মুজনাই সাপ্তাহিক
বিশেষ সংখ্যা
শান্তিনিকেতনের অর্থ সংগ্রহ নিয়ে গুরুদেব ও গান্ধীজির মধ্যে মতবিরোধ গড়ে ওঠে
বটু কৃষ্ণ হালদার
কবিগুরুর স্বপ্নের শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথকে কত সময় আর্থিক কৃচ্ছতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে একথা আজ আর আমাদের নিকট কারো অজানা নয়।বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য কবিকে অনেক সময় দেশে বিদেশে ভাষণ দিতে হয়েছে মাঝে মাঝে তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সংগীত নিত্য নাট্যাভিনয় জন্য ঘুরে বেড়াতেন। অর্থের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টা গান্ধীজীর মনে খুব কষ্ট দিত।রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একবার অর্থ সংগ্রহের জন্য উত্তর ভারত অঞ্চলের সফরে বের হলেন এই সংবাদ গান্ধীজীর মনে ব্যথা দিলো। দিল্লিতে সদলবলে কবির সঙ্গে গান্ধীজীর সাক্ষাত হলে তিনি শান্তিনিকেতনে কবিকে ফেরত পাঠালেন।
গান্ধীজী গুজরাটের ওয়ার্ধা থেকে ১৩/১০/১৯৩৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন_"একথা আমার নিকট ভাবনার অতীত বলে মনে হইতেছে যে আপনার এই বয়সে আপনাকে আবার ভিক্ষার উদ্দেশ্যে বাইর হইতে হইবে আপনার শান্তিনিকেতনের বাইরে পা বাড়ান ব্যতীত ই এই অর্থ কে আপনার নিকট পৌঁছে দিতে হইবে"। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে ব্যবসায়ীরা রবীন্দ্রনাথের নিকট ৬০ হাজার টাকা পৌঁছে দিলেন। ওই অর্থে শান্তিনিকেতনের বহু ঋণ শোধ করা হয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুরুদেব নিজের উত্তরোত্তর বার্দ্ধনমান বিশ্বভারতীর জন্য চিন্তা করতে শুরু করলেন। কারণ মৃত্যু চিরন্তন সত্য, তাকে উপেক্ষা করার মতো সাহস বিশ্বে কারো নেই। এই ভেবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন যে তার অবর্তমানে বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ কী হবে। এই ভাবনা গুরুদেবের মনকে প্রবলভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলতে লাগলো। তবে তিনি চিন্তা করেননি এমনটা নয়, ভেবেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর কথা। মহাত্মা গান্ধীর নিকটের বিশ্বভারতী স্থায়িত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ গুরুদেবের চোখে গান্ধীজী যেমন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতাও অপরিসীম তেমনি বিশ্বভারতী আদর্শের প্রতি অতি নিয়ে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাবান ছিলেন। মনে মনে এত শত ভাবার পর গান্ধীজীর অনুমতি না নিয়ে গুরুদেব বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি মনোনীত করেন গান্ধীজী কে। ট্রাস্টি মনোনয়নের পর পর কবি গান্ধীজী কে একটি চিঠি লিখেন_"(১০.০২.১৯৩৭) আমি আপনাকে আমাদের বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি মনোনীত করার স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের এই ভাঙ্গা শেষ বয়সে জিনিসটা জানতে পারলাম যে যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ এবং শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য নিয়োজিত করিয়াছি সেই প্রতিষ্ঠান আপনাকে তার একজন অভিভাবকরূপ লাভ করিবে"। উদ্ভিদও উক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীকে কতটাইনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে।
