সব কেমন ভুলে যাচ্ছি,, বয়স হচ্ছে বলে?” মেয়েটাও খুব গাছ ভালোবাসে। ছাদে কত গাছ রাস্তার কুকুরগুলোকে কত সেবা,যত্ন করে। আমার মেয়েটার শেষে……
হে ভগবান … বাবার বুকের ভেতরটা ফুঁপিয়ে ওঠে ।
শীত নামছে। ক্লান্তিতে বাবার চোখ দুটো খালি বুঁজে আসে। মা মাটিতে বসে, মাথা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। সারাদিন খাটনির শেষ নেই।অসুস্থ বৃদ্ধার সেবা, রান্না। মেয়েটা রোজ বলে ,”একটা লোক রাখো। আমি এখন চাকরি করি মা।”
রাজী হন না মা। কত কষ্ট করে রোজগার করে মেয়েটা।কোন সকালে উঠে ট্রেন ধরতে ছোটে । চোখদুটো লেগে আসে।আবছা ঘুমের মধ্যে
মেয়েটা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, কাছে আসে, গালে হাত রাখে। মা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন। কটকট করে টিউব লাইট জ্বলছে, দরজা হাট করে খোলা । বারান্দার চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন বাবা, অপলক।
“ওঠো ওঠো একটা বাজে।
আমি আর অপেক্ষা করব না। ফোনের সুইচ এখনো অফ। পুলিশে চল, গ্রিলে তালা দাও। মা ঘুমোচ্ছেন, ডেকোনা।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মা হাঁপান। বাবা চটি পড়ছেন ভাবছেন এত রাতে পুলিশে না গিয়ে যদি ফোন করলে …,কি জানি ফোন নাও ধরতে পারে, আর কাউকে বিশ্বাস হয় না।
“এত রাতে হেঁটে যাবে? পারবে?”
“পারব ,পারব।” মা গেটটা খুলে ফুটপাতে দাঁড়ালেন।
কারা যেন আসছে না এদিকে? রাস্তার টিমটিমে আলোয় খানিক দূরে থাকা চেহারাগুলো স্পষ্ট নয়। “শুনছো এদিকে এসো তো, তাড়াতাড়ি,”
বাবা ছুটে এলেন।
চেহারাগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
চারটে ছেলে মনে হচ্ছে, সাথে দুটো মেয়েও আছে বোধ হয়। ওদের মধ্যে কে একজন খুব দ্রুত পায়ে প্রায় ছুটে আসছে বাবা মাকে দেখে। ছিপছিপে,লম্বা ,পিঠে ব্যাগ প্যাক, চশমার কাঁচে আলোর প্রতিফলন।
মা ….জড়িয়ে ধরেছে মাকে। মা বসে পড়েছেন গেটের সামনেই। থরথর করে কাঁপছেন।
“আমার চার্জ ছিল না ।”
অন্য কারুর ফোন থেকে তো একটু জানাবে, বাবার গলাটা খুব দূর্বল শোনায়।
“মুখস্থ নেই যে।” অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চারটে ছেলে,ওরা ওকে পৌঁছে দিতে এসেছে। সঙ্গে আরেকটি মেয়ে,সামনেই বাজারের কাছে থাকে ,ওকে পৌঁছে তারপর ওরা আরেকটু দূরে নিজেদের বাড়ি ফিরবে। ছেলেগুলো কেউ প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে, কেউ ব্যবসার কাজে কলকাতায় যায়, কেউ কলেজের স্টুডেন্ট। এক সাথে রোজ যাতায়াত করতে গিয়ে বন্ধু হয়ে গেছে। মা বলছেন,” এসো না বাবা একটু জল অন্তত খেয়ে যাও।” “আরেক দিন আসব মাসীমা।
