রিঞ্চেংপঙ
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
সে এক রূপকথার দেশ। এই জায়গাটির সন্ধান পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই। সেবার পুজোর ছুটিতে কোথায় যাব ভাবছি,আমাদের দুইজনের এই ছুটিটাতেই একসাথে বেড়াতে যাবার একমাত্র সুযোগ থাকে। আমার এক কলিগ তখন এই জায়গাটির কথা জানাল, সে শুনেছে তার এক বন্ধুর থেকে। নেট ঘেঁটে একটু দেখে নিলাম,জায়গাটি অবস্থিত পশ্চিম সিকিমে,গ্যাংটক থেকে প্রায় ১২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে,গিয়ালসিং থেকে ৮৯কিলোমিটার দক্ষিণে, নিকটবর্তী গ্রাম কালুক। বেশ,তো চল পানসি রিঞ্চেংপং। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিমানের টিকিট কাটা হল।তার আগে অবশ্যই কলিগের দেওয়া হোমস্টের মালিকের ফোন নম্বর এ ফোন করে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে নেওয়া হল।উনি বললেন যে, হোমস্টে থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন,ড্রাইভারের নাম সন্তু। যথা সময়ে বিমান নামল বাগডোগরা। সন্তুর গাড়িতে রওনা হলাম হোমস্টের উদ্দ্যেশে। রাস্তা সরানোর কাজ চলছিল জায়গায় জায়গায়।রাত্রি হয়ে আসছিল।জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাস্তা,দেখা পেলাম এক বুনো বেড়ালের। অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে সন্তু আমাদের পৌঁছে দিল রাত নয়টার সময়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা,হবেই ৫৫৭৬ফিট উচ্চতায়। হোমস্টের ঘরে ঢুকেই পেয়ে গেলাম গরম খাবার,জল,সব। হোমস্টের মালিক এসে দেখা করে গেলেন।
পরেরদিন সকালে - 'সারপ্রাইজ,সারপ্রাইজ' তখন ঊষাকাল (ভোর ৪টে)। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক, "সামনের জানলাটা খুলে দিন তাড়াতাড়ি" ওই ভোরে কম্বলের তলা থেকে একটু বিরক্তি নিয়েই উঠলাম, তবে জানলা খুলতেই সব অসন্তুষ্টি চলে গেল। 'আহা কি দেখিলাম! '- শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা একদম ঘরের দুয়ারে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়লে সোনার বরণ ধারণ করল সে। এরপর গেলাম ওই হোমস্টের রুফ টপে। ঐখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ স্পষ্ট দেখা যায়। চা, ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আলাপ হল মালিক আর মালকিনের সঙ্গে। অল্পবয়সী ছেলেটির ফোনে আমার কর্তার গলার আওয়াজ শুনেই এতো ভাল লেগেছিল যে সে নিজেদের বাসস্থানেই আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। ওদের অন্য হোটেলে নয়।আলাপ হয়ে গেল ওদের সঙ্গে। সেখানেও লুকিয়ে রয়েছে এক গল্প। ওরা দুইজনে আদতে কলকাতার বাসিন্দা। হানিমুনে এখানে এসে পূর্ণিমার রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে এতো ভাল লেগে যায়, তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেলে যে , সব কিছু থেকে দূরে এখানে এসে থাকবে। তারপর এখানে এইবাড়িটিতে নিজেরা থেকে হোমস্টে হিসেবে শুরু করে তখন তারা গোটা দুয়েক হোটেলের মালিক। সত্যিই, এইখানে এলে মনে হয় যেন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছি। হোমস্টেটির সামনেই প্রসারিত মাঠ, তার একপাশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি বৌদ্ধ মন্দির। এই বৌদ্ধমূর্তি তান্ত্রিক মতে নির্মিত। তার পাশে রয়েছে শিক্ষকদের বাসস্থান।বেলার দিকে একটু উপর থেকে সারিবদ্ধভাবে নেমে এলো ক্ষুদে ছাত্রের দল। তারা মন্দির গৃহে শিক্ষক এবং অপেক্ষাকৃত বড়ো ছাএদের তত্বাবধানে দুই পঙক্তিতে বসে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করার সময় আমাদের সেখানে দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আবার দাদাদের ইশারায় পাঠে মনোনিবেশ করছিল। এই জায়গাটির বিশেষত্ব সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, নিস্তব্ধতা। একটি গাছে ঘেরা জলাশয় আছে (তখন একমাত্র পানীয় জলের উৎস) যেটিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় স্থানীয় আদিবাসীরা বিষাক্ত ভেষজ দিয়ে সেটির জল পান করার অযোগ্য করে দেয়।এরফলে অর্ধেকের বেশী ব্রিটিশ সেনা মারা যায়। বৃটিশবাহিনী একটি চুক্তি করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এইটির জল এখনো বিষাক্ত। এটি বিখ পোখরি (বিষাক্ত হ্রদ) নামে পরিচিত। কিছুটা দূরে স্থানীয় বাজারে হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম, চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু বুনো গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক। আমাদের পথ চলার সঙ্গী হয়েছিল এক লোমশ কুকুর।
এই ভ্রমণের বড়ো পাওনা সবসময় চোখের সামনে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গের দৃশ্যমানতা। দেবানুর (মালিক) মতে এইরকম প্রতিটা শৃঙ্গ প্রধানত দেখা যায় শীতকালে ,পরিষ্কার আকাশে,আমরা যখন গিয়েছিলাম সেই সময় প্রতিদিন এমন দৃশ্যমানতা থাকার কথা নয়। ও আরো বলল যে,স্থানীয় অধিবাসীদের মতে ভাল মানুষদের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবসময় ধরা দেয়।জানিনা, আমরা মানুষ হিসেবে কতটা ভাল, তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু কখনোই আমাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করেনি। তবে এইখান থেকে এতো স্পষ্টভাবে এই পর্বতশৃঙ্গের প্রতিটি চূড়াকে এতো ভালভাবে আর কোথাও দেখিনি। মনে পড়ে, ফিরবার আগের দিন ওদের বালক পুত্রকে পড়াচ্ছিলাম ভঙ্গিল পর্বত,হিমালয়কে সাক্ষী রেখে। সেইদিন রাতে সবাই একসঙ্গে দেশী মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়েছিলাম ওই ঠান্ডায় চোখের সামনে ভঙ্গিল পর্বতের সারি দেখতে দেখতে। এ অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভুলবার নয়।ওখানকার খাবার সব অর্গানিক, দুধের পুরু সর, ভেজালের নাম নেই। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল ওদের সঙ্গে।রাতে রুফ টপে বসত জমাটি আড্ডা, সঙ্গী অবশ্যই রুমহিটার। ফেরার দিন নন্দিনী দিয়ে দিয়েছিল ওদের হাতে বানানো আচার,আর খাঁটি ঘি।উভয় পক্ষের চোখে জল ছিল,ওরা প্রণাম করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল আমাদের। এয়ারপোর্ট এ পৌঁছলাম সন্তুর গাড়িতেই। নামতেই আবার ফোন ঠিকমতন সময় পৌঁছেছি কিনা জানতে, আবার কলকাতায় ফিরে ফোন। এইসব ভালবাসা অমূল্য। কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া দুঃখ হেরে যায় এইসব নিঃস্বার্থ ভালবাসার কাছে।
(ছবি- সংগৃহিত)
No comments:
Post a Comment