মুজনাই সাপ্তাহিক
বিশেষ সংখ্যা
সম্পাদকের কথা
মহাপ্রয়াণের এত বছর পরেও তাঁর দীর্ঘ ছায়া আসমুদ্রহিমাচল পরিব্যাপ্ত। নিজের জীবনকে যিনি পাঠক্রমে পরিণত করেছিলেন, তাঁকে নিয়ে এক ক্ষুদ্র পত্রিকার ততোধিক ক্ষুদ্র সম্পাদকের কী-ই বা বলবার থাকে! শুধু মনে হয় এই অস্থির সময়ে তাঁর বড্ড প্রয়োজন ছিল। যে অসহিষ্ণুতা আজ কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের রক্তে তার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ তাঁর জীবন দর্শন ও শিক্ষা।
এই দেশে অবশ্য তিনি ব্যক্তি পূজা আর ব্যক্তি নিন্দার ওপরে উঠতে পারেন নি। তিনি হয়ত ব্যর্থ তাই। আবার এই ব্যর্থতাই প্রমাণ করে যে, তিনি আজও কতটা প্রাসঙ্গিক।
আজ জন্মদিনে মহামানবকে প্রণাম। তিনি থাকুন অন্তরে, পরিশুদ্ধ আত্মায়....
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
ডঃ রাজর্ষি বিশ্বাস, অধ্যাপক অংশুমান পাল, শঙ্খনাদ আচার্য, বটু কৃষ্ণ হালদার,
শ্রাবণী সেনগুপ্ত, বিপ্লব তালুকদার, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত ,
তানভী দাম, অদ্রিজা বোস, সুজল সূত্রধর
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা
গান্ধী বাওয়ার অতিমানব হয়ে ওঠার আখ্যান
ডঃ রাজর্ষি বিশ্বাস
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে গান্ধীজি এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন। এই ভেনি-ভিডি-ভিসি কীভাবে সম্ভব হল ? গান্ধীজীর এই চমকপ্রদক উত্থানের পেছনে ভারতীয় সমাজে ফল্গু ধারার মত বহমান কল্প রাজ্যের ধ্যান ধারণা ও অলৌকিকতায় বিশ্বাস অনেকটাই সহায়ক হয়। বিদেশের মাটিতে আংশিক সাফল্য এদেশে তাঁকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যাতে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মায় গান্ধীজিই হলেন প্রকৃত ত্রাতা। পূর্বেকার কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের বেশভূষা, চালচলন এবং সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির সাথে আম ভারতবাসীর কোন মিল ছিলনা। সেই প্রেক্ষিতে এক অতি সাধারণ চেহারার ও ততোধিক সাধারণ বেশভূষার - অনেকটা সাধুসন্তদের সাথে তুল্য মানুষটি অশিক্ষিত ভারতবাসীর কাছে মেসিয়ায় পরিণত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। উত্তর ভারতে তিনি যত না একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে, তার থেকেও অধিক একজন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাই তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে যে প্রবল উন্মাদনা তৈরি হত, তা বর্তমানের নেতা-নেত্রীদের কাছেও অকল্পনীয়।
গান্ধীজীর এই অতিমানবীয় প্যারাডাইম নির্মাণের পেছনে একাধিক গল্প প্রচার পেয়েছিল। এই কাজে ইন্ধন দিয়েছিল গান্ধীজীর অনুগামীবৃন্দ ও স্থানীয় একাধিক পত্রপত্রিকা। ইতিহাসবিদ শাহিদ আমিন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন এসব প্রচার মূলক নানা গল্পগাঁথা কী প্রবল ভাবে তাঁকে মহাত্মা বানিয়েছিল। এই গল্পগুলি যেন এক সুরে বাধা ছিল। যেমন একবার জনৈক এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রাতে স্বপ্ন দেখে পালাও পালাও চিৎকার করতে করতে ইংরেজ অফিসারের বাংলোর দিকে ছুটে যান। কারণ তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গান্ধীজী ইংরেজদের ধ্বংস করতে ছুটে আসছেন অনেক মানুষজন নিয়ে। মধ্যরাতে সেই চিৎকারে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় তাতে গোরক্ষপুরে সব সাহেবরা বিছানা ছেড়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় স্টেশনের দিকে ছুটে যায়। গান্ধীজিকে নিয়ে ইংরেজ সাহেবদের মধ্যে এই ভয়াবহ আতঙ্কের গল্পটি ছাপা হয়েছিল বেনারসের ' আজ ' পত্রিকায় এবং পরে 'স্বদেশ ' পত্রিকায়। শুধু এই গল্পটি নয়, গ্রামেগঞ্জে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে হাজারো অলীক গল্প। যেসবের মূল আধার ছিল গান্ধীজী এক অভূতপূর্ব অলৌকিক শক্তির অধিকারী। ছোটখাটো এরকম নানা গল্পের নমুনা পেশ করেছেন শাহিদ আমিন। যেমন জনৈক এক ব্যক্তি একবার এসে বললেন, গান্ধীজীর ওপর তার বিশ্বাস আসবে যদি আখের রস ভরা কড়াই দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায় - বলা মাত্রই কড়াইটি দু'টুকরো হয়ে যায়। এক কাহারের বক্তব্য ছিল যে সে তাঁকে বিশ্বাস করবে যদি তার বাড়ির চাল উপরে উঠে যায়। সকলে বিস্ময়ের সাথে দেখে যে তার বাড়ির চাল এক হাত উপরে উঠে গেছে। আর একজনের কথায়, গান্ধীজীর