দিদিকে পৌঁছে দিলাম। এত রাতে একা ,যা দিনকাল। আসলে এতটা যে দেরী হবে বুঝতে পারিনি।এই দিদিকে পৌঁছতে হবে। আরেকদিন আসব।” ছেলেগুলো চলে যাচ্ছে ।ওদের ছায়ারা নেচে নেচে চলেছে ওদের সাথে।একটু সামনে হাঁটছে অন্য মেয়েটা। বাবা দাঁড়িয়ে দেখছেন একটা আশ্চর্য্য সুন্দর দৃশ্য । গভীর রাতে আলোআঁধারি পথ ধরে হাঁটছে যেন চারটে আলোক শিখা। আকাশে সেই তারাটা একা একা খুব উজ্জ্বল হয়ে আছে। হট করে নামটা মনে পড়ে গেল বাবার, বুধ, হ্যাঁ বুধ গ্রহই তো। আবার কত হাজার বছর পর এমন ভাবে কাছ থেকে ওকে দেখা যাবে। গেটের কাছের গাছটা থেকে দমকা হাওয়ায় কতগুলো পাতা ঝরে পড়ল। ঘরের ভেতর থেকে মা আর মেয়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। গাছটার ডালপালাগুলো দুলছে, কটকট, খসখস শব্দ হচ্ছে, কী যেন বলছে। বাবা গাছটার গায়ে হাত রাখলেন। “সামনের শীতটাতে একটু কষ্ট কর। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।” মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাবার পাশে।
“কি করছ বাবা ?” বাবা হাসছেন, গাছটার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন।
“একটু ভালোবাসছি মা।”
ছিয়া
চিত্
আজ এ বাড়িতে সকাল থেকে পুজোর আয়োজন। দীপ্তিময়ী ভালোই বুঝতে পারছেন। সদ্য বিয়ে হওয়া নাতনী নাতজামাই আসবে, তারই তোড়জোড় চলছে। দীপ্তিময়ী খুব ধীরে ধীরে নিজের কাজ কর্ম সেরে একখানা পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে ঠাকুর ঘরে নমস্কার সেরে নিজের ঘরে এসে বসেছেন । এর মধ্যে আবার কখন যে বিছানায় একটু শুয়ে পড়েছেন, চোখে তন্দ্রাও এসে গেছে তা টের পাননি।
দীপু ও দীপু দ্যাখতো, ভাইটা কোথায় গেলো। দীপু খাওয়া ফেলে দৌড়লো, ও দিকে ঠাকমা সমানে ডেকে চলেছে ,দীপু কোথায় গেলি রে, রান্নাঘর থেকে শাকের চুবড়ি খানা নিয়ে আয় তো ;শাক কটা বেছে দিই। নাহলে তো রান্নাই হবে না, ও চুবড়িতেই শুকুবে।“এই হলো দীপুর ঝকমারি। হাজার জনের হাজারটা কাজের যোগান দিতে হয়। আর বাড়িতে আছে একমাত্র ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো ওই। যার যেমন কপাল। ও যে এমন কপাল নিয়েই জন্মেছে।এই সব ভাবলেই ওর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে।আর এসব ভাবতেও চায় না।
আসলে ও একজন ব্যাতিক্রমী জীবনের।নাহলে এরকম কেন হবে। সবই শোনা কথা। ও তখন ছয় মাসের শিশু, দাদার বয়স আড়াই বছর ,শীত পড়েছে সবে।সবার বাড়ির দরজা জানালা বিকেল থেকেই বন্ধ, আর রাতের প্রথম প্রহরেই সব খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে লেপ কাঁথারতলায়, দালানে একখানা কুপি জ্বলছে টিমটিম করে।