Saturday, April 13, 2019


ফিরে এসো পদ্য পাতা 

সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য 








সাবেক কালে রাজা-রাজড়ার বিয়েতে পদ্য ছাপা হতো নকশাপেড়ে রঙিন কাগজে পদ্য ছাপিয়ে তাতে সুগন্ধি মাখিয়ে বিলি করা হতো বিয়েবাড়ির অতিথিদের হাতে হাতে। পদ্যগুলি লিখতেন বর অথবা বরকনের আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব প্রমুখ। ভালবাসা, আশীর্বাদ, রঙ্গ-রসিকতা, কৌতুক, রীতি রেওয়াজ কী না থাকত সেসব পদ্যে। এটি ছিল রীতি, প্রীতি উপহারের রীতি।  
            সত্যি বলতে কি, সামাজিক বাঙালি বিয়েকে আমার একটা ক্রিয়েটিভ প্রসেস মনে হয় ক্রমিক উত্তরণে যার পরিসমাপ্তি পাত্রপাত্রী নির্বাচন থেকে দ্বিরাগমন পর্যন্ত সর্বত্রই বাঁকে বাঁকে রোমাঞ্চ, চমক, আনন্দ বরকনের প্রশংসা, পরিচিতি ও শুভকামনার মধুময় মাখামাখি আর সেই প্রসেসেরই একটি ধাপ হচ্ছে বিয়ের পদ্য
            বিয়ের পদ্য নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লেখা হয়েছে পদ্যের নমুনাও তাতে কম নেই কিন্তু আশ্চর্য লাগে ভাবলে, সেসব প্রবন্ধে কেবল মহা মহা সেলেব-এর বিয়ের উদাহরণের ছড়াছড়ি কত কত ভূস্বামী , সাহিত্যিক, ফিল্ম আর্টিস্ট, শিল্পপতি, মনীষীদের বিয়ের পদ্যের নমুনাই না সেখানে দেওয়া আছে, নেই কেবল গরীবগুর্বো গ্রাম্য অশিক্ষিত মানুষের মৌখিক প্রতিভার উদাহরণ। অন্তত আমার নজরে তো পড়েনি। অথচ কাব্যপ্রতিভা দেশ স্থান উপনিবেশ বা সামাজিক অবস্থান দেখে জন্মায় না। ছাপাখানা সাধ্যের মধে নেই, ছাপার অক্ষরে নিজের নামটাও দেখার সৌভাগ্য হবে না জেনেও পদ্য লিখে যে মানুষগুলির আহ্লাদ হয়েছে গর্ব হয়েছে তাদের অনুভবকে তাচ্ছিল্য করার মতন বুকের পাটা নগর সভ্যতার থাকতেই পারে কিন্তু সাহিত্যের ভাঁড়ারে সেগুলি খুব কম সঞ্চয় নয়।
             পাত্র পাত্রী বাছাই করে পাকা কথা হলো তারপর বাজারঘাট করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যেত পদ্য লেখার তোড়জোড়। আলতা কুমকুম কাজল নিয়ে পড়শিরা বসে যেতেন বালি কাগজের পাতার চারদিকে পাড় আঁকতে। অনেকগুলো পাতা তৈরি হবে, সে এক মহাযজ্ঞিবর না কনে এ দলাদলি সবার আগে সামনে আসতো। কোন পক্ষের পদ্যপাতা বেশি ভালো হয়েছে, বিয়ের রাতে যাচাই হবে যে! একটু কমবেশি হলে মানইজ্জত ধুলো চাটবে। পাতা তৈরি হতে হতে পদ্যলিখিয়ে হাত চালাবেন তাঁর কাগজকলমে। বিয়ের আর পাঁচজন কর্মকর্তার মতন তাঁরও তখন মস্ত দেমাক। তাঁর এলেমেই তো ভরাবর্ষায়ও কোকিল ডাকবে, অমাবস্যায় রাত ভেসে যাবে ফুটফুটে জোছনায়, কালো ভ্যাদা হুমদো বর হয়ে উঠবে স্বপ্নের রাজপুত্তর, আইবুড়ি ধুমসি হয়ে যাবে ডানাকাটা পরী। পদ্য আর কবিতায় কী ফারাক আছে তা নিয়ে পন্ডিতেরা টিকিদাড়ি ছিঁড়ুন, কাছা চশমা নাড়ুন, বিয়ের পদ্যে শুধুই উৎসবের মেজাজ, নারীপুরুষের সন্মানিত সমর্থিত মিলনের মহোৎসব।
            যদি এমনটা পড়েন,
                        তোমাদের বিয়ে হলো ফাগুনের চৌঠা
                        অক্ষয় হয়ে থাক সিঁদুরের কৌটা।
কাব্যবিশারদ হ্যাক ছি করতেই পারেন। কিন্তু জেনে রাখুন, এ স্বয়ং রবিঠাকুরের লেখা ‘বিয়ের পদ্য’। আবার একটি নমুনা এইরকম-
                        শুনিয়াছি ঠাকুরের পো আজকা তোমার বিয়া
                        বউ আনতি যাচ্চ তুমি ফেরেন্ডদের নিয়া।
                        গুড় মিটা চিনি মিটা আরও মিটা হানি
                        সব্বার থেকে ওয়াইফ মিটা জাইনে রাখ তুমি।
বানান ব্যাকরণ চলন বলন, বিয়ের পদ্যে সব বাজে কথা। আসল সত্যিটা হলো এই পদ্য লিখিয়ে ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত।