ক্ষমতা যদি সত্যি হয় তবে তাদের জমি সর্ষেতে ভরে যাবে এবং হলও তাই। এমনকি গুপী গাইন বাঘা বাইনের মত গান্ধীজীর নামে আকাশ থেকে মিষ্টি বর্ষণও হল। গোরক্ষপুরের গ্রামে গ্রামে গান্ধীজীর প্রতি এরকম অলৌকিক বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য এরকম বহু গল্প চলতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। তাইই নয়, শুরু হয় ভয় ভীতির সুকৌশল আখ্যান। যেমন গান্ধীজীর নামে গালিগালাজ দিলে এক ব্যাক্তির চোখের দুপাতা জুড়ে যায় বা আরেকজনের চার সের ঘি নষ্ট হয়ে যায়; আবার একজনের গায়ের থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। এরপর শুরু হয় গান্ধীজীর নামে মানত রাখার গল্প। যেমন ভাগলপুরের জনৈক এক মুসলমান ব্যক্তির একটি পাত্র কুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। গান্ধীজীর নামে মানত করায় সেই পাত্র আপনা থেকেই ভেসে ওঠে। একই ভাবে তাঁর নামে মানত করায় আজমগড়ে এক ব্যক্তির বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া বাছুর বাড়িতে ফিরে আসে। বার্নিয়া জেলার একজনের হারিয়ে যাওয়া টাকার সমেত থলি মানত করেই ফিরে পায়।
গান্ধীজীর আশীর্বাদের গল্পও ইস্তক ছড়িয়ে পড়ে। এই গল্পই হোক বা গুজব তা শুধু যে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ছড়িয়েছিল এমন নয়, সমাজের শিক্ষিত অংশকেও প্রভাবিত করেছিল। যেমন গোরখপুর শহরের এক উকিলের বাগান বাড়িতে দুটো গাছ মরে গেলেও গান্ধীজীর আশীর্বাদে বেঁচে ওঠে। ক্রমে খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আশেপাশের গ্রাম গঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ সেই গাছ দুটিকে দেখতে ছুটে আসে এবং ফুল, ফল, বাতাসা, টাকা, গয়না এসব প্রণামী দিতে শুরু করে। এসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে সেসব স্থানে প্রায়শই মেলা বসে যেত এবং গান্ধীজীর অলৌকিকত্বের নানা গল্প ও গুজব লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। আর তা স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হত। সেসময়ে 'স্বদেশ' পত্রিকায় এরকম নানা স্থানীয় খবর প্রচারিত হত। তবে এগুলির সত্যাসত্য পরীক্ষার বলাই ছিল না। এই পত্রিকার অনেক খবরের মধ্যে একটি ছিল - একবার গোরখপুর সিভিল কোর্টের কাছে এক গ্রামে ভয়াবহ আগুন লাগলে লোক জলের জন্য গান্ধীজীর নামে মানত করে। সাথে সাথেই আশেপাশের যত কুয়ো ছিল সব জলে পরিপুর্ণ হয়ে যায়। যথারীতি সেখানেও বহু মানুষের সমাগম হয় এবং সেই জল পবিত্র মনে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে। এই সব জমায়েতে গান্ধীজীর মাহাত্ম্য প্রচারের পাশাপাশি স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে এসব প্রকাশিত হলে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন গান্ধীজী। ব্রিটিশের পুলিশ গুলি করছে, তা তাঁর গায়ে লেগে জল হয়ে যাচ্ছে অথবা তিনি আগুনের ওপর দিয়ে নির্বিকারে হেঁটে যাচ্ছেন - এসব মানুষকে এক গণ উন্মাদনায় ধাবিত করে।
সাধারণ মানুষের চৈতন্যে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা গান্ধীজী দ্রুত সারাদেশের গণদেবতায় পরিণত হয়ে যান। শুধু উত্তর ভারতের গ্রামগুলিতেই নয়, গান্ধীজীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। এমনকি প্রান্তিক রাজ্য কুচবিহারেও সেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তখন রাজ্যে মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ ক্ষমতাসীন। সাধারণভাবে কুচবিহারবাসী মহারাজার অনুগত প্রজা হলেও, তাদের হৃদয়ে সেসময় গান্ধীজীই মহারাজার স্থান অধিকার করে নেন। পুন্ডিবাড়ি গ্রামে এক সভায় মহারাজা স্বয়ং হাজির হলে আয়োজক এক নেতা এসে বলেন, " হুজুর এ সভা গান্ধী মহারাজের কথা শুনিবার আর মানষিগুলাক শোনাইবার জন্য।" মহারাজার সমানে স্থানীয় কৃষকেরা যেভাবে গান্ধীজী প্রতি তাদের আনুগত্যের কথা বলেছিল তা শুনে মহারাজা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, " আমি তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজা থাকতে চাই না। তোমরা যদি গান্ধীজিকে রাজা করতে চাও, সেটা বল। আমি এখনই রাজ্য ছেড়ে চলে যাব। কোন ভয় নাই - তোমরা তোমাদের কথা পরিষ্কার করে বল।" রাজার রাজ্যেই যদি এই পরিস্থিতি হয়, তবে অন্যত্র গান্ধী বাবা বা বাওয়া, গান্ধী মহারাজ ও মহাত্মার প্রভাব কতটা ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
Title: A yogi who was read wrong in India?