কেননা, তখন কেরোসিন তেল পাওয়া তেমন সহজ নয়। তাই হারিকেন সবাই নিভিয়ে রাখে। এমন সময় বাইরে পড়শীদের চীত্কার। তোমাদের বাড়ির ছাদে আগুন লেগেছে গো , শীগগির দ্যাখো। তখন ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিলো কাঠের,আর কোন রকম ধরার হাতল ছিলো না। তাই ঘুম থেকে উঠে ছাদে পৌঁছতেও সময় নিলো। গিয়ে দ্যাখে,এবাড়ির ছোট বউ মানে , আমার মা সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তার জ্বালায় সে চীত্কার করছে। যাই হোক সবাই মিলে উদ্ধার করলেও তাকে সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেনি। এগুলো সব ঠাকুমার মুখে শোনা। পরে বড় হয়ে পাড়ার মানুষের কাছে শুনেছি যে বাবা চিরকাল রগচটা , অল্পতেই খেপে ওঠার মতো,বাবাই নাকি মাকে পুড়িয়ে মেরেছে।তবে ও গুলো সব কথার কথা। কোনটা ধোপে টেঁকেনি।
যাইহোক, ঠাকমার কাছেই বড় হওয়া আমাদের দু ভাইবোনের। দাদা খুব দুষ্টু ছিলো।ঠাকুমা ওকে সামাল দিতে পারতো না। মাঝে মাঝে বাবার কানে তুলে দিলে বাবা দারুণ পিটুনি দিতো।তখন কয়েকদিন শান্ত থাকতো, আবার যে কে সেই। একবার কালীপূজোর সময় ছুঁচোবাজি ছেড়ে ওপাড়ার মান্নাদের খড়ের গাদা পুড়িয়ে ফেলেছিলো। তারা তো সোজা বাবাকে এসে বললো, আমরা ওকে পুলিশে দোবো, তারপরে ওরা যখন বেধড়ক পিটুনি তে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে তখন সোজা হবে। বাপ যেমন বউটার গায়ে আগুন দেচে,তার বেটা তো তেমনই হবে। বাবার মাথায় আগুন ধরে গেল এই কথা শুনে। ওরা চলে যেতেই বেধড়ক ঠেঙানি খেলো দাদা। কিন্তু আমার মনে প্রশ্নটা থেকেই গেল,সত্যিই কি তাই?
এরপরে একটা কান্ড ঘটলো। কি জানি কি মনে করে ঠাকুমা আমাকে এখানকার পাঠশালায় ভর্তি করে দিলো। আমার ওখানে পড়তে বেশ ভালই লাগতো। তার ওপরে ঠাকুমা বলে দিয়েছিলো,দাদারদিকে নজর রাখতে।আমার হয়ে গেলো দুদিকে চাপ। এদিকে ঠাকুমা বলে, দাদাকে দেখতে, ওদিকে দাদা বলে, বাড়িতে বললে মাথা ফাটিয়ে দোবো,। একদিন দাদা ডাংগুলি খেলতে গিয়ে মধুদার মাথায় এমন গুলি মারলো, যে কপাল কেটে চৌচির। মধুদার বাবা এসে বাবাকে কি সব বলে গেলো। তবে বাবাকে তখন সব সহজ ভাবেই নিতে দেখেছি। বাড়িতে কথাবার্তা শুনছিলুম, কদিন পরেই বাবা নতুন মাকে নিয়ে এলো।
নতুন মা আসাতে কদিন একটু ভাসা ভাসা খুশির আভাস বাড়িতে, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ভাল রান্নার হালকা সুগন্ধের মতো।আমি ইস্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম,বৃত্তিপেয়ে পাশ করেছি দেখে ঠাকুমা বাবা সবাই খুশি। আমি দুমাইল দূরের বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনায় বাধা এলো অনেক। এক তো স্কুল্টা দূরে বলে হেঁটে যেতে আসতে সময় লাগতো, আর ভাই আসার পরে আরও অসুবিধে। প্রায়ই মা বলতো, আজকে ইস্কুলে যেতে হবে না। আমার আজ রান্না বাকি আছে,তুই বরং ভাইকে দ্যাখ,কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়,” আমিও তাই করতুম। প্রায়ই যাওয়া হতোনা।কি কাজে বাবা ও পাড়ার দিকে গিয়েছিলো ,ওখানে গীতার সঙ্গে দ্যাখা।ওর কাছেই শুনেছে আমি স্কুলে যাই না ঠিকমতো। বাবা বাড়িতে এসেঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে, ও ক্যানো স্কুলেযায় না। ঠাকুমা বললো সেটা ওর মাকে জিগা,বলে ঠাকুমা বাবার সামনে থেকে সরে গেলো।
