উপহার
দেবব্রত সেন
সঞ্জিত আর সুরমার প্রেম সেই কলেজ থেকেই, এখন দুজনেই প্রাপ্ত বয়স্ক, তাদের প্রেম এমন জায়গায় পৌঁছায় যে শেষ পর্যন্ত বিয়েতে মত দেয়। সমাজ ব্যবস্থায় দুটো ভিন্ন জাতির, তাই দু 'বাড়ির লোক তাদের সম্মতি দিল না, বিয়ে থমকে থাকল আর ভালোবাসা চলছে।
কিছু দিন পর সঞ্জিতের দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেল, সঞ্জিত সুরমাকে ডেকে বলল, আমার জীবন ব্যার্থ, তুমি অন্য কোথাও একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে নাও, আমার জন্য তোমার জীবন নষ্ট হতে দিও না ।
সুরমা বলল, আমাদের স্বপ্ন কি তবে স্বপ্নই থেকে যাবে! এই বলে চলে গেল।
২১ শে মার্চ সঞ্জিতের জন্মদিন, সে হাসপাতালে ভর্তি! কেউ একজন কিডনি দেওয়া কথা ছিল কিন্তু সারাদিন গেল কেউ এল না, মৃত্যু এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল। সন্ধ্যে নাগাদ সুরমা এসে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে একটা কিডনি দিয়ে দিল, কিছুটা হলেও সুস্থ বোধ করছে সঞ্জিত।
দেখল সুরমা সুরমার চোখে জল, সে কাঁদছে আর বলছে যতটুকু বাঁচব একটি করে কিডনি নিয়েই ,এক সাথে দুজন।
স ঞ্জিত বলল, আমার জন্য সুরমা তুই একি করলি!
সুরমা! ধরে নাও এটা একটা তোমার জন্মদিনে আমার উপহার। আমি চেয়েছি জীবনেই তোমার আমার সংসার আর কিছুই না।
সঞ্জিত বলল ,এদিকে আয় সুরমা একটু তোমাকে ছুঁই,
সঞ্জিত সুরমার চোখ মুছে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমরা সংসার করবই সুরমা, যেখানে জাত পাত হীন সমাজ থাকবে সেখানে চলে যাব একটা সীমাহীন বসন্তে। এমন সময় একটা বাউলের গান ভেসে এল ------
"সব লোকে কয় লালন কি জাত,
এ সংসারে
লালন বলে জাতের কি রুপ, দেখলাম না এই নজরে ",।।
টুসুমনি
সুতপা মিশ্র
লালধুলো উড়িয়ে চলে গেলো আরও দুটো মোটরগাড়ি, দেখে টুসুমনির কালো মুখটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো।
দোল এসেছে, বাবুদের আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। পলাশের কমলা রঙে চারদিক ভরপুর এই দুই মাস চলবে শহুরে বাবুদের আনাগোনা, দোলের দুদিন তো আরও বেশি। হাটগুলো অন্য সময়ের চেয়ে বেশি জমজমাট, তখন তো অনেক কাজ বেড়ে যায়। কয়েক জনের তো দিনের সাথে রাতে রাতের হিল্লে হয়ে যায়। টুসুমনি ভাবে শহুরে বাবু বিবিদের এ এক মজা বটে! শহরে কোনো দিন যায় নি ও, তবে প্রতি বছর এদের সাথে আলাপ হওয়ায় ও এখন অনেক কিছু জানে, আর মরদ যেহেতু এখন অনেক জানে ...তাই ওও এখন অনেক জানে। এই বাবুগুলো নাকি শহরে অনেক বড় চাকরি করে সময় পায় না সারা হপ্তা, তাই মাঝেমধ্যে হপ্তা শেষে বেড়াতে বেড়োয় আর বসন্ত কাল এলেই সাঁওতাল দেশে। বিবিরা সব এসি গাড়িতে চড়ে আসে, পা টিপে টিপে একবার করে ওদের সাথে নাচ করবে আর ছবি তুলবে। পলাশের ফুল মাথায় দেওয়া ছবি গুলো নাকি এফবিতে পোস্ট করবে। সেটা নাকি খবরের কাগজের মতো সবাই যা খুশি করতে পারে তাতে, ওর মরদের কাছে শুনেছে। তবে হ্যাঁ বিক্রি বাট্টা খুব ভালো হয় এ কদিন। ওরা একটু আনন্দের মুখ দেখে। সারা বছর তো শুধু অভাব, না পায় একটু ভালো খেতে পরতে, না চিকিৎসা না ভালো পড়াশোনা করতে পারে ওদের ছেলেমেয়েরা।
এই পলাশ যখন নীল আকাশকে কমলা করে তোলে, আমের মুকুল আর নিম ফুলের গন্ধে চারদিক যখন ম'ম করে, পাতার ফাঁকে কোকিলের ডাক, লাল মাটি আরো রুক্ষ হয়ে ওঠে তখন সাঁওতাল গ্রাম যেন নতুন করে জাগে। দ্রিমি দ্রিমি মাদলের তালে পাহাড় যেন নতুন মাত্রা পায়।
দুমাসের আনন্দ, ভালো খাওয়া অনেক লোকের সাথে মেলামেশা এসব আনন্দ তো আর সারা বছর পাওয়া যায় না। তারপর আর এদিকে কেউ আসে না।
আরো দুটো গাড়ি বড় হোটেলের দিকে গেলো, টুসুমনি আরো একবার হাসলো। গুটি গুটি পায়ে মাথায় পলাশের ঝুড়ি নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলো।
সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ব্যক্তি
অলোক কুমার শতপথী
এ- '' মানুষ ধর্মীয় হতে হবে।আমি নিজেকে একটি উদাহরণ।আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন গঙ্গায় স্নান করি।এর পরে আমি দুই ঘন্টার জন্য ঈশ্বরের উপাসনা।আমি নিয়মিত সব ধর্মীয় উপবাসই করি।"
বি- 'আমাকে বলুন, এখন পর্যন্ত কতজনকে আপনি অন্য ধর্মের খুন করেছেন?'
এ- '' একক ব্যক্তি নয়।''
বি- 'তাহলে কিভাবে আপনি বলতে পারেন যে আপনি একজন ধর্মীয় ব্যক্তি?... আমি উদাহরণ।আমার দ্বারা প্রত্যেক ধর্মীয় দাঙ্গায় কমপক্ষে দশজন অন্যান্য ধর্মীয় লোক নিহত হয়েছিল।এখন আমাকে বলো কে বেশি ধর্মীয়?তুমি অথবা আমি?''
এ- 'ভাই আপনি এবং শুধুমাত্র আপনি বৃহত্তম ধর্মীয় ব্যক্তি।'
নববর্ষ
শৌভিক কার্য্যী
মা : যা রেডি হয়ে নে
ছেলে : আমরা কোথায় যাচ্ছি মা
মা : কেন, তুই জানিস না
ছেলে : না, আমি সত্যি কিছু জানি না
মা : সারাদিনটা মোবাইল নিয়ে থাকিস, আজ সকালে তোর বাবা বাইরে যাওয়ার আগে কি বলে গেল কিছু শুনিস নি বলছিস, কতো তারিখ আজ সেটা জানিস তো ?
ছেলে : কেন আজ কি আছে, আজ তো ১৫ই এপ্রিল
মা : ওরে পাগল আজ পয়লা বৈশাখ সেটাও মনে নেই তোর, কেউ বুঝি তোকে আজ ফোন করে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায় নি
ছেলে : কেন কে জানাবে আবার
মা : যার ফোনের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় ধরে বসে আছিস
ছেলে : মা কি হচ্ছে
আজ নববর্ষ তাহলে বাবা হঠাৎ অফিসে গেলেন কেনো
মা : অফিসে যায়নি তো, তোর বাবা সুরজ কাকুর বাড়িতে গেছে
ছেলে : কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায় ?
মা : তোমার বাবার বসের বাড়িতে আমরা আজ সেখানে ইনভাইটেট
ছেলে : কিন্তু মা ..
মা : এই যা দেখেছিস, তোর জন্য নতুন জামা কিনে এনেছি অথচ তোকে দিতেই ভুলে গেছি, দাড়া নিয়ে আসছি,
( ঘর থেকে জামা নিয়ে এসে )
দেখতো রঙটা পছন্দ হয় কিনা, সাইজটা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে
ছেলে : ভালো হয়েছে
মা : শুধু ভালো হয়েছে বলছিস, এক বারো ভালো করে তাকালিও না পর্যন্ত, জানিস কতো দোকান ঘুরে শেষমেষ এই হলুদ রঙটা পেয়েছি, একটা লাল রঙেরও ছিল ওটাও তোকে বেশ মানাত জানিস, পরে ভাবলাম . . . .
