সম্পাদকের কথা
দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচিত একটি সরকার আগামী পাঁচ বছরের জন্য পুনরায় দেশের দায়ভার নিয়েছে।
বিপুল জনাদেশে নির্বাচিত সরকারের কাছে আমাদের সাধারণের প্রত্যাশাটিও বিরাট। আশা রাখি যে, সেই প্রত্যাশা পূরণে সরকার সফল হবে।
নির্বাচন প্রচার চলাকালীন এক কুনাট্যে ভ`রে গিয়েছিল আমাদের রাজ্য। ভাবতে বিস্মিত হই যে, এই রাজ্য ও এই রাজ্যের মহান পুরুষেরা একসময় সমগ্র ভারতকে আলো দেখিয়েছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না মহিলারাও। সকলের হাত ধরে যেন কাঙ্খিত মুক্তি এসেছিল আমাদের মননে, চিন্তায়, ভাবনায় ও সংস্কৃতিতে। বড় বিষন্ন হতে হয় তাই এই অধঃপাত দেখে। নির্বাচনের দিনগুলিতে যে হিংসা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তা ভীষণ বেদনাদায়ক। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় সবকিছু মিলে।
তবু আশা রাখি যে, আগামীদিনে সব অন্ধকার দূর হয়ে একটি আলোকজ্জ্বল সকাল আমাদের ঋদ্ধ করবে। আসবে এমন একটি সকাল যেখানে সমস্ত কলুষতা মুছে গিয়ে সবাই মানুষের জয়গান গাইবে। কেননা সবার ওপর মানুষ সত্য একথা ভুলে গেলে নিজের সঙ্গে অন্যায় করা হবে।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ১৪২৬
প্রথম পর্ব
প্রথম পর্ব
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
নিবন্ধ- ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দোপাধ্যায়, কুমকুম ঘোষ, কাকলি ভদ্র, অপরাজিতা দেবনাথ কর্মকার
কবিতা- তৈমুর খান, সুবীর সরকার, নরেশ রায়, ফিরোজ আখতার, দীপ্তিমান মোদক
রবির আলোয়- মৌসুমী চৌধুরী, সুপর্ণা চৌধুরী
বিশেষ নিবন্ধ- বটুকৃষ্ণ হালদার
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ১৪২৬
প্রকাশক - রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস - শৌভিক রায়
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
ইমেল-
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ১৪২৬
নিবন্ধ
রুদ্র ও মধুর নজরুল
ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির সাহিত্য ও সমাজের এক আশ্চর্য অগ্নিবীণা, কোনো একটি বিশেষ বিশেষণে তাঁকে বিশেষিত করা যায় না।বহু প্রশংসিত ও বহু বিতর্কিত বিরল প্রতিভার অধিকারী তিনি একজন উদারচেতা মানুষ ,তাঁর চরিত্রকে একই সঙ্গে রুদ্র ও মধুর রূপ দ্যুতিময় করে রেখেছে।তিনি বিদ্রোহের কবি, প্রতিবাদে র কবি আবার শান্তি ও সাম্যের কবি। প্রেম -সংঘাত, আস্তিকতা- নাস্তিকতা ধার্মিকতা -অধার্মিকতা সব ই তাঁর সাহিত্যে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
বাস্তবিক ই তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে র মধ্যবর্তী বাংলা তারুণ্যের প্রতিমূর্তি। তিনি নিজে ই বলেছেন 'সাহিত্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।আমি সাহিত্যে কি করেছি,তার পরিচয় আমার ব্যাক্তিত্বের ভিতর'।
তিনি প্রধানতঃ কবি ছিলেন তবে কেবল কবি ছিলেন না, তাঁর ছোট গল্প, শিশু সাহিত্য, উপন্যাস, নাটক, সাংবাদিক নিবন্ধ, চিঠি পত্র তাঁর শানিত লেখনী র জন্য আজ ও পাঠক হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
তিনি তাঁর লেখনী ধরেছিলেন দেশবাসী র মুক্তি চেতনা কে ত্বরান্বিত করার জন্য। মাত্র একুশ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্যে দেখা দিয়ে হঠাৎ ধূমকেতুর মতো আবার আকাশে বিলীন হয়ে গেলেন। চুরুলিয়া র দুখু মিঞা দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে ১৯১৭ সালে নাম লেখালেন ৪৯নং বাঙালি পল্টনে। দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল তাঁকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল তাই তিনি সেখান থেকে চলে এলেন কলকাতায়।
পরাধীন জাতির মুক্তি কামনা য় লেখনী ধরলেন। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা এক ই সঙ্গে মোসলেম ভারত ও বিজলী তে প্রকাশিত হল।দিকে দিকে জেগে উঠল বিদ্রোহী মন্ত্র।জনতার কন্ঠে এক ই অগ্নি ঝরা বাণী---
'চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত'
নজরুল ও তখন খ্যাতি র শীর্ষে। তিনি সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে তাই তাঁর তকমা হল বিদ্রোহী কবি কিন্তু এটি তো তাঁর খন্ড পরিচয় । অচলায়তন কে তিনি ভাঙতে চেয়েছিলেন তবে এই বিষয়টি তাঁর কবিতা র একমাত্র লক্ষণ নয় তাঁর কবিতা র আর একটি প্রধান উপাদান ভালবাসা। তাঁর লেখা গজল গুলি এবিষয়ে বড় প্রমাণ। 'দোলে দোলনচাঁপা দোলে দোল পূর্ণিমা রাতে ' গান টি র মাধুর্য্য কবির হৃদয় মাধুর্য্য কে ই ব্যক্ত করে। তাঁর অধিকাংশ প্রেমের কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে সিন্ধু হিন্দোল,ছায়ানট,পুবের হাওয়া ও চক্রবাক গ্রন্থে।
ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে শানিত লেখা র জন্য কবি র পাঁচ টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হল-যুগবাণী,বিষের বাঁশী, ভাঙার গান,প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দু । প্রলয় শিখা র জন্য প্রথম কারাবন্দী হলেন তিনি। পরে ধূমকেতু পত্রিকার আনন্দ ময়ীর আগমনে কবিতা টির জন্য এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হল তাঁর। আলিপুর থেকে হুগলি জেলে তাঁকে পাঠানো হলে সেখানে কতৃপক্ষের বৈষম্য মূলক আচরণের বিরুদ্ধে তিনি অনশন শুরু করেন । ঊনত্রিশ দিন পর তিনি অনশন ভঙ্গ করেন । জেলে থাকা কালীন তিনি লেখেন শিকল ভাঙার কবিতা -
'শিকল পরার ছল মোদের এই
শিকল পরার ছল।'
তাঁর লেখা কুহেলিকা ও মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস কে এক কথায় বলা যায় সর্বহারা দলের আলেখ্য। তাঁর মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস কে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয় কারণ পেটে র ক্ষুধা যে কিভাবে মানুষ কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তা এমন বাস্তবত সম্মত দৃষ্টি তে আর কোথাও আঁকা হয় নি। তবে তাঁর সমগ্র জীবন চেতনা র প্রকাশ ঘটেছে বাঁধন হারা উপন্যাসে। সেখানে উপন্যাসে র নায়ক নিজের ই নিজের পরিচয় দিয়েছে -'স্বেচ্ছাচারী নূরুল হুদা'। নূরুল নিজের সম্পর্কে বলে--আগুন,ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ,বজ্র, আঘাত বেদনা এই আট ধাতু দিয়ে তৈরি আমার জীবন'।
সত্যি তাই তাঁর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য - নজরুলের তুলনা তিনি নিজে। স্বজন হারানো র বেদনা য় তাঁর হৃদয়ের দুকূল ভেসে যায় আবার লেখনী তুলে নিয়ে দেশবাসী কে নতুন জীবন বোধের দীক্ষা দেন।
তিনি শিল্পী, মূর্তি গড়েন,কালী প্রতিমা ভালবাসেন। তিনি দরাজ সুরে দেবী পূজা করেন - 'আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন'....'ধর্মের ধ্বজা ধারীরা তাঁকে সমালোচনা করলেও তাঁর সংবেদনশীল হৃদয় দুই ধর্ম কে সমান ভালবেসেছিল।
তাঁর জীবন যেমন ঘটনা বহুল তেমনি তাঁর লেখা ও বহুমাত্রিক। শুধু বীর রস নয় আদিরস এমন কি হাস্যরসে ও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ।তাই তিনি বন্দীশালায় নিদারুণ কষ্টকর পরিস্থিতিতে ও হা হা করে হেসে বলে ওঠেন 'দে গরুর গা ধুইয়ে'।
শিশু দের বন্ধু ছিলেন নজরুল, শিশুদের জগৎ টাকে তিনি নানা রঙের তুলিতে সুন্দর করে এঁকেছেন। ছোটবেলায় পড়া 'ভোর হলো দোর খোলো' লিচুচোর ছড়া এখন ও মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
তাঁর প্রতিভার যেন শেষ নেই তিনি একাধারে গায়ক, গীতিকার ও সুরকার। রাগাশ্রয়ী গান ও নতুন ধারার শ্যামা সঙ্গীতে তিনি যেন এক মাইল স্টোন।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৪২ এর ৯ জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রোগ্রামের সময় তাঁর স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। অবশেষে ১৯৭৬ এর ২৯ শে আগস্ট তিনি মর্ত্যলোক থেকে পাড়ি দিলেন মহাশূন্যে।রেখে গেলেন মৃত্যুঞ্জয়ী সাহিত্য, সঙ্গীত ও সুরের মূর্ছনা।
১৯২৯ এর ১৬ ই ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে কবি কে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন সুভাষ চন্দ্র বসু যথার্থই বলেছিলেন 'নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির।'
তিনি সমগ্র জাতির প্রিয় কবি ,যেমন বুদ্ধিদীপ্ত গম্ভীরের তেমন আবেগপ্রবণ তারুণ্যের, মধ্যবিত্তের আবার মেহনতি জনতার,যেমন মেঠো সুরের কবি তেমন ই মজলিসের প্রাণভোমরা।এক ই সঙ্গে কড়ি ও কোমলের আশ্চর্য বিস্তার, বিপ্লবের সঙ্গে সুফি মরমিয়া র মিশ্রণ তাঁর লেখা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।এই উপ মহাদেশের দুই কবি আমাদের প্রাণ এক জন রবীন্দ্র নাথ আরেক জন নজরুল।
আমাদের প্রেরণা র উৎস, জীবনীশক্তি র উৎস কবি নজরুলের জীবন চারণ ও সাহিত্য চর্চা ও স্মরণে র র মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রতিভার কণা মাত্র যদি অর্জন করতে পারি তবে তাই হবে আমাদের চলার পথে পরম পাথেয়।
কাজী নজরুলের বিরল অসুখ
কুমকুম ঘোষ
"মুসাফির মোছরে আঁখিজল ফিরে চল্ আপনারে নিয়া"
সৃষ্টি ও প্রেমের দুরন্ত আগুন বুকে নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলার মাটিতে।শৈশবে পিতৃবিয়োগ তাঁকে বাধ্য করেছিল ধরণীর বুকে আপন প্রতিভা বিকাশের জায়গা খুঁজে নেওয়ার কাজে। অনাবিল প্রকৃতি ও সহৃদয় কিছু ব্যক্তি ছাড়া জীবন যাপনের কোন স্থায়ী পটভূমি ও তাঁর ছিল না। দুঃখ দারিদ্র্য ও উৎসারিত প্রাণচাঞ্চল্য সম্বল করে, তিনি তাই আজন্ম ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষের সাথে মানুষের খোঁজে : ছুটেছেন কখনও যাত্রাদলের "লেটো" গানের গায়কের বেশে, কখনো সঙ্গ করেছেন পিরফকির , আউল- বাউল , দরবেশের। কীর্তনের আখড়ায় গিয়েও প্রাণের খোঁজ, সৃষ্টি র রসদ সংগ্রহ করেছেন ; পড়েছেন মাদ্রাসা ইস্কুলে এমনকি ইংরেজী ইস্কুলের পাঠ ও গ্রহন করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর যাঁকে এই দুনিয়ায় মুসাফির এর ছদ্মবেশে পাঠিয়েছিলেন দুনিয়াদারির খোঁজে, কোন পাঠশালা কোন ইস্কুল কোন সমাজ তাঁকে আটকে রাখতে পারে?
"শূন্য এ বুকে পাখী মোর আয়, ফিরে আয় ফিরে আয়".......
