সম্পাদকের কথা
একটা বছর শেষ হতে চলেছে বিষাদ নিয়ে। একটা বছর আসছে নতুন প্রত্যাশা নিয়ে। হারিয়েছি যা কিছু কখনো তার হিসেব মিলবে না। আসলে কোনো হিসেব মেলে না আমাদের কোনোদিন। আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই।
কিন্তু মানতে পারি না আদর্শহীনতা, অসংবেদনশীলতা, অসহিষ্ণুতা। দুর্ভাগ্য, এসব কিছুই গ্রাস করেছে আমাদের। ফল, ধর্মের নামে, জাতের নামে পীড়ন, অনায়াসে কাউকে দাগিয়ে দেওয়া এবং অবাঞ্চিত মন্তব্যে কাউকে মেরে ফেলা।
নতুন বছর নতুনভাবে আসুক।
নতুনের কাছে এটাই আশা।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা, ১৪২৫
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
নিলয় মিত্র, কুমকুম ঘোষ, রাহুল গাঙ্গুলী, শুভাশিস দাস, গীর্বাণী চক্রবর্তী, চিরকুমার, রীনা
মজুমদার, তৃপ্তি মিত্র, দেবব্রত সেন, রুনা দত্ত, জয় চক্রবর্তী, বহ্নিশিখা ঘোষ, সুব্রত নন্দী,
সুরভি জাহাঙ্গীর, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, সুতপা মিশ্র, অশোককুমার শতপথী, জয়শ্রী রায়মৈত্র,
অসীম মাহাত, অন্বেষিকা দাস, বটু কৃষ্ণ হালদার, বিনীতা সরকার, শৌভিক কার্য্যী,
অদিতি মুখার্জী, সব্যসাচী নজরুল, রাজু দাস, মিনহাজ উদ্দিন শরীফ, দিপংকর দাশ, মাম্পি
রায়, মজনু মিয়া, স্মৃতি, অঞ্জলী দেনন্দী, চৌধুরী সাখাওয়াত হোসেন রনী, মাথুর দাস, শ্যামল
কুমার রায়
মজুমদার, তৃপ্তি মিত্র, দেবব্রত সেন, রুনা দত্ত, জয় চক্রবর্তী, বহ্নিশিখা ঘোষ, সুব্রত নন্দী,
সুরভি জাহাঙ্গীর, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, সুতপা মিশ্র, অশোককুমার শতপথী, জয়শ্রী রায়মৈত্র,
অসীম মাহাত, অন্বেষিকা দাস, বটু কৃষ্ণ হালদার, বিনীতা সরকার, শৌভিক কার্য্যী,
অদিতি মুখার্জী, সব্যসাচী নজরুল, রাজু দাস, মিনহাজ উদ্দিন শরীফ, দিপংকর দাশ, মাম্পি
রায়, মজনু মিয়া, স্মৃতি, অঞ্জলী দেনন্দী, চৌধুরী সাখাওয়াত হোসেন রনী, মাথুর দাস, শ্যামল
কুমার রায়
ছবি - শৌভিক রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা, ১৪২৫
প্রকাশক - রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার
কবিতা
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
নিলয় মিত্র
চাইলেই যায়না পাওয়া অনেক কিছু
গোলাপের গন্ধ, চিত্রল হরিণ,
অবনীন্দ্র,রামকিঙ্করের ছবি,
পিকাসোর তুলি,
সুকান্তের কবিতা,রবিঠাকুরের ভাষা,
স্বপ্নের মতো সশব্দ স্বাধীনতা।
চাইলেই যায় না পাওয়া সমাজের জাজিম শরীর
গগন মাঝির মাঝ দরিয়ার গান
কালজানির চিকন শরীরের প্রণয়
বাঁশ পাতার সানাইযে ভুবন রাঙানো সুর
ধান কাটা মাঠে, স্বপ্নিল শিল্পের চিত্রকল্প
পাত পেরে উঠোনে বাসমতি চালের গন্ধ।
অন্বেষণে যাই তবু ঝুলিতে স্বপ্ন ভরে
দ্রহে,যুদ্ধের তুন এইসব ভেঙ্গে
প্রিয় নামে ডেকে
বোধে,মমত্বে আর অস্তিতে,যাই
মাটির কাছে
ভালোবেসে মানুষের দাওয়ায়
স্বপ্নরেণু ছড়াতে ছড়াতে।
বিকেলের সপ্তক ও রূপকথার ভায়োলিন
১
সা|লোয়ারে লেগে আছে ~ নীলমেঘ
গভীর ← আরো → গভীর
টানটান রেললাইন
মেখে ফেলে চুমুঠোঁট
২
রে|লব্রীজ ০-স্থান
কেবলমাত্র অস্থিরতা ~ চেনামাটি অচেনা
ঝলমলে < ইচ্ছেসুখ > অনুপ্রবেশ
৩
গা|ভর্তি রুপোরস
গন্ধপারদ ~ হার মানছে চন্দনফুল
উঁকিঝুঁকি জোনাক } ভিজছে বর্ষা
৪
মা|নচিত্র জলবাস
ভাসছে গোলাপচাঁদ [ আদর ]
মুখোমুখি কাটাকাটি ~ উড়োবালির ঘুড়ি
৫
পা|লক আকাশে ~ ফর্সা উরু
জিভলোভ < লোভী নিশ্চয়
আড়াআড়ি আয়না ))) ?-গলে
৬
ধা|নফুল রাশিরাশি
দেওয়াল চিহ্নগুলো ~ টুপটাপ নৌকো ভাবায়
চুপিচাপি ঘনো রাত।ঘনত্ব বাড়ায় শরীর
৭
নি|চ-মুখী সিঁড়িপথ
এবার ঝলসাক্ ~ ঘড়িভর্তি বারুদ
চিতাচাপ।চিতাছাই।চিতামুখ
আদপে সবই ফসল {{{ পোড়ামুখী
শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী
ওয়েটিং
শুভাশিস দাশ
আমাদের গেরস্থালি আর সরকারি বিজ্ঞাপন এর মধ্যে বিস্তর ফারাক
জমি চষা আর অট্টালিকার ফ্রাইডরাইচ
যাদের হাতে তুলে দিলাম রাজ্যপাট তারা এখন ভাগাড় মুখী
পাগার ভরে সত্যের ছেঁড়া লাশে
প্রতিশ্রুতি ভেঙে গড়ে ওঠে নষ্ট যাপন
সুন্দর কথা গুলো দিন দিন ঢুকে যাচেছ আশ্চর্য জাদুঘরে ,বিপন্ন সময়
রুদ্রাশিষ এসময় সংযত থাকতে হয়
কেননা "আপনার কল ওয়েটিং -এ আছে ..