ছেলে : আচ্ছা থাক না এসব এখন, বললাম তো ভালো হয়েছে জামাটা, এখন আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না, আমি রুমে যাচ্ছি মা
মা : আচ্ছা বেশ যাও দু'ঘন্টা পর তোমার বাবা ফিরবেন রেডি হয়ে নিও
( ছেলেটি ঘরে এসে তার মোবাইল চেক করে দেখে কোনো কল আসেনি। দু'ঘন্টা পর বাবা বাড়িতে ফিরে আসে । মা রেডি হয়ে আয়নার সামনে সাজগোজ করছে, এমন সময় ছেলেটি তাদের ঘরের দরজার সামনে এসে দাড়ায় )
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫
কবিতা
বৈশাখের গন্ধটা নেই
সুব্রত নন্দী
বৈশাখ মাসে নববর্ষের আগমন,
উচ্ছ্বাস উন্মাদনায় আর মাতেনা মন,
অনেক প্রতীকী প্রতীক্ষার অবসান,
অস্তরাগে আবর্তিত নকল আয়োজন,
কাঠামোর মাটি পড়ছে খসে খসে,
বিবর্ণতার চালচিত্র উর্বর ভূমিতে!
নিজ কৃতিত্ব প্রাক্তন ইতিহাসকে ঘিরে,
দাঁড়িয়ে আছি এখনো সেই পুরাতনীতে!
নবান্ন ফসলের ভাতে সেই গন্ধটা উধাও,
নেই সেই বৈশাখী উৎসবের আমেজ,
বিশৃঙ্খলার আর অনাচারের যুগলবন্দী,
শিক্ষিত বেকার মৃত্যু পদযাত্রী অনশনে,
কখনো বা শুধুই রঙের বিচার রাজাসনে!
দিন আসে দিন যায় একটি একটি করে,
স্বপ্নের ক্যানভাসে রঙিন স্বপ্নই থেকে যায়।
প্রত্যাশিত সেই আগ্রহ খুঁজে পাইনা মননে,
নব বৈশাখের সুমিষ্ট গন্ধটা নেই জীবনে।
বর্ষা রাণী.. কলঙ্কিনী"
সুরভি জাহাঙ্গীর
বর্ষা আমার রূপের রাণী মনের ছবি
লালা গোলাপীপ্রেমের কলি !
শ্রাবণ মেঘের নূপুর পায়ে রিনি ঝিনি শব্দ করে
সাগর প্রাণে যায় যে ছুটে!
একূল অকূল দুকূল বেয়ে, প্রেমের খেলায় উছলে পড়ে!
মেঘের ডাকে ময়ূর নাচে---
ঢেউয়ের মালায় লুকিয়ে থাকে ভালোবাসার মুক্তো সেজে ঝিনুক মাঝে ছদ্ম বেশে!
বর্ষা আমার জলের ছবি... ছলের রাণী!
আকাশ মাঝে ষড়ঋতু ছন্দ এঁকে সাগর নদীর মিলন হবে! শুকনো নদী ধন্য হবে !
নদীর বুকে মাছের চোখে জেলে বধূর স্বপন ভাসে ----
মহাজনের দাদন করের সুদের টাকায় স্বপ্ন চাপা পড়ে মরে !
মাছের চোখেই জীবন বাঁচে!
মাছের চোখেই মরন ভাসে !!
ভাদর ডাকে মেঘের বনে
নদীর বুকে বান আসে---
নদীর বুকে নৌকা চলে ----
মোর বুকেতে স্বপ্ন হাসে!!
বনের মাঝে বৃষ্টি নামে সবুজ বনে হাসি ফোটে!
মাটির বুকে পলি জমে
কৃষক মনে আশা জাগে!
ধানের ঘ্রানে কৃষক বধূর স্বপ্ন সাজে...নোলক নাকে ঘোমটা টানে!
সবুজ বুকে কলি জাগে.. জুঁই, চামেলি, কদম ফোটে!!
বর্ষা আমার স্বপ্ন ভাসি.. সর্বগ্রাসী!
একূল ভাঙ্গে.. অকূল গড়ে নদীর বুকে
চর জাগে...
চরের বুকে বসত গড়ে
সেই চরেতে দখল চলে!
কেহ মরে কেহ বাঁচে!
এইতো নদীর খেলা!
স্বপ্ন ভাঙ্গে স্বপ্ন দেখে জীবন নদী বয়ে চলে
মরণ সদাই সাথে চলে!!
বর্ষা মেয়ে রূপের রাণী
হরেক রূপের হাসি!
সেই হাসিতে আমরা সবাই খেলছি কানামাছি!
বর্ষা আমার ধনীর ঘরের সুখের ছবি!
ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ.ভূনা খিচুরী!
দিন মজুরের অনাহারীর শূন্য থালার কষ্টে গাঁথা নক্সি কাঁথার কদম তলীর ছবি!
বর্ষা আমার "আসমানিদের ছোট্ট চালা রসূল পুরের বাড়ি একটু খানি হাওয়া দিলেই গড়িয়ে পড়ে পানি"!!
বর্ষা আমার ডুবে যাওয়া, স্বজন হারা স্বপ্ন সুখের তরী!
মাঝির কন্ঠে স্মৃতির সুরে জারি,সারি, ভাটিয়ালি!
বর্ষা আমার রূপের রাণী... কূল হারা তাই কলঙ্কিনী....!!
ক্যামিক্যাল নগরী
সব্যসাচী নজরুল
মুক্ত আলো-বাতাস, হিম-শীতল হাওয়া, ঘাসের ডগায় শিশিরের স্পর্শ বিহীন এ শহর আমার নয়...!
না না না, এ শহর আমার হতেই পারে না।
আমার শহর, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি একটি পরিছন্ন আবাসভূমি, বাসযোগ্য আলোকিত শহর চেয়েছিলাম।
যেখানে আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস হবে নিরাপদ।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম বেড়ে ওঠবে আলো-হাওয়ায়, ফুলেল শোভায়।
যেখানে জীবনের জয়গান উৎসারিত হবে প্রতিটি পদযাত্রায়, কোলাহলে, মিছিলে মিছিলে...
অগনিত শবদেহ ধারী, শবযাত্রা বাহী ,নিরব নিস্তব্ধ নিথর কাঁধ গুলো, অঢেল অশ্রুবহা মানুষেরা বুক চাপড়ে হাহাকার করবে না;
নেত্র নদীর অশ্রুধারা বুড়িগঙ্গার পথ ধরবে না?
কোথায় আমার আলোকিত শহর?
ক্যামিক্যালের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা হঠাৎ আলোর বিচ্ছুরিত এ শহর আমি চাই না, চাই না, চাই না....
অগ্নিকুন্ডে ভস্মীভূত অগনিত লাশের এ শহর আমার না!
ক্যামিক্যালের আশটে বিদঘুটে ঝাঝালো দুর্গন্ধ মাখা এ শহর বুঝি তোমার?
আচ্ছা, এ সীসা দুষণে, গাছপালার ছায়াহীন এ বদ্ধ পরিবেশে তুমি দম নাও কি করে?
তোমরা, হ্যাঁ হ্যাঁ তোমরা দম নাও কি করে?
মহাপ্রভুর অশেষ কৃপায় বেঁচে আছো বুঝি সীসা-দমের যুদ্ধে...
যেখানে দমের দাম নেই, যেখানে জীবনের দাম নেই, পদযাত্রার নিরাপত্তা নেই, হরদম বিদগ্ধ অনলে হৃদয় পোড়া জীবনের নিরাপত্তা নেই, শুধু ই নেই নেই..
যেখানে হরহামেশাই ক্যামিক্যালের অগ্নিকুন্ডে, ভীষণ ভয়ানক, ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ধ্বংস লীলায় নিশ্চিহ্ন সব। ধ্বংস হয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে জীবন, স্বপ্ন আশা, চাওয়া-পাওয়া সব, সব, সবকিছু...
কেবলই পরে থাকা মৃত্যু নগরী, এ যেন জনমানবশূন্য প্রাণহীন ক্যামিক্যাল নগরী!
আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারো, কেন কেন কেন, কেন এমন হয়?
কেন এতো জীবন, এতো প্রাণ, বড় বেশি অসময়ে জলন্ত উত্তপ্ত আগুনে ভস্মীভূত হয়ে ছাই হয়ে বাতাসে ভেসে উড়ে যায়।
বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও.. বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও...
বাকরুদ্ধ আওয়াজগুলো আগুনের লেলিহান শিখায় হারিয়ে যায়, হাওয়ায় মিলিয়ে যায় চিরতরে।
ক্যামিক্যাল নগরীর আকাশে-বাতাসে মিশে যাওয়া পানি প্রার্থী, অতৃপ্ত, তৃঞ্চাত্ব আত্মারা সব সীসার আড়ালে অজস্র অশ্রু ঝরিয়ে কি যেন বলতে চায়....!
তোমরা আমাকে বাঁচাতে পারলে না!
তোমরা আমাদেরকে বাঁচাতে পারলে না?
এ শহর মনুষ্য কুলের নয়, এ শহর আমার নয়।
এ শহর ক্যামিক্যালের!
এ নগরী আমার নয়, এ এক মৃত্যু নগরী।
এ এক ক্যামিক্যাল নগরী!
