সম্পাদকের কথা শীত শেষ হতে চলল। বাতাসে বসন্তের আগমন স্পষ্ট।
এই সময়ের হাতছানি এড়ানো বড্ড কঠিন। তাই গড়পড়তা সাধারণ মানুষ নিজেদের সাধ্যমতো সাধ মেটাতে চায়। বেরিয়ে পড়তে চায় গতানুগতিক জীবন থেকে।
মুজনাইয়ের এই সংখ্যাও সেই বার্তা দিচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে ঘরবন্দি পাঠকের জন্য নিয়ে এসেছে ভ্রমণের আনন্দ, মুক্তির স্বাদ।
বাকি যা থাকলো আর সবটাই ইচ্ছে আর তা পূরণের চেনা গল্প!
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী, দেবাশিস ঘোষ, চিত্রা পাল, কুমকুম ঘোষ, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, গৌতম চক্রবর্তী, জয়িতা সরকার, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, অদিতি মুখার্জি (সেনগুপ্ত), দেবর্ষি সরকার, স্বপন কুমার দত্ত
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
শ্রীনগর থেকে সড়কপথে লে- লাদাখ
কুমকুম ঘোষ
১ম দিন :- শ্রীনগর থেকে শোনমার্গ , জোজিলাপাস হয়ে দ্রাস ও কার্গিল
দিনটা ২২শে মে' ২০১৯। শ্রীনগরে একদম ডাল লেকের মুখোমুখি হোটেল SUNSHINE এর নীচের টেরেসে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই।আলুর পরোটা তরকারি দিয়ে ঠেসে ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছি। এবারের লে- লাদাখ ভ্রমণের টিমে ছ'জনের মধ্যে আমরা দুজন ছাড়া আছে আমার দিদি জামাইবাবু শুভ্রা ও অসীম ব্যানার্জি এবং দিদির ননদ,অসীমদার ছোড়দি কৃষ্ণা ব্যানার্জি ও দিদির বেয়ান পুষ্প ঘোষ। ঝকঝকে আকাশ আর সামনে ডাল লেকের বুকে শিকারা ঘুরছে।সে এক অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি সবাই মে' মাসের হাল্কা ঠান্ডায়। এমন সময় একটা নতুন ইনোভা থেকে লাফ দিয়ে নামলেন চালক হোসেন ভাই। শ্রীনগর টু লাদাখ আবার ব্যাক শ্রীনগর এই পুরো ট্যুর এর গাড়ির বন্দোবস্ত করেছিল জম্মুর ট্যুর অপারেটর। সমস্ত হোটেল এর বন্দোবস্ত দেবাশিসের চেনা অপারেটর স্বপনবাবু। নতুন ইনোভা দেখে আমাদের মনটা তো আনন্দে নেচে উঠল কিন্তু মাল তুলতে গিয়ে দেখা গেল তার মাথায় ক্যারিয়র লাগানো নেই। ফলতঃ আমাদের সব কটা সুটকেস ব্যাগ ডিকিতে ধরছে না। প্রাক্তন এস এস বি কম্যান্ডো হোসেন ভাই একসময় কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম এ পোস্টিং ছিলেন। সমাধান করলেন বিন্দাস।এখন দুটো সুটকেস পেছনের সিটে ঠাসিয়ে দিলেন। আমার বর দেবাশিস আর অসীমদার ঘন্টা খানেক অসুবিধে হবে বটে কিন্তু কিছু টা এগিয়ে কার্গিলের গাড়িতে ওদুটো তুলে দেবেন। পৌঁছে যাবে সেখানকার হোটেলে নির্বিঘ্নে।কার্গিলে গিয়ে উনি গাড়িতে ক্যারিয়ার লাগিয়ে নিয়েছিলেন,পরের জার্নিতে আর অসুবিধা হয়নি। আমাদের ও উপায় নেই। ছোড়দির পা' এর প্রবলেম সামনে বসলেন , আমরা তিনজনে মাঝখানের সিটে। লাদাখ ঘোরার সময় কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বন করতেই হয়। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট খুব কমন সমস্যা। ডাক্তারের পরামর্শ আমরা আগেই নিয়েছিলাম বিশেষ করে দিদি,অসীমদা ছোড়দি তিনজনে ষাট পার করছেন। হোমিওপ্যাথি coca-6,coca-30 এবং এলোপ্যাথি র Diamox ।
শ্রীনগর - লেহ্ হাইওয়ে ধরে আজ আমাদের গন্তব্য কার্গিল। দূরত্ব ২০৪ কিমি এবং সময় লাগবে ৫ ঘন্টারও বেশী। সেখানে রাতটা কাটিয়ে পরদিন,২৩শে মে আমরা পৌঁছাবো লাদাখের রাজধানী লে(Leh)তে। ।ফ্লাইটে দিল্লি থেকে সরাসরি লেহ্ যাওয়া যায়।তাতে সময়ের সাশ্রয় হয় কিন্তু লে' র উচ্চতায় কিছু সমস্যা হয়, বিশেষ করে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া এই ট্রিপের কমন প্রবলেম। তাই আমরা সড়কপথ বেছে নিয়েছি সইয়ে সইয়ে হাই অলটিচ্যুড এ পৌঁছনোর জন্য।সময় লাগলেও এই পথের সৌন্দর্য অতুলনীয়।সড়কপথে হিমাচল প্রদেশ র মানালি দিয়েও যাওয়া যায়, তবে সেই রাস্তা একটু টাফ।
আমাদের রুটে প্রাইভেট কার ছাড়াও অনেক বাইক দেখেছি। বাইকার দের প্রিয় রাস্তা এটি। এমনকি পৃথিবীর সবথেকে উঁচু মোটরেবল রাস্তা খারদুংলা পাসেও বাইকার দেখেছি অজস্র এমনকি সাহসী মহিলা বাইকার ও দেখেছি।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। শ্রীনগর থেকে শোনমার্গ ৮৬ কিমি,এটা কাশ্মীরের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। দূরে পীরপঞ্জাল পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের টুপি, ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে অতি প্রাচীন ঘন গাঢ় সবুজ পাইন ও ফার গাছের সারি , মাঝখানে বয়ে চলেছে পাহাড়ী ঝর্ণা। জল জমে বরফ হয়ে সেগুলো স্থির এবং দেখতে লাগছে লম্বা লম্বা সাদা ফিতের মতো। প্রতিটা স্তব্ধ ঝর্ণাধারা ঘন সবুজ পাইন - জঙ্গলের বুক চিরে নেমে এসেছে।কোথাও পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাসজমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে লোমশ ভেড়ার দল। যাকে বলে নয়নাভিরাম দৃশ্য। এ যেন চোখের আরাম ও পর্যটক মনের অপার তৃপ্তি। ড্রাইভার ভাই বলছিলেন কত ব্লকবাস্টার হিন্দি সিনেমার শুটিং হয়েছে এই শোনমার্গে বিশেষ করে ষাটের দশকের বিখ্যাত নায়ক শাম্মী কাপুরের সিনেমার নামগুলো বলছিলেন। এই পর্বে আমরা শোনমার্গে থামবো না, আমাদের গন্তব্য এখন ভূগোল বইতে পড়া বিখ্যাত জোজিলা পাস যাকে gate way of Laddakh বলা হয়। উচ্চতা ১১,৫৭৬ ফিট।
এই রাস্তায় প্রথম উল্লেখযোগ্য স্পট বালতাল। এখান থেকে অমরনাথ যাবার সূচনা হয়।অন্যটি পহেলগাঁও এর চন্দনবাড়ি দিয়ে। এক জায়গায় প্রচুর গাড়ি। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম।যানজট হয়েছে সামনে। জায়গাটার নাম মনে নেই এখন কিন্তু গুমরি এখান থেকে ১৩ কিমি সোজা এবং ডানদিকে ৫কিমি গেলেই বালতাল।এই অঞ্চল থেকেই বরফের রাজ্য শুরু হয়ে গেল। পুরো রাস্তার দুপাশে ই বরফের দেওয়াল এতো কাছে যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। রাস্তায় বরফ গলা জল কাদা। অবশেষে দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুমরি তে।
পুরো এলাকা বরফের সাদা চাদরে ঢাকা। এখানে আছে জোজিলা ওয়ার মেমোরিয়াল।পাথরে খোদাই করা বীর সেনানী দের নাম।১৯৪৮ সালে শত্রুর হাত থেকে যাঁরা এই জোজিলা পাস রক্ষা করেছেন দেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন তাঁদের স্মৃতি- স্মারক। সিঁড়ি দিয়ে উঠে জাতীয় পতাকা লাগানো সেই স্মারক স্তম্ভের দুপাশে বরফের স্তূপ একটি মন্দির ও তাকে ঘিরে রঙ বেরঙের থাঙ্কার মত পতাকা লাগানো আছে।সাদা বরফের পটে সেনাবাহিনীর শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক যেন। এখানে আমরা আর বেশীক্ষন থাকলাম না।কারণ পরের গন্তব্য দ্রাস । আমরা পৌঁছে গেছি ১১,৬৪৯ ফুট উঁচুতে দ্রাস এ। শ্রীনগর থেকে ১০৪ কিমি দূরে। Project Vijayak এর অন্তর্গত এই ভয়ানক বিপজ্জনক রাস্তা টি সেনাবাহিনীর এর আন্ডারে থাকে( Border Roads Organization) । এই রাস্তা ধরেই আমরা কার্গিল হয়ে লাদাখের রাজধানী লে তে পৌঁছে যাবো।তখনো লাদাখ আলাদা ইউনিয়ন টেরিটরি হয়নি, জম্মু কাশ্মীরের অংশ ই ছিল।
দ্রাস পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। উচ্চতা ও ভৌগলিক অবস্থান এর জন্য দায়ী। আমাদের গাড়ি এসে থামলো মেমোরিয়াল এর ঠিক সামনে। মহারাষ্ট্রের নাম্বার প্লেটের একটি লাল জিপ কম্পাস গাড়ি অনেকক্ষণ থেকেই আমাদের সঙ্গে চলছিল।এরা স্বামী স্ত্রী ও শিশু পুত্র নিয়ে নাগপুর থেকে সড়কপথে লেহ্ যাবেন। সাহস বটে। এরাও থামলেন।
ওয়ার মেমোরিয়াল ঘুরে দেখলাম। দূরে টাইগার হিল পয়েন্ট নির্দেশ করছিলেন এক সেনানী। সত্যি বলতে কি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও সাহসের এক অন্যতম নিদর্শন এই মেমোরিয়াল। একদিকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরে সারি সারি কার্গিল যুদ্ধের শহীদ বীর সেনাদের নাম লেখা। আমাদের পুষ্পদি' র প্রয়াত স্বামী সেনাবাহিনীতে ছিলেন বহুদিন। স্বাভাবিকভাবে খুব ই আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়লেন। মেমোরিয়াল এর একদিকে একটা ফাইটার প্লেন ও বোফর্স কামান রাখা আছে কার্গিল যুদ্ধের অন্যতম স্মারক হিসেবে। যে সৈনিক ভাই মেমোরিয়াল এর সামনে প্রতীকী পাহারা দিচ্ছিলেন তাঁর সাথে ছবি তোলার অনুমতি দিলেন।
দুপুর গড়িয়ে গেছে।ঠান্ডায় হাত পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে, খিদেও পেয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে পেলাম গরম চা কফি দশ টাকায়।সিঙ্গারা দশ টাকা।ছ'টার এক প্লেট মোমো তিরিশ টাকায়। পাশেই একটা হলে কার্গিল বিজয়ের ছোট ফিল্ম এর প্রর্দশনী হচ্ছিল। আর কেউ রাজী নয়, আমি একাই দেখে এলাম একশ টাকার টিকিটে।
তখন বেলা পড়ে এসেছে।স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।একদল ছাত্র ছাত্রী পিঠে ব্যাগ নিয়ে বাড়ীর পথে চলেছে। এবার আমরা দ্রাস থেকে কার্গিলের পথে রওনা দিলাম। বরফের দেওয়াল দূরে সরে গিয়ে দেখা দিল সুরু নদী। এটা সুরু উপত্যকা। আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর সেখানটায় যেখানে পাকিস্তানের গোলা এসে পড়েছিল।এখন উঁচু পাঁচিল দেওয়া। হোসেন ভাই এর সুন্দর দোতলা বাড়িটা দেখালেন নদীর ওপারে। নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের কোলে এমন একটা বাড়ী আমাদের স্বপ্নেই থেকে যাবে।
কার্গিলে আমরা ছিলাম হোটেল BARU LA তে।
রুমে র কোনো চাবি নেই। যদিও একরাতের ব্যাপার তবুও চাবি চাইতে গেলাম রিসেপশনে। শুনলাম-- ম্যাডাম ইঁহা পর চোরি তো নেহি হোতা।ফির আপ কাঁহা তো ঢুঁঢনা পড়েগা-- ওরে বাবা বলে কি! দুর্নীতি সূচকে যে দেশ তখন ৮০ তম ( এখন ৬ ধাপ নেমে ৮৬) সেখানে চুরি নেহি হোতা? থাক্ ভাই আর ঢুঁঢতে হবেনা -- মনে মনে বলে রুমে ফিরে আসি। জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা বটে!