জৈষ্ঠ্য মাসে জন্ম তাঁর কিন্তু তিনি ছিলেন দুরন্ত "কাল -বোশেখীর ঝড়" ; বর্ধমানের মাথেরুন স্কুলে ভর্তি হলেন, ছেড়ে চলে গেলেন যাত্রাদলের সঙ্গে। শেষবার বীরভূমের শিয়ারশোল হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণী থেকে ডবল প্রোমোশনে একেবারে নবম শ্রেণীতে উঠলেন; সেখানে বন্ধু পেলেন শৈলজানন্দ (মুখোপাধ্যায়) কে। কিন্তু কলেজের পড়া আর হোলো না, দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে "দুখু মিঞা" যোগ দিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে।দুই বন্ধুর একসাথে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু শৈলজানন্দ র "রায়বাহাদুর" দাদু নিজের নাতিকে আটকাতে পারলেন। কিন্তু তাঁকে আটকাবে কে? তিনি তো আজন্ম পথিক!! পৃথিবীর পাঠশালায় সৃষ্টির উত্তাপ ছড়াতে এসেছেন : চলে গেলেন করাচি-বালুচিস্তানের রণাঙ্গনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো ১৯১৯ সালে, ভেঙ্গে দেওয়া হলো উনপঞ্চাশ নং ব্যাটেলিয়ন ।বিশ বছরের "হাবিলদার কবি" ফিরে এলেন দেশে এবং এসেই হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলেন নানান কর্মকান্ডে। পরবর্তী দুইবছরের মধ্যে তরুণ কবির কবিতা প্রকাশিত হয়ে গেল, লেখা হলো সেই বিখ্যাত কবিতা " বিদ্রোহী" : রাজরোষে পড়লেন। জেলবন্দী হলেন।অনশন প্রতিবাদ করলেন এবং রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়ে উঠলেন।
প্রেমিক কবি কুমিল্লা র দৌলতপুরের নার্গিস সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে নিশ্চিত বিবাহ সম্পর্ক ছেদ করলেন বাধ্যতামূলক কাবিজনামায় (ঘরজামাই হবার প্রস্তাব) সই না করে। আবার পরবর্তী দুবছরের মধ্যে সমাজে আলোড়ন তুলে হিন্দু কন্যা প্রমীলা সেনগুপ্ত কে বিবাহ করলেন।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানান টানাপোড়েনের মাঝে সৃষ্টি র অবিরল ঝর্ণা ধারা বয়ে চললো। বাংলাদেশের সাহিত্য-সমাজ অবাক বিস্ময়ে এই বিপুল প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল,তখন তিনি "বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম", বয়স তিরিশের কোঠায়।
প্রথম দুটি পুত্র ( চারটি সন্তান ) অকালে হারালেন যার মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র কাজী বুলবুলের মৃত্যু অত্যন্ত আকস্মিকভাবে, এবং পত্নী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেন।আঘাত এলো অর্থনৈতিক দিক থেকে।একদা সহৃদয় ব্যক্তিরা সুযোগ বুঝে কবির অজস্র পান্ডুলিপি করায়ত্ত করলো নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে।ধার দেনা ও অপমানে বিপর্যস্ত কবি তখন।
আকস্মিকভাবে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ পেলেন, পেলেন গভীর আঘাতও। তার পরের বছরই ঘটল সেই অনিবার্য ঘটনাটি; যার অভিঘাতে জীবনের পরবর্তী চৌত্রিশ বছর এক নীরব শূন্যতার মাঝখানে অসহায় অস্তিত্ব হয়ে বেঁচে থাকলেন "বিদ্রোহী কবি"।
ঘটনাটি ঘটেছিল আকাশবাণী কলকাতা বেতারকেন্দ্রের বর্ষা ঋতুর ওপর এক সরাসরি সম্প্রচার করার সময়। সেদিন ৯ই জুলাই। তখন তিনি রেডিও র সংগীত বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একই সঙ্গে ভাষ্যপাঠ ও সঙ্গীত পরিবেশন করবেন তিনি। গ্রন্থনার দায়িত্বে ছিলেন অনুজ কবি ও ভাষ্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাক ই চলছিল কিন্তু কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান চলার পরেই হঠাৎই মাইকের সামনে জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল কবির, কথা জড়িয়ে গেল। উদাত্ত কন্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে আসতে লাগলো, চোখমুখ লাল হয়ে ঘামছেন তখন।গলার স্বর স্তব্ধ। পাশের সহযোগী শিল্পী রা কবিকে ধরে ফেললেন এবং নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষণা করলেন-- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আপাতত অনুষ্ঠান স্হগিত রইল... আকস্মিক এই বিপর্যয়ে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
১০ ই জুলাই,১৯৪২ সাল থেকে বাকী জীবন কবি যাপন করলেন নির্বাক হয়ে, চলমান শব্দময় পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এক নিভৃত গ্রহের বাসিন্দা হয়ে।
"ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি"........
কাজী নজরুলের বিরল অসুখ টির নাম--পিকস্ ডিজিজ( Picks Disease)। এই অসুখের অভিঘাতে রোগী বাকশক্তি ও বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। কবির ক্ষেত্রে ও সেটাই ঘটেছিল। ৯ই জুলাই,'৪২ এ আকস্মিকভাবে এই রোগে আক্রান্ত কবিকে আকাশবাণী স্টুডিও র বাইরে আনা হয়।সকলেই তখন ভেবেছিলেন কবি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার কোন লক্ষণ দেখা যায় নি।ভাবা হয়েছিল তিনিও স্ত্রী'র মত সন্ন্যাসরোগ বা স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ জনিত রোগের শিকার হয়েছেন।
কবিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কার্যত ১৯৪২-৫২ এই ১০ বছর কবির সঠিক রোগনির্ণয় হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের আদর্শবাদী কয়েকজন নেতার সহৃদয়তায় ও সাহায্যে সস্ত্রীক লন্ডন পাঠানো হয়।
সেখানে কয়েকজন বিখ্যাত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন এবং সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রাথমিক ভাবে অপ্রতুল চিকিৎসার শিকার কবির নিরাময় অসম্ভব। ইতিমধ্যে কবির মস্তিষ্কের বিশেষ এক্স রে রিপোর্ট সহ সবকিছু ভিয়েনা ও ইউরোপে পাঠানো হয়। কবিকে ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে স্বনামধন্য ডাঃ হ্যান্স হফ রোগটিকে সর্বপ্রথম "পিকস্ ডিজিজ(picks disease) বলে সনাক্ত করেন।
(এখানে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য এই যে লন্ডনের চিকিৎসকরা যেখানে কবিকে দেখার ভিজিট হিসেবে প্রতিবার ২৫০ পাউন্ড করে নিয়েছিলেন, সেখানে ইউরোপীয় চিকিৎসকরা বিনামূল্যে কবিকে পরীক্ষা করেছেন ও দেখেছেন)
এই অসুখের কোন চিকিৎসা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি,তখন তো ছিলই না।রোগটি প্রথম বর্ণনা করেন ডাঃ আর্নল্ড পিক( Arnold Pick)১৮৯২ সালে এবং রোগটি প্রথম রিপোর্ট করেন জার্মান ডাক্তার আলজাইমার্স(Dr Alois Alzheimer's)১৯১১ সালে।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়--
Picks Disease is a kind of dimentia, similar to Alzheimer's but far less common.It affects parts of the brain that control emotions, behavior, personality and language.Its also a type of disorder known as Frontotemporal Dimentia (FTD).....
