ব্যক্তিগত গদ্য
দিনের পরে যায় দিন
অনিতা নাগ
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো মণি। বাইরেটায় এই অসময়ে আঁধার নেমেছে। আকাশের মুখ ভার। বেশ জোর হাওয়া দিচ্ছে। আবার কোন এক সাইক্লোন আছড়ে পড়তে চলেছে। শহুরে মানুষের হাজার ব্যবস্থা। তাও মন ভ'রে না। সবসময়েই কি যেনো নেই, কি যেনো পাওয়া হলো না , এই বিলাসিতাতে বাঁচতে ভালোবাসে। সুরক্ষিত বৈঠকখানায়, সোফায় গা এলিয়ে টিভিতে নিউজ আপডেট দেখতে দেখতে আহা উহু করা। এবার আবার নতুন এক শব্দ বন্ধ, নতুন এক পর্যটনের নাম শুনে অবাক মণি। সাইক্লোন টুরিজ্যিম। ভাবো কান্ড। যে তুফানের ভয়ে তটস্থ সকলে তা দেখার জন্য উদগ্রীব কিছু মানুষ। রিল বানাবে, ভিডিও বানাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। লোক যতো দেখবে ততো লাভ। মণি ভাবে দিনে দিনে আর কতো দেখবে।
শরৎ কে বিদায় দিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় হেমন্তের দিনলিপি। অথচ প্রকৃতিতে তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। হেমন্ত মানেই একটা হাল্কা শীতের আমেজ। রাত বাড়লে হিমের পরশ। সকালে ঘাষের ডগায় শিশিরবিন্দু। ছোটবেলায় রাত বাড়লে হাল্কা শীত কাপড়ে কান মাথা ঢাকতে হতো। নাহলেই বড়দের বকুনি। এখন সবই গল্প কথা। সাইক্লোনে বৃষ্টি হলো। নাজেহাল হলো কলকাতাবাসী। তারপর আবার সেই কটকটে রোদ। গ্লোবাল ওর্য়ামিং। যেহারে আধুনিকীকরণ আর সৌন্দ্যাযায়ন এর ধূম, তাতে প্রকৃতি আর করবে কি!
জানলা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায় এখনো। ক’দিন পর সেই টুকরো আকাশ হয়তো লুকিয়ে পড়বে কোনে ইমারতের আড়ালে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয় মণি। উঠোনের এক কোণে জল দিয়ে এঁটেল মাটি মাখছে তার মা। আটপৌরে শাড়ি, একরাশ চুল হাতখোপ করে বাঁধা। ফর্সা মুখে কেমন এক পবিত্রতা মা'কে ঘিরে থাকতো। তখন চোখে পড়ে নি। এখন আকাশের কোণে মায়ের মুখটা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে মণির।
মহালয়া, অষ্টমীতে গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার সময় মাঝিদের থেকে এঁটেল মাটি নিয়ে আসতেন বাবা। সারাবছর উনুন নিকোতে মাটি লাগতো। আর কালিপূজোর আগে মা ওই মাটি দিয়ে প্রদীপ বানাতেন। এঁটেল মাটিকে জল দিয়ে মেখে হাত দিয়ে চেপে চেপে প্রদীপ তৈরী করতেন মা। অনেক গুলো প্রদীপ। তারপর রোদে শুকোনো হতো। দুপুরে কাজ সেরে ঠাকুমা সলতে বানাতেন। পুরোনো ধুতি ছিঁড়ে, পাকিয়ে পাকিয়ে সলতে বানাতেন। পাড়ার অনেক বাড়ীতে মোমবাতি জ্বলতো। কিন্তু মণি’দের বাড়িতে প্রদীপ জ্বলতো। সন্ধ্যেবেলায় মা'র সাথে ঘুরে ঘুরে প্রদীপ জ্বালাতো। বাড়ীর আনাচে, কানাচে, সব জায়গায় প্রদীপ দিতো। মা বলতেন ভূত চতুর্দশী তিথিতে প্রদীপের আলোয় সব অন্ধকার মুছে যাবে। সত্যি কি প্রদীপের আলোয় অন্ধকার দূর হয়! জানা নেই মণির। তবু সেই বিশ্বাস আজো বয়ে নিয়ে চলছে ।কার্তিক মাসে বাবা ছাদে লম্বা বাঁশের মাথায় একটা ছোট আলো লাগিয়ে দিতেন। আকাশপ্রদীপ। ঠাকুমা বলতেন এই সময় আকাশ প্রদীপ দিতে হয়। বিদেহী আত্মাদের আলো দেখাতে হয়। এখনো গ্রামে নিশ্চয় আকাশ প্রদীপ জ্বলে, হয়তো বা শহরেও জ্বলে আকাশ প্রদীপ। মণি কার্তিক মাস ভোর একটা করে প্রদীপ জ্বেলে রাখে তুলসী তলায়। সেই আলো কি পৌঁছোয় আকাশ পারে! জানা নেই। তবু ছোটবেলার সেই সংস্কার আজও আঁকড়ে বাঁচে মণি। ভালো লাগে। জানে এরপর আর কেউ জ্বালবে না দীপ। আধুনিক আলোর বাহারে সাজছে শহর থেকে গ্রাম। সুইচ জ্বালালেই জ্বলে উঠে সারি সারি সাজানো প্রদীপ, মোমবাতি। হাওয়া এসে নিভিয়ে দিতে পারে না। হাতের আড়াল দিয়ে আগলে রাখতে হয় না প্রজ্জ্বলিত শিখাকে। স্হির হয়ে থাকে দীপ শিখাটি। সাহসী, নিঃসংশয়। মুঠোফোনে বন্দী হয় রঙীন মুহুর্তেরা। বিজন ঘরে টুংটাং আওয়াজে মুঠোফোনে ভেসে আসে সেই মুহুর্তগুলো। আলো ঝলমলে মুহুর্তেরা নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারে না। বিজন ঘরে বসে সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে মণি। সকলে ভালো থাক। আর থেকে থেকেই পুরোনো দিনগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ঐ যে নীচের ঘরে মা নাড়ু বানাচ্ছেন। কালিপূজোর দিন অলক্ষি বিদায়ের পূজো হবে যে। কতো কাজ। ঠাকুমা পূজোর বাসন মেজে ঘসে সাজিয়ে রাখছেন। বাজারের দায়িত্ব বাবার। উঠোনের একদিকে ছোড়দা বাজির মশলা তৈরী করছে। তুবড়ি বানাবে। রাতে পাড়ার সকলে একসাথে বাজি পোড়াবে। তখন কার তুবড়ি কতোদূর উঠলো সেই হিসেব হবে। রান্নাঘরে উনুনে তখন পেতলের হাঁড়িতে পূজোর নৈবেদ্যর আতপ চাল ফুটছে। মা সেই ফুটন্ত চালে মটর ডাল বেটে গোল্লা গোল্লা করে দিয়ে দিচ্ছেন, সবার জন্য একটা করে। বাজির গন্ধের সাথে সেই ফুটন্ত ভাতের গন্ধ আজও মিশে আছে। আজকাল বাসমতি, গোবিন্দভোগ, কতো রকমের চাল। কিন্তু সেই মোটা আতপ চালের ভাতের স্বাদ আর পাওয়া যায় না। সেই ভাতে মায়ের পরশ ছিলো যে! সবাই মিলে পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়ার আনন্দ ছিলো। বেশ ছিলো দিনগুলো। কেনো যে ছোটবেলাটা হারিয়ে যায়! এই হেমন্তের দিনগুলোও তেমনি। বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। দুর্গা পূজো, লক্ষ্মি পূজো হয়ে গেলেই কেমন মন কেমন করে। ছোটবেলায় মনে হতো দিনগুলোকে যদি বেঁধে রাখা যায়! ছুটি শেষে আবার স্কুল, পড়ার চাপ। চিরকালের ফাঁকিবাজ ছিলো যে!
হেমন্তের সাথে সাথে শিউলি বিদায় নেয়। ধীরে ধীরে শীতকে তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে কখন যেনো টুপ করে লুকিয়ে পড়ে হেমন্ত। ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু, মাঠে মাঠে কচি ধানের লুটোপুটি। তবু সে যেনো আড়ালে থাকে। আঁচল বিছিয়ে আড়াল করে রাখে নিজেকে। তারপর একদিন টুপ করে হারিয়ে যায়। যেমন করে আকাশের কোলে হারিয়ে যায় প্রিয়জনেরা। পড়ে থাকে একরাশ স্মৃতি। মণি হাতড়ে বেড়ায় পুরোনো দিনগুলো। স্মৃতির ঝুলি থেকে লুকোচুরি খেলে তার ফেলে আসা দিনগুলো। এখন চুলে তার রূপোলী উঁকিঝুঁকি। সে'দিনের ছোট মেয়েটা পেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ পথ। সেই দীর্ঘ পথের বাঁকে বাঁকে কতো স্মৃতি। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ঘুরেছে। প্রত্যেক রাজ্যের উৎসবের রঙ আলাদা, সাজ আলাদা। কিন্তু কোথাও, কোনোখানে সব চাওয়া পাওয়া মিলে যেতো। অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তোরণের পথ আলাদা হলেও সব পথের একটাই চাওয়া শান্তি, সমৃদ্ধি, আনন্দ।
দিন বদলের গল্প গুলো বড্ড তাড়াতাড়ি পালা বদল করে। সিনেমার দৃশ্যপটের মতো জীবনে বদল আসে। ঋতু বদল হয়। হঠাৎ আকাশ পারে বিদ্যুতের ঝলকানিতে মণির চমক ভাঙে। দূরে হারিয়ে যায় আলপনা আঁকা লক্ষ্মির পা। মুঠোফোনে গান বেজে উঠে ‘আমার কিছু কথা আছে ভোরের বেলার তারার কাছে, সেই কথাটি তোমার কানে চুপি চুপি লও’।
মণি পরম যত্নে আগলে রাখে তার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে।
No comments:
Post a Comment