২য় দিন:- কার্গিল- মুলবেক মনস্ট্রি -ফতু লা টপ - লামায়ুরু মনস্ট্রি- মুনল্যান্ড- ম্যাগনেটিক হিল- সিন্ধু- জাঁসকা নদীর মিলনস্থল এবং লেহ্
২৩ শেষ মে' ২০১৯ সকাল বেলায় গাড়ির মাথায় ক্যারিয়ার লাগিয়ে হাজির আমাদের সদাহাস্য বাহনচালক হোসেন ভাই।এক দিনের জন্য থাকলেও বারু- লা হোটেলের কর্মচারী দের ব্যবহার মুগ্ধ করার মতো। সত্যি বলতে কি পুরো ট্রিপে স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে অত্যন্ত সহৃদয় ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেছে।সে তিনি গাড়ির চালক হোন, কি হোটেল মালিক তথা সেখানকার কর্মচারী। কার্গিল থেকে লেহ্ দূরত্ব ২০০ কিমি র
বেশী ,সময় লাগবে ৪ঘন্টার ও বেশী কারণ এই পথে ইন্টারেস্টিং ও আকর্ষণীয় কয়েকটা ট্যুরিস্ট স্পট আছে। প্রথম স্পটে থামলাম আমরা। রাস্তা র ধারে পাথরে খোদাই মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি।গ্রামের নাম মুলবেক।এটি মুলবেক টেম্পল,জুতো খুলে সেখানে ঢুকতে হবে, মঙ্ক এর চেয়ারে বসা যাবেনা,ফ্ল্যাশে ছবি তোলা যাবেনা শতাব্দী প্রাচীন মন্দির গাত্রের ছবিগুলির, নীরবতা পালন করতে হবে-- এমন নির্দেশ বোর্ডে লেখা আছে । মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষা করার এই বার্তা টি সব দর্শনার্থীরাই পালন করছিলেন দেখলাম , পাশেই একট বিশালাকৃতির জপযন্ত্র আছে। এতো বড়ো যপযন্ত্র কম দেখা যায়। বাইরে থেকে ছবি তুলেই পরের স্পটে গাড়ি ছুটলো ।
আমাদের পরের স্টপেজ FATULA TOP।লে-শ্রীনগর হাইওয়েতে এটি সবচেয়ে উঁচু টপ বা পয়েন্ট, ১৩,৪৭৯ ফুট। প্রবল হাওয়ায় বেশীক্ষন দাঁড়ানো মুশকিল এখানে। লাল নীল হলুদ সাদা থাঙ্কা টাঙানো আছে এমাথা ওমাথা করে।
সকাল এখন ঢলে পরেছে দুপুরের দিকে । ভরসা একটাই ভারতের একদম উত্তর- পশ্চিম দিকে যাচ্ছি আমরা যেখানে বিকেল দীর্ঘস্থায়ী ও আলো নিভতে নিভতে সন্ধ্যা আটটাও হয়ে যায়।দুদিন আগেই (২০ শে' মে,) পহেলগাঁও তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ওদিকে পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচ্ছে এমন অবিশ্বাস্য ছবি দেখেছি ,ক্যামেরা বন্দী করেছি।
পৌঁছে গেলাম LAMAYRU মনেষ্ট্রি কিন্তু সেদিন বন্ধ থাকায় ঢুকতে পারলাম না। এখানে দেখলাম প্রকৃতির বিস্ময় সৃষ্টি MOONLAND । পাহাড়ের আকৃতি অচেনা গ্রহের মতো।বালিপাথরের হলুদ রঙে র ঢেউখেলানো বিস্তৃত অঞ্চল।
আমরা ক্রমশঃ লেহ র কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি।নিমু(Nimoo) গ্রামের কাছে গাড়ি থামলো এবার। অনেক ওপর থেকে জাঁসকা ও সিন্ধু নদীর অপরূপ মিলনস্থলটি দেখা যায় এখানে।বাঁদিক থেকে সবুজ জাঁসকা নদী মিলেছে ডানদিক থেকে আসা ইতিহাস বই তে পড়া সিন্ধু নদের সাথে। হাজার হাজার বছর ধরে ভূপ্রকৃতি তার রূপ বদলাতে বদলাতে পাহাড়ের রঙ ,খাঁজ আর অপার বিস্ময় মিলে মিশে এমন স্তব্ধতা ও বিস্ময়ের জন্ম দিতে পারে। এখান থেকে লেহ র দূরত্ব ৩৫ কিমি। এই পথের আর একটি বিস্ময়কর ট্যুরিস্ট স্পট ম্যাগনেটিক হিল। গাড়ি নাকি আপনার থেকেই গড়াতে থাকে পাহাড়ের দিকে। ভীষন ভিড় ছিল। আমরা আর এখানে থামলাম না।
বিকেল তিনটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম লেহ্, অবশেষে। দূর থেকে দেখেছি গুরু নানকের স্মৃতি ধন্য গুরুদ্বার পাথ্থর সাহিব , এবার চোখে পড়লো উঁচু পাহাড়ের মাথায় ধবধবে সাদা শান্তি স্তূপ।
"বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি"-- এই অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান। কলকাতা থেকে বুক করা হোটেল LEH CHEN এ পৌঁছে গেলাম অবশেষে। হোটেলের লবিতে মালপত্র রেখে অসীমদা আর দেবাশিস কাউন্টারে রেজিস্ট্রার খাতায় সই সাবুদ ও অফিসিয়াল কাজ করতে চলে গেল। রিসেপশনে র সামনে টাঙানো নন্দলাল বসুর তিনকন্যা ছবিটা দেখে বাঙালি হিসেবে আর একবার গর্ব বোধ করলাম।
এবার টাকা পয়সা মিটিয়ে হোসেন ভাই কে বিদায় দেবার পালা।ফির মিলেঙ্গে ভাইসাব" , দুদিনের মধ্যে ই কেমন এক আত্মীয়তার অনুভব আমাদের সকলের মনেই । লাদাখের বাকি অংশ আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবেন রশিদ ভাই নামে আর একজন স্থানীয় ড্রাইভার ,এটাই ট্যুরের অলিখিত চুক্তি।
এবার পুরো দিন বিশ্রাম নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে লেহ র ১১,৫৬২ ফুট উচ্চতায়।অল্প অল্প জল খাওয়া,কম কথা বলা এবং প্রয়োজনে ওষুধ এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হতে পারে। এই সব অবশ্যপালনীয় নিয়ম এখানে আসা সব ট্যুরিস্টকে পালন করতে হয়।
আগামী কয়েকটি দিন (২৪-২৯ শে'মে) আমরা দেখে নেবো লাদাখের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট গুলো-- খারদুংলা পাস,নুব্রা ভ্যালি,প্যাংগং লেক,সোমোরারি লেক,থ্রি ইডিয়টস্ সিনেমার বিখ্যাত স্কুল ও অন্যান্য জায়গাগুলো।সে তো আরো এক দীর্ঘ রোমাঞ্চকর স্মরণীয় ভ্রমণ ছিল কারণ পরদিন ই বিকেলে আমার দিদিকে ( শুভ্রা ব্যানার্জি) অক্সিজেন লেভেল কমজনিত অসুস্থতার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো এবং তারপরও অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য নিয়ে ১৮,০০০ ফুট উঁচু খারদুলাং পাশ পার করেছিল অদম্য মনোবল হাতিয়ার করে ; সেসময় হোটেল মালিক মঞ্জুর ভাই ও কর্মচারীরা এবং ড্রাইভার রশিদ ভাই এর যে সাহায্য পেয়েছি তার কোনো প্রতিদান হয়না। সত্যি লাদাখ এক অবিস্মরণীয় ভ্রমণ হয়ে থাকবে।আগামী দিনের কোনো পর্বে ভাগ করে নেবো সেই অভিজ্ঞতা।
জোজিলা পাস,গুমরি
রাস্তায় বরফের দেওয়াল
শোনমার্গ থেকে দ্রাস এর পথে
দ্রাস ওয়ার মেমোরিয়াল
সুরু নদী
জাঁসকা - সিন্ধু নদের মিলনস্থল
মুলবেক টেম্পল
বিরাট জপযন্ত্র
বোফর্স কামান
(ছবি- লেখক)
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
ছবিতে ভ্রমণ
দেবাশিস ঘোষ
কাঁথির এক গ্রাম ( পূর্ব মেদিনীপুর)
বকখালির সমুদ্র সৈকত ( দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা )
মন্দারমণির সৈকতে(পূর্ব মেদিনীপুর)
বরন্তি লেকে সূর্যাস্ত ( পুরুলিয়া)
বিহারীনাথ ( বাঁকুড়া)
উদ্ধত পলাশ ( বাঁকুড়া)
রূপনারায়ণ নদীতে সূর্যোদয় ( হাওড়া)
অযোধ্যা পাহাড়( পুরুলিয়া)
ইয়ুম থাং ভ্যালি ( সিকিম)
তোপচাঁচি লেক (ঝাড়খন্ড)
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
শীত বেলার হিম পরশে
সান্দাকফু ভ্রমণ
জয়িতা সরকার
উত্তরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে কখনও কখনও উঁকিঝুঁকি দেয় দূরের ওই তুষারশুভ্র পাহাড়চূড়া। কোথাও একটু স্পষ্ট, কোথাও বা অন্য পাহাড়ের আড়ালে থেকে মাথা উঁচিয়ে এক ঝলকের দেখা। সেই চূড়ার টানেই এবারে আমাদের গন্তব্য ঠিক হল।
বরফে মোড়া সাদা চূড়ার টানে হিম বাতাসকে উপেক্ষা করেই পৌঁছে গেলাম আমার রাজ্যের উচ্চতম জায়গায়। যাত্রাপথ মোটেও মসৃণ নয়, তবে পথের প্রতি বাঁকে আছে এক অন্য অনুভূতি। শীতকালে শীতের দেশের মজা যেন একটু আলাদাই। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমরা ছুটলাম ওই চূড়ার হাতছানিতে সাড়া দিতে।
যাত্রা শুরু হলো ভোর 6টায়। জলপাইগুড়ি থেকে মানেভঞ্জন, ঘড়ির কাঁটায় সকাল 9.30টা, আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন। এই পথেই আমাদের সঙ্গী হলো সে। পথের ডানদিক ধরে চকচকে সাদা চূড়ারাশি যেন আহ্বান করছে আমাদের। এবার পালা গাড়ি বুকিংয়ের। এই বিষয়ে উত্তেজনা আরও তুঙ্গে, অতীত কালের ল্যান্ডরোভার সওয়ারি হওয়ার যে অনুভূতি তা এবার সত্যি হওয়ার পালা।
আমরা ছ' জন বসে পড়লাম সেই ভিনটেজ গাড়িতে। গাড়ির ড্রাইভারের হাতে যেন জাদু আছে। খাড়া পথ ধরে যেভাবে এগিয়ে চলেছেন তা যেন অবিশ্বাস্য। প্রথম তিন কিলোমিটার যেতেই চিত্রে, বাঁধানো পথ ধরে চিত্রে ছাড়িয়ে আমরা চললাম মেঘমার পথে। নামেতেই রয়েছে জায়গায় পরিচয়। সত্যি এক মেঘের দেশ।
মেঘমা ছাড়িয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম প্রথমদিনের রাত্রি নিবাস টংলুর জিটিএ-র গেস্ট হাউসে। ভেতরে ঢুকতেই অপরূপ সৌন্দর্য্য, গেস্ট হাউসের উঠোনে দাঁড়িয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা-র মোহময়ী রূপ, যা কোন শব্দেই বর্ণনা করা যায় না। আমাদের জন্য বরাদ্দ যে রুমটি, সেটির জানলা দিয়ে তাকালেই ধরা দেয় তৃতীয় উচ্চ শৃঙ্গ। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেও মন যেন ভরে না।
