Monday, October 4, 2021


 মুনা 
অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৮


সম্পাদকের কথা 

মহামারীর মধ্যেই চলে এলো শারদীয়া উৎসবের মরশুম। বিগত বছরও পুজো কেটেছে অনাড়ম্বরভাবে। এই বছরও সেই একই ঘটনা ঘটতে চলেছে। তাই এবারের পুজোও আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারল না। বরং অতিমারীর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় আমরা শঙ্কিত। এখনও জনজীবন স্বাভাবিক হয় নি। মানুষের ওপর চেপে রয়েছে নানা বিধিনিষেধ। বন্ধ স্কুল-কলেজ। সব মিলে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়। তাই এবারের শারদীয়ায় একটাই প্রার্থনা, দ্রুত ছন্দে ফিরুক সব। শারদ শুভেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে আবেদন সবার কাছেই, পুজোর আনন্দের মাঝেও বজায় থাকে সব সাবধানতা। 


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়

প্রচ্ছদ- শৌভিক কার্যী  

মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা


সূচি 

ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দোপাধ্যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়,  চিত্রা পাল, শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী, নির্মাল্য ঘোষ, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত,  স্বপন কুমার দত্ত, কবিতা বণিক, শ্রাবণী সেন, তমালী দাস, রীনা মজুমদার, জয়িতা সরকার, চম্পা বিশ্বাস, শিউলি রায়,  মৌসুমী চৌধুরী, মিঠু অধিকারী, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, রীতা মোদক,  পারিজাত প্রীত, রেবা সরকার,  অপর্ণা বসু, প্রদীপ চৌধুরী, চন্দ্রানী চৌধুরী, অমিতাভ সরকার, অলকানন্দা দে, অদিতি মুখার্জি সেনগুপ্ত, বিজয় বর্মণ, মুনমুন সরকার, সুনন্দ মন্ডল, শতাব্দী সাহা, অভিমূন্য, মজনু মিয়া, সুদীপ দাস,  বুলবুল দে, মহাজিস মণ্ডল, বিপ্লব গোস্বামী, দেবর্ষি সরকার, রূপক রায়, আকাশলীনা ঢোল, প্রিয়াংশু নন্দী, দেবাঞ্জনা রুদ্র, দেবোদয় গুহ রায়, অনুস্মিতা বিশ্বাস, অদ্রিজা বোস, তানভী দাম, অভ্রদীপ ঘোষ


মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৮



। পুজো প্রবন্ধ ।


বঙ্গে দুর্গোৎসব : বাবু সংস্কৃতি ও  বারোয়ারি পুজোর পরম্পরা
                  ডঃ  ইন্দ্রাণী  বন্দ্যোপাধ্যায়


এক বিশেষ ধর্মীয় -সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ষোড়শ শতকের মধ্য ভাগে বঙ্গে দুর্গোৎসব  শুরু হয়েছিল। এই সময় কোন সম্প্রদায়ই তাঁদের  নিজস্ব  রক্ষণশীলতার  পরিসর থেকে মুক্ত  হতে পারে নি। বিদগ্ধ সমালোচকরা মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন  যে হিন্দুদের  স্বকীয়তা রক্ষার  দাবি কে কেন্দ্র  করেই  সপ্তদশ  ও অষ্টাদশ  শতকে বেশ  কয়েক টি পারিবারিক  দুর্গোৎসব  প্রচলিত  হয়েছিল। আর এসব পারিবারিক দুর্গোৎসবে ইংরেজ  কর্মচারীদের  সাদর আমন্ত্রণ  ও তাদের  উপস্থিতি এই পূজায় তাদের  সক্রিয়  সমর্থনের ই  প্রমাণ  দেয়। প্রথম
দুর্গোৎসবের  প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা কংস নারায়ণ  রায়।
(১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে)।  তারপর আনুমানিক ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে  নদিয়ার  মহারাজা কৢষ্ণচন্দ্র রায়ের  পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার  দুর্গাপুজো করেছিলেন  এরকম জনশ্রুতি থাকলেও এ বিষয়ে বিশেষ  কোনো প্রামাণ্য  পাওয়া যায় না।  ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম  দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত  হয়েছিল কলকাতার  সাবর্ণ রায়চৌধুরী  পরিবারে ।পুজোর  প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন  লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার। এই মতটি সর্বজনস্বীকৢত। এই পরিবার থেকে ই গোবিন্দ পুর, সুতানুটি ও কলিকাতা গ্রামের ইজারা নিয়ে বাংলায় বানিজ্য সনদ লাভ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সূত্র ধরেই বলা যায় সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার পর ও বিশেষত অষ্টাদশ শতকের  মাঝামাঝি একদিকে নতুন জমিদার তালুকদার  শ্রেণী অপরদিকে ইংরেজের  তাঁবেদার দালাল ও দেওয়ান দের নিয়ে গড়ে উঠল বাবু শ্রেণী, তাদের বিচিত্র  বিলাস বহুল  আচার আচরণের নাম হল বাবু সংস্কৃতি বা জেন্টু কালচার। বাবু নবাবের দেওয়া উপাধি হলে ও নব্য ধনী উশৃঙ্খল সম্প্রদায় নিজেরা নিজেদের কে বাবু নামে ঘোষণা করল। এই হঠাৎ ধনী হওয়া বাঙালি বাবুরা যারা চরম বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) ও শোভাবাজারের তালুকদার রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তবে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি পন্ডিত দের পৃষ্ঠ পোষকতা করতেন। রাজসভায় পন্ডিত দের খুব সম্মান ছিল। তিনি বাংলায় একাধিক পূজা পার্বণের প্রবর্তক। কথিত আছে যে তিনি খুব জাঁকজমক সহকারে দুর্গা পুজো করতেন ও অন্য ভূস্বামীদের এই পুজোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই পুজোয় কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির ধূমধাম ছিল সকলকে অবাক করার মতই। তাঁরা প্রচুর টাকা খরচ করতেন কিন্তু ভক্তি ভাবের থেকে আমোদ প্রমোদ বিনোদনের প্রাধান্য ছিল বেশি। আষাঢ় মাসে উল্টো রথের দিন কামানের গোলা ফাটিয়ে পুজোর সূচনা করা হত। দেবী দুর্গা পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্র নিয়ে যোদ্ধা র বেশে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহ রূপী বাহনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতেন। ১০৮ মণ মাটি দিয়ে ঠাকুর তৈরি হত, সপ্তমী র দিন ১০৮  টি ঢাকের বাদ্য দিয়ে পুজো শুরু হত। পুজোর  জন্য  লাগত  ১০৮ টি পদ্ম , ১০৮ টি পাঁঠাবলি হত আর ১০৮  গাড়ি নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হত। তিনিই প্রথম পুজো উপলক্ষে বাঈজী নাচের আয়োজন করেছিলেন। আসলে সেই সময় দুর্গা পুজো  পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধনসম্পত্তির প্রাচুর্য দেখানোর মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।
বড় বিস্ময় লাগে যখন আমরা জানতে পারি পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ে শোভাবাজারের তালুকদার নবকৃষ্ণ দেব বিজয়োৎসব পালন করেছিলেন। আর সেই উপলক্ষে বাড়িতে দুর্গা দালান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে বছর খুব আলো বাদ্যি সহকারে পুজো হয়েছিল। শুধু তাই নয় লর্ড ক্লাইভ কিছু টাকা ঝুড়ি ভর্তি ফল আর একটি পাঁঠা ও উপহার দেন। এই রাজবাড়িতে কামানের গোলার শব্দে শুরু হত পুজো আর ১০০১ টি পশুবলি হত। সেখানে সাধারণ মানুষের থেকে প্রাধান্য পেত ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। বিভিন্ন ধরনের নাচ ও বিনোদনের মধ্যে দিয়ে তাদেরকে তুষ্ট করা হত। প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘোষ ও উইলিয়াম কেরি র রচনায় এই বাবু দের দুর্গা পুজোর জাঁকজমক ও ইংরেজ তোষণের অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।
এ প্রসঙ্গে আরো জানা যায় রাজা রামচন্দ্র রায়, ভূ কৈলাশের দেওয়ান গোকুল চন্দ্র ঘোষাল, দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহ প্রভৃতির পারিবারিক দুর্গা পুজোয় এমন বাড়াবাড়ি  রকমের আমোদ আহ্লাদ  হত যে তাঁদের দুর্গোৎসব কে বলা হত  'গ্র্যান্ড  ফিস্ট অফ দা জেন্টুস'।
ভূস্বামী গোবিন্দ রাম মিত্রের কুমোরটুলি র পুজোর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরা দেবী কে রূপোর সিংহাসনে বসাতেন । ভূরিভোজ ও মদ্যপানের ব্যবস্থা থাকত, নাচের আসর ও  বসত।
জোড়াসাঁকোর কয়লা ও লোহার ব্যবসায়ী শিব কৃষ্ণ দাঁ  প্রতিমা কে সোনা দিয়ে মুড়ে দিতেন। দেবীর অলংকারের মুক্ত পান্না  প্যারিস থেকে আনা হত এরূপ জনশ্রুতি আছে। সাহেব মেমরা এই পুজোয় গান নাচে অংশগ্রহণ করত। মহারাজা সুখময় রায়ের বাড়িতে সাহেব দের খুশি করার জন্য ইংরেজি সুরে ভারতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। গড সেইভ দা কিং এই রকম গানর তখন বেশ চল ছিল  এরকম শোনা যায়। এভাবে দুর্গোৎসব  বাবুদের ধনসম্পদ দেখানো , পান ভোজন গান নাচ ও মহিলা দের অলংকার দেখানোর উপলক্ষ মাত্র হয়ে দাঁড়ালো। ভক্তি বা আরাধনার কোন স্থান রইল না। কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচা র নকসায় বলা হয়েছে নবকৃষ্ণ দেবের ছেলের দুর্গা পুজো য় নবমীতে বিশেষ আয়োজন থাকতো বাঈ খেমটা , কবি গান  ও কীর্তনের। মেডেল পাওয়া শহরের বড় বড় বাঈজিরা ও খেমটা ওয়ালীরা সে দিন দুর্গা পূজার আসর জমাত।
শোভাবাজার রাজবাড়ি তে বারো দিন ধরে পুজো হত পুজো দালানে সাধারণ মানুষের প্রবশাধিকার ছিল কিন্তু পুজোর তিন দিন সাহেব মেমরা নিমন্ত্রিত থাকতো আর কিছু মুষ্টিমেয় অতিথি। খাবারের সময় বাইরের জনসাধারণের প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
তবে ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে বাবু দের অন্তরঙ্গতা ও দুর্গা পুজোর আমোদ আহ্লাদ  মিশনারী রা ভালো ভাবে গ্রহণ করল না। ১৮১৩ সালে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে দেওয়া নতুন সনদ অনুসারে মিশনারী রা এদেশে বসবাস ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। তারা তিনটি বিষয়ের  পুরোপুরি বিরোধিতা করে - ১.হিন্দু দের দুর্গা পুজোয় সরকারি কর্মকর্তা দের যোগদান ২. পুজোর শোভাযাত্রা য় সামরিক বাজনা বাজানো ৩. উৎসব উপলক্ষে দুর্গা ও জাহাজ থেকে কামান দাগা। মিশনারী দের আন্দোলনের ফলে ১৮৮০  সালে  হিন্দু দের  দুর্গা পুজো য় সাহেব মেম দের যোগদান বন্ধ হয়ে যায়।
             ধনী পরিবারের পুজো য় সাধারণ মানুষের যোগদানের সুযোগ না থাকায় ও যথাযোগ্য সম্মানের অভাব থাকায় সর্বপ্রথম  ১৭৯০ সালে বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু  নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে কালনার কাছে গুপ্তিপাড়ায় শ্রী শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী পুজো সমিতি  গঠন করে  পুজো করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরে আশে পাশে অঞ্চলে ও শান্তিপুরে পুজো শুরু হয়।
পরবর্তী সময়ে কলকাতায় ভবানীপুর, রামতনু মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে ও সর্বজনীন দুর্গোৎসব প্রচলিত হয়।
শান্তিপুর অঞ্চলে  বারোয়ারি পুজোর পান্ডারা ক্রমশঃ ধনী পরিবারের পুজোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে ফলে এর আসল উদ্দেশ্য ই নষ্ট হতে থাকে। চাঁদা নিয়ে তারা জুলুমবাজি করতে থাকে  এমন কি কখনো কখনো মহিলা দের গয়না ছিনতাই করে নেয়। একবার প্রতিমার আকার নিয়ে রেষারেষি র ফলে শান্তিপুরে একটি বারোয়ারি সমিতি  ষাটলক্ষ টাকা ব্যয় করে বিরাট পুজো করে ও ষাট হাত উঁচু ঠাকুর তৈরি করে অবশেষে মূর্তি কেটে কেটে টুকরো করে বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জনের সময় এমন অবস্থা হত চুরোট তামাক ও চরসের  ধোঁয়ায় কখনো ঠাকুরের মুখ পর্যন্ত দেখা যেত না।
এই বারোয়ারি পুজোর প্রভাবে  যে সামাজিক গ্লানি ছড়িয়ে পড়েছিল তার বিরুদ্ধে  সমাজে যথেষ্ট বিরোধিতা  হয়েছিল। সোমপ্রকাশ পত্রিকা, সংবাদ ভাস্কর ও   তত্ববোধিনী   পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। ১২৯৩ সালের ২৯ শে আষাঢ় সোমপ্রকাশ পত্রিকায় এরূপ মন্তব্য করা হয়েছিল --  আজকাল বারোয়ারি তে বিশুদ্ধ আমোদ লাভ করা যায় না। প্রায় ই মদ বেশ্যা ইত্যাদি লইয়া বারোয়ারি র পান্ডা দিগের আমোদ প্রমোদ হয়।
তবে তাতে ও পুজোয় পান্ডাদের উশৃঙ্খল আচরণ কিছু মাত্র কমে নি।
তার সঙ্গে ই সমানভাবে চলেছে ধনী  মদ্যপ বাবু শ্রেণীর দুর্গা পুজো উপলক্ষে নাচ গান ভোজন ও সুরাপান আর পাশবিক পশুবলি। এ সময় কলকাতা শহরে  কোন  কোন দুর্গা পুজো র খরচ ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর পাঁঠাবলি হত হাজারের বেশি।
দুর্গা পুজো উপলক্ষ করে নাচ গান সুরা পানে ধনী বাবু সম্প্রদায়  ক্রমে ধনসম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হতে লাগল। কোনরকমে পারিবারিক সম্মান টুকু বজায় রেখে পুজো করতে লাগল। আর পারিবারিক পুজোর নবতম সংস্করণ লাভ করল  সার্বজনীন বা বারোয়ারি পুজো।
এর পরবর্তী ঊনিশ শতকে মূর্তি পূজা বিরোধী ব্রাহ্ম ধর্মের আন্দোলন সমাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শারদীয়া দুর্গা মাতার মধ্যে দেশমাতৃকাকে দেখতে পেলেন। দেশের জনগনের  মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ জাগিয়ে তোলার জন্য গান গাইলেন
ত্বং  হি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারনী
--- - -
ধরণীং ভরণীং মাতরম্।
বন্দে মাতরম গানটি গৃহীত হল জাতীয় সঙ্গীত রূপে।
কবিগুরু র সাহিত্যে দুর্গা  যেন ঘরের আদরিণী মেয়ে বছরে একবার বাপের বাড়ি আসে। শুধু তাই  নয় পৌত্তলিকতা  বিরোধী কবি দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি পূজোর মধ্যে বাঙালির  প্রাণের  আবেগ ও  মাধুর্যের  ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯০২ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর   আঁকলেন  চতুর্ভূজা ভারতমাতা র চিত্র। দেবীর হাতে ধানের গুচ্ছ ও কমণ্ডলু। ছবিটি র নাম  দিলেন বঙ্গমাতা।
সমাজে দুর্গা সম্পর্কিত ধ্যান ধারণা বাবু সংস্কৃতি র সময় থেকে সমানে পরিবর্তিত হয়েছে। বাবু সংস্কৃতি র জন্য সমাজে অবক্ষয়ের কালো ছায়া দেখা দিলেও তা স্থায়ী হয় নি।  এই উৎসব ক্রমশঃ জাতি ধর্ম  নির্বিশেষে সকলের  আনন্দ ও  মিলনের  উৎসবে পরিণত  হয়েছে।
বারোয়ারি  পুজোর  জাঁকজমক  ও সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে।  বিশ্বায়নের যুগে অনেক  বারোয়ারি পুজো তে ভক্তি কে  গ্রাস করতে চাইছে থিমের  ধারণা,বাজি ,আলোর রোশনাই ,প্রতিযোগিতা ,পুরস্কার  ও মিডিয়ার  তীব্র  আলো। বনেদী বাড়ি গুলি  সাবেকী ঐতিহ্য  আঁকড়ে ধরে রাখার  চেষ্টা করে চলেছে। মঠ ও মিশনের ভক্তি ও নিয়ম  নিষ্ঠা আন্তরিকতার  বিষয়টির ও এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট  গুরুত্ব  আছে। বাস্তবিক  ই অন্তরের ভক্তি ও  শ্রদ্ধার  বিনম্র  নিবেদনের কোন  বিকল্প নেই, হতে পারে না। বারোয়ারি  বা বনেদী যাই হোক  দুর্গোৎসবের জন্য  সকলেই   অপেক্ষা করে থাকে।শিউলির আলপনায়, কাশফুলের  চামর দোলায় , রৌদ্র ও মেঘের  লুকোচুরি  খেলায়  বেজে ওঠে মাতৃ আবাহনী  মন্ত্র। অসুর বিনাশিনী দেবী ভক্তের  আহ্বানে তুষ্ট  হয়ে সানন্দে বরাভয় প্রদান করেন --
সর্বদৃশা মম স্থানং সর্বেকালব্রতাত্মকা
উৎসবাঃ সর্বকালেষু যতোঽহং সর্বরূপিনী।