এই অসুখে মস্তিষ্কের সামনে এবং পাশের দিকে (frontal & partial lobes) -র স্নায়ুকোষ সমূহ শুকিয়ে যেতে শুরু করে।অনুমান করা হয় তার পেছনে সেল এর কোন অভ্যন্তরীণ এনজাইম এর রাসায়নিক পরিবর্তন দায়ী। এখনও নিশ্চিত কোন কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। গবেষণা চলছে। মস্তিষ্কের ওইসব অঞ্চলে যেহেতু বোধবুদ্ধি, অনুভূতি,কথা বলা ইত্যাদির শেল্টার থাকে, সেই কারণে পিকস্ ডিজিজ এ আক্রান্ত রোগীদের ওইসব প্রকাশ আর থাকে না। শারীরিক ভাবে জীবিত থাকলেও তাঁরা জড়পদার্থের মতো হয়ে যান।
(তথ্য ঋণ : নবকুমার বসু-- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
বিনোদ ঘোষাল -- কে বাজায় বাঁশি
উইকিপিডিয়া )
ফুলভাবনায় কবি নজরুল...
কাকলি ভদ্র
নজরুল মানেই একটা কন্টকাকীর্ণ আলপথ পেরিয়ে কুসুমাস্তীর্ণ রাজপথের দিকে এগিয়ে চলা।নজরুল মানে প্রকৃতির ঝরনা থেকে ঝিলের জলে সুর ও ছন্দে ঝরের পড়ার মত বিবর্তনের এক অবিরাম প্রবাহ।
তিনি বলেছেন
‘'আমি দুর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল…’'
কিন্তু তাঁর এই দ্রোহের আড়ালে আছে দরদিয়া কোমল প্রকৃতির নিবিড় আলাপন। আছে নন্দনকানন থেকে পারিজাতকে পাওয়ার বাসনা। তাই তিনি তাঁর বইয়ের নামকরণে বেছে নিয়েছেন অনবদ্য ফুল-নাম। দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, মহুয়া—আরো কত নাম....যা তাঁর সৃষ্টিকে সুরভিত করেছে বার বার। তাঁর রচনাসম্ভারে নানাভাবে ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে। কখনো উপমায়, কখনো সরাসরি। যেমন—নার্গিস কখনো প্রিয়তমা, কখনো ফুল হিসেবে এসেছে। তিনি গেয়েছেন—
'‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে
ঝরা বন-গোলাপের
বিলাপ শোনে।''
নার্গিস আসলে ফুলের নাম। আমাদের দেশে গুলনার্গিস নামে একটি কন্দজ ফুল আছে। সেটি নজরুলের সেই নার্গিস নয় বলেই মনে করা হয়। তবে আমাদের দেশে এ ফুল চাষ হয় না বলেই জানি।
''রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেয়া।
শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া
ঝিলে শাপলা কমল
ওই মেলিল দল,
মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া’'...
বর্ষার কেয়া -কদম -শাপলায় সুরভিত হয়েছে...স্নিগ্ধতায় স্নাত হয়েছে তাঁর লেখনী।
তিনি গভীর ভাবনা-বোধ থেকে কোনো রূপসী নারীর পরনে পুষ্পালঙ্কার দেখেছেন, দেখেছেন কানে অর্জুনের ফুল আর গলায় কদমফুলের মালা—
'‘অর্জুন মঞ্জরী কর্ণে
গলে নীপ-মালিকা'’....
বাংলার অবহেলিত বুনোফুলও তাঁর কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি ফুলকে মেখলা সাজিয়ে দেখতেই বেশি আনন্দ পান। বাবলা ফুলের নাকছাবি আর নীল অপরাজিতার শাড়ি তাই তার উপমায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
'‘বাবলা ফুলের নাকচাবি তার
গায়ে শাড়ি নীল অপরাজিতার
চলেছি সই অজানিতার
উদাস পরশ পেতে।’'
কখনো তিনি তাঁর লেখায় খোঁপায় পরিয়েছেন অবহেলিত ধুতরা ফুল। ধুতরা ফুলের সৌন্দর্যও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি গান বেঁধেছেন—
‘কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো।
খোঁপা খুলে কেশ হ’ল বাউল লো’...
কোনো এক অভিসারের পথে কবি তাঁর প্রিয়তমার জন্য পুষ্পার্ঘ্য কামনা করেছেন। তিনি চেয়েছেন তাঁর মানসপ্রিয়া হেঁটে আসুক পুষ্পবিছানো পথ ধরে।
‘'দিও ফুলদল বিছায়ে পথে... বধূর আমার
পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুলদল
আজি তার অভিসার।’'
সাতভাই চম্পার পারুল কিন্তু একটি দুর্লভ ফুলের নাম। এই বিখ্যাত এবং দুর্লভ ফুলটি নিয়েও তিনি কাব্য করেছেন।
'‘সাতভাই চম্পা জাগরে
কেন বোন পারুল ডাক রে'’...
নজরুল কিশোরী রাধার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন—
'‘তুমি অপরাজিতার সুনীল মাধুরী
দু চোখ আনিলে করিয়া কি চুরি?
তোমার নাগকেশরের ফণী- ঘেরা মউ
পান করাল কে কিশোরী?’'
এখানে কবি অপরাজিতা এবং নাগেশ্বরের কথা বলেছেন।
আলতো ছোঁয়ায় নুয়ে পড়া লজ্জাবতীও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন—
'‘লজ্জাবতীর ললিত লতায়
শিহর লাগে পুলক-ব্যথায়
মালিকা সম বধূরে জড়ায়
বালিকা-বধূ সুখ-স্বপনে'’..
কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে আমরা পেয়েছি আমাদের চারপাশের সমস্ত চেনা ফুলগুলো। চামেলি, জুঁই, শিউলি, চাঁপা, মালতী, টগর, বকুল, বেলি, শাপলা, পদ্ম, বৈঁচি, পলাশ, কেয়া, হাসনাহেনা ইত্যাদি। তাঁর গানে ফুলের ব্যবহার সম্ভবত আর সব গীতিকারের চেয়ে বেশি করেছেন। উপমহাদেশে পাওয়া যায়, এমন প্রায় সব ফুলের কথাই তার গানে কোনো না কোনোভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি যেসব ফুলের প্রতি মানুষের কোনোরূপ আগ্রহ নেই, নজরুল সেসব নিয়েও অনবদ্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। যথা- 'দূর দ্বীপবাসিনী' গানে এলাচির ফুল-
''তব কবরী মূলে, নব এলাচির ফুল''
অন্য একটি গানে বেলের ফুল-
''বেল ফুল এনে দাও চাই না বকুল।
চাই না হেনা আনো আমের মুকুল"...