ফ্রেশ হতেই ঘড়ি বলছে বেলা তিনটে, ছুটলাম কিছুটা দূরের উঁচু পাহাড়ে। আকাশ তখন সেজেছে বিদায়ী কমলা রং -এ। আর বিপরীতের তুষার শৃঙ্গ তখন যেন সোনালী আভায় সুসজ্জিত। নিচে মেঘের ভেলা, সঙ্গে হাওয়ার দাপট,সব মিলিয়ে এক অবর্ণনীয় প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা।
ফিরে এসে গরম গরম স্যুপ, তারপর ডিমকারী যোগে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে, ক্লান্ত শরীরে শুতে যাওয়া। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি চাঁদের আলোয় চকচক করছে স্লিপিং বুদ্ধ। আর জোনাকির মতো জ্বলছে দূরের দার্জিলিং।
বিকেলের অস্তরাগেই বার্তা ছিল নতুন সকালের, ভোরের ক্ষীণ আলোতে আদিগন্ত যেন অকাল হোলিতে মাতোয়ারা । পূব আকাশ জুড়ে রং এর ছটায় প্রতিফলনে ঘুম ভাঙ্গে চির তুষার শৃঙ্গ খানির। রাতের চাদর সরিয়ে রেখে আড়মোড়া ভাঙ্গে সে। মেঘ ভাসে পাহাড় জুড়ে, সম্মোহিত হয়ে পড়ি ওই বৃহৎ এর সন্মুখে।
টংলু ছেড়ে সেই ল্যান্ড রোভারে চেপে রওনা হলাম দ্বিতীয় দিনের ডেস্টিনেশনের দিকে। কিছুটা পথ যেতে বাঁক ফিরতেই দেখি উঁকিঝুঁকি দিয়ে মাথা উঁচিয়ে নিজের পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে মাউন্ট এভারেস্ট, পৃথিবীর সর্বোচ্চতাকে এক ঝলক দেখতে পাওয়ায় যে প্রাপ্তি তা মনের ভ্রমণ সিন্দুকের আজীবন সম্পদ। তার গা ঘেঁসে একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাকালু, অন্যদিকে লোৎসে। গাড়ি চলছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে দিয়ে।
আমাদের গাড়ি পৌঁছল গৈরিবাসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার শুরু, কালিপোখরিতে পৌঁছে লেকের পাশে কাটল কিছুটা সময় কাটালাম, কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে কিছুটা বেসামাল আমরা। পথ বলতে শুধুই পাথর আর মাটির মিশ্রণ। খাড়াই ক্রমশ বেড়েই চলেছে আর সেই পথ অতিক্রমের জাদু আছে গাড়ির চালকের হাতে। দুর্বিষহ পথ পেড়িয়ে পৌঁছলাম আমার রাজ্যের সর্বোচ্চ স্থানে।
স্বপ্নের সান্দাকফু, সিঙ্গালিলা শ্রেণীর সর্বোচ্চ শিখরে। এ যেন বাস্তবে থেকেও প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া। গাড়ি থেকে নামতেই চোখ জুড়ে শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, ঘুমন্ত বুদ্ধের সামনে নিষ্পলক দৃষ্টি আমাদের। শত শত বছর আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে কুম্ভকর্ণ থেকে পান্ডিম।
ঠান্ডা বাতাসকে উপেক্ষা করেই দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কম্পমান আমরা ধীরে ধীরে পা রাখলাম হোটেলের ঘরে। একটু ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চ সেরেই বেড়িয়ে পড়া। আল-এর সানসেট পয়েন্ট আমাদের গন্তব্য। পাহাড়ি পথ, হিম-হাওয়া, তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ নামছে, আমরা হেঁটে চলেছি, প্রায় আধ-ঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম আল। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে প্রকৃতি সেজেছে নিজের খুশিতে। পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে দিন শেষের জানান দিতেই মেঘের খেলা শুরু হলো। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ তখন বর্ণনাতীত।
মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘায় তখন সন্ধ্যে নামল। হৃদয়ের চিলেকোঠায় একরাশ ভালোলাগা গুছিয়ে নিয়ে আমরা রওনা হলাম সেই আলো আঁধারি পথ ধরে। আকাশ বাতাস জুড়ে শুধুই শীতলতা। আড্ডায় মশগুল আমাদের সঙ্গী হলো পাকোড়া আর কফি। তাতে যেন কিছুটা উষ্ণতার ছোঁয়া। হাঁড়হিম করা ঠান্ডায় কাঁচের দরজা খুলে বাইরে আসতেই আকাশ জুড়ে ঝিকিমিকি। রাতের আকাশে এতো তারা, সেই দৃশ্য দেখে যেন মন ভরে না। ঠান্ডা উপেক্ষা করেই দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা।
ঘড়িতে তখন রাত ন'টা, ডিনার সেরে লেপ কম্বলে নিজেদের জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পালা। রাত বাড়তেই ঠান্ডা আর হাওয়া দুজনেই দাপুটে হয়ে পড়েছিল। ওদের যুগলবন্দিতে খানিক বিভ্রান্ত হয়েছিল ঘুম বেচারা। ভোর হতেই পূব দিগন্তে আলোর রেখার দেখা মিলতেই বিছানা ছেড়ে সোজা হোটেলের ছাদে। একদিকে সূর্যোদয় আর তার আলোর ছটায় রূপময়ী হয়ে উঠেছে মেঘের আড়ালে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই বৃহৎ এর সামনে আমরা সামান্য, যেমন বিশালতা, তেমন সৌন্দর্য্য , স্থির এক ধ্যানী-যোগী প্রহরী হয়ে বসে রয়েছে। বারবার তার রূপে মুগ্ধ হয়েছি, এবার ফেরার পালা।
ব্যাগ গুছিয়ে, রুম ছেড়ে আবার সেই ল্যান্ড রোভার এর সওয়ারি হলাম আমরা। নতুন অভিজ্ঞতায় ভ্রমণ ঝুলি ভরিয়ে এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে নেমে এলাম মানেভঞ্জন। আমাদের গাড়ির দু' দিনের ঠিকানা ছিল মানেভঞ্জনের পার্কিং জোন। মোমো দিয়ে লাঞ্চ সেরে গাড়ি ছুটল জলপাইগুড়ির পথে।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
মহানন্দা অভয়ারণ্যের আরণ্যক সৌন্দর্য্যে
গৌতম চক্রবর্তী
মহানন্দা অভয়ারণ্যে সেইসব দিনকাল
নব্বই এর দশকের প্রারম্ভে প্রথম
মহানন্দা অভয়ারণ্যে আসা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে এসে হেন ছুটির দিন ছিল না যে
আশেপাশে কোথাও যাই নি। সেইভাবেই মহানন্দা অভয়ারণ্য চেনা। মোহরগাঁও গুলমা চা বাগান, ন্যাড়া জঙ্গল পেরিয়ে শুকনা। বাঁদিকে বামনপোখরি, গাড়িধুরা হয়ে মিরিক যাবার পথ। ৫০-৬০ বছর আগে এইসব অঞ্চল ভয়ঙ্কর গভীরতম জঙ্গল ছিল। এইসব তল্লাটে মানুষ নয়, বাঘ, চিতাবাঘ এবং হাতির পাল হামেশাই দেখা যেত। মনে আছে বহুবছর আগে যখন শুকনা বনবাংলো হয়ে মহানন্দা ওয়াইল্ড
লাইফ স্যাংচুয়ারিতে গিয়েছিলাম তখন শুকনা রেঞ্জ অফিসের ভেতরে এখানে ওখানে ছিল
কাঠের ঘরবাড়ি, বনবিভাগের অফিস এবং এখানে ওখানে শুকনো কাঠের স্তুপ। আমরা দেখতে গিয়েছিলাম
প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র। মহানন্দা
অভয়ারণ্যের গাছপালা, জীবজন্তু, পাখি, সাপ ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল চমৎকার এই সংগ্রহশালা। শিলিগুড়ির কাছে এটা ছিল অসাধারণ সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান। দোতলার প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রটির উপরে হাতির পা দিয়ে
মোড়া, বাঘ-ভালুকের টপ মডেল ছিল। পাহাড়ি ভাল্লুক ছিল যেন জীবন্ত। সাপের খোলস, পাখি, ডিম কাঁচের বাক্সে ছিল সযত্নে রক্ষিত। জীবজন্তু, পাখি, অর্কিড ইত্যাদি ছিল ওই মিউজিয়ামে সুসজ্জিত। এখানে ছিল সুসজ্জিত হলঘর। সেখানে বসে বড়পর্দায় দেখেছিলাম কিভাবে বন্যপ্রাণী ধরা
হয়, পোষ মানানো হয়, চিকিৎসা এবং সেবা করা হয়। সবশেষে মহানন্দা অভয়ারণ্যের ওপর একটা ভিডিও ফিল্ম
দেখেছিলাম। অসাধারণ ভিডিও
ফিল্ম।
অতীতের স্মৃতিপটে গোলাঘাট সাফারি
মনে আছে নব্বই এর দশকে এসেছিলাম
মহানন্দা অভয়ারণ্যে সুহানা সফরে। মহানন্দা অভয়ারণ্যের অন্তর্গত গোলাঘাট থেকে
চকলংখোলা বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছিল বনদপ্তর। অভয়ারণ্যের মূলকেন্দ্র গোলাঘাট থেকে চকলংখোলা পর্যন্ত ছিল
নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর সফর। চকলংখোলা থেকে দেওরালি পর্যন্ত ৮০০ ফুট উঁচু বনপথ ছিল বড়ই মোহময়। এখনো চালু আছে কিনা জানা নেই। মূলত এটা ছিল জঙ্গল সাফারি বা ট্রেল। বেড়ানোর সময় ছিল সকাল আটটা থেকে দশটা, দুপুর দুটো থেকে চারটে, এবং চারটে থেকে বিকেল ছয়টা
পর্যন্ত। বুধবারে কাউন্টার
বন্ধ থাকত। অনুমতিপত্র বা
টিকিট দেওয়া হতো শুকনার প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র থেকে। খরচাপাতি ছিল মাথাপিছু ৫০ টাকা এবং শেষ ট্রিপে ছিল ১০০
টাকা। গাইডের জন্য ছিল ১৫০ টাকা এবং
গাড়ির জন্য জমা দিতে হতো ১০০ টাকা। ক্যামেরা ১০০ টাকা। তখনকার বাজার মূল্য অনুযায়ী টাকার অঙ্কে তা ছিল অনেক বেশী। কিন্তু পর্যটক হত। আমরা
গিয়েছিলাম গুলমা গোলাঘাটের দিকে। অরণ্যবেষ্টিত পথ গাড়িতে বসে রুদ্ধশ্বাসে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে এগিয়ে
চলেছিলাম যদি হাতি বা হরিণ দেখা যায়। সবুজ অরণ্যছায়ায় গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকলে কোথা দিয়ে যে সময়
