উঠোন
মৌসুমী চৌধুরী
সক্কাল সক্কাল উঠে নারকেল কাঠির ঝাঁটার থমকে আম-জাম- কাঁঠাল-পেয়ারা-আতা প্রভৃতির হলুদ ঝরা পাতাগুলোকে ঝাঁটিয়ে সাফাই করতেন জেঠিমা। গোটা উঠোন জুড়ে তখন একটা মিষ্টি মসমস-সরসর আওয়াজ উঠত । তারপর গোবর ছড়া দিয়ে চতুর্ভূজাকার পেল্লাই সেই উঠোনটিকে তিনি খুব সুন্দরভাবে নিকোতেন। সেই লেপনটা শুকিয়ে গেলে গোটা উঠোনটা বেশ খটখটে হয়ে উঠত। আর আমরা তাতে স্কুল থেকে নিয়ে আসা চক দিয়ে কোর্ট কেটে এক্কাদোক্কা খেলতাম। কখনও কুমীর ডাঙা খেলতাম, কখনও বৌচুরি ও কখনও খেলতাম ইচিং বিচিং ... জেঠিমা আমার রক্তীয় কেউ ছিলেন না। আর সে সময় আমাদের আপন পর বোধগুলো একেবারেই আলাদা ছিল। আমাদের বাবা মায়েদের আমাদেরকে
নিজের ঘরে আটকে রাখার প্রবণতা একদম ছিল না। তাঁদের জীবন দর্শন ছিল—
"আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্ব ঘটে পেতাম না ঠাঁই... "
তাঁরা আমাদের বিশ্ব ঘরেই ঠাঁই দিয়েছিলেন। ফলে জেঠিমা আমার অনুভূতিতে কোনদিন বাড়উলি জেঠিমা নন, প্রকৃত জেঠিমা-ই ছিলেন।
যে সময়টাতে উ
ঠোন ঘিরে পাতা ঝরে পড়ার মতো গাছ প্রায় সব বাড়িতেই ছিল, আবার গাছেদের সামনেও পাতা ঝরিয়ে দেবার মতো উঠোনের দু'বাহু বাড়ানো উদাত্ত আহ্বান ছিল। আর সেই সময় আমাদের জীবন ছিল মাথার ওপরের হালকা নীল তুলি বুলোনো আকাশের মত। আর জীবন জুড়ে জেঠিমা ছিলেন গাছেদের মতোই স্নেহের ছায়া-শীতলতা বিছিয়ে।
উঠোনের এককোণে ছিল জেঠিমার তুলসীমঞ্চ। সকালে স্নান সেরে এসে এক পিঠ ভেজা চুলে তিনি পিতলের ঘটি থেকে তুলসী গাছের গোড়ায় জল দিতে দিতে চোখ বুজে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন। সকালের নরম ফিকে হলুদ আলো জেঠিমার মুখে এসে পড়ত। মুখে তাঁর খেলে যেত এক স্বর্গীয় দীপ্তি।
আবার সেই উঠোনেই ছোট্ট এক পুকুর কেটে জেঠিমা নাটাই পুজো করতেন। কখনও শনি-সত্যনারায়ণ পুজো করতেন। প্রিয় সেই উঠোনটিতে পাত পেড়ে বসে আমরা পুজোর প্রসাদ খেতাম। দোলের দিন উঠোনের এককোণে উনুন খুঁড়ে আমাদের পিকনিক হত খিচুরি, আলু ভাজা, ডিম কষা দিয়ে। হাসি মুখে গরম গরম খিঁচুরি রাঁধতেন জেঠিমা। কাঠের জ্বালের লালাভ হলুদ আভায় তাঁর ফর্সা
মুখখানিতে নরম আদুরে ভাব ফুটে উঠত।
উঠোনের পুব দিকে ছিল জেঠিমাদের শোবার ঘর, বারান্দা আর বারান্দা লাগোয়া আরও একটি ছোট্ট ঘর। পশ্চিমে ছিল মা আর জেঠিমার রান্নাঘর পাশাপাশি, পরিচ্ছন্ন নিকোনো দাওয়া। উঠোনের উত্তর দিকের শোবার ঘরটিতে আমরা থাকতাম। আর উঠোনের দক্ষিণ প্রান্তের পুরোটা জুড়ে ছিল জেঠিমার কিচেন গার্ডেন। লাউ, কুমড়ো , ঝিঙে, ঢ্যাঁরশ, লঙ্কা, লেবু ফলত সারা বছর। আর ছিল মস্ত একটা সজনে গাছ। ফাল্গুন মাসে সেই ফুলবতী সজনে সুন্দরী সাদা মুকুট মাথায় বড় আহ্লাদে মাথা নাড়ত। আর উঠোনখানা ঘিরে মায়ের মতো আঁচল বিছিয়ে ছড়িয়ে দিত ফুলেল আদর। আবার ফলবতী সজনের সবুজ ডাঁটাগুলোও তিরতিরে মিহি বাতাসে দুলে দুলে উঠত। উঠোন ঘিরে সম্ভ্রমে মাথা উঁচু করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকত আম, জাম, আতা এবং কাঁঠালেরাও। আর উঠোনের অনতিদূরে পাতকুয়োটি এক বুক ঠান্ডা জল নিয়ে অপেক্ষা করত কখন আমরা জল তুলে ঝুপ ঝুপ স্নান করব। আর গা মুছিয়ে দিয়ে জেঠিমা আমাদের সারা গায়ে তেল মেখে দেবেন। শীতকালে সর্ষের তেল আর আর বাদবাকি সারাটা বছর নারকেল তেল।
