Monday, May 1, 2017



।। সম্পাদকের কথা।।
বইতে থাকা, বয়েই চলা। এই বয়ে চলা যেন আবহমান কাল ধরেই। চলবে বয়ে চলা এই আবহমান পর্যন্তই। 
প্রকাশিত হচ্ছে মুজনাই সাহিত্য পত্রিকার অনলাইন প্রথম সংখ্যা। আপাতত ব্লগেই। যদি সম্ভব হয় আগামীতে আসবে নিজস্ব ওয়েবসাইট। 
প্রচেষ্টা সামান্য, ইচ্ছেকে সামান্য করতে পারলাম না। 


গদ্য

 মহামরণপারে
শ্যামলী সেনগুপ্ত
          
        ঘুম যখন ভাঙলো,তখন পশ্চিমের আকাশ লাল করে তুমি বিশ্রামগৃহে যাচ্ছো।দূরের বৃক্ষবাহু দুলে দুলে উঠছে,স্রোত জেগেছে পত্রপুঞ্জে-----ফিরে আসছে যে তাদের প্রিয়জনেরা!সারাদিন ডানায় ভর করে দানা সংগ্রহ করে এবার আশ্রয়।পরম শান্তি।
         শান্তিতেই ঘুমিয়েছিলাম।ঘুম ভাঙতেই পশ্চিমের আবির-আলো প্রবেশ করলো অন্তরে- - -হাত বাড়ালাম----
                                        'রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে
                                         আলোর প্রার্থনাই,
                                         তেমনি  গভীর মোহের মাঝে
                                       তোমায়  আমি চাই '
             সামনে অনন্ত আকাশ।সে আকাশ জড়িয়েনিলো শ্যাম-অঙ্গদ---তারায় তারায় খচিত।হীরকদ্যুতির দিকে অপলক  তাকিয়ে---মনে আলোড়ন,যেন অশান্ত এক সমুদ্র।আমি দাঁড়িয়েআছি তটে--বারবার গর্জন করে আছড়ে পড়ছে ঢেউ তটভূমিতে।লবণে-জলে-বালুতে মাখামাখি আপাদমস্তক। তবুও ছেড়ে যাচ্ছি না তটভূমি--ঢেউয়ের আঘাতে পড়েযাচ্ছি--আবার উঠে দাঁড়াচ্ছি--এ আমার রূপনারায়ণ!এখানে দাঁড়িয়ে তোমার মতোই কঠিন সত্য কে উপলব্ধি করি-- - - -সম্বিৎ ফেরে একলা কাকের ডাকে।দলছুট সে-তবুও ফিরেযাচ্ছে----ফিরতেই হবে---এই তো আমার যাত্রাপথ- - -
                          ' হংস যেমন মানসযাত্রী
                             তেমনি সারা দিবস রাত্রি
                              একটি নমস্কারে,প্রভু,একটি নমস্কারে

                             সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ পারে। '


                     


রামায়ণ  প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।
           মীরা সরকার।
ভারতবর্ষের দুটি প্রধান মহাকাব্যের একটি রামায়ণ ।একে ইতিহাস ও বলাচলে।
      শতাব্দীর  পর শতাব্দী ধরে  এর জনপ্রিয়তার  রহস্য কী? রবীন্দ্রনাথ নিজের অনুসন্ধিৎসু বীক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে এর বিশ্লেষণ করেছেন।এই ধারা বহে চলেছে বহুদিন। এ শুধু ভক্তির উৎস নয়।ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে প্রতিদিন পঠিত  হয় এই মহাকাব্য ।এর বাণী বহু নর নারীর জীবনে অজস্র শান্তি ও শক্তি বহন করে।এর কারন কি?তাঁর  মতে  একে 'এপিক' বলা চলে না। কারন বীররস প্রধান কাব্যকেই এপিক বলে,এটাই চলিত ধারনা।কিন্তু  রামায়ণে বীররস আছে,যুদ্ধ আছে।রামের বীরত্ব  সামান্য নয়।কিন্তু এ বীররস প্রধান মহাকাব্য নয়।
     যেহেতু  রাম একজন অবতার সুতরাং অবতার লীলা  সংকীর্তন ই মুখ্য উদ্দেশ্য তাও নয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সূক্ষ্ম  অন্তর্দৃষ্টি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।তিনি  দেখেছেন  আদিকান্ডে আদিকবি বাল্মীকি   রামকে অবতার করে দেখান নি,তাঁকে মানুষ হিসেবেই তৈরী  করেছেন।যদি রামায়নে বিভিন্ন চরিত্রে দেবত্ব আরোপ করে তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হত তবে হয়তো এত জনপ্রিয়তা এত বছর টিঁকত না।মানুষের মনুষ্যত্ব ই সর্বগুণ ধারণ করে দেবতা হয়ে উঠেছে।রবীন্দ্রনাথের মতে যুগ যুগান্ত ধরে ভারতবর্ষের দীনাতিদীন কুটিরেও যে একটি মানুষের এত গুণ তাদের সৎ নিষ্ঠাবান থাকার প্রেরণা দিয়েছেন তিনি ই রাম। 
রাম সর্বাঙ্গ সুন্দর,সর্বগুনসম্পন্ন। আদিকবি নিজে একথা নারদকে বলেছেন। রামের মত এত গুণযুক্ত পুরুষ  দেবতাদের মধ্যেও  নেই ।রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমার কথা।দেবতার  নয়।
      দেশজয়, শত্রুবিনাশ,দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচন্ড আঘাত, প্রত্যাঘাত, সংঘাত এসব সাধারনতঃ মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন উদ্দীপনা   সৃষ্টি করে কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম রাবণের  যুদ্ধের কারণে নয়।এখানে রাম সীতার দাম্পত্য প্রীতি, পিতার প্রতি পুত্রের শ্রদ্ধাশীল আনুগত্য, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, রাজা প্রজার পারস্পরিক  নিষ্ঠাকে আশ্রয় করে লতিয়ে উঠেছে যুগ যুগান্তের বিশ্বাস।আমাদের চিরকালীন ঘরের সম্পর্ক গুলিকে যেন এর প্রতি ছত্রে আমরা দেখতে পাই।এই একাত্মতা রামায়নকে এত মধুর গ্রহণযোগ্য করেছে।
    রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের একটি অতি উচ্চ স্থান ছিল।এই কাব্যে তাই প্রমাণিত।কবির মতে গৃহাশ্রমই সমস্ত সমাজকে ধারণ করে।
       রামায়ণের সুচারু আদর্শ এই সমাজকে সুন্দর করতে সাহায্য  করেছে।এই আদর্শ আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রবহমান  করেছে।কোথাও  ব্যাহত  করেনি।শত শত বৎসর ধরে ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা কেবল যে শিক্ষা  পেয়েছে তাই নয় আনন্দও পেয়েছে।একে শুধু শিরোধার্য  করেনি হৃদয়ের  মধ্যে  ধারণ  করেছে ।তাই রামায়ণ শুধু ধর্ম শাস্ত্র নয় এটা তাঁর  মতে কাব্য ।
       রবীন্দ্রনাথ শ্রীযুক্ত দীনেশ চন্দ্র  সেনের রামায়ণ চরিত্র সমালোচনার একটি ভূমিকা  লিখবার জন্য অনুরুদ্ধ  হয়েছিলেন ।তখন তাঁর  দৃষ্টির সম্মুখে  রামায়ণের ভিতর দিয়ে  শাশ্বত  ভারতবর্ষের  জীবন যাত্রার যে চিত্র ভেসে উঠেছিল, পরম শ্রদ্ধায় নতমস্তকে এই পরিপূর্ণ মানবের আদর্শ চরিত্র কে স্বীকার করে  নিয়েছেন ।তিনি  বুঝেছেন শুধু নিছক ভক্তি নয়,পূজা  নয়, আনন্দ উপলব্ধ  ভালবাসাই এই মহাকাব্যের উপজীব্য ।
     একে বাস্তবতা বিরোধী বলার কাল কখনো আসেনি ।সর্ব কালোত্তীর্ন এই কাব্য অমৃত পিপাসুদের চিরকাল আনন্দ,শান্তি দান করেই যাবে।





আমি ও রবীন্দ্রনাথ আর আমি
                      শুভদীপ ঘোষ
                            


                              (।)
                   আমি ও রবীন্দ্রনাথ
      
রবি ঠাকুর কেমন যেন পাল্টে যায় --শুধুমাত্র সাজিয়ে রাখা রবি ঠাকুরকে বাদ দিলে। 
ওই যে দাদু মার্কা রবি ঠাকুর, সাদা ধবধবে চুল, এইয়া লম্বা লম্বা দাড়ি। বাড়ি, ইস্কুল, অফিস ছাড়া ওই সনাতন, চিরন্তন আবহমান কাল ধরে চলে আসা রবি দাদুকে কোথাও খুঁজে পেলাম
না !!