বৈশাখী পদধ্বনি
গীর্বাণী চক্রবর্তী
তোমার তপ্ত শ্বাস ছুঁয়ে যায়
হৃদয়ের মসৃণ আঙিনাকে।
বসন্ত বিদায়ে ঘোরলাগা
চোখ কেঁপে ওঠে রক্তিম সূর্যকিরণে।
ভুটান পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা
উতলা বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়
তোমার আসার অপেক্ষায়।
তৃষিত মৃত্তিকার ঝাপসা দৃষ্টিপথে
তরঙ্গায়িত চেহারা দীঘল হয়।
তবুও প্রিয় বৈশাখ তোমার রুদ্রতায়
খুঁজে পাই অমল বাতাস অফুরান।
তবুও রুদ্র বৈশাখ তোমার পদধ্বনি
হৃদয়ে কত না জলছবি এঁকে যায়।
যুগ যুগান্তরের ওপার থেকে
তোমার দীপ্ত পদক্ষেপে
দিঙমন্ডল জুড়ে জাগে শঙ্খধ্বনি।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন সংখ্যা ১৪২৫
মুক্তগদ্য
উড়ালের দিনগুলো
কুমকুম ঘোষ
সোনালী ফসলের দিন ফুরোলো
ফুরিয়ে এলো, পত্র পুষ্পরাজির উল্লসিত উদ্ভাস।
চৈতী রোদে দগ্ধ প্রান্তর তপ্ত বৈশাখের আজন্ম প্রতীক্ষায় পাষাণী অহল্যা; যার পাশে, কালের সীমান্ত অতিক্রম করে, এক প্রাচীন বট খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ো মজ দাদুর মত: মাথা ভরা সময়ের আঁকিবুঁকি কাটা ঝাঁকড়া চুলে র ভার সয়ে।।সব দেখে সব শোনে আর শুধু অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বেড় করে, থেকে থেকে আরো কিছু মুহূর্ত। জাদুমন্ত্রের গিলি গিলি গে, ফুসমন্তর। হাওয়া পাক খায়।
মাটির কিছু দাবী থাকে, মাটির কিছু দায় থাকে,সে ডাকে আজন্মের নাড়ীর তন্ত্রীতে টুং টাং সুর তুলে। পরিযায়ী পাখীদের ডানায় ক্লান্তি নেমে আসে অপরাহ্নের ফুরনো আলোর মত।তখন তারা চলে আসে মাটির কাছাকাছি।
কাদা য় মুখ ডুবিয়ে লম্বা ঠোঁট গোলাপী সারস কথা বলে মাটির সঙ্গে। সংলাপে সংরাগে গাঢ় ও গূঢ় তাত্বিক সেই আলোচনায় বুড়ো বট ও যোগ দেয় মাঝে মধ্যে জড়ত্বের আড়মোড়া ভেঙে।
মাঠের ধান কাটা হয়ে গেছে বহুকাল, বন্ধ্যা নারীর মত উদাস ও ব্যর্থ তার বুক, ধুলো গুলো আছড়ে পরে ঠিক সাত-বিয়োনো শাশুড়ির জিভের মত: নতশির ভীরু মেয়েটা সেই রাতে স্বামী-সোহাগী হবে বলে যেন প্রস্তুত হয় "আর একবার, আর একবার"..মত্ত মরদকে আঁকড়ে ধরে উড়ালের তীব্র আকাঙ্খায়।
নারীও শঙ্খিনী হয়।
বটের পাতা হাওয়ায় মাথা নাড়ে নীরব আশ্লেষে।
চিরহরিৎ বৃক্ষেরা বহু আলোকবর্ষ পার করেও মায়াজল জমিয়ে রাখে বুকের গভীরে। শুকনো হাওয়া পাক খায় চারপাশে।
অকস্মাৎ আলোড়ন ও চিৎকার।
কদিন নিখোঁজ থেকে ফিরে এসেছে বিশ্বাস'দের ছোট বৌ; থ্যাঁতলানো যোনি,খোবলানো স্তনে ভরভরন্ত শরীরটা।
কোতোয়ালী :আড়মটকানো বড়বাবু র চাহনি; এবং একপাল উৎসুক চোখ ,লকলকে জিভ ভেদ করেও এক বলবান তেজী যুবকের উদাস দৃষ্টিতে চারপাশে র সব ই আবছায়া,প্রবল বৃষ্টিতে ধোঁয়াটে গাড়ীর কাঁচের মত।
বুড়ো বট চোখ বোঝে : প্রান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে দুটো ছায়া- শরীর।দেখেছে সে, গোধূলির রক্তে যখন সন্ধ্যে নামে পশ্চিমে, মিলেছিল তারা ,তারা দুই যুবক ও যুবতী : যেন দুই পরিযায়ী--নীড় বাঁধে, উড়ালের অন্তিমে।
শুকনো হাওয়া ফিসফিসিয়ে বুড়ো বটের কানে কানে যেন বলতে থাকে;--তারপর-তারপর---;
মাটির বুকের ওপর নতজানু হয়ে থাকে আদিগন্ত নীরবতা।
আঁকড়
অন্বেষিকা দাস
বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে হিমেল পরশ গায়ে মেখে পৌঁছে গেলাম খোয়াই মাঠে।গাছের পাতার ফিস্ ফিস্ শব্দ,কোকিলের কুহুতান,হস্তশিল্পীদের রং-বেরং এর পসড়া,সাঁওতালিদের মাদল নৃত্য সব মিলিয়ে যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।এরই মাঝে অদূরে হঠাৎ করে চোখে পড়ল বহু জনসমাগম।একটি শিশু একতারা হাতে বসে আছে;পড়নে গৈরিক বসন,সমস্ত শরীর কুষ্ঠে জরাজীর্ণ।সকলে এসে জিজ্ঞাসা করছে "এই ছোকরা তোমার বাড়ি কোন গ্রামে? একটা বাউল গান ধরো দেখি আমরাও তোমার সুরে সুর মেলাই।"শিশুটি চুপটি হয়ে বসে আছে আর চোখ দিয়ে বেয়ে চলছে জলের স্রোত।তার এই স্রোত দেখে সকলে একটা দু'টো পয়সা দিয়ে চলে যাচ্ছে।আমি একটু এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম -"ভাই তোর নাম কি?" বলতেই বাচ্চাটি গলা জড়িয়ে ধরে বলছে-"দিদিয়া আমায় নিয়ে চলো তোমার বাড়ি।বাপ মা সারাদিনের জন্য আমাকে হাটে ফেলে চলে যায় বাবুদের বাড়ির বিভিন্ন পরবে-একটা দু'টো পয়সা পাবে বলে।দিদিয়া আমি কুষ্ঠ হাতে একতারা বাজাতে পারি না ,পারি শুধু রং তুলির টান দিতে।আমায় নিয়ে চলো তোমার বাড়ি।তোমার গৃহস্হালির কাজ করব,বাবুর সাথে বাজারে গিয়ে বাজার আনব পরিবর্তে আমাকে দেবে এক মুঠো ভাত আর একটু থাকার জায়গা।আমি নতুন করে বাঁচতে চাই,নতুন করে ধরতে চাই রং পেনসিল।সৃষ্টি করতে চাই আমার মা-বাপকে।তোমায় বসিয়ে আঁকতে চাই মায়ের মুখোচ্ছবি।বিক্রি হবে দেশে বিদেশে - অনেকটা মোনালিসার মতো।" কথাগুলো শুনে আমি ওকে তুলে নিলাম আমাদের গাড়িতে।কয়েকঘন্টা অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম আমাদের চিলেকোঠাতে।বাড়িতে ঢুকেই ছেলেটি বলছে "দিদিয়া খুব খিদে পেয়েছে এক মুঠো খেতে দাও।"এই শুনে চলে গেলাম রান্নাঘরে।খাওয়া সেরে সবে মাত্র বসেছি সেও রং তুলি নিয়ে বসে পড়েছে মাটিতে।কয়েকঘন্টায় এঁকে ফেলল ওর মায়ের মুখোচ্ছবি।চোখ জুড়িয়ে গেল দেখে মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত ছবি।বেশ কিছুদিন পর এক চিত্র প্রদর্শনীতে বীরভূমের এক বাবু কিনে নিল চড়া দামে যে বাড়িতে ওর মা-বাপের নিত্য-নৈমিত্তিক যাতায়াত।বাবু খুদে শিল্পীর শিল্পসত্তা দেখে তার বাড়িতে ডেকে নিল কিছুটা সাক্ষাৎকারের জন্য।সেইসময় মা তাকে চিনতে পেরে বুকে আঁকড়ে ধরে বলে -"এই দিনটির অপেক্ষায় আমি তোকে ফেলে আসতাম জানিস? তোকে প্রতিষ্ঠিত দেখব বলে,এবার চল তোর দেশের মাটিতে তোর দিদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে।" মায়ের হাতে ছেলেকে তুলে দিয়ে আমি ফিরে এলাম আমার সাজানো চিলেকোঠাতে।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫
নিবন্ধ
বিশ্ব কবি ও তাঁর স্বদেশ প্রেম
বটু কৃষ্ণ হালদার
বিশ্ববাসীর কাছে এক জীবন্ত প্রতি মূর্তির নাম হল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর. পঁচিশে বৈশাখ দিনটি আজও সমগ্র ভারত তথা বিশ্ব বাসির হৃদয়ের মাঝে অক্ষত. এই দিনটির জন্যে প্রতি বছর অপেক্ষা করে থাকি আমরা সবাই কারণ সাহিত্যের পিতাকে স্মরণ করার জন্যে. সেই গৃহ বন্দি ছোট্ট রবি, বিশ্ব বরণীয় কবি. সমগ্র বিশ্বের দরবারে এক বিস্ময়কর বাস্তবধর্মী জীবন্ত প্রতি মূর্তি. তাই তাঁকে স্মরণ করে পঁচিশে বৈশাখ সমগ্র ভারত বর্ষে জন্ম দিনের উৎসব মহা আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করা হয়. সমগ্র বিশ্বের দরবারে তিনি এক জীবন্ত আইডল. স্থান, কাল পাত্র,,, অলিগলি, রাজ পথ, গ্রাম সমগ্র জায়গায় তাঁর অবস্থান. তাই তাঁকে ছাড়া সাহিত্যের ভান্ডার অপূর্ণ. আমরা যারা এই সময় সাহিত্য নিয়ে চর্চা করি তার উৎস হল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর. তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দেখানো পথের দিশায় দিক নির্দেশ করি কারণ তার প্রেরণা ছাড়া আমরা এক পা ও চলতে পারবো না. তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে গঙ্গা পূজা করা, নিজের সাহিত্যের আত্মl কে শুদ্ধ করে নেওয়া. এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে যেমন মাপা যায় না সমুদ্রের গভীরতা তেমনি কার সাধ্য আছে তাঁকে বিশ্লেষণ করার?