বাবা মাতে ভাল তর্ক শুরু হলো। এর মধ্যে ঠাকুমা যেই একবার বলেছে, আজ ওর মা থাকলে কি এমনধারা হতো ? সেই শুরু হলো আরও বাগবিতন্ডা।শেষে এক কথায় এসে থামলো, নিজেরাই গায়ে আগুন দে পুড়িয়ে মারলে আবার কতা। আমার মনে ধক করে আবার সেই কথাটাই মনে হলো, সত্যিই কি বাবা মেরে ফেলেছে, না, মা নিজেই--- কেজানে।
ঠাম্মা, ও ঠাম্মা তুমি আর কত ঘুমুবে, একটানা ডেকে চলেছে, ছোট নাতনী। এই তো দালানে হ্যারিকেন ল্যাম্পও গুনো পুঁছে রাখছিলুম, ওরা আবার ধাক্কা দেয়,কি পরিষ্কার করছিলে? দীপ্তিময়ী বলে ওঠে,”হেরকেন”।সেটা কি? তখন সজাগ হয়ে আবার ভাবতে থাকেন, কে যেন ডাকছিলো ? ঠাম্মি, দ্যাখো, দিদি, এসেছে সঙ্গে জর্জদা।বড় নাতনী এসে প্রণাম করে। দীপ্তিময়ী বলে, ‘শাড়িতে কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছেরে। তোকে খুব ভাল লাগছে।‘ বলে দীপ্তিময়ী আবার শুয়ে পড়ে।
জর্জ এসে দ্যাখে,ঠাম্মি আবার নিদ্রায়। কিন্তু আর ওরা ডাকে না। ওরা বলাবলি করে, বয়স হয়েছে,হয়তো শরীর ঠিক নিতে পারছে না।এখন এমনভাবেই যাবে। কিন্তু বলো,ও কত কিছু দেখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,রবীন্দ্রনাথের জীবিতকাল, ষোলআনা দিয়ে টাকা, পালকি থেকে প্লেন কত পরিবর্তন।কত সমস্যা আর তার কত বৈজ্ঞানিক সমাধান যে এলো,আর মানুষ তা নিয়েও নিলো। এত পরিবর্তন জীবনের কম সময়ে কমই হয়।
দীপ্তিময়ীর আবার সেই দালানে ফিরে আসা। লেখাপড়া স্কুলে যাওয়া সবই এক জায়গায় এসে থেমে যেতো বাড়ির কাজ করবে কে? ঠাকুমার কথা, পড়া যদি না হয়, তাহলে বে দিয়ে দাও। সেখানেও নানান বাধা। এক দীপ্তিময়ীর রোগা কালো শীর্ণ চেহারা,তারওপরে মুখে গুটি বসন্তের দাগ, গর্ত। সকলেই আসে, খায় দায় চলে যায়,কেউ পাকা কথা দেয় না।তখন বাবা দোজবর এসব খুঁজতে শুরু করলো। আর মা বিয়ে কথাতেই আগুন হয়েযায়। তখন বুঝিনি,পরে বুঝতে পারলুম,আমার মায়ের, বেশ খানিক সোনার গয়না ছিলো, সে গুলো মা হাতছাড়া করতে চাইছিলো না। বিয়ে দিলে সেগুলো আমার প্রাপ্য হয়ে যায়। কাজেই বিরোধিতা করাই বুদ্ধির কাজ।
আমার খুব ইচ্ছে ছিলো স্কুলের শেষ পরীক্ষাটা দেবার। কিন্তু সে আর হলোনা। পাশের গ্রামেই বিয়ে হলো আমার। ভাসা ভাসা শুনলুম ওদের কিছু ধারকর্জ ছিলো মহাজনের ঘরে। বাবা সেগুলো মিটিয়ে দিতে রাজি হওয়ায় ওরাও রাজি হলো। আমার আরও মনে হলো, বাবা বোধ হয় ওদের বাড়ির সব দায়িত্ব মেটালেন নিজে কিছু ধার কর্জ করে। আর আমার রূপ যাই হোক, আমার গয়না গুলো সবাই ভালো বলেছে। আর একটা কথা চুপি চুপি বলি, আমার আসল মানুষটা ভালো ছিলো।এটা আমার কপাল বলতে পারো। আমি যে সেকেন্ড ক্লাস অব্দি পড়েছি, ইংরেজি পড়তে পারি, বাংলা নাটক নভেল বেশ পড়া আছে, সেটা ওর ভালো লেগেছিলো, আর সত্যি বলতে কি, লুকিয়ে চুরিয়ে যেটুকু বইপত্র পড়েছি, সেটা ওর কারণেই। আর খারাপ লাগতো, যখন যে কেউ মায়ের চলে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করতো।