বোশেখ অগোচরে
জয়শ্রী রায় মৈত্র
ঘন শিমূলের রক্তস্রোতে
ভেসে আসা কণিকাগুলো
অসংখ্য শিরা উপশিরার
সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক নতুন তন্বী দেহ,
গরম ধোঁয়ার আক্রমনে
ঝলসে যাওয়া মন
অগোচরে চুপি চুপি কথা বলে
ভেঙ্গে দেয় শব্দ তরঙ্গ জাল,
উড়ে আসা ধূলিকণা রচনা করে চলে
অনন্তের জড়ি বুটির শুদ্ধতা
জনস্রোতের কলধ্বনিতে মিশে যায়
বোশেখের রক্তরূপ শিমূলের রক্তস্রোতে ।
দেশ
অদিতি মুখার্জি
আমার দেশ আজ নাকি শুধু যুদ্ধবাদীরাই বলতে পারে!
আমার দেশ আজ শুধু নাকি তারাই বলতে
পারে যারা শুধু
রক্তের আঁশটে গন্ধ চেনে।
আমার দেশ আমার দেশ ,
কোথায় ছিল এত কাল
কোন অন্ধকারে মুখ গুটিয়ে ,
ঠান্ডা গাড়ির কাঁচ একটুও ফাঁকা হয় নি আমার দেশের কচিঁ গলার ডাক শুনে ....
আমার দেশ শুধু সীমান্ত নয় ,
কোথাও একটা সুখের গৃহকোন ।
আমার দেশ তাদের ও যারা কাগুজে বিপ্লব বোঝে না ,
বারবার গলা ফাটায় না আমার দেশ আমার দেশ বলে ।
মা
রাজু দাস
দশমাস দশদিন
মায়ের গর্ভে ছিলাম
আজ প্রথম পৃথিবীটা দেখলাম,
প্রথম মাতৃশব্দে মা বলে ডাকলাম
মা ডাকে আয় খোকা
আয় আমার কোলে,
প্রথম দুধের স্বাদ মায়ের বুকে
বলবান হয়েছি মায়ের স্পর্শে,
মা আমি তোমাকে কত ভালোবাসি?
মা বলে মাতৃত্বের ভালোবাসা
হয় না কো দাঁড়িপাল্লাতে।।
চৈত্রের আলো
মিনহাজ উদ্দীন শরীফ
ফাগুন শেষে চৈত্র আসে
অগ্নিশিখা জ্বলে,
তীক্ষ্ণ ভাবে সূর্যের আলো
ছড়ায় আপন বলে।
মাঠে-ঘাটে চলতে গেলে
ভীষণ গরম লাগে,
পূব আকাশে সূর্য্যি মামা
বাঘের মতো জাগে।
হাট বাজারে যেতে হলে
হাতে লাগে ছাতা,
রেগেমেগে সূর্যের আলো
পুড়িয়ে দেয় মাথা।
কৃষক শ্রমিক ঘাম ঝড়িয়ে
লেগে থাকে মাঠে,
চৈত্রের খরায় ক্লান্তি লেগে
চলা যায় না হাটে।
চৈত্রের দহন
দিপংকর দাশ
ফাগুন মাসের আগুন শেষে
চৈত্র রাজা আসে,
শুকনো নদী জল হারিয়ে
খুব বেদনায় ভাসে।
খা-খা শুষ্ক মরুভূমি
পথিক তৃষ্ণায় মরে,
জলের অভাব নলকূপেও
রোগে ধরা ভরে।
ফসলের ক্ষেত লালচে লাগে
ক্ষেতে নেই আর পানি,
জলের অভাব করতে পূরণ
মহা টানাটানি।
চৈত্র মাসের পরেই আবার
বৈশাখের ফুল ফোটে
পাকা ধানের শাখায় শাখায়
কৃষক শ্রমিক ছুটে।
স্বাগত রুদ্র বৈশাখ
মাম্পি রায়
নতুন নীলিমা কলম চালিয়ে,
ক্লান্তমনে সাঁঝবেলাতে,
ইশান কোনে চোখ মেলে আজ,
আসছে দেখ রুদ্র বোশেখ;
প্রাণের পরে,প্রাণের মিলন,
ঘটবে নবীন আম্রশাখে।
গুটি আমের সুবাস ভাসে,
মোলের দোলায় দুলে;
ঋতু রাজের আগামবার্তা
দিচ্ছে কোয়েল বলে।
চৈতী পরব, গাজন,গমীরা,
বিসবা,সিলুয়া, আলকাপি..!
উত্তপ্ত বদ্বীপে সবুজের বুকে
রৌদ্রের কাঁপা-কাঁপি।
মাথার খোঁপায় লাল-সাদা ফুল,
ঝুলিয়ে নাকে নথ;
নাচব মোরা গাইব সবে,
ভাদুর মেঠোপথ,
পাতার বাঁশি হাতে নিয়ে
শহুরে পান্তা-ইলিশ পদে
সারতে পরব বটমেলাতে।
বাসন্তি রং লম্বা কোছা,
শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে
কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুনে
ফাগুর ছোঁয়া লাগে।
দহন সহন
মজনু মিয়া
রোদ্র প্রখরতা ঢোলের তেজ
দরদর করে ঝরছে ঘাম
বিদঘুটে সব ভাবনা মনে
চান্দি গরম হয়ে যায়।
পুজার মাতাল সময় চলছে
বিকিকিনি দোকানে দোকানে
বাহারী পশরা সাজিয়েছে দোকানী
চমচমা পকেট মনে ফুর্তি।
দহন চলছে ভেতরে সহন
কঠিনতর অবস্থা
বিরহ্ ক্রন্দন হৃদ কোঠুরীতে
হায়! পুড়া চৈত্র মাস!
রাঙাবেল চাঙমা (পিইউসি)
স্মৃতি
তুমি আমার
চোখের মণি,
তুমি আমার আলো
যখনি বিদায় নিলে
অশ্রু চলে এলো।
তোমায় আমি ভালোবেসেছি
প্রাণের চেয়ে কতো
শত দু:খ বিড়ম্বনায়
নি:স্ব হয়ে গেলো।
তোমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে
প্রাণের জ্বলমল সুগভীরে,
ও গো প্রিয়সী-
তুমি যেও না আমার বিহঙ্গের
খাচাঁ ভেঙে।
তুমি এসেছিলে একদিন
পোষ মানার বিহঙ্গের মতো
কেনো তুমি চলে যাচ্ছো..?
অজানা পথ পাড়ি দিয়ে !
তুমি এসেছিলে পরীর মতো
দানা মেলে আমারি পাশে
কেনো তুমি চলে যাচ্ছো..?
সোনার বিহঙ্গের খাঁচা
আগুনের মাঝে দ্বীপ শিখা ছুড়ে মেরে।
ও গো প্রিয়সী আমাকে
ছেড়ে যেও না চলে কোনোখানে।
তুমি যেখানে যাওনা কেন..?
মনের দর্পণ থেকে মুছতে
পারবেনা কোনো জনে।
তোমারি পরশ আমি
কোনোদিন পারিবনা ভুলিতে,
স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে রহিবে
জীবনের চলার পথে।
ও গো প্রিয়সী তুমি
আমায় যখনি জানিবে
গুছিবে মনের সংশয় তোমার,
স্মরিবে তুমি আমায়
প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে।
আমি বসন্তের দূতী
অঞ্জলি দেনন্দী
প্রকৃতির ডাকে
বসন্ত উপস্থিত।
কুসুম - কলি কুসুমিত
শাখে শাখে শাখে।
অলি ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে
ওদের গান শোনাতে থাকে
গুনগুনিয়ে।
অলি, কুসুমের মিত।
বসন্তের আগমনে
কোকিল বড়ই প্রীত!
কুহু কুহু কুহু স্বরে
যায় তাই গান শুনিয়ে।
পবন কেলী করে
কল্লোল পরে।
ঋতুরাজের বরে
প্রেম গড়ে
ঘরে ঘরে
মিলনের সুখ-স্বর্গ।
নিবেদিত হয়
হৃদয়ে হৃদয়ে ভালোবাসার অর্ঘ্য।
মন কয়,
জয় বসন্তের জয়!
অতঃপর তুমি
চৌধুরী সাখাওয়াত হোসেন রনী
কথাছিল আগামীর ফাল্গুনে
তুমি আমাতেই মিশে যাবে
আমৃত্যু অমর হবে ভালবাসা,
তারপর কতবার ফিরিয়ে দিয়েছি
বৃষ্টিস্নানের নিমত্রন
মহুয়ার ঘৃানে মাতাল হওয়া
স্বার্থক প্রেমিক হওয়ার শত আয়োজন,
ফিরে গেছে তাহারা শূন্য হাতে
অপবাদ আর অভিশাপে
রেখে দীর্ঘশ্বাস,
অতঃপর তুমিও ফিরে আসোনি
স্বাগত রুদ্র বৈশাখ
মাথুর দাস
চড়ক-পূজা গাজন শেষে
উড়িয়ে দিয়ে এক নিমেষে
জীর্ণ মনের কালি,
আম কাঁঠালে ধরিয়ে পাক
জাম জারুলের ভর্তি শাখ
হাওয়ার করতালি --
ভাবছ নাকি ক্ষুদ্র সে যে
আসতে পারে রুদ্র তেজে,
শুনছ না কি ঐ ডাক ?