অনেক খুঁজলাম-ছোটবেলায় রচনা বইতে,সহজ পাঠে, শিশু ভোলানাথে, খাপছাড়াতে...ধুত্তরি !! কোথাও তো দাদু মনে হতো না রবি ঠাকুরকে।
তবে ওইরকম একটা ছবি যে কেন তা বুঝতে পারতাম না।
"তোমার রবীন্দ্রনাথ এর বয়স কত ?"--- একদিন স্যারকে আমার মনের কৌতূহল টা বলতেই, এইরকম একটা প্রশ্নবান ধেয়ে এল।
সেদিন উত্তর টা ঠিক সাজিয়ে উঠতে পারি নি।

আমার মা ভালো গান গাইতে পারত না। গীতবিতান টা আবৃত্তি করে শোনাত।
শীতকাল, ছোট্ট জানালা, মায়ের আঁচল--আমি যেন বেশ দেখতে পেতাম, আমার দুষ্টু,নাছোড়,চঞ্চল,বীরপুরুষ রবি জোড়াসাঁকোর ছোট্ট জানলার সামনে বসে আমার জন্যে গান,ছড়া লিখছে। 

শৈশব থেকে কৈশর, কৈশর থেকে যৌবন আমার রবীন্দ্রনাথ কেমন পাল্টে যেতে লাগলো--আমার হাত ধরে সুখে, সন্তাপে তিলে তিলে আমার রবি পড়ল পদ্মা নদীর নৌকায়, কখনো শিলাইদহে, কখনো সাহাযাদপুরে।
আমার ছিন্নপত্রাবলীর রবীন্দ্রনাথ। আমার যৌবনের রবীন্দ্রনাথ।
যে আমি, আমার রবি  জোড়াসাঁকোর ছোট্ট জানালা ছেড়ে পরিব্যাপ্ত প্রকৃতির মধ্যে এসে পড়লাম। আশ্চর্য নিঃসঙ্গ  আমি আর আমার রবীন্দ্রনাথ।
রোমান্টিক রবি,বিরহে রবি, আত্মার বিশ্বাসে রবি।

                             (।।)
                       আর আমি

সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ফুটপাথে দেখলাম রবির ছবি গুলো বিক্রী হচ্ছে। প্রবল দরাদরি।সবাই লাভের গুড় চায়। 
সেদিন মেয়েটা রেলের লেডিস কম্পার্টমেন্টে চুলোচুলির ধকল ছেড়ে যখন জেনারেলে আসলো ছেলেগুলো উত্যক্ত করছিলো।

রাস্তায় নামতে দেখি দুধার নোংড়া, ইস্কুলে যখন সহ-শিক্ষ্কদের চর্চা শুনি, ছাত্র-ছাত্রীগুলোর বাড়ির অবস্থা শুনি,গল্প শুনি তখন খুব মন খারাপ হয়ে যায়।
রবি ঠাকুর কেমন আমায় একা রেখে চলে যায়।
পড়ে থাকি শুধু আমি আর আমি...
এইরকম রবির না থাকার দিনে বাড়ি ফিরে রবির মন ভালো লাগার গান গাই। তারপর মন টা আস্তে আস্তে ভালো হয়ে ওঠে।

সেই খারাপ লাগা মুহূর্তগুলো কি সত্য না রবীন্দ্রনাথ ও তার গান সত্য ??
এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর হাতড়াচ্ছি।


রবিকে নতুন করে পাওয়ার আশায় সেদিন পুরনো তালা বন্ধ লাইব্রেরীতে ঢুকব বলে মনস্থ করলাম।
কাজের মাসি কিছুতেই চাবি খুঁজে পাচ্ছিল না। কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। বারবার এসে বলছিল 'খোকা কিছু মনে করো না,কিছুতেই পাচ্ছি নে চাবি..." 
মাসিকে খুব অনুতপ্ত দেখাচ্ছিল। কেন তা আজো বুঝে উঠতে পারি নি।
আসলে রবিকে জানার আসল চাবি টাতো আজো আমিও খুঁজে পেলাম না ।।