কে য্যানো ডাকছে আমায়। কি যে বলে কে জানে। একবার ঠাকুমার গলা শুনতে পেলুম য্যানো।শুনলুম বলছে ,পুরনোরা চলে যায়, নতুনরা আসে,গাছের পাতার মতো। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ছিয়াশি বছর আগে যে কথাটা উঠেছিলো, মা যে কি করে চলে গেলো, নিজেই চলে গ্যালো না,কেউ মানে, --- কি যে বলি, সেটা কেউ বলবে কি,কেজানে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান
পিনাকী
জল জল জল। পরাশর মন্ডল, রাতের শেষে ,চারদিকে শুধু জল দেখছে, নির্বিকার, স্থির, জেদি জলস্তর , নামছে কই! বরং বেড়েই চলেছে, পোয়াতির পেটের মতন হাবভাব। হুগলির শ্রীপুর বলাগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের মিলনগড় গ্রাম, এলাকা দেখতে নিজে আসছেন সাংসদ, জনপ্রতিনিধি, দেশ চালানোর জন্য দিল্লীতে, লোকসভা আছে, সেখানে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটা জোরদার ভাষণ দিতে হবে। জনপ্রতিনিধির পাশে পাশে থাকবে পরাশর মন্ডল, এতে লাভ হবে, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামবাসীদের কাছে ভরসার লোক হয়ে উঠবে, অবশ্য সে এই গ্রামেরই ,মানুষের আপদে বিপদে পাশে থাকে।
নদীর পাড়ে গ্রাম, মাটির বস্তা দিয়েও ভাঙন আটকানো যাচ্ছে না। ডিভিসি জল ছাড়লেই বন্যায় ভাসে গ্রাম গুলি, প্রতিবছর এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে ল্যাংটো শৈশব।
পরাশর মন্ডল মনে মনে বলল - দিদি আসছে, সুরাহা হবে? তবে কিছুতো মাস্টার প্ল্যান হবে।
পরাশর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির কাঁচ খোলা, ভিতরে দেখছে, দিদি রুমাল দিয়ে নাকের জল মুছছে।
দিদির কান্না দেখে, পরাশর মনে মনে বলল - দিদি বুঝতে পারেননি,ক্যামেরা নিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে,ওগুলো হালফিলের ছোকরা, গ্রামবাসীদের ভাষায় “ইটুইবার”, দিদি ওদের সাংবাদিক ভেবে, আগেই কেঁদে ফেলেছেন, মেকাপ নষ্ট হয়ে গেলো!
দিদি বললেন -” ইটিউবার!! এই একজ্বালা, ফোন থাকলেই , ইউটিউব নিয়ে নেমে যাও। এদের আটকানো যায়না, কোত্থেকে কী হয়, কে জানে! “
পরাশর, গাড়ির বাইরে থেকে, জানালার ভিতর, মুখ ঢুকিয়ে ,কানে ফিস ফিস করে বলল - “দিদি, আগেরবার জলের পরিমাণ কিউসেক থেকে কুইন্টাল হয়ে গিয়েছিল, আপনার মুখে। “
দিদি দাঁত বের করে বললেন - “ মনে আছে ভাই। আমি আর কী বলবো, কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া এই সমস্যা সমাধান হবে না।ভয় নেই, আমি এইবার ওল কিনবো। তোমাদের এখানকার ওলে গলা ধরবে না তো?”