কেটে যায় তা টের পাওয়া যায় না। অল্পসময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া হয়েছিল গুলমার জঙ্গলে জলাধার এর কাছে। নীরব, নিস্তব্ধ, সবুজ অরণ্য। চারিদিকে ছিল গভীর প্রশান্তি। পারস্পরিক কথাবার্তাই বিরক্তিকর। আমরা সেইসময় ঝটপট উঠে পড়েছিলাম নজর মিনারে। পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ভ্রামণিক গৌরীশঙ্করদার কাছ থেকে শুনেছিলাম এই
বন্যজন্তু পরিদর্শন মঞ্চ রেলস্টেশনের কেবিনঘরের কাছে ছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে। হাতিরা দল বেঁধে চাঁদনী রাতে রেলস্টেশন আক্রমণ করেছিল
ভয়ঙ্কর আক্রোশে। ভয়ার্ত এবং
আতঙ্কগ্রস্ত স্টেশন মাস্টার টেবিলের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে বসে হাতিদের সঙ্গে
লুকোচুরি খেলেছিলেন। রেলকর্মীরা
কোয়ার্টার থেকে দৌড়ে কেবিনঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। হাতির দল লেপ, তোষক, বালিশ লন্ডভন্ড করে চাল, ডাল, আনাজপত্র খেয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরের দিন গিয়ে দেখা গিয়েছিলো সেখানে শুধুমাত্র হাতির
নাদি পড়ে আছে। হলুদ এর ওপরে কালো
অক্ষরে লেখা গুলমা নামক কংক্রিটের সাইনবোর্ড পর্যন্ত ভাঙ্গা ছিল। রেলস্টেশন এখন একনজরে হল্টিং স্টেশনে পরিণত হয়েছে।
অভয়ারণ্যের পথে
সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। অথচ বৃষ্টির কোন লক্ষণ নেই। তীব্র দাবদাহে ফুটিফাটা বিশ্বচরাচরকে দেখলে কে বলবে শরৎকালের
সাদা শিউলি আর কাশফুলের সমারোহে হালকা শীতের আমেজে ঢাকের বোলে যে দূর্গা ঠাকুরের
বোধন হতো, এখন মাঝেমধ্যেই রুখাশুখা মরসুমী খরা অথবা তীব্র বৃষ্টির ছটায় ক্ষিপ্ত
নদীগুলির বন্যায় আগমনী গানে বাজে বিষাদের সুর। শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততা থেকে নিস্তার পাবার জন্য জঙ্গলের
ছোঁয়া পেতে ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মাঝেমধ্যেই ছুটে যাই রাস্তার দুই ধার বরাবর
জঙ্গলের শান্ত পরিবেশে শান্তির ছোঁয়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক পলকের জন্য
বন্যপ্রাণ দেখার আশায়। শুকনার এই জঙ্গলমহল আমার খুব
প্রিয়। আমি ছাড়াও আমার মতো ভবঘুরে শহরবাসীর পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও এই রাস্তা
খুবই আকর্ষণীয়। তাদের গন্তব্য হয় রংটং। দাগাপুর, নিউ চামটা, মোহরগাঁও গুলমা চা বাগান হয়ে শুকনা। শহরের ত্রিসীমানা পেরিয়ে শালবাড়ি পার হয়ে বাইকের গতি কমলো
শুকনাতে এসে। শিলিগুড়িতে এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি অন্তত
একবার হলেও শুকনায় আসেন নি। রাস্তার ধারেই শুকনা বাজারের অনতিদূরে জঙ্গল সাফারির জন্য বহু পুরনো ব্যবস্থা
রয়েছে। গাইড এর সহযোগিতায় জঙ্গলের ভেতরে প্রায় ছয় কিলোমিটার যাওয়ার ব্যবস্থা
রয়েছে। কিন্তু জঙ্গলের স্নিগ্ধতা এবং
বন্যপ্রাণীর খোঁজে জাতীয় সড়ক ধরে পর্যটকদের যাওয়া-আসা বাড়লেও সাফারির প্রতি
আগ্রহীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এমনকি জঙ্গল সাফারির জন্য ছোট গাড়ির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এখানে সেরকম একটাও
গাড়ি নেই। লাটাগুড়ি,
গরুমারার মতো থাকা কিংবা সাফারির পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় অনেকেই মহানন্দা অভয়ারণ্যতে না এসে বেঙ্গল
সাফারিকেই বেছে নিচ্ছেন। তাই সাফারির প্রতি আকর্ষণ
বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
মোহরগাঁও গুলমার ছায়াঘেরা সবুজে
দুয়ার থেকে অদূরে এক সৌন্দর্যময় জায়গা মোহরগাঁও গুলমা। শিলিগুড়ি শহর
থেকে অল্প দূরত্বের পথ। মাল্লাগুড়ি মোড়, তেনজিং নোরগের গা ধুয়ে ডানদিকে হিলকার্ট রোড। এই পথ কার্শিয়াং হয়ে দার্জিলিং
পর্যন্ত প্রসারিত। ডানদিকে খেলনা ট্রেনের লাইন। তিনটে নীল রংয়ের দেশলাইয়ের বাক্সের মতো কামরা নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যায়
খেলনা ট্রেন।
তবে পঞ্চনই নদীটাকে দেখলে কান্না পায়। টোটো, অটো, নানাপ্রকার যানবাহন, দোকানপাট, দার্জিলিং, কার্শিয়াং যাবার গাড়িগুলো
লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন বেশিরভাগ
গাড়ি সুকনা, গাড়িধুরা, শিমূলবাড়ী,
রোহিনী হয়ে কার্শিয়াং এবং দার্জিলিঙে
আসা-যাওয়া করে। পুরনো পথ প্রায় পরিত্যক্ত। বাবা লোকনাথের শ্বেতশুভ্র প্রস্ফূটিত পাপড়ি মন্দির। কংক্রিটের
জঙ্গল,
ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়,
হোস্টেলের ছড়াছড়ি। দাগাপুর, সুকনা,
নিউ চামটা চা বাগান, শালবাড়ি সুকনার তেমাথা। আমরা পৌঁছে গেলাম মোহরগাও গুলমাতে। মোহরগাঁও গুলমাতে ইলা পাল চৌধুরীদের চা বাগান। বাঁদিকে মাঠ, চা বাগান, দূরে নীল
পাহাড় এবং মুখোমুখি শালবন। মোহর গ্রাম
অপভ্রংশ হয়ে গাঁওতে রূপান্তরিত হয়েছে আর গুলমা একটা স্টেশন। চা বাগানের
ডিভিশন মোহরগাঁও।
চৌধুরী পরিবারের অপর একটি বাগান বাগড়াকোটের কাছে ওয়াশাবাড়ি। বর্তমান
পাল চৌধুরী পরিবারের নয়নতারা পাল চৌধুরী দেখাশোনা করেন বাগানটি।
মহানন্দার
জঙ্গলমহলে চরৈবেতি
নদীকে ডানপাশে রেখে বনদপ্তরের অনুমতি
নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। মেঘের ঘরে যেখানে
সেখানে চিলেরা ধীরে উড়ে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। গাছের ডালে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা। বিকেলের দিকে ময়ূর আর বনমুরগি ঘুরতে আসে এই জঙ্গলে। এখানে একটা চারাগাছ তৈরির কেন্দ্র আছে। বর্ষায় বনের ভিতর এই সব গাছ লাগানো হয়। বর্ষার সময়ে সাধারণের অরণ্যে প্রবেশ নিষেধ। তখন প্রাণীদের মিলনের সময়। সৃষ্টির তাগিদে অরণ্যকুল সক্রিয় থাকে মধুচন্দ্রিমা যাপনে। মহানন্দা অভয়ারণ্য। নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক
জঙ্গলমহলের ছবি। প্রায় মাইলখানেক ঢোকার পর এক জায়গায় ১০-১৫ ফিট উচ্চতার অনেকগুলি চালতা
গাছে প্রচুর চালতা ধরে আছে। কিছু গাছের ডালপালা ভাঙ্গা অবস্থায় গাছের সাথে দুলছে। প্রচুর হাতির নাদি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলাম
এটা হাতির আবাসস্থল। বসন্তকালে প্রচুর
পাখি সারাক্ষণ নানা সুর করে ডেকে চলে। পঞ্চনই নদীর স্বচ্ছ জল পান করতে মাঝেমধ্যে তৃষ্ণার্ত জন্তু উপস্থিত হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া চিৎকার করে জঙ্গলের উপর দিয়ে উড়ে
গিয়ে আবার জঙ্গলের সবুজে হারিয়ে যাচ্ছে। বকেরাও নিঃশব্দে সারিবদ্ধভাবে উড়ে যাচ্ছে। একটু উঁচুতে উড়ছে পানকৌড়ি। ময়না পাখির দল আকাশে উড়ছে আর মিষ্টি কন্ঠে সুরে সুরে গান
গাইছে। একটা কোকিল গাছের ছায়ায় বসে
বিরামহীনভাবে গলা সেধে চলেছে। এই সুরে পাগল হয়ে আরো কিছু কোকিল বিভিন্ন গাছের ছায়ায় বসে সুর করে গাইছে
প্রাণের গান। অরণ্যে বুঝি আজ
গানের উৎসব। দোয়েল, মাছরাঙ্গা, মৌটুসী, টুনটুনি, খঞ্জন, সোনাবউ, ফিঙে, কাঠঠোকরা কোন গাছে যে কোন পাখি বসেছে আর ফুরুত করে উড়ে
যাচ্ছে দেখতে দেখতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। এখানে পাখিরা কথা বলে গাছের সঙ্গে। বাতাস শুকনো পাতার বার্তা বয়ে নিয়ে আসে মাটির কাছে। আকাশ আশ্বাস প্রদান করে মেঘমেদুরতার। ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে বনস্থলীর কলকল্লোল হৃদয়ঙ্গম করতে হয়।
(ছবি- লেখক)
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
একটি দিবা-ভ্রমণ
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
নভেম্বর মাসের একটি দিন , সকাল ছ’টা ।কথাকলির ফোন , দিদি উঠেছো ?ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ি । উঠে পড়ি বলতে একেবারে পড়িমরি করেই উঠি । তারপরই দৌড় দৌড় ! চা পান- স্নান -খাবার গুছোনো ---এরপর ছুটতে ছুটতে গাড়িতে ।আমি -কত্তা-ছেলে , কথাকলি-ওর কত্তা -মেয়ে , আর এক কর্তা -গিন্নি ---এ ক’জন , গাড়ি চালাচ্ছে মানিক ।
গাড়ি চলল । চলতে চলতে পেরিয়ে গেল মনোহর হরিৎবর্ণের মথুরা চা বাগান ।এরপর চিলাপাতা পেরোলাম ।আকাশছোঁয়া গাছগুলোর পা ছুঁয়ে চলে গেছে মসৃণ রাস্তা ---জঙ্গলের মৌনতায় নিজেরাও নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম ।আশা ছিল প্রচুর পশুপাখি দেখব , দেখলাম শুধু গজরাজের লেজটুকু !