            বিয়ের পদ্য মানে প্রাণের বুলি। একটি পূর্ণাঙ্গ বাঙালি ছেলে বা মেয়ের যা যা পরিচয় থাকতে পারে, বংশ পিতামাতা পরিবার জন্মভিটে, বয়স চেহারা গুণ সমস্ত তথ্য হাজির থাকে বিয়ের পদ্যে। সমাজ ব্যবস্থার বর্ণনা থাকে না? পড়ে দেখুন তো-
                        দেখতে দেখতে ষোলোটি বছর  করলে তুমি পার
                        চললে এবার শ্বশুরবাড়ি মোদের ঘর ভরিয়ে আঁধার।
অর্থাৎ আঠারো নয়, তখন মেয়েদের ষোলোতেই বিয়ের রেওয়াজ ছিলো।
            আবার ধরুন, পদ্যের খসড়া লিখলো কেউ, তাঁর ওপর হাত মকশো করল কেউ যেমন, ঠাকুমা জেঠিমা পিসীমা হলে জ্ঞান মকশো হবে যেমন-
                        মাথায় সিঁদুর আর হাতে লোহা দিয়ে
                        চিরকাল ঘর কোরো পতিপুত্র নিয়ে
অথবা,
                        সীতা সাবিত্রী সমা       সতী ধর্মে অনুপমা
                                    স্বামীর ছায়া হয়ে থেকো অনুক্ষণ
                                    মা তুমি মোর হৃদয়ের ধন
আবার যদি বৌদি বা জামাইবাবুর হাতে পদ্যখানা পড়ে, তো এমন হয়ে যাবে-
                        এক মা
                        হেঁশেলে
                        হয়ে গেছে ক্লান্ত
                        নয়া হাতে
                        দুধে ভাতে
                        হোক ফের জ্যান্ত
অথবা,
                        ছি ছি সমীর-
                        তোমার কান্ড দেখে মরি!
                        সবার সামনে করলে তুমি
                        লোকের মেয়ে চুরি?
বুঝুন মজাটা আবার পদ্য লিখতে বসে নাকানি চোবানি খাচ্ছেন এমন নমুনাও পাওয়া যায়-
                        ভাইয়ের বিয়ে অদ্য     লিখতে বসেছি পদ্য
                                    সন্দেশ যেমতি চাই দধি পাতে পেলে
                        কিন্তু (হায় বিধি) একি ঝকমারি   যেটা এত দরকারি
                        সেই পদ্য লিখিতে শক্তি কেন নাহি দিলে
আবার আশীর্বাদ আহ্লাদ মিলেমিশে হয়ে যায় পদ্য-
                        মাইজিয়েও কইন বিয়া
                        বাবাজিয়েও কইন বিয়া
                        কুলকুলায়া হাসি উঠে দামান দেখিয়া
                        আমার কইন্যা সোনার বালি
                        মুক্তা ঝুরা হাসি
                        দামানকুলে পড়বো জোনাক
                        মিটমিটায়া আসি
উদাহরণ থাক একটা কাজের কথা বলি আমরা বড্ড হাহাকার করতে ভালোবাসি যা নেই তার হাহাকার আমাদের বেশ কোয়ালিটি টাইম পাস কিন্তু পজিটিভটাও ভাবুন, আজকের জেটসেট যুগে বাসরজাগা গান, নাপিতের ছড়া, ঘটক, লগ্ন পত্র, কামলাভোজন যেমন হারিয়ে গছে, আমরা কিন্তু বাঙালি বিয়ের কিছু কিছু মেজাজ ফিরিয়েও এনেছি ফিরিয়ে এনেছি কলাপাতা, মাটির খুরি, পরিজন দিয়ে পরিবেশন, সাধারণ ধাঁচে শাড়ি, ধুতি, শাঁখাপলা, আলতা সিঁদুরের সাজ, শালি বিদেয়, শয্যাতোলা, গেটধরা এমন কত আনন্দ একটা রাতের তো ব্যাপার, আমাদের কাছে ভালোই লাগছে এসবতেমনই, বিয়ের পদ্যটাকেও আনা যায় না? যাঁরা কবিতা লিখতে ভালোবাসেন, কবিতাকে ভালোবাসেন, দেশজ সংস্কৃতি ভালোবাসেন- একবার দেখবেন নাকি ট্রাই করে?
            বিয়ের মরশুম তো শুরুই হয়ে গেল!




অলংকরণ- কৃষ্ণেন্দু চাকি (সংগৃহিত) 
ছবি- সংগৃহিত  
                                               

                                                                                    

No comments:

Post a Comment