যদি পাহাড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াও নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় ঠিক তেমনই সাহিত্য তথা সমাজ দর্শনে তিনি এক জাগতিক মাহীরুহ, তার মহিমা ত্ব কখন ও মাপা যায় না. প্রতি বছরের ন্যlয় সমগ্র ভারত বর্ষ তথা বিশ্বে তার জন্ম দিন মহা সমারোহ তে পালন করা হবে. ব্যস্ত সময় একে একে ফিরে যায় গ্রীষ্ম, বর্ষা,শীত, আসে বসন্ত ঝরা পাতা ডাক দিয়ে যায় আগামীর নব কল্লো লের, রবীন্দ্র সম্ভারের বিশ্ব চর্চিত বন্দনায় তাঁর স্মরণে স্বরচিত কবিতা, গান, নাটক, ছড়া, গীতি
আলেক্ষ্য, গল্প ভরিয়ে দেবে লাল পলাশের সামাজিক বন্দনায়.
তিনি ছিলেন বঙ্গ তনয়ার গর্ব. মা সরস্বতীর কৃপা য় ভোরে উঠেছিল তার সাহিত্যের অঙ্গন. তিনি ছিলেন দেশ গৌরব শ্রেষ্ঠ কলম সৈনিক. জাগতিক সমগ্র ধারা তার কলমের রেখায় ফুটে উঠেছিল. তিনি বঙ্গ বিশ্বের বিশ্ব কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরোবরের তাজা পদ্ম হয়ে উনিশ শতকের দোর গোড়ায় এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যের রেনেসাস. তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর মিলন ঘটিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন সাহিত্যের দরবার. দেশ তখন পরাধীন. ব্রিটিশদের পায়ে পদ দলিত ভারত. স্বাধীনতা পাওয়ার লক্ষে অবিচল সমস্ত জনগণ. দেশ মায়ের মুক্তি ঘটাতে মিটিং, মিছিলে ব্যস্ত সন্তানরা. যে কোনো মূল্যে এমন কি দেশের জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে বদ্ধ পরিকর সবাই. একে একে বীর সন্তানেরা ফাঁসির মঞ্চে গাইছে জীবনের শেষ জয়গান. সেই সময়ে তিনি ও বসে থাকেনি হাত গুটিয়ে. জনগণ কে উৎসাহ দিতে চলতে থাকে তার কলম. দেশের প্রতি দায়িত্ব বোধ জাগিয়ে তুলতে কলমের খোঁচায় তুষের আগুন কে খুঁচিয়ে দিয়ে লিখেছেন অগণিত দেশত্ব বোধক
গান, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি. শহীদ ভাইদের স্মরণে তাঁর কলম অবিরত চলেছিল. তিনি ও বসে থাকেনি, সর্বদা অবিচল ছিলেন আন্দোলনের লক্ষ তে. অনেক আন্দোলনে তিনি সামিল হয়েছেন. ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন এর বাংলা বিভাজনের প্রয়াস ব্যর্থ করতে তিনি সামিল হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে. তিনি হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলল ঘটাতে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করেন. দিয়ে গেছেন সম্প্রতির মেল বন্ধন এর বার্তা. ১৯১৯ সালে বিশেষ করে জালীয়ানওয়ালাবাগে বর্বর হত্যাকান্ডের নায়ক জেনারেল ডায়ারের তীব্র নিন্দা করেন এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশ দের থেকে প্রাপ্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন লর্ড
চেমসফোর্ডকে তিনি বলেন যে "আমার এই প্রতিবাদ, আমার আতঙ্কিত দেশ বাসির মৌন যন্ত্রণার অভিব্যক্তি". এর থেকে বোঝা যায় তিনি কত না দেশ কে ভালোবাসতে ন. তিনি শুধু কলম দিয়ে নয় মন প্রাণ দিয়ে দেশ কে সেবা করেছেন. তিন এক দিকে দেশ প্রেম আর অন্য দিকে সাহিত্য চর্চায় নিজেকে মোহিত করা দুটো কেই সমান তালে চালিয়ে নিয়ে গেছেন. সাহিত্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন সমগ্র বিশ্বে. তিনি বিশ্ব জোতিরময়ের অগ্নি বল য়. জীবন্ত প্রতিমূর্তি, যুগ যুগ ধরে জাজল্য মান.
বিশ্ব কবি তাঁর অমূল্য সৃষ্টি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ লিখে পেয়েছিলেন বিশ্ব শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল ১৯১৩ সালে. বিদগ্ধ এশিয়ায় সর্ব প্রথম এই বিশ্ব সম্মানে ভূষিত হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি তথা ভারতকে বিশ্বের দরবারে এক আলাদা মাত্রা দান করেন.