করম পূজা 
শ্রাবণী সেনগুপ্ত 


অরণ্যচারী শিকারী জীবন থেকে কৃষিজীবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ থেকেই করমের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। সাঁওতাল লোককথা ও সৃষ্টিতত্ত্বে করম হলো আদিমতম বৃক্ষ।পুরাণ ও লোককাহিনীতে করম উৎসবের উৎপত্তির কথা রয়েছে।শস্য এবং সন্তান কামনায় গ্রীসদেশে
Garden of Adonis  নামে যে অনুষঠান পালিত হয় তার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের করম উৎসবের এক আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
                         করম পালনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষিজীবি কুড়মি জাতি অন্যতম হলেও
ভূমিজ,খেড়িয়া,কামার,কুমার,বাগাল,রাজোযাড়,ঘাটুয়াল,হাড়ি,বাউরী,ডোম,সাঁওতাল,মুন্ডা,ওরাওঁ,হো সকলেই করম পালন করে।মূল আদি বাসিন্দা ছাড়া অন্যেরা এখনো করম উৎসবে সামিল হতে পারেন নি।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া,ঝাড়খন্ড,মেদিনীপুরে
এবং এককথায় পুরো ঝাড়খণ্ডী এলাকায় করম উৎসব অত্যন্ত নিষঠার সঙ্গে পালিত হয়।ড.বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত,ড.আশুতোষ ভট্টাচার্য,ড.বিনয় মাহাত,ড.সুধীর করণ,স্যার জেমস ফ্রেজার,ডলটন সাহেব,রাধাগোবিন্দমাহাত, শরৎচন্দ্র রায়, সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ বিদগ্ধ্জনেরা করম সম্বন্ধে গবেষণা করেছেন এবং একে কৃষিউৎসব বলে চিণ্হিত করেছেন।

                       গরাম দেবতার পুজোর পরেই ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে ধান রোপণের কাজ শুরু হয়ে যায়।ধান এই এলাকার একমাত্র ফসল না হলেও প্রধান ফসল।সাধারণতঃ শ্রাবণ মাসের শেষ বা ভাদ্র মাসের মাঝামাঝির মধ্যে ধান রোঁয়ার কাজ শেষ হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময়েই উপযুক্ত রোদ,বৃষ্টির স্পর্শে চারাগাছগুলি সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে।এই সময়েই ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে পর্যাপ্ত ফসলের আশায় কুমারী মেয়েরা 'জাওয়া' নামে একটি বর্নাঢ্য অনুষঠানের মাধ্যমে শস্যোৎসব পালন করে থাকেন। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনে কুমারী মেয়েরা একটা ডালার মধ্যে বালি দিয়ে ঝাড়খণ্ডে যে সব শস্য জন্মায় সেইসব শস্যবীজ কাঁচা হলুদে রাঙিয়ে ঐ থালাটির মধ্যে চারা দেয়।তারপর একাদশী তিথি পর্য্যন্ত রোজ সন্ধ্যায় তারা ঐ ডালাটিকে মাঝখানে রেখে নাচ গান সহকারে নবাঙ্কুর চারাগাছগুলির বন্দনা করে ।হাত ধরাধরি করে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে কোমর দুলিয়ে পা ফেলে ফেলে ঘুরে ঘুরে যৌথ নৃত্য করে ও গান গায়।তারপর একাদশী তিথিতে আসে তাদের করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনের দিন।একাদশীর দিন গ্রামের কুমারী মেয়েরা করম ঠাকুরের পূজার ফুল তুলতে বনে যায়।সারাদিন তারা নির্জলা উপবাসে থাকে।দিনের শেষে সূর্য অস্ত গেলে পূজোর জন্য সংগৃহীত ফুল নিয়ে তারা ঘরে ফেরে।ঐ সমস্ত ফুল তুলসীতলায় রেখে তারা গ্রামের পুকুরে স্নান করতে যায়।স্নান শেষে পুকুরের   ধারের ক্ষেত থেকে তারা মুঠো ভরে নিয়ে আসে নতুন ধানের সবুজ পাতা করম ঠাকুরের কাছে অঞ্জলি দিতে।ঘরে ফিরে সারাদিনের সংগৃহীত ফুল ও ফল থালায় সাজিয়ে,জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে গাঁয়ের আখড়ায় বা যে বাড়িতে পূজোর জন্য করম গাছ পোঁতা 
হয়েছে সেখানে সেই করম গাছের তলায় সবাই উপস্থিত হয়।ব্রত উদযাপনকারিণীদের প্রত্যেকের থালায় থাকে একটি করে সবৃন্ত,সুপুষ্টূ 
কাঁকুড়।করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনকারিণীদের পার্বতী নামে অভিহিত করা হয়।এই কাঁকুড়টিতে পুরোহিত সিঁদুর মাখিয়ে দেন।কাঁকুড় পুত্রের প্রতীক এবং এই কাঁকুড়ের মতো সুপুষ্ট পুত্র প্রার্থনা করম পূজার ব্রত উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য।পুরোহিত ব্রতকথার মাধ্যমে পার্বতীদের করম ঠাকুরের ব্রত উদযাপনের গুণাগুণ শুনিয়ে থাকেন।এই ব্রতকথা  শোনানো  শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেদিনের মতোন পূজোর অনুষঠান শেষ হয়।এরপর করম গাছটিকে ঘিরে সারারাত চলে নাচ গান।ধামসা মাদল বাদ্যযন্ত্র সহযোগে চলে পাতা নাচ বা দাঁড় নাচ।পরের দিন সকালে দেওয়ালে তুলসী মঞ্চের অনুরূপ গোবর জলে করম ঠাকুর এঁকে গুঁড়ির ছোপ দেয়।স্নান করার সময় নদি-পুকুরঘাটে ঝিঙে পাতে তেল হলুদ দাঁতন দেয়।ধান ক্ষেত থেকে মূলসমেত ধান ঝাড় তুলে এনে সিঁদুর দিয়ে করম ঠাকুরের কাছে রাখে,তারপর আলত পাতে বাসি ভাত দিয়ে পারন করে।
                   জাওয়া ডালি ভাঙার সময় পার্বতী রা বছরের শেষ জাওয়া নাচ নেচে নেয় এবং করম ঠাকুরকে বিদায় জানায়-
               জাহু জাহু করম গুঁসাই
                জাহু  ছও মাস গ ,জাহু ছও মাস।
                পড়ত ভাদর মাস আনব ঘুরাই।
জাওয়া ভেঙে জাওয়ার অঙ্কুর শস্যক্ষেত্রে দেওয়া হয়,কেউবা ছাতা পরবে ছাতা ডাঙ্গে দেবার জন্য রাখে।
                          সাঁওতালেরা ডাল করম কে বলে কারাম।ঘরের চালে বাস্তুভিটায় করম গাছ জন্মালে শস্য ক্ষেত্রে পোঁতা ডালিতে ডালপালা গজালে,ধানের গাছে তসর বাঁধলে করম পূজা  করতে হয়।নিজস্ব নাচ গান থাকলেও পূজা অনুষঠানে পুরুষেরাই অংশগ্রহণ করে।মেয়েদের ওখানে কোনো স্থান নেই।
                             করম ও জাওয়া গানগুলিতে সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।আবার গীত হিসাবে আবাহন বিসর্জন তো আছেই।তাছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক,ঐতিহাসক,অর্থনৈতিক বিদ্রোহ,বিক্ষোভ,জীবনবোধের অবস্থা,ঘটনা,ভ্রাতৃপ্রেম ,নারী সমাজ,ব্যঙ্গবিদ্রূপ,সন্তান,দেবর,ননদ,বাপের বাড়ি,শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ প্রভৃতি রূপ চিন্হিত হয়েছে।
                       জাওয়া করমের মূল ভাষা কুড়মালি।অধুনা বাংলা,হিন্দি ও উড়িয়া ভাষারও গানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে।পুরুলিয়ার শীতলপুর ডুংরি ও ময়ূরভঞ্জের ভাঙাপাহাড়ে করম মেলা বিখ্যাত।এই উৎসব লোকজীবনের ঝাড়খণ্ডী নৃত্য ও সঙ্গীতের উৎস এবং লক্জিবনের দর্পণ।
     "এক দিনকার ইলদ বাঁটা তিন দিনকার বাসি 
                                                             লো।
       মা বাপ কে বলে দিব বড় সুখে আছি লো।।"
করম অনুষঠানে কোথাও কোথাও একটির বদলে দু'টি করম গাছ বা ডাল পোঁতা হয়।এই দুইটির একটি পুরুষ এবং অপরটি প্রকৃতি বা সূর্য এবং পৃথিবী।এদের উভয়ের মিলনে ধরিত্রী শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে এই আশাতেই করম শাখার প্রতীকের মাধ্যমে এদের বিবাহ অনুষঠান সম্পন্ন করা হয়।করম পূজার আচার অনুষঠানগুলির প্রতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে এগুলি একাধারে যেমন হরপার্বতীর মিলন অনুষঠান,তেমনই সূর্য ও পৃথিবীর মিলন অনুষ্ঠান।







অভ্রদীপ ঘোষ

 


। পুজো ভ্রমণ। 


রানি রুদাবাঈ 

চিত্রা পাল

পুবের শহরে থাকি, চলে গেলাম দেশের একেবারে পশ্চিম সীমানায়, চলার পথে বদল হতে লাগলো ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ,‌ মানুষ তার সঙ্গে মানুষের জীবনযাপন। এই বদল  খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করলাম পশ্চিমের শহরে এসে। আমার এবারের যাত্রা শুরু গুজরাট  প্রদেশের আমেদাবাদ শহর থেকে।কিছুদিন আগেও আমেদাবাদ গুজরাট রাজ্যের রাজধানী ছিলো,এখন তা গান্ধীনগরে স্থানান্তরিত। আমেদাবাদ শহর থেকে ১৮ কি।মি দূরে আদালজ নামে এক গ্রামে আছে এক গভীর কুয়ো বা স্টেপ ওয়েল, পরদিন সকালে সেই কুয়ো দর্শনের জন্য চলে এলাম আদালজ।

   রুদাবাঈ স্টেপওয়েল বা কুয়ো যাকে গুজরাঠিভাষায় বলে ভাব।আগেকারদিনে এই  ভাব বা জলাশয় রাজামহারাজারা দেশের জনগনের হিতার্থে উ‌ৎ‌সর্গ করতেন। আমাদের দেশেও এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত  পুকুর সরোবর আছে, যা সেইসময়ে সেখানকার অর্থবান মানুষজন সাধারণের ব্যবহারের জন্য উৎ্‌সর্গ করে দিয়েছিলেন।  গুজরাট শুষ্ক অঞ্চল, একেবারে মরুভূমির গায়ে লাগা।গ্রীষ্মে সুতীব্র দাবদাহ ও জলকষ্টহয়।তা থেকে বাঁচাতে প্রজা হিতার্থে রাণী রুদাবাঈ ১৪৯৮সালে তাঁর স্বামী রাণা ভীর সিংহের স্মৃতিতে এটি নির্মাণ করান। ভারতীয় স্থাপত্যের এটি একটি অসাধারণ  নিদর্শন।বালি পাথরে নির্মিত পাঁচতলা গভীর এই জলাশয় এক অসামান্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ও। রাণী রুদাবাঈ এর নিজের মর্যাদা রক্ষার্থে  এই ভাবএ  জীবনদানের মর্মন্তুদ কাহিনী পর্যটকদের অশ্রুসজল করে তোলে।আজও তাঁর কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে।  

     পঞ্চদশ শতকে এই দন্ডাই দেশে রাজত্ব করতেন বাঘেলা বংশের হিন্দুরাজা ভীরসিংহতাঁর রাজ্য ছোট ছিল। কিন্তু তাঁর রাজ্যে ছিলো প্রবল জলাভাব। সব সময় বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করতে হতো। গ্রীষ্মকালে জলকষ্টতো ছিলোই, আবার যে বছর বৃষ্টি কম হতো, তখন সারা বছরই জলের অভাব দেখা দিতো।জলের জন্য মানুষের কষ্টের আর সীমা ছিলো না। রাজা ভীর সিংহ রাজ্যের মানুষের জলকষ্ট দূর করার জন্যএকটা গভীর কুয়ো জলাশয় নির্মাণ করার কাজে ব্রতী হন। এই কুয়ো নির্মাণ শেষ হবার আগেই  প্রতিবেশী রাজ্যের মুসলিম শাসক মহম্মদ বেগদা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজা ভীর সিংহ তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। আর তাঁর রাজ্য মহম্মদ বেগদার করায়ত্ত হয়।রাণা ভীর সিংহের পত্নী রাণী রুপবা  বা রুদাবাঈ পরলোকগত স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবার বাসনায় সতী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।  সবাই জানে সতী হবার অর্থ অগ্নি কুন্ডে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া।

রাণী রুদাবাঈ ছিলেন অপরুপা সুন্দরী। রুপমুগ্ধ মহম্মদ বেগদা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন ও রাণী সে প্রস্তাবে সম্মতি দেন।  কিন্তু শর্ত একটাই যে তাঁর স্বামীর আরব্ধ কাজ,এই জলাশয় নির্মাণ আগে সম্পূর্ণ করতে হবে।  মহম্মদ বেগদা দ্রুত, খুব কম সময়ে এই কুয়ো বা জলাশয় নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন।এবার মহম্মদ বেগদা রাণীর প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন।তখন রাণী তাঁর সহচরীদের নিয়ে কুয়ো প্রদক্ষিণ করে কুয়োর জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেন।

  এই কুয়োর কাছে দুশো বছর আগেকার এক সমাধি লিপিতে এই কথা উৎ্‌কীর্ণ আছে, কুয়ো নির্মাতা  ছয় জন স্থপতির সমাধি এটি।শোনা যায়, মহম্মদ বেগদা কুয়ো নির্মাণকারীদের ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলো   যে এই রকম আরো একটা কুয়ো নির্মাণ  করতে পারবে কিনা। ছয় জন নির্মাণকারী বলেছিলো হ্যাঁ, তারা পারবে। বেগদা এই কুয়োর স্থাপত্যে এতো মুগ্ধহয়েছিলেন যে তিনি চাইছিলেননা আরো একটা এরকম   কুয়ো  কেউ তৈরি করুক। তিনি তৎক্ষণাৎ্‌ ওই ছয়জনকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।