গ্রীষ্মের সন্ধেতে হ্যারিকেনের ফিকে হলুদ আলোয় ওই উঠোনেই মাদুর পেতে আমরা দাদুর কাছে পড়তে বসতাম। দুলে দুলে পড়া মুখস্থ চলত। জেঠিমার বাগান থেকে তখন লেবুফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। স্কুলের বইতে "রাতের আকাশ" পড়তে পড়তে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল প্রভৃতিকে বইয়ের পাতা থেকে সোজা আকাশের গায়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখতাম। মিলিয়ে নিতাম সত্যি সত্যি সপ্তর্ষিমন্ডলকে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দেখাচ্ছে কিনা! আর মিলে গেলেই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠতাম। কখনও কখনও উঠোন পেরিয়ে জেঠিমার ঠাকুরঘর থেকে ভেসে আসত ঠাকুরের গান, "... হরি নাম পরম ব্রক্ষ্ম/ জীবের মূল ধর্ম/ অধর্ম কুকর্ম ছাড়রে।..." সে গানের মানে তখন বুঝতাম না। শুধু বুকে এসে বাজত একটি শব্দ "কুকর্ম", মনেহত বুঝিবা জেঠিমা আমাদের কুকর্মগুলো জেনে গেছেন। দুপুরের উঠোনে শুকোতে দেওয়া জেঠিমার আচার, আমসত্ত্ব সাবাড় করবার কুকর্ম যে করে ফেলেছি। খুব লজ্জা হত তখন।
সেই উঠোনেই একদিন কলাগাছ দিয়ে তৈরি হয়েছিল ছাঁদনাতলা। জেঠিমার ছোট মেয়ে রেখাদির বিয়ের আসর বসেছিল — মালাবদল, শুভদৃষ্টি। পরের দিন বাসি বিয়ে। সাত পাক ঘুরিয়ে সিঁদুর দান, তারপর আংটি খেলা৷ সবশেষে ওই উঠোন ছেড়েই কাঁদতে কাঁদতে রেখাদির শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ার ঘটনা খুব কষ্ট দিয়েছিল আমাদের। তারও পরে যেদিন ঘোর কালো এক বৃষ্টির দিনে কানায় কানায় ভরা রাক্ষুসে নদী জেঠিমার বড় মেয়ে শিখাদিকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনও শেষবারের মতো সেই নিকোনো উঠোনেই তার শয্যা পাতা হয়েছিল। "বল হরি হরি বল" বলতে বলতে শিখাদিকে নিয়ে যাবার সময় দুধ সাদা খইগুলো যেন কেঁদে কেঁদে মুক্তোদানার মতো উঠোনের ইতিউতি ছড়িয়ে পড়েছিল। জেঠিমা আর্তনাদ করে কেঁদে চলেছিলেন। সঙ্গে আমরাও কাঁদছিলাম হাপুসনয়নে। উঠোনও কি আমাদের দুঃখের শরিক হয়েছিল সেদিন? নাকি নির্কিকার, নিরাসক্ত সত্য দ্রষ্টার মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছিল শিখাদির চলে যাওয়া?
আমাদের সেই দুই-ঘর এক-উঠোন একদিন আর রইল না। বাবা-মায়ের আঙুল ধরে আমরা পাড়ি দিলাম অন্য এক উঠোনে। সে উঠোন নাকি আমাদের নিজেদের বাড়ির উঠোন। কিন্তু মন কেন তাতে সায় দেয় না? কেন আজও নিজের একান্ত উঠোন বলতে জেঠিমার স্নেহবিজরিত সেই উঠোনটিকেই বড় মনেপড়ে? আমি কি সত্যি সত্যিই শুধু আপন ঘরে নয়, বিশ্ব ঘরেও ঠাঁই পেয়েছিলাম?
No comments:
Post a Comment