তবে সমস্যার সূত্রপাত হলো এখান থেকে।গুরুদেব এভাবে গান্ধীজিকে বিশ্বভারতীর আজীবন ট্রাস্টি মনোনয়ন দেওয়ার উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছিল।গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির উত্তরে যে কথা লিখেছিলেন তার মধ্যে এমন ইঙ্গিত ছিল যে গান্ধীজিকে এই ট্রাস্টি মনোনয়নের ভিতরে প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষে অর্থ সংগ্রহের যোগ আছে।মহাত্মা গান্ধীর একথা ঠিক অভিপ্রেত না থাকলেও গান্ধীজীর উত্তরের ভিতরে দিয়ে একথা কবিগুরু মনে মনে ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। একটা সময় শান্তিনিকেতনের জন্য গুরুদেব সংগীত নৃত্য নাট্যাভিনয়ের দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন,তা দেখে গান্ধীজি একটি পথে কোভিদ এই জাতি সম্পর্কে একটি "ইবমমরহম সরংরপড়হ" বলে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর এমন ধারণা দেখে কবিগুরু মনে মনে প্রচন্ড ব্যথিত হয়েছিলেন।গুরুদেবের এইজাতীয় সফরের সাথে আর্থিক প্রয়োজন এর কোন সম্পর্ক ছিল না এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি শান্তিনিকেতনের জন্য কেবল অর্থ ভিক্ষার অভিযান বলে অভিহিত করলে ও ঠিক হবে না। গুরুদেব নতুন নতুন সৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকতে ভালবাসতেন। সেই সৃষ্টির মধ্যে নিখুঁত সুরে নৃত্য অভিনয় রূপায়িত দেখতে দেখতে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতেন। তাঁর কাছে অর্থের মূল্যের থেকে আনন্দের মূল্য কোন অংশে কম ছিলনা। যার ফলস্বরূপ বয়স কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি।বৃদ্ধ বয়সেও তাই দলবল নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরতে তাঁর উৎসাহের খামতি ছিল না। এটাতে শুধুমাত্র গুরুদেবের ব্যক্তিগত আনন্দ নয়, যে দৃশ্য দেখার জন্য বিশ্বের সুতা ও দর্শক দিনের-পর-দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। আনন্দ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের রুচি আচরণ জীবনের সাধারণ মূল্যবোধ উন্নত করে তোলাই গুরুদেবের মহৎ দায়িত্ব ছিল। এসবই ছিল গুরুদেবের দেশ ভক্তি র নমুনা।তিনি মনে করতেন এই সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি তার মহৎ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তবে গান্ধীজীর সহজাত ধারণা ভিন্ন ছিল বলে তিনি হয়তো এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাই মহাত্মা গান্ধীর ধারণা সম্বন্ধে গুরুদেব একটি চিঠি লেখেন (২৬/২/১৯৩৭)_"আমার দিক হতে অকপটে আপনাকে একটা কথা বলতে দিন।আমি যে কাজকে সানন্দে আমার নিজের বন্ধু বলে মনে করই সম্ভবত আপনার নিজের ধাত্রী সে ব্রতের মহিমা উপলব্ধি করতে আপনাকে বাধা দেয়। আমার এই যে ব্রত তাহা ভারতবর্ষের কেবলমাত্র কোন আর্থিক সমস্যা লইয়া ব্যস্ত নয়। ভারতবর্ষের কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের লইয়াও ব্যস্ত নয়। ইহা একটা ব্যাপক অর্থে মানব মনের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে আছে।আমার মতে আমার একটি কবি সৃষ্টিকে আমি যখন বাহিরে পাঠাইয়া দিবার জন্য ভিতরে তাগিদ বোধ করি তখন আমি শুধু ভিক্ষা বা কোন উপকার আশা করি না।আমার এই কবি সৃষ্টিকে সাড়া দেওয়ার মতো যাদের মধ্যে একটি সংবেদনশীল হৃদয়ে আছে তাহাদের নিকট হইতে আমি আশা করি আমার সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রতি একটি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধার্ঘ্য"।
এই সমস্ত অনুষ্ঠানে অসুস্থ শরীরেও গুরুদেব দেশ-বিদেশে কেন নিজে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন তার কৈফিয়ৎ স্বরুপে মুক্ত চিঠিতে আরো লেখেন_"একটা কথা আমি স্বীকার করতেছি, আমি নিজে যে সকল শিল্পীদের শিক্ষা দিয়াছি সেই সকল শিল্পী যখন ছন্দ তালে সমন্বিত অঙ্গ সঞ্চালন এবং সুরময় কণ্ঠস্বরে আমার কোন সৌন্দর্যের স্বপ্নকে একটি নিখুঁত রূপ দান করিতে চাহে তখন তাদের পাশে সগর্বে বসে থাকা অপেক্ষা আর অন্য কোনো জিনিসই আমি বেশি ভালোবাসি না। আমি সগর্বে এই জন্য বসে থাকি যেন তাহাদিগকে বলিতে পারি চমৎকার হইয়াছে"।
No comments:
Post a Comment