উড়ছে পাতা ঝরছে ঘাম
করছে যা-তা সুখ আরাম,
ঐ আসে কাল-বৈশাখ !
মন্দ-ভালোর বার্তা নিয়ে
সর্ব সুযোগ কার তা নিয়ে
অহেতুকী চর্চা থাক,
বৈশাখের এই আগমটিকে
বরণ করি দিকে দিকে
মঙ্গলেরই বাজুক শাঁখ ।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫
গল্প
সিঙ্গেল পেরেন্ট
শ্যামল কুমার রায়
প্রথম অধ্যায়
আজ বছর ছয়েক হল যশোর রোডের লাগোয়া ' চিন্তামণি ধাম ' অ্যাপার্টমেন্টে প্রদ্যুম্ন ও শাশ্বতী থাকে । প্রদ্যুম্ন পেশায় ঠিকাদার । গ্রামে যেমন সোনার ধান চাষ হয় , ঠিক তেমনই বৃহত্তর কোলকাতাতে ফ্ল্যাট এর চাষ হয়। পেশাগত কারণেই , প্রদ্যুম্ন কোলকাতার সব বড় সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে । সরকারি দপ্তরের বিশেষ বিশেষ আধিকারিক তো প্রদ্যুম্ন যশ বলতে অজ্ঞান । আসলে প্রদ্যুম্ন যে কোনো আধিকারিক এর সঙ্গে সম্পর্কটা অফিসের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যায়। তার অর্থ এই নয় যে প্রদ্যুম্ন স্ত্রী, শাশ্বতীকে 'হানি ট্রাপ ' হিসেবে ব্যবহার করে টেন্ডার হস্তগত করে । প্রদ্যুম্ন আসলে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ায় । আর কাটমানি? ওটা তো সিন্ডিকেটের বৈঠকে ঠিক হয়ে যায় । সিন্ডিকেটের গোলকধাঁধা বোঝা সাধারণের কম্ম নয়।
শাশ্বতীর কিছু সমস্যা থাকায় , সন্তান ধারণে সমস্যা হচ্ছিল । কিন্তু, প্রদ্যুম্নর মায়ের আর তর সই ছিল না । বাঁজা মেয়েমানুষ! বংশ রক্ষা করতে পারবে না । প্রথম দিকে শাশ্বতী শাশুড়ির এই অযাচিত আক্রমণে খানিকটা গুটিয়ে থাকত ; আর মনে মনে নিজেকে খুব অপরাধী ভাবত। কিন্তু, প্রদ্যুম্ন তো কোনও কটু কথা বলেনি ।
বরঞ্চ, পূর্ত দফতরের আধিকারিক মাননীয়া রাজন্যা রাজবংশী একদিন প্রদ্যুম্ন কে জিজ্ঞেস করলেন, " ভাই , প্রদ্যুম্ন! আমার ভাইপো না ভাইঝি? পাছে দিদি বাড়ি যায় , তাই একদিনও তো মুখ ফুটে বললেও না।" প্রদ্যুম্ন মুখ নীচু করে বলল - " ইস্যু নেই , ম্যাডাম । " হোয়াই ? অ্যাপ্রক্সিমেটলি , ইউ ম্যারেড ইন্ ১৯৯৮ । ইয়েস, ম্যাম । ইজ্ দিজ্ অ্যা পয়েন্ট অব্ ডিসপিউট্ বিটূইন ইউ এন্ড ইয়োর ওয়াইফ? আসলে, মা অধৈর্য হয়ে পড়েছে । ' জেনারেশন্ গ্যাপ, প্রদ্যুম্ন! জেনারেশন গ্যাপ! ' বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ভাই । কলকাতার বাইপাসের যে কোনো সুপার স্পেশিয়্যালিটি হাসপাতালে ফার্টিলিটি সেন্টারে দেখাও ; ভালো কাজই হবে , আশা করি ।
রাজন্যা ম্যাডামের কথা মত এক সুপার স্পেশিয়্যালিটি হাসপাতালে সমস্ত রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল যে শাশ্বতী বেবি ক্যারি করতে পারবে না । সি নিডস্ এ স্যারোগেট মাদার। এ যেন ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারীর শত পুত্রের জন্ম দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল গরু খোঁজা করে খোঁজা । স্যারোগেট মাদার পাওয়া গেলেও কোনো না কোনো কারণে শেষমেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছিল।
রাতে ফ্ল্যাটের তারকাখচিত সিলিং এর দিকে চেয়ে চেয়ে আকাশ কুসুম ভাবতে লাগল প্রদ্যুম্ন । হঠাৎই কোথা থেকে রোহিণীর মুখ ভেসে উঠল। রোহিণী আচার্য । প্রদ্যুম্নর ফার্স্ট ফ্যান্টাসি । কিন্তু, প্রদ্যুম্ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই রোহিণী পাত্রস্থ হয়েছিল । কিন্তু, ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! রোহিণীর স্বামী পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টটেটিভ্ । সেদিন ছিল শনিবার । হিরণ্ মার্কেট এ বের হয়েছিল বাইকে চড়ে । কিন্তু, এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওদের দাম্পত্যের সব সুখ । অপশন দুটো - হয় মৃত্যু অথবা স্থায়ী পঙ্গুত্ব । শুধু চোখের দেখা দেখতে পাবে - এটুকুই!
কিন্তু, নিয়তি? আগে থাকতেই সব গেম সেট করে রাখে । প্রাইভেট কোম্পানির জব। রোহিণী সে অর্থে সাহায্য পেল না কিছুই। তবে কোম্পানি থেকেই এক প্রাইভেট হসপিটালে স্বল্প বেতনের ট্রেনি হিসেবে একটা জব এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রোহিণী শুধুমাত্র ঔরসজাত সন্ততি, চিত্রাঙ্গদার মুখ চেয়ে জব্ অ্যাকসেপ্ট করল। কারণ , ও বাপের বাড়িতে ভাই ভাজের সংসারে বোঝা হতে চায়নি । মনের দুঃখ বুকের ভেতর চেপে রেখে হাড়ভাঙ্গা খাটনি হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল রোহিণী। রোহিণী একা মহিলা; খুব সাবধানে থাকে। পাছে কেউ যদি কিছু বলে! সব সময়ই একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করে । বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছিল রোহিণী তার এই অকাল বৈধব্যের জীবনে।
কিন্তু, ডে কেয়ার ইউনিটের সামনে টয়োটা ফরটুনার্ গাড়ি থেকে সস্ত্রীক কে নামল ? কৈশোরের ফার্স্ট লাভ্, প্রদ্যুম্ন নয় তো?ঘোর কাটল, প্রদ্যুম্নর ডাকে। রোহিণী! এখানে? 'কাজ করি', গলা নামিয়ে বলল রোহিণী । মিট মাই ওয়াইফ, শাশ্বতী। শাশ্বতী! মাই ব্যাচমেট , রোহিণী। সৌজন্যের পর্ব উত্তরণ ঘটাল সখ্যতায় । গতিমান, জনবহুল শহরের গগনচুম্বী ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নিঃসঙ্গ শাশ্বতী সমমনোভাবাপন্ন রোহিণীর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠল। চিত্রাঙ্গদা খুঁজে পেল এক সত্যিকারের মাসীকে। আর শশব্যস্ত ঠিকাদার প্রদ্যুম্নর মধ্যে ' কামরূপ দুর্বারিত অনল' এর কারকতা ছিল না। শাশ্বতী কে নিয়ে দিব্যি খুশি ছিল।
চিত্রাঙ্গদার তিন বছরের জন্মদিন শাশ্বতীর ফ্ল্যাটে ঘরোয়া ভাবে পালন হল। মাসীমণিকে ছেড়ে অবুঝ চিত্রাঙ্গদা মায়ের সাথে বাড়ি ফিরে যাবে না । অথচ , জীবনে ঘা খাওয়া রোহিণী বোঝে সব।
দ্বিতীয় অধ্যায়
শেষমেশ, সন্তানহীনা শাশ্বতীর কাতর অনুরোধের কাছে হার মানতে বাধ্য হল রোহিণী। সেদিন, এক ঘরে চিত্রাঙ্গদাকে মাঝে রেখে শাশ্বতী আর রোহিণী শুলো। চিত্রাঙ্গদার কথা মাথায় রেখে খুব হালকা করে এসি চালিয়ে দিল শাশ্বতী।
ধীরে ধীরে একে অপরের জীবন পাতার প্রতি পাতা উল্টালো। রোহিণীর হিরণহারা হওয়া ও বাপের বাড়ির কাছে সম্পূর্ণ অপাক্তেয় হওয়ার কথা যেমন এল; গর্ভধারণের অক্ষমতা, শাশুড়ির বাক্যবাণ, আজ শাশ্বতীকে এই জনারণ্যে একলা করে দিয়েছে। খুব সরল, সাবলীলভাবে একে অপরের আন্তরিক সই হয়ে উঠল। এখানে প্রদ্যুম্নর মতামতের খুব প্রয়োজন অনুভূত হল না।
পরের বছর রাজারহাটে একটা টাউনশিপ প্রকল্পে যুক্ত হল প্রদ্যুম্ন। ঐ পশ্ এলাকাতে প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে নিজের জন্য একটা বিশাল বাংলো কিনল। যশোর রোডের ফ্ল্যাটে যদিও চেনাশোনা ছিল, এখানে তো লালবাতির দাপাদাপি, অডি, বি এম ডব্লিউ র যাওয়া আসা। তবে রোহিণীর খুব কাছে হয়ে গেল শাশ্বতীর নতুন ঠিকানা। চিত্রাঙ্গদার মাসীর কাছে থাকতে পেয়ে বেশ ভালো থাকত। আর রোহিণী সে তো পরম নিশ্চিন্ত। যে কর্পোরেট হাসপাতালে শাশ্বতীর চিকিৎসা চলত, সেই হাসপাতালে একই ডক্টর এর সেক্রেটারি হিসেবে প্রমোশন পেয়েছিল শাশ্বতী। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ডক্টর যোগমায়া ম্যাম জানালেন যে একটা সময় পর বেবি কে অন্য গর্ভে স্থানান্তরিত করতে হবে; পুরো দু'শ আশি দিন শাশ্বতীর গর্ভে সন্তান প্রতিপালন করা যাবে না। উপায়? বড় অসহায় লাগছিল প্রদ্যুম্ন আর শাশ্বতীকে। শাশ্বতীর অসহায় , করুণ চোখের অব্যক্ত ভাষা রোহিণী হৃদয়ঙ্গম করে শুধু ডাক্তার যোগমায়া ম্যাম কে বলল, আমি কি এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারি?
