Friday, October 3, 2025



 বিজনবাড়ির বিজনে

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য 


দার্জিলিঙ পাহাড়ের ঘুম থেকে যে রাস্তাটা উঠে গেছে সান্দাকফুর দিকে, তারই পথে অনেকটা এগিয়ে তবে দেখা পাওয়া যায় নিরিবিলি শান্ত পাহাড়ি গ্রাম বিজনবাড়ির। বছরের গোড়ার দিকে এই বিজনবাড়ির রেলিংয়ের পোখরেল পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে ছিল আমাদের সপরিবার নিমন্ত্রণ। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মোট দিন তিনেক ছিলাম বিজনবাড়িতে। বিজনবাড়ির ভেতরে রেলিং অঞ্চলের দিকটা যতটা নিরিবিলি আর কোলাহলহীন, মূল বিজনবাড়ি বাজার এলাকা ও শহুরে অংশটুকু আবার তুলনায় যথেষ্টই ঘিঞ্জি, এবং উন্নতও। অতটা ওপরে হওয়ার পরেও রাজ্য সরকারি বোর্ডের ভাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে রেলিং গ্রামে। তবে নামে গ্রাম হলেও আদতে কিন্তু এই গোটা রেলিং এলাকাই বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম ও সাধারণ বসবাসের উপযোগী সবরকম পরিষেবাযুক্ত। ক’বছর আগে গোটা পাহাড় এলাকার মধ্যে আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল বিজনবাড়ির রেলিং গ্রাম। তবে জায়গাটা নৈসর্গিক দিক দিয়ে এতটা স্বর্গীয় সুন্দর হলেও ঘুমের পর থেকে বিজনবাড়ি পৌঁছনোর রাস্তার অবস্থা ভীষণই ভয়াবহ। গোটা রাস্তাটাই অজস্র ছোট বড় খানাখন্দ আর ভয়ানক ভাঙাচোরা পথের কোনও কোনও জায়গায় আবার এই সময় মানে মার্চের মাঝামাঝি রাস্তার কাজ চলার জন্য গাড়িতে যাতায়াত করাই দুষ্কর। এখানকার নিয়মিত গাড়ি চালকদের কাছেই এ রাস্তার নাম এখন ‘ডান্সিং রোড’ অথবা ‘হজমলা রোড’, অর্থাৎ এ রাস্তায় কিছুক্ষণ চললেই পেটের যাবতীয় খাবার সম্পূর্ণ হজম হয়ে যেতে বাধ্য! আমি বাইরে গেলে ইচ্ছে করেই সাধারণ বাস বা শেয়ারের গাড়িতেই যাতায়াত করি, কারণ তাতে ওই পথের নিয়মিত যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষজনের সাথে আলাপের সুযোগ ঘটে যায় অনায়াসে, তাদের গল্প জানা যায় সহজে। কিন্তু এই ব্যক্তিগত পছন্দটুকু সরিয়ে রেখেও বলব অন্তত এই বিজনবাড়ির পথে নিজের শারীরিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তির খাতিরে নিজস্ব গাড়ি নয়, বরং পাহাড়ের দক্ষ গাড়ি চালক যারা কিনা এ রাস্তায় নিয়মিত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করছে তাদের সঙ্গে শেয়ার গাড়িতে যাওয়াই মঙ্গলজনক। তাতে পথের দুর্গমতা ও অসংখ্য চোরা বাঁক সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থেকে পথের স্বর্গীয় সৌন্দর্যটি পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। বিজনবাড়ি এখনও স্পট হিসেবে যথেষ্ট আনকোড়া এবং দুর্গম এবং বিজনবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটিও ভারী সুন্দর। এত ঘন সবুজে মোড়া পাহাড়ি রাস্তা দার্জিলিঙ পাহাড়ে খুব কমই আছে। এ রাস্তা তাই চোখে আরাম দেয়, মন দেয় ভিজিয়ে। শুধু এই প্রাণের আরামটুকুর জন্যেই বোধহয় হাজারো অসুবিধে সত্ত্বেও বার বার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে ছোট্ট শান্ত কোলাহলহীন এই পাহাড়ি জনপদটিতে।



