জীবিত না মৃত?
শুভেন্দু নন্দী
নিঃশব্দ রাত্রিকে খানখান করে বেজে উঠলো ঘড়িতে এগারোটা। বাড়িতে এই মুহুর্তে অর্ক একা। একটা গোয়েন্দা গল্পে সদ্য মনোনিবেশ করেছে, সেই মুহুর্তে দরজায় খুটখুট আওয়াজ। বাইরে নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। অকাল বর্ষনের ধারা। দপ করে সব আলো নিভে গেলো। লোডশেডিং। কলিংবেল সম্ভবতঃ সেই কারণেই অচল। অর্ক ধীরে ধীরে ঘরের সদর দরজার পানে অগ্রসর হোলো। দরজায় লাগানো গোলাকার ছোট্ট লেন্সে চোখ নিবদ্ধ করলো। নাঃ আগন্তুক সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছু ধারনা অনুভূত হোলোনা ।মোবাইল-লাইট জ্বালিয়ে সভয়ে ও কিছুটা সন্তর্পনে অর্ক দরজা উন্মুক্ত করলো।
-আরে! শ্যামল কাকু তুমি? এই ঝড়,জল,রাতে?
পরনে তাঁর রেইনকোট, হাতে পুরনো আমলের ছাতা আর একটা জীর্ন ঢাউস ব্যাগ।চোখে-মুখে ক্লান্তি ও অনিদ্রার ছাপ স্পষ্ট। গালে দু-তিন দিনের
না-কামানো বাসি দাঁড়ি। একী চেহারা! মিলিটারীতে
সার্ভিস করা এই শ্যামল কাকুুর ? প্রায়ান্ধকারেও বেশ বুঝতে পারলো। কিছুটা অবাকই হোলো অর্ক।
কিন্তু এত রাতে সে প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করলা না অর্ক।
"দাঁড়াও, মোমবাতি একটা জ্বালাই । কি যে বিড়ম্বনা! কতক্ষণ যে এই অন্ধকারে কাটবে।
এসো এসো । ভিজে গেছো দেখছি। ছাতা,বর্ষাতি ঘরের কোণে রেখে দাও।"
- তা তুই একা? আর সব কোথায়? আগন্তুকের প্রশ্ন।
- বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গেছে। আমি আজ কলেজের পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরেছি। যেতে ইচ্ছা করলোনা তেমন তাই। যাও, বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। এই নাও পাঞ্জাবী,পাজামা আর তোয়ালা। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।"
- ঠিক আছে। আমি কিন্তু কাল খুব ভোরে.....
কথাটা তাঁকে শেষ করতে না দিয়ে বললো,"ঠিক আছে।" বাবা-মা কিভাবে ব্যাপারটা নেবে ভেবে একটু আশঙ্কিত হয়েই তাঁকে সমর্থন করলো অর্ক।
চারটে রুটি, সব্জি ঢেকে রেখে দিয়েছিলেন মা যাবার সময়। সেটার থেকে আর একটা ডিসে ও বাটিতে খাবার ভাগ করলো।
খাবার মিটে যাবার পর ডাইনিং হল সংলগ্ন পাশাপাশি দুটো ঘরের একটিতে পরিপাটি করা বিছানায় শয্যা নিলেন শ্যামলবাবু ।
রাতে তেমন কথা হোলোনা। কিন্তু একটা রহস্য রয়ে গেলো। হঠাৎ কি কারণে এ পাড়ায় নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও এখানে আশ্রয় নিতে হোলো। এই দুর্যোগের রাতে? বেশী রাতে খাওয়াদাওয়ার শেষে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে অবশেষে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো অর্ক।
পরের দিনে ঘুম ভাঙতে বেশ দেরী হোলো। সকাল নটার কাছাকাছি। পাশের ঘরে দেখলো ঘর খালি অর্থাৎ কাকু চলে গ্যাছেন ইতিমধ্যে দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে। দরজাটা বন্ধ করে দিলো অর্ক।
- কেমন হোলো ব্যাপারটা? অনেক প্রশ্ন মনে ভীড় করেছিলো অর্কর কিন্তু তার তো সদুত্তর মিললোনা।অর্ক দেখলো উপরে টাঙানো একটা এনলার্জড গ্রুপ পারিবারিক ফটো যাতে মধ্যমনি হয়ে রয়েছেন স্বয়ং শ্যামল কাকু। তাদের অত্যাধুনিক ক্যামেরাতে বন্ধু জয়ন্ত শ্যামল কাকুর অনুরোধে তুলেছিলো। আর ইঞ্জিনিয়ারীং কলেজে জয়েন করার পূর্বে অনেক আশীর্বাদ করেছিলন কাকু আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা রহস্য সিরিজের বই তাকে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন "এটা আমার তরফ থেকে উপহার তোর জন্য".....