    প্রজাহিতার্থে এই কুয়ো বা জলাশয় নির্মাণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা  অশ্রু সজল কাহিনীও কম গুরুত্বের নয়। কয়েক শতক আগেও এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাণী জনসাধারণের সুবিধার জন্য, মঙ্গলের জন্য নিজের প্রাণদান করতেও দ্বিধা করেননি, তা ভেবে আজকের যুগে দাঁড়িয়েও আমাদের মাথা  নত হয়েছিলো।        



মন চলো যাই
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী 


এই একটু আগে স্টেশনে ট্রেন ঢুকলো । বেশি কিছু নেই সঙ্গে বাক্সো প্যাটরা । শুধু একখানি ব্যাগ । গতকাল বিকেলে উঠেছিলাম বরাক ভ্যালি এক্সপ্রেসে দুমুঠো আতপের ভাত খেয়ে । কিসের এক্সপ্রেস ! গরুর গাড়িও জোরে ছোটে । মিটারগেজ লাইন । কামরাভরা দেহাতি মানুষ লটবহর নিয়ে । নামছে , উঠছে । যেদিকে তাকাই , শুধু ধানের খেত , একটু পর পর জঙ্গল । লামডিং কখন যে পেরিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি । তখন রাত । বসে বসেই ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম কুকুরশাবকের মতো । ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটলো , আর ভেসে উঠতে লাগলো অসাধারণ সব চিত্রপট। পাহাড় । তার গায়ে লেপ্টে থাকা সবুজ । নল বাশের বাগান রেল লাইন ছাড়িয়ে ট্রেন ছুতে চায় যেন । হাফলঙ্গে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে , ধেখলাম পেছনে আরেকটি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে । একটূ পরেই ট্রেন খাড়া উঠতে লাগলো , ঝুকে পড়লাম পেছনে । আবার নেমে গেলো , এবার সামনে ঝুকলাম । এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে এক লোহার সেতু , ট্রেন ধিকি ধিকি চলছে । নিচে বিস্ময় , ছোট্ট উপত্যকা ভূমি ।পিপড়ের আকারের মানুষ কি যেন করছে সেখানে । রেখার মতো নদী , সবুজের গালিচার মধ্য দিয়ে সূতোর মত গেছে ।বিকেলে বদরপুর । এখান থেকে ধর্মনগর নাকি খুব কাছেই । আমরা চার বন্ধু , অভিযানে নয় , চাকরির পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে পড়েছি । শিলচর স্টেশনের গায়ে এক বন্ধুর স্বল্পপরিচিত পরিবার । হোটেলে থাকবার সামর্থ্য নেই , তাই চেনা বাড়ি খুজে নিই আগে । দরজায় টোকা দিলাম । মাসিমা সদৃশ মহিলা আগল খুলে বললেন , খিতা খরলা , এথো দেরি !
অনেক কথাই মাসিমার বুঝতে পারি না । বাধ্য ছেলের মতো শুনি , কী বলছেন বোঝার চেষ্টা করি , বুঝতে পারলে উত্তর দিই আর বাদবাকিতে আন্দাজে মাথা দোলাই ।
ডিমের ঝোল , আলু ভাজা , ভাত ; জম্পেশ খাওয়া হল , প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাদে। আহা , অমৃত । যেমন স্বাদ রান্নার , তেমনি মাসিমার আদর যত্নের । এক ঘরের মেঝেতে ঢালা বিছানা হল । আসল গন্তব্য কিন্তু শিলচর নয় । আমরা আরো দূরে যাবো , যেখানে যাওয়ার কথা অনেকেই ভাবতে পারে না। অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়েছি । প্রাত্যকৃত্য সেরে বেরিয়ে পড়লাম । মাসিমা অনেক করে চায়ের কথা বললেন বটে , কিন্ত তাঁর আর যন্ত্রণা বাড়াতে মন চাইছিল না । আমরা যাবো আইজল , মিজোরামের রাজধানী । আন্তঃরাজ্য পাস নিতে হবে । চারটেয় গিয়ে মিজো পরিবহনের কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ালাম । একজন দাঁড়াই , তিনজন বসে জিরাই । পরীক্ষার প্রবেশ পত্র দেখিয়ে ছাড় পাওয়া গেল । ঘন্টা দুয়েক বাদে পাস হাতে বাসের টিকিটও কাটা হল । বাস ছেড়ে দিলো ঠিক আটটায় । আমরা চার মূর্তি পাশাপাশি দুই আসন পেয়ে গেছি বলে কয়ে । বাস তো ছাড়লো , কিন্তু পেটের কোনো ব্যবস্থাই করা গেল না । চায়ের দোকানে ঝাপ তখনো ওঠে নি , সময়ও নেই দূরে দেখবো , পকেটের অংকটিও মাথায় রাখতে হচ্ছে । দেখা যাক , চল তো , পথে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে । শিলচরের পরিবেশ আর আমাদের এদিককার অনেকটাই এক রকমের । সমতল ভূমি , সুন্দর শহর । গোছানো কিন্ত ফাঁকা । মসৃন পাকা রাস্তা ধরে বাস ছুটলো , ঘন্টাখানেক । সব যাত্রী শান্ত হয়ে বসে । তারপর পাকদন্ডী শুরু , সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠছে । সঙ্গে উঠে আসছে পাটের নাড়িভুড়ি । মিজো সীমান্তে পাস চেকিংয়ের পর আবার চললাম । অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য চারদিকে । মুগ্ধ হয়ে দেখছি । যোয়ান যোয়ান মিজো ছেলেগুলো দামাল হতে শুরু করলো । প্রত্যেকের কাছেই ছোড়াছিল , সেগুলো ওরা বার করে হাতে ধার করলো , যেন এক্ষুনি মুরগি জবাই করবে । বাসের মধ্যে মোটেই আমরা চার বাঙ্গালী , বাকি সব ওরাই , সব বয়সের , মহিলা বা পুরুষ । অল্প বয়সীরা দল বেঁধে দুর্বোধ্য কোরাস গাইতে শুরু করেছে , খোলা চাকু হাতে , মিজো মেশানো ইংরেজি ভাষায় । আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি , পেটের খিদের চেয়ে প্রাণের ভয় বেশি হল । দুপুর নাগাদ পাহাড়ের গায়ে এক মাঠ মতন জায়গায় বাস থামলো । দুতিনটি খাবারের দোকান , আশেপাশে খোলা স্থানে দোকান বিছিয়ে আছে মহিলারা , দোকান মানে একরকমের সাদা বিড়ি । এখানে মেয়েরাই ব্যবসা চালায় । অনেক কষ্টে বোঝাতে পেরে একটি করে ডিম ভাজা ও পাউরুটি খেলাম ।

বুঝতে পারছিলাম হিমালয়ের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছে গেছি । যে দিকে চোখ যায় , শুধুই পাহাড় আর পাহাড় ; পাহাড় বলা ভুল হল , পর্বত বলাই সমীচীন। তবে ন্যাড়া নয় , বরং ঘন আর হালকা সবুজে ছয়লাপ । একটাই রং দূরে সমান্তরাল - সবুজ, উপরে কেবল নীল । আর কিছু তুলো উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে । হোটেলের মালিক পরিস্কার বাংলায় বললেন , সূর্যাস্তের পর ঘর থেকে বেরবে না কেউ , কেউ  ডাকলেও । গায়ে কাঁটা দিল যেন , এমন বিপজ্জনক সতর্কবানীতে এবং আইজলের এক মিজো হোটেলের মালিকের মুখে স্বচ্ছন্দ বাংলা শুনে । বললাম , আপনি বাঙ্গালী দাদা ? দেখে তো বুঝতে পারিনি ?
শিলিগুড়ির লোক আমি । পিওর বাঙ্গাল । মালিক বললেন । এতদূরে অজানা পরিবেশে ব্যবসা করছেন! কিভাবে যোগাযোগ হল এখানে ?
আমাদের ছিল জিজ্ঞাসা ।
তিনি এখানে অনেকদিন , প্রায় কুড়ি বছর আগে এসেছেন , এখানেই মিজো বিয়ে করে থিতু ।
ব্যক্তিগত বিষয়ে আর উৎসাহ দেখানো ঠিক নয় । দোতলার এক ঘরে ঠাঁই হল । 

কাচের শার্সিতে যেন মায়ামাখা ছবি কোন এক দুরন্ত শিল্পী ছবি এঁকে গেছেন ।




চিলাপাতার জঙ্গলে 

    কবিতা বণিক

নিরিবিলি কোন জঙ্গলে রাত্রি বাস করার একটা সুযোগ পেয়ে চলে গেলাম চিলাপাতা ফরেস্ট এর উদ্দেশ্যে। কোচবিহারের রাজ সেনাপতি চিলা রায়ের নাম অনুসারে এই জঙ্গলের নাম চিলাপাতা ফরেস্ট। বিকেলবেলা বেরোনোর ফলে পৌঁছতে রাত্রি হয়ে গেল।  দিনহাটা পার হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রামের রাস্তা ধরে এগোচ্ছি।



কোথাও মোটামুটি ভাল রাস্তা আবার কোথাও মাঠ পেরিয়ে বনের মধ্য দিয়ে গা ছমছমে রাস্তা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে। গিয়ে উঠলাম একটা রিসোর্টে " চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প।" বেশ সুন্দর পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছেরা দু-একটা বৃষ্টির ফোটা দিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো। আমরাও আপ্লুত হলাম। মনে মনে বললাম সারা পৃথিবী জুড়ে তোমাদের সুরক্ষার দায়িত্ব যে আমাদেরই।  চারিদিকে মৃদু আলো আছে কিন্তু সবই ফুটল্যাম্প এর  কাজ করছে। যাতে বন্য পশু, পাখিদের কোন কষ্ট না হয়। রিসোর্ট এর ভিতরে অনেক রকমের গাছ আছে। বৃষ্টিভেজা বাগানের সরু বাঁধানো পথ ধরে নানান গাছগাছালির মধ্য দিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কনসার্ট শুনতে শুনতে পৌঁছলাম আমাদের নির্দিষ্ট কটেজে। বেশ অনেকগুলো কটেজ আছে। প্রথমেই মনে হোলো ভোরে উঠতে হবে। ভোরের আলোয় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কে মনের মনিকোঠায় বন্দি করে নিয়ে যাব। 




মোরগের ডাকে বাইরে বের হলাম। অনেক মোরগ-মুরগি ছুটে ছুটে খেলছিল। কত পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা। কত  রকম গাছ আম ,বকুল ,কাঞ্চন ,অর্জুন, খয়ের, বয়রা ,সেগুন, শাল আরও  নাম-না-জানা কত গাছ। রিসর্টের পিছনদিকে   সীমানার বাইরে সবুজ ধান ক্ষেত অনেকটা দূর পর্যন্ত। চলে এলাম সামনের দিকে। ডাইনিং স্পেসের পাশেই একটা দীঘি আছে। ডাইনিং হল টা টিনের চাল কাঠের খুঁটির ওপর বাঁশের অর্ধেক বেড়ার ঘর। খাবার টেবিলে বসে চারিদিক খোলা থাকায়  চার-পাশটা বেশ ভাল দেখা যায়। কটেজ গুলোর আশে পাশে গাছ গাছালির ফাঁকে ফাঁকে বসার জায়গা করা আছে। মাঝে মাঝে কোথাও দোলনা দিয়ে ও বসার জায়গা দিয়ে  সুন্দর সাজানো হয়েছে। রাতেও খুব বৃষ্টি হয়েছে, এখন বেশ পরিষ্কার আকাশটা। সামনের গেটটা খুব সুন্দর করে সাজানো। " চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্প "লেখা আছে।  জঙ্গলে ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা দিচ্ছে এই ক্যাম্প। গেটের সামনে দিয়ে পিচের রাস্তার ওপারে সবুজ ধানক্ষেত অনেক দূর পর্যন্ত। ধানক্ষেতের পেছনদিকটা চিলাপাতার জঙ্গলে ঘেরা।




           দশটা নাগাদ বের হলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল গাছবাড়ি। আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। বড় বড় গাছের ওপর একজন বা দুইজন মানুষ বেশ বসতে বা শুতে পারে এতটাই বড়। মইয়ের মত সিঁড়ি দেওয়া ওপরে ওঠার জন্য। ছোট ছোট নদী, জলের ধারা, বর্ষায় এমন রূপ নিয়েছে চারিদিক থেকে সবাই বয়ে চলেছে অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে। কোথাও এমন জলের ধারা পরছে মনে হল যেন চিত্রকূট পৌঁছে গেলাম। বর্ষায় নদীগুলো যেন রূপসী যুবতী। জলের ধারার চলার ছন্দ, পাথরে পাথরে জলের কলতান এই সুর তো কত সাধনা করে তোলেন রবিশংকর , ভীম সেন যোশী। অপূর্ব সুরের মূর্ছনা জলের। কতনা ধারায় কতনা ছন্দে নেচে নেচে গেয়ে চলেছে।  বর্ষায় জল-জঙ্গলের যে মেলবন্ধন সেই অপরূপা শ্যামলীকে যখন সূর্যের কিরণে দেখি তার মোহময়ী নোলক ও কুণ্ডলের এর দ্যুতি  যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।  রাস্তা থেকে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে চুপচাপ মাছ ধরার কাজ। খাইবে সুখে খিচুড়ি আর মাছ ভাজা। আবার বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দল বেঁধে গাছের পাতায়, রাস্তায় নেমে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আমরা বৃষ্টির খেলা দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম।






। শারদীয়া গদ্য।   

মা আসছেন
শ্রাবণী সেন

ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ছে খুব। 
কি মাস এটা? আশ্বিন?  আশ্বিন মাস! 
তুলোর মত হাল্কা হাল্কা মেঘ উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে  বলে গেল "ঘরবার  সব গুছিয়ে রাখ গো সব গুছিয়ে রাখ! মা আসছেন, মা আসছেন।"
মা আসছেন ঘরের মেয়ের রূপধরে। তাই আগে ভাগে আগমনী গান গেয়ে কাশফুল এল, শিউলি ফুল এল, স্থলপদ্ম সেও এল বৈকি।
শেষ বর্ষণের আকাশজলে মুখ মেজে প্রকৃতি তাই একেবারে প্রস্তুত।
মা আসছেন, জগজ্জননী মা দুর্গা আসছেন।
দশহাতে দশ প্রহরণধারিণী মা অসুরনাশিনী আসছেন।
এসো মা এসো...