বিজনবাড়িতে তিনটে দিন আমরা ছিলাম সাশিং ভ্যালি হোমস্টেতে। এই হোমস্টেটি গাড়ি চলাচলের রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উৎরাই নেমে গিয়ে প্রশস্ত খোলামেলা অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। হোমস্টের চারদিক সবুজ আচ্ছাদিত পাহাড়ে ঘেরা। এখানে থাকার দোতলা কটেজগুলো একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা গ্রাউন্ড জুড়ে সুন্দর করে বানানো। মাঝের খোলা অংশে আছে সুইমিং পুল, তার ওপারে ব্যাডমিন্টন খেলার বড় গ্রাউন্ড এবং আয়েস করে বসে রোদ পোহানো ও দূরের সবুজে মোড়া দিগন্তবিস্তৃত ঢেউখেলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য মাঠের মধ্যেই চেয়ার টেবিলওলা সুব্যবস্থা। বামদিকে ছড়ানো অনেকখানি অংশ জুড়ে হোমস্টেরই বিশাল ফার্ম। নিয়মিত দুধের জোগানের জন্য গরু মহিষ থেকে শুরু করে ছাগল মুরগি সবই আছে। এছাড়া অর্গ্যানিক ফল সব্জিরও ঢালাও চাষ হচ্ছে হোমস্টের ঘেরা এলাকার মধ্যেই। এর মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি আর পেঁপে গাছের ফলন তো আমরা নিজের চোখেই দেখলাম। এমনকি সকালের কাঠকয়লার আঁচে মাটির উনুনে সেঁকা মোটা মোটা রুটির সাথে রাই শাকের যে সব্জি হত প্রতিদিন তাও এদের খেতেরই। তবে মাটির উনুনের পাশাপাশি আজকাল গ্যাসের ব্যবহারও হয় ব্যস্ততার জন্য।



হোমস্টেতে থাকাকালীন প্রতিদিন সকালে আমাদের কাজ ছিল সকালের চা পান শেষে নীচের উৎরাই ধরে একটু হেঁটে আসা। হোমস্টের ছোট্ট কাঠের গেট ঠেলে বেড়োতেই ডানদিকে সোজা ওপরে উঠে গেছে গাড়িতে করে মূল রেলিং গ্রামে যাবার রাস্তা আর বামে এঁকেবেঁকে পায়ে হাঁটা পাহাড়ি মেঠো পথে নামতে নামতে প্রায় কিলোমিটার দুয়েক গেলেই কুলকুল শব্দে সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট রঙ্গিত। এই রঙ্গিত নদীর রিনরিনে জলের শব্দ সারারাত হোমস্টের বন্ধ ঘরের ভেতর থেকেও শোনা যায়। আমরা সাধারণত এই উৎরাই পথে নেমে আবার ডাইনে বেঁকে একেবারে নীচে গিয়ে ডানদিকে খেলার মাঠ ছাড়িয়ে পাশের নদীতে আর যেতাম না কারণ রঙ্গিতকে আমরা আরও ভাল করে দেখতে পেয়েছিলাম কনেবাড়ির রিসেপশনের দিন ওদের পারিবারিক রেলিং রঙ্গিত রিসর্ট থেকেই। আমাদের সকালের চা হাতে তাই রোজকার গন্তব্য ছিল হোমস্টের নীচের অংশের খোলা চাতাল মতো জায়গাটি যার ঠিক নীচ থেকে ধাপে ধাপে পাহাড়ের ঢেউখেলানো ঢাল বেয়ে নেমে গেছে ঝুমচাষের খেত। এই সময় অবশ্য খেতে ফসল ছিল না। বরং পোড়া খেতের ধাপে ধাপে গজিয়েছিল ঝাঁক ঝাঁক বেগনে রঙের খুদে খুদে পাহাড়ি ফুল। এই নাম না জানা অকিঞ্চিৎকর ছোট্ট বেগুনী, সাদা আর হলদে ফুলের ঝাড় আমাদের আসা যাওয়ার পাহাড়ি পথের ধার ঘেঁষেও ফুটে থাকতে দেখেছি অজস্র।



