বাঁকুড়া থেকে সড়কপথে কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটী
গৌতমেন্দু নন্দী
বাঁকুড়ার জয়পুরের ঘন জঙ্গলের বুক চিরে বিষ্ণুপুরকে পাশে রেখে সড়কপথে বাঁকুড়া থেকে দুই ঘন্টায় প্রায় ৮৫ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুর----গোটা বিশ্বের কাছে যে স্থানের পরিচিতি রামকৃষ্ণের পূণ্য জন্মস্থানের জন্য।
এখানে এসে চারপাশের ঘন সন্নিবেশিত হোটেল, দোকান আর বহিরাগত জনসমাগম দেখে বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না এই পবিত্র ভূমির মাহাত্ম্য সম্পর্কে। রাস্তার দুই পাশে দোকানগুলোতে রামকৃষ্ণ ও সারদামণির অসংখ্য বিক্রয়যোগ্য ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলোই বলে দেয় এই পবিত্র জনপদের গুরুত্ব ও
মাহাত্ম্য। হুগলি জেলার অন্তর্গত শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মভূমি এই কামারপুকুরের আগে নাম ছিল "সুখলালগঞ্জ"। গ্রামের আদি জমিদার সুখলাল গোস্বামীর নামেই এই নাম।
কথিত আছে মানিকরাজা গড়মান্দারন এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত কয়েকটি ঘর কর্মকারকে একসময় এখানে এনে বসতি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ঐ কামাররা মানিকরাজার অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত। আগ্নেয়াস্ত্র প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে কামারদের কাজ কমে যাওয়ায় রাজা তখন তাদের কাজ দিয়ে বনজঙ্গল কেটে একটি পুকুর খনন করান এবং বসতি স্থাপন করেন। সেই "কামারদের পুষ্করিনী" নাম থেকে কালে কালে সেই গ্রামের নাম হয়ে যায় "কামারপুকুর"।
১৯৩৬-১৮৫৩ পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর রামকৃষ্ণ এখানে ছিলেন। এর পরেও বহুবার তিনি দক্ষিণেশ্বর
থেকে কামারপুকুরে আসেন। রামকৃষ্ণ কথামৃতকার "শ্রীম" যখন এখানে আসেন সেই স্মৃতি তাঁর মণিকোঠায় চিরোজ্জ্বল ছিল------তাঁর উপলব্ধি ছিল " আমি যখন প্রথম কামারপুকুরে আসি তখন এখানকার সমস্ত লোককে ঠাকুরের কথা জিজ্ঞেস করেছি, তাঁদের সকলকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে হতো কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ঠাকুরকে দর্শন ও স্পর্শ করেছেন....."
গোপেশ্বর শিবমন্দিরের কাছে " কামারপুকুর " নামক সেই পুকুরটিকে চাক্ষুষ করতেই এক অন্যরকম অনুভূতি টের পেলাম। মঠ প্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বারে স্থাপিত হয়েছে বিবেক তোরণ। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা গেল আম্র বৃক্ষ, তাঁতী পুকুর,খাঁ পুকুর,রঘুবীর মন্দির। মঠের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে যাত্রী নিবাস, গ্রন্থাগার, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, হোটেল,লজ সহ অসংখ্য দোকান পাট, স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি।
এখানে এসে শুনলাম ধর্মদাস লাহার নাম। হুগলি জেলার পশ্চিমাংশে কামারপুকুরের জমিদার ছিলেন তিনি। যিনি লাহাবাবু নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আর এক জমিদার সুখলাল গোস্বামীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ধর্মদাস লাহা ও সুখলাল গোস্বামীর ঐকান্তিক ইচ্ছে ও চেষ্টায় ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় সপরিবারে দেরিয়াপুর থেকে কামারপুকুর চলে আসেন এবং বসবাস করতে শুরু করেন। বালক গদাধর এই লাহা বাবুদের দুর্গাপ্রতিমার চোখ এঁকেছিলেন। লাহা বাবুদের বংশধরেরা কয়েক ঘর নিয়ে আজও কামারপুকুরে বসবাস করছেন। তাঁদের কয়েকজনের সাথে কথাও হল। এখানে রামকৃষ্ণের হাতের লেখা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
কামারপুকুর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে আরও এক পূণ্যভূমি -----জয়রামবাটী। হুগলি জেলার কামারপুকুর এবং বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী যেন দুই জেলার সীমানা নির্ধারণ করে চলেছে।
"যে গ্রামে জন্মিলা মাতাদেবী ঠাকুরানী
পূণ্যময়ী লীলা-তীর্থ নামে তারে গণি।
শ্রী প্রভুর পদরেণু বিকীর্ণ যেখানে
বিধাতার সুদুর্লভ তপস্যা সাধনে...."
"জয়রামবাটী "---এই নামটিও কামারপুকুরের মতো বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। শ্রী শ্রী মা সারদামণীর পূণ্য পাদস্পর্শে এই ছোট্ট জনপদটিও আজ বিশ্বের কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থভূমিতে পরিণত। স্বয়ং মা সারদামণী এখানকার ভূমির ধূলি নিজ মস্তকে ধারণ করে বলেছিলেন ---
" জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী।"
এখানে এসে তার প্রমাণ স্বরূপ দেখলাম দুই একজন বিদেশী মেমসাহেব মাটিতে বসে ভক্তির সঙ্গে মা এর প্রসাদ গ্রহণ করছেন।
মূল প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ডানদিকে চোখে পড়ল সারদা মণির একসময়ের খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির সেই ঘর। এর আগে ছবিতে দেখা সেই পরিচিত ঘরটির পাশ দিয়েই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে শ্রী শ্রী মাতৃ মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। চারপাশে মনোরম সবুজ উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত সারদামণীর শ্বেত পাথরের মূর্তি সহ শ্বেত পাথরের মন্দিরটির ভেতরে প্রবেশ করতেই এক অব্যক্ত আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম শরীর ও মনে।
১৮৫৩-১৮৫৯ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর জয়রামবাটীতে ছিলেন শ্রী শ্রী মা সারদা দেবী। এই জয়রামবাটীতে শ্রী রামকৃষ্ণ ও তাঁর পার্ষদরা সহ শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর বহু সন্ন্যাসী গৃহী সন্তানেরাও বহুবার এসেছেন। শ্রী রামকৃষ্ণ-ভক্ত গিরীশ চন্দ্র ঘোষ পুত্রশোকের আঘাত সামলাতে কিছু দিন জয়রামবাটীত মাতৃভবনে বাস করেছিলেন।
একই সঙ্গে উচ্চারিত "কামারপুকুর--জয়রামবাটী" গোটা বিশ্বের কাছে আজও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উত্তরণের পীঠস্থান। বলা হয় "কামারপুকুর " ও "জয়রামবাটী"---এই দুটি জনপদ যেন "পুরুষ" ও "প্রকৃতি"।
কামারপুকুরে শ্রী রামকৃষ্ণের আবির্ভাবের সঙ্গে যেমন "সত্যযুগ"এর সূচনা, তেমনি জয়রামবাটীতে শ্রী শ্রী সারদা মায়ের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন এক "মাতৃযুগ" শুরু। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষ এখানে ছুটে ছুটে আসেন। সেই টানেই এই দুই পুণ্যভূমিতে আমারও ছুটে যাওয়া।
No comments:
Post a Comment