আবছা পাহাড়ের সারি ,বিস্তীর্ণ চা বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে গন্তব্যে এগোচ্ছি , গন্তব্য রায়মাটাং ।পথে এক জায়গায় চা বাগানের টানে আমরা নেমেই পড়লাম।সেই বাগানের নাম যে কি কে জানে !কুয়াশাভেজা ঝলমলে সেই চা বাগানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম , প্রাণভরে শ্বাস নিলাম , দেখলাম আশ্চর্য সুন্দর সাদা সাদা কুঁড়ি চা গাছের গায়ে গায়ে----ফোটার অপেক্ষায় ।
কিছুক্ষণ ছবি তোলা চলল । চা বাগানের মাঝখান দিয়ে একটি পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে , যার দু’পাশে ছায়াগাছের সারি , পথের মাথায় আবছা পাহাড়শ্রেণী , যার গায়ে সামান্য রোদের ছোঁয়া ।মেঘলা দিন ছিল সেদিন । সেই অনন্ত পথের যে পর্যন্ত দৃষ্টি গেল মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেল চিরতরে , যে পথ দিয়ে যাবার আনন্দ এবং বিষাদ ---দুইই সমান ।
এরপর গাড়ি গড়গড়িয়ে ছুটে সোজা গিয়ে পৌঁছলো রায়মাটাং ।শুকনো পাহাড়ি নদীর বুক চিরে চলল গাড়ি । নদীখাতের মাঝে-মাঝে ক্ষীণ জলধারা আর পাথরের কঙ্কাল ।নদীতে এখন জল নেই , কিন্তু বর্ষাকালে এই নদীতেই বান আসে । সেই জলের ধারার রেখার দাগ দেখলে বোঝা যায় কি ভয়ানক তার স্রোত !
রায়মাটাং পিকনিক-স্পটে প্রাতঃরাশ সারলাম সকলে , সেদিন কেবল আমরাই ছিলাম। পিৎজা-ডিমসেদ্ধ-চা-মালপোয়া-রসগোল্লা-মুড়ি ---রকমারি খাওয়া হল, খাওয়া বাকি রয়ে গেল প্রচুর ফল আর কেক----যা আবার ফিরে গেল গাড়িতেই ।
নদীখাতে নামতে পারলাম না , বয়স বাধ সাধল , নামলো বন্ধুরা । দূর থেকে যতটুকু দেখতে পেলাম সেও এক অসামান্য অবলোকন । নিচে কুলকুল শব্দ করে নদী বইছে ,গাছের ফাঁক দিয়ে দেখছি তাকে ।নদীকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় ,পাহাড়কে ছুঁয়ে আকাশ ।তারপর আমি এদিক – ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । একটা রিসর্ট দেখলাম , দেখতে খারাপ নয় , তবে লকডাউনের কারণেই বোধহয় বড়ো করুণ দশা । তার পাশ দিয়ে গলিপথে ঢুকে গেলাম স্থানীয় লোকের বসতিতে । কাঠ ও টিনের বাড়িঘর , পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন , সকলের বাড়িতেই গাছপালা আছে । চিহরগাছের বীজের মস্ত খোলা সংগ্রহ করলাম ক’টি । বীজগুলো স্থানীয় মানুষরা খায় হয়তো ! প্রকৃতির সব কিছুই অমূল্য ।
এর পরের গন্তব্য লতাবাড়ি। পৌঁছে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম । খয়ের গাছের সারি , পরিচ্ছন্ন নির্জন জায়গা , ঝিরঝিরে কালজানি নদী , নদীর এপারে আমরা ,ওপারে সেগুন গাছের দল ! দূরে আবছা নরম পাহাড় । অপূর্ব সুন্দর !মন ভালো হয়ে গেল ।
পাশের ধাবাতে দুপুরের খাবার খাওয়া হল ।সবই পাওয়া যায় , রান্নাও খুব খারাপ নয় , তবে দুর্মূল্য । ওরা বলল---এই নদী থেকেই বোরোলি মাছ ধরে রান্না করা হয় ।আমরা বোরোলি মাছের ঝোল , পনির আর চিকেন অল্প-অল্প করে মিলিয়েমিশিয়ে খেলাম ।
এবার বাড়ি ফেরার পালা । ফেরার পথে চিলাপাতার রাস্তায় প্রচুর বানর আর ময়ূর দেখলাম ।ভালোই লাগলো ঘুরে , লোকের ভিড় ছিল না বলে আরো ভালো লেগেছে ।তবে বন্য প্রাণরা সংখ্যায় অনেক বেশি থাকবে বলে যে প্রত্যাশা করেছিলাম , তাদের বাড়বাড়ন্ত নজরে পড়ল না তেমন ।
আর একখানা সুখের বিষয় ছিল ,অমন ফাঁকা জায়গায় করোনা দাদারা যায় না , তাই মাস্ক পরি নি মোটেই !
(ছবি- বৈবস্বত ভাদুড়ী)
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
স্বপ্নের রেনচেনপং
শ্রাবনী সেনগুপ্ত
পূর্ব সিকিমের একটি ছোট্ট লেপচা জনপদ রেনচেনপঙ৷ ২০১৯ সালে পূজোর সময় কোথাও যাবার কথা ভেবেও গন্তব্যস্থল ঠিক করতে পারছিলাম না৷তখন আমার এক সহকর্মীর কাছ থেকে হঠাৎ করেই রেনচেনপং-এর কথা জানতে পারি৷ এই পাহাড়ী শহরের সৌন্দর্য্যের বর্ণনা শুনে মনস্থির করে ফেলি ওখানেই যাবো৷ সহকর্মী সুমনার কাছ থেকে রেনচেনপং-এর একটি হোটেলের মালিক দেবাণু ওরফে গোগোর দূরভাষ নম্বর নিয়ে তৎক্ষণাৎ তাকে ফোন করলাম৷ গোগো বললো যে সে বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কলকাতা-বাগডোগরার ফ্লাইটের টিকিট বুক করলাম৷ যাত্রী আমরা দুজন,আমি এবং আমার অধ্যাপক স্বামী পার্থ৷ মনে খুব উত্তেজনা, কারণ এমন একটি জায়গায় আমরা বেড়াতে যাচ্ছি যার নাম আগে শুনিনি। বাগডোগরা বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম বিকাল তিনটের সময়৷ বাইরে অপেক্ষারত ছিল লেপচা যুবক সন্তু তার বাহন টাটা সুমো গাড়ী নিয়ে৷ শুরু হলো বায়ুপথ ছেড়ে স্থলপথে রেনচেনপং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা৷ রাস্তা পূণর্নির্মিত হচ্ছে, তাই কখনও কখনও ঝাঁকুনি খেতে খেতে চারপাশের প্রকৃতিকে উপভোগ করছি৷মাঝে একটা রেস্তোঁরাতে গাড়ী থামিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম৷ আবার পথচলা শুরু৷ গাড়ী এগিয়ে চলেছে৷ এক পাশে পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গল, আরেকপাশে পাহাড়ী খাদ, বিভিন্ন বাঁকে ভরা রাস্তা৷ হঠাৎ গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় জঙ্গলের ধারে একটা বনবিড়ালের দেখা পেলাম৷ হঠাৎ করে গাড়ীর আলো তার চোখে এসে পড়াতে খুব বিরক্ত হয়ে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করতে করতে জঙ্গলের দিকে চলে গেল, তার তখন রাস্তা ক্রশ করা হলো না৷ রাতের কূয়াশা ভেদ করে গাড়ী এগিয়ে চলেছে, পথের প্রতিটা বাঁকে মনে হচ্ছিল বোধহয় আরও কারোর সঙ্গে দেখা হবে কিন্তু আর কোনও রাতের অতিথির সঙ্গে দেখা হলো না৷
প্রায় ছয় ঘণ্টা পর, রাত নয়টার সময় আমরা আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছোলাম৷ খুব ঠান্ডা, চারিদিক নিঃস্তবদ্ধ৷ গাড়ী থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে একটু উঠেই হোটেল৷ সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ৷চারিদিকে অন্ধকার, আর কিছুই চোখে পড়ছে না, শুধু হোটেলের আলোকমালা ছাড়া৷প্রথম দর্শনেই যেন জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলাম৷ একটি ছেলে এসে আমাদের ঘরে নিয়ে গেল আর একটু পরে এসে খাবার জল দিয়ে গেল৷আমরা ভাবছি হোটেলের মালিকের সঙ্গে এখনও দেখা হল না কেন? কিছুক্ষণ পরে দেবাণুর আবির্ভাব৷ পরিচয় বিনিময় করে রূম-ডেলিভারি ডিনারের ব্যবস্থা করে, ‘বাকি কথা কাল হবে’ জানিয়ে সে বিদায় নিলো৷
পরদিন ভোর ৪টার সময় দরজায় ঠকঠক্,ওপার থেকে আওয়াজ এলো-‘সামনের জানলা খুলুন’। জানলা খুলতেই একরাশ বিস্ময়,মুগ্ধতা আমাদের ঘিরে ধরল৷একেবারে যেন হাতের কাছে হিমালয়ের রাণী কান্চনজঙ্ঘা৷ এর আগেও বিভিন্ন জায়গা থেকে কান্চনজঙ্ঘা দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে, কিন্তু এবার যেন সে একদম ঘরের মেয়ে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে৷ অপার্থিব আনন্দে চোখে জল এসে গেল৷ মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানালাম তাকে যে আমাকে এই জায়গার সন্ধান দিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল জীবনে যেন আর কোন কিছুরই দরকার নেই,সব চাওয়া-পাওয়া যেন হারিয়ে গিয়েছে৷ তারপর আস্তে আস্তে চারপাশে নজর পড়ল৷ যে বিরাট মাঠটির সামনে কাল রাতে গাড়ী থেকে নেমেছিলাম তার শেষ প্রান্তে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয় নজরে এলো৷ ভোরবেলা সেখান থেকে আসা ঘণ্টাধ্বনি মন-প্রাণ যেন বিশুদ্ধ করে দিলো৷ মন যেন আবিষ্ট হলো এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে৷ এরপর চা খেতে হোটেলের উপরে গেলাম৷ রূফটপে দারুণ ব্যবস্থা। গোগো আর নন্দিনী তাদের একমাত্র পুত্র-সন্তান টোটোকে নিয়ে এখানেই থাকে৷ ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং তাকে মধ্যমণি করে আরও কয়েকটা শৃঙ্গ যেমন, কাব্রু, রাথং, কক্তাং,কুম্ভকর্ণ প্রভৃতি দৃশ্যমান হলো৷ সে এক অভূতপূর্ব মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা৷
জানতে পারলাম ওই বৌদ্ধ উপাসনালয়টি ‘তান্ত্রিক’ ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত৷ ভারতবর্ষে একমাত্র এখানেই এই ধরণের মনাষ্ট্রি আছে৷ বহুপ্রাচীন এই মনাষ্ট্রির গঠনশৈলী একদম অন্যরকম৷ বুদ্ধের মূর্তিটিও অন্যান্য মনাষ্ট্রির থেকে আলাদা, বুদ্ধের চোখ নিমীলিত৷ এই মনাষ্ট্রিতে একটি লামা-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে৷ মনাষ্ট্রির পেছনের অংশে পাহাড়ের ঢালে বালক প্রশিক্ষণ-প্রাপকদের থাকার জায়গা৷আমরা যখন ওখানে উপস্থিত হলাম,তখন দেখলাম বালক শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হয়েছে৷আমরা শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে মিষ্টি আর ছোট্ট লামাদের উপাসনা প্রত্যক্ষ করলাম৷মন্ত্র উচ্চারণ এবং ধুপ-ধুনো ও ঘণ্টাধ্বনির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হল উপাসনা৷গুরুগম্ভীর পরিবেশের পবিত্রতা মনকে ছুঁয়ে গেল৷