একটা আশ্চর্য জিনিস এখানে এসে প্রতি মুহূর্তেই ভীষণরকম অনুভব করলাম যে, শহুরে জনবসতির চাপ থেকে অনেক অনেক দূরের এই পাহাড়ি গ্রামে প্রকৃতির রূপে কোথাও এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই। পুরোটাই এখানে বড় আগোছালো ধরনের স্বাভাবিক, স্বকীয়, নিজস্ব, ঠিক যেমন এখানকার নির্বিবাদী সদাহাস্যময় মানুষগুলো। এই অঞ্চলের মনখোলা পাহাড়ি মানুষজনের আশ্চর্য স্বাভাবিক আত্মীয়তা আমাদের শহুরে চোখে কখনও এতটাই বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে থেকে থেকেই একটা অস্বস্তিকর কুণ্ঠা বোধ হয় এই ভেবে যে, এতটা সরল দরাজ আবেগ আজও এভাবে টিকে আছে কী করে? আর এত সহজ বিশ্বাসভরা ভালবাসা পাওয়ার আমরাই কি আজ আদৌ যোগ্য! বিজনবাড়ির প্রকৃতি, মানুষজন তাদের সবটুকু উদারতা নিয়ে তাই শেষমেষ মনের মধ্যেটায় রয়ে গেল বড় আপন হয়ে, এবং, আবারও খুব তাড়াতাড়ি এই পাহাড়ি স্বর্গলোকে ফিরে আসার নিজের সাথেই নিজের করে ফেলা এক একান্ত গোপন অঙ্গীকার নিয়েও।



বিজনবাড়ির পোখরেল পরিবার পাহাড়ের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক জায়গার পাশাপাশি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের নিজস্ব ভাষার পরিসরে রেখে চলেছেন যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য অবদান। এবং এই যৌথ পরিবারটির অভিভাবকসম সদস্য শ্রদ্ধেয় শ্রী নরহরি পোখরেল মহাশয়ের সাথে ফিরে আসার দিন বসে অনেকটা সময় একান্তে কাটানোর যখন সুযোগ হল, বিজনবাড়ির ইতিহাস নিয়ে, তাঁর জীবন ও পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কথা হল বিস্তারে। এমনকি আলোচনা শেষে তাঁর গোর্খা অর্থাৎ নেপালি ভাষায় লিখিত সময় বা যুগের কালচক্র নিয়ে প্রকাশিত অধ্যাত্মবাদ বিষয়ক বই ‘ফনকো’ এবং বিজনবাড়ির পুরনো ইতিহাস নিয়ে লিখিত সত্য সাঁই সেবা সমিতি থেকে প্রকাশিত বহুল তথ্যসমৃদ্ধ ‘সংক্ষিপ্ত ইতিহাস‘ বইদুটি উপহারও দিলেন তিনি স্নেহভরে। পোখরেলদের যৌথ বাড়ির পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে বিজনবাড়ির একমাত্র নিত্যপুজোর যে শিবমন্দিরটি আছে, যেখানে পুজোর পত্তন হয় সেই ১৭৩০ সাল থেকে, বর্তমান সেই মন্দিরটি স্থাপিত হয় তাঁরই উদ্যোগে। আসলে কোনও জায়গাই তো শুধু তার ইঁট কাঠ পাথর আর প্রকৃতি নিয়ে নয়, সে জায়গাগুলো বেঁচে থাকে আসলে সেখানকার মানুষগুলোর দৈনন্দিনের অস্তিত্বে, তাদের একান্ত অনুভবে, তাদের প্রতি মুহূর্তের যাপনে। এই সব টুকরো টুকরো অনুভবের গল্প জুড়েই আমার বিজনবাড়ির স্মৃতি। আজও ফিরে দেখলে বুঝতে পারি, এই টুকরো টুকরো আলোছায়ামাখা স্মৃতিগুলোই যাত্রা শেষে আমার একমাত্র প্রাপ্তিও বটে যা কিনা নিঃসন্দেহে এ মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল




(ছবি- লেখক)


No comments:

Post a Comment