"After some medical test, I can confirm that" , ডাক্তার যোগমায়া যাদব ঐ হাসপাতালের কর্মী তথা তাঁর বর্তমান সেক্রেটারি রোহিণী আচার্যকে জানালেন। রোজ একই ধরনের চিকিৎসা, ঘটনা পরম্পরা দেখেও রোহিণী কেমন যেন নার্ভাস হয়ে গেছিল ; এ যেন তার নিজের বোনের চিকিৎসা চলছে। পরের দিন ফের অ্যাপয়নমেন্ট নিল ওরা। অনেক টেস্টের পর ডক্টর যোগমায়া যাদব তাঁর সেক্রেটারি, রোহিণী ও পেশেন্ট শাশ্বতী এবং তাঁর বর প্রদ্যুম্ন কে জানালেন যে সারোগেট মাদার হিসেবে রোহিণী আচার্য কে ব্যবহার করা সম্ভব এবং শাশ্বতী ও প্রদ্যুম্নর ভালোবাসার চিহ্নকে রোহিণীর গর্ভস্থ করা যাবে।
সেদিন চিত্রাঙ্গদা ওর মাসীর বাড়িতে অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। ফিরে এসে শাশ্বতী রোহিণী কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জীবন যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত রোহিণী শাশ্বতীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ' তুমি না চিত্রাঙ্গদার মাসী; কাজেই তোমাদের সন্তান, আমার বনপো কে আমি আমার জঠরে বাস করতে দেব।' তুমি সত্যি বলছ, রোহিণী! আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না, কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল শাশ্বতী।
সত্যি,সত্যি,সত্যি। হল , বিশ্বস? আমি এখনই ওকে ফোন করে বলছি। বেশ! প্রশস্ত হাসি হেসে বলল রোহিণী। ওদিকে ফোনে প্রদ্যুম্ন বলে বসল, রোহিণীকে বলো, ড যোগমায়া ম্যাম এর সাথে কালকে আর্লি মর্নিং এ যেন অ্যাপয়ন্টমেন্ট ফিক্স করে দেয়। ওকে! জানু। রোহিণী কাল যখন ড এর কাছে যাব , তখন চিত্রাঙ্গদাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব, আর কাল তো তোর অফ্ ডে, সো নো প্রবলেম ।
শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে শাশ্বতী মা সন্তোষীর ব্রত পালন করে, চিত্রাঙ্গদা কে কোলে নিয়ে সামনের সিটে বসল । কারণ, সোনা মেয়ে গাড়ির ভেতর থেকে চলমান ঘর , বাড়ি, মানুষ সব দেখতে দেখতে যাবে। সেদিন, প্রদ্যুম্নই ড্রাইভ করে নিয়ে গেল। আর রোহিণী গাড়ির মাঝের সিটে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল। ড. যোগমায়া যাদব যথেষ্ট বয়স্ক এবং দূরদৃষ্টি সম্পূর্ণ। কাজেই , রোহিণী যে সারোগেট মাদার হিসেবে থাকবে, তা যথাসম্ভব গোপন করে রাখার জন্য ডে কেয়ার ইউনিটের ছ'তলায়, যেখানে ভি আই পি দের ট্রিটমেন্ট হয় , সেখানেই দেখার ব্যবস্থা করলেন। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রদ্যুম্ন,শাশ্বতীর নিষিক্ত ভ্রূণ রোহিণীর গর্ভস্থ হল। মা সন্তোষীর ভক্ত শাশ্বতীর সন্তান , রোহিণীর গর্ভ থেকে প্রসূত হল সোমবার। রোহিণীর একটা আবদার ছিল শাশ্বতীর কাছে ; ওদের সন্তানের নাম রোহিণী রাখবে। হসপিটালের সুইট্ এ শুয়ে হিরণ কে খুব মিস্ করছিল রোহিণী। প্রদ্যুম্ন আর শাশ্বতীর সামনেই রোহিণী বলে উঠল , "ওর নাম স্যমন্তক রাখলে কেমন হয়? "
এখন রাজারহাটের ঐ পশ্ এলাকার বাংলোতেই থাকে শাশ্বতী, রোহিণী, চিত্রাঙ্গদা , স্যমন্তক ও প্রদ্যুম্ন। ধীরে ধীরে দুই ভাই বোন এক সাথে বড় হতে লাগল । চিত্রাঙ্গদা যেহেতু স্যমন্তক এর থেকে বছর তিনেকর বড় , তাই ঠিক সময়েই প্রদ্যুম্ন ওকে এক নামী বেসরকারি প্লে স্কুলে ভর্তি করে দিল। দিন দিন প্রদ্যুম্নর ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। ওর নতুন কনস্ট্রাকশান কোম্পানির নাম হল ' চিত্রাঙ্গদা - স্যমন্তক এন্টারপ্রাইজ '।
তৃতীয় অধ্যায়
কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড এ এক নতুন তারকা ' চিত্রাঙ্গদা - স্যমন্তক এন্টারপ্রাইজ ' । কিন্তু, সব সুখ,বোধ হয় ভগবান , একসাথে মানুষকে দেন না । উন্নতির সাথে সাথে শত্রু সংখ্যা বেড়ে গেল। একদিন রাতে সিন্ডিকেটের এক গোপন বৈঠক শেষ করে রাত এগারোটার সময় পরমা আইল্যান্ড এর কাছে এসে দাঁড়াল। হঠাৎই , কয়েকজন দুষ্কৃতী প্রদ্যুম্নকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছয়টা গুলি মারল।
আবার সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল । প্রদ্যুম্ন যখন মারা গেলো, তখন চিত্রাঙ্গদা সিক্স এ পড়ে ; আর স্যমন্তক থ্রি তে পড়ে। জীবন যুদ্ধে আহত বাঘিনী, রোহিণী এবার হাল ধরল ' চিত্রাঙ্গদা - স্যমন্তক এন্টারপ্রাইজ ' এর । প্রখর বাস্তব বোধ সম্পন্ন রোহিণী ব্যবসা সামলে আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর থেকে জেনে নিল , কে বা কারা প্রদ্যুম্ন কে খুন করেছিল । প্রদ্যুম্নর চরম শত্রু, এক সময়ের তোলাবাজ আজকের নামী ঠিকাদার ল্যাংড়া বিশু। সুতরাং , আর দেরি নয় ; এবার এনকাউন্টার । শাশ্বতীকে কিছু না জানিয়েই, এক সময়ে ওর ফার্স্ট ফ্যান্টাসি , প্রদ্যুম্নর মৃত্যুর বদলা নিতে এক কোটি টাকায় সুপারি দিল , রোহিণী । ঘটনার দিন, নিজে উপস্থিত থাকল , ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স এর এক সম্মেলনে । প্রশাসন ওটাকে একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে ধামাচাপা দিয়ে দিল।
দেখতে দেখতে চিত্রাঙ্গদা এম আই টি থেকে এম টেক করে দেশে ফিরল। খুব ধুমধাম করে এক বিজনেস ম্যাগনেট এর ছেলের সাথে চিত্রাঙ্গদার লাভ কাম অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ সম্পূর্ণ হল। দিদির বিয়ের তিন বছর পর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করে দেশে ফিরে স্যমন্তক ' চিত্রাঙ্গদা - স্যমন্তক এন্টারপ্রাইজ ' এর ভার নিজের কাঁধে তুলে নিল। ওকে ভীষণ ভাবে গাইড করল ওর মাসী রোহিণী ।