ডিভিসি প্রতিবছর বৃষ্টি হলেই, হাজার হাজার কিউসেক জল ছাড়ে, বন্যা হয়, ক্ষতি হয়, মানুষ ভাসে, মানুষের চোখের জল ,জমা জলের মধ্যে মিশে যায়, মানুষ প্রতিবার ভোট দেয়, সুরাহা হয় না।
পরাশর জানে, জনপ্রতিনিধির ওল কিনে, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া, আর কোন কাজ নেই।
পরাশর মনে মনে বলল - সেটাই ভালো। চাষীদের থেকে ওল কিনছে, সেটাও তো উন্নয়ন।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ,দিদি বললেন - “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আদলে, বলাগড় মাস্টার প্ল্যান করতে হবে।”
পরাশর মন্ডল ডুবতে থাকা গ্রামের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে বলল- ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে।আমরা জাতে উঠলাম!
কলকাতার খবরের কাগজে আরেকটা মাস্টার প্ল্যান আসতে চলেছে।
পরাশর, কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল - বেঁচে বর্তে থাকুক, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান।
স্যার
পার্থসারথি মহাপাত্ররুপাই সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। মাস খানেক ক্লাস হয়েছে। এর মধ্যে ওর ভিতরে একটা দাদা দাদা ভাব চলে এসেছে। টি-শার্টের কলার তুলে বেপরোয়া আদব কায়দা বেশ আয়ত্ত করেছে।
সেই রুপাই একদিন মামাবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাকে নিয়ে একটা বাসে উঠল। বেশ ভীড় বাস। রুপাই ভাবছে মায়ের জন্য একটা সিটের ব্যবস্থা করতে না পারলে সে কলেজ স্টুডেন্ট হলো কি করে! ভীড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করে শুরু হলো সিট খোঁজা।
- 'দাদা কোথায় নামবেন?.....
- মাসিমা আপনি কি কাছাকাছি কোথাও নামবেন?.....
- কাকু কোথায় যাবেন?' বলতেই একজনের কাছ থেকে উত্তর এল,'ব্রজপুর।' সাথে সাথে রুপাইয়ের মুখে বিশ্বকাপ জয় করার মত অভিব্যক্তি ঝলক। আরেকটা স্টপেজ পেরোলেই ব্রজপুর। রুপাই সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রুপাইয়ের সামনে মানে সিটটির পাশে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাই রুপাই এগিয়ে যেতে পারছে না। ব্রজপুর স্টপেজ আসতেই সিটে বসে থাকা লোকটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে সিটটি ছেড়ে দিয়ে বলল, 'বসুন।'
রুপাইকে যেন কেউ আগুনের ছ্যাঁকা দিল। উত্তেজিত হয়ে বলল, 'এটা কি হল? আমি আপনাকে সিটের কথা বললাম আর আপনি ওনাকে বসতে বলছেন।'
- 'না বাবা তুমি সিট রাখতে বলোনি। জিজ্ঞেস করলে আমি কোথায় যাবো, আমি সেটার উত্তরে বলেছি, ব্রজপুর। উনি অনেক আগের থেকে এই সিটটা বলে রেখেছেন। তাই এই সিটটিতে উনি বসবেন।'
তর্ক শুনে কন্ডাক্টর ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে এল। ঐ ভদ্রলোককে বলল, 'স্যার আপনি বসুন।'
'রুপাই বলল, 'না স্যার, ওই সিটটা আমি বলে রেখেছি। ওটা আমি পাব।
কন্ডাক্টর বলল, 'তুমি কি ওনাকে চেনো? উনি পাঠমন্দির হাই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই। প্রতিদিন এই বাসে যাতায়াত করেন। আর তুমি তো ছোকরা ছেলে, দাঁড়িয়েও যেতে পারবে।'
হেডমাস্টারের উদ্দেশ্যে কন্ডাক্টর বলল, 'আপনি বসুন স্যার।'