তিনি গেয়েছেন—
‘'পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে
অমলিন প্রেম-পারিজাত।’'
এই পারিজাত হল মান্দার... স্বর্গের ফুল।
অশোকের বর্ণিল রঙের কথাও পাওয়া যাবে এখানে—
'‘অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রঙ পিয়াসী মন-ভ্রমর গুঞ্জে,
ঢালো আরো ঢালো রঙ
প্রেম-যমুনাতে।’'
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর পরিবেশ আজ বড়োই বিপন্ন। নির্মম পরিবেশে আজ বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, যান্ত্রিক সভ্যতার বিষবাষ্প, গ্রীন হাউস এফেক্টের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অরণ্যের অবক্ষয় , বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি ইত্যাদি সমস্যা প্রকটরূপে দেখা দিয়েছে। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণ সমান তালে তাল মিলিয়ে চলছে। তাই আজ আমরা পরিবেশ দূষণ নিয়ে হইচই করছি।আজকের এই বিপন্নতার পৃথিবীতে কাজী নজরুল ইসলামের প্রকৃতি ভাবনা বড়োই প্রাসঙ্গিক।যত সময় গড়াবে তিনি আরো বেশি আবেদন যুগিয়ে নতুন সময়ের চাহিদা মিটিয়ে পাঠক মনকে যেমন করবেন উদ্দীপ্ত তেমনি সমাজে তাঁর লেখা নতুন করে
নতুন দিনের ছড়াবে আলোকবর্তিকা...
" ' বালক ' পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথ "
অপরাজিতা দেবনাথ কর্মকার
তদানীন্তন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিবার হয়ে উঠেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার।সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রেই এই পরিবার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসেও ঠাকুরবাড়ির পত্রিকাগুলি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।প্রথম বাংলা সাময়িকপত্রের প্রকাশ ঘটেছিলো ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে।অল্প পরেই ঠাকুরবাড়ির পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ' তত্ত্ববোধিনী ' প্রকাশের মাধ্যমে।' তত্ত্ববোধিনী 'র পর ক্রমশ ঠাকুরবাড়ির নানা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচিত্র প্রকাশ এখানে লক্ষ্য করা যায়।জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসের তথ্যাদির স্বর্ণখনি হলো এইসব পত্রিকগুলি।
এমনই একটি মাসিক পত্রিকা ' বালক ',যা সে সময় প্রকাশিত হতো ঠাকুরবাড়ি থেকে।এই পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ ঘটেছিলো ১২৯২ সালের বৈশাখ মাসে।
রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা তথা ভারতের প্রথম আই.সি. এস. অফিসারের সহধর্মিনী শ্রীমতি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছিলেন এই ' বালক ' পত্রিকার সম্পাদিকা।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তাঁর ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য কলকাতার ঠাকুরবাড়িতেই থাকতেন।এই ঠাকুরবাড়িতে তিনি ছোটদের নিয়ে ভাবতেন।তাই তো তিনি সেই কচি-কাঁচাদের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান করে তাদের জাগাবার চেষ্টা করেছিলেন।সেইমতো বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের জড়ো করে তিনি একটি পত্রিকা বের করেছিলেন ' বালক ' নামে।যা ছিল একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা এবং তার বার্ষিক মূল্য ছিল দুই টাকা।সেই পত্রিকাতে ঠাকুরবাড়ির বলেন্দ্র,সরলা,প্রতিভা,ইন্দিরা ইত্যাদি অনেকেরই সাহিত্যচর্চার প্রথম হাতেখড়ি হয়।
রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন চব্বিশ বছরের এক যুবক।সে সময় তাঁর মেজবৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তাঁকে এই পত্রিকায় ছোটদের জন্য লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।বৌঠানের এই ' বালক ' পত্রিকার জন্যই কবি ছোটদের লেখায় হাত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।কিন্তু মেজবৌঠানের এই নির্দেশ পালন করতে করতে দেখা গিয়েছিল একে একে পত্রিকাটির সমস্ত ভারই বর্তেছে রবীন্দ্রনাথের উপরে।পত্রিকার পাতা ভরাতে তাঁকেই লিখতে হচ্ছিল গল্প,উপন্যাস,নাটিকা,কবিতা,প্ রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনী।' বালক ' পত্রিকায় ছোটদের জন্য লিখছিলেন বলে লেখাগুলি যে সবসময় বালকোচিত হয়েছিল তা-ও নয়।বালকদের জন্য লেখা বলে রচনাগুলি যাতে লঘু না হয়ে যায় দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল তাঁকে।
' বালক ' পত্রিকাটির প্রচ্ছদ পত্রটি ছিল অতি মনোরম।একটি গাছের ডালে একটি পাখির বাসায় চারটি পক্ষীশাবক।তাদেরকে খাওয়াচ্ছে দুটি বড়ো পাখি।পাখির বাসাটির মাঝখানে লেখা ' বালক '।এই পত্রিকার প্রথম রচনাটি ছিল রবীন্দ্রনাথের বাংলার বর্ষণমুখর দিনের আদি ছড়া-- " বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদী এল বাণ "।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও যেমন বাল্য বয়সে পাঠ্য-অপাঠ্য বাছাই করেননি,টানেননি কোনো ভেদরেখা--গোগ্রাসে গ্রহণ করেছেন সব ধরণের রচনাই--অবিকল ঠিক সেই ধারাটিই বজায় রাখতে পেরেছিলেন ' বালক '-এর জন্য লিখিত বিবিধ রচনায়।
বস্তুত,' বালক '-পত্রিকা প্রকাশ কালে রবীন্দ্রনাথ যেন প্রকৃতই ' সব্যসাচী '-সাহিত্যিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।এর রচনাবৈচিত্র সেই সাক্ষ্যই দেয়।একদিকে রয়েছে ' মুকুট ',' রাজর্ষি ',ইত্যাদি গল্প-উপন্যাস,অন্যদিকে ' চিরঞ্জীবেষু ','শ্রীচরণেষু'র মতো বিতর্কমূলক পত্রগুচ্ছ।কিংবা ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য হেঁয়ালি-নাট্য।পত্রগুচ্ছে এবং হেঁয়ালি-নাট্যতে তাঁর তৎকালীন সমাজচিন্তা--শিক্ষাচিন্তার পরিচয়ও মেলে।তা ছাড়া আছে ভ্রমণকাহিনী ' রুদ্ধগৃহ ',' লাইব্রেরি ',' বাংলা উচ্চারণ ' জাতীয় গুরুগম্ভীর রচনা।গুরুনানক থেকে আকবর বাদশা কেউই বাদ পড়েননি।ছিল তাঁর শৈশবের একাকিত্বের সাক্ষী সেই পুকুর পাড়ের বটগাছটির কথাও---
" নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট,
ছোট ছেলেটি মনে কি পড়ে ওগো প্রাচীন বট ।" [পুরোনো বট : শিশু]
এছাড়াও তিনি লিখেছিলেন 'ফুলের ঘা','মা লক্ষী','লাঠির উপর লাঠি','সাত ভাই চম্পা','দশ দিনের ছুটি','ন্যায় ধর্ম','বীরগুরু','বরফ পড়া','শিখ স্বাধীনতা','বৈজ্ঞানিক সংবাদ','আহ্বান গীত','সংজ্ঞা বিচার','ডেঞ্চে পিঁপড়ের মন্তব্য','জন্মতিথির উপহার' ইত্যাদি।তবে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নিজে অবশ্য এই পত্রিকাতে লিখেছিলেন একটিমাত্র রচনা।
সব মিলিয়ে ' বালক '-এর পাতায় পাতায় আনন্দ বেদনার সঙ্গে সঙ্গে নানা বৈচিত্রের মিছিল চলছিল সে সময়।
কিন্তু বালকের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র এক বছরের।১২৯২ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত।তাঁর ভাষায় এক বছরের 'ওষধির মতো' ফসল ফলিয়ে পত্রিকাটি 'লীলা-সংবরণ' করেছিল।এরপর ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ থেকে যুক্ত হয়েছিল ঠাকুরবাড়িররই আর এক পত্রিকা ' ভারতী '-র সাথে।এই 'বালক ' পত্রিকা বিলুপ্তির অন্যতম কারণ ছিল ক্লান্ত কার্যাধক্ষ রবীন্দ্রনাথের দায়িত্ব ছাড়ার বাসনা।
কবিতা
পরামর্শরা
তৈমুর খান
এখন সব জানালা বন্ধ
পরামর্শরা বাইরে অপক্ষা করছে
শীত-গ্রীষ্ম চলে যাচ্ছে
মৌমাছিরা উড়ে যাচ্ছে পুরোনো চাক ফেলে
আবার বর্ষা আসবে
আবার বজ্র-বিদ্যুৎ ভর্তি আকাশ
জানালার ওপারে একটা দীর্ঘ ঘুমের প্রহর
একটা উপেক্ষার রাষ্ট্র
একটা বদ্ধ সমাজ
পরামর্শরা বৃদ্ধ হতে হতে একদিন কথা বলতেও ভুলে যাবে
নদীপুরাণ
সুবীর সরকার
উপনদীশাখানদীপরিধীতে সমস্ত ম্যাজিক ম্লান
হয়ে যায়
গাঢ় মেঘে ডুবে যাওয়ার ইঙ্গিত
ভুলা মাষাণের থান
অবসর ও অবসাদের দিনে কুন্ডলী
পাকানো সাপ
আহা এমন যদি হ’ত
নরেশ রায়
খেলার শেষে হাত ধরাধরি করে
ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডের দিকে একসাথে
বা বিজয়িকে করমর্দন করে হেসে
করতালি দিয়ে সম্বর্ধিত করতে পারে
হেরেও দুঃখেও , যেন প্রীতি ম্যাচ ।
রেফারির ভুলে কখনোও বা প্লেয়ারের
সাময়িক যুদ্ধ যুদ্দ পরিস্থিতি যেন
যেন সীমান্তে সীজফায়ার উলঙ্ঘন
তবুও খেলাশেষে হাসিমুখে হাতে হাত
বুকে টেনে উষ্ণ আলিঙ্গন ।
গণতন্ত্রের বড় ম্যাচের শেষে
সুখ ও দুঃখের হাসি হেসে
একসাথে আনন্দ দুঃখ ভাগ বাটোয়ারা
নাকি হারজিতের পরে কুরুক্ষেত্র
পরিণামে হরিনাম , হা ঈশ্বর ও — ।
চোব্য
কবিতা কি চিবিয়ে খাওয়া যায় ?
না, সে প্রশ্ন বড়ো অবান্তর । কিন্তু চিরন্তন ৷
ভাত চিবিয়ে খাওয়া যায়
ভাত চিবিয়ে খেতে হয় ৷
অন্ততঃ চিবিয়ে খাওয়া'র মতো কিছু দে...
কবিতা তো চিবিয়ে খাওয়া যায়না ৷
ঘুরে দাঁড়ানো
দীপ্তিমান মোদক
পরিশ্রম, তার ফসল
নীরবে চেয়ে দেখা আগুন।
"সত্য"দরজায় দাঁড়িয়ে বলে
এবার তো না হয় জাগুন।
"লোভ" সশরীরে ফাঁদ পেতেছে
দিয়েছি আমরা পা।
ওদিকে দেখি অশ্রু পতন
শূন্য কোলে "মা"।
তখন যদি এক হতাম
বাঁচত আট থেকে আশি
একবার যদি বলতাম " মা"-কে
তোমায় বড্ড ভালোবাসি।
আবার না হয় ঘুরে দাঁড়াই
রক্ষা করি "মা"-কে
কতদিনই বা বাঁচা যায়
এমন অদৃশ্য পাঁকে।
রবির আলোয়
বিচ্ছেদ
মৌসুমী চৌধুরী
কবিগুরুর ভাবধারায় মানুষ হয়েছিল ওরা। "টেগোরর্স স্টাডি" ক্লাসে পড়া রবীন্দ্র দর্শনে বিশ্বাস রেখে বড় হয়েছিল ওরা -----"সভ্যতার মূল দেহে দেহে প্রতিযোগিতা কিন্তু মনে মনে সহযোগিতা। এইভাবে মানুষ তার ব্যক্তি-মানুষকে ছাড়িয়ে বৃহৎ-মানুষ হয়ে উঠতে চাইছে। এই বৃহৎ মানুষ তারই অন্তরের মানুষ -- মনের মানুষ। এই মানুষের জাত নেই, ধর্ম নেই, সমাজ-সংসার কিছুই নেই। সে শুধুই মানুষ।" কথাগুলো বিশ্বাস করত ওরা ---- শবনম আর কৃষ্ণেন্দু।
ছায়াময় বকুল বীথির ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ওদের গায়ে চুঁইয়ে পড়ছিল দোল পূর্ণিমার রুপোলী জ্যোৎস্না। হাতে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে শেষবারের মতো বসে ছিলো ওরা। দূরে গৌর প্রাঙ্গন থেকে ভেসে আসছিল, "ন্যায় অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে---/ শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি/ ওগো সুন্দরী।" নাহ্, কৃষ্ণেন্দু একথা বলতে পারে নি শবনমকে। নাহ্, ভালোবেসে ঘর বাঁধা হল না ওদের।
ওদের মাঝে সমাজের আগুণ চোখ, বরফ চোখ --- ওদের মাঝে মন্দির আর মসজিদ ---- ওদের মাঝে আমরা-ওরা। সেজন্যই শুধু নিজেদের সুখের জন্য প্রিয়জনদের জীবন বিপন্ন করতে পারে নি ওরা দুজনেই। প্রেমের সমস্ত ছক বাঁধা চরিতার্থতার বাইরে বিচ্ছেদেই ওরা তাই গাঁথতে চাইল মিলনের মণিহার।
...কেননা গত সপ্তাহেই মজজিদ ফেরৎ শবনমের বাবাকে কারা যেন প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে গেছে, মুখে তাদের ছিল "জয় শ্রীরাম" ধ্বনি, ওদিকে বাজার থেকে ফেরার পথে গলির মোড়ে কৃষ্ণেন্দুর বাবাকে "মুন্ডু কেটে ফুটবল খেলব" বলে শাসিয়ে গেছে আল্লাহ্-র বান্দারা।
রবির আলোয় উত্তরণ
সুপর্না চৌধুরী
সন্ধ্যের শুরুতে আকাশে ঘন মেঘ জমাট
বেঁধেছে। ঘরে ঢুকে সৌমেন দেখল ঘর
অন্ধকার করে জানালার পাশে বসে আছে
শমিতা। টের পায় নি সৌমেনের আগমন।
পেছন থেকে শমিতাকে জড়িয়ে ধরে সৌমেন গেয়ে উঠল--- "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা"।
শান্ত অবসন্ন গলায় সমীতা বলল, "কখন এলে তুমি?"