ঐ দিনটা পাহাড়ী পথ ধরে ঘুরে বেড়ালাম৷ পথের দুই পাশে অনেক নাম না জানা পাহাড়ী ফুল চোখে পড়ল৷ নিস্তব্ধ রাস্তায় শুধু পাখীর ডাককে সঙ্গী করে হেঁটে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগছিল৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ডেন্টাম বাজার৷ পথে সঙ্গী হলো এক পাহাড়ী সারমেয়৷লোম ভর্তি সারা গা নিয়ে সে লেজ নেড়ে নেড়ে আমাদের পিছু নিলো৷ মনে হচ্ছিল যেন চলেছি মহাপ্রস্থানের পথে৷ বাজারটি ছোট, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ সবই পাওয়া যায়৷ উপহারসামগ্রীর দোকানও রয়েছে৷ পাহাড়ী জনপদের এই বাজারটি দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো৷ ছোট ছোট পাহাড়ী পথ বেয়ে মানুষ-জনেরা আসছেন,এই দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগছিলো৷ বাজারে এসে সারমেয়টি একটা দোকানের সামনে বসে পড়ল৷ সেই দোকানটি থেকে বিস্কুট কিনে ওকে দিতেই নড়েচড়ে উঠল৷ বুঝলাম তার উদ্দেশ্য৷ কিছু টুকটাক উপহারসামগ্রী কিনে ফিরে চললাম হোটেলের পথে৷ ফেরার পথে দেখা পেলাম গাছপালা আর পাহাড় ঘেরা একটি পরিতক্ত্য সরোবরের৷ স্থানীয় এককজন মানুষের কাছ থেকে জানলাম সরোবরটি ‘পয়জন লেক’ নামে পরিচিত৷ এই সরোবরটিকে ঘিরে একটি কাহিনী আছে৷ ১৮৬০ সালে বৃটিশ সেনারা এখানে এসে ঘাঁটি গাড়ে৷ তাদের সাথে স্থানীয় লেপচা জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ বাঁধে৷ যুদ্ধ চলাকালীন লেপচারা এই লেকের জলে বিষ মিশিয়ে দেয়৷ সেই বিষ মেশানো জল খেয়ে কিছু বৃটিশ সৈন্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এবং এই দেখে বাকি পালিয়ে যায়৷ এইভাবেই লেপচাদের বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান বৃটিশ ক্যাপ্টেন ম্যুরে৷ সেই থেকেই এই সরোবরটি ‘পয়জন লেক’ নামে পরিচিত৷
পরের দিন গেলাম কাছাকাছি কিছু দর্শনীয় স্থান দেখতে সন্তুর গাড়ীতে চড়ে৷ পথে পড়ল অপূর্ব সুন্দর এক পাহাড়ী উপত্যকা যেটি ওখানকার সুইজারল্যান্ড বলে পরিচিত৷ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সেই ছোট উপত্যকাটিতে খেলনার মতো ছোট ছোট ঘর-বাড়ী৷ এরপর গেলাম সেনসম সেতু দেখতে৷ ঝুলন্ত এই সেতু পেরোনোর মজাই আলাদা৷ দুই পাশে পাহাড়ের সারি আর থেকে অনাবিল ধারায় বয়ে চলেছে সুন্দরী ঝর্ণা৷ পায়ের নীচে দুরন্ত পাহাড়ী নদী৷ নদীর ওপারের কাফেটারিয়ায় কফি খেয়ে, চারপাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে আবার ফিরে এলাম সেতুর এপারে৷ এবারের গন্তব্য আমুল কোম্পানির চিজ্ তৈরীর কারখানা৷ মিষ্টি হাসির পাহাড়ী দূহিতা সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন৷ কিভাবে চিজ্ তৈরী হয় তা ঘুরে ঘুরে দেখলাম৷ ওখানে অনেক ধরণের চিজে্র সন্ধান পেলাম৷ কিছু অন্য ধরণের চিজ্ সংগ্রহ করলাম৷ এইসব পাহাড়ী পথে এমন-ই চলতে ভালো লাগে, চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্য্য মন ভরিয়ে তোলে৷
এরপর হোটেলে ফিরে এসে আবার ছাদে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন৷ রাত্রে গোগোর ছেলে টোটোকে নিয়ে বসলাম ভূগোল পড়াতে৷ আমি ভূগোলের দিদিমণি জানতে পেরে ওদের-ই অনুরোধে এই পাঠদান৷ সে এক অসাধারণ অনুভূতি৷ চোখের সামনে ভঙ্গিল পর্বতকে সাক্ষী রেখে তার সম্পর্কেই পড়ানো৷ এর অনুভূতিই আলাদা৷
পরের দিন গেলাম হেরিটেজ হাউজ দেখতে। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই বাড়ীটি লেপচা উপজাতির চিরায়ত নিজস্ব সংস্কৃতি বহন করে চলেছে৷ এর পাশেই অবস্থিত রবীন্দ্র ভবন৷ রবীন্দ্রনাথ নাকি এখানে এসেছিলেন৷তাঁর রচিত বেশ কিছু কবিতার জন্ম হয় এখানেই৷ এই পবিত্র স্থানে এসে মন-প্রাণ ভরে উঠল৷ তাঁর প্রস্তর মূর্ত্তির সামনে এসে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁকে স্মরণ করলাম৷ সেদিনটি আশেপাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে আর বাসস্টপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করেই কেটে গেল৷ রাতের খাবারে উপভোগ করলাম অতি সুস্বাদূ দেশী মুরগীর মাংস আর ভাত৷ তারপর শুরু হল আড্ডা৷ পার্থ আর গোগোর নানা বিষয়ে আড্ডা চললো অনেক রাত পর্যন্ত৷
এখানকার সব সব্জীই অরগ্যানিক পদ্ধিতে চাষ করা হয়৷ নন্দিনীর হাতে তৈরী ঘরোয়া লাল লঙ্কার আচার তো অতুলনীয়৷ রেনচেনপঙের ডেয়ারী প্রোডাক্ট অসাধারণ৷ খাঁটি দুধের তৈরী কফি আর দুধের সরের স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে রয়েছে৷
পরের দিন ফেরার পালা৷ সবারই মন ভারাক্রান্ত৷ সকালে টোটো টাটা করে স্কুলে চলে গেল৷ সেদিনও সকাল থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান৷ গোগো বলল যে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এইভাবে তার সমস্ত সাথী শৃঙ্গদের নিয়ে সবাইকে রোজ দেখা দেয় না৷ সৎ আর ভালোমানুষদের কাছেই সে এতো পরিষ্কারভাবে সারাক্ষণ ধরা দেয়৷ এই শ্রেষ্ঠ অনুভূতির দ্বারা আবিষ্ট হয়ে বিদায় জানালাম আমাদদের স্বপ্নের রেনচেনপঙকে৷
আবার একই পথে কলকাতায় ফিরে আসা৷ নিয়ে এলাম একরাশ ভালোলাগা, সঙ্গে নন্দিনীর নিজ হাতে তৈরী আচার আর ঘি৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনই আমায় বিমুখ করেনি, যেখানেই ছুটেছি তাকে দেখব বল্ সে আমার কাছে ধরা দিয়েছে৷ সুযোগ পেলে বারবার ছুটে যাব তার কাছে৷
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
আরব
সাগরের কূলে
চিত্রা পাল
আজ চলে এসেছি একেবারে ভারতের পশ্চিম সীমানায়
আরব সাগরের কূলে দিউ শহরে। সাজানো গোছানো ছোট সুন্দর শহর দিউ, আর পুরো দিউ শহরটাকে
মালার মতো জড়িয়ে আছে আরব সাগর তার উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে।আমরা দুপুরের খাবার
আগেই পৌঁছেচি। একেবারে সমুদ্রের ধারে হোটেল। বারান্দায় বসেই সমুদ্র দর্শন। এ বড়
আনন্দের। আমি এসেই বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বেশ গুছিয়ে বসলাম। আমার সামনে নীল জলরাশি
নিয়ে আরব সাগরের বিস্তার। এখানে সাগর মাঝে মাঝেই স্থলের কণ্ঠলগ্না।আসলে দিউ একটা
দ্বীপের মতো। তাকে সেতু গড়ে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে। এই দ্বীপ
দীর্ঘদিন ছিলো পর্তুগীজদের দখলে, ১৯৬১ সালে এর ভারতভুক্তি হয়।
আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছি, আর উঠেই বারান্দায়।
প্রভাত সূর্য দেখা দিলো তার মনোহর রুপে। আমার সামনের সাগর জলে তার প্রতিবিম্ব। এখন
বেশিক্ষণ বসা যাবে না, কারণ সকালের জলখাবার সেরেই বেরিয়ে পড়তে হবে দ্বীপ দর্শনে।
প্রথমেই চলে এলাম এখানকার দুর্গ দেখতে। পর্তুগীজদের এই দুর্গ ফোর্ট অফ দিউ ১৫৩৫-৪১ সালে তৈরি
হয়। প্রায় ২৯ মিঃ উচুঁতে গড়া এই ফোর্ট আজও
সমুদ্রের ধারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে। ফোর্টের ওপর থেকে সমুদ্র দর্শন এক কথায়
অসাধারণ। একটু দূরে
রয়েছে আরও একটা জাহাজের মতো দেখতে ছোট আকারের দূর্গ। আগে
নাকি সুড়ঙ্গ পথে ওই দূর্গের সাথে এই
দূর্গের যোগাযোগ ছিলো, এখন সবই বিধ্বস্ত, তবে অতি উৎসাহীরা নৌকো করে ওখানে যেতে
পারেন।এখন সে অন্যমনস্ক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার উদাসীন দৃষ্টির সামনে খেলা
করছে লীলা চঞ্চল নীল সাগরের অসীম
জলরাশি।আগে যে এই ফোর্টে ভালই গোলা গুলি চলতো তার প্রমাণ এখনও এখানে রাখা কামান।
আগে ছিলো
যুদ্ধাস্ত্র এখন হয়েছে ফটো তোলার স্থান। এই
কামানের পাশে দাঁড়িয়ে সকলেই তুলে নিচ্ছে এখানে এসেছে তার প্রমাণ।
দুর্গ দেখা শেষ করে চলে এলাম সি বিচে।সেখান
থেকে একটু দূরে গিয়ে দেখলাম গঙ্গেশ্বর শিব। এই শিবালয়টি একেবারে সমুদ্রের
কোলে।জোয়ারের জল বাড়তে এসে একেবারে অভিষেক করে দেবতাকে জলে , তখন
পুজোর পত্র পুষ্প সব
ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার ভাঁটার টানে জল সরে গেলে শিব জেগে ওঠে। আমরা যখন গিয়েছিলাম
তখন ছিলো ভাঁটা, তাই দেবদর্শন আমাদের ভালোই হলো।
ওখান থেকে চলে এলাম নাগোয়া সি বিচে।
শহর থেকে খানিক দূরে শান্ত স্নিগ্ধ বাঁকা চাঁদের মতো এ উপকূল। এইসমুদ্র তট একেবারে
স্নানের উপযোগী। আমাদের
সংগীসাথীরা অনেকেই নেমে পড়লো জলে। সমুদ্রতীর বলে এখানে ,ঝাউবনের খুবই সমারোহ। অন্য
অনেক জায়গার তুলনায় এখানে ডাবের দাম বেশ কম।
আমার হোটেলের সামনে রয়েছে একটা জেলে নৌকোর ঘাঁটি। দেখলাম দুপুরের পরে সব
নৌকো একে একে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়লো।মাছ ধরা এখানকার লোকেদের মুখ্য জীবিকা। এখানে