শারদীয়...
তমালী  দাস

শারদ প্রাতে সোনালী রোদ্দুর, কাশফুল, পূজোর গন্ধ, উৎসবের আমেজ...সব আসে।এর সঙ্গে অবধারিত ভাবে প্রচুর স্মৃতি আসে।জীবনের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে যদি পূজোর অনুভূতি খুঁজতে যাই..সত্যি বলতে,তেমন আনন্দের মুখ মনে পড়ে না।শৈশব,কৈশোর.. সব বয়সেই পূজো আসত আর এক অদ্ভুত বিষাদ নামতো মনোভূমি তে।আমার বোধহয় শরৎ তেমন প্রিয় ছিল না।ছিল...যতদিন অবধি ভোরবেলা শিউলি ফুল কুড়ানো ছিল,তার হলদে বোঁটার রঙ হাতে লেগে যাওয়া ছিল...ততদিন।তারপর ভালোলাগা এল হেমন্তের চরাচর জুড়ে। পুজো নয়,পুজো পরবর্তী নিসর্গ বড় প্রিয় হয়ে উঠল।কোজাগরী চাঁদ ছোটো হতে হতে মিশে যেত দীপাবলির আলোয়..তারপর সবকিছুর বিসর্জনান্তে,ফসল কাটার পর পড়ে থাকা মাঠের বুকে লেগে থাকত পাতলা সরের মত কুয়াশা।দূর রাস্তা থেকে উদাসী চোখ অনিমেষ চেয়ে থাকত ঐদিকে। সন্ধ্যের হালকা ভেজা ভেজা ভাব,বাতাসে হিমেল আমেজ..এসবই প্রিয় হল।পূজো প্যান্ডেলে জমজমাট আড্ডা,হৈচৈ,পারিবারিক উদযাপন,অজস্র উৎসবমুখর ভিড় থেকে সরে থাকা বয়ঃসন্ধি কিভাবে পেরিয়ে গেল জীবনের চৌকাঠ... আজ পূজোর স্মৃতির ভিড়ে সেগুলো অতীত। পূজো নয়,পূজো পরবর্তী হেমন্তবেলা বড় প্রিয় হয়ে উঠল।

                                      

শারদ কথা 
জয়িতা সরকার 


নীল আকাশ,সাদা মেঘ, আর বাতাসে মন কেমনের গন্ধ মানেই প্রকৃতি জুড়ে শরতের সুর। শহর জুড়ে উৎসব আমেজ। আকাশটা আজ একটু বেশিই নীলচে। মেঘের আনাগোনাও আছে। কিন্তু ছেলেবেলা নেই। নতুন জামার গন্ধ তো আর তেমন করে মন ভোলায় না, কিংবা পঞ্চমীতে স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পুজোর প্ল্যানিং গুলো আজ কেমন ' পুজোতে আসছিস নাকি' এই প্রশ্নেই ইতি টানে। 

শরৎ এলেই ঘরে ফেরার ডাক আসে। তিস্তা পাড়ে কাশফুল গুলো মাথা নাড়িয়ে আগমনী তালে ছন্দ মেলায়। কুমোরটুলির ব্যস্ততায় পুজো আসে মন জুড়ে। কমলা-সাদা শিউলি ভরা উঠোন জুড়ে শারদ সকালের মিঠে রোদে পুজোর সুর বাজে প্রকৃতিতে। মাঠের কাঁচা পাকা ধানগুলোও যেন অপেক্ষা করে ঘরের মেয়ের পথ চেয়ে। 

শরৎ মানেই একমুঠো মুক্তো বাতাস, ছুটির আমেজ, দূর থেকে কাছে ফেরার তাড়া। হই-হুল্লোড়, ছেলেবেলা,স্মৃতিগলি বেয়ে এই মন্ডপ , ওই মন্ডপে শৈশব খুঁজে পাওয়া। অথবা কিশোরী বেলার প্রথম ভালোলাগার অপেক্ষা। আমার শহর জুড়ে পুজোর ভালবাসার এমন কত গল্প ছড়িয়ে আছে। 

ওই যে প্রথম শাড়ি পড়ে আশ্রম যাওয়ার তাড়া। অষ্টমীর সকালে হাজারো চোখ এড়িয়ে প্রথম চোখাচোখি, সেসব মিলিয়ে শরতের স্বরলিপি জুড়ে শুধুই ভালবাসা। এই আশ্বিনে শরত জোড়া মন কেমনের রাত-দিন। ছেলেবেলার স্মৃতি সিন্দুকের ধূলো ঝেড়ে কাটিয়ে দেওয়া এক শরত। 

আসলে এবার নিজ শহরে শরত দেখার সুযোগ নেই। তিস্তা পাড়ে কাশ ফুলের হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার উপায় নেই। সাদা বালিতে ছুটে বেড়ানোর তৃপ্তি নেই। দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দও নেই। সাদা মেঘের ভেলায় দূরদেশ থেকে আসা চখাচখির সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ নেই। 

শরত জুড়ে যে পুজোর গন্ধ মাখা অনুভূতি, কিশোরীবেলা থেকে প্রথম প্রেমিকা হয়ে সংসার জীবনেও সেসবের  ছুঁয়ে যাওয়া। সময়ের নিয়মে মুহুর্ত বদলায়, তবে প্রকৃতি আসে নিজ রূপে নিজ সাজে। ধান ক্ষেতের রোদ ছায়ায় লুকোচুরি খেলা ছেলেবেলাকে হৃদয় সিন্দুকে যত্নে রেখে দূর থেকে ছুঁয়ে যাওয়া শরত হয়ত এভাবেই স্মৃতিযাপনের গল্প লেখে।



পূজার গন্ধ 

চম্পা বিশ্বাস 
 
"ও আয়রে ছুটে আয় পূজোর গন্ধ এসেছে, 
ড্যাং কুড়কুড় ড্যাং কুড়কুড় বাদ্যি বেজেছে।"
         শরত ঋতুর আগমনের সাথে সাথে সত্যি  সত্যিই যেন আকাশে বাতাসে একটা পূজার গন্ধ অনুভূত হয়। প্রকৃতি তার রূপের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় আমাদের আনন্দ দানের আশায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সকালে শিউলি ফুল কুড়ানো, তিস্তা, করলার পাড়ে ফুটে থাকা কাশফুলের সমাহার পূজার বার্তা বহন করে। 
           বাঙালীর বড়ো উৎসব দুর্গাপূজা। সারা বছর অপেক্ষা করার পর শরতের আগমনে তাই চারপাশে ছড়িয়ে পরে দেবীদূর্গার আগমন বার্তা। পূজার গন্ধে চারিদিক তখন ম-ম করছে। চারপাশের পূজা মন্ডপে মন্ডপে  শুরু হয় বাঁশ বাঁধার কাজ, দোকানে
দোকানে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়, সাধ্যমতো প্রতিটি বাড়ির  নবরূপে সাজ পূজার মাত্রা আরোও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।  
             ঋতুরানী শরতের প্রথম পূজা হল বিশ্বকর্মা পূজা। আর এই পূজার মধ্য দিয়েই উৎসবের মরসুমের সূত্রপাত। মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে ধ্বনিত -"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির।"--এই শব্দ গুলো বাতাসে পূজার গন্ধ ছড়িয়ে এক অনাবিল আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।




বিস্ময় 
শিউলী রায় 

"আয় রে ছুটে আয় 
পূজোর গন্ধ এসেছে 
ঢ্যাং কুড় কুড় ,ঢ্যাং কুড় কুড়‌
বাদ্যি বেজেছে ..."
ছোট থেকে এই গানটি শুনে বড় হয়েছি। পূজোর সময় এই গানটি শুনলে‌ আজ ও সমান ভাবে এক অন্য অনুভূতি জাগায় বা বলা যেতে পারে ছোটো বেলার স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।

তবে এই কথাটা বোধহয় সত্যি বাঙালি মাত্রই পূজোর গন্ধ পায় । পাবে নাই বা কেন, প্রকৃতি ও যে সেজে ওঠে নতুন সাজে। আকাশের নীল রঙ আর পেঁজা তুলোর মত আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে, পূজো আসছে। কাশফুল আর বাতাসে শিউলির সুবাস জানান দেয় মায়ের আগমনের সুর। পূজো আসছে এই অপেক্ষাটাই বড় মধুর।

পূজো এলেই ছোটবেলার টুকরো টুকরো বহু কথা খুব মনে পড়ে । তবে একট বিষয় ছোটো বেলায় আমাকে বড় অবাক করত, সে হলো প্রতিমা তৈরি করার কাজ । আমার মামাবাড়িতে যাওয়ার পথে দূর্গা প্রতিমা তৈরি করা হতো । পূজোর প্রায় এক - দেড় মাস আগে থেকেই শুরু হতো প্রতিমা গড়ার কাজ । সারা বছর সেই স্থান থাকত বিবর্ণ , রিক্ত কিন্তু পূজো এলেই সেই স্থান যেন তার শ্রী ফিরে পেত । চারিদিক কেমন সাজসাজ রব শুরু হয়ে যেত। সারিসারি প্রতিমার কাঠামো রাখা থাকত । মাটি ,খড়, কাপড়, দড়ি, রঙের বালতি ,তুলি আর সেই সাথে ব্যাস্ততা স্থানটিকে কর্মমুখর করে তুলত । 

যখন মামাবাড়ি যেতাম তখনই এক ছুটে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম প্রতিমা গড়ার কাজ । বাবা কে বলতাম - আমাকে প্রতিমা বানানো দেখাতে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে থাকতাম মা দুর্গার পায়ের কাছে । কত্ত বড় বড় দুর্গা প্রতিমা । শিশু মন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত শুধু । বড় ভালো লাগত দেখতে । কোনো কাঠামোতে তখন হয়তো মাটি লেপা হচ্ছে ,কোনটায় তখনও হয়নি । আবার কখনো গিয়ে দেখেছি মা দুর্গার গায়ে রঙ করছে, কাপড় পড়াচ্ছে । সকাল সন্ধ্যা কাজ চলত । ভেতরে হলুদ বাল্ব ঝোলান থাকত । আবার কখনো গিয়ে দেখেছি মাকে সাজানো হয়ে গিয়েছে । মা দুর্গা তার ছেলে মেয়ে নিয়ে মন্ডপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে । একটা নয় একের অধিক মা দুর্গা অপেক্ষারত একই স্থানে । এক নজরে সব প্রতিমার মুখগুলো দেখে নিয়েই নিজের মনে ঠিক করে নিতাম কোন ঠাকুর টা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে আর  মনে মনে ভাবতাম ওনারা কিভাবে পাড়ে এত সুন্দর করে প্রতিমা গড়তে । কোথায় আমরা তো পারি না । 

এই বিশ্ময় আর ভালো লাগাটা আজও রয়ে গিয়েছে । আজও বড় ভালোবাসি প্রতিমা গড়া দেখতে । সুযোগ পেলে অন্তত একবার হলেও দেখে আসি মায়ের মৃন্ময়ী রূপের সৃষ্টি দু চোখ ভরে । তবে সময়ের চাকায় আমার আর মায়ের সৃষ্টির স্থানের স্থান বদল হয়েছ বৈকি । 

আমার মনে হয় যেই স্থানে প্রতিমা গড়া হয় তার চাইতে পবিত্র স্থান কিছু হতে পারে না । মন্ডপের জাঁকজমক, আলোর ঝলকানিতে প্রতিমা দর্শন তো আমরা করেই থাকি । সেখানে আছে আড়ম্বরতা কিন্তু যেখানে একজন মানুষ কাঠের কাঠামো কে ধীরে ধীরে সাজিয়ে ,তিলে তিলে মায়ের রূপ দেয় তার চাইতে সুন্দর কিছু হতে পারে না । সেই স্থান জৌলুস হীন কিন্তু সেখানে রয়েছে একজন শিল্পীর আশা, তার সৃষ্টি যেন সকলের মন জয় করতে পারে । কাজের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একটা কাঠের কাঠামো মায়ের রূপ নিতে পারে । না দেখলে ভাবা যায় না । যা আজও আমার কাছে বিস্ময়ের । 




। পুজো ভাবনা। 


পুজোর সেকাল একাল 
স্বপন কুমার দত্ত 

পুজোর সেকালের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই মনের মধ্যে উঁকি মারে,ভোরের প্রভাতী অনুষ্ঠান " মহিষাসুর মর্দিণীর" কথায়। মহালয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই রেডিওর ব্যাটারী ভরে এবার শুধু প্রতীক্ষার পালা। তখনতো আর টিভি ছিলনা। হ্যারিকেনের আলোয় রেডিওর চারধারে বসে নি:শব্দে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে চন্ডীপাঠ শোনা সঙ্গে " বাজলো তোমার আলোর বেণু" সহ আরও নানা গীতিমাল্য। সেদিন থেকেই বেজে যেত,পুজোর বাদ্যি। শ্বেতশুভ্র শিউলির আলোয় চারদিকে আলোর রোশনাই। নীল মেঘের ভেলার নীচে কাশফুলের গহীন সমুদ্রে অপু দূর্গাদের শুধু অবাক চাহনি আর সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে আলপথ ধরে ছুটে চলা।শিউলি,শালুক, পদ্ম,স্থলপদ্ম সংগ্রহ করার মধ্যেই সেকালের ছোটবেলা কেটেছে আমাদের পুজোর সময়।

               এরই মধ্যে শুভ রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো দিয়ে শুরু হয়ে যেত প্রতিমা নির্মানের কাজ। প্রতিমা গড়ার কাজ কতটুকু এগোলো,পাঠশালা যাওয়া আসার পথে বা অন্য সময় অবশ্যই উঁকি মারা চাই,পাড়ার চন্ডী মন্ডপ বা কুমোরটুলিতে।ইতিমধ্যেই এসে পড়তো,পুজোর জামা কাপড় জোগাড়ের পর্ব। বাড়িতে দর্জি ডেকে একই থান কাপড়ে বানাতে দেওয়া হত,সব ছানাপোনাদের পিরান,ফ্রক,আর ইজের। পুরুষদের জন্যে ধুতি আর মহিলাদের জন্য তাঁতের সাধারণ আটপৌরে শাড়ি।পোশাকের গুণগত মান বা দাম নিয়ে কারোর থাকতোনা কোন মতামত বা অভিযোগ। সবাই সানন্দে সেটা তুলে নিত মাথার উপর। নতুন কাপড়ের গন্ধটা পেলেই হল। সেকালে সংসারে অভাব ছিল ঠিকই,কিন্তু স্বল্পতা কোনদিন প্রাধান্য পেয়ে প্রকাশ করেনি নিজেদের দৈন্যতা। অল্পেই খুশি হত সবাই পুজোর বাজারের সামগ্রী নিয়ে।

            এরপর প্রতিমা আনয়ন করবার ব্যাপার  একচালা ডাকের সাজের প্রতিমা উৎসাহী  জনতার কাঁধে চেপে, জমির আলপথ ধরে আসতো দুর্গা মন্ডপে। বাজেটের আতিশয্যে নয়, সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে সেকালের পুজো হয়ে উঠতো,প্রানবন্ত, মনোগ্রাহী এবং ভক্তিরস সিঞ্চিত। বৈদ্যুতিক আলো বা এল ই ডির মোহময়ী আলোকসজ্জা নয়, সামান্য হ্যাজাকের মৃদু আলোয় মা দুর্গা সপরিবারে মন্ডপে করতেন অবস্থান, হাস্যময়ী বরাভয় প্রদায়িনী রূপে। ফলমূলসহ পুজোর সামগ্রী সামর্থ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা হ' লেও ভক্তি অর্ঘ্যে থাকতোনা কোন ঘাটতি।

               সেকালেও ছিল বারোয়ারী পুজো। সকলের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রদত্ত চাঁদায় নির্বাহ করা হত, পুজোর খরচ। অর্থমূল্যে কেউ চাঁদা দিতে না পারলে বাড়ির উৎপন্ন ফলমূল বা চাল ডাল দিয়েও যোগদান করা যেত সর্বজনীন পুজোয়।ছিলনা চাঁদার জুলুম বা হুমকী প্রদানের অভিযোগ ।

              নিয়মনিষ্ঠা মেনে ষষ্ঠী থেকে দশমী পুজো চলতো,পাঁচদিন ধরে।এরমধ্যে ঘড়ি ধরে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান,সন্ধিপূজা বা ভোগগ্রহণ এবং প্রসাদ বিতরণ অনুষ্ঠিত হ' ত।তৃপ্তি ভরে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার সাগ্রহ উপস্থিতি প্রকতই  রূপান্তরিত হতো শারদোতৎসবে।

              নিরঞ্জনের সময় সকালে ধুনুচি নৃত্য সহযোগে নারী পুরুষের মিলিত শোভাযাত্রায় স্থানীয় পুকুর বা নদীতে দেওয়া হ' ত দেবী প্রতিমার বিসর্জন।আবার আগামী বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার শুরু হ 'ত সেদিন থেকেই।এরপরই শুভ বিজয়া।পারস্পরিক আলিঙ্গন বিনিময় বা বড়দের প্রণামের মাধ্যমে আশির্বাদ দেওয়া নেওয়ার পালা ছিল সেকালের একটি সামাজিক রীতি।ছিল মিষ্টিমুখের প্রথা। মা মাসী বৌদিদের হাতে তৈরী নাড়ু, মোয়া,মুড়কি,বা  বোদে দিয়ে করা হত,সেকালের আপ্যায়ন। এক কথায় বলতে গেলে সেকালের পুজো নিয়ে তৈরি হওয়া নস্টালজিয়া এখনও আমাদের স্মৃতিতে অমলিন।

              অথচ একালে পদার্পণ করে পুজো এখন যেন কেমন হয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক। মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠান এখন বোকাবাক্সে। চন্ডীপাঠের পাট চুকিয়ে গীতিনাট্য আর অসুরের সাথে দেবী দুর্গার ভয়ঙ্কর যুদ্ধের রঙচঙে নাটকই এখন মহালয়ার মূল উপজীব্য।চলচিত্রের নায়ক নায়িকাদের ঢালাও এনে সমানে প্রচেষ্টা চলেছে এর টি আর পি বাড়ানো।সঙ্গে রয়েছে মাঝে মাঝেই বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। কিন্তু সেকালের মহালয়ার সেই স্বাদ কোথায়?