Subtitle: Or was Gandhi actually a poverty-loving, spiritual figure out of the touch with practical world?
Anghsuman Paul
Okay, so let’s start with a question. What comes to your mind when you hear the name ‘Gandhi’? With definite conviction, the answer would be a non-violent, poverty-loving, spiritual figure out of touch with the so-called hard-headed world or the answer can be also as a supporter of woolly backward ideas. There’s more! In the economic sphere, he’s often illustrated as an anti-industrial person and if you are a Bong (like this author), then you must have also heard he was anti-Bengali (read Subhash Chandra Bose). Instead of merely drawing a simplistic conclusion on the father of the nation, let’s try to see Gandhi’s certain philosophies, which otherwise have been overlooked. Like say for instance, his preaching of forgiveness has been criticized as cowardice but the fact is Gandhi believed one should be first powerful enough to punish and only then should practice forgiveness; forgiveness without any power has been actually coined by Gandhi as cowardice.
For we Indians, Gandhi still remain as imaginary person who’s ideal was to judge the moral basis of our actions and we could never understand his personal austerity. Renowned author Pavan K Varma says, “We respect him for it but more as a person from earth may look up to the powers of someone from another planet.” So is he an alien yogi who’s paid obeisance only on 2nd of October? With definite conviction, Gandhi’s imperviousness to the temptations of the material world left us awed but unconverted and Indians admired his ability to restrict his wants but certainly were not prepared to emulate him. No wonder his ashram in Ahmedabad remained a place of curiosity, not of inspiration.
Without concluding anything on whether Gandhi loved poverty or not; it can be said to him, wealth creation was the way out of the ‘grinding pauperism’ and he was looked up to as a Mahatma because in his denial & sacrifice of wealth, he was so different. Even conventional yogis, the saints & sadhus who proliferate in India today are porous to earthly munificence but Gandhi’s instrumental view of wealth derived directly from his love of the Isavasya Upanishad. And to understand that we Indians must read Gandhi’s work first rather than commenting on something based on the work of others written on this wrongly read yogi.
গান্ধীজি ও নোবেল
শঙ্খনাদ আচার্য
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, আসমুদ্রহিমাচলে 'গান্ধীজী' নামেই সুপরিচিত। কারো কারো কাছে তিনি আবার 'বাপুজি' নামে, আবার কারো কাছে 'মহাত্মা' নামেও পরিচিত। আমৃত্যু 'সত্যাগ্রহের' আদর্শে বিশ্বাসী যে তপস্বী ছিলেন বিংশ শতকের 'অহিংস' আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রতীক তিনি কখনও 'নোবেল শান্তি পুরস্কার' পাননি, এর চাইতে লজ্জাকর ঘটনা ইতিহাসে আর কিইবা হতে পারে! যদিও নোবেলের ইতিহাস বলছে বেশ কয়েকবার এই পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন।
স্যার আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯০১ সাল থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি প্রদান করে আসছে। এই পুরস্কার স্টোর্টিং (নরওয়েজিয়ান সংসদ) কর্তৃক নিযুক্ত পাঁচজনের একটি কমিটি প্রদান করে। তবে আলফ্রেড নোবেল কেন নরওয়েজিয়ান কমিটি কর্তৃক শান্তির জন্য পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং অন্য চারটি পুরস্কার সুইডিশ কমিটি দ্বারা পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেননি।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গান্ধীজি মনোনীত হয়েছিলেন পাঁচবার -১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭, এবং সর্বশেষ, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁর হত্যার মাত্র কিছুদিন আগে। ১৯৩৭, ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে গান্ধীজিকে মনোনীত করেছিলেন নরওয়েজিয়ান স্টর্টিংয়ের (সংসদ) লেবার পার্টি সদস্য ওলে কোবিওর্নসেন। অবশ্য প্রথম মনোনয়নের সময় গান্ধীজির পক্ষে প্রণোদনাটি রচনা করে দিয়েছিলেন 'ফ্রেন্ডস অভ ইন্ডিয়া'-র নরওয়েজিয়ান ব্রাঞ্চের এক নেত্রী। উল্লেখ্য, 'ফ্রেন্ডস অভ ইন্ডিয়া' নামক গান্ধীবাদী সংগঠনটি ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩০-র দশকের গোড়ার দিকে।