স্যমন্তক এর কোনো অ্যাফেয়ার ছিল না । তাই পাত্রী জোগাড় করতে মাঠে নামল শাশ্বতী আর রোহিণী । ওদের বৈভব দেখে অনেক উঠতি মডেল, বি গ্রেডেড্ অ্যাকট্রেস , বিত্তবান বাড়ি থেকে যোগাযোগ করা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু, শাশ্বতী , রোহিণী খুব ভালো করে জানত যে ওদের একটা ঘরোয়া, সংস্কৃতি মনস্ক , উচ্চ শিক্ষিত বউমা দরকার । যে এক কথায় ভালো মেয়ে ' মানুষ ' । শেষমেশ, বোটানি তে এম এস সি রাধিকা রায়চৌধুরী, বয়স তেইশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট, দুধে আলতা গায়ের রঙ, সৌখিন, গান বাজনা জানা এবং সোজাসাপ্টা ভাবে বললে কোনো অ্যাফেয়ার্ না থাকা সহজপুর গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে পাত্রী নির্বাচিত হল। জ্যোতিষী শ্রী অংশুমান শাস্ত্রী যোটক বিচার করে জানালেন যে যোটক বিচারে পয়েন্ট পঁচিশ; সুতরাং যথেষ্ট মিলমিশ হবে।
বাড়ির ছেলের বিয়ে, তার উপর আবার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা; সেইজন্য একদিকে যেমন রাজনীতি জগতের কেষ্টবিষ্টু , তেমনি কর্পোরেট জগতের, সিন্ডিকেটের, পূর্ত দফতরের, জেলা পরিষদের, পঞ্চায়েত সমিতির বিভিন্ন পদাধিকারী তার সঙ্গে নিজেদের কোম্পানির কর্মীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন হায়াত রিজেন্সির ব্যাঙ্কোয়েট হলে। আত্মীয় স্বজন, কন্যে পক্ষ এসব সামালে নিল শাশ্বতী । আর বাইরের সমস্ত লোকজন আপ্যায়ন করল একা হাতে রোহিণী ।
বেশ কয়েক বছর বেশ শান্তিতেই কাটল ওদের । চিত্রাঙ্গদার ছেলের আট বছর বয়স হল ; আর স্যমন্তক এর মেয়ের পাঁচ বছর বয়স হল। এখন রোহিণী অনেকটা ঝাড়া- হাত- পা ; আর শাশ্বতীর ও সংসারের জোয়াল টেনে টেনে এবার ছুটি চায়। কিন্তু, ওরা কেউই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে রাজি নয় ; আর এটাও বলতে রাজি নয় যে চিত্রাঙ্গদা বা স্যমন্তক এর পরিবার ওদেরকে অবহেলা করে।
এই জীবন সায়াহ্নে ভগবৎ ধামে যাওয়ার কথা ভেবে হরিদ্বারে ক্ষীরোদ আশ্রমে মাতাজী ব্রহ্মময়ী দেবীর আশ্রমে জীবনের শেষ দিনগুলো ভাগবৎ চর্চা করে কাটানোর জন্য চলে গেলেন দুই সিঙ্গেল পেরেন্ট। পিছনে ফেলে গেলেন এক বর্ণময় অতীত আর এক বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য ।
ভোম্বলের বিয়ে
চিরকুমার
এক
ওরা তিন বন্ধু ছোটো থেকেই কোচবিহারে একসাথে পড়াশোনা করেছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর কাজল ওরফে কাল্টু যোগ দিল বাবার ব্যাবসায়। আর নীলাঞ্জন মানে নিলু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেয়ে গেল।এদিকে বিশ্বরূপ মানে ভোম্বল পেল সরকারি চাকরি। আর ওর পোস্টিং হল সেই কোচবিহারেই।বিভিন্ন জায়গায় কাজ করলেও তিনজনের বন্ধুত্ব প্রায় একই রকম রয়ে গেছে।
ভোম্বলের বাড়িটা পুরো দোতালা নয়। নিচতলায় ওর বাবা মা থাকেন। আর দোতালায় একটা ঘর ভোম্বলের জন্যে। আর সেখানেই ওদের আড্ডার জায়গা। ঘরে ঢুকে ওরা দেখতে পেল বিছানায় ভোম্বল বাবাজির ডায়েরি পেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ঘরে গিয়ে বসতে না বসতেই মনাদা ওদের জন্যে ঠাণ্ডা সরবত নিয়ে এলো। সরবত খেতে খেতে ওদের আড্ডা চলতে থাকলো।
নিলু জিজ্ঞাসা করলো, - কি রে আজ সকাল সকাল আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিস কেন?
ভোম্বল বলল, - বাবা তোদের সাথে কথা বলবেন বলেছেন।
ভোম্বলের বাবাকে ওরা একটু ভয়ই পায়। তিনি একসময় কড়া ধাঁচের মাস্টারমশাই ছিলেন। আর ছোটবেলায় ওদেরকে অংকও দেখাতেন।
তাই ভয়ে ভয়ে কাল্টু বলে উঠলো, - কেন রে?কি হয়েছে?
ভোম্বল হেসে বলল, - সেটা তোরা বাবার কাছেই শুনিস।
এরই মাঝে আবার ট্রেতে খাবারের প্লেট নিয়ে মনাদা এসে হাজির। চোখের সামনে প্লেটে গরম গরম ফুলকো লুচি, কষা মাংস ও লবঙ্গলতিকা দেখে কাল্টুর চোখটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো।
আর মনাদার পিছু পিছু ঘরে এসে ঢুকল ভোম্বলের বাবা ও মা। ওদের হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিতে দিতে কাকিমা বললেন,- নাও বাবা, খেতে খেতে তোমরা কথাবলো।
কাল্টুপ্লেট থেকেসটান লুচি মাংস মুখে পুরে বলে ওঠে, - স্বর্গীয়!
নিলু মাথা নেড়ে তাতে নীরব সম্মতি জানায়।
এরকম এক মোক্ষম মুহূর্তে ভোম্বলের বাবা বলে ওঠলেন, - তোরা শোন, ভোম্বলের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
কথাটা শুনেইকাল্টু প্রচণ্ড বিষম খেলো। নিলু প্রায় চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিল। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে আমতা আমতা করে বলল, - খুব ভালো খবর,কাকু। কার সাথে?
কাকু বলে চললেন, - ভেবেছিলাম অপদার্থটার এখন বিয়ে দেবনা। কিন্তুরিনিমা আর ওর বাবা দেবলবাবু এমন করে ধরলেন যে আর না করতে পারলাম না।
রিনিকে ওরা আগে থেকেই চিনতো। রিনি ওদের সাথে জীবন স্যারের কাছে এগারো বারো ক্লাসে কেমিস্ট্রি পড়ত। তাই ভোম্বল যখন রিনির সাথে প্রেম শুরু করলো তখন আর ওদের অজানা থাকল না।কতবার ওদের জন্যে ভোম্বলের বাড়িতে যে নিলুদের গুলগাপ্পা দিতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
নিলু বলল,-বিয়ের তারিখ কবে ঠিক করলেন?
কাকু জানালেন, - বৈশাখের শুরুতেই ঠিক করেছি।
কাল্টু বলে উঠলো,- এই গরমে! তা আমাদের কি করতে হবে, কাকু?
কাকু বললেন - এই তোদের ভরসাতেই আছি।নাহলে এই অকর্মার ঢেকির পক্ষে কি বিয়ের মতো গুরুদায়িত্ব সামলানো সম্ভব? ভোম্বলের কাছে সব শুনে নে।
দুই
এরপর ভোম্বল একগাল হেসেবললো -দাঁড়া , সব বলছি তোদের।বৌভাতের হল বুকিং হয়ে গেছে। ডেকোরেটরের কাজ ওরাই করবে।
কাল্টু বলে উঠলো, - তা হলে তো ভালোই। আর গাড়ি?
ভোম্বল জানালো, - গাড়ির ব্যাপারে ঘোষপাড়ার বাপ্পাদাকেবলেছি।
নিলু জানতে চাইলো, - আর ক্যাটারার?
ভোম্বলের সোজা জবাব, - ভাবছি ক্যাটারিংটা নিজেরাই করবো।
একথা শুনেই দুই বন্ধু আঁতকেউঠল!নিলু বলল, - মানে?
ভোম্বল বলল,- কোনো প্রবলেমনেই। চাকরির যা দিনকাল, যে কোনদিন উল্টোপাল্টা জায়গায় ট্র্যান্সফার করে দিতে পারে। তখন কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে।
নিলু আমতা আমতা করে বলল, - কিন্তু ক্যাটারিং-এর তো কিছুই জানিনা আমরা।
ভোম্বল জবাব দিল, - কোনো চিন্তা নেই। কেষ্টদা সামলে নেবে।
কাল্টু অবাক হয়ে বলল, - কেষ্টদা আবার কে?