রুপাইও হার মানতে রাজি নয়, ও
কন্ডাক্টরকে বলল 'শুনুন আমি ছোকরা ছেলে সেটা আমিও জানি। সিটে বসার জন্য আমার কোন আকুতি নেই।' হেডমাস্টারকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'স্যার, আসলে সিটটা আমি আমার মায়ের জন্য বলেছিলাম।'
হেডমাস্টার মহাশয় সিটটিতে বসতে গিয়েও উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুস্বরে বললেন, 'নাও, মাকে ডেকে এনে বসাও।' হয়তো রুপাইয়ের বিবেক জাগ্রত হল। বলল, 'না স্যার আপনিই বসুন, আমি মায়ের জন্য অন্য সিট খুঁজে দেখছি।'
- না বাবা তুমি আমাকে 'স্যার' বলেছ। স্যার মানে মহাশয়। তোমার এই সম্বোধনকে সম্মান দিতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কষ্ট টুকু আমাকে সহ্য করতেই হবে। মাকে ডাকো।
অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১
বৃন্দাবনের পথে
সুতপা সোঽহং
সকাল সকাল শরতের পুজো পুজো আমেজ নিয়ে ভাবছিলাম পুজোর ছুটিতে এবার কোথায় যাওয়া যায়। প্রতিবার পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলে ঘুরতে গেলেও এবার সেসব দিকে যেতে চাইছিলাম না। এমনসময় বান্ধবীর কল এলো।এটা সেটা নানা কথার শেষে ওকেও ঘোরার কথা বলাতে বলল চল 'এবার বৃন্দাবন যাই।' ওর শ্বশুরবাড়ি বৃন্দাবনে। ফলে থাকা খাওয়ার সমস্যা নেই। উপরন্তু চেনা জানা ঘোরানোর লোক ও গাড়ি আছে। এককথায় রাজী হয়ে গেলাম। তৎকালে টিকিট কাটা হলো। NJP থেকে মথুরা স্টেশন। যাওয়ার দিন যথারীতি চেপে বসলাম ট্রেনে। আড়াই দিনের ট্রেন জার্নি।ট্রেনের দুলকি চালে দুলতে দুলতে আর বান্ধবীর সাথে গল্প গল্প করতে সময় ভালোই পার হচ্ছিল।ট্রেনের রুট পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বিহার হয়ে উত্তরপ্রদেশ। ফলে স্টেশনে স্টেশনে স্থানীয় খাবার, লোক, ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছিল। ট্রেন যত মথুরার কাছে আসছিল তত দেখছিলাম কামরাগুলোতে হরিনাম কীর্তন হচ্ছে। কেউ হয়তো কাউকে চেনে না কিন্তু তাতে সবাই গলা মেলাচ্ছিল। অনেককে দেখলাম ঘরের গোপালের প্রতিমূর্তি নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে বৃন্দাবন দর্শনে। মথুরাতে যখন পৌঁছলাম সবাই ট্রেন থেকে নেমেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন মথুরার মাটিকে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করা হলো বৃন্দাবনের রাধা কুন্ডের উদ্দেশ্য। বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি রাধাকুন্ডে। আমরা যাবো বলে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। তারা সবরকম ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন। আমরা পৌঁছেই আগে স্নান, খাওয়া দাওয়া সারলাম। একবেলা রেস্ট নিয়ে বিকেলে বেরোলাম রাধাকুন্ড পরিক্রমায়। অসংখ্য মন্দির এবং প্রত্যেক মন্দিরেই রাধাকৃষ্ণের কিছু না কিছু লীলার ঘটনা জড়িত। ঘুরতেই ঘুরতেই সন্ধ্যায় এক মন্দিরে দর্শন হলো প্রাণকৃষ্ণ দাস বাবাজীর সাথে। উনিও রাধাকুন্ড পরিক্রমায় এসেছেন। ওঁনার আশীর্বাদ নিয়ে ও ভাগ্য সুপ্রসন্ন দেখে আমরা পরিক্রমা শেষে প্রফুল্ল চিত্তে সেদিন বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন সকাল সকাল টিফিন করে বেরিয়ে পড়লাম বাঁকে বিহারী মন্দিরের উদ্দেশ্য।