আজও কখনো কখনো গুণ গুণ করে হৃদয়ের আলক্ষ তে গেয়ে ওঠে আমার ও পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো. কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি, পূজা পাণ্ডেল, এ দূর হতে দূর অন্তরে আমরা তার সুরের ছোঁয়া পাই. তার সৃষ্টি ধারা মধুরিত হয় আকাশ বাতাস. কোনো সাহিত্য চর্চা অনুষ্ঠান এ আমরা তাঁর আলোচনা দিয়ে শুরু ও শেষ করি. যারা এই সময় সাহিত্য চর্চা করেন তার অমৃত ধারা পান করে শুদ্ধ হই মাত্র. তিনি জাগতিক সাহিত্য ধারার সৃষ্টি কর্তা তাই তাঁকে স্মরণ না করলে, সাহিত্যের আসর কখনো ও পূর্ণ হবার নয়. ছোট্ট শিশুর ঘুম পাড়ানিয়া গানে মায়ের সুরে তাঁর ছোঁয়া. বিশেষ করে একটি বিনি সুতোর মালায় গাঁ, শহর, অলি, গলি, রাজপথ কে বাঁধা. সে দিক থেকে তাঁর প্রয়াস সার্থক. তাই তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে ছিল, আছে, এবং থাকবেন সমগ্র বিশ্ব বাসির হৃদয়ে.
রবি ঠাকুর শুধু মাত্র তিনি সাহিত্যের ধারক ছিলেন না, ছিলেন দেশের প্রতি কর্তব্য বিমূড় সুচিন্তিত রাজনীতিবিদ. তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ধারা ছিল অত্যন্ত জটিল. তিনি সর্বদা সন্ত্রাস বা দের বিরোধিতা করেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কে সমর্থন করেন. ১৮৯০ সালে প্রকাশিত "মানসী" কাব্যগ্রন্থ তে কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়. হিন্দু _জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় তথ্য প্রমাণ ও পরবর্তী কালের বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় তিনি গদর ষড় যন্ত্রর কথা শুধু জানতেন না বরং এই ষড়যন্ত্র তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর এর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন. অন্যদিকে ১৯২৫ সালে একটি গ্রন্থে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা" সংস্কৃতি বলে বিদ্রুপ করে রবি ঠাকুর এর কঠোর বিরোধিতা করেন. তিনি সাম্রাজ্যবাদ কে ঘৃণা করতেন. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যা গুলির উপসর্গ". এই কারণে বৈকল্পিক ব্যখ্যা হিসাবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্ব নির্ভরতা ও বৌদ্ধি ক উন্নতির উপর গভীর ভাবে আলোক পাত করেন. তিনি অন্ধ বিপ্লব কে বিশ্বাস করতেন না. বাস্তব সম্মত উপযোগী মূলক শিক্ষার পন্থাটি কে গ্রহণ করার আহবান জানান. তাঁর এই ধরণের রাজনৈতিক মতবাদে অনেকেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন. ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোর একটি হোটেলে অবস্থান কালে একদল ভারতীয় চরম পন্থী রবি ঠাকুর কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন.
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কে উজ্জীবিত করার জন্য লিখেছেন অগনিত গান ও কবিতা, নাটক ইত্যাদি. তাঁর কবিতা "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য" ও গান " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে" রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টনিক হিসাবে কাজ করেছিল. একলা চলো রে গানটি বাপুজির খুব প্রিয় ছিল. গানটির আক্ষরিক অর্থের সঙ্গে মানব জীবনের অঙ্গlঙ্গি ভাবে জড়িত. সত্যই একা এই পৃথিবীতে আগম ন ও একা একা ফিরে যাওয়া তবু ও এই বিশ্বের দরবারে আমার আমিত্ব সংজ্ঞায় ভাই ঝরায় ভাই য়ের রক্ত বা সন্তান ঝরায় পিতা মাতার রক্ত. মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির ছিল অমল মধুর. দলিত সম্প্রদায় দের জন্যে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কে কেন্দ্র করে মহাত্মা গাঁধী ও ড: বি. আর. আমবেদকরের মধ্যে যে বিরোধের সূত্র পা ত হয় তার সমাধানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন. গান্ধী তাঁর আ _মরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেন. স্বদেশ প্রেমে তিনি মোহিত ছিলেন কারণ দেশের উন্নতি কল্পনায় সর্বদাই উন্নত শীল চিন্তা করতেন. তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে চেয়েছিলেন আমূল পরিবর্তন. তিনি বুঝেছি লেন যে একমাত্র শিক্ষার আলোয় অন্ধ কুসংস্কারছন্ন ভারতের মুক্তির পথ লুকিয়ে আছে. তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কে মিলিয়ে দিয়ে নতুন শিক্ষার অঙ্গন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন. আধুনিক চিন্তা ধারা য় সমাজকে সাজাতে চেয়েছিলেন. আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠবে আধুনিক ভারতের সমাজ ব্যবস্থা, এই রাস্তায় আসবে প্রকৃত বিপ্লব, পাল্টাবে বস্তা পচা ধ্যান ধারণা, আসবে উন্নতির জোয়ার তাই জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত না করলে থমকে যাবে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা র ধারা. আর উন্নত সমাজ না গঠন হলে
গড়ে উঠবে না উন্নত দেশ. উন্নত দেশগড়ার মানচিত্র থেকে যাবে খাঁচায় বন্ধী পাখির মত,শুধু ই ডানা ঝাপটাবে কিন্তু অসীম আনন্দের দিশা খুঁজে পাবে না. ১৯১৭ সালের ১১ই অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সানটা বারবারা ভ্রমণের কালে এই চিন্তা ধারার ফলশ্রুতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক নতুন ধরণের বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করেন. তাঁর হাতে গড়া শান্তিনিকেতনের আশ্রম টিকে দেশ ও ভূগোল এর গণ্ডির বাইরে ভারত ও বিশ্বকে এক সূত্র ধারায় বিশ্ব পাঠ কেন্দ্র তে পরিনত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন. এক কথায় তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কে এক ধারায় আনতে চেয়েছিলেন. অবশেষে ১৯১৮ সালের ২২শে অক্টোবর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করেন. ১৯২২ সালের ২২শে ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন বিশ্ব বিদ্যালয়েরর. তিনি নিজে কঠিন পরিশ্রম করে অর্থ জোগাড় করেছেন শুধু মাত্র দেশের মানুষ কে সু চিন্তায়, সু শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে বলে. তিনি পেয়েছিলেন বিশ্ব শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থের জন্য. সেই পুরস্কার এর আর্থ মূল্য ও ব্যয় করেন বিশ্ব বিদ্যালয়ের জন্যে. ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত একাধিক বার ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে অর্থ জোগাড় করতে.