উত্তরে সৌমেন বলে, "এইমাত্র। কিন্তু তুমি এভাবে ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?"
ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে সৌমেন জানতে চাইল, "এই তো ঘন্টা খানেক আগে তুমি ফোনে জানালে ঠিক মত ওষুধ খেয়েছ, ব্যায়ামও করেছ। হঠাৎ কি হল?"
"অন্ধকারটা ভাললাগছে তাই", উদাস
গলায় শমীতা বলল।
শমীতার মনের ভেতরটাও যে আজ বাইরের প্রকৃতির মত মেঘাচ্ছন্ন সৌমেন তা বুঝতে পারল।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরতা শমিতা এক মোটর দুর্ঘটনায় চলাফেরার শক্তি হারিয়েছে। হুইল চেয়ারই
এখন তার নিত্যসঙ্গী। পরিস্থিতি তাকে হীনমন্য আর বড় বিচলিত করে দিয়েছে।
স্বামী সৌমেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। রবীন্দ্র সাহিত্যকে সে অন্তর
দিয়ে উপলব্ধি করে জীবনের প্রতিটি বাঁকে।
শমিতার মনের গুমোট ভাবটিকে হালকা করতে সৌমেন তাকে বলল,
"সত্যি অন্ধকারেরও একটা রূপ আছে, একটা ভাষা আছে। সেও তো কিছু বলতে
চায়। তার বক্তব্য আর ভাষা দিয়ে নিজেকে উপলব্ধি কর তো।"
শমিতার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, "আমার জীবনটা এই মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যের মত অন্ধকারময় হয়ে গেছে। আর তো স্বাভাবিক হবে না।"
সৌমেন বলে উঠল, "কেন হবে না? তুমি কবিগুরুর হাত ধর। তিনি তাঁর গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গানে মানুষের অক্ষমতাকে কাটিয়ে ওঠার কত পথ দেখিয়েছেন। তোমার জীবনে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে তো ঠিকই, কিন্তু তা বলে জীবন তো স্তব্ধ হয়ে যায় নি। জীবন তো থেমে থাকবে না, চলবে উত্তোরণের পথ বেয়ে। তোমাকে আবার তোমার কর্মজগতে ফিরে যেতেই হবে শমি।"
রবীন্দ্র-সাহিত্য হাতড়ে সৌমেন বলে
চলে, " রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহজপাঠের দ্বিতীয় ভাগে অন্ধ কুঞ্জবিহারির কথা বলেছেন; সে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে এক পোড়ো মন্দিরে। একটি কুকুরকে সে নিচ্ছে সাথী হিসেবে। গান গেয়ে কুঞ্জবিহারি মানুষের মন জয় করছে। মানুষ প্রতিদানে তার প্রতি কর্তব্য করছে।"
উজ্জ্বল মুখে শমিতা শুনতে থাকে সৌমেনের কথা। মনের মেঘ ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে তার।
গমগমে স্বরে সৌমেন বলে চলে, "আবার দেখ 'ফাল্গুনী'র অন্ধ বাউল শব্দ ও অনুভূতির সাহায্যে অপরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। "সুভা" গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন মূক সুভা মূক প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে এক অন্য জগতে উন্নীত হয়েছে। সংসার সুভাকে প্রত্যাখ্যান করলেও সে ওই উচ্চতাতে স্থিত হয়েছে। তারপর দেখো, ক্ষুদ্র জোনাকির মধ্যে যে আলো উৎপাদনের শক্তি আছে , আলো বিতরণ করে আঁধার কাটিয়ে ওঠার শক্তি
আছে, তাকে সম্মান করেছেন রবীন্দ্রনাথ
'তুমি ছোট হয়েও নও তো ছোট' বলে।" সৌমেনকে জড়িয়ে ধরল শমিতা। সৌমে- নের কথাগুলোর মধ্যে প্রবল এক শক্তি খুঁজে পেল সে, "তোমার মধ্যেও শক্তি আছে তাকে খুঁজে বের কর, শমি। তাকে
ধরেই এগিয়ে চল তুমি।"
"আত্মস্থ কর রবীন্দ্রনাথের সেই লাইনগুলো, কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস!/ হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো মোরা পরিহাস।"
অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে সৌমেনের কথা শুনছিল শমিতা। এবার সে দৃঢ গলায় বলে উঠলো, "আমিও আমার পথ খুঁজে পেলাম। আর ভুল হবে না আমার।" হঠাৎই দরাজ গলায় শমিতা গেয়ে উঠল,
"ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো..."।
রবীন্দ্র-অনুষঙ্গে জীবন দীপ জ্বালাতে পেরে আনন্দে শমিতার সাথে গলা মেলাল সৌমেনও...
বিশেষ নিবন্ধ
একটু দূষণ মুক্ত জল চাই
বটু কৃষ্ণ হালদার
আজ সারা বিশ্ব জুড়ে একটু দূষণ মুক্ত জলের হা হা কার বেড়ে চলেছে দিন দিন, এক বিন্দু শুদ্ধ জলের মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবন বাঁচার রসদ. সংবাদ মাধ্যম, খবরের কাগজের শিরোনামে চোখ রাখলে একটা খবর সংবাদের শিরোনামে প্রতি মুহূর্তে অবস্থান করছে তা হলো দূষণ. ভেজাল খাদ্য আর ধর্ষণ যেমন সামাজিক ও মানসিক দূষণের মূল স্তম্ভ, তেমনই জীবন বাঁচার অন্যতম অবলম্বন জল দূষণ এর মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে. এগুলি বন্ধ না হলে কিভাবে গড়ে উঠবে উন্মুক্ত দূষণ মুক্ত সমাজ, এইভাবে একদিন হয় তো এই সুন্দর পৃথিবী একদিন বন্ধ্যা তে পরিনত হবে আমরা আজ তা বেশ বুঝতে পারছি. থমকে যাবে উন্নত বিকাশের ধারা, আসুন আমরা সবাই মিলে গাড়ি এক দূষণ মুক্ত পৃথিবী. যার ছত্র ছায়ায় বাঁচবে আগামীর ভবিষ্যত. এ সব দেখে শুনে প্রশাসন নির্বিকার, তাই এই সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারবদ্ধ নিজেদের হতে হবে, চাই সচেতন মানসিকতা. তাহলে আবার এই পৃথিবীর হাস্যজ্জ্বল রূপ, শিশুর হাসির ন্যায় ভোরে যাবে বিশ্ব জননীর আঁচল.