ভোম্বল বলল, - ঠিক সময়ে জানতে পারবি।
ওরা যখন কথাবার্তা বলছে তখন বাড়ির বেলটা আবার বেজে উঠলো। আর মনাদার সাথে ঘরে এসে ঢুকলো রোগা প্যাঁকাটি মার্কা চেহারার একটা লোক। ভোম্বলের থেকে জানা গেল ইনি সেই কেষ্টদা।
চা খেতে খেতে কেষ্টদা জানালো, - আমাকে যখন একবার বলেছ তখন তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। রান্নার ঠাকুর থেকে আরম্ভ করে জোগানদার, সার্ভ করার লোক সব আমি জোগাড় করে নেব।ক্যাটারিং ইন্ডাস্ট্রিতে সুদীর্ঘ পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা আমার।
চেহারা দেখে অস্বস্তি হলেও কথা শুনে ওরা একটুভরসা পেল।
নিলু জানতে চাইলো, - আমাদের ঠিক কি কি করতে হবে, কেষ্টদা?
কেষ্টদা জানালো, - তোমাদের আমি সবকিছুর লিস্ট ধরিয়ে দেব। তোমরা শুধু লিস্ট মিলিয়ে আমাকে সব এনে দেবে।।
কাল্টু আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো,- আর মাছ মাংস?
কেষ্টদা বলল, - সেটাও তোমরা আনবে।
নিলু মনে মনে বলল, - তাহলে বাকি আর কি থাকলো?
কেষ্টদা একগাল হেসে বললো, - বিয়েবাড়ির ক্যাটারিং কি আর চাট্টিখানি কথা! তোমরা খালি সময়মত জিনিসগুলো এনে দেবে। তাহলেই সব হয়ে যাবে।
ভোম্বলবললো,- আমরা তাহলে বিয়ের দিন দুয়েক আগে মুদিখানা ও সব্জি বাজার করে রাখবো। মাছটা কে আনতে পারবি?
কাল্টুবললো, - গুড়িয়াহাটি রেলগেট বাজারের কার্তিকদাকে চিনি। ওকে বললেই কাতলা/আড়/চিংড়ি/চিতল যেরকম দরকার সেরকম মাছ এনে রাখবে। খালি বউভাতের দিন সকাল সকাল আমরা গিয়ে ওজন করে কাটিয়ে আনলেই হল।
ভোম্বল বললো,- তাহলে তো হয়েই গেল। খাসীর মাংসটা না হয় আমি মিন্টুমামার সাথে গিয়ে নুতুন বাজারের আসগর আলির দোকান থেকে নিয়ে আসবো।
কেষ্টদা অ্যাডভান্স নিয়ে চলে গেল।নিলুরাও প্লানিং শেষ করে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরল।
তিন
দেখতে দেখতে ভোম্বলের বিয়ের দিন চলে এলো। বিয়ের দিন দুয়েক আগে কাল্টুকে নিয়ে নিলু বৌভাতের যাবতীয় মুদিখানা বাজার করে এসেছিল।তাই সকাল থেকেই একটু নিশ্চিন্তে ছিল।
হাতে সেরকম কাজ না থাকায় সকাল সকাল নিলু স্কুলে চলে এসেছিল। সবেপ্র থম ক্লাসটা শুরু হয়েছে ওমনি মোবাইলটা ভাইব্রেট উঠলো।মোবাইলস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সেইভোম্বল। কোনোমতে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে সে ফোনটা ধরল।
ভোম্বল প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, - এই নিলু, বিয়েটা প্রায় কেঁচে যেতেবসেছে|
নিলু অবাক হয়ে জানতে চাইল - কেন? কিহয়েছে?
ভোম্বল জবাব দিল, - বেলা বারোটার মধ্যে রিনিদের বাড়িতে গায়ে দেওয়ার হলুদ নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু গাড়ি আসেনি|
নিলু বলল, - সেকিরে? বাপ্পাদাকে বলিসনি?
ভোম্বলজানালো - আরে গায়ে হলুদের সময়টা বলতে ভুলে গেছি।এখন বাপ্পাদা বলছে গাড়ি নেই।
নিলু বলল - এখন উপায়?
ভোম্বল জানালো- ওদিকে রিনি ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে আছে।ওর বিউটি পারলার যাওয়ার দেরি হয়ে যাবে।ভাই তুই যদি একটু আসতে পারিস তাহলে খুব ভালো হয়!
অগত্যা নিলু আর কি করে । হেডস্যারকে বলে কোনোমতে স্কুল থেকে বাইকে বের হয়ে যখন হাজরাপাড়ায় পৌঁছয় তখন প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা।
হন্তদন্ত হয়ে ভোম্বলের বাড়িতে ঢুকে নিলু দেখতে পেলকাকু, কাকিমা, রত্নাদি সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
সবাইকে একসঙ্গে বাইরে দেখে নিলু জানতে চাইল, - ভোম্বল কোথায়? আমাকে গায়ে হলুদের বাটি নিয়ে যেতে বলল।
কাকিমা বললেন, - আর বোলো না বাবা। বিয়ের দিন ছেলেটা কিনা বাইক চালিয়ে দক্ষিণ খাগড়াবাড়িতে মেয়ের বাড়িতে হলুদের বাটি নিয়ে গেল!বাপের জন্মে কোনো দিন দেখিনি এসব!
ভোম্বলের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় নিলুর একটা কথাই মনে হল - ভোম্বল সব পারে!
সন্ধ্যাবেলায় বরযাত্রী যাওয়ার জন্যে কাল্টু ও নিলু যখন ভোম্বলের বাড়িতে এসে ঢুকল, তখন আত্মীয়স্বজনে বাড়ি প্রায় গমগম করছে। নানা আচার নিয়ম মেনে বরের গাড়ি যখন বের হলো তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা।
হাজরাপাড়া থেকেদক্ষিণ খাগড়াবাড়ি যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি থামিয়ে ভোম্বলের বাথরুম করা ছাড়া বিশেষ কিছু ঘটলোনা। একটা জিনিস নিলুরা ভালোই বুঝল যে বিয়ের আগে বউ যতই চেনা হোক, বিয়ের করতে গেলে সবারই টেনশনহয়!
ভোম্বলের বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে। তাই বিয়ে শুরু হতে হতে রাত বারোটা বেজে গেল।বিয়ে শেষ হতে হতে প্রায় শেষ রাত। তখন বাসর জাগার মতো ইচ্ছে আর কারো ছিলোনা।
চার
এদিকে ভোম্বলের বৌভাত পড়েছে রবিবার। কদিন ধরেই কোচবিহারে খুব গরম পড়েছে। ঝড়বৃষ্টির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
আগের দিন সন্ধ্যায় কাল্টুকে নিয়ে বৌভাতের সব্জিবাজার হয়ে গিয়েছিল। তাইনিলু একটু আরাম করে ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু নটা বাজতে না বাজতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল কাল্টুর ফোনে।
কাল্টু বলল, - এই নিলু তাড়াতাড়ি ওঠ। এদিকে কেলো করেছে।
নিলু চোখ কচলাতে কচলাতে বলল - কি হয়েছে রে?সকাল সকাল আর কাওকে পাসনি? আমাকে জ্বালাচ্ছিস কেন?
কাল্টু বলল - আরে বলিসনা, কার্তিকদার মা মারা গেছে।
ঘুমের চোখে নিলু বলে - তাতে আমাদের কি?
কাল্টু জানায় - আরে কার্তিকদার দোকানেই তো মাছের অর্ডার দেয়া আছে!আর মাছ আসবে সেই শিলিগুড়ি থেকে। মা মারা যাওয়ায় কার্তিকদা মাছ আনতে যেতে পারেনি।এদিকে অ্যাডভান্সও করা আছে।
নিলু বলে - তাহলে উপায়?
কাল্টু জানায় - এত ভাবিস না। বাইক বের কর। চল যাই খাগড়াবাড়ি চৌপথী।
সুতরাং নিলু আর কি করে! তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে চাবিস্কুট খেয়েই বাইক নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
খাগড়াবাড়ি চৌপথীতে ট্রাক দাড় করিয়ে দুই রকম মাছের পেটি নামিয়ে তা ছোটো ট্রাকে তুলতে তুলতে দুই বন্ধু গলদঘর্ম হয়ে গেল। সকালের এই যুদ্ধ শেষে খাগড়াবাড়ি থেকে মাছের
পেটিগুলো নিয়ে নিলুরা যখন অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছল তখন সূর্য প্রায় মধ্যগগনে।
কেষ্টদা ওদের দেখেই ক্ষেপে গিয়ে বলল, - বলি বেলা একটার সময় মাছ আনলেহবে?কাটাবো কখন আর ঠাকুর রান্না করবে কখন?
কাল্টুবলল - একটু ম্যানেজ করে নাও কেষ্টদা।সেই সকাল থেকে দুই বন্ধু না খেয়েদেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছি।
কেষ্টদা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো - ভোম্বলের পাল্লায় পড়লে এরকমই হবে।এই যেমন আমি ফেঁসে গেছি!
এরপর নিলুরা চলে এসেছে সোজা ভোম্বলের বাড়িতে। কাকিমা ওদের দেখেই দুই প্লেটলুচি তরকারী পাঠিয়ে দিলেন।কাকিমার পাঠানো সেই খাবার খেয়ে নিলুরা সবে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েছে, ওমনি কেষ্টদা এসে হাজির।
ভোম্বল বলে উঠলো - একি কেষ্টদা!তুমি এখানে!