তিনি এক ধারে মহান ব্যক্তিত্ব অন্য দিকে সাহিত্যের দরবার. ভারতের সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি নিজেকে যুক্ত না করলেও অনেক খানি ভূমিকা পালন করেছিলেন কারণ সমসাময়িক কিছু কিছু ঘটনা গুলি (বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন, জালীয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ইত্যাদি)থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেনি বরং তিনি ছিলেন স্বদেশীকতার বরেন্য পুরুষ. ১৮৯৬ সালে কলকাতায় যে কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে " বন্দে _মাতরম" গান টি রবি ঠাকুর উদ্বোধন করেন. মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর শিবাজি উৎসব পালন করেন তার অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা "শিবাজী উৎসব". তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন দেশের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন আনতে চেয়ে বাংলা কে দুই ভাগ করতে চেয়েছিলেন তার প্রতিবাদে তিনি রাস্তায় নেমে পড়েন. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মেল বন্ধন গড়ে তুলতে তিনি "রাখিবন্ধন" উৎসব চালু করেন. আজও সেই উৎসব যুগের পর যুগ পালন করা হয় সম্প্রীতির মেলবন্ধন হিসাবে. এই উৎসব কে স্মরণীয় করার জন্য রচনা করেন গান "বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পূন্য হউক, পূন্য হউ ক, পূন্য হউক হে ভগবান". তিনি শিলাইদহে বসবাস কালীন দরিদ্র প্রজাদের জন্যে চালু করেন শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জল সরবরাহ, সড়ক নির্মাণ ব্যবস্থা, ঋণের দায় থেকে কৃষক দের মুক্তি দান, সহ বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কাজ. তাই তিনি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন সবার হৃদয়ের মাঝে যুগ যুগ ধরে. তিনি স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন কালে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ কে কখনো সমর্থন করেন নি. একদিকে ভারতের জাতীয় প্রকৃতি ও তার ইতিহাসের ধারা কবির কাছে হয়ে ওঠে গভীর অর্থবহ আর অন্য দিকে আধ্যাত্মিক ভাবনায় তাঁর চিত্ত ধাবিত হয় রূপ. জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবন জিজ্ঞাসা ও সাহিত্য দর্শনের পরিক্রম ঘটেছে. যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে কবি সব কিছু কেই আত্মত্ব করেছেন গভীর অবলীলায় ক্রমাগত নিরীক্ষায় এবং বিশ্ব পরিক্রমার মধ্য দিয়ে. এই পরীক্ষা, নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছড়া, ছোট গল্প, গল্প, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, ভ্রমণ কাহিনী, চিঠি পত্র, এবং দেশ বিদেশে বক্তৃতা মালা. তাঁর অন্ত নিহিত জীবন বোধ ছিল স্থির এবং বস্তু পরিবর্তন কে স্বীকার করে নিয়ে আপন আদর্শতে প্রতিষ্ঠিত. অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল. তিনি কালের নন, ছিলেন কালজয়ী বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
স্বাগত রুদ্র বৈশাখ
বিনীতা সরকার
নিজ হাতে ভেঙ্গে যতনে গড়ে দিতে যে জানে, সেই বৈশাখ - রুদ্র বৈশাখ আবারও আগত জীবনের চেনা প্রান্তে l উন্মোচিত করতে জীবনের আরও অচেনা-অজানা দিক,খুঁজে দিতে জীবনের নতুন নতুন মানে l
মাস পরিক্রমায় বছর ঘুরে চৈত্রের পরেই বৈশাখের আগমন I সমাপনীর রেশ নিয়েই শুরু হয় এক নতুন যাত্রা l যে যাত্রা পথের কান্ডারী এক তেজদীপ্ত পৌরুষ- রুদ্র বৈশাখ l ধূলায় ধূসর, পিঙ্গল জটাজালে তার ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি নিয়ে স্বমহিমায় হাজির হয় সে l তার রুদ্র রূপের জাদুতে একটি বছরের নিরাশা আর বেদনাকে ধূলোর সাথে মিশিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে চায় l বৈশাখী ঝড় তাকে তাকে অনেক দূর বয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশায় l মন বার বার গেয়ে ওঠে -----
' ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ ,
ভাঙ্গিয়া মধ্যাহ্ন তন্দ্রা জাগি উঠি বাহির ধারে l '
