গ্রন্থ আলোচনা
কাব্যগ্রন্থ- দাম্পত্যের রাত্রিজল
কবি- মৌমিতা পাল
প্রকাশক- ধানসিড়ি
মূল্য- ৯৫ টাকা
আলোচক- শৌভিক রায়
উদীয়মান কবি হিসেবে যিনি ইতিমধ্যেই 'নার্গিস পুরস্কার`-সহ একাধিক পুরস্কারে ভূষিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ নিয়ে নতুন করে কিছু বলবার থাকে না। ঊনপঞ্চাশটি কবিতা মলাটবন্দি হয়েছে কবি মৌমিতা পালের 'দাম্পত্যের রাত্রিজল' কাব্যগ্রন্থে আর প্রতিটি কবিতাই নিজের মতো কবিতা হয়ে উঠেছে। এখানেই কাব্যগ্রন্থটির সার্থকতা। কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে কখনই একঘেয়েমি লাগে না। বরং পাঠ যত এগোয় তত যেন পাঠকের সামনে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হতে থাকে কবির নিজস্ব অনুভূতি যাতে মাখামাখি হয়ে যায় ''চু কিত্ কিত্ খেলতে গিয়ে মধ্যপদের 'যা ভাগ!'' আর ''...প্রিয় শরীরের কবলে/ ক্ষমাহীন স্বকাল''।
অসম্ভব সব শব্দ সাজিয়েছেন কবি মৌমিতা পাল তাঁর কবিতাগুলিতে। কবিতা যদি হয় শব্দচয়ন, তবে তাতে সার্থক কবি মৌমিতা পাল। পড়তে পড়তে মনে হবে যে, শব্দ নিয়ে তাঁর এই অনায়াস খেলা সহজাত। এখানে বোধহয় প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর বাংলা বিষয় নিয়ে পড়া ভীষণভাবে সাহায্য করেছে, যদিও এটি একেবারেই ব্যক্তিগত অনুমান। আসলে 'বিম্ববতী পদ্মকাঁথায় সময় মুড়ে ঘুমায়।/ জ্ঞানশক্তিকে শূন্যে চুমু খায়' জাতীয় বাক্যে কবির বিষয়ের ওপর গভীর পড়াশোনাই প্রকাশ করে। পাশাপাশি 'ন্যাকামোর ভাবভঙ্গি বড়ো সৃজনশীল/ (মনে মনে যদিও বজ্জাত)/ প্রেমতত্বে পিদিম জ্বালিয়ে নাও/ লাগলে তুক না লাগলে থাক!' প্রমান করে যে, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে কম শেখায় নি! 'সোঁতকাল', 'কবন্ধ্যাসীমা', 'ডারউইনের ডাকবাক্স`, 'যৌথ খামার', 'নিখোঁজ চিবুক` ইত্যাদি প্রতিটি কবিতার নামকরণে যে চমক, পংক্তিতে পংক্তিতেও সেই চমক। প্রতিটি পাঠ পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। আধুনিক কবিতা যে রহস্যময় বৌদ্ধিক প্রয়োগ ও আবেগের সংমিশ্রনে এক নতুন ভুবনে পাঠককে উন্নীত করে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই কবিতাগুলি। পিছিয়ে নেই অন্যান্য কবিতাগুলিও। দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরী করে সেগুলিও যখন পড়া যায়- ''ফিরতি পথে লুকিয়ে রেখেছি সমুদ্র-উন্মাদকে।/ বুকের ভেতর মাটি মাটি ঢেউ তুলে/ সে জানান দেয় 'আমি আছি`` অথবা 'রাগি পুরুষকে কাছে টেনে চুমু খেলে/ তার ঘেন্না ছুড়ে দেওয়া হয় ফুৎকারে/ এসব ছলনা আসলে সৃজন/ কুম্ভকার মেয়ে তার সৃজন ভোলে না কখনও'। যে কবিতার নামে কাব্যগ্রন্থের নাম সেই 'দাম্পত্যের রাত্রিজল` পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ব্যক্তিগত কথন কবির নিজের অজান্তেই সার্বজনীনতা ও বহুমাত্রিকতা স্পর্শ করেছে। এই উচ্চারণ জীবন সম্পর্কে প্রগাঢ় বোধ না থাকলে আসবার কথা নয়। খুব কম বয়সে কবি তা অর্জন করেছেন বুঝে ভাল লাগল। আসলে যিনি 'সুফি প্রেমে নিজেকেই খুন` করেছেন তাঁর কাছে এটাই প্রত্যাশিত। ভণ্ডামিহীন টানটান শাণিত বাক্যবন্ধ আর ঋজু চলন...কবি মৌমিতা পালের কবিতা