জল মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা. আজ এ সময়ে দাঁড়িয়ে জলের গুরুত্ব বিশেষ বোঝানোর দরকার হয় তো নেই, কারণ জল সামাজিক জীবনের এক এবং অন্যতম চাহিদা. সেই জল আজ দূষিত হচ্ছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে, আর তার মূল কারণ হলো আমরা নিজেরাই এর থেকে বড় লজ্জার আর কি হতে পারে. আজ আমাদের কারণে পবিত্র গঙ্গায় বইছে দূষণের মহা প্লাবন.
শস্য, শ্যামলা, ফল ফুলে সোভিত আমাদের পূর্ন ভূমি ভারত বর্ষ. গঙ্গোত্রী হিমবাহের পাদদেশে থেকে গঙ্গার উৎপত্তি. পৌরানিক কাহিনীতে শোনা যায় নীল কণ্ঠর জটা হতে উৎপত্তি হয়ে বয়ে চলেছে সমগ্র জায়গায় নীরবে, বন্ধ্যা ভূমি কে করে তুলেছে উর্বর ও পবিত্র. সেই গঙ্গা আজ নিজের সন্তান দের রক্তে সিক্ত হচ্ছেন প্রতি নিয়ত সইছে অপমান. গঙ্গা স্বয়ং ইশ্বরের বরদান, সেই গঙ্গা আজ দূষিত ও কলুষিত. এর জন্যে দায়ী কারা? যদি প্রশ্ন করা হয় কয়েকজন ব্রিটিশ ভারত বর্ষে এসে কিভাবে প্রায় দুই শত বছর রাজত্ব করেছিলেন? তাই মনে হয় অন্যের দিকে আঙুল না তুলে প্রশ্ন টা নিজের বিবেকের কাছে করা টা শ্রেয় বলে মনে হয়. এক নারী যেমন নিজের পরিবার ছেড়ে অন্যের সংসার আলোকিত করার জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেন, ঠিক তেমনি গঙ্গার অবদান. ঠিক গঙ্গা যুগের পর যুগ তার অবারিত ধারা বয়ে নিয়ে ভারত তথা বিশ্বের দরবারে নিজেকে বারংবার স্বচ্ছ তথার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন. আদি পূর্নবতি তে পরিণত হয়েছে. বিশ্বের নদী মাতৃক দেশ হিসাবে ভারতের মানচিত্র কে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে.
জল হল জীবন, তা বোধ হয় বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না. জল সমগ্র জীব বৈচিত্র কে প্রভাবিত করেন. প্রতিনিয়ত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানব জীবন চক্র জলের দ্বারাই অতিবাহিত হয়. বিশেষ করে খাদ্য তে শুদ্ধ জল অপরিহার্য. উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের ক্ষেত্রে জল অপরিহার্য উপাদান. জীব কুল এর জলের প্রয়োজন তথা ছোট্ট শিশু দের জন্য অপরিহার্য বিশুদ্ধ জল. কারণ তারাই দেশের ভবিষ্যত. উন্নত বিকাশের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ জল অমৃত সম.
কথায় বলে পেট ভালো যার সব ভালো তার, পেটের একমাত্র অপরিহার্য হোল বিশুদ্ধ জল. সেই জল দূষিত হচ্ছে নোংরা আবর্জনার কারণে, তার উপর প্লাস্টিকের ব্যবহার জলের জীবন কে বিনষ্ট করে চলেছে দিন দিন আর এই গুলি আমরা জেনেশুনে ব্যবহার করি. এ সময়ে জল দূষণ হচ্ছে আর্সেনিক এর কারণে দূষণ হচ্ছে তা দিন দিন বেড়ে চলেছে. হয়ে পড়েছি রোগগ্রস্ত. মানব দেহে লিভার হোল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সেই লিভার ও কিডনির পথ্য হল জল. তার সঙ্গে বেড়ে চলেছে মানসিক রোগ, হার্ট এর সমস্যা, অল্প বয়সে চুল সাদা হচ্ছে, বাড়ছে চর্ম রোগ. শিশুদের বুদ্ধি নষ্ট হচ্ছে, নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে আসছে, বুঝতে পারছেন তো এই বিশ্ব আস্তে আস্তে বন্ধ্যা তে পরিনত হতে চলেছে. "একটা গাছ একটা প্রাণ" সেই জীব কূল এর প্রাণ ধারণের রসদ লুকিয়ে আছে গাছের মধ্যে. গাছ সালোকসংশ্লেশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার তৈরি করে, মূল দিয়ে শোষিত জল, পাতায় উপস্থিত ক্লোরোফিল এর দ্বারা সূর্যর রশ্মি ও বাতাস সহযোগে. খাবার তৈরির পর গাছ অক্সিজেন দেয় পরিবেশ কে, এবং নিজে কার্বন ডাই অকসাইড গ্রহণ করে নেয়. আর প্রাণী কুল অক্সিজেন গ্রহণ করেন এবং কার্বন ডাই অকসাইড বাতাসে ত্যাগ করে. জীবের সঙ্গে উদ্ভিদ এর সম্পর্ক নিগুড়. সেই বাঁচার রসদ জল, আলো, বাতাস, মাটি আজ দূষিত. এই ভাবে চলতে থাকলে বন্ধ হয়ে যাবে ক্রিয়া, বিক্রিয়া উদ্ভিদ ও প্রাণী কুলের. পরিবেশ যতো দূষণ হবে ততই বাড়বে রোগব্যাধি. জন্ম নেবে বিকলাঙ্গ সন্তান সন্ততি. চোখের সামনে নিজ সন্তান দের এমন পরিনতি দেখে নীরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না.
আসুন আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি দূষণ মুক্ত সমাজ. আসুন এই পৃথিবীকে আমরা শিশুদের বাস যোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার এ আবদ্ধ হই সবাই মিলে. কোনো দূষণ জাতীয় কোনো দ্রব্য পরিবেশে ছাড়িয়ে দেয়ার আগে আমরা ভাববো আমাদের পরর্বতী প্রজন্মের কথা. বিশেষ করে প্লাস্টিক এর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে. আসুন আমরা এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করি প্লাস্টিক এর ব্যবহার বন্ধ করব. হাতে হাত রেখে আমরা এগিয়ে আসব আমরা এই সুন্দর পৃথিবী কে আরো সুন্দর থেকে সুন্দরতর করে তুলতে।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ১৪২৬
No comments:
Post a Comment