এমন সময়ে দরজার উপরে কলিংবেল বেজে উঠলো তাকে সচকিত করে।
-তাহলে ওরা এসেছে ! আনন্দে আত্মহারা হোয়ে
দরজার ছিটকিনি খুললো।
- কাল খেয়েছিলি তো? তোর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল? মার প্রশ্ন। রমলা মাসী এখনও আসেনি?
- দাঁড়া, তোকে চা করে দিই, কেমন? গেলেও পারতিস আমাদের সঙ্গে। তোর কথা ওঁরা খুব বলছিলো রে।
এই সময়ে জুলি বলে ওঠে" দেখো মা, একটা ডিস
ও বাটি উপুড় করা -বেসিনেের পাশে খোলা জায়গায়"
- দেখছি দাঁড়া। দাদাকে চা,জলখাবারটা দিই আগে।
-ওমা! তাই তো? কেউ এসেছিলো নাকিরে?
বন্ধুটন্ধু ? জয়ন্ত? আর থালা, বাটি তো বেশ পরিপাটি করে মাজা।"
-হ্যাঁ মা,রাত এগারোটার পরে। তবে জয়ন্ত নয়। শ্যামলকাকু।" একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলো অর্ক।
- কী বলছিস পাগলের মতো। মা যেন একটু চমকে উঠলেন।
কেন, মা? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অর্ক ।
-সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে রে। চারমাস আগে তো এনকাউন্টারে মারা গেছেন তোর মিলিটারী কাকু !
- আমি তো জানতাম না। তা হোলে, মা কী হবে? একটু কেঁপে উঠলো আর ধপাস করে বসে পড়লো অর্ক।
- কী রে দাদা. কাকু কী ভূত হয়ে এসেছিলো?বোনের প্রশ্ন।
- ওরে আমার কী হবেরে ? বিয়ে বাড়িতে তুই গেলে এই কান্ডটা ঘটতো না। কত করে বললাম-তুই তো
রাজীই হোলিনা। এই ব্যাপারটা কাউকে বলবিনা। এমন কি কাজের মাসিকেও। আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছেরে। তুই ঠিক দেখেছিস তো,খোকা ?
-হ্যাঁ মা। বলে দেয়ালে টাঙানো ফটোর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করলো অর্ক। বাবা বললেন," আরে! নিউজে তো বলেছিলো চারজন স্পট ডেড। শুধু একজন কোমাতে চলে গিয়েছিলো। এখনও হাসপাতালে। lying Inclined in bed ! তাহলে, খোকা কাকে দেখলো ? আমি তো প্রতিদিনই নিউজ চ্যানেল ও পেপার দেখছি। ভদ্রলোকের এখনও তো জ্ঞান ফেরেনি। নিজের বাড়ি থাকতে শ্যামলের এখানে কেনই বা আগমন ঘটলো এই ঝড়- জল রাতে? সবটাই রহস্যের মোড়কে আবৃত।
দেখা যাক, কালকের কী খবর হয়? চ্যানেল আর
পেপারই তো একমাত্র ভরসা। "
আরও একটা রাত কেটে গেলো । পরের দিন তাঁর বাড়িতে পাড়ার নেপাল প্রতিদিনের মত পেপার দিয়ে গেলো। বাবা মানে রমেনবাবু বলে উঠলেন সকলের উদ্দেশ্যে " এই দেখো। ভদ্রলোকের sense নাকি ফিরে এসেছে। প্রেস, মিডিয়া সকলকে তিনি বলে যাচ্ছেন তাঁর আচ্ছন্ন অবস্থায়,
" শ্যামল কোথায়?" সে তো আমার পাশেই ছিলো।
সে তো মারা যায়নি স্পটে। বরং উঁচু পাহাড় থেকে
তার পড়ে যাবার সম্ভাবনা "
প্রেস,মিডিয়া সমস্বরে বলে উঠলো" কিন্তু ডিপার্টমেন্টের কথায় " চারজনই নাকি স্পট-ডেড? আর তাতে স্পষ্ট করে শ্যামলের কথারও উল্লেখ ছিলো।"
- তাহলে শ্যামলের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকেও
একদম উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা, তাই না? বলে বাবা সবাইকে একটু আশ্বস্ত করলেন।
- "হে ঠাকুর! তাই যেন হয়" - অর্ক মনে মনে বলে উঠলো। "তাছাড়া, ঐ ভদ্রলোকের কথামতন অত উঁচু পাহাড় থেকে পড়েও তিনি যে অক্ষত রয়ে যাবেন, তার গ্যারান্টি কোথায়?"
- তবে কি রাখে হরি মারে কে?
পুরো ব্যাপারটার মধ্যে বেশ রহস্যের গন্ধ পেলো অর্ক। এ রহস্যের উদঘাটন করতে পারেন একমাত্র
শ্যামলকাকু- অবশ্য যদি তিনি সত্যি সত্যিই ফিরে আসেন তবেই। আর তারই অপেক্ষায় থাকতে হবে- ভাবতে ভাবতে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। পরশু রাতের ঘটনাটা বারে বারে যেন উসকে দিচ্ছে অর্ককে।
No comments:
Post a Comment