বৈশাখের মাঝে লুকিয়ে থাকে নতুনের দিগ্বীজয়ী সম্ভাবনা I পুরাতনকে মুছে ফেলে নতুন উল্লাসে জীবন শুরু করার আহ্বান l বিগত বছরের দুঃখ, শোক, জ্বরা, ব্যাধি সব ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে ব্রতী হতেই উদ্বুদ্ধ হই আমরা বৈশাখের কাছে l যেভাবে কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব বছর শেষের বিবর্ণ পাতাগুলি উড়িয়ে নিয়ে যায় অনন্ত আকাশে , তেমনই রুদ্র বৈশাখ উড়িয়ে নিয়ে যায় মানুষের মনের গহীনে জমে থাকা দুঃখ, হতাশা, গ্লানি l আনমনে মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের সেই প্রার্থনা বাণী -------
' উড়ে হোক ক্ষয়
ধূলিসম তৃণসম পুরাতন বৎসরের যত
নিষ্ফল সঞ্চয় '
বৈশাখের একটি স্বকীয় স্বর রয়েছে l একেবারেই নিজস্ব l সেই স্বরে সদা প্রতিধ্বনিত হয় জীর্ণতার অবসান আর জীবনের জয়গান l জীবনকে নতুন রূপে, রসে, গন্ধে, সজীবতায় ভরিয়ে দিতে বৈশাখ আসে নতুন ছন্দ বেঁধে l
বৈশাখ বয়ে নিয়ে আসে মুক্তির উল্লাস l বৈশাখের রুদ্র, বিপ্লবী রূপ আঁধার ভুবনে করাঘাত হানে বারংবার l ভেঙ্গে খান খান হয় মানুষের মনের তিমির কারাগার l প্রকাশিত হয় আশার আলো l কাব্যিক ব্যঞ্জনার মাধ্যমে কবি দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারন করেন-------
' ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর '
বৈশাখেরও আছে এক কষ্টময় জীবন আলেখ্য l গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ, জল কষ্ট পক্ষী ও প্রাণী কুলকে প্রচন্ড কষ্টও দেয় l কোনো কোনো কবি তাঁদের লেখায় বৈশাখকে অভাব-অনটন ও যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবেও ব্যক্ত করেছেন l
রুদ্র রূপের পাশাপাশি বৈশাখের রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি রূপ I খুব নিবিড় পর্যবেক্ষনেই তা ধরা পড়ে l আর তা হ'ল --- কোমলতা, পেলবতার স্বাদ l চৈত্র দিনের বিধবা চরের সাদা থানের পরে বোশেখ ছড়িয়ে দেয় সবুজ থরে থরে l বোশেখ শেষের বালুচরে বোরো ধান সোনা ছড়িয়ে রাখে সারি সারি l নদীর ধারের চঞ্চল বাতাসে দোলে ধানের সোনালী পাড় l ওদিকে মধ্য চরে ফুটে ওঠে আউশ ধানের সবুজ পারাবার l সব মিলিয়ে বৈশাখ প্রকৃতিকে দান করে এক অদ্ভুত অমৃতপ্রলেপ l
বৈশাখকে নিয়ে বহু কবি সাহিত্যিক কাব্যে -লেখায় তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করেছেন I চমৎকার সাবলীল ভঙ্গিতে তাঁরা বৈশাখের জয়গান ও নিত্য নতুন অনুসঙ্গ উল্লেখ করেছেন l একদিকে ধ্বংসরূপ, অন্যদিকে নতুনের আগমন সৃষ্টিকে নতুন রূপে উন্মোচিত করে l মনে নাড়া দেয় কবি গুরুর সেই অমোঘ কিছু লাইন--------
' এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক
মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জ্বরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা l '
প্রকৃতির এই শুচিতা মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে I আসলে মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান l বৈশাখের অগ্নিস্নানে প্রকৃতি যেমন নবরূপ লাভ করে, ঋদ্ধ হয়, তেমনি মানব মনেও লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া l সে পরিবর্তন কল্যাণমুখী ও সৃষ্টিশীল l মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এ ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজনীয় l বৈশাখ প্রকৃতি ও মানুষের অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও সাহস জোগায় বারংবার l
বৈশাখের আছে আরও কিছু অনুষঙ্গ I বৈশাখ আমাদের গ্রামীণ মানুষের জীবনে অনেক সময়ই একটা আতঙ্ক নিয়ে আসে l উৎসবের আমেজ ছাড়িয়ে কালবৈশাখী অনেক সময়ই আতঙ্কিত করে এই জনপদের মানুষদের l এখানে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, সিডর ইত্যাদির আতঙ্কে যতটুকু না মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে, তার চেয়ে অনেক বেশি কেঁপে ওঠে অপসংস্কৃতির সিডর আতঙ্কে l কারন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, সিডর ইত্যাদির ক্ষয়-ক্ষতি খুব তাড়াতাড়ি পুষিয়ে নেয়া যায় কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতির অঙ্গনে চাপিয়ে দেয়া সিডরে বিধ্বংস্ত জাতির শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে সময় লাগে , কখনো বা দাঁড়াতেই পারে না l তার অকালমৃত্যু ঘটে l তাই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিতে, কর্তাব্যক্তিদের মননে-মস্তিস্কে, উঁচু-নিচু সর্বস্তরের জনগনের জীবনে ও মননে একটা বিশাল বৈশাখী ঝড়ের প্রয়োজন l যে ঝড়ে সব অপসংস্কৃতির বীজ ধুলো হয়ে উড়ে গিয়ে এ পৃথিবীর রত্নগর্ভা হয়ে উঠবে l বন্ধনা করি সেই দীপ্ত শক্তির l স্বাগত জানাই সেই রুদ্র বৈশাখকে l
