Friday, May 2, 2025


 

মনুষ্যত্ব 

শুভেন্দু নন্দী 

সাইকেলে জোরে পা চালিয়ে গুনগুন করে পরিচিত একটি হিন্দী গানের কলি আওড়াতে আওড়াতে অন্যমনস্কভাবে ছুটছিলো অনিকেত। এ.টি.এম. থেকে হাজার দশেক টাকা তুলেছিলো। বাড়িতে কিছু রিপেয়ারিং-এর কাজ চলছে। লেবার পেমেন্ট  করতে হবে। আজ রবিবার। অফিসে যাবার তাড়া নেই।  হঠাৎ মনে হোলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে না তো ? চারিদিকে ছিটকে চোর ও পকেটমারদের দৌরাত্ম্য ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে।  সেল ফোনের দিকেই আগ্রহটা বেশী। নাঃ, আর পারা যাচ্ছেনা। বড্ড চায়ের পিয়াসা। "ঐতো সামনেই একটা চা-বিস্কুটের দোকান"- বলে ওঠে অনিকেত। সাইকেলটা দোকানের পেছনে এককোণে লক্ করে দোকানঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। ভালো করে তার মোবাইল ফোন এবং পকেটে টাকার অবস্থান পরীক্ষা করে আড়চোখে  চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।
- দাদা, এখানে নতুন এলেন বুঝি? কয়েকজন অল্প বয়স্ক যুবক তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।
-হ্যাঁ - মোটামুটি তাই-ই - অনীক বলে ওঠে। মনে মনে ভাবলো এর পরে হয়তো অবধারিতভাবে প্রশ্ন 
তুলবে - কী করা হয়, মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি ভাববাচ্যে প্রশ্ন। কিন্তু তেমন কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হোলোনা -ভেবে খুব অবাক লাগলো অনীকের। আসলে  কৌতুহল,উচ্ছ্বাস-  দিনের পর দিন যেন হারিয়েই যাচ্ছে। মানসিক চাঞ্চল্যতাই বিরাজ করছে তার মূলে। আর আছে বেকারত্বের জ্বালা। অন্ততঃ ছেলেগুলোর চোখে-মুখে তার দৃঢ় ছাপ প্রতীয়মান। আর বেশী গবেষণা করার ইচ্ছে এই মুহুর্তে তার নেই।  পিয়াসা সাঙ্গ করে দোকানে দাম মিটিয়ে দেয় অতঃপর।  বিধির বিধান একেই বলে! সাইকেলে কিছুদূর পথ এগিয়ে দেখতে পায় অনীক পথের ওপর অচেতন হয়ে পড়ে থাকা একজন। অবিন্যস্ত চুল। সারা শরীরে,জামাকাপড়ে রক্তের দাগ। অনীক বিচলিত না হয়ে হনহন করে এগিয়ে গেলো ।
- কি দাদা, কি দেখছেন ? আরে, চলে যান মশাই। 
ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী ? একজন 'মাতাল' তার কাছে এসে বিড়বিড় করে অসংলগ্ন ভঙ্গীতে বলে উঠলো।
- আরে আরে ! বলছেন কি আপনি? লোকটার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, এখনও। হাসপাতালে এক্ষুনি নিয়ে যাবার দরকার। এখনও প্রাণ আছে দেখছি। - বলে একজন রিকশাওয়ালার কাছে এগিয়ে যায় অনীক।
- ঝামেলা তাহলে নিলেনই দাদা। ঠিক আছে। এই বুবু! শিগগীর এদিকে আয় দেখি। নিয়ে যা এই দাদাকে আর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ঐ অসহায় লোকটিকে। সাবধানে নিয়ে যাবি,বুঝলি। 
- দাদা আপনাকে আমার প্রণাম। আর আমি হলাম
রাজু। রাজু পাঁড়ুই। তিনকূলে কেউ নেই আমার। ছিল এক পিসী। কিছুদিন হোলো তাঁর স্বর্গবাস হয়েছে। শুনুন- সামনেই নার্সিং হোম। পকেটে টাকাকড়ি কিছু আছে কী ? এই নিন দুশো টাকা। কাজে লাগতে পারে।
- কিন্তু আমার সাইকেল? অনীক চিন্তিত মনে তাকে বললো।
- ওঃ কিস্সু হবে না মশাই। এটা আমার ডেরা!
তারপর কি ভেবে একা একাই ধীরে ধীরে চালিয়ে
নিয়ে যেতে লাগলো ।
সেদিন সব কিছু সেরে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিলো। লেবাররা অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেছিলো। রমলা-ওর বৌয়ের আহ্বানে - অনীক খেতে বসলো। ছেলে-মেয়ে ততক্ষণে ঘুমিয়ে
পড়েছে। পরের দিন লেবারদের পেমেন্ট মিটিয়ে দিলো অনীক। ওরা "বাবুর " এ ধরনের মহান হৃদয়ের গল্প আগে অনেকবার শুনেছে। যাই হোক, রাজুর দুশো টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাকে ধন্যবাদ দেবার সাথে চা খাওয়ার অফার দিয়েছিলো এবং সানন্দে তা গ্রহনও করেছিলো রাজু। অবশ্য ইনট্ক্সকিটেড অবস্থায় নয়। অনীকের কিছু টাকা খসেছিলো জখম লোকটিকে ভর্তি ও ওষুধ কেনার পেছনে। অবশ্য তার পরোয়া করেনা একদম অনীক। এ ব্যাপারটা তার বৌ অবশ্য বোঝে আর মনে মনে তাঁকে সমীহও করে থাকেন।
........আজ এত বছর পরে তার মনে হোলো মানুষের সদগুণ,সহানুভূতি, শুভবুদ্ধি,বোধোদয় আজও বিরাজমান- তার বিরাট প্রমাণ তথাকথিত ঐ  রাজু পাঁড়ুই। মনে মনে তাকে নমস্কার জানালো অনিকেত।

No comments:

Post a Comment