           এখন পুজো আর সর্বজনীন নয়,ক্লাবের কিছু সদস্য দ্বারা হয় নিয়ন্ত্রিত।প্রতিমা তৈরী দেখতে আর কচিকাঁচারা পায়না বিন্দুমাত্র উৎসাহ। পড়াশুনা,নাচগান,ড্রয়িং,আবৃত্তি করার পর আর ওসব ফালতু জিনিসে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? এখনতো আগে ইঁদুর দৌড!  প্রতিমা আসে এখন ম্যাটাডোর বা ট্রাকে কুলি পরিবৃত হয়ে। সুদৃশ্য প্যান্ডেল,আলোর ফুলঝুড়ি, ডিজের উন্মত্ত কোলাহল আর সঙ্গে থিমের ছড়াছড়িতে পুজো এখন হট্টমেলার সামগ্রী।নেই তাতে প্রাণ,নেই ছিটেফোঁটা ভক্তি অর্ঘ্য, নেই জনতার প্রাণের আকুতি। ভোগরাগ নৈবেদ্যর থেকে প্রাধান্য পায় ডেকোরেশন ,লাইটিং ইত্যাদি। স্বভাবতই বাজেট রক্ষা করতে নামতে হয় জুলুমবাজ বাহিনীকে  মানুষকে মুরগী বা ছাগলের থেকেও নিম্নস্তরের প্রাণীর মর্যাদা দিয়ে আদায় হয় চাঁদা। ভয়ে ভক্তিতে চাঁদা দিলেও পুজোয় থাকেনা মানুষের টান। এভাবেই চলেছে একালের পুজো।

            পোষাক আশাকেও এসেছে একালে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।তৈরী করা পোষাককে ব্যাক ডেটেড ঘোষণা করে সবাই এখন পতঙ্গ দৌড়ে ব্যস্ত রেডিমেটের দিকে। টিভি বা সিনেমার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে হতে হবে পুজোর সাজ পোষাক। এই পোষাক নিয়েই তাই সংসারে এখন মন কষাকষি, রাজ্যের অশান্তি। নমো নমো করে পুজো শেষ করে সবাই এখন ব্যস্ত হয়, দশমীর পর দিন থেকেই ফাংশন আয়োজনে। আরে এই পুজোইতো এখন নাচাগানা,খানাপিনার দেয় অফুরন্ত যোগান। তাই ওখানেইতো আসল বাজেট।

         বিসর্জনের মিছিল এখন একালে এসে হয়ে পড়েছে, আতঙ্কের মিছিল। উদ্দাম নৃত্য, সমস্তপথ জুড়ে যুবক যুবতীদের এক কথায় বেলেল্লাপনা, মাইক ডিজের হৃৎকম্প জাগানো শব্দ ভীতি সঞ্চার করে রোগী,অসুস্থ এবং শিশুদের। মানে কৃষ্টির ষষ্ঠীপুজো করে তবে ছাড়। বিজয়াও তথৈবচ। প্রণাম নমস্কারের পাটতো কবেই গেছে চুকেবুকে। হ্যালো, হায় বা হ্যান্ডশেকের মাধ্যমেই এখন ভাব বিনিময়।একালে পৌঁছে পুজো যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত। তবে একালে এসে পুজোয় ঘটেছে এক নতুন সংযোজন। এখন দশমীতে বিসর্জন না দিয়ে আর দুয়েকদিন বাড়ানো হয় বাণিজ্যের প্রয়োজনে। এখন চলেছে রাজপথে কার্নিভাল। সমস্ত দেবী প্রতিমা সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতা বাছাই পর্বের অনুরূপ পুরস্কৃত করা হয় সেরা পুজোকে। মানে প্রতিমারও প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় হওয়ার পালার আমদানি করে সৃষ্টি করা হয়েছে সাড়ে সর্বনাশের। এটাকি
পুজো, না পুজো পুজো খেলা।
           
সবশেষে বলতে চাই একটাই শেষ কথা
" এ কোন সকাল
                     এ যে রাতের চেয়েও অন্ধকার!"






দেবাঞ্জনা রুদ্র 



। পুজো গল্প 


ফুলকলিদিদি
মৌসুমী চৌধুরী 

     মঞ্জিমাদের ঠাকুর দালানে কুমোর-কাকুরা একচালার সাবেকী দুর্গাপ্রতিমায় ফিনিশিং টাচ দিতে ব্যস্ত। আজ পঞ্চমী। আকাশের নীল ক্যানভাসে পুজোর গন্ধ ছড়াচ্ছে সোনা রোদ। আর নীল যমুনায় যেন সাদা মেঘের দল বেশ ছুটি কাটানোর আমেজে অলস অলস ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশ ভরা ইতিউতি এই সাদা মেঘেদের দেখে সকাল থেকেই মঞ্জিমার ভিতরটা ঘুলিয়ে একটা সুর আজ যেন বার বার উঠে আসছে — "অলস যমুনা বহয়ি যায় ললিত গীত গাহিরে।/ শশি-সনাথ যামিনী, /বিরহ-বিধুর কামিনী,/কুসুমহার ভইল ভার হৃদয় তার দাহিছে।..." মাঝে মাঝে প্রকৃতির রূপ দেখে এমনভাবে ভীষণ গান পায় মঞ্জিমার। আর তখন গান গায় প্রানভরে ... সে গান কেউ না শুনলেও লুডোবাবু চুপ করে বসে প্রাণভরে তার মায়ের গান শোনে।
          আজ সুখীদিদি আর ফুলকলিদিদের আসবার কথা। আর এই খবরেই একটা মন খারাপ যেন বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে মঞ্জিমাকে এবং গানের ছাতা মেলে ধরে তার সেই মন খারাপের ওপর ছায়া ফেলছেন তিনি — এক এবং অদ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ। শন্তিনিকেতনে পড়বার সময় থেকেই এমনটা হয় মঞ্জিমার। মন খারাপের সময় তাকে যেন বেশি বেশি করে জড়িয়ে ধরেন তিনি। মঞ্জিমার মনেপড়ে সুখীদিদি আর ফুলকলিদিদির গানের গলা খুব মিঠে ছিল। ছোটবেলায় মঞ্জিমা যখন গানের রেওয়াজ করত তখন গেটের ধারে দাঁড়িয়ে তৃষিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনত তারা। অনেকবারই সুখীদিদি আর ফুলকলিদিদিকে
রবিঠাকুরের গান গাইতেও শুনেছে সে। গলা একটু হাস্কি। কিন্তু ভারী চমৎকার লাগে শুনতে। মন ভরে যায়।   
        একটু বড় হতে মঞ্জিমা দেখেছে কারও বাড়িতে বাচ্চা হলেই সুখীদিদি আর ফুলকলি দিদিরা দল বেঁধে তাদের বাড়িতে এসে ঢোল বাজিয়ে নাচ করে। তারপর বাচ্চাকে আশীর্বাদ করে টাকা নিয়ে চলে যায়। কিন্ত বাড়ির লোকেরা তাতে মোটেও আনন্দিত হয় না। সবাই কেমন যেন তাদের বাঁকা নজরে দেখে।তারা চলে যাওয়ার পর সবাই বিশ্রিভাবে বলে,
— " শালার হিজরের বাচ্চা! ফোকটে কত টাকা নিয়ে চলে গেল!"
কেন যেন এসব শুনে খুব কষ্ট হত মঞ্জিমার। নানা প্রশ্নে আলোড়িত হত তার কিশোরী মন। হিজরে হওয়া কি খুব খারাপ কিছু ? তবে তারা এ কাজ ছেড়ে দেয় না কেন? মেয়েদের মতো লম্বা চুল, ছেলেদের মতো গলার স্বর আর লম্বা দোহারা চেহারা বলেই কি তারা খারাপ? পরে ঠাম্মির কাছে জানতে পেরেছিল তারা বাকি ছেলেও নয়, মেয়েও নয়। তাই তথাকথিত  সমাজ তাদের ঠাঁই দেয় না। কেউ কোন কাজেও নেয় না তাদের। শুনে মনটা খুব খারাপ লাগত মঞ্জিমার। তবে তারা কি কাজ করে খাবে? তাদের বাঁচার উপায়টা কি? এই প্রশ্নগুলো কিশোরী বয়স থেকেই খুব ভাবাত মঞ্জিমাকে। খুব মায়া হত তাদের জন্য। 
   অনেকদিন পর সেই সুখীদিদিরা আজ তার নিজের মেয়ে গুঞ্জাকে আশীর্বাদ করতে আসছে। মঞ্জিমার ইচ্ছে পুজোর আগে তাদের দিনটাকে একটু অন্যরকম করে তোলে। দুপুরে এখানে খাবার আয়োজন করা হয়েছে তাদের। মঞ্জিমার পরিকল্পনা মতো তার বাবা সব আয়োজন করেছেন। বাবার সঙ্গে বেরিয়ে সুখীদিদিদের আট-দশ জনের জন্য যত্নকরে পুজোর জামাকাপড়ও কিনে নিয়ে এসেছে মঞ্জিমা।  
       লেজ লেজ নাড়তে নাড়তে প্রতিদিনের মতো লুডোবাবু আজও তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গান শুনছে...লুডোর যখন পনেরো দিন বয়স, তখন মঞ্জিমার কোল জুড়ে এসেছিল সে। আমেরিকান এস্কিমো ডগ। তারপর থেকে প্রতি মুহূর্তে তার মা হয়ে উঠেছে মঞ্জিমা। লুডো হয়ে উঠেছে তার আনন্দ বেদনার সঙ্গী। আর সেই থেকেই মঞ্জিমার গান-সাধনার সিরিয়াস শ্রোতা তার ছেলে লুডো। যে কোন মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সেনসেটিভ তার লুডো এবং তাকে খুব ভালো -বাসে। তারপর তো এল লুডোর বুনু। দশ মাস, দশ দিন গর্ভ ধারণের কষ্টমিশ্রিত আনন্দ শেষে গত পয়লা ভাদ্র মঞ্জিমার কোল জুড়ে এসেছে তার মেয়ে গুঞ্জা। গুঞ্জার আজ এক মাস দশদিন বয়স পূর্ণ হল। তাকে আজ আশীর্বাদ করতেই তাদের বাড়িতে আসবে সুখীদিদি আর ফুলকলিদিদিদের দল। তাই আজ মঞ্জিমাদের বাড়িতে বেশ একটা সাজো সাজো রব। 
     গুঞ্জা ফুলকলিদিদির কোলে শুয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর লুডো সুখীদিদির কোলে আয়েশ করে বসে আছে। ফুলকলিদিদি  গান ধরেছে ,
— " বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও /ফিরাইও না জননী..."
চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে তার। তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও কেউ কেউ একেবারে চুপ। থমথমে মুখ। কেউ কেউ আবার খুব বিরক্ত,
— " হিজরের আমার কান্না!  ফুঃ!  টাকার রফা
 আগে করবে তা নয়! যত্ত সব!!!"
    গান থামিয়ে মঞ্জিমার মাকে প্রণাম করে ফুলকলিদিদি। সজল চোখে বলে,
— " তোমাদের বাড়িতে ভিখ মেগে খাই, মাগো। এই তো দেখছ আমাদের এগুলো পেট। কিন্ত মা, বড় সাধ জাগে গো। আমায় আশীর্বাদ কর  পরজন্মে যেন তোমার মতো কারও মা হতে পারি।"
     মঞ্জিমার চোখে বাষ্প জমে ওঠে। শরৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে কার কাছে যেন বিড় বিড় করে প্রার্থনা জানায় , 
— " এ জন্মেই যেন ফুলকলিদিদিরা কারও মা হয়ে উঠতে পরে, হে ঈশ্বর। তাদের মাতৃত্বের আনন্দ দিও। এ জন্মেই যেন কেউ তাদের মা বলে কাছে টেনে ভালোবাসে।"



ক‍্যাপ -বন্দুক
মিঠু  অধিকারী 


পূজো এলেই মিলির বায়না,"বাবা, ক‍্যাপ বন্দুক কিনে দাও।" বাবা বোঝান,"ওরে, তুই মেয়ে মানুষ, বন্দুক দিয়ে করবি কি? তুই বরং বেলুন, পুতুল এইসব নে।"

মিলির বড্ডো  রাগ হয়। এ আবার  কেমন কথা! মেয়ে হলে বুঝি বন্দুক চালাতে নেই। মেয়েরা  তো কত লড়াই  করেছে। রানী লক্ষীবাঈ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এনাদের কথা তো পড়ার বইয়ে লেখা  আছে।তাছাড়া, স্কুলের দিদিমনি তো বলেন মেয়েরা  এখন পুলিশ থেকে সেনাবাহিনী  সবেতেই কাজ করছে।

চকচকে টিনের  বন্দুকে বারুদের রোল লাগিয়ে  ফটাস।কি যে ভালো  লাগে মিলির। কিন্তু  বুঝবে কে! 

মা কিন্তু  বোঝেন।পাড়ার দোকান  থেকে চুপিচুপি কিনে আনেন ছোট্ট  কাগজের  কৌটোতে বারুদের রোল। বন্দুক নেই তো কি হলো, বিকল্প ব‍্যাবস্থা তো রয়েছে।শান বাধাাঁনো একচিলতে বারান্দার মেঝেতে  বারুদের রোল রেখে বড় একটা পাথর  দিয়ে ঠুকে  দিলেই হল। ফটাস, ফটাস......। মিলির যে কি আনন্দ। দরজার  পাশটিতে মায়ের মুখেও  তার ছোয়াঁ।

তারপর  চলে গেছে কত পূজো। মিলি কিন্তু  এখন বন্দুক পেয়ে গেছে। ডিউটিতে যাবার আগে, বাবার  ছবির সামনে  মাথা নত করে রোজকার মত। বেরোনোর আগে দেখে নেয় সার্ভিস  রিভলবারটি যথাযথ  আছে নাকি। পুলিশ  অফিসার  মিলির পূজার  কটাদিন কোনো  ছুটি নেই।



