বন্ধু
লীনা রায়
রাত আটটায় ডিনার। কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটায় ঘুমোতে যায় অমিতেশ। দীর্ঘদিনের অভ্যেস। আজকাল ঘুমানোর আগে প্রতিদিন প্রমিস করেন মর্নিং ওয়াকে যাবার। কিন্তু ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেও আলসেমি শরীরে ভর করে। অথচ রণিতা থাকাকালীন দুর্যোগ ছাড়া তার সকালের হাঁটা বাদ যায়নি। আজ দু' মাসের ওপর সকালটা তার বিছানাতেই কাটে। অপরাধবোধ হয়। এত অবহেলা শরীর সইবে তো! কিন্তু তারপরেও বালিশটাকে আরো জোরে আঁকড়ে বিছানাতেই পড়ে থাকে।
সেদিনও সকালে বিছানাতেই ছিল অমিতেশ। হঠাৎ একটা জান্তব শব্দ কানে এলো। গোঙানির মত, খুব বিচ্ছিরি। বাড়ির সামনের দিক থেকে আসছিল শব্দটা। কিছুক্ষন পর বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পরদিন, তার পরদিন সেই এক রকম শব্দ। আর এই শব্দটার জন্যই অমিতেশ সেদিন বিছানা ছেড়ে সামনের বারান্দায় আসে।
শেষ কবে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল ভুলে গেছে অমিতেশ। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। তার বাড়ির মুখোমুখি রাধাকৃষ্ণ আবাসন। আর সেই আবাসনের ডানদিকের তিনতলায় প্রীতম শাহুর ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটি দীর্ঘদিন বন্ধ। ওখানে কেউ থাকত না। সেই ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একটি বছর ষোলোর ছেলে পাখিদেই বিস্কুট দিচ্ছে। আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। ছেলেটি মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। হাঁটা চলাতেও সমস্যা রয়েছে। ব্যালকনির রেলিংয়ে রাখা বিস্কুট পাখি ঠোঁটে করে তুলে নিলেই ও অদ্ভুত শব্দ করছে। শব্দটা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সেটা বুঝতে পারে।
ওকে অবাক যায় দেখছিল অমিতেশ। ছেলেটিকে দু' হাতে শক্ত করে ধরে আছে একজন পুরুষ। চোখে চোখ পড়তেই ভদ্রলোক একটু হাসলেন। অমিতেশ হেসে হাত নাড়ে। আর এভাবেই শুরু। অমিতেশ সকালে উঠেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাবা, ছেলের পাখিকে বিস্কুট খাওয়ানো দেখে। মাঝে মাঝে ছেলেটির মা এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সুন্দর মুখশ্রী, বড় বড় দুটো চোখ, ঘাড়ের কাছে আলতো করে ফেলে রাখা খোঁপা। ছেলেটির আনন্দ দেখে ওদের স্বামী স্ত্রীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অমিতেশও খুশি হয়। খুশি খুব ছোঁয়াচে। ওরা ঘরে ঢুকে যায়, কিন্তু অমিতেশ বসেই থাকে। রোদের তাত বাড়লে ঘরে ঢোকে।
বারান্দায় বসে বসে সবার ব্যস্ততা দেখে অমিতেশ। রণিতার অবর্তমানে তপুর হাতেই ওর সংসার। রান্না, ঘরের কাজ , বাজার, দোকান অব্দি। সেদিন জলখাবার খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল অমিতেশ। সে সময় সেই অদ্ভুত শব্দটা শুনতে পায়। শব্দটা বেশ জোরালো। এক নাগাড়ে হয়েই চলেছে। বারান্দায় আসতেই চমকে ওঠে অমিতেশ। ছেলেটি আবাসনের গেটে দাঁড়িয়ে একভাবে চিৎকার করছে। ওর মা প্রাণপনে ওকে টানছে। ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। অমিতেশ তাড়াতাড়ি গায়ে জামা গলিয়ে ওদের কাছে আসে। মায়ের কাছে জানতে পারে ছেলেটি বাইরে ঘুরতে যাবার জন্য বায়না করছে। কিন্তু ওর মা সাহস পাচ্ছে না।
অমিতেশের খুব মায়া হয়। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে - তোমার নাম কী?
ছেলেটি মাথা নাড়াতে থাকে একভাবে। ওর মা জবাব দেয় – আমরা ওকে রনি বলে ডাকি।
অমিতেশ এবার বলে - ঘুরতে যাবে রনি?
কথাটা শোনা মাত্র রনি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে।
অমিতেশ রনির মাকে বলে- সামনেই তো পার্ক। ওকে নিয়ে গেলেই তো পারেন। সারাদিন ঘরে আটকে রাখা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। চলুন।
অমিতেশের গলার স্বরে হয়ত আদেশ ছিল। রনির মা গেট খুলে ওকে নিয়ে বাইরে আসে। গেট খুলতেই রনির সে কী আনন্দ। হাততালি দেবার চেষ্টা করছে, মাথা নাড়ছে। অমিতেশ রনির হাত ধরে।
পার্কে কিছুক্ষন কাটিয়ে রনিকে ওদের ঘরে পৌঁছে বাড়ি ফেরে অমিতেশ। রনির মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে রনির অসুখের কথা। জেনেটিকে ডিসঅর্ডার। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করে। আগে অফিসের কাছেই থাকত। তাই রনিকে নিয়ে সকালে বের হতে অসুবিধে হত না। কিন্তু এখান থেকে অফিসের দূরত্ব অনেকটা। সেজন্য রনির বাইরে বেরোনো বন্ধ।
পরদিন অমিতেশ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। তৈরী হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাধাকৃষ্ণ আবাসনের তিনতলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে তখন রনি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে। অমিতেশ খানিকটা গলা তুলে রনিকে ডাকে। বলে- আমার সঙ্গে পার্কে যাবে রনি? এসো…
খুব দুর্যোগ না হলে আজকাল অমিতেশের সকালের হাঁটা বাদ যায় না। সঙ্গী রনি। একজন অপরিণত কিশোর আর ষাটোর্ধ যুবকের মাতামতিতে সকালের ঝিমিয়ে থাকা পার্কেও ঝলমলে খুশি। আর হ্যাঁ, রনি কিন্তু অমিতেশকে বোন..দু..উ বলেই ডাকে।
No comments:
Post a Comment