আধুনিক/অতি আধুনিক কবিতা এবং হোমিওপ্যাথি
গৌতমেন্দু নন্দী
সাহিত্য আর বিজ্ঞান ---আপাতভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করলেও দুটোরই প্রকাশ মাধ্যম ভাষা। সেই ভাষা হোতে পারে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি --- যে কোন ভাষা।
সাহিত্যর একাধিক শাখার মধ্যে অন্যতম হোলো "কবিতা" আর বিজ্ঞানেরও অনেক শাখার মধ্যে একটি হোলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। তারও একাধিক শাখার অন্যতম হোলো "হোমিওপ্যাথি"।
এই কবিতা তথা আধুনিক কবিতা এবং হোমিওপ্যাথি---এই দুটো বিদ্যা বা অনুশীলন-চর্চার মধ্যে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।
প্রথমে হোমিওপ্যাথি তেই আসা যাক ----।
ভদ্রলোকের নাম ঘনশ্যাম সামন্ত। সরকারী চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তাঁর সময় কাটছিল না। দুই -একমাস দুই একটা হোমিওপ্যাথির বই ঘাঁটাঘাঁটি করে শুরু করে দিলেন প্র্যাকটিস। বাড়িতেই খুলে ফেললেন ডিসপেনসারি। সামনে নেমপ্লেটে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা ---ডাঃ ঘনশ্যাম সামন্ত,বি.এস সি। না, হোমিওপ্যাথির উপর তার প্রথাগত কোন ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা নেই। রোগীদের আনাগোনা কিন্ত বাড়তে লাগলো।
"ডাক্তারবাবু,ক'দিন ধরে মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে,জ্বর জ্বর ভাব...." স্টেথোর দুই প্রান্ত দুই কানের মধ্যে ঢুকিয়ে বাকী প্রান্তের গোল মেটাল চাকতিটি ঘনশ্যাম দাবার চালের মতো রোগীদের বুকের উপর বিভিন্ন অংশে আঙ্গুল দিয়ে যেন চাল দিতে লাগলেন----
" হুম্, ওষুধ দিচ্ছি---ছয়টি করে বড়ি দিনে তিনবার, দুই দিন পরে আসবেন।"যে ওষুধ তিনি দিলেন তা হোল বেলেডোনা 200 এবং রোগী দুই দিন পরে যথারীতি সুস্থ হয়ে এলেন।
ঘনশ্যাম সামন্ত ধীরে ধীরে চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেতে লাগলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রেসক্রাইব করতে লাগলেন " ককুলাস ইন্ডিকা--30, একোনাইট--30, আর্নিকা --30.......
রোগীরাও চার-পাঁচ দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। ওষুধের গুনে না সময়ের স্বাভাবিক স্রোতে জানা গেল না। নো সাইড এফেক্ট,নো রিক্স অ্যাট অল কিন্তু সামন্তবাবু চিকিৎসক হয়ে গেলেন।
এবার আসা যাক কবিতায/আধুনিক,অতি আধুনিক কবিতায়। কবির নাম উদাসীন হালদার।বয়স মধ্য চল্লিশ। শরীরে মাংস বর্জিত অস্থি সমৃদ্ধ লিকলিকে কাঠামোয় নিত্যনতুন পাঞ্জাবির বিজ্ঞাপন। মাথায় এবং গালে জলাভূমির মতো আগাছার আধিক্য। ঘাড়ে স্নান-খাওয়া বাদে সবসময় ঝুলছে শান্তিনিকেতনী সাইড ব্যাগ। তিনি সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ---"আধুনিক, উগ্র আধুনিক,অতি আধুনিক"। চোখে কবিতার আগুন। তাঁর কবিতার শব্দ চয়ন কেমন? ---অভিধান বহির্ভূত শব্দভাণ্ডারে তার কবিতা মাথার উপর দিয়ে আকাশ, মহাকাশ কোথায় গিয়ে যে শেষ হয়! কিন্তু তার নিজস্ব পরিমন্ডলে তার গুণগ্রাহী পাঠকদের কাছে উদাসীন হালদার "লাজবাব"! "গুরুর জবাব নেই মাইরি!" "উদাসীন দা কী লিখছেন আজকাল,একদম চাবুক!"
"----- রমনীর যোনীতে জারজ সন্তান
ধরনীর খনিতে যমজ মস্তান....."
"উহু!! ফ্যান্টাস্টিক!!" "গুরুর জবাব নেই"।
না, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তিনি "উদাসীন" হলেও কবিতার ক্ষেত্রে একশো শতাংশ অ্যাক্টিভ। বলে বলে কবিতা লেখেন। কলম দিয়ে ফুলঝুরির মতো তার কবিতা বেরোয়। সেদিন "হঠাৎ উন্মোচন" ক্লাবের সদস্যরা উদাসীন হালদারের কাছে এসে বললো
" উদাসীন দা, এবার ক্লাবের পুজোর সুভিনিয়রের জন্য একটা প্রবন্ধ চাই---একদম ব্যুলেট"।
"দ্যাখ, ঐসব গল্প, প্রবন্ধ-টোবন্ধ আমার ঠিক আসে না। কবিতা চাই? ঝুড়ি ঝুড়ি সাপ্লাই দিতে পারি"।
কী বুঝলেন? পাঠকরা কি ভাবছেন আমি কবিতার "পিন্ডি" চটকাচ্ছি? বিশ্বাস করুন,মোটেও তা নয়। "হোমিওপ্যাথি" প্র্যাকটিসে যেমন কোন সাইড এফেক্ট বা ঝুঁকি নেই, তেমনি তথাকথিত এই "আধুনিক,অতি আধুনিক" কবিদেরও কোন ঝুঁকি নেই। গল্প, উপন্যাস লেখার অনেক হ্যাপা। চরিত্র, সংলাপ নির্বাচন এবং বোধগম্য ভাষার অক্ষর বিন্যাস। ভালো -মন্দে "বিমূর্ততা" নেই বললেই চলে।
সেখানে পাঠকের প্রতিক্রিয়া সরাসরি ---"ভালো" বা "মন্দ" কিন্তু কবিতার তথাকথিত অতি আধুনিক কবিতার বিচার কে করবেন? পুরো ব্যাপারটাই তো কেমন "বায়বীয়"! দুর্বোধ্য শব্দে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পংক্তির সঠিক বিচার কি হয়? নাকি ছন্দহীন দর্বোধ্যতাই কবিতার অলংকার?! কাকে বলে কবিতা? যা পড়েন কবি, তা?
নিজের অভিজ্ঞতা বলি। একবার কোন এক পত্রিকার তরফে লেখা চাইতে এসে বলা হোল দুই দিনের মধ্যে একটা লেখা দিতে। বললাম অন্ততঃ চার -পাঁচ দিন সময় দিতে। উত্তরে তারা বললেন,
" তাহলে অন্তত একটা কবিতা দিন"------।
আসলে চিকিৎসা শাস্ত্রে হোমিওপ্যাথি এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে কবিতা ---দুটোর সঠিক অনুশীলন ও
চর্চার জন্য মেধা এবং পড়াশোনা দুটোরই প্রয়োজন। "আপাত সহজ " --এই ধারণা প্রত্যাহার করে সঠিক অনুশীলন দরকার।
এই লেখায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী। অনুরোধ এই নিবন্ধকে "রম্য রচনা" হিসেবেই গ্রহণ করবেন।
No comments:
Post a Comment