১৯৩৯ সালের পর গান্ধীজি পুনরায় নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ১৯৪৭ সালে। সে বছর তাকে মনোনীত করেছিলেন বি জি খের, জি ভি মাভালাঙ্কার এবং জি বি পান্থ। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন পেশের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীজিকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও। ইতিপূর্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার 'মরণোত্তর' কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি মোতাবেক, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া যেত। ফলে গান্ধীজিকে নোবেল দেবার রাস্তাও খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও, নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীজিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেননি। এর পেছনে কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেন, গান্ধীজি কোনো সংগঠনের অংশীদার ছিলেন না, তিনি কোনো সম্পদ রেখে যাননি, কোনো উইলও করে যাননি, ফলে তার পুরস্কার গ্রহণ করবার মতো কোনো যোগ্য উত্তরসূরী নেই। শেষ পর্যন্ত জন আবেগের কথা মাথায় রেখে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর তারা জানান, - "কোনো যোগ্য জীবিত প্রার্থী না থাকায় এ বছর কাউকে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে না।"
২০১৯ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সেক্রেটারি গেইর লান্ডেস্ট্যাড বলেন, মহাত্মা গান্ধীর নোবেল না জেতার বিষয়টি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল। সম্ভবত নোবেল কমিটির সদস্যদের তৎকালীন ইউরোপ-কেন্দ্রিক মানসিকতাই এর পেছনে দায়ী। সেই সঙ্গে তিনি আরো বলেন, "নোবেল পুরস্কার ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।"
আসলে 'গান্ধী' কোন ব্যক্তির নাম নয়, একটি আদর্শের নাম। তাই কোন ব্যক্তিকে পুরস্কারের মাপকাঠিতে মাপা গেলেও আদর্শকে মাপা যায় না। যেমনটা গান্ধীজীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কারণ, মহাত্মার আদর্শ অবিনশ্বর, তাঁকে হত্যা করা গেলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই গান্ধীজীর এই নোবেল না পাওয়ার আক্ষেপ যতটা না ভারতবাসীর তার চাইতে ঢের বেশি নোবেল কমিটির, যা কোনদিনও ঘোচবার নয়।
তথ্যসূত্র:
১। মহাত্মা গান্ধীর নোবেল পুরস্কার না জেতার কারণ - জান্নাতুল নঈম পিয়েল। (রোর মিডিয়া ১৩/০৫/২০২০)
২। এই সময় (অনলাইন পোর্টাল ০২/১০/২০১৯)
৩। প্রহর (অনলাইন পোর্টাল ২০/১০/২০১৯)
শান্তিনিকেতনের অর্থ সংগ্রহ নিয়ে গুরুদেব ও গান্ধীজির মধ্যে মতবিরোধ গড়ে ওঠে
বটু কৃষ্ণ হালদার
কবিগুরুর স্বপ্নের শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথকে কত সময় আর্থিক কৃচ্ছতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে একথা আজ আর আমাদের নিকট কারো অজানা নয়।বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য কবিকে অনেক সময় দেশে বিদেশে ভাষণ দিতে হয়েছে মাঝে মাঝে তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সংগীত নিত্য নাট্যাভিনয় জন্য ঘুরে বেড়াতেন। অর্থের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টা গান্ধীজীর মনে খুব কষ্ট দিত।রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একবার অর্থ সংগ্রহের জন্য উত্তর ভারত অঞ্চলের সফরে বের হলেন এই সংবাদ গান্ধীজীর মনে ব্যথা দিলো। দিল্লিতে সদলবলে কবির সঙ্গে গান্ধীজীর সাক্ষাত হলে তিনি শান্তিনিকেতনে কবিকে ফেরত পাঠালেন।