কেষ্টদা বলে - বলি মাংস কোথায় রেখেছ?
এবার ভোম্বল আমতা আমতা করতে করতে বলে - এই যাহ! ভুলে গেছি।
মাংস কেনার দায়িত্ব ভোম্বল মিন্টুমামা ও নিজের উপর রেখেছিল|তার পরিণতি যে এরকম করুণ হবে তা নিলুরা আন্দাজ করতে পারেনি।
কেষ্টদা বলল - মানে? আর কখন কিনবে আর কখনই বা তা রান্নাহবে?
ভোম্বল জবাব দেয়, - না মানে! এই আনতে যাচ্ছি।
এবার কেষ্টদার গলা আস্তে আস্তে চড়তে থাকে - মাংসের দোকান কি তোমার শ্বশুরের যে এই ভরদুপুরে খোলা থাকবে?
ভোম্বল আমতা আমতা করে বলে, - না, মানে, ইয়ে…
কেষ্টদা সবশেষে তার ব্রহ্মাস্ত্রটা ছেড়ে দেয়, - এই আমি চললাম।এরপর নিজের বউভাতের রান্নার ব্যবস্থা নিজেই করো।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিলুরা প্রায় হাতেপায়ে ধরে কেষ্টদাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
ঘরে চেঁচামেচি শুনে ভোম্বলের বাবা আর মিন্টুমামা এসে হাজির হন।
কাকু বলে ওঠেন, - অকালকুষ্মান্ড! অপদার্থ| সারা জীবন কিছুই তো নিজে করতে পারলি না। বিয়েটা অন্তত ঠিকঠাক কর।
কাকু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মিন্টুমামা কোনোমতে সামাল দিলেন।
নিলুরা তখন ভাবতে বসেছে যে বেলা দুটোর সময় কোথায় মাংস পাওয়া যাবে।মিন্টুমামা তখন বললেন, - তোমরা সোজা পাওয়ার হাউসের মোড়ে রহিম চাচার দোকানে চলে যাও। ওই খাসীর দোকানটি সারাদিন খোলা থাকে।
অতএব কাল্টু আর নিলু গজগজ করতে করতে বের হয়ে পড়ল।ওরা ভেবেছিল বন্ধুর বিয়েতে একটু হৈহৈ করবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি!
পাওয়ার হাউসের মোড়ে রহিম চাচার দোকান খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হোলো না। কিন্তু এত পরিমান খাসির মাংস কেনার পর কাটাতে গিয়ে সেই বিকেল হয়ে গেল।
তারপর মাংস নিয়ে ঘেমে নেয়ে নিলুরা যখন হাজরাপাড়ায় পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যা হব হব করছে। অনুষ্ঠানবাড়ির রান্না ঘরে গিয়ে নিলু বলল - এই নাও মাংস, কেষ্টদা|
নিলুদের দেখেই ঠিক যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কেষ্টদা - এই ভর সন্ধ্যা বেলায় মাংস নিয়ে আমি কি নাচবো না গাইবো?
কাল্টু তাও মেকআপ দেওয়ার চেষ্টা করলো, - না না, এখুনি গিয়ে রান্নার ঠাকুরকে বসিয়ে দিতে বলো। তাহলেই হয়ে যাবে।
কেষ্টদার গলা খেঁকরে বলে উঠলো, - তোমার মুন্ডু হবে!এই মাংস ভালো করে ধুয়ে বসাতে বসাতেই সাড়ে সাতটা বেজেযাবে। তারপর কষিয়ে রান্না হতে হতে কম সে কম রাত নয়টা। শুরুতে খেতে বসা ব্যাচগুলো কি মাছি তাড়াবে?
সারাদিন গরমে ঘুরে ঘুরে নিলুরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো - সে তুমি একটু ম্যানেজ করে নাও, কেষ্টদা|
আর বলেই কাল্টুকে নিয়ে সে সটান কেটে পড়ল।
পাঁচ
বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে হেলতে দুলতে কাল্টু আর নিলু যখন অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছল তখন রাত প্রায় রাত সাড়ে আটটা। ভোম্বলের বিয়ে উপলক্ষ্যে কেনা নতুন কুর্তা পাঞ্জাবি পড়ে দুজনে অনুষ্ঠান বাড়িতে এসেছে।
তবে বাইরে বেশ গরম। বিকেলে একটু ঝড়ো হাওয়া দিলেও বৃষ্টি হয়নি। তাই অনুষ্ঠান বাড়িতে ঢুকে অত লোকের মাঝে ওদের আরও গরম লাগতে লাগলো।
বন্ধুদের দেখেই ভোম্বল চলে এলো। ও বেশ জম্পেশ পোশাক পড়েছে|ওকে দেখতে একটু মোটাসোটা রাজপুত্রের মতো লাগছে।
ভোম্বল জানালো, - ভাই, খাওয়ার ওখানে একটু সমস্যা হয়েছে!
নিলু বলল, - কি হয়েছে রে, ভোম্বল?
ভোম্বল বলল, - ফার্স্ট ব্যাচ শেষ করে সেকেন্ড ব্যাচ চলছে।কিন্তু মাংস নাকি টেনেও ছেড়া যাচ্ছেনা!
কাল্টু বিজ্ঞের মতন বলল, - ও নিয়ে চিন্তা করিস না। থার্ড ব্যাচ থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভোম্বল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো|
নিলু আর একটু খুলে বলল, - বুঝলি না? মাংস ততক্ষণে সিদ্ধ হয়ে যাবে।
এরমধ্যে শ্বশুরবাড়ীর লোকজন চলে আসায় ভোম্বল একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আর নিলুরাও সেই সুযোগে স্ন্যাকসের স্টলের সামনে চলে এল।
ওরা ফুচকা দিয়ে শুরু করল।তারপর বেবীকর্ন, ফিশফিংগার, চিকেন ড্রামস্টিক কিছুই বাকি রাখলো না। মাঝে মধ্যে মেয়ে দেখলে অবশ্য একটুআধটু লাইন মারাও চলছিল।
দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বেজে গেছে।বাইরের নিমন্ত্রিত অতিথিরা খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরে গেছে। তখন পড়ে রয়েছে ভোম্বল আর রিনির আত্মীয়স্বজনেরা।
সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে নিলুরাও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওদের বেশ খিদে খিদেও পাচ্ছে। কিন্তু ভোম্বলদের ছেড়ে তো আর ওরা খেতে বসতে পারেনা।
এরকম একটা সময় ভোম্বলের ডাক এলো - চল ভাই সবাই খেতে বসি।
শুনে কাল্টুর ধরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। যাইহোক, নির্বিঘ্নে ওদের খাওয়া শেষ হলো।খাওয়াদাওয়ার পরে ভোম্বল ও রিনিকে শোবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিলুদের কাজ শেষ।
আর ঘরে ঢুকে ওরা দেখে আরেক কান্ড। ভোম্বল ফুলশয্যার খাট সাজাতে বলেছিল পাড়ার মোড়ের ফুলের দোকানের বগাদাকে।আর রোববার রজনীগন্ধা ভালো না পাওয়ায় গাঁদা ফুলের মালা ও কুচো ফুল দিয়ে খাট সাজিয়েছে সে।আর তা দেখে ঘরে ঢুকেই রিনির মাথা গরম। এমনি তে ভোম্বলের সারাদিনের কান্ড দেখে সে একটু রেগেই ছিলো। কিন্তু ফুলসজ্জার এমন বাহার দেখে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি সে।
ঘটনাটা আরো বাড়ার আগেই রত্নাদি এসে কোনোরকমে রিনিকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।আর ভোম্বল কাঁচুমাচু মুখ করে বন্ধুদের সামনে এসে দাঁড়ালো|
আর কি করা যায়! চোখের সামনে নিলুরা তো আর বন্ধুর প্রেস্টিজ কিচাইন হতে দিতে পারে না! রত্নাদির সাথে কথা বলে কাল্টুকে নিয়ে নিলু ফের বের হল হাসপাতাল পাড়ার উদ্দেশ্যে।
তারপর এক পরিচিত দোকানদারকে ঘুম থেকে তুলে নিলুরা কিছু রজনীগন্ধার স্টিকও গোলাপ ফুল জোগাড় করল। সেসব নিয়েওরা যখন ভোম্বলের বাড়ি আবার পৌঁছল তখন রাত প্রায় দুটো।
খাট পরিস্কার করে আবার রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে সাজাতে সময় লাগলো আরো ঘন্টা দেড়েক। অবশ্য রত্নাদি, রিনি আর ভোম্বল ও তাতে হাত লাগালো। খাট সাজানো যখন শেষ হল, তখন সবাই প্রায় ঘেমে নেয়ে একশেষ।
তারপর ভোম্বল ও রিনিকে ঘরে ছেড়ে কাল্টু ও নিলু যখন বাড়ি থেকে বের হল তখন ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫
No comments:
Post a Comment