   এবং রবীন্দ্রনাথ

     সব্যসাচী

একটাই তো ছুটির দিন গোটা সপ্তাহে। সংসারের সব কাজ জমে থাকে ঐ দিনটার জন্যে। জানলার পর্দাগুলো ময়লা হয়েছে। কচতে হবে হবে করে কাচা আর হয়ে উঠছে না কবে থেকে! হবে কি করে! স্কুল করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে-পাঁচটা, ছটা বেজে যায় একেক দিন। ফিরে এসে টুকিটাকি দোকান – বাজার সব করতে হয় নিজেকে। এত বড়  মেয়ে হল বাবান, কুটো ভেঙে দুটো করে না এখনো! নিজের কলেজ, বন্ধু-বান্ধব, র ঐ হয়েছে এক ফোন – ঘরে থকলে সারা দিন ঐ ফোন নিয়ে...। হয় হোয়াটসঅ্যাপ করছে, ফেসবুক করছে না হলে কানে কর্ড গুঁজে ওয়েষ্টার্ন- মিউজিক...। যা পারে করুক...। কাঁহাতোক আর কিটির কিটির করা যায় এত বড় মেয়ের পিছনে! মল্লিকা পর্দাগুলো খুলে ওয়াশিং-মেশিনে ঢোকায়। মানদা এসে যাবে ন’টার মধ্যে। আসলে কে দিয়ে একটু পোস্ত বাটিয়ে নিতে হবে। ফ্রিজে চিংড়ি মাছ আনা আছে। আজ নিজে রান্নাটা করবে – পোস্ত দিয়ে পটল চিংড়ি...। বাবান খুব ভালোবাসে। কিন্তু মানদা আসার আগে স্নানটা সেরে নিলে ভালো হয়। মল্লিকা বাথরুমে গিয়ে ঢোকে...।
শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে চোখ বোজে মল্লিকাজল নিজের ধারয় বয়ে যায় শরীরে। এক ভাবে অনেকক্ষণ জলের তলায় দাঁড়িয়ে শরীর শিরশর করে। জমে থাকা ক্লান্তি, অবসাদ যেন ধুয়ে যেতে থাকে জলে। কিন্তু জল দিয়ে কি সব ধোয়া যায়! স্নানে কি ধুয়ে ফেলা যায় জীবনের গ্লানি! যায় না। জল দিয়ে মন ধোয়া যয় না বলেই তো বরবার মনে পড়ে যায় মিথ্যে সম্পর্কের সব কথা। মনে পড়ে মলয়ের দ্বিচারিতা। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে দু-বছরর বাবনকে নিয়ে সেপারেশন-এর সেই প্রথম দিনের ছবি। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও, কৈ স্মৃতি থেকে তো ধুয়ে ফেলা যায়নি কিচ্ছুটি... মল্লিকা চোখ খুলে তকায়। একান্তে জলের ধারা যেন বুকের ভেতরে শূণ্যতা তৈরি করে। দশ বছর আগে হলেও সেই শূণ্যতা থেকে কান্না উঠে আসতো হু হু করে। এখন আসে না। বরং সেই শূণ্যতায় জায়গা করে নেয় রবি ঠাকুরের গান। মল্লিকা নিজের অজান্তে নিজের জন্যে গেয়ে ওঠে –‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে/সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে...’
গানটা গাইতে গাইতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় মল্লিকা। টাওয়ালটা মেলে দেয় টানটান করে। তারপর বাবানের ঘরে এসে ঢোকে। বিছানায় নেই। তার মানে উঠেছেন নবাব-নন্দিনী! টয়লেটে ঢুকেছে। ইস্ ঘরের কি ছিরি! বিছানার উপরে ফোন, ল্যাপটপ। পড়ার টেবিলে বই-পত্র সব ছড়ানো, ছিটানো...। কি যে করবে বিয়ের পর কে জানে – গজগজ করতে করতে মল্লিকা পড়ার টেবিল গোছায়। ল্যাপটপ তুলে, বিছানার চাদর ঝেড়ে টানটান করে পাতে। তা করতে টয়লেট থেকে বেরিয়ে বাবান এসে বিছানার উপর বসে। ফোনটা হাতে নিয়ে মল্লিকার দিকে তাকায়, বলে – তোমার স্নান হয়ে গেছে! মল্লিকা মাথা নাড়ে। বাবান বলে – ও, ঐ জন্যে...। মল্লিকা অবাক হয়ে তাকায় – কী, ঐ জন্যে কী...?
- না, গান গাইছিলে তো, তাই আর কি...।
মল্লিকা কপট রাগ দেখায় – ইয়ার্কি মারবি না বাবান। বাবান হাসে হিঃ হিঃ করে, বলে – আচ্ছা মা, রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও আরো অনেক অনেক রকমের গান আছে পৃথিবীতে; তুমি কি সে কথা জানো! মল্লিকা জানে বাবান এর পর কি কি বলতে পারে, একটু সুযোগ পেলে কোন দিকে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে – মল্লিকা সব জানে। তাই সে সব এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বলে – তুই জানলেই হবে। আমার জেনে কাজ নেই... বাবান খপ্ করে মল্লিকার হাতটা চেপে ধরে – বসো না মা...। মল্লিকা বাবানের মুখের দিকে তাকায়। মনে হয় মেয়ে আসলে সঙ্গ চাইছে। সারা সপ্তাহে তো সময় দিতে পারে না মেয়েকে! মল্লিকা বিছানায় বসে, বলে – বল কি বলবি! বাবান বলে – তুমি এত পড়াশুনো করেছ..., তাও তুমি এরকম কেন! তুমি জানো পৃথিবী কত এগিয়ে গেছে...! মল্লিকা মৃদু হাসে, বলে – তা না হয় এগিয়েছে; কিন্তু তার জন্যে রবীন্দ্রনাথের গান কি দোষ করলো...! বাবান বলে – দোষ-গুণের কথা নয়। কথা হচ্ছে আটকে থাকা। তোমরা একটা শিক্ষিত সেকশান রবীন্দ্রনাথেই আটকে আছ!
- বেশ যদি আটকে থাকি; তাতেই বা অসুবিধা কোথায়! তোদের কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে! বাবান এবার বেশ সিরিয়াস; বলে – কন্টেম্পোরারিদের না শুনলে সেটা বুঝবে কি করে! তোমরা তো অকুপায়েড। মিউজিকের ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে, কম্পোজিশান নিয়ে নতুন নতুন কত কাজ হচ্ছে। ওয়েষ্টার্ন মিউজিক তো কোথায় এগিয়ে গেছে। তুমি তো ‘বিটেলস’ ও শোন নি। অ্যাডেল, জিম মরিসন, উইলি নেলসন – কিছুই তো শুনলে না...। ঐ এক রবীন্দ্রনাথ ধরে বসে আছ। বাঙালির ওয়ান এণ্ড অনলি ইনস্টিটিউশন! মল্লিকা মুচকি হাসে আবার। মেয়েকে রাগাতে বলে – তোদের কত কে আছে! কত নাম বলিস বাবারে...! আমাদের না হয় ঐ একটাই রবীন্দ্রনাথ আছে; থাক না...। বাবান এবার রেগে যায়, বলে – দেখেছ তো, এই কারণে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের বাইরে বেরতে পারলো না...। মল্লিকা উঠে দাঁড়ায়, বলে – দরকার কি বেরনোর! এই তোর সাথে বকবক করর সময় নেই। আমার কাজ আছে অনেক...। বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বাবানের বেরনোর কথা ছিল দুপুরে। অর্ঘ্যর সাথে মুভি দেখতে যাবে আইনক্স-এ। লাস্ট-উইকের প্ল্যান। অর্ঘ্য হোয়াটসঅ্যাপ-এ রেসপন্স করছে না দেখে বাধ্য হয়ে রিং করে বাবান। অর্ঘ্য কি সব এসকিউজ দেয় – ওর নাকি রিলেটিভ এসেছে, তাই ওর হবে না...! বাবান ফোন রেখে দেয় – কয়েক দিন ধরেই অর্ঘ্য কেমন একটা অ্যাটিটিউড করছে...। অর্ঘ্য কি অ্যাভয়েড করতে চাইছে! সেদিন যেমন কলেজ থেকে সবাই যাবে ‘কাফে ডি’-তে, অর্ঘ্য কাজ আছে বলে গেল না। কি হয়েছে কে জানে...! কাল দেখা হলে ডিটেলে জানতে হবে। এত চাপা স্বভাবের – কোনকিছু খুলে বলে না সহজে...।
দুপুর বেলা খেয়ে উঠে কখন ঘুমিয়ে পড়ে বাবান। সানডে দুপুরের ভাত-ঘুম। ঘুম যখন ভাঙে তখন প্রায় সন্ধ্যে। বাবান বিছানায় উঠে বসে – মা টা যেন কী! ডাকেও না! বাবান উঠে টয়লেট-এ যায়। মুখে-চোখে জল দেয়। ফোনটা নিয়ে বিছানায় এসে বসে। ফেসবুক খোলে। আপডেটগুলো দেখে। দেখতে দেখতে হঠা চমকে ওঠে – এ কি! কে রে ভাই – প্রিয়াঙ্কা! প্রিয়াঙ্কা নাহাতা। নাঃ চেনে না। তনয়ার লিঙ্ক থেকে এসেছে নিউজ-ফিড-এ। তার মানে তনয়ার ফ্রেণ্ড-লিষ্ট-এ আছে। বাবান ভালো করে দেখে – অর্ঘ্যর সাথে ক্লোজ সেলফি! হ্যাঁ, যে আইনক্স-এ আজ ওদের যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেই তো! ২টো ৫৪তে পোষ্ট করেছে মেয়েটা। লিখেছে – কমিটেড...। বাবান ফোনটা রেখে দেয় – অর্ঘ্য একবার বলতে তো পারতো...। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। এমনটা আগে হয়নি কখনো। বাবান স্থবির হয়ে বসে থাকে একভাবে। হঠা করে পৃথিবীটা যেন কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। সেল্ফ-কন্ফিডেন্স, আত্মসম্মান সবকিছু ধরে কে যেন ঝাঁকিয়ে দেয় জোরে। বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা তৈরি হতে থাকে ধীরে ধীরে। গলার কাছে একটা কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে। বাবান বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর উঠে এসে দাঁড়ায় জানলার কাছে। নীচে রাস্তায় গাড়ির মিছিল, লোকজন – শহর ছুটে চলেছে দ্রুত। শুধু বিশ্বাসে ধাক্কা খেয়ে বাবান যেন থেমে গেছে হঠা করে। বুকের ভেতরে তৈরি হওয়া শূন্যতায় যে বাষ্প জমাট বাঁধে – সে এবার বেরিয়ে আসার পথ খোঁজে। বাবান নিষ্পলক ভাবে দূরের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে শুধু নিষ্ক্রমণের মাধ্যম সন্ধান করে। করতে করতে হঠা নিজের থেকে গেয়ে ওঠে – –‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে...’
পাশের ঘরে গানটা শুনে চমকে যায় মল্লিকা। বেরিয়ে এসে মেয়ের ঘরে চুপি দেয় – সে কি রে বাবান! তুই গাইছিস রবীন্দ্রনাথের প্যানপ্যানানি...! বলতে গিয়েও বলতে পারে না মল্লিকা। মেয়েকে দেখে ছ্যাত্ করে ওঠে বুকের ভেতরটা। মেয়ে যে জীবনে ধাক্কা খেল প্রথমবার, মা হয়ে সে কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না মল্লিকার। মল্লিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর মনে মনে বলে – গা বাবান...। মাতৃভাষা ছাড়া যেমন কাঁদা যায় না, তেমনি রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া ভেতরের কষ্ট বাইরে আসে না। আর কষ্ট প্রকাশ করতে না পারলে যে বেড়ে যায় আরো। গা...। দেখবি রবীন্দ্রনাথের গান সব কষ্ট মুছে দেয়...।   


                              
                                                      


      
        ২৫ শে বৈশাখের উপহার…
                  সম্পা দত্ত                                         
                              
         প্রগতি সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যেগে পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে সমরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী যাচ্ছে। নাতনী তুন্ তাই কদিন আগে পক্সে বিছানায় ছিল। এখন সুস্থ একটু। যাবার আগে প্রিয় নাতনীকে আদরে আল্হাদে একটু রসিকতা খুনসুটি ক'রে যাবেন বলে নাতনীর ঘরে ঢুকলেন। বাড়ির সবাই জানে…সে বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা ক'রে সবাই।
সমরেন্দ্র বাবু চিৎকার করেন…অ গিন্নী এই ভর সন্ধ্যায় বাইরে বৃষ্টি পরতাছে, নির্ঝর কি টিউশন পড়াইতে গ্যাছে।
…বউমারে তো হেইডাই কয়া গ্যালো।
…আমার ও মনে হয় বাইরে যাওন স্থগিত দ্যাওন লাগে। যাই দিখি দিদি তুনতাই কি গানে বইছে একটু খ্যাপাই গিয়া।
…হ'কেবলি বইলো। কিছু কইবা না কইতাছি বাড়ি মাথায় তুলব এক্ষনি।
গিন্নি আর একখান কথা। ঘরে কি শুকনা মাছ আছে।
…থাকলে হইব ডা কি।
…কেন আবার খাইমু।
…ইস্ মরন, বুড়ার ভিমরতি লাগছে,  শুঁটকি খাওনের ল্যাইগ্যা জিব্বা লগলগ করতাছে।
…গিন্নি হা হা হা, কি যে কও মায়ের হাতে  শুঁটকির চাটনি কি সোয়াদ। আমি ময়মন সিং কিশোর গঞ্জের লুক(লোক) আমি খামু না তা কেডা খাইব।
তুনতাই কেবল ক্লাসিক ধরেছে…"কানহা মোরে আশাবরী রাগ শুনায়ে…"
সমরেন্দ্র বাবু বলতে শুরু করলেন কি ললিতা বিশাখা সখী আমার লগে যাইবা অনুষ্ঠানে। নিয়া গেলেও তো যন্ত্রনা। হাজারটা প্রশ্ন রবি দাদার লম্বা দাড়ি ক্যান? রবি দাদা কবিতা লেখে ক্যান? রবিদাদার ফটোর সামনে গান কবিতা কয় ক্যান?
…দাদা ভাল্লাগেনা কিন্তুু আবার লগে মগে আমার লগে যাইবা নাকি। ও ঠাম দাদা আমার গান থামিয়ে দিচ্ছে।
…আহা! দিদি অমন করো ক্যান। আর কমু না। সারাদিন কাজের জায়গায় "পোষাকি" ভাষা কইতে কইতে বাবু হয়ে থাকি। অবসর সময়ে নিজের শিকড়ের, নিজেরভাষা, মায়ের নাড়েরটান  জল মাটির হাওয়া নিতে ভালই লাগে। তুমরা হইলা গিয়া আধুনিক। নাতনির বয়স সাড়ে ছয় বছর খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভানুসিংহের পদাবলী গায়।
…দিদি তুমি না কাঠবাদাম সহজে ভাংতে চাওনা। ফিরতি পথে তুমার জন্যি চকোলেট আনুম, এইবার আমারে ঐ ভানুসিংহের পদাবলীটা গাইয়া শুনাও তো।
…কোনটা দাদা, বল কত গান তো করি মনে পরছে না।
…ওই যে ভানুসিংহের পদাবলী, তুমি নাম গুলান কও আমি কইতাছি।
…গহণ কুসুম মাঝে, না কি সজনী সজনী রাধিকালো, উমম নাকি মরন রে তুঁহু মম শ্যাম, নাকি নাচাহিলে যারে পাওয়া যায়।
ইস কি একটা গাও বিনাবাদিনী, শতদল কি সব আঁখিজল।
…'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়…'
ঠিকঠাক বলতে পারেনা আবার বলে দিদি গান গাও …শোনো করছি…
তুন তাই গান করছে সমরেন্দ্র বাবু ওর নজর এড়িয়ে কি যেন করছেন । রেকর্ড করার মতো।
গান শেষ হলে তুনতাই বলে ও দাদা কাঁদছো কেনো?
…দিদিরে তোর দরদী গলায় এই গানডা শুনলে চোখ দিয়া এমনেই ঝরঝর কইরা জল ঝরে। দ্যাশের বাড়ির কত কথা মনের মাঝে উঁকি দ্যায়।
…ঠিক আছে কিন্তুু তোমার হাতে ওটা কি?
কমুনা তোমারে আমার লগে পঁচিশে বৈশাখ অনুষ্ঠানে যাইতে কইলাম যাইবা না। কতজনে কত আবৃতি নাচ গান নাটক করব। মনিমালা মায়ের নাচের ইস্কুলের টিম অমল ও দই ওয়ালা, ডাকঘর, শ্যামা নৃত্য নাট্য করব।
গ্যালে দ্যাখতে পাইতা।
হেইজন্যি ই তো তোমার গানডারে রেকর্ড করলাম,  মৌপিয়া নাচব সেই নাচের সাথে তোমার গান যুগলে রবীঠাকুরের শ্রদ্ধায় শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবে উৎবোধনী নৃত্যে উপহার দেওয়া হইব।
…দাদা আগে বলনি কেনো তা হলে ভাইয়ের সাথে তবলায় করে দিতাম। 
…না না তা লাগবনা আমার দিদির গান এমনেই সোন্দর!!!!
ওদিকে গিন্নী রান্নাঘর থেকে চিৎকার…শুঁটকি মাছ আছে, পিঁয়াজ লইয়া আইতে হইবো।
…ঠিক আছে গো গিন্নী…বলে নাতনীর কপালে স্নেহমাখা চুমু এঁকে দিয়ে হাসতে হাসতে ঘরের বাইরে পা বাড়ান।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে…সমরেন্দ্র বাবু গান গাইছেন "জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন……ধন্য হ'লো ধন্য হ'লো মাণব জীবন……"
মনে মনে নিজের লেখা কবিতার লাইন আওড়াচ্ছেন…
মম কড়পুটে দিয়েছিনু অঞ্জলি…
রেখেছিনু টগর বেল জুঁইমালা ভরা থালি…
হে রবি কবি মোরে মাথা ণত করে দাও…
প্রভু তব পাদপদে দিই মম কবিতাঞ্জলি…
হে বিশ্বকবি রবি…।।।
প্রণাম…!!!!
…কোনটা দাদা?   






তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ নও
আশিস চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের হুল্লোড়পনা দেখে কবি বিষ্ণু দে-র কলমে উঠে এসেছিলো এই কথা-'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?'তাঁর এই আক্ষেপ অনেক সময় আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে যায় ।
আমরাও তখন ভাবতে থাকি সত্যিই কি রবীন্দ্রনাথ ওই দুটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ? তিনি যে সময় এ কথা বলেছিলেন আজও হয়তো তার প্রাসঙ্গিকতা আছে,তবু বলব সামগ্রিক অর্থে রবীন্দ্রনাথ আমাদের
জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে গেছেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের হয়তো অনেকেরই দিন চলে না।এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের জীবনে এমন একটা দিন ও  বোধ হয় নেই যে সেদিন তিনি রবীন্দ্রনাথের
কোনও গান শোনেননি ।কারণটা কি?শঙ্খ ঘোষের মর্মস্পর্শী কলমে উঠেএসেছে সেই কথা ।'জীবনে তো  আমদের সবারই এমন কোনও মুহূর্ত আসে, ভিতরে ভিতরে ধ্বনিত হতে থাকে সব মিথ্যা বৃহৎ
বঞ্চনা,পৃথিবী থেকে যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় মন,অভিমানে টলটল করতে থাকে আমাদের অস্তিত্ব।আর সেই সময়েই মন আশ্রয় খোঁজে নিবিড় আর নির্ভর যোগ্য কোনও বন্ধুর কাছে।' হ্যাঁ,রবীন্দ্রনাথই হচ্ছেন
আমাদের সেই নিবিড় আর নির্ভয় যোগ্য বন্ধু।বিশেষ ক'রে তাঁর গান আমাদের ব্যক্তি জীবনের সব না পাওয়ার বেদনা ভুলিয়ে দেয়।জীবনের ঊষর মরুভূমিতে বারি সিঞ্চন করে,আমাদের প্রাণের 'পরে
বসন্তের বাতাস টুকুর মত বয়ে যায় ।তাঁর গানই আমাদের এই ভোগবাদী আত্মসর্বস্ব জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও রেহাই দেয়।আমাদের ভেতর গুনগুনিয়ে ওঠে সেই সুর-'আমার মুক্তি আলোয়
আলোয় এই আকাশে।' আমাদের অনেকেরই তো এরকম অভ্যেস আছে যে কোনও কিছুই ভালো লাগছে না, যেন এক বিপন্ন মুহূর্তে বসে আছি তখন আমরা আমাদের প্রিয় তাঁর গানগুলি শুনতে থাকি।আর
সেই গান তখন আমাদের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে যেন একটা উপশমের প্রলেপ দিয়ে দেয়।আমরা কিছুটা ঝরঝরে হয়ে উঠি ।তখন বলতে ইচ্ছে করে-'বিরস দিন বিরল কাজ,প্রবল বিদ্রোহে/এসেছ প্রেম এসেছ
আজ কী মহা সমারোহে।'এই প্রেম শব্দের গভীর ব্যঞ্জনা তিনি যেভাবে ভুবনময় ছড়িয়ে দিয়েছেন তা দেখে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই ।তাঁর গানে প্রেমের যে ব্যাপ্তি আছে তেমনটি আর কোথাও পাইনা।
'তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে /কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।'এই সেতু বাঁধার কাজ আমাদের সারাজীবনই চলতে থাকে।হয়তো শেষ পর্যন্ত বাঁধা হয় না।বাঁধা হয়না বলেই আমাদের
অন্তরের গভীরে উচ্চারিত হয় এই বানী-'আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।'এই বঞ্চনার একটি গভীর তাৎপর্যময় দিক আছে, সেই দিকটি হ'ল ইতিবাচক।এই বঞ্চনা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি।আর অই যে তিনি সেতু বাঁধার কথা বলেছেন তা যদি একসময় শেষ হয়ে যায় তাহলে তো সেতু বাঁধার জন্য আকুলি-বিকুলির অবসান হবে।'হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়/আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়।' সাঙ্গ হয়ে গেলে তো বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে পড়বে।খুব ব্যাপক অর্থে প্রেম শব্দটিকে ব্যবহার করলে আমরা বুঝতেপারবএটা আমাদের জীবনে অনেকটা acceleration-এর মত কাজ
করে।অর্থাৎ জীবনের গতি ত্বরান্বিত করে।ওই যে কথায় বলে না প্রেমই জীবন আর প্রেমহীনতায় মৃত্যু ।এ শুধু এক অতল জলের আহ্বান  আবার কখনও বা রক্তিম মরীচিকা ।তবু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন
'আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।' যে কথাটি বলব তোমায় বলে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে।কথাটা বলতে পারিনা বলেই তো এত ছটফটানি ।রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন
- আমাদের জানা দু-রকমের । একটা হচ্ছে জ্ঞানে আর একটা অনুভবে।তাঁর গানের কথা দিয়েই বলি-'অনুভবে জেনেছিলেম।'কাজেই রবীন্দ্রনাথের গানে 'প্রেম'-এর যে বিস্তার আছে তা অনুভবে জানতে
হয়। এই প্রেম হল যাকে আমরা পেতে চাই তার জন্য এক ধরনের ছটফটানি ।হতে পারেন তিনি ঈশ্বর, হতে পারেন কোনও মানুষ ( পুরুষ অথবা নারী) আবার হতে পারে আমাদের 'ছোটো আমি' থেকে 'বড় আমি'র দিকে যাওয়ার জন্য অনন্ত অভিসার।এই কথা শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ।যা আমি সৃষ্টি করতে চাই তা কিছুতেই পারছিনা। 'তোমাতে আমাতে হয়নি যে কথা মর্মে আমার আছে সে বারতা।'  এই বারতা থেকেই যায় ,কথা হয় না। আর আমাদের এই না বলা বানীর ঘনযামিনীর মাঝে তোমার ভাবনা তারার মত বাজে।এই তুমি যে  কে সেটাও আমরা অনেক সময় বুঝতে পারিনা। ' যে ছিল আমার স্বপনচারিণী/তারে বুঝিতে পারি নি।' বিশেষ ক'রে  তাঁর প্রেম ও পুজা পর্যায়ের গানগুলি শুনলে এই কথাটাই মনে হয়।যদিও আমরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথের গানকে কোনও পর্যায়ে ফেলে ভাবতে চাই না কারণ তাতে রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটে ।আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ। শুধাইনি কেউ বলেই তো এত সৃষ্টি ।ছবি,গান, কবিতা । এখানেই সব মরমের কথা বলে যেতে হয়।আর এই প্রেমের জন্যই আমরা 'দুয়ারে এঁকেছি  রক্ত রেখায় পদ্মআসন ।হয়তো এই প্রেম ক্ষনিকের অতিথি হয়ে আসে আবার হারিয়ে যায় । হারাই- হারাই সদা হয় ভয় , হারাইয়া ফেলি চকিতে। মন কে তখন প্রবোধ দিই এই বলে-যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর?
                                                      জীবনে আমরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত থাকি,আবার এমন অনেক কিছু অযাচিতভাবে পেয়ে যাই যা কখনও চাইনি।এই চাওয়া পাওয়ার জগতেই হঠাৎ ক'রেই মনে পড়ে যায় সেই গান-অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া/সেই টুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া।' হ্যাঁ, এই সেই হাওয়া যাকে আমরা বলতে পারি-আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ।জীবনে এই বসন্ত বাতাসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । এই বাতাস যখন আমাদের প্রাণের পরে  বয়ে  যায় তখন আপন মনে গুনগুন ক'রে উঠি -এই লভিনু সঙ্গ তব' সুন্দর হে সুন্দর ।এই সুন্দর প্রকৃতি হতে পারে ,আবার মানুষও হতে পারে।এই সুন্দরের আকাঙ্খা আমাদের সকলের জীবনেই থাকে। এই সুন্দর নানা বেশে নানা ছলে আমাদের কাছে আসে আমরা অনেক সময় তা টের পাই না।যখন টের পাই'সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন/নিশীথ তিমিরে বিলীন।তখন ভিতরের আমি বলতে থাকে-'আমার মন যখন জাগলি না রে/ও তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে/তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ও তোর ভাঙ্গল রে ঘুম/ও তোর ভাঙ্গল ড়ে ঘূম অন্ধকারে ।'তারপর শুরু হয় আবার প্রতীক্ষার পালা- আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ/ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া,বর্ষা আসে বসন্ত।'                                            রবিন্দ্রনাথের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি যে তিনি গান লিখে সব থেকে বেশি আনন্দ পেতেন । আর একথাও তো সত্যি যে আমরা অনেকেই তাঁর গান ছাড়া তাঁকে ভাবতে পারি না।গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি /তখন তারে চিনি আমি,তখন তারে জানি।আমাদের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে আমরা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,দাঁড়াতে হয় ।প্রতিদিন আমি ,হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে/করি জোড় কর, হে ভুবনেশ্বর,দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে ।তিনি তাঁর গানে অধরা মাধুরীকে ছন্দোবন্ধনে ধরে আমাদের যা উপহার দিয়েছেন তা হ'ল মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি 'প্রেম'-এর স্বাদ।জীবন কে প্রগাঢ় ভাবে ভালোবাসার নামই তো প্রেম।এই প্রেমছাড়াআমাদেরর জীবন অচল।তিনি আমাদের অধিকাংশ বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন,সেটা আমরা স্বীকার করি আর নাই করি তাতে কিছু যায় আসে না। অই যেমন সূর্যের আলো ।প্রকৃতির বাতাস যাদের আমাদের স্বীকার -অস্বীকারের দলাচলে এসে দাঁড়াতে হয় না,থিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ। আমরা কোনোভাবেই তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁকে এড়িয়ে চলতে পারি না।এই মানুষটিকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই।'বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে/ কোথা হতে এলে তুমি হৃদি মাঝারে।'




পদ্য

 রবিবাবু শুনছেন
শশাঙ্কশেখর পাল

তোমাকে দেখব দেখব ভাবি
নাগাল যায় না
সভা সমিতি 
সাহিত্যবাসর সাংস্কৃতিক সন্ধে
শববাহী
রাস্তা ঘাট গাড়ির হর্ণ ভেদ করে 
এই যে তোমার গান আমৃত্যু লেপটে থাকে
সুখে দুখে শয্যায় স্বপ্নে

নিজের মতো আপন করছে যে যার মদের গ্লাসে

কোথায় আছো তুমি
‘রাশিয়ার চিঠি’তে
‘আফ্রিকা’য়
‘দেবতার গ্রাস’য়ে
নাকি ‘সোনার তরী’তে

তোমাকে কী পাব বুড়ো হাড়ে ভেল্কির মত ‘শেষের কবিতা’য়
ঠিক টগবগে টাট্টু—
একি বলছি আমি 
দেখ তোমার বিশাল ভারে মাথাটাই চেপটেছে
ফাঁক গলে তোমার ভিতরেই ঢুকে পড়েছি
কী আলো কী আলো
সৌরমণ্ডল থেকে সৌরমণ্ডলে
আমি নিল আর্মস্ট্রং ঝুলে আছি বাঁধা সুতোয়....   




রবীন্দ্র স্মরণে
নারায়ণ দত্ত

জন্ম তাঁর কোলকাতার
ঠাকুর পরিবারে
কে না চেনে সে ঠাকুরে
গোটা বিশ্ব জুড়ে ?

নাম ছিল তাঁর রবীন্দ্রনাথ
পিতা "দেবেন ঠাকুর"---
কবিতা আর গানের রাজা
নিজে দিলেন সুর....।

" জল পড়ে পাতা নড়ে"
প্রথম লেখেন কবি...
লাজুক খোকা সে রবিই তো
হলেন বিশ্ব কবি ।

গীতাঞ্জলী লিখে পেলেন 
"নোবেল" পুরস্কার....
বিশ্ব সেরা কবি তোমায় 
জানাই নমস্কার ।।




"কবিগুরু  আপনাকে"
দেবাশিস  বর্ধন

প্রতিটি দিনই কোনো না কোনো সময় আপনি আসেন
আপনার কবিতা, গল্প, উপন্যাসের চরিত্রেরা এসে
অল্প হলেও দেখা দিয়ে যায়
উদাস মনে বা একাকিত্বে আপনার গান সজ্ঞীবনীর মত লাগে
ব্যস্ত জীবনে সব যখন অপ্রাসংগিক, গতানুগতিক, অবসাদে ভরা
মনে হয়, তখনই আপনাকে খুব করে পাই
আপনার বাণীতে ও সুরে খুঁজে নিই
চলার পথ
অতিপ্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক শক্তিকে জানি না
যদি থাকে
তবে সে আপনিই
আপনাকে হৃদয়ে অনুভব করি |


                                   




প্রথম পঁচিশে ও আমি
উদয় সাহা

তখন আমি চতুর্থ শ্রেণী
নীল হাফ প্যান্ট, গোলাপি হাফ হাতা জামা
পাড়ার বন্ধুরা মিলে আয়োজন করেছিলাম তোমার জন্মোৎসব--
ছুটোছুটি, হইচই কত কলরব
মুঠোভর্তি খুচরো পয়সা
বুকপকেটে আনন্দের ঢের
অবচেতনে দুশ্চিন্তার মেঘ
'এ যে বোশেখ, কালবৈশাখীর জের '
সেদিন তোমায় মাথায় ক'রে মঞ্চে বসিয়েছি
কোথায় আর স্পন্সরশীপ!
মা -কাকিমাদের শাড়িতে তোমায় ঘিরেছি
মঞ্চ বলতে ঐ একটা ছোট্ট চকি
জিতেন জ্যেঠু তো বলেই ফেললেন, 'এ যে মস্ত বড় ঝুঁকি!'
ছিল না কোনো বৈদ্যুতিন সংযোগ
ছিল না আড়ম্বর
একজনের বক্তৃতা, সাত-আট জনের ছবি আঁকা,
একটা আবৃত্তি আর দুটো গানের আসর
গুটি গুটি পায়ে আমিও উঠেছিলাম সেই মঞ্চে
পেছনে তোমার ইয়া বড় ছবি
বইয়ে পড়েছিলাম তুমি বিশ্বকবি
সরলরেখায় বলে গেলাম,'মা গো আমায় ছুটি দিতে বল...'
কি করেছো তুমি!
তিন দশক পেরিয়েও তুমিই অল ইন অল
হাফ প্যান্ট তখন আমার কতটাই বা চিনি
কিন্তু মনে ধরেছিল, বড় দিদিমণি বলেছিলেন
'তুমি বরেণ্য, তুমি চিরন্তনী '।
জানো ঠাকুর,
আজ ওই সরলরেখাটা পলির চাপে বেঁকে গেছে
শিখে গেছি কায়দা
সেদিনও তুমি ছবিতেই ছিলে
আজও তেমনই রয়েছো;
প্রতি পঁচিশে তোমারে সুধাই
ওহে ঠাকুর, তুমি কেমন আছো?







   " রবীন্দ্র স্মরণে"
 নিশীথ বরণ চৌধুরী

 
         হে সৌম্য, হে আচার্য্য্য ,হে বিশ্ব কবি,
        আগামী  একশ সাতান্ন তম জন্ম জয়ন্তী,
        প্রণমি তোমার চরণে, অঞ্জলি লহ মোর।
দ্যাখো সেজেছে কেমন পল্লীর প্রান্তর নগরের মন্ডপ
রাশি রাশি ফুলে ঢাকা তোমার প্রতিকৃতি ,শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।
    অনুপ্রেরণায় শিহরিত  মন
 শুরু হয় রবীন্দ্র ভাবনা ও চিন্তন
নির্বিশেষে মন মুগ্ধকর বক্তৃতায় এগিয়ে চলে সময়ের 
ক্ষণ।
রক্ত করবী থেকে অরূপ রতন, শেষের কবিতা,
নাটক নাটিকা থেকে ছন্দ ময় কবিতায় ঝলসে ওঠা  আলোচনা,
সমাপ্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও তোমার আরাধনা।
হে সৌম্য আচার্য্য ভারত বাসীর অহঙ্কার,
নানান ভাষায় অনূদিত তোমার সৃষ্টি
এখনও অর্বাচীনে করেনি করাঘাত।
একই সূত্রে সহস্রটিমন বন্ধনহীন,
বিচ্ছিন্নতা বাদ, মানুষে মানুষে বিভেদ ও
 বিচারের বানী দুর্বলে হানিছে আঘাত।
 প্রতি বছর সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন,
পরক্ষণে ভুলে যায় তোমার লেখনীর ভাষা,
আর্ত নিপীড়িত মানুষের  কহিতে কথা,
 "শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সব গেছে ঋণে"
 তবুও দেখি তোমার বুকেতে বুর্জোয়া কবির তকমা আঁটা।
হে চির ভাস্বর আচার্য্য আমারা থাকিব প্রতীক্ষায়
বাঁধিব একই সূত্রে সহস্রটি মন
নতুন এক ঐক্য সুরের লহমায়।



আমার বারোমাস্যা, কবিগুরুকে--
মৌসুমী চৌধুরী 



খুব সঙ্কটে আছি, হে কবিগুরু, 
গভীর সঙ্কট  !
ওই  যে  "আমাদের ছোট নদী"গুলো
যাদের  বাঁকে বাঁকে চলতে দেখে গিয়েছিলেন  আপনি , 
ওরা যে আজ প্লাস্টিকের বোঝা বুকে নিয়ে  গতিহীন,  বিষন্না !
ওদের দিশাহীন করুণ কান্না ওড়ে 
 দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু বালুচরে !

বড়ই সঙ্কটে আছি , হে কবিগুরু, 
গভীর   সঙ্কট  !
শরৎ আসে, বেশ আড়ম্বরেই আসে ,
থিমের হোর্ডিং এ ভরে ওঠে চারধার ।
হাওয়ায় ওড়ে পুজো সেলের হাঁকডাক , 
কিন্তু হাওয়ার  'পরে  "হিমের পরশ" লাগে না।
তপনের খর শাসনে "সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে  " না !
"গ্লোবাল ওয়ার্মিং ", গুরুদেব,
বিশ্ব উষ্ণায়ণ  !
ওষ্ঠাগত  প্রাণ আমাদের !


বড়ই সঙ্কট,  হে রবিঠাকুর  , 
গভীর  সঙ্কট ! গভীর সঙ্কট ! 
আমাদের শিশুরা আর বলে না, 
"মাগো , আমায় ছুটি দিতে বল 
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা। "
বললে চলবে কেন? আমরা শুনবোই বা কেন  ? 
সাইন্স, ম্যাথস্, ইংলিস অলিম্পিয়াড আছে না ? 
তোমার মতো 
ঘোড়া হয়ে মাঠ পার হওয়া,
মাছ হয়ে সাঁতার কাটা,
পাখি হয়ে গগনে ওড়ার
 স্বপ্নসাধ কি ওদের মানায় ? 
পিঠে বইয়ের ভারে
 বড়ই ক্লান্ত ওরা  ,  কবিগুরু ! 


 আর শুনুন , 
 "উচ্ছে বেগুন পটল মুলো,
বেতের বোনা ধামা কুলো
সর্ষে ছোলা ময়দা আটা,
শীতের র‍্যাপার নকশা-কাটা । "
সব আমরা মোর আর স্পেনসারে
পেয়ে যাই, রবিঠাকুর   ।
হাটে  টাটে  আমরা  আর  যাই না।
আপনার বংশীবদন,  তার ভাগ্নে মদনরা আজ সব নিখোঁজ  ।


বড়ই আত্মিক সঙ্কট, হে রবিঠাকুর ,
প্রেম সঙ্কট,   গভীর  সঙ্কট !
"আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস।"
এমন সমর্পণী "প্রেমের জোয়ারে"
আমরা আর  ভাসতে পারি না,  কবিগুরু, 
আমরা আজ ডিজিট্যাল প্রেমে অভ্যস্ত ........
মুঠো মুঠো ঝা চকচকে প্রেম উড়ছে আকাশে বাতাসে।
সহজেই "পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।"


"ওরে বকুল, পারুল,ওরে শাল-পিয়ালের বন,
কোনখানে আজ পাই
এমন মনের মতো ঠাঁই "......
হে গুরুদেব, আমরা শাল-পিয়ালের বন সাফ করে
উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছি।
ঠাঁই খুঁজে নিয়েছি বহুতলে......


" বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে" না আর, কবিগুরু, 
প্রতিবাদের মোমবাতি মিছিলে 
বুক ফাটা আর্তনাদ করে ! 


আমি এক অধম কবি, রবিঠাকুর,
আমার প্রাণের পরে দাঁড়িয়ে থাকো শুধু  তুমি,  আমার প্রাণের মানুষ ।
বৈশাখে যখন লাল চেলিতে  সেজে ওঠে  কৃষ্ণচূড়া , 
রোমাঞ্চিত মনটি আমার  উদ্বাহু হয়ে গাইতে থাকে,
"ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে............... "


দুঃখ সুখের আলোছায়ায় এই আমার বারোমস্যা, কবিগুরু ।




  জীবনানন্দ - একটি নিস্তব্ধ ঝড়
 শিবু

হাওয়া বড় বিষম বস্ত কোন আধারকে শূন্য থাকতে দেয় না
তাইতো জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছি- রোজ বিকেলের মত আজও
 সে কড়া নেড়েছিল ,বাতাসের কলঙ্ক গায়ে মাখব না বলে
কপাট খুলিনি । সে ফিরে গেছে । ঘরের সন্ধ্যে জুড়ে শুধু
জীবনানন্দ বাষ্প ঘোরাফেরা করছে- সে আরেক নিস্তব্ধ ঝড়- যে শূন্যতা
চাইছিলাম সে যেন ধীরে ধীরে মহাশূন্যতার শেষ সীমানায় ঠেলে দিল ।

বাকি রাত যখন আমার শিয়রে জাগে, আমি একহাতে
মেয়ের নরম আঙুলের স্পর্শ আর চোখে মহাকাশের টান
নিয়ে জেগে থাকি । জানলার পর্দা সরিয়ে, বায়ুমণ্ডলের
মেঘের ভীড় সরিয়ে অন্তরীক্ষের জোনাকিদের খুঁজে ফিরি । 






“রবি বরণ”
দেবশ্রী চক্রবর্তী

নমামী তোমায় শতবার,
তোমার প্রেমে কতবার
হারিয়ে নিজেকে ফেলেছি;
তোমার কলমে প্রকৃতির নেশা-
নারীর কষ্ট, প্রকৃতি,
আবেগ, ভালোবাসা;
কখনও প্রতিবাদে ব্রিটিশ নত
সমাজের কত ছোট বড় ক্ষত
কিভাবে তুমি আঁকলে?
যে সেই নেশা
যেন শ্যাম মম বাঁশি
দিয়ে বেঁধে রাখলে
দূর গাঁয়ে তখন সাঁঝ বেলা
খুদে শিশুদের ঘরে ফেরার পালা
ক্ষীণ শোনা যায় রাখাল ছেলের বাঁশি;
মিঠে পবন কারও মনে তোলে ঢেউ
স্থির কোন পুকুর পাড়ে সে
তোমাকে মনে করে কেউ
ইট পাথরের যান্ত্রিক দেশে
রবি তুমি কোথা থেকে
এসে আমাদের মন ভরালে?
ছোট, বড় কোনও বাঁধা নাই
তোমায় ভাল বাসেনা বাংলায়
এমন কোনও রাধা নাই-
প্রণমি কবি বার বার
ফিরে এসো রবি
আলোকিত কর, উজ্বল কর
বাংলা তোমাকে করবে বরণ
শতকোটি বার




রবি লাল চিরকাল
          - প্রদীপ কুমার ঘোষ
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলে
দুহাতে পুষ্পাঞ্জলির ভঙ্গিতে
যেসব আরতি জমা হয়,
তার রঙে রবিগন্ধ পাই।
আমরা যখন ক্যালকুলেটেড
অসামঞ্জস্যের যানজটে
কবিতাকে বারবার শব্দে খুঁজছি,
আকাশের মেঘে লিরিক্যাল পোয়েট্রি
ততবার আমাকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে
কবিতায় সূর্যের মৃত্যু নেই।
নামের সামনে ডেফিনিট আর্টিকেল
এবং সুপারলেটিভ অ্যাডজেক্টিভে
যতবার ২৫শে বৈশাখ আসে,
ততবার ধুলোপড়া গীতাঞ্জলী
বলাকা হতে চায়…
ততবার স্তুপীকৃত রচনাবলী ঘেঁটে
উদ্ধার হয় চিরন্তনত্ব।
বছরে একদিনই সূর্যোদয়?
একদিনেই আমাদের বছর?
মাথার ধোঁয়াগুলো প্রেসিপিটেড হয়ে
কখন না জানি রাবীন্দ্রিক বর্ষণে ভিজিয়ে দিল
৩৬৪ দিনের নাগরিক বচনধুলো।





     আমার রবি.......
দেবপ্রিয়া সরকার

আমার রবি, অসীম আকাশ
দিনের নীলে, রাতের তারায়
অহর্নিশি অমোঘ প্রকাশ l
তাঁর সৃষ্ট কাব্য গানে;
ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথার গল্প গাথা
জীবন মুখর উপাখ্যানে
যুগে যুগে ধন্য হল বিশ্ব জোড়া
                পাঠক-শ্রোতা l
আমার রবির অমর রচন
যুগ ছারিয়ে, কাল পেরিয়ে
হারায়নি তার প্রাসঙ্গিকতা l
তিনিই সকল গুরুর গুরু
বন্দিত সেই মানব প্রেমিক
তাঁর ভাবনার ডুবসাগরে, সাঁতরে ফেরে
ভাবজগতের হাজার পথিক l



" আমার রবীন্দ্রনাথ "
   জীতেন্দ্র দেওঘরিয়া

             ১
দুঃসময় এসেছে নেমে
পৃথিবীর বুকে। গেছে থেমে
সুন্দরের গান।
দুর্যোগ ঘনালে বুকে মিছে ভরসা রাখা
মৃত‍্যুকালে লাভ-ক্ষতি
দুটোই সমান ----
শুভবুদ্ধি থাকা বা না-থাকা।

            ২
শ্রেয়সী মূর্ছা গেছে,
দিব‍্যি দিয়ে পালিয়েছে
মনের মানুষ ---- খাঁটি সোনা!
অন্ধকার এসে
ভরিয়ে তুলেছে তার বিশ্বচরাচর।
সমুদ্রের স্বাদ বুঝি নোনা ?
খ‍্যাপা তার‌ই তীরে খোঁজে পরশপাথর।

              ৩
দারুণ দুর্মূল‍্য দিনে
প্রেমের পরম মূল্য লাভ করিবারে
আলো জ্বালি। ঘোর অন্ধকারে।
এক কোণে। খুঁজে দেখি ---
শরীরেই লেগে আছে শরীরের সুখ।
দান করে জড়িয়েছি ঋণে।
শব্দব্রহ্ম ভাসমান, প্রতিটি রাত্রি সর্বভুক।

              ৪
সহজ মুক্তির পথ
অর্ধসত‍্য। দেবতার রথ
পক্ষপাতে এসে থামে।
চিরসত‍্য ভিক্ষার ঝুলি -----
স্বার্থে বসতে লক্ষ্মী, সুমিত আরামে।
কিছু সত্য অলৌকিক! চোরাবালি!
বুঝেছিল একমাত্র পাগল মেহের আলি।

             ৫
যুদ্ধ লেগেছে ঝোঁকে,
আলোচনা বৈকুন্ঠলোকে ----- মরণের জের।
অমৃতের কালোবাজারি
লুকিয়ে দেখেছি আমি ঢের
------------জনম ভিখারি।
মর্ত‍্যে শুধু গঙ্গাজল। হরিবোল খ‌ই।
নির্বাসিত বৈতরনী তীরে, একা পড়ে র‌ই।

             ৬
ক্ষমা কোরো সখা।
তর্ক নেই এসবের মাঝে।
অর্থহীন । বাজে । খেয়ালী বালাই।
তুমি জানো ---------ভালোবাসি।
তোমা ছাড়া এ জগতে মোর কেহ নাই।
আর, পাশাপাশি সংসার করতে হলে --
এইটুকু ঠোকাঠুকি না-হলে কী চলে ?




ভেক
অতনু মৈত্র

তোমার কতই না নাম বিশ্বকবি, কবিগুরু
আরও না কতকিছু।
কিন্তু আমার কাছে তুমি শুধুই আমার দাঁড়িবুড়ো।
সব চলে গেলেও, তুমিই আছো একমাত্র আমার আপনার
কত সহজেই না বলে দিয়েছিলে-
"ভালোওবাসি ভালোবাসি,,,"
গোরাদের তুমিই বাংলা শিখিয়েছিলে,
তোমার দৌলতেই  আজও দেখি-
কিছু বাঙালির একটিদিনের বাঙালিয়ানা,
শুধুমাত্র তোমার জন্মদিনের উপলক্ষ্যে।
আজও তোমার অবারিত দ্বার
কিছু বাঙালির মননে, স্বপনে।
তোমার অঢেল গুণগ্রাহী,
তোমাকে বুঝুক অথবা না বুঝুক
তোমাকে ছাড়া বাঙালির এক মূহুর্ত চলে না
তবুও তুমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছো-
উদাসীনতার ভিড়ে।
তোমার উপলব্ধি গুলো আজ প্রায় লুপ্তপ্রায়।
তুমি শুধুই একটা তারিখ হয়ে রয়ে যাবে নাতো ?
বড়ো ভয় হয়,,,





ফ্লাশব্যাক
  কৌশিক কুমার রায়

ভোর হতে দেরি এখনও
আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢাকা l
সারা দেশে একটা গুমোট ভাব
বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা l

বাড়ির পোষ্যটিও নিদ্রায় অচৈতন্য
জীবনটাও বিষময়, অসহনীয় অত্যাচারে l
পরাধীনের শিকলে বাঁধা গর্ভের শিশুটি
সৈন্যের পায়ের শব্দে গুটিয়ে থাকে সকলে l

হায়নার ছদ্মবেশে হাজির ইংরেজ সাহেবও 
অকথ্য গালাগাল দুর্গন্ধ মুখে l
শিবের কণ্ঠে বিদ্রোহ, চাষীর
পাহাড় প্রমাণ বিপদ যে সম্মুখে l

নিজেদেরই সাথে লড়াই, নৌসেনার
সাদা কালোর বিভাজনে l
খোকলা করার রাজনীতি ব্যর্থ
ধর্মের কার্তুজে....l

অতঃপর মেঘের চাদর সরিয়ে
পর্বত শীর্ষে উঁকি দেয় ভাস্কর
কান্নার আওয়াজে,মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে
কলমে তাড়াবে ভিনদেশী তস্কর l



                   

রবীন্দ্রনাথ
আর্যতীর্থ

ভেবেছিলাম যৌবনের অবিমৃষ্যকারিতায়,
আর কটা বছরেই তাঁর সবকটা কবিতা পড়ে নেবো,
নয় নয় করে তিনটে দশক হয়ে এলো প্রায়।
এই তো সামনের ছুটিতেই হাত দেবো,
এই করে বিকেল গড়িয়ে এলো প্রায় সন্ধ্যায়।
ছোটোবেলার আবৃত্তি বা কৈশোরের চিরকুটের চেনা লাইন,
আজও খুঁজে ফিরি ছিঁড়ে যাওয়া সঞ্চয়িতায়,
সে সব সোপান পেরিয়ে তাঁর মন্দিরে যাবো,
অন্তত এখন অবধি তার আশা ক্ষীণ।
তবু, জীবনের প্রতি স্তরে ও স্তবকে,
ফিরে ফিরে আসি আমি তাঁর কবিতায়,
রচনাবলীর কোণে পড়ে থাকা কোনো অপঠিত কাব্যে নয়,
চেনা পংক্তিরাই বারংবার ধরা দেয় অদ্ভুত বিমূর্ততায়,
চিরপুরাতন এক শাশ্বত সত্য নিয়ে আসে নব পরিচয়।
বড় ক্লেদে ভরে গেছে জীবন এখন,
ক্লান্ত ডানারা আজ ওড়বার আশা ছেড়ে ঘুম যেতে চায়,
পরাজয় মেনে নিয়ে শত্রুকে করতে চায় অস্ত্র সমর্পণ।
ঠিক তখনই, ম্রিয়মাণ সন্ধেবেলায় ও কার স্বর শোনা যায়,
অস্ফুট, কিন্তু কি দৃঢ়, প্রত্যয়ী,  কি অমোঘ সে ডাকা,
পিছু হটতে থাকা জীবন আচম্বিতে আবার ঘুরে দাঁড়ায়,
কান পেতে শোনে...' এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা...'
এই আঁধার যুগে, পদে পদে ভয়ে থাকি, এই বুঝি পা পিছলায়,
এই বুঝি তিলক বা ফেজ ভূতে পিছু থেকে গেঁথে দিলো ধর্মের তির ,
দ্রিমি দ্রিমি বেজে ওঠে চেনা শব্দরা, অহেতুক ভীতু বুকে সাহস জোগায়,
আমাকে বলেন রবি চিত্ত করে ভয়শূন্য, উচ্চে রাখো শির....

"রবি"_র 
    আলয়"

রায় মাম্পি

("প্রাণে"র মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে",,,,,,, কবিকে প্রণাম জানিয়ে)
               
                  যেদিকে চাই হেরিতেছি তাই
                          দক্ষিণ_দ্বার খুলে,
                  বৈশাখীর সুরে ভাসল জগৎ
                 ফুলে _ফুলে, ঢলে_ঢলে।।

 রামধনু রঙ লাগল চোখে,
   উঠল ধ্বনি মন্দিরেতে,
   বাজল কাঁসর, পড়ল ঘন্টা,
         ফুঁকল সুরে শাঁখ, 
প্রভাতী আলো বইয়ে এলো
   পঁচিশ_ এ _বৈশাখ।।

  শতবর্ষের কাহিনী সে এক পুরাতন 
   নব ছন্দে,নব আনন্দে সাধব নিরন্তন।।

"রবি" আমার ছন্দ_তালে,
গদ্যে_পদ্যে, কাব্যগ্রন্থে,
গীতাঞ্জলী, গীতিমাল্যে।।
          
        নানান রূপে, নানান সাজে
         প্রাণের ঠাকুর সবার মাঝে।।

রবি'র বীণা উঠলো বেজে, 
 তাইতো আকাশ নীল,
রবি'র আলয় ভাসল এসে
রঙিন শঙ্খচীল।।

            রবি'র বাণী "শেষরক্ষা" য়,
              সকল দ্বিধা "প্রশ্ন "_তে।।
             রবি'র বাণী, পুরাতন হতে
              নবীন কাব্যগ্রন্থে।।

রবি'র কথা 'শিশু _মহল'
"সহজপাঠ" _এর ভাঁজে;
রবি"র কথা আবাল_বৃদ্ধা
সকল লোকেই সাজে।।

                      "গীতবিতান "হতে "চণ্ডালিকা"
                         সবই রবি"র দেওয়া;
                "আমার মিনি", "দেবতার গ্রাস "
                        যায়নি কিছুই খোয়া।।

"উপেন" আজও আছে দেখ
 সকল কাব্য জুড়ে;
 ধর্মের _মেকি_ সুর বইছে
 "গোরা"র পৃষ্ঠা মুড়ে।।

                   হিংসার মুখে ছিটোয় নি কালি
                       ওই জয়সিংহের ছোড়া
                         "মাধো"র কাছেই সেই
                   "শ্রমিক আন্দলনে'র "
                     কাহিনী টি  আছে পড়া।।

বিভেদ যত, নিরক্ষরতার 
     শিকল ছিল পরা
দূষণ হতে মুক্তি পেতেই
রবি"র প্রবন্ধ, ছড়া।

                   " ছোটোগল্প" ",রক্তকরবি"
                         নাটক, উপন্যাস, 
                       একমাত্র "রাশিয়ার চিঠি"ই
                         অগ্রগতির আশ।।

প্রাতঃ কালের স্ত্রোত্র পাঠে 
  রবি"র "আরণ্যক শ্রুতি "
সন্ধ্যাদীপ জ্বালিয়ে রবি"র
"প্রার্থনা "র প্রতিশ্রুতি।।

                     রবি" সবার হাল ধরানোর
                      ভাঙা নৌকো র হাল;
                   রবি"সবার "মানসী "হয়ে 
                      থাকবে চিরকাল।।





সম্পাদনা ও অলঙ্করণ- শৌভিক রায়

                         


No comments:

Post a Comment