গান্ধীজী গুজরাটের ওয়ার্ধা থেকে ১৩/১০/১৯৩৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন_"একথা আমার নিকট ভাবনার অতীত বলে মনে হইতেছে যে আপনার এই বয়সে আপনাকে আবার ভিক্ষার উদ্দেশ্যে বাইর হইতে হইবে আপনার শান্তিনিকেতনের বাইরে পা বাড়ান ব্যতীত ই এই অর্থ কে আপনার নিকট পৌঁছে দিতে হইবে"। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে ব্যবসায়ীরা রবীন্দ্রনাথের নিকট ৬০ হাজার টাকা পৌঁছে দিলেন। ওই অর্থে শান্তিনিকেতনের বহু ঋণ শোধ করা হয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুরুদেব নিজের উত্তরোত্তর বার্দ্ধনমান বিশ্বভারতীর জন্য চিন্তা করতে শুরু করলেন। কারণ মৃত্যু চিরন্তন সত্য, তাকে উপেক্ষা করার মতো সাহস বিশ্বে কারো নেই। এই ভেবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন যে তার অবর্তমানে বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ কী হবে। এই ভাবনা গুরুদেবের মনকে প্রবলভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলতে লাগলো। তবে তিনি চিন্তা করেননি এমনটা নয়, ভেবেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর কথা। মহাত্মা গান্ধীর নিকটের বিশ্বভারতী স্থায়িত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ গুরুদেবের চোখে গান্ধীজী যেমন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতাও অপরিসীম তেমনি বিশ্বভারতী আদর্শের প্রতি অতি নিয়ে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাবান ছিলেন। মনে মনে এত শত ভাবার পর গান্ধীজীর অনুমতি না নিয়ে গুরুদেব বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি মনোনীত করেন গান্ধীজী কে। ট্রাস্টি মনোনয়নের পর পর কবি গান্ধীজী কে একটি চিঠি লিখেন_"(১০.০২.১৯৩৭) আমি আপনাকে আমাদের বিশ্বভারতীর একজন আজীবন ট্রাস্টি মনোনীত করার স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের এই ভাঙ্গা শেষ বয়সে জিনিসটা জানতে পারলাম যে যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ এবং শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য নিয়োজিত করিয়াছি সেই প্রতিষ্ঠান আপনাকে তার একজন অভিভাবকরূপ লাভ করিবে"। উদ্ভিদও উক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীকে কতটাইনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে।
তবে সমস্যার সূত্রপাত হলো এখান থেকে।গুরুদেব এভাবে গান্ধীজিকে বিশ্বভারতীর আজীবন ট্রাস্টি মনোনয়ন দেওয়ার উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছিল।গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির উত্তরে যে কথা লিখেছিলেন তার মধ্যে এমন ইঙ্গিত ছিল যে গান্ধীজিকে এই ট্রাস্টি মনোনয়নের ভিতরে প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষে অর্থ সংগ্রহের যোগ আছে।মহাত্মা গান্ধীর একথা ঠিক অভিপ্রেত না থাকলেও গান্ধীজীর উত্তরের ভিতরে দিয়ে একথা কবিগুরু মনে মনে ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। একটা সময় শান্তিনিকেতনের জন্য গুরুদেব সংগীত নৃত্য নাট্যাভিনয়ের দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন,তা দেখে গান্ধীজি একটি পথে কোভিদ এই জাতি সম্পর্কে একটি "ইবমমরহম সরংরপড়হ" বলে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর এমন ধারণা দেখে কবিগুরু মনে মনে প্রচন্ড ব্যথিত হয়েছিলেন।গুরুদেবের এইজাতীয় সফরের সাথে আর্থিক প্রয়োজন এর কোন সম্পর্ক ছিল না এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি শান্তিনিকেতনের জন্য কেবল অর্থ ভিক্ষার অভিযান বলে অভিহিত করলে ও ঠিক হবে না। গুরুদেব নতুন নতুন সৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকতে ভালবাসতেন। সেই সৃষ্টির মধ্যে নিখুঁত সুরে নৃত্য অভিনয় রূপায়িত দেখতে দেখতে তিনি আনন্দ খুঁজে পেতেন। তাঁর কাছে অর্থের মূল্যের থেকে আনন্দের মূল্য কোন অংশে কম ছিলনা। যার ফলস্বরূপ বয়স কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি।বৃদ্ধ বয়সেও তাই দলবল নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরতে তাঁর উৎসাহের খামতি ছিল না। এটাতে শুধুমাত্র গুরুদেবের ব্যক্তিগত আনন্দ নয়, যে দৃশ্য দেখার জন্য বিশ্বের সুতা ও দর্শক দিনের-পর-দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। আনন্দ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের রুচি আচরণ জীবনের সাধারণ মূল্যবোধ উন্নত করে তোলাই গুরুদেবের মহৎ দায়িত্ব ছিল। এসবই ছিল গুরুদেবের দেশ ভক্তি র নমুনা।