কবিতা
একাকি মান্দাস
তৃপ্তি মিত্র
অবৈধ ইচ্ছেরা ভাসে খেয়ালি শব্দস্রোতে
আকাঙ্খার রঙমহলায় খেলে মেঘ,বৃষ্টি,রোদ
বাতাসের কানে কানে কেবলই ফিসফাস
নীলনদী জল আঁকে কবিতা কোলাজ
পংতির শরীর খোঁজে নিবিড় সহবাস
কামনার নীল জলে বোপরোয়া একাকি মান্দাস ৷৷
বৈশাখীর আগমনী ঘ্রাণ
রুনা দত্ত
হেমন্তের হলুদ ঝরা পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
বসন্তের ফাগুন পলাশ কৃষ্ণচূড়ার ছোঁয়ায়
হৃদয় জুড়ে আজ যেন শুধুই ভালোবাসার সুর ।
নতুন উচ্ছ্বাসে আজ আবার নতুনের আশ্বাস
আবার সবুজ জীবন সবুজ প্রাণ ছুঁয়ে
পৃথিবী জুড়ে আসন্ন বৈশাখীর আগমনীর ঘ্রাণ।
আবার যেন নতুন ভাবে সবটুকু শুরু করা
আবার যেন নতুন ভাবে একসাথে পথচলা
সব পুরোনো স্মৃতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আজ আবার বৈশাখীর সুরে
পায়ে পায়ে সবুজ স্নিগ্ধতায় জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া ।
বছর ফুরিয়ে
জয় চক্রবর্তী
বালুচর বেড়েছে পশ্চিমে, নদী এখন চুপটি করে থাকে
চুপ করে থাকে সুখী গৃহকোণ, আলু ভাতের স্বপ্ন
দূর পাল্লার বাজার হাঁকে- এক দুখানি বর্ণ কিনে যাও
সন্ধ্যার শেষে মিলিয়ে নিও শব্দ।
বসন্তের পর কোনো একদিন বছর ফুরিয়ে যাবে
তোমার ছাদে ফুল গাছের জন্মদিন
আমার আনুমানিক বয়স বেড়ে শতাব্দীর শেষ,
স্পর্শ তখন ওজন কমিয়ে দিতে চায়।
চৈত্রের শেষ সন্ধ্যে
বহ্নিশিখা ঘোষ
পড়ন্ত বেলার শেষ রোদ্দুরটা বাঁশবনের
ঝিরিঝিরি হাওয়ার ফাঁকে হাজার সূর্যের মতো
এসে হাজির হলে তার গায়ে লেপে দিই
সারাদিনের শ্রান্তি আমার।
চৈত্রের শেষ সন্ধ্যে নামার আগে বেয়ে যাই
মধুকর ডিঙা,এক অলীক সুখের আশায়,
এক ঢেউ হাজার রূপে এলে ভেঙে যায় পাড়
তার চোখে এঁকে দেই ভবঘুরে একাকিত্বের নেশা।
ভাঙা চরে বাঁধি এক ঘর, চারদিক খোলা
আমি আপাদমস্তক এক বৈরাগী, গেয়ে যাই জীবনের গান,
ধেয়ে এলে ঝড় আমি তার ঠোঁটে লিখে দিই শান্তির স্তব।
পৃথিবী শান্ত হলে চেয়ে থাকি টেরাকোটা পথটার দিকে,
বিধ্বস্ত বুকের ভেতর ফেরার আশা।
শুধু আজও তুমি একবিন্দু জলের মতো
যত্নে থাকো চোখের কোণায়।
সেই চোখে জমে শুধু লবণ পাহাড়,
মনের মাঝেতে বাজে ভাঙনের সুর
বৈশাখে সূর্য
রীনা মজুমদার
দিবাকর তোমার আমার
একটি মাস বজ্রকঠিন প্রেম,
জমা রাখি তোমার জলন্ত আঁখিতে
যেখানেই গন্ধ পাই
বছরভর চুরি করি, কুড়িয়ে আনি
ওদের মজুত করা বারুদ l
বৈশাখে তপ্ত শরীর
তোমার রক্তঅশ্রু মুছে যায়
আমার শ্মশ্রুর শ্রমবারি ধারায়
সঙ্গমে ছাই হয়
কত কত বারুদ !
দিবাকর তোমারই কথাতে
কথা দিলাম --
প্রতিটি শিশুকে বারুদহীন
শান্ত পৃথিবী ফিরিয়ে দেব l
রাখে না ? কেউ কথা রাখে ..
ফিরে আসে সূর্য রুদ্র বৈশাখে ll
অস্থির অস্তিত্ব
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
সময়টা বেশ এলোমেলো,অগোছালো
চৈত্রের চারিত্রিক চাতুরি
বিপন্ন বৈশাখে বিভ্রান্তি,
ভোটের ভড়ং'এ ভরপুর ভরতুকি ।
ফাঁদে ফেলার ফাঁকফোকর
জটিলতায় জনতা-জনার্দন জেরবার !
অনশনে অনাহারের অন্যায় অন্যথাচরণ !!
লোভীর লালসায় লাভবান লঙ্কা,
দেশের দুর্দশায় দুর্নীতিগ্রস্থের দুরভিসন্ধি
কদলীবালার কথার কচকচানিতে করতালি !
গুনধরের গুনকীর্তনে গুলবাজের গুজব,
প্রত্যহ প্রতিশ্রুতির পাল্টা প্রতিবিপ্লব ।
আনচান
অসীম মাহাত
প্রবীণ হলো আজ নবীন
বৈশাখের রঙিন প্রভাতে ।
ঝিরঝির এলোমেলো বাতাসে -
সবুজ ঘাসের ডগায়
রঙ্গ ভরা যৌবনে,
জীবন নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা -
হবে আজ প্রাণ খুলে কথা ।
দেখা হবেই হবে !
গোপন চিঠির অপলকে ।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫
No comments:
Post a Comment