প্রচুর ভিড় ঠেলে যখন মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম মন একেবারে শান্ত হয়ে গেল। কী এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠল। এখানে বাঁকে বিহারীজী রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে পূজিত হন। স্বামী হরিদাস ঠাকুরের ঐকান্তিক আকুতিতে এই অভিনব রূপটিতে কৃষ্ণের হাতে বাঁশি থাকে না বছরের অন্যান্য দিনে। একমাত্র অক্ষয় দ্বিতীয়ার দিন হাতে বাঁশি দেওয়া হয়। এখানে ভক্ত অন্তপ্রাণ বাঁকে বিহারীজী যাতে ভক্তের ডাকে মন্দিরের বাইরে না যেতে পারেন সেজন্য ঝোঁকা দর্শন বা পলক দর্শন করানো হয়।সেখানে আমরা পুজো দিয়ে, আশে পাশের আরো কিছু মন্দির দর্শন করে বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন গাড়ি রিজার্ভ করে গেলাম বরসানা অর্থাৎ রাধারাণীর জন্মস্থান। শ্রীজীর মন্দিরটি ৫০০০ বছরের পুরানো ও ভানুগড় নামক পাহাড়ে অবস্থিত। আমরা গোলাপ ফুলের মালা, প্রসাদী ও পটবস্ত্র নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। অপরূপা রাধারাণী গোটা বৃন্দাবনের ঈশ্বরী। কথিত আছে মালকিন রাধারাণীর ইচ্ছা বিনা বৃন্দাবনের মাটিতে পাও রাখা যায় না।ওখানে বসে বসে অনেকক্ষণ কীর্তন করলাম। মনে যে কী এক প্রকার প্রশান্তি ও প্রেম অনুভব করলাম তা বর্ণনাতীত! হ্লাদিনী শক্তি রাধারানীকে প্রণাম করে বেরোচ্ছি দেখি হঠাৎ এক পন্ডিতজী রাধারাণীর গলা থেকে মালা খুলে আমার হাতে দিলেন।এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে আমার চোখে জল এলো। অপার করুণাময়ীর এই অযাচিত ভালোবাসায় মন একেবারে বিগলিত হয়ে গেল। 'রাধে রাধে' বলতে বলতে তারপর সেখান থেকে গেলাম মথুরায় কংসের কারাগার, দ্বারকাধীশ মন্দিরে ও রমণরেতীতে।সেখানে দর্শন ও পুজো করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরাও সেদিনের মত ফিরে এলাম। তার পরেরদিন অটো রিজার্ভ করে গেলাম নিধুবনে। সেখানে এখনো রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস। রং মহলে রাধা ও কৃষ্ণকে সিঁদুর, চুড়ি, আলতা, পান, ইত্যাদি দিয়ে শৃঙ্গার করানো হয়।সন্ধ্যা থেকে পুরো নিধুবন বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কথিত আছে নিধুবনের সমস্ত গাছরা রাতে রাধারাণীর সখিতে পরিণত হন এবং কৃষ্ণের সাথে লীলা করেন। নিধুবন দর্শনের পরে গেলাম দশরথ ঘাটে। সেখানে যমুনায় স্নান করে আরো অন্যান্য মন্দির যেমন রাধাবল্লভ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, ইস্কন মন্দির ইত্যাদি দর্শন করে বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন গোবর্ধন পরিক্রমা, গোকুল, প্রেম মন্দির, কাঁচ মন্দির, সোনার তালগাছ ও আরো নানা লীলাক্ষেত্র দর্শন করে শেষে রাধাকুন্ড ও শ্যামকুন্ডে স্নান সেরে ফিরলাম। বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দির দেখতে একমাস সময়ও কম পড়ে যায়। কিন্তু সময়ের অভাবে প্রধান প্রধান লীলাক্ষেত্র দর্শন করেই বৃন্দাবনের অপূর্ব সব স্মৃতি সাথে নিয়ে আমাদের শিলিগুড়িতে ফিরতে হলো।
অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১
No comments:
Post a Comment