তিনি মনে করতেন এই সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি তার মহৎ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তবে গান্ধীজীর সহজাত ধারণা ভিন্ন ছিল বলে তিনি হয়তো এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাই মহাত্মা গান্ধীর ধারণা সম্বন্ধে গুরুদেব একটি চিঠি লেখেন (২৬/২/১৯৩৭)_"আমার দিক হতে অকপটে আপনাকে একটা কথা বলতে দিন।আমি যে কাজকে সানন্দে আমার নিজের বন্ধু বলে মনে করই সম্ভবত আপনার নিজের ধাত্রী সে ব্রতের মহিমা উপলব্ধি করতে আপনাকে বাধা দেয়। আমার এই যে ব্রত তাহা ভারতবর্ষের কেবলমাত্র কোন আর্থিক সমস্যা লইয়া ব্যস্ত নয়। ভারতবর্ষের কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মমতের লইয়াও ব্যস্ত নয়। ইহা একটা ব্যাপক অর্থে মানব মনের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে আছে।আমার মতে আমার একটি কবি সৃষ্টিকে আমি যখন বাহিরে পাঠাইয়া দিবার জন্য ভিতরে তাগিদ বোধ করি তখন আমি শুধু ভিক্ষা বা কোন উপকার আশা করি না।আমার এই কবি সৃষ্টিকে সাড়া দেওয়ার মতো যাদের মধ্যে একটি সংবেদনশীল হৃদয়ে আছে তাহাদের নিকট হইতে আমি আশা করি আমার সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রতি একটি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধার্ঘ্য"।
এই সমস্ত অনুষ্ঠানে অসুস্থ শরীরেও গুরুদেব দেশ-বিদেশে কেন নিজে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন তার কৈফিয়ৎ স্বরুপে মুক্ত চিঠিতে আরো লেখেন_"একটা কথা আমি স্বীকার করতেছি, আমি নিজে যে সকল শিল্পীদের শিক্ষা দিয়াছি সেই সকল শিল্পী যখন ছন্দ তালে সমন্বিত অঙ্গ সঞ্চালন এবং সুরময় কণ্ঠস্বরে আমার কোন সৌন্দর্যের স্বপ্নকে একটি নিখুঁত রূপ দান করিতে চাহে তখন তাদের পাশে সগর্বে বসে থাকা অপেক্ষা আর অন্য কোনো জিনিসই আমি বেশি ভালোবাসি না। আমি সগর্বে এই জন্য বসে থাকি যেন তাহাদিগকে বলিতে পারি চমৎকার হইয়াছে"।
জাতির জনকশ্রাবণী সেনগুপ্ত
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন কতক পরিমাণ ।গান্ধীজির ঐতিহাসিক ভূমিকার তাৎপর্য্য আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।একথা আজ স্বীকার করতেই হবে যে-স্বাধীনতা দিয়ে বিচার করলে গান্ধীজির ঐতিহাসিক ভুমিকা ভারতের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনাবিশেষ,সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় স্বাধীনতার নেতা হিসেবে তাঁর স্থান আজও অটল।
গান্ধীজির অহিংসা,তাঁর বিকেন্দ্রীকরণ, কুটির শিল্প ইত্যাদির প্রতি বিশেষ বাণী ছাড়াও তিনি যে ভারতের মুক্তি
সংগ্রামের নেতা ছিলেন সেই ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেহেরু বিবৃত করেছেন তাঁর 'Discovery of India 'বইটিতে।
গান্ধীজি শুধু স্বাধীনতার আন্দোলনই সংগঠিত করেন নি,সেইসঙ্গে তিনি হয়তো অজান্তেই সমাজতান্ত্রিক পটভূমিকাও তৈরি করেছিলেন।তিনি নিজেকে হরিজন বা ভাঙ্গি বলে পরিচয় দিতেন।তিনি ছিলেন শ্রেনীহীন সমাজের এক উপাসক।সর্বোদয় সমাজ,শোষণহীন, শ্রেণীহীন সমাজের আদর্শই ছিল তাঁর প্রতিদিনকার জীবনচর্চা।ভারতের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে গান্ধীজি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা অন্দোলনের সম্মিলিত শক্তিসমূহের নেতৃত্ব দিয়েছেন।ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে গান্ধীজির স্থান সর্বাগ্রে।ধনী,বণিক,চাষী,মজুর,নারী-পুরুষ,শিক্ষিত,অশিক্ষিত,বহু শ্রেনী উপশ্রেণীর মানুষজন সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি।নিজের অসামান্য ক্ষমতা ও শক্তির বলেই তাদেরকে প্রায় দুই যুগ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।গান্ধীজির বিভিন্ন লেখাতে তাঁর সত্যকে জানার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছে।তবে তিনি নিজে যা আবিষ্কার করেছেন,প্রত্যয় করেছেন তাকেই অবিনশ্বর ও শেষ সত্য বলে জাহির করতে কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি।তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক।জীবনভর সত্য সন্ধানের পর তিনি সত্য থেকে সত্যতে পৌঁছাতে চেয়েছেন।প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মতো তাঁর মন ছিল সর্বদাই জিজ্ঞাসু, সদাসতর্ক,নতুনকে গ্রহণ করার মতোন সাহসী।সত্যই ছিল তাঁর কাছে ঈশ্বরের মতোন।তাই কোনো সময়েই তিনি নিত্য নতুন সত্যকে গ্রহণ করতে অসমর্থ হননি।তিনি মনে করতেন সত্যকে
আবিষ্কার করা অহিংস পথেই সহজ ও সম্ভব।গান্ধীজির বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্ধবিশ্বাসের কোনো স্থান ছিলনা।উদার দৃষ্টিভঙ্গী তাঁকে সম্পূর্ন আধুনিক করে তুলেছিল।তিনি ভারতের ইতিহাসে spirit ,passion for truth খুঁজে পেয়েছিলেন,তাই তাঁর ভারতবর্ষের প্রতি এত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল।তাই তিনি বারবার বলেছেন যে-তিনি নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করেন যে -ভারত সমগ্র বিপ্লবের আদর্শ লক্ষ্য হতে পারে।
গান্ধীজি একজন সত্য সাধক,মহান পথিক,একজন মহান নেতা।তাঁর অনেক চেষ্টা,অনেক কাজ,অনেক ভাবনা,অনেক দূরদৃষ্টি ও সাধারণ জ্ঞান আমরা তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করব।জীবনের প্রতি,মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার শ্রদ্ধার শক্তি,আর অহিংসার বাণী-যে অহিংসা হল সভ্যতার পরম সুন্দর মূর্তি।নিজেকে তুচ্ছ করে তাঁর অপূর্ব আত্মত্যাগের কাহিনী বিশ্বের কাছে এক অনন্য উদাহরণ। বিশ্ব সভ্যতা ও সাম্যবাদ স্থাপনের পথে তিনি যে জাতীয় অহিংসা,সহনশীলতা ও বিশ্ব প্রেমের মনোবৃত্তি রচনা করতে চেয়েছেন তা আগামী সভ্যতার জনজীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান।গান্ধীজি যে নৈতিক আদর্শের নমুনা
তাঁর নিজের জীবনে ও মরণে দেখিয়ে গেছেন,যা তাঁর দেশব্যাপী সত্যাগ্রহের মধ্যেও সমস্ত জাতির প্রাণে একদিন প্রেরণা জাগিয়েছিল।আজকের এই ভোগবাদের যুগে তাঁর অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায় ।মহান বিশ্ব সভ্যতা গঠনের পথে আজও তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করে অনেক সাধনা ও দুঃখবরণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।তাঁর মতো ব্যক্তি পৃথিবীতে ও ইতিহাসে কদাচিৎ জন্মান।গান্ধীজি আমাদের ঐতিহাসিক শক্তি জুগিয়ে দিয়ে গেছেন।আমাদের নিজেদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছেন,তার মূল্য দিয়েছেন।
মহাত্মা গান্ধী ...কিছু কথা বিপ্লব তালুকদার
অক্টোবর মাস এলেই শারদীয়া উৎসবের ছোঁয়া লেগে যায় ,তারই অন্যতম মহাত্মার জন্মদিন। আজ ২রা অক্টোবর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে দেশজুড়ে চলছে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই নিবন্ধন। উনি কিন্তু শুধু আমাদের দেশের নেতা ছিলেন না,সারা বিশ্ব জুড়ে ছিল ওনার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে ছিলো। তাই তো দেশ তো বটেই বিশ্বের প্রতিটি দেশে ওনার নামে রাস্তা ,স্মৃতি স্মারক,ভবন এবং মূর্তি স্থাপিত আছে। ওনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, আজ একটু ওনার অন্য কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আমরা সবাই জানি নেতাজি গান্ধীজী কে জাতির জনক বলে সম্বোধন করতেন,কবিগুরু ওনাকে মহাত্মা উপাধি দেন,আবার ফ্রাঙ্ক মরিস ওনাকে অর্ধ নগ্ন সাধু বলতেন, উইলসন চার্চিল ওনাকে ফকির বলতেন । গান্ধীজী তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন আমেরিকায় পা রাখেন নি অথচ ওখানে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর অন্যতম অনুরাগী হেনরি ফোর্ড এক সাংবাদিকের হাত দিয়ে তাঁকে সুতা কাটার একটি চরকা উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম শিক্ষক একজন আইরিশ থাকার দরুন তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে আইরিশ টান ছিলো।
বাপুজি ছোটবেলায় খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন, স্কুল ছুটির পর দৌড়ে সোজা বাড়ি চলে আসতেন। বন্ধুদের সাথে একদম মিশতে পারতেন না, লজ্জায় কোনো কথাই মুখে আসতো না যাঁর তিনি কি করে বন্ধু বানাবেন! লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসেও তিনি সেই মুখচোরা ছিলেন। ওকালতি ব্যবসায় পসার ছিলোনা, হবে কি করে ---আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর যে হাতপা কাঁপতে থাকতো। বিপক্ষের উকিল কিছু বললে উনি আমতা আমতা করতেন কোনো উত্তর দিতে পারতেন না। এমন উকিলকে কে নেবে......অগত্যা তিনি চললেন দক্ষিণ আফ্রিকা।
খাওয়ার ব্যাপারে উনি ছিলেন একদম শাকাহারি, নুন ছাড়া খাবার খেতে ভালোবাসতেন। যদিও পরে ডাক্তারের পরামর্শে নুন খেতে শুরু করেন। "দ্য মরাল বেসিস অফ ভেজিটেরিয়ানিজম" বইয়ে ওনার খাদ্যাভ্যাসের আরো একটি ছবি উঠে আসে,উনি একটানা ছয় বছর দুধ খান নি। চিনি ছাড়া কাঁচা রান্না পছন্দ করতেন। জল ও আগুন ছাড়া যে খাবার তৈরি হতো সে রকম খাবার পছন্দ করতেন। ছোট থাকতে একবার পরীক্ষামূলক ভাবে মাংস খান,যদিও এটা তাঁর কৌতুহল মেটানোর জন্য হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ নিরামিষ ভোজন কারী।
গান্ধীজী মাত্র তেরো বছর বয়সে কস্তুরবাকে বিবাহ করেন। এরপর আটত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি চার সন্তানের পিতা তখন তিনি ব্রহ্মচর্য জীবন শুরু করেন। এক সময় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আধ্যাত্মিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল।
স্বাধীনতা ও গান্ধীজী
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"The withdrawal of British rule from India was a Supreme act to the realization of which I must devote my whole energy . " ১৯৪২ সালের ৩১ শে মে "হরিজন " পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যার এই প্রত্যয়ের কথা ঘোষিত হয়েছিল, তার সম্পর্কে আইনষ্টাইন বলেছিলেন, " Generation to come will scare believe that such a one as this ever in flesh and blood walked upon this earth." আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বাস করতে চাইবে না, যে রক্তমাংসের এমন একজন মহাপ্রাণ এই পৃথিবীতে একদা হেঁটে চলে বেড়িয়েছেন।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একজন অতি সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ এবং সর্বপরি মহাত্মা হয়ে উঠেছিলেন, তার ভিত্তিভূমি ছিল সত্য, অহিংস এবং তাঁর জীবন দর্শন। কবি বলেছেন ঃ
"সত্য যে কঠিন
কঠিন রে ভালোবাসিলাম
যে কখনও করেনা বঞ্চনা।
"My experiments with truth" গ্রন্থটি তার জীবনের এক দলিল বিশেষ। তিনি গোটা সমাজব্যবস্থাকে একসুত্রে গেঁথেছিলেন। ভারতবাসীদের দু, দুটো দূর্বলতাকে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। নিরন্ন ভারতবাসীদের অনশণ সত্যাগ্রহ এবং নিরস্ত্র ভারতীয়দের অহিংস আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত ও একতাবদ্ধ করেছিলেন। তিনি কখনোই দেশভাগের পক্ষে ছিলেন না। তিনি তার প্রাণ দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "You can cut me into two, but Don't divide India. "
ববহুত্ববাদ ভারতের গনতন্ত্রের মূল ভিত্তিভূমি, সাম্প্রদায়িক রেষারেষিতে তা আজ কোনঠাসা। সারাবিশ্ব জুড়ে যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অসহনশীলতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে, গান্ধীর জীবন দর্শন ও গান্ধীবাদ আজ খুবই প্রাসঙ্গিক। সারা বিশ্বের এই মহান নেতাকে তাঁর জন্মদিনে প্রণাম জানাই।
গান্ধীজীর মূলনীতি ‘অহিংসা’ আজও অনুসরণীয়
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
মানব ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে যারা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়ে সংস্কারমূলক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিতায় ভারতে জন্ম নিয়েছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। যাঁর মূলধন ছিল অহিংসা ও সত্য।
অহিংসা একটি নৈতিকতত্ত্ব। অহিংসার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতে। জৈনধর্মের সঙ্গে এর বিশেষ সংযুক্তি হলেও বৌদ্ধধর্মে এর অনুশীলন বেশি। সকল জীবের প্রতি অহিংসা প্রদর্শনের ধারণাটি জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে। জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতায় সকল জীবের প্রতি করুণা ও ক্ষতি না করার বিষয়টি অনন্য এবং পশুবলির প্রাচীন বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ জৈন ও বৌদ্ধ নৈতিকতার উৎপত্তি। এক কথায় অহিংসার অর্থ হলঃ সকল প্রাণী সুখী হোক। আধুনিককালে মহাত্মা গান্ধী অহিংসার রূপকার হিসেবে সর্বজনবিদিত। মহাত্মা গান্ধী অহিংসার ধারণার মধ্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংসাকে একটি সক্ষম ফলপ্রসূ রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে যেখানে সাধারণত সহিংসতা এবং প্রচুর অস্ত্র ব্যবহৃত হতো, সেখানে মহাত্মা গান্ধী অহিংসাকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশ শাসকদের শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় করার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল আবিষ্কার করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
ছোটদের গান্ধী
তানভী দাম
অদ্রিজা বোস
সুজল সূত্রধর
No comments:
Post a Comment