বোধন
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

চাপ চাপ কালো অন্ধকার গায়ে মেখে ছুটে চলেছে এক কিশোরী। তার মুখ দুহাত দিয়ে ঢাকা। তার দিকে উড়ে আসছে একটা সাদা থান। সে পালাতে চাইছে অনেক দূরে। সেই থান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে .....স্বপ্ন? নাকি স্মৃতির ভয়াবহতায় শিউরে ওঠা?  বিস্মৃতির অতল থেকে আলো আঁধারির কুহেলিকায় মৃন্ময়ী মায়ের ডাকের সাজের সালংকারা মূর্তিটি স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। মায়ের ঠোঁটে স্নেহের হাসি। মায়ের মুখের আদলে ধরা দিচ্ছে নিতান্তই সাধারণ এক গ্রাম্য রমনীর মুখ,যার 'উমা' ডাকে অসীম শক্তি। সাদা থান পরা কিশোরীটির চারিদিক রঙিন আলোয় ভরে উঠছে। কাশের গুচ্ছে, শিউলির গালিচায়, পদ্মপাতার শিশিরে সর্বত্রই লেখা হচ্ছে একটিই নাম.... 'মা'.... 
                                 'মা, আমাদের মালাকার বলে কেনো? 'কৌতূহলী কিশোরী উমা কতবার যে একই প্রশ্ন রাখতো মায়ের কাছে সেই কিংবদন্তির গল্প শোনার লোভে। মা বলতেন, 'শিব ঠাকুর পার্বতীকে বিয়ে করার সময় বলেছিলেন তিনি শ্বেত মুকুট পরবেন। ডাক পড়লো বিশ্বকর্মার। তিনি ভাবলেন কিভাবে এই মুকুট তৈরী করা যায়। তখন শিবের ইচ্ছেতে জলাশয়ে শোলাগাছ নামে এক নরম উদ্ভিদ জন্মালো। শক্ত দ্রব্য দিয়ে কাজে অভ্যস্ত বিশ্বকর্মা ওই নরম শোলা দিয়ে কিছু বানাতে পারলেন না। শিবের ইচ্ছেতে জলাশয়ে এসে হাজির হলেন এক সুন্দর যুবক; যার নাম হলো মালাকার।' এই সময়ে দাঁড়িয়ে উমার পাশে এমনই একজন কাউকে কল্পনা করেন মা যার হাতে উমার হাত তুলে দিতে পারলে তিনি সবচেয়ে শান্তি পাবেন। 
                               'শোলা' এই শব্দটি মাকে ভালোবাসার মতো করেই মজ্জায় মজ্জায় জড়িয়ে গেল উমার সঙ্গে উমার নিজেরই অজান্তে। মনসা পুজো, দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কার্তিক পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো এসব সময় চাহিদা অনুযায়ী মাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছে উমা দুচোখ ভরে। উমার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বেশি বেশি করে বায়না নিয়ে, ধানের জমি বা জলা জমি থেকে শোলা জোগাড় করে, প্রয়োজনে রাত জেগে অতিরিক্ত কাজ করে উমার পাশে থেকেছেন মা; যা উমাকে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শোলার কাজের আগ্রহী করে তুলেছে প্রতিনিয়ত। কী নিখুঁত কাজ মায়ের। শোলার প্রতিটি কাজেই অসাধারণ তাঁর দক্ষতা। বছরের যেকোনো মেলার আগে রাত জেগে শোলা দিয়ে নানারকম ফুল, পুতুল, পশুপাখি,  খেলনা, নৌকো, মালা, পটচিত্র, মুখচিত্র সব তৈরী করে গ্রামের যারা মেলার উদ্দেশ্যে যেত; তাদের হাতে তুলে দিয়ে আসতো মা।
                                  উমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আশাতীত ফলাফলের পর গ্রামের সকলের চোখ রাঙানি, হুমকি  সবকিছুকে উপেক্ষা করে কাটোয়ার ওই নিতান্তই ছাপোষা অথচ ব্যক্তিত্বময়ী এই রমনী কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে উমার ইচ্ছে মতো তাকে ফাইন আর্টস নিয়ে ভর্তি করেন। উমার হাতের আঁকা ও শোলার কাজও ছিল দেখার মতোই। মায়ের হাতে হাতে কাজ করার ফাঁকে সে নিজেও পটু হয়ে উঠেছিল শোলার খেলনা, পুতুল, ফুল বানানোয়। তেঁতুল বিচির আঠা দিয়ে সংযুক্ত করেছে পাতলা করে কাটা শোলার টুকরোগুলোকে ; টোপর, পশুপাখি, ঠাকুরের অলংকার, চাঁদমালা, চালচিত্র, পটচিত্র তৈরীর কাজে। সবচেয়ে ভালো লাগতো মায়ের নিঁখুত করে তৈরী করা বিশেষ বিশেষ জিনিসগুলোকে আকর্ষণীয় করতে তার ওপর রং,  জরি,  সুতো,  চুমকি দিয়ে কাজ করতে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে উমা ছুটির অবকাশে বাড়িতে এলে মায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের খেলায় মেতে উঠতো মনের আনন্দে। এরপর শোলার কাজ নিয়ে ওর স্বতঃস্ফূর্ত গবেষণা ওকে আরও একাত্ম করে তুলল এই কাজে। 
                                  দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে কতগুলো বছর। বেশ কয়েকবছর আগে ব্যাংক লোন ও গবেষণার বৃত্তিকে পুঁজি করে রুচি, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের এই কুটির শিল্পের কারখানা তৈরী উমার স্বপ্নপূরণের বৃত্তকে পরিপূর্ণ করেছে। কুমোরটুলি, চন্দননগর, কলকাতার অন্যান্য পুজো, বিভিন্ন জেলার পুজো এমনকি বিদেশ থেকেও বায়না আসছে ওদের শোলার সামগ্রীর জন্য। কয়েকবছর আগে একবার বিদেশে ওদের কারখানায় তৈরী শোলার বিভিন্ন জিনিসের এক্সিবিশনও হয়ে গেছে। বিভিন্ন জেলার নানা সময়ের নানারকম মেলায় ওদের শোলার কাজের সামগ্রী গ্রামের পুরুষ মহিলাদের হাত ধরে অনেক বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। 
                        উমার কারখানায় কাজের অগ্রাধিকার পেয়েছে গ্রামের গৃহবধূ তথা মেয়েরা। ঘরের অন্ধকারে নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে তারা যাতে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হয় আর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে সেদিকে উমার সজাগ দৃষ্টি। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আরও সুন্দর ভাবে শোলা শিল্পকে যাতে বিভিন্ন রূপ দেওয়া সম্ভব হয়, সারা পৃথিবীতে তাদের কাজ যাতে সমাদৃত হয় এবং তা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে কাজে লাগে সেটাই উমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। ওর আর ওর মায়ের এতদিনের নিরলস পরিশ্রম তবেই সার্থক হবে। করোনা আবহে গত এক বছর যাবৎ কিছুটা ঘাটতি গেলেও এই সময় কেটে যাবে বলেই আশাবাদী উমা। 
                   কারখানা জেগে উঠেছে প্রতিদিন সকালের মতো। পুজো আসন্ন, তাই এখন অনেক রাত পর্যন্ত কাজের পর সকাল সকাল হাজির কারখানার মেয়ে বৌয়েরা। উমা ঘুরে ঘুরে ওদের কাজ দেখবার সঙ্গে সঙ্গে ওদের প্রয়োজনমতো নিজেও হাত লাগাচ্ছিল কাজে। বিভিন্ন মন্ডপের কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী শোলার মডেল তৈরী হচ্ছে। দেবীর রত্নহার, নাগপাশ, মুকুট বানাচ্ছে মেয়েরা যত্ন করে। কাগজের ওপর ডিজাইন করা ডাকের সাজের চালচিত্রে আঠা লাগিয়ে ডিজাইনের জায়গায় জরি, চুমকি, সলমা, জমিরা, তবক,  ভুরো লাগিয়ে দক্ষতার সঙ্গে অলংকরণের কাজ করছে মেয়ে বৌয়েরা। উমার ঐকান্তিক আগ্রহে, উদ্যোগে ও প্রচারের দক্ষতায় কিছু কিছু জায়গা থেকে বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষে মঞ্চ নাটকের সাজসজ্জার জন্য শোলার তৈরী জিনিস খুব কম খরচে নতুনত্ব ও চমক হিসেবে ব্যবহারের জন্য অর্ডার হয়েছে ওদের কারখানায়। পরবর্তীতে সারাবছর ধরেই এই ধরণের কাজগুলোর বায়না আসবে তাদের কাছে; এ ব্যাপারে উমা যথেষ্ট আশাবাদী। পরিবেশ বান্ধব শোলাকে এভাবে ব্যবহার করতে পেরে উমা সত্যিকারের খুশি। 
                             মা এসে দাঁড়ালেন উমার পাশে। উমা ব্যস্ত হয়ে পড়লো মায়ের হাত দিয়ে কারখানার কর্মীদের হাতে একে একে পুজোর বোনাস তুলে দিতে। ওদের আনন্দোজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে উমার মন ভরে যেতে লাগলো কানায় কানায়। 
                                  মা এসে আলতো হাত রাখলেন উমার পিঠে। স্নেহমাখা হাসিমুখে বললেন, 'সবার তো হলো, এবার বল তোর কী চাই মায়ের থেকে? '
উমা চোখ তুলে চাইলো ওর সব কাজের অনুপ্রেরণা, ওর শক্তি, ওর বিশ্বাস ও ভরসার দিকে। যাকে ছাড়া সেই অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ অসম্ভব ছিল। যিনি সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও দুহাত দিয়ে উমাকে আগলে রেখেছেন এতগুলো বছর ধরে। শাশুড়ি থেকে মা হয়ে উঠেছেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। উমার পড়াশোনা নিয়ে ওর বাবার বাড়ির সকলের আপত্তি ছিল সেই শুরু থেকেই। একবাড়ি লোকের অভাবের সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মে ও যেন ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছিল। সেই ছোট বয়সে উমাকে বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হয়েছিল ওর বাড়ির লোকেরা।'বিয়ে' কাকে বলে বুঝে উঠবার আগেই ছয়মাসের মধ্যেই বৈধব্য এসেছিল উমার জীবনে। ছেলের শরীরে যে মারণ রোগ বাসা বেঁধেছিল তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি উমার শাশুড়ি। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা বুকের মধ্যে চেপে রেখে গ্রামের মানুষদের বিভিন্ন কুসংস্কার, প্রতিবাদ সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে উমার পাশে সব ভাবে থেকে গেছেন এতগুলো বছর। তাঁর মঙ্গলকামনা উমার স্বপ্নপূরণের পথকে প্রশস্ত করেছে প্রতিনিয়ত। 
                                    উমা দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে। আনন্দ মিশ্রিত কান্নাভেজা গলায় বলে উঠলো, 'তোমার উমার যা আছে তা আর কারোর নেই..  কী কী আছে শুনবে মা? '
'আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, 
শোলার পাখির ছা, 
সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার
একটি খেলার মা। '



। পুজো নাটক 


দূর্গা 
রীতা মোদক 

(দূর্গার এক ভক্ত সাধিকা শিউলী ফুল ছড়িয়ে পথ তৈরী করতে করতে মঞ্চে উঠে এলো । তারপর আসনে অনেকগুলি ফুল ছড়িয়ে ধুপ প্রদীপ সহ আরতি দিল । শঙ্খ বাজলো । এমন সময় আর এক ভক্ত কাকিমা মঞ্চে উঠে এলো । )
কাকিমা : কিরে মা , এসব কি করছিস ? শিউলী ফুলগুলো ভাবে ফেলে দিলি ? এখন পুজো কি করে হবে ? 
সাধিকা : কাকিমা তুমি কখন এলে ? আমি তো শিউলী ফুলগুলো ইচ্ছে করেই ফেলেছি । দেখো না কি সুন্দর পথ তৈরী হয়ছে । এই পথ দিয়েই তো মা দূর্গা আসবেন । 
ঠাকুমার : এই পথে দূর্গা আসবে ? তুই হাসালি আমায় । 
সাধিকা : হ্যা কাকিমা এই পথেই দূর্গা আসবে । চার দিকে দেখছো না কত অশান্তি ছড়িয়ে আছে । কোথা ও বোমা পরছে ,কোথাও বা অবলা নারী ধর্ষিত হচ্ছে , চারদিকে শুধুই মারামারি , হানাহানি । এতো অসুরের আক্রমণে মায়ের আসার পথ ঘাট সব ক্ষত বিক্ষোত হয়ে গেছে । তাইতো মায়ের আসার পথ তৈরী করে দিলাম । 
কাকিমা : তুই বেঁচে থাক মা । তোর মন্দিরে দূর্গা আসবেই । জয় মা দূর্গা তুমি অসুরের হাত থেকে আমাদের বাঁচাও । 
দৃশ্য ২
( দূর্গা শিবের পাশে বসে আছে । নন্দী ভীণ্গী হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে )
শিব : দেবী , এবার আর তোমার মর্তে যাওয়া হবে না । চারদিকে এতো মারামারি হানাহানি হচ্ছে যে , এবছর অনেক জায়গায় মনে হচ্ছে তোমার পুজো হবে না । 
দূর্গা : আমার পুজো হবে না এটা কি সম্ভব ? দেখো মর্তে কত কাশ ফুটেছে , গাছে গাছে শিউলী ফুলে ভরে গেছে । আমার পুজো না হলে কাশ ফুলেরা ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদবে যে , শিউলী গাছের ফুল ফোটা ই বৃথা হয়ে যাবে । 
শিব : ওই দেখো তোমার এক ভক্ত তোমার যাবার পথ তৈরী করছে । 
দূর্গা : তুমি যে শুধুই সাধিকাকেই দেখছো । ভালো করে দেখো কত রমণী অত্যাচারের ভয়ে কাতর হয়ে আমাকে ডাকছে । আমাকে তো যেতেই হবে । 
দৃশ্য ৩
(মঞ্চে অনেক নারী দূর্গার জন্য প্রার্থনা করছে , ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা দুর্গার আগমণী গান করছে --- পুজোর গন্ধ এসেছে.... )
দৃশ্য ৪
(মঞ্চে শিব শুয়ে আছে । দূর্গা লক্ষী সরস্বতীকে যুদ্ধ বিদ্যা শেখাচ্ছেন )
শিব : দেবী তুমি মেয়েদের সাথে মারামারি করছো কেনো ? ওরা কি কোনো অন্যায় করেছে ? 
দূর্গা : না স্বামী মেয়েরা কোনো অন্যায় করেনি । আমি তাদের যুদ্ধ বিদ্যা শেখাচ্ছি । প্রতিবার অসুরদের সাথে আমি একা একা লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে যাই । এবার যে অসুরের সংখা বেড়ে গেছে । ছেলে মেয়েরা যদি আমাকে সঙ্গ দেয় তাহলে আমরা একসাথে অনেক অসুরদের দমন করতে পারব । 
দৃশ্য ৫ 
( কয়েক জন অসুর দুর্গার আরাধনা করছে )
অসুর : মা দূর্গা এবার আমরা ও তোমার পূজা করবো । তুমি মর্ত্যভূমিতে আসো । আমাদের আরো শক্তি দাও । সব কিছু ভেঙে চুরমার করে আমরা স্বর্গের সিংহাসনে বসব । কি সুন্দর সিংহাসন ! তোমার মেয়ে দুটো কি সুন্দর ! হা হা হা ! আমি তদের বিয়ে করবো । 

দৃশ্য ৬

শিব: দেবী , দেখো দেখো অসুরেরা তোমার প্রার্থণা করছে । এ যে সর্বনাশের ইঙ্গিত । এবার কি করবে । তাদের আশা পূরণ করলে যে মহাবিপদ হয়ে যাবে ! 
দূর্গা : স্বামী , আপনি এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন ? আমি দেখছি কি করা যায় ...
দৃশ্য ৭
(দূর্গা সরস্বতীর কাছে যায় , সরস্বতী এক মনে বীনা বাজাচ্ছে )
দূর্গা : সরো কি করছিস মা ? 
সরস্বতী : মা তুমি ? কখন এলে ? 
দূর্গা : এইতো এখন । জানিস মা অসুরেরা এবার আমার প্রার্থণা করছে । তাদের আশা পূরণ করলে যে সবকিছু ধ্বংশ হয়ে যাবে , আমার খুব চিন্তা হচ্ছে ...
সরস্বতী : তুমি অনুমতি দিলে আমি অসুরদের বুদ্ধি নাশ করে দিতে পারি । তোমার সামনে এলেই এদের বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যাবে । 
দূর্গা : তবে তাই হোক । আমি নিশ্চিন্ত হলাম । 
দৃশ্য ৮
( মর্তভূমিতে দূর্গা স্বপরিবারে এসেছেন । নারীরা উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি দিছেন এমন সময় ভিড় ঠেলে কয়েকজন অসুর উঠে এলো )
নারীরা : বাঁচাও , বাঁচাও , মাগো -- অসুরের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো । 
দূর্গা : (অসুরদের উদ্দেশ্য ) বাছারা কি হয়েছে ? তোমরা কি চাও ? (সরস্বতী বুদ্ধি নষ্ট করে দেয় )
অসুর : মাগো , বড় বিপদে পরে তোমার কাছে এসেছি , সারাক্ষণ অত্যাচার করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি । সাধারণ মানুষেরা আমাদের অত্যাচারে ঘুমোতে পরছে না । পথ ঘাট এতো রক্তাক্ত করেছি , জায়গায় জায়গায় বোমা ফেলে ফেলে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি । রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারছি না । 
দূর্গা : তাহলে তোমরা আমার কাছে কি চাও ? 
অসুর : মা , আমরা ঘুমোতে চাই , অনেক দিন যেন ঘুমিয়ে থাকতে পারি । 
দূর্গা : তথাস্তু । তোমরা ছয়মাস ঘুমাবে , একদিন জাগবে । 
অসুর : না না মা , ভুল বলেছি , আমরা এই বর চাই না । 
দূর্গা : এটা তো ফেরানো যাবে না , আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে । 
অসুর : কি ব্যপার আমার ঘুম পাচ্ছে কেনো ?( অন্য অসুর ) আমার ও ঘুম পাচ্ছে ।
( তারা ধীরে ঘুমিয়ে পড়লো )
দৃশ্য ৯
( ঢাক ঢোল বাজছে , উলুধ্বনি হচ্ছে , ভক্তেরা শিউলী ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছে , অসুর দের উপরে ভক্তেরা আনন্দে নাচছে )






