Wednesday, July 2, 2025


 

কালিন্দিপুর
  অর্ণব ঘোষ

_খেজুরি দেবেন একটা।
_ সরি। শেষ বাস মিনিট পাঁচেক আগেই ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আপনাকে ভোর অবধি অপেক্ষা করতে হবে।
বলেই মুখের ওপর কাউন্টার শাট ডাউন করল লোকটা।

বাইরে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি হচ্ছে। একটা কাক-পক্ষীও নেই ওয়েটিংরুমে। কুকুরগুলো মাঝেমধ্যেই ডেকে উঠছে বিচ্ছিরিভাবে। রঞ্জন হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে দশটা। খুব খিদে পেয়েছে ওর। দোকানপাটগুলোও সব বন্ধ। অগত্যা ক্লান্ত বিধস্ত শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিল ও। তন্দ্রার ভাব আসছিল। কিন্তু তাতেও বাধ সাধল বেয়াদপ মশা।

_নাঃ। এভাবে সারারাত কাটানো যায় নাকি! কিছু একটা উপায় বার করতেই হবে। বৃষ্টিও দেখছি ছেড়ে এসেছে।

হঠাৎ মনে পড়ল কামিনী কাকার কথা। বাবার দুঃসম্পর্কের ভাই। বহুবছর অবশ্য যোগাযোগ নেই। তবু, এই দুর্দিনে যদি রাতটুকু আশ্রয় মেলে তাই বা কম কি! ছাতাটা ফোটাল রঞ্জন। ঝিরঝির বৃষ্টি এখনও হয়ে চলেছে।
_ বাড়িটা যেন কোন্ দিকে?
রঞ্জন মনে করার চেষ্টা করল। কৈশোরে বাবার সাথে এসেছিল একবার। কাকা একাই থাকেন, বিয়ে-থা করেননি।

গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে রঞ্জন হাঁটতে শুরু করেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রখর নিস্তব্ধতায় ছেদ টানছে শুধু ঝিঁঝির ডাক। অবশেষে একটা রঙচটা,মলীন, ঈষৎ ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাল রঞ্জন।

 কামিনী কাকা..., কামিনী কাকা..., বাড়িতে আছো?
খাটো, শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ দরজা খুললেন। তার চোখদুটো ঘোলাটে, মুখের ভাঁজ যেন অনেককালের সাক্ষ্য বহন করছে।
_ তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
_ আমি তারিণী ঘোষের ছোটছেলে, খেজুরি থাকি। কালিন্দিপুর এসেছিলাম একটু গবেষণার কাজে।
_ ও..! হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি এবার। ভেতরে এসো বাবা।
_ বোসো। তা তোমার গবেষণা কী নিয়ে?
_ মৃত্যু, আত্মা, পরলোক। আপনি জানেন মৃত্যু আসলে কী?

_মৃত্যু আসলে ঘুমেরই পূর্ণরূপ। প্রতিদিনই আমাদের একপ্রকার মৃত্যু হয়। জেগে উঠতে পারলেই তা ঘুম, না পারলেই তা মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে যেমন কোনো নিয়ন্ত্রন থাকেনা, মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে সত্য। ঘুম সতেজ করে শরীরকে, আর মৃত্যু মনকে।
_ মন তাহলে কী?

_দেখো, মন বলে কোনো প্রাকৃত অঙ্গ নেই। এটা হৃৎপিন্ড নয় আবার মস্তিষ্কও নয়। মন আসলে মস্তিষ্কপ্রসূত এক চিন্তার-আধার।
_ আত্মার সাথে কি এর মিল আছে?

_ বলতে পারো। মারা যাবার পর এই চিন্তা-সমন্বিত আধারের মুক্তি ঘটে। ওটি তখন সর্ববৃহৎ আধারে মিলিত হয়, যেভাবে নদী মিলিত হয় সাগরে।

_ সর্ববৃহৎ আধারই কি তবে পরমাত্মা?

_ হবে হয়তো। তবে তার কোনো ব্যপ্তি নেই। মানবের তুচ্ছজ্ঞান বা কল্পনায় তাকে ধরা যায় না। অনেকটা গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মতো।

_ বৃদ্ধের জ্ঞান ও বিশ্লেষণে অভিভূত হচ্ছিল রঞ্জন। মনের কৌতূহল জঠরের আগুনকে চাপা দিয়েছে ইতিমধ্যেই। নির্ঘুমেই বেড়ে চলেছে রাত। সারাদিন খেটেখুটে যে তথ্য জোগাড় করতে পারেনি, এক লহমায় দর্শনতত্ত্বের সেই নির্যাসটুকু আত্মস্থ করতে চাইছে ও।

_পরলোক সম্পর্কে কী বলবেন?

_পরলোক আসলে একটা অনুভূতি। সেই চিন্তা-সমন্বিত আধারের কামনা-বাসনা সম্পৃক্ত স্মৃতি-বিজরিত সবাঙ্গীন অনুভূতি। তবে তা নিয়ন্ত্রণহীন। আমার "আমি" সেখানে নিতান্তই অসহায়। এই অসহায়তা ঠিক স্বপ্নের মধ্যেকার অসহায়তার মতোন- জেগে ওঠা তথা জন্মাবধি পর্যন্ত।

এতো অব্ধি ব'লে বৃদ্ধ উঠে গিয়ে কিছু খাবার আর একগ্লাস জল নিয়ে এলেন।
_ খাও। আমি একটু আসছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরও বৃদ্ধ আসছেননা দেখে রঞ্জন পাশের ঘরে উঁকি দিল।

 কী সবর্নাশ! বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল রঞ্জনের। বৃদ্ধ তখন তারিনীর সাথে বসে দাবা খেলছেন। কিন্তু রঞ্জনের বাবা তো বছর সাতেক আগেই মারা গেছেন। তাহলে.., তাহলে কামিনীও কি.....???

রঞ্জন চিৎকার করতে চাইল। পারলনা। দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করল। নাঃ, পা নড়ছেনা একচুলও। স্বপ্ন দেখছেনাতো ও? নাকি.., নাকি রঞ্জনও......!!

একি সত্যিই কালিন্দিপুর নাকি এ অন্য এক মৃত্যুপুরী?

No comments:

Post a Comment