মানসকন্যা
ঋতুপর্ণা ধর
সৃজনী জানালার পাশে বসে থাকে। বিকেলের আলো ছুঁয়ে যায় তার কপাল, চোখেমুখে খেলে যায় এক অনুচ্চ বিস্ময়ের রেখা। জানলার ওপারে গলফের মাঠ, সেখানে সাদা পাখির মতো কিছু বাচ্চা দৌড়োচ্ছে। সে ওদের দেখে না, আসলে দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তার ভেতরে আরেকটা পৃথিবী আছে—ছায়ার মতো, অথচ ঠিক নিজের ছায়া নয়।
সেই ছায়ার নাম "নিশীতা"।
নিশীতা—সৃজনীর গল্পের মানস কন্যা। একবার এক ছোট গল্পে সে তাকে সৃষ্টি করেছিল, ভেবেছিল নিছক একটি চরিত্র, কিছুদিন থাকবে, তারপর অন্য চরিত্র এসে তাকে সরিয়ে দেবে। কিন্তু নিশীতা তেমন নয়।
সে নিজের মতো ভাবতে জানে। কথা বলতে জানে।
প্রথমে সৃজনী অবাক হয়েছিল। একটা চরিত্র যদি প্রশ্ন তোলে—"তুমি কেন আমায় এইভাবে গড়ে তুললে?"—তখন কী উত্তর দেওয়া যায়?
সৃজনী প্রথমে গল্পে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল তাকে। একটি নির্দিষ্ট পরিসরে বাঁধতে চেয়েছিল—নাটকের চরিত্র যেমন, আলোর ভেতরে জন্মায় আর অন্ধকারে গলে যায়। কিন্তু নিশীতা থেকে যায়।
অন্ধকারেও।
রাত্রে যখন সৃজনী তার স্টাডি ডেস্কে বসে লিখছে, হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়—এই তো, নিশীতা তো রাগ করেছিল গত পর্বে, তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি।
তখন মনে হয়—সে কি ঠিক করেছিল? নাকি লেখিকা নিজেই ভয় পেয়েছিল?
গল্পের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় একধরনের অন্তর্জল। নিশীতা কখনো সৃজনীর মতো কথা বলে, কখনো উল্টো। বলেই ফেলে—
"তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো ভালোবাসা শুধু উপলব্ধি? না কি একটা নিঃসঙ্গ যুদ্ধ?"
সৃজনী তখন আর জানে না কে কার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
লেখালিখি এখন তার কাছে দৈনন্দিন কাজ নয়। সেটা একটা মানসিক অনুসন্ধান, যেন নিজের ছায়ার ভিতর ডুবে গিয়ে কার মুখ দেখতে পাওয়া। নিশীতা এখন শুধু গল্পের চরিত্র নয়, তার আচরণে, ভাবনায়, এমনকি গলার আওয়াজে এসে গিয়েছে তার ছাপ।রোজ রাতে মনের ঘরে আসন পেতে দিনযাপন কেমন হলো তা নিয়ে গভীর আলোচনায় বসে দুজনে। মুখোমুখি হয়... চোখাচোখি হয়... চোখ নামিয়ে কলম ধরে সৃজনী। লিখে চলে বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপট।
একদিন একজন সহকর্মী বলল,
— "তুমি বদলে গিয়েছ সৃজনী, আগের সেই কৌতূহলী চোখের মেয়ে আর নেই। এখন তুমি যেন সব জানো, অথচ কিছু বলো না!"
সে হেসেছিল। কিন্তু উত্তর দেয়নি।
ভেতরে নিশীতা বলেছিল—
"জানা আর বলা এক নয়। আর আমি তো এখন তোমার মুখেই থাকি!"
সৃজনীর মনে পড়ে, তার প্রথম পুরস্কার পাওয়া গল্পে নিশীতা গলায় দড়ি দিয়েছিল। পাঠক কেঁদেছিল, বিচারকেরা বাহবা দিয়েছিল তার মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার জন্য।
কিন্তু সৃজনী জানত—সে গল্প লিখতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল। শেষ লাইনটা লেখার পর তার ঠোঁট ফাটছিল, বুক ধড়ফড় করছিল—সে কি নিশীতাকে মেরে ফেলেছে?
না, নিশীতা মরে না।
সে থেকে যায়।
আর এখন, প্রতিটা গল্পেই একটু একটু করে নিজের শরীর তৈরি করছে। যেন একদিন উঠে দাঁড়াবে, সৃজনীর চোখে চোখ রেখে বলবে—
"এখন আমি লিখব। তুমি শুধু কাগজটা ধরো।"
No comments:
Post a Comment