তানভী দাম



। পুজো কবিতা ।


মহাপুজো 
নির্মাল্য ঘোষ 

পুজো মানে শিউলির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে 
তোমার- শুধুই তোমার স্বপ্ন দেখা
পুজো মানে তোমার নগ্ন হৃদয়ে আমার 
ভগ্ন বসন্তের অশ্রুধারা...
পুজো মানে তোমার নীল আকাশে নিজেকে 
সাদা সাদা মেঘ ভাবা...
আর পুজো মানে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 
চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠা...
এক মাঠ খোলা হৃদয় নিয়ে আর আকাশে 
এক ফালি চাঁদ হয়ে জ্যোৎস্নায় তোমার 
মনের  কাশবন ধুঁইয়ে দেওয়া...
সেটাও পুজো আমার কাছে...মহাপুজো



জন্ম, কবিতা ও আরো কিছু(১)
পার্থ সারথি চক্রবর্তী 
 
রাতের শরীরে জন্ম নেওয়া এক অবিশ্বাসের ঘনঘটা।
নিজেকে খুঁজে পেতে ডুব দিতে হয় জলাশয়ের মোহাচ্ছন্ন এক স্বপ্নপুরীতে।
জীবনের জিজ্ঞাসাগুলোকে এক করে তুলে দেওয়া তোমার হাতে।
তোমার হাত, যে হাত আয়নার সামনে অস্তিত্বহীন কতগুলো শব্দের অসম্পূর্ণ চিত্রকল্প।
বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার আবছা সন্ধিক্ষণে ছকভাঙা ছন্দহীনতার ঝংকার।
সহসা উঠে আসে শরীর বেয়ে এক অসংলগ্ন সংলাপ।
যুগ যুগ ধরে সম্মিলিত প্রলাপ ও বিলাপ, লোপ পেতে পেতে এক অপুস্পক উদ্ভিদ।
পুরুষ ও বৃক্ষ তো একে অপরের গোপনচারি। শুধু মাঝে ব্যবধান আড়াআড়ি।
গোলাপি বাস্তবতার খোঁজ আদিম রাত থেকে চলেছে দিনভর, আজন্ম।
এভাবে হতে থাকে পুনর্জন্ম; এক অস্থায়ী শেষের পর শুরু, ফিরে আসা বারবার।



অমৃত
পারিজাত প্রীত

মৃত্যুর পথে শক্তিবিহীনে 
পথিক বন্ধু দেহ আলয়,
সকল তিমির অনাবিল হোক 
ব্রহ্মময় শুভ আলোয় ||
হর্ষগীতে মুখরিত হোক, 
অমৃত বারি করহ দান,
সৃষ্টির ন্যায় আনন্দ রূপে 
চিরনিদ্রায় করহ ম্লান ||



 বাহার
রেবা সরকার

অসুখ চেপে রাখলে তার কোনো নামকরণ হয় না
বোধের উপর ঔষধি লেপনে অনেকটা পথ অতিক্রম। 

জন্মালো বৃক্ষ। নামকরণ হয়েছে শাল
আমার ফিরে আসা এই বৃক্ষের তলায়। 

মুষল বৃষ্টি হয়ে গেছে
ছায়া বিষণ্ণ। আমি ছায়া দেখি মেঘ দেখি 
শালের বাহারে বাহারে বেঁধে থাকি 

পরে 
পথে প্রান্তরে চকচকে দুরন্তপনা
ফিরে আসে অবলিলা ঝড়

তুমি কী জানো এ ঝড়ের নাম




 দেবী
  ‌‌‌‌‌   রীনা মজুমদার

ও মেয়ে তুই, শিউলি ফুটিয়েছিস  
আধো আলোয় ফুল কুড়ানোর
নিরাপদ একটাও ভোর রেখেছিস ?

ও মেয়ে তুই, কাশফুলে মাঠ ভরিয়েছিস
ঢেউ দোলানো দিগন্তে রূপের পরশ নিতে
নিরাপদ একটাও দুপুর রেখেছিস ? 

ও মেয়ে তুই, দিঘি ভরে পদ্ম মেলেছিস
শেষবেলায় জলকেলিতে মন হারানোর
নিরাপদ একটাও সন্ধ্যা রেখেছিস ? 

ও মেয়ে তুই, ললাটে রুদ্র নয়ন এঁকেছিস
পথে ঘাটে কাজের পথে ঘরে ফিরতে
নিরাপদ একটাও রাত রেখেছিস ?  

 মেয়ে তুই ত্রিশূল হাতে
     মায়ের মতো আগলে নিতে
 অসুর বিহীন নির্ভয় শান্তির
      আলোকিত ভুবন রেখে দিস।



পূজার গন্ধ
 অপর্ণা বসু

                    আবার শরৎ  এল  বাজলো আলোর বেণু
                    কাশের চামর দুলছে পূজার আয়োজনে
আমি দেখছি পথের ধুলায় ছড়ানো
তোমার ফেলে যাওয়া  কাশবর্ণ খই চিহ্ন
                    নির্বাক সিঁথির  সমান্তরালে  ছড়ানো

                   গোধূলির রঙ মুছে
                    ধু ধু পড়ে থাকা ললাট ছেড়ে
                    ফিরে গেছে মধুমাস

                     সেই থেকে আমার  শরৎ আসে
                     কাশের শাদায়  তীব্র বিষাদ নিয়ে

                     তোমার আমার পরিপাটি  মায়াযাপনের দিন গুলোর  স্মৃতিগন্ধ
                      এখন শরৎ আর পূজায় মাখামাখি।



শিশিরের কথা
প্রদীপ চৌধুরী 

দীর্ঘ একটা রাতের পর আরেকটা সকাল... 
      আবার নতুন করে নিজেকে নিয়ে ভাবা,
একরাশ ভাবনায় ভেসে যায় সকালের রোদ 
         ভেসে যায় কত অনুভূতি ।
ঘাসগুলোকে জাপটে ধরে শিশির, হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে
তবুও একটা সময়ের পর তারা অস্তিত্ব হারায় ।
মানুষের কানে কানে বলে যায় শিশির তার কথা
     এভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায় না....
বাঁচার জন্য লড়তে হয় দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে ।
নয়তো দুপুর হওয়ার সাথে সাথে শিশিরের মত 
হারিয়ে যেতে হবে নিজেকে ।


 

 নষ্টালজিক 

 চন্দ্রানী চৌধুরী 


ইচ্ছে সুখের পাখনা মেলে নষ্টালজিক 

রাত্রিশেষের ভোরবেলাতে ঘুমচোখে বীরেন্দ্রগান

বুকের মধ্যে নেব 

শিশির মাখানো  শিউলি মানেই পুজো এলো

সকাল হতেই একগুচ্ছ কাশফুলের সাথে 

প্রাণের আলাপন হল 

পঞ্চমীতে মাঠে বাঁশবইপত্তর বন্ধ

ঘর জুড়ে খুশির তুফানমায়ের হাতের 

নাড়ু মুড়কির গন্ধ।

নতুন জামা নতুন জুতো আনন্দে আটখা 

দৌড়ে বেড়াই প্যান্ডেলেমাইকে তখন অবিরাম 

পুজোর নতুন গান  

থিমের হাওয়া নেই সেখানে ছোট্ট য়োজন

তবু ছোট বড় সবার মনে খুশির জোয়ার 

আনন্দ উদযাপন 

পুজো এলেই আজ শুধু মন ভেসে যায় দূরে

খুঁজে বেড়াই পুজোর গন্ধবিষন্ মন অতীত 

স্মৃতির কড়া নাড়ে। 



প্রাপ্তিযোগ
অমিতাভ সরকার 

মুকুটের ভারে নত হয় মাথা 
             আলখাল্লার আবরণে রুদ্ধশ্বাস,
উলঙ্গ বিহঙ্গের আছে মুক্তির স্বাধীনতা
             জীবনের পূর্ণতা আনে সন্ন্যাস।

না পাবার চোরাস্রোতে খুঁজে ফিরি শুধু
              পাবার তরণী তবে করে অভিমান,
খালি হাতে এসেছিনু ভবে, তবু --
               ঝুলিতে তো কিছু দিয়েছেন ভগবান।

এ বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে 
               কত আর নেবে এতটুকু  প্রাণ,
নাই যদি পায় কিছু,  তৃণ হতে তরু --
               আলো আর তাপ দিয়ে সূর্য মহান।

আনন্দ, সুখ, ভালবাসায় হই ধন্য,
              নিজে যদি হয়ে থাকি তৃপ্ত 
তবে আর যা রইল কিছু
              থাক সব তোমাদেরই জন্য।



স্বপ্নসুখ

অলকানন্দা দে


আমার গোলাভরা আছে শরৎ আকাশ!

প্রখর শান্তির খর রৌদ্রঋণ নিই মাঝে মাঝে আশা!

আকাঙ্খার মাটিতে আনন্দের অবিরাম দুর্গোৎসব!

সবুজ নীলের পাক খেয়ে ওঠা আবেগে আমার উত্তরাধিকার

হাজার ছন্দের ঢাকে আনন্দভৈরবীআমি রচি শিউলিমালা!

শাপলা মেলা দিঘির পাশে ভিটেদুয়ারে টলটলে রোদের প্রতিশ্রুতি!

সোনার দেশে ক্লেশের নেই ভয়!

নিঃস্বার্থ আকাশকে মিনতি করি,দিও মিত্র ছাউনি!

কথা রাখে দীর্ঘকালএটাই অভ্যেস!

আলো আঁধারির বিহানে নীহারের খুটখাটে টিনের  চালে সিম্ফনি!

আমি শুনি দিলদার মিউজিক শরতের সেতারে!

কাশ আছে ঘাস আছেআছে ধানের হাওয়া!

কানায় কানায় ভর্তি হৃদয়ে পরমেশ্বরী মৃদু হাসে!

আমার উদার শারদীয়ায় ফাঁক থাকে না

নয় সে বান্ধবহারাহাহাকারে!

দেখেছ মাআমার স্বপ্নের রামরাজত্ব!





 আগমনী 
 অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 

শরৎকালে মেঘের ভেলা ঐ আকাশে, 
মাতোয়ারা হয়েছে সবাই শিউলির সুবাসে, 
আসছেন মা উমা এই ত্রিভূবনে, 
খুশির জোয়ার বয়ে যায় সবার মনে।

মহিষাসুরমর্দিনী আসছেন সপরিবারে বছর ঘুরে, 
বাঙালির মন গুনছে দিন মনে মনে বারে বারে,  
আসবে সাথে গনেশ বিঘ্নহর্তা ও কার্তিক দেবসেনাপতি, 
আসবে অনন্যা দুই কন্যাও বাড়াতে মায়ের দ্যুতি।

সকল অসুর বধে মাগো করেছো তমসা দূর, 
আনন্দে মেতেছে ভুবন বাজে আগমনীর সুর।
শিল্পীরা করে মায়ের রূপের মহিমার অবলোকন, 
বলপ্রদায়িনী মা গো আমাদের অভয় করো এই নিবেদন।


ভালো থেকো মা 
বিজয় বর্মন

শ্রাবণ শেষে বর্ষা চলে যাবে,
যেমনটা আসা আর যাওয়া,
আমি তখন হিসাব নিয়ে বসি,
ভাঙ্গা-গড়ায় কত গেল আর এলো।

হিসাব তো মিলেনা,
অবশিষ্ট কষে রাখি,
গর্ভবতী ধান গাছের গোড়ায়,
আগাছা নিরানোর ছলে,
ছুঁয়ে দেখি আপন সত্তা।

শরতের আভাস দেয়,
শিউলি ঝরা সকাল,
কাশফুলের সাদা আলখাল্লায়,
ভেসে আসে আগমনী সুর।

বরাবরের মত খুশি হই আমিও,
মা যে আসছে,
নিখিল আকাশ দেখি, আমার মত করে,

আগমনীর বার্তায় লিখে রাখি,
তুমি ভালো থাকলেই,
আমি ভালো থাকবো,
আমি যে ভালো থাকতে চাই মা।



আগমনী
  মুনমুন সরকার 
            
ভেজা  শিশিরে  শিশিরে  দূর্বা  ঘাস
নদীর  চরে  দু'ধারে  ভরেছে  সাদা  কাশ ।
তাজা  শিউলিগুলো  পড়েছে  ঝরে 
প্রভাতে  ছড়িয়ে  ছিটিয়ে  ভূমির  ওপরে  ।
সবুজে শ‍্যামলে  স্নিগ্ধ  অপূর্ব  শোভা 
হালকা  বাতাসে  বইছে  আমেজের  আভা।
শরৎ  তো  আকাশে  মেলেছে  উজ্জ্বল  রামধনু 
স্বচ্ছ  চারিপাশে  ফুটেছে  আলোর  বেনু   ।
কচি  কচি  ধানছড়া  দোলা  দেয়  প্রাণে
কলরব  পাখিদের  খোলা  আকাশ  শোনে ।
মুগ্ধ  গাছের   দৃশ্য  শ্বেত গোলাপী  কমলেতে
শীঘ্রই  আবির্ভূত  জগৎজননী  মর্তভূমিতে ।
অলির  দল  প্রজাপতিরা  পুষ্পে পুষ্পে  ধেয়ে 
সকল  মর্তবাসী  দিনগুনে  অপেক্ষায়  পথ  চেয়ে।
ভাদরের  শেষে  আশ্বিনে  ঢাকের  বাজনা
তাঁরই  আরাধনায়  ভাটিয়ালি  সঙ্গীত  শোনা ।
সততা ,ভালোবাসার  বীজ  সঙ্গে  নিয়ে 
আসছে  আগমনী  সুখ, সমৃদ্ধির  ভেলা  সাজিয়ে ।।



 বোধনের আহ্বানে
              সুনন্দ মন্ডল
              ‎
ঘুমঘোর সকাল
পাখিজাগা ক্ষণে, শরৎ মেলেছে ডানা।
চোখ ঢুলুঢুলু
বাতাসের শনশন, মানে না কোনো মানা।

রোদের পিঠে
রোদ পোড়ে, অপেক্ষায় চাঁদ।
খুশি ভাঙা দুপুর
আলতো ছোঁয়া, কেউ নেই বাদ।

মহামায়া জাগে
শেষ প্রহর, বোধনের আহ্বানে।
স্রোত ভাঙা আবেগ
আমরা জাগি, মায়ের আগমনে।




মুহূর্ত 
শতাব্দী সাহা


গলি থেকে রাজপথ
আলো মেঘে ভেসে
ডান বাম বুঝিনা
অলিন্দ নিলয়ের সব কপাটিকার
দ্বার খুলে একমন অপেক্ষার শেষে
এল শরৎ অবশেষে।

মোড়কের  আড়াল খসে
অনেক গল্প জমা ছবিতে
খুঁজে ফেরা চেনা অবয়ব,
অন্তমিলের হদিস নিরূদ্দেশ
খেয়ালী সুর উল বোনে প্রতিরাতে
আয়েসী আলাপের আড্ডা জমে নিস্তব্ধ শীতে।


কুমারী মায়ের বেশে
অভিমন্যু

রবির কিরণে ঐ আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘ থরে থরে
মায়ের মূর্তি এখনো হয় নি গড়া কুমোরটুলির ঘরে,
বাঁশের ও খড়ের কাঠামোগুলো তৈরি হয়েছে সবে
মাটির প্রলেপ দেয়ার সাজগোজ শেষ হবে কবে !