আছে পরপর সুরা তৈরির কারখানা, আছে লবণ তৈরির কারখানা।
বিকেলে পায়ে হেঁটে শহরটাকে ঘুরে দেখতে বেরো লাম।কাছেই রয়েছে সেন্ট পলস্
চার্চ। চার্চের অভ্যন্তরে বার্মাটিকের
কার্ভিং এর কাজ খুব সুন্দর। আর সেন্ট
পলসের উত্তরে আছে সেন্ট টমাস চার্চ। সেটি আজ মিউজিয়ামে পরিবর্তিত।
নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর শোভায় মোড়া
ছোট্ট শান্ত দ্বীপশহর দিউ।দ্বীপ থেকেই দিউ নামের উৎপত্তি । এর দিগন্ত বিস্তৃত অটুট
জলরাশি,অপার অখন্ড পরিপূর্ণতা পর্যটকের মনে এনে দেয় স্নিগ্ধ মুগ্ধতা। এ স্মৃতি
ভুলে যাবার নয়।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
সুরজকুন্ডের সোনালী স্মৃতি
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
উড়নচন্ডী জীবনের, যাপন কাহিনি লেখার কোনো সুযোগ বলে কয়ে অাসে না। আভিধানিক অর্থে ভ্রমণ যাকে বলে তা কখনো এ জীবনে ঘটেছে, এ কথা হলফ করে বলতে পারি না। ১৯৮৩ তে টিউশানির টাকায় হাওড়া স্টেশনে কালকা মেলে চেপে বসবার সময় কখনো ভাবি নি সে বছর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেও, ১৯৮৫ থেকে ৯৭ একটানা বারো বছর দিল্লিতে কাটাতে হবে।
এই দীর্ঘ সময়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর বিভিন্ন অংশে কর্মসুত্রে গেলেও সেই সোনালী দিনগুলোতে ঐতিহাসিক এবং দ্রষ্টব্য স্থানে উপস্থিত থেকেও ভ্রমণের আনন্দ বা অনুভূতি কোনটাই নিতে পাই নি।
তবে নতুন দিল্লির ভারতীয় বিদ্যাভবনে সাংবাদিকতা পড়বার সময় দ্বিতীয় বর্ষে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষামূলক ভ্রমণের সুযোগ ঘটেছিল। সকাল সকাল দুটো গাড়ি বোঝাই হবু সাংবাদিকরা গোটা দিল্লি চক্কর কেটে যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হব হব তখন পৌঁছলাম সূরজকুন্ডে।
কে জানত প্রকৃতি যেখানে অকৃপণ ভাবে উজাড় করে দিয়েছে তার সবটুকু সবুজ। অাকাশ যেখানে নীল রঙ বিলিয়ে দিয়েছে দীগন্ত জুড়ে, সূর্যাস্তের সোনালী ছটায় পরিযায়ী পাখিরা গান গোয়ে ঘরে ফিরছে তখন সেখানে চলছে উত্সব। বলিউড এর প্রথম সারির নায়ক - নায়িকা, গায়ক গায়িকা দের শুটিং।
কি যে ভালো লাগা মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে গন্তব্যে পৌঁছলাম,তা আজও স্মৃতির সরণীতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
দেওঘর ভ্রমণ
অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত)
ঋকবেদের উল্লেখনীয় একটি পদ আছে,
"বিমে কর্না পতয়তে বিচক্ষুর,
বী হৃদং জ্যোতির্হৃদয় অহিৎযৎ।
বিমে মনশ্চরতি দর আধী:
কিং স্বিদ্বক্ষ্যমি কিমুন্দ মনিষৎ"। যার সহজ অর্থ হোলো,
"আমার কর্ণ সকল কিছুই শুনিবার জন্য উৎসুক, আমার চক্ষু দেখিবার জন্য। আমার ভিতরের জ্যোতির্ময় আলোটি সর্বক্ষণ সুদূর প্রান্তে ভ্রমিয়া থাকে, এবং সেই কারনেই আমার মন বিশ্বের সকল জায়গাতেই ভ্রমিতে ইচ্ছুক"।
এই উপরোক্ত বাক্য সমষ্টিগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে সকল ব্যক্তিই অবসর সময় সুদূর প্রান্তে নিজের বাড়ি-ঘর-শহর ছেড়ে ভ্রমণ করতে ভালোবাসে।
আমি ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছি। তবে, মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে আছে ১৯৯৪ সালে বন্ধুদের সাথে দেওঘর ভ্রমণ।
তখন সবে স্নাতকোত্তরের পর ইভিনিং কলেজে বি. এড. পড়ার পাশাপাশি একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। এইসময় একদিন, আমার প্রিয় বান্ধবী, রুবি ফোন করে জানাল, ওদের কলেজ থেকে দেওঘর বেড়াতে যাওয়া হবে। আমি ছাত্রী না হওয়া সত্ত্বেও ওদের সাথে যেতে পারব। মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল। অবশ্য, অনেক কান্ড-কারখানার পর স্কুলের ছুটিটা মঞ্জুর হয়েছিল।
৩০শে সেপ্টেম্বর, সারাটা সকাল ভ্রমন সংক্রান্ত বাঁধা-ছাঁদা শেষে সবাই হৈ-হৈ করে হাওড়া স্টেশন থেকে রাত্রি ৯:৫০ মিনিটের দানাপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। বাবাই খুউব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছিল, আমরা যেন পরিকল্পনা মাফিক ঘোরা ফেরা করি। ছুটি নেওয়ার উদ্বেগ আর বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার উৎফুল্লতা, দুটো মিলে-মিশে একটা দারুণ অনুভূতি হচ্ছিল, যা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না।
১লা অক্টোবর, সকাল ৪:৩০ মিনিটে জসিডি স্টেশনে পৌঁছলাম। মৃদুলা প্রসাদ নিকেতন - এ এসে যখন উঠলাম, ঘড়িতে তখন ৫: ৫০ মিঃ। অনেক্ষণ বাদে যখন জলখাবার পেলাম, ততক্ষণে খিদে মরে গিয়েছিল। তারপর রোদ মাথায় করে বৈদ্যনাথধাম দর্শন করতে বেরোন, মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু বাবা-কে দর্শনের পর মনের সকল কলুষতাই দুর হয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকে ফেরার পর গোটা দুপুর-টা আমরা সবাই অন্তাক্ষরী খেললাম। বিকেলে অবশ্য আশা ভঙ্গের পালা আরম্ভ হলো। আড়াই মাইল হেঁটে যখন শ্রীশ্রী অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে পৌছলাম তখন আমাদের জন্য বন্ধ দ্বার অপেক্ষা করছিল। তারপর ফিরে দেখি, লোডশেডিং। জানতে পারলাম, রোজ সন্ধ্যায় লোডশেডিং-টা অনিবার্য। কি আর করা, সারা সন্ধ্যা গান-বাজনা করেই কাটালাম।
২রা অক্টোবর, বহুদিন পর, ভোর দেখলাম। কোলকাতায় তো প্রভাতে পাখির গান শোনার কোনও উপায় নেই। বেড়াতে যাওয়ার উৎসাহে ঘুমও সকাল সকাল ভেঙে গিয়েছিল। ঐদিন আমাদের দারুন আনন্দে কাটল। ওমলেট টোস্ট দিয়ে চা পান করে ৮ টা নাগাদ সবাই জিপে রওনা দিলাম দেওঘরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য।
ত্রিকুট পাহাড়ের দিকে যাওয়ার সময়, দুটি জিপগাড়ির গতিবেগ নিয়ে রেষারেষিটা বেশ ভালই লাগছিল। ত্রিকুট পাহাড়টির প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতা। পাহাড়টিকে উপলক্ষ করে রাবনের সীতা হরনের কাহিনী বেশ ভালোই লেগেছিল। কথিত আছে, সীতাকে হরণ করে রাবন যখন তাঁকে লঙ্কায় নিয়ে যাচ্ছিল তখন সীতা তাঁর গয়নাগুলো ত্রিকুট পাহাড়ের চূড়ায় নিক্ষেপ করেন। জটায়ু পাখিকে রাবন এই পাহাড়েই মেরেছিল। ১০০০ ফিট উচ্চতায় এখানে একটা সুন্দর মন্দির আছে। আমরা সবাই এই মন্দির অবধি গিয়েছিলাম।
এরপর আমরা তপোবনের দেখতে গেলাম। ওখানে হনুমানের দল আমাদের স্বাগত জানাল। তপোবনে একটা খুবই সরু সুরঙ্গ পথ আছে, যেটা অতিক্রম করার পর একটা সুন্দর মন্দিরে প্রবেশ করেছিলাম। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়েছিল। গাইডরা ঐ সুরঙ্গ পথটিকে মাতৃগর্ভ থেকে বেরনোর পথের সাথে তুলনা করে। এরপর, নলক্ষা মন্দির পরিদর্শনে গেলাম। ওখানকার দেওয়াল এবং ছাদে সুক্ষ্ম কারুকার্য দেখে সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ হতে হল।
ওখান থেকে আমরা বালানন্দ মন্দির প্রদক্ষিণ করি। দেওয়ালে খচিত উপনিষদের শ্লোকগুলো আমার মনে গভীর দাগ কাটে, যা এখনো বিদ্যমান। সেখান থেকে, নবদুর্গা মন্দির দর্শন, সেখানকার স্নিগ্ধ পরিবেশ পর্যটকদের অনায়াস আকর্ষণ করে। বিকেলে দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশনে গেলাম। মিশনের শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ মনকে স্নিগ্ধ করে তুলেছিল।ফিরে এসে লজের বাগানে কিছুক্ষণ কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলার সময় যেন নিজেদের শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম।
৩রা অক্টোবর, সকালে সবাই মিলে আবার গেলাম বৈদ্যনাথধামে পুজো দিতে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে গেলাম অনুকুল ঠাকুরের আশ্রম। আশ্রমে প্রতিষ্ঠিত অনুকুল ঠাকুরের কাঠের মডেলটি মনে রেখাপাত করলো। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি যেন আমাদের সম্মুখে বসে আছেন।
এই দিন, রাত দশটা নাগাদ কোলকাতায় ফেরার জন্য ট্রেনে সওয়ার হলাম।
মনটা ভারাক্রান্ত, পরের দিন বন্ধুদের থেকে আলগা হয়ে যাবার কারণে। পাশাপাশি আনন্দও ছিল, বাড়ির লোকদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন পর মিলন হবে, ঘোরার কত গল্প হবে। তবে দুঃখ ও সুখের মধ্যে দুঃখ কিছুটা ভারী হওয়ায়, সবাই কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে, ঘুমিয়ে পড়লাম।
৪ঠা অক্টোবর, এদিনটা ছিল বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা বহনকারী মহালয়া। এইবার অবশ্য চন্ডী পাঠ ট্রেনে বসে শুনতে হল। ৬:৩০ মিঃ নাগাদ ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌছানোর পর সেবারকার দেওঘর ভ্রমণে যবনিকা পড়ল।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
হিমালয় ভ্রমণ
দেবর্ষি সরকার
"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি !
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী।
মানুষের কত কীর্তি,কত নদী গিরি সিন্ধু মরু ,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে।"
অপার রহস্যময়ী এই বিশ্ব প্রকৃতি।বিস্তার তার অনন্ত আকাশে, মহাসমুদ্রের সীমাহীন গভীরতায়, সুউচ্চ পর্বতমালায়, অসূর্যমস্পর্শা গহন অরণ্যে। মন ছুঁতে চায় এইসব শতসহস্ত্র প্রকৃতির সৌন্দর্যকে।প্রকৃতির প্রতিনিয়ত এই আহ্বানে এ
মন বারবার ছুটে যেতে চাইলেও অর্থ সময় ইত্যাদি প্রতিকূলতার কারণে সব সময় সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়া যায় না। তবুও সেই স্বপ্ন পূরণ কোনো কোনো সময় হয়। সেই কথাই একটু বলি।
তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। সেবার পুজোর ছুটি শুরু হতে বেশ কিছুদিন বাকি। বাবার প্রস্তাবে হিমালয়ের গাড়োয়াল তীর্থভ্রমণ ঠিক হলো। একেবারে চার ধাম। যমুনোত্রী ,গঙ্গোত্রী কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ। হিন্দুদের চিরআরাধ্য তীর্থভূমি। দীর্ঘ যাত্রার জন্য দীর্ঘ ও বিস্তর আয়োজন।সেইসব প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে নির্দিষ্ট দিনে আমরা সবাই দুন - এক্সপ্রেসের স্লীপার কোচে যে যার নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করি।
নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ট্রেন ছেড়ে দেয়। রেলের গাড়ি চলতে থাকে । রাত্রি বাড়ে। চারিদিকের ছোট জনপদ রাত্রির চলমান ট্রেনের দুপাশ দিয়ে দ্রুত পিছু হটতে থাকে। দৃশ্যও দ্রুত বদল হতে থাকে। ক্রমে পিছনে ছুটতে থাকে ছোট ছোট পাহাড় ,গম, ভুট্টা ,আখের ক্ষেত।এইভাবে ক্রমে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত শহর পেরিয়ে তৃতীয় দিনের সকাল দশটা নাগাদ দেরাদুনে পৌঁছাই।এখানে ঐ দিন বিশ্রাম নেওয়া হল এবং মূল ভ্রমণ পর্বের জন্য প্রস্তুতি ও কিছু কেনাকাটা করা হলো।
দেরাদুন থেকেই আমাদের মূল ভ্রমণ পর্ব শুরু। দীর্ঘ প্রায় একমাস কালের ভ্রমনসূচী। এই দীর্ঘ ভ্রমনসূচীতে কত কি দেখে বেড়াই।মুসৌরিতে সহস্রধারা, কান্টি ফল্স্ দেখে পরদিন যমুনেত্রী যাওয়ার পথে হনুমানচটি, সন্যাচটি হয়ে কুলি কাম - গাইড রণজোর সিং কে সঙ্গে করে দুর্গম ১৩ কিমি পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে যমুনেত্রী পৌঁছাই। ফিরতি পথে ধরাসু হয়ে গঙ্গোত্রী। এখানে দু দিন বিশ্রাম। এরপর গোমুখ যাত্রা।সেই বিখ্যাত ভুজবাসায় লাল বাবার আশ্রমে রাত্রি বাস করে পরদিন সকালে অবিস্মরণীয় ভারতপীযূষ গঙ্গার উৎসমুখ গোমুখ দর্শন। পদব্রজে সন্ধ্যায় গঙ্গোত্রী প্রত্যাবর্তন। এবারে গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশী। সেখানে রাত্রি বাস করে রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছাই দ্বিতীয় দিনের সন্ধায়।গৌরীকুণ্ডে মন্দাকিনীর উষ্ণ প্রস্রবনের ধারে একটি হোটেলে রাত্রি বাস করে পরদিন পদব্রজে যাত্রা শুরু হলো কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। ১৪ কিমি পথ। মাঝে রামওয়ারাতে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় সেই হিন্দুদের পরম তীর্থ কেদারনাথ পৌঁছাই।কেদারনাথ মন্দিরের সন্ধ্যা আরতি দর্শন ও পরদিন সকালে ওখানে পূজা পাঠ দিয়ে আমরা সকলে আবার দীর্ঘ পদব্রজে গৌরীকুণ্ডে প্রত্যাবর্তন করি।
এবার লক্ষ বদ্রীনাথ দর্শন। পথিমধ্যে যোশীমঠে দুদিনের বিশ্রাম। এখানেই সেই বিখ্যাত আউলি রোপওয়ে ও শীতকালীন তুষার ক্সীরাক্ষেত্রের প্রবেশদ্বার। এখানথেকে টানা বাস পথে পরদিন বদ্রীনাথে পৌঁছে যাই। ঋষিগঙ্গা ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমে উষ্ণ প্রস্রবণ এবং এই বিষ্ণু তীর্থ।হিন্দুদের চিরপ্রার্থিত এই তীর্থ ও দেবতার মন্দির দর্শন করে পরদিন হরিদ্দারে ফিরে আসি।এখানে ঋষিকেশ এর দ্রষ্টব্যস্থান লক্ষণঝোলা, রামঝোলা, গীতাভবন , চন্ডী পাহাড়, মনসাপাহাড়, ইত্যাদি দর্শন করে বেড়াই। ঘিঞ্জি শহর হরিদ্দার। যাত্রী ,ক্রেতা-বিক্রেতা, ভিখারি, বাঁদরের বাদরামি, দালালের উৎপাতে হরিদ্বারে একেবারে দমবন্ধ হবার জোগাড়। তবু মানুষ এখানে আসে হিমালয়ের টানে, তীর্থের আহবানে। আমার তোমার মতো কত মানুষ আসবে যাবে চিরকাল।
দিনের উড়ান শেষে সব পাখি যেমন তার নীড়ে ফিরে তেমনি আমাদের প্রায় দীর্ঘ মাসব্যাপী হিমালয় যাত্রার পরিসমাপ্তি হলো হাওড়ার ফিরতি ট্রেনে।স্মৃতির পাতায় কতনা নয়নমোহন দৃশ্য, কতনা পাহাড়ি মানুষের আচার-আচরণ যা চিরদিন আমার হৃদয়ের কন্দরে লালিত সত্তা হয়ে থাকবে।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
বেড়িয়ে এলাম আদিনা স্বপন কুমার দত্ত
এই বড়দিন অর্থাৎ গত ২৫ শে ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে বেরিয়ে এলাম ইতিহাস বিজড়িত আদিনা।গৌড়ের সঙ্গে অদিনাও একদা বাংলার রাজধানী ছিল। তখন আদিনা ছিল এক বর্ধিষ্ণু জনপদ। এন এইচ ৩৪ ধরে শিলিগুড়ি থেকে মালদহ যাতায়াতের পথে গাজলের পরেই পড়ে আদিনা স্টপেজ।একেবারে বাস রাস্তার পাশে হওয়ার কারণে আদিনা যাবার কোন অসুবিধানেই। মালদা থেকেও সব সময় বাস,ট্যাক্সি, ম্যাজিক ইত্যাদি গাড়ি রয়েছে।
আদিনার প্রধান দ্রষ্টব্য আদিনা বা জামা মসজিদ।ইহা ১৩৬৪ থেকে ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতান সি কানদার শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়।বাংলার ঐশ্লামীক স্থাপত্য কলার বৃহত্তম নিদর্শন আদিনা মসজিদ।এটি একটি বৃহৎ উপাসনা স্থল। এর চারদিকে রয়েছে খিলান সমৃদ্ধ গম্বুজাবৃত প্রদক্ষিণ পথ।এর উত্তরে রয়েছে বাদশাহ - কি - তখত নামক একটি উচ্চ রাজ আসন।সুলতান এবং তাঁহার পরিবারের মহিলাদের জন্য এই আসন ছিল সংরক্ষিত। পশ্চিম দিকের দেওয়ালের বহির্ভাগ সংলগ্ন কক্ষ টিতে সুলতান সিকান দার শাহ সমাহিত। ভারতীয় পুরা তত্ব সর্বেক্ষ্ন বিভাগ কর্তৃক মসজিদটির দেখ ভাল করা হয়পুরাকীর্তিটির অভ্যন্তরে রয়েছে সুদৃশ্য বাগিচা।নানাবিধ ঝাউ এবং ফুলের গাছের সমারোহ।রাতে রঙিন আলোর মাধ্যমে " লাইট অ্যান্ড সাউন্ড" অনুষ্ঠানের রয়েছে ব্যবস্থা।বহু পর্যটক দেশী ও বিদেশী দের আগমনে এই স্থাপত্য টি হয়ে উঠেছে খুব আকর্ষণীয়। সেদিন বড়দিন উপলক্ষে হয়েছিল বহু দর্শকের সমাগম। এছাড়া কিছু দূরে রয়েছে " একলাখী মসজিদ"।শোনা যায় এটি রাজা গণেশের দ্বারা নির্মিত।পূর্বে এটি ছিল নাচ ঘর। পরে রাজা গণেশ ধর্মান্তরিত হয়ে যদু বা জালালউদ্দিন নাম গ্রহণ করেন। পরে এটি রূপান্তরিত হয় " একলা খি মসজিদে"।
আদিনা মসজিদের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে " ইকো পার্ক"।এছাড়া দুই কিলোমিটার দূরে রয়েছে " আদিনা ডিয়ার পার্ক "।টোটোয় যাওয়া যায়।আনুমানিক আড়াই শত হরিণ, একটি নীল গাই এবং অসংখ্য রং বেরংয়ের পাখির রয়েছে সমারোহ।প্রতি বৃহস্পতিবার এই ডিয়ার পার্ক বন্ধ থাকে। একটি পুরোপুরি ছুটির দিন প্রাচীন ইতিহাসের নস্টালজিয়ায় উপভোগ করে বেড়ানোর জন্য আদর্শ জায়গা আদিনা বললে অত্যুক্তি হবেনা। একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন সবাই আপনারা।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment