Saturday, December 9, 2017

কাব্যগ্রন্থ আলোচনা

কাব্যগ্রন্থ- ওঁ চিহ্নের সন্ধি: বিপ্লব সরকার
মূল্য- ১০০ টাকা
প্রকাশক- শাম্ভবী

আলোচক- শৌভিক রায়




একটি অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং কোন কিছু ধ্রুব বা আদর্শের বিপরীতে নির্দিষ্ট প্রকরণ ও কাঠামোকে আশ্রয় করে শিল্পসৃষ্টির প্রচেষ্টাই উত্তর আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উত্তর আধুনিকতা ভাবনা নিয়ে একটু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্যে কালগত দিক থেকে "উত্তর" বা Post কথাটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু বাংলা কবিতায় আধুনিকতা উত্তীর্ণ হওয়াই উত্তর আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য। আধুনিকতায় যে অবক্ষয় আমরা পরিলক্ষিত করি সর্বত্র, মননে বা সমাজে, সেই অবক্ষয় থেকে উত্তরণের প্রকরণ খোঁজে উত্তর আধুনিকতা।
মনে রাখতে হবে উত্তর আধুনিকতা কোন নতুন শব্দ নয়। একশ তিরিশ বছর আগেও এই শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে (তথ্যসূত্র: পবিত্র সরকার)। এক একটি দশকে এক এক ভাবে প্রয়োগ ঘটেছে শব্দটির। সমস্ত দশকের ব্যবহার মাথায় রেখে বলা যেতে পারে উত্তর আধুনিকতা কোন নির্দিষ্ট ভাবনায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং ভাবনার বৈচিত্র্য, চিন্তার অভিনবত্ব এবং দর্শনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া এবং সময়ে থেকেও সময়ের জালে বাঁধা না পড়াই উত্তর আধুনিকতার বড় বৈশিষ্ট্য। আর সেদিক থেকে দেখতে গেলে ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত বিপ্লব সরকারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ওঁ চিহ্নের সন্ধি" উত্তর আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে ছুঁতে পেরেছে।
"যুগ্মাক্ষর" কবিতার একটি লাইনই এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যেখানে কবির উচ্চারণ "পৃথিবীর বিচিত্র চিৎকার মালা গাথে এক সুতোয়"। এই বাক্যটিই যেন বলে দিচ্ছে ভাবনার বৈচিত্র্যে আলাদা হয়েও দর্শন কিন্তু সেই একই যা সামগ্রিক এক সত্ত্বাকে হাজির করে পাঠকের মননে, যে সত্ত্বার ভেতর পাঠক নিজেও থেকে যান। এই সামগ্রিকতা বোধই যেন অবক্ষয় থেকে উত্তরণের হাতিয়ার। সময়ের জালে বাঁধা যায় না এই বোধকে। অথবা "প্রেমিক" কবিতার "হাঁটতে হাঁটতে কোনো কোনো শিরদাঁড়া বেঁকে গেলেও প্রেমিকেরা দাঁড়ায়। সোজা হয়।" সেই একই উচ্চারণ। এরকম আরও উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাব্যগ্রন্থের নানা পাতায়। অ্যান্টিফর্মে লেখা "রাস্তাটা পিচ্ছিল" বা "সংযম" বা "শিকার" যে বিরোধাভাসের জন্ম দেয় তা দ্যোতক হয়ে ওঠে বাসনার। আর এই বাসনা থেকেই বিনির্মিত জগত খোলে পাঠকের বন্ধ মনের দরজায় যেখানে "আমরা সাক্ষি থাকি/ বন্ধ দরজা দেখে মেঘের সমুদ্রে চাঁদের আত্মহত্যার।" এই প্যারাডক্স হাত ধরে ঘোরে "ঢুপলুং", "নপুংসক", "পর্দা" ইত্যাদি কবিতাগুলিতে। তুলনায় "মানসাই" শীর্ষক কবিতা দু'টিতে কবি অনেক রোমান্টিক। নদীর বুড়িয়ে যাওয়া দেখে কবির পাথর ভাঙা চিৎকার ছুঁয়ে যায় এক ইউনিভার্সাল আর্তনাদকে যে আর্তনাদ রোমান্টিকতার স্তর উত্তীর্ণ করে কখন যেন নিজেই ক্ল্যাসিকের পথে যাত্রা শুরু করে। তুলনায় কাঁচা লেগেছে "একটি প্রেম-বিরোধী প্রেমের কবিতা", "যবনিকা"। আসলে কবির ম্যাচিওরিটি বাড়ে অভিজ্ঞতা, বয়স, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদির সাথে সাথে। হয়তো তুলনামূলকভাবে আগের লেখা এই কবিতা দু'টি। তবে তথাকথিত "কাঁচা" কবিতা দুটিতেও কবির "পরবর্তীতে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস হতে চাওয়া" বলে দেয় কবির "সংগ্রামটা নিজের সাথে।" আর এই আলোচকের বিশ্বাস সেই সংগ্রামে কবি অবশ্যই নিজের দিশা খুঁজে পেতে সঠিক পথেই যাত্রা করছেন। "নপুংসক" কবিতাটিতে যে পরিতাপ উল্লিখিত হয়েছে তাতেই বোঝা যায় কবির সেই দিশার পথে যাত্রা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চোরা যৌনতার সুর লক্ষ্য করা যায় "হরিণ", "ছাই", "একটি অন্তর্দেশ ক্যানভাস", "প্রতিবিম্ব", "পর্যটন কেন্দ্র", "সংযম", "তিলক" ইত্যাদি কবিতায়। যৌনতা তার খন্ড থেকে নানা রূপে, মূর্ততায় বিমূর্ততায়", কবির লেখনীতে লিপিবদ্ধ। আবার "গোলতন্ত্র", "আমার দেশে", "নাগিন" ইত্যাদি কবিতায় অবক্ষয়িত সামাজিক ও রাজনৈতাক ঘূর্ণিপাককেই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা এবং অতি অবশ্যই "অবজেকটিভ কোরিলেটিভ" থিয়োরি অনুযায়ী। সবশেষে আর পাঁচজন সাধারনের মতোই, এই সময়ের মানবসন্তানের মতোই কবি হন মুখোমুখি শূন্য ও সবুজের। কিন্তু ধ্রুপদী ভাবনায় নিজেকে ভেঙে দেখতে পান "মুজনাই বালিকা তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।" এই অমোঘ উচ্চারণ মনে করিয়ে দেয় কবিতা নিয়ে যত তর্কই হ'ক না কেন, যত মতবাদ আসুক না কেন...কবিতাই সেই শক্তি যা যোগাতে পারে একক মানুষকে চলবার শক্তি সারা জীবন।
কাব্যগ্রন্থের মনোজ্ঞ ভূমিকা লিখেছেন কবি সুবীর সরকার। গ্রন্থটি শুরু করবার আগে সেই ভূমিকা অবশ্যই পাঠককে সাহায্য করবে বিপ্লব সরকারের কবিতাগুলিকে অনুধাবণ করতে।

No comments:

Post a Comment