কুমারী বেশে মা এলেন লালপেড়ে সাদা শাড়িতে
এসো মা তুমি মর্তলোকে তোমার বাপের বাড়িতে,
মৃন্ময়ী মাকে চেয়ে যে দেখি আমার দু'চোখ মেলে
আরাধনা করি যে ধুনো ধুনুচি পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে।

তোমার আবাহনী গানের সুরে প্রতীক্ষায় দিন গুনি
নিষ্পাপ তোমার মাঝে দুগ্গা মায়ের পদধ্বনি শুনি।




মঙ্গলার্থে প্রার্থনা 
মজনু মিয়া 

ধরায় তুমি ছাড়া মহৌষধ আর নেই 
চাইবার, প্রার্থনা করার মতোও আর
তুমি ছাড়া কেউ নেই। 

সুখে দুখে অসুখে বিসুখে একমাত্র 
ভরসা তুমি, এটা ভেতরের বাসনা
তাও তুমি জানো নিশ্চয়। 

তুমি আছো ধরায় তুমি রবে অনন্ত
আমার পুনরায় জনম হবে বলেছো,
তুমি নিদাঘ, নির্দোষ, নিরপরাধী।

আমার পাপের সীমা নেই, তুমি জানো
চলতে,বলতে, ইশারা,ইংগিতে পাপ
তুমি মঙ্গল করো প্রভু।



মহালয়া
সুদীপ দাস

মৃন্ময়ীর সাজো সাজো রব,
এখনও মাটির ওপর রঙের শেষ প্রলেপ পরেনি,
আলয়ে যাবে ঐ মহিষাসুরমর্দিনী
আর গৃহহীন রা! ওরাও তাকিয়ে শরতের নির্মল আকাশে।
আজও যারা আশ্রয়হীন , দীন,
দিন কাটে দূর্দশার ঘোরে, তারাও বেঁচে আছে
আর দূর থেকে ভেসে আসে
মহালয়ার মনোরম ভোরে
"বাজলো তোমার আলোর বেণু"
পিতৃ তর্পনের মন্ত্র পাঠে পূর্বপুরুষের স্মরনে মত্ত
বিদেহী আত্মার শান্তির কামনায়
মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে, ওই যে সুর ভেসে আসে
"জাগো তুমি জাগো"
পরিবেশ কিন্তু অফুরান দিল, দিল মনোরম,
পাহাড়ী নদীর জল, প্রস্ফুটিত স্বচ্ছ কত
ভিন্ন আকারের কাঁকর গুলো একদম স্পষ্ট,
চরে তার কাশ বনের দোলা
বার বার জানান দিয়ে যাচ্ছে আগমনীর আগমন।
এই আগমনী বার্তায় ওরা যেন আজও ম্লান!
"আয় রে ছুটে আয় পূজার গন্ধ এসেছে"
এই মাত্র গানটি বাজিয়ে মোটর গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে শহরের এক নামী ক্লাব। 
আর  মাঝে মাঝে বাজছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া পাঠ,
জীবনে বাঁচার জন্য অনেক চাওয়া পাওয়া থাকলেও,
এই কালজয়ী পাঠ একটু হলেও ওদের মনে নাড়া দেয়, অন্নান্য সবার মত।
নুন ভাতের থালা ফেলে ওই ছোট্ট মেয়েটি
দৌড়ে গিয়ে দেখে আসে মহালয়ার গাড়িটি,
যাতে ঐ গান, ঐ সুমধুর পাঠ অনবরত বেজেই চলেছে,
আর ক্রমাগত অস্পষ্ট হতে অস্পষ্টতর হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
"দেবী দূর্গতি নাশিনী",
বার বার ধ্বনিত হয় মগজে,মজ্জায়, হৃদয়ে।
ঢাকের তালিম এখনো শেষ হয়নি,
ওই ছয়টি দিনে বেপরোয়া হতে হবে তাল উঠিয়ে
ঢাকে বোল উঠবে সারা বছরের সব ভুলে গিয়ে, 
আজ মহালয়ার দিনে বার বার গাইতে ইচ্ছে হয়
"রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি"।







অদ্রিজা  বোস

 



।।  পুজো ছন্দে। । 
                     

শারদীয়া 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

শ্রাবণ  মেঘের  বিদায়  বেলায়
শরত  মেঘে  কাশের  আলো,
নীল  আকাশে  রঙ   মাখিয়ে
সাজলো মেঘের পেঁজা তুলো।

স্থলপদ্ম,  শিউলিরা   সব
আলোর ছোঁয়ায় মেলল আঁখি, 
এই  শরতেই   ভাঙল   যে ঘুম,
উঠলো ডেকে ভোরের পাখি। 

নরেন পালের তুলির ছোঁয়ায়
কুমোরপাড়ায় দূর্গা হাসে,
আলোর  মালা  মন্ডপেতে
ধুপ-ধুনোরই  সুবাস ভাসে।

বানভাসি  সব লোকজনেদের 
রাখছে  বল  খবর   কেবা,
ছুটছে  তারা পেটের জ্বালায়
হচ্ছে   কোথায়  নারান  সেবা।

মানিব্যাগ দেয় জোর শাসানি 
সদাই  থাকি  বেজায়  ত্রাসে,
রেখো  মাগো  নজর  খানি
খারাপ  খবর আর না  আসে।

মাগো   তুমি   দশটি   হাতে 
অস্ত্র  গুলো  নাও   সাজিয়ে, 
অসুর  ভায়া   হাড়  কাঁপানো 
 আওয়াজ তুলে যাক পালিয়ে। 



ক্ষমাঘেন্না কোরো মাগো একটুখানি করি রঙ্গ 
বুলবুল দে 

দূগ্গা মাগো দূগ্গা মাগো আসছো আবার বঙ্গে,
বঙ্গ আবার উঠবে মেতে আহা কত রঙ্গে।
ঝলমলানো অঙ্গাভরন জড়িয়ে নিয়ে অঙ্গে,
ছানাপোনারাও লম্ফে ঝম্ফে আসছে তোমার সঙ্গে।
ব্যোমভোলানাথ ঢিলুমঢুলুম চোখটি রগরে নিয়ে,
অসুর সাথে তোমার পিছে ধাইছে পনপনিয়ে।
গাজা-কলকে ছিটকে কোথায় পড়ল কে তা জানে,
ভাঙের নেশা চটকে তোমায় ডাকছে আকুল প্রাণে।
"গিন্নি ওলো,ওলো গিন্নি আরে একটু সবুর করো,
পোষ্য গুলো রইল পড়ে আহা ওদের কেন ছাড়ো।"
চোখ পাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে আঁচল খানা গুজে,
দূগ্গা গিন্নি বাক্যি ছোটান রাগে গজগজিয়ে।
"আ মলো যা ধামসা মরদ, ডাকছো কেন পিছে?
যাত্রা ভঙ্গ করার এসব বাহানা রাখ  মিছে।
পোষ্যরা সব ট্রেনিং দেওয়া ওরা আসতে পারে চিনে,
ওরাও বোঝে ,তোমার মত নয়কো মিনমিনে।
ভাঙের নেশায় সারা বছর বেভোর হয়ে থাক,
বৌ এর কথা তখন বুঝি মনে পড়ে নাকো!
যেই না বৌ এর বাপের বাড়ি যাবার সময় হল,
অমনি নাকি সকল ওনার রসাতলে গেল!
হায় গতজম্মে বুঝতাম যদি এই আছে কপালে,
প্রাণটা কি ছাই দিতাম অমন বৃথাই অবহেলে!
কোথায় তোরা হতচ্ছারা ভৃঙ্গী আর নন্দী?
ফাঁকিবাজের সাথে থেকে ফাঁকিবাজির ফন্দি?
করনাসুরের জ্বালায় একেই জ্বলছে আমার আপনজন,
তার ওপরে আনলি তোরা অপয়া এই ঘোটক বাহন!
ম্যাচিং ম্যাচিং মাস্ক আর সুগন্ধি স্যানিটাইজার,
না জোগালে তোদের কিন্ত এসপার কি উসপার।"
নন্দী ভৃঙ্গী বোঝায়," মাগো রাগ কোরোনা এমন,
বুঝেও কেন বোঝনা বাবার মনভোলা এই মন।"
"ধুত্তেরি ছাই এতই কারো হয় কি ভোলা মন?
জানেনা যেন পাল্টে গেছে ধরার নিয়ম কানুন!
আমার আগে কতবার তো ধরায় ঘুরে এলে,
এর মধ্যেই সবই বুঝি নেশায় উড়িয়ে দিলে?
ভিড় বাড়ানো চলবেনা, থাকতে হবে দুরে দুরে,
পোষ্য গুলো তোমার সাথে তাই এখানে রইল পড়ে।"
কোঁকিয়ে উঠে বলে ভোলে, "গিন্নি এতই নিঠুর হলে!
পায়েরনিচের একটুকু ঠাঁই সেটাও দিলে দুরেঠেলে!"
দূগ্গা বলে," চাও যদি এই পায়ের নীচের ঠাঁই,
করোনাসুরকে মারার অস্ত্র আগে আমার চাই।"
"ক্ষেপছো কেন গিন্নি, চেষ্টার করছি নাতো কসুর,
কিছুতেই পুরো আসছেনা বাগে ধুরন্ধর এই অসুর।"
"আচ্ছা! তবে থাকো পড়ে ,ধরবেনা আমার পিছু,
কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে চাইনা কিছু ।"
দুম্ করে পথে বসে পড়ে গুম্ হয়ে ভাবে ব্যোম্,
"তার চে বরং ধ্যানেই বসি, ওম্ শান্তি ওম্!"




পুজোর বাঁশি
মহাজিস মণ্ডল

শরৎ দিনে
খুশির বীনে
বাজে পুজোর বাঁশি,
পাতার ফাঁকে
বাতাস ডাকে
স্বপ্ন রাশি রাশি।
হারাই দূরে
তেপান্তরে
মেঘ মুলুকের দেশে,
ছন্দ গানে
হৃদয় টানে
আনন্দেতে ভেসে।



দুই রূপে দুই মা
বিপ্লব গোস্বামী


আমার এক মায়ের পূজা হয়
বড়োই ধুমধামে ;
আমার অন‍্য মা মাঠে খাটেন
শরীর ভিজে ঘামে !
আমার এক মায়ের পূজার লাগি
বড়োই আয়োজন ;
আমার অন‍্য মায়ের খবর নিতে
নেইতো আপন জন !
আমার এক মাকে তুষ্ট করতে
লক্ষ বলিদান ;
আমার অন‍্য মায়ের ভাগ‍্যে জোটে
কত শত অপমান !
আমার এক মায়ের গায়ে শোভে
হাজার আভূষণ ;
আমার অন‍্য মায়ের লজ্জা ঢাকার
নেইতো আবরণ !
আমার এক মায়ের প্রণামী থালায়
স্বেচ্ছায় করি দান।
আমার অন‍্য মা ভিক্ষা মাগতে
সইতে হয় অপমান !



পুজো
দেবর্ষি সরকার

পুজো মানেই নতুন কাপড় জামা,
হরেকরকম মন মাতানো আহার।
পুজো মানেই দেয় বুকে সুখ হামা,
রংঝলমল দারুন সাজের বাহার।
পুজো মানেই লম্বা টানা ছুটি,
বই খাতা পেন সটান শিকেয় তোলা।
পুজো মানেই আলোয় লুটোপুটি,
পুজোর মজা যায় কখনো ভোলা?
পুজো মানেই শিউলি সুবাস ভাসে,
নদীর জলে শাপলা শালুক হাসে।
পুজো মানেই বাতাস নাচে কাশে,
রোদ চুমো দেয় শিশির ভেজা ঘাসে।
পুজো মানেই সুখের সাগর বুকে,
দলবেঁধে রাত জেগে ঠাকুর দেখে।
পুজো মানেই শুকনো মলিন মুখে,
কোথাও যেন কেউ থাকেনা একা।
পুজো মানেই প্রীতির প্রহর গোনে,
সবুজ অবুজ ছোট খোকা খুকি।
পুজো মানেই সবার মনের কোণে,
সুখের সূর্য খুশিতে দেয় উঁকি।
পুজো মানেই ক্লান্ত কালোর আঁধার,
সরিয়ে আসুক আশার আলোর ঝালর।
পুজো মানেই পাহাড় বিঘ্ন বাধার,
নড়িয়ে হাসুক সুদিন সবার ভালোর।



আবাহন
রূপক রায়

কাশ ফুলে ফুলে
         দুলছে হাওয়া
সাদা মেঘের ভেলায় 
   সেজেছে ভুবনমোহিনী
বেজেছে শঙ্খধ্বনি
ধরণী জুড়ায়,
মাটি! সে সাধারণ নয়
রক্ত চলে যেন প্রতিটি শিরায়
আনন্দের মরশুমে
      শরতের প্রথম ভোরে 
              দেখেছি তোমায়
 শারদ আকাশে 
          স্নিগ্ধ আলোয
    ডাকছে পাখি কিচির-মিচির
আমার ভেজা ঘাসে জমে আছে
                      ভোরের শিশির।



আসছে পুজো

আকাশলীনা ঢোল

পুজো আসছে, পুজো আসছে,

মা আসছে ঐ-

পুজো আসছে, পুজো আসছে,

চারিদিকে হৈ চৈ।

পুজো আসছে, পাড়ায় পাড়ায়,

মণ্ডপসজ্জার কাজ-

পুজো আসছে, বুকের ভেতর

উথাল-পাথাল আজ।

পুজো আসছে, রকমারি,

জামাকাপড় কেনা-

পুজো আসছে, তবু কারোর

হাজার টাকার দেনা।

পুজো আসছে, মনের ভেতর

আনন্দ সব্বার-

এমন পুজোর সময়ও কেন

অনেকেরই মুখ ভার?

পুজোর মরশুমে নেই কেন

তাদের গায়ে নতুন জামা?

বস্ত্রহীন শিশুটিকে দেখো-

যে ফুটপাতে দিচ্ছে হামা।

পুজো আসছে, সবদিক

আনন্দে মাতোয়ারা-

পুজোর দিনেও একই থাকে

সর্বকালের সর্বহারা।



। ছোটদের পুজো।




  অনুস্মিতা বিশ্বাস



    
শরতের কবিতা
প্রিয়াংশু নন্দী

এ কোন রঙে রাঙ্গিয়ে দিলো
আজ এই শরৎ আকাশ,
শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাসে 
এ কোন সোনালী উদ্ভাস। 

ওগো দেখো তুমি শতবার 
তোমার মুগ্ধ নয়নে, 
এ কোন সুখ তরঙ্গে 
ঢেউ খেলে যায় কাশবনে.. 

শিউলিরা আজ দল বেঁধে
আনমনে আছে পথটি ছেয়ে, 
তাদের গন্ধে, কিসের তরে 
এই ব্যাকুল মন বেড়ায় গেয়ে।  

কার আসার সময় হলো 
বলবে কি এই শরৎ তপন! 
তিনি, মানব জীবন ধন্য করে---
ফেরাবে কি আজ সুখের স্বপন!!

এ কোন সুরভির পরশে 
মোর প্রাণে এত উল্লাস!! 
এ কোন রঙে রাঙ্গিয়ে দিলো
আজ এই শরৎ আকাশ...



দুগ্গামা ও করোনা অসুর 
দেবাঞ্জনা রুদ্র

ঢাকের তালে কোমর দুলে, 
উঠলো নেচে মন-
কাশফুল আর শুভ্র আকাশ
জানায় মা; তোমায়  নিমন্ত্রণ। 


দশভূজা শক্তিশালিনী 
তুমিই যে মা-
স্কুল কলেজ সবই বন্ধ 
কবে খুলবে জানি না !


মাক্স আর স্যানিটাইজার 
হয়েছে মাগো সঙ্গী ,
ঘরের চারি দেওয়ালে
আমরা ছোটরা বন্দী! 


আকাশে বাতাসে ভাসছে 
মাগো আগমনী সুর ,
তোমার কাছেই হারবে জানি            
দুষ্টু করোনা অসুর।।  





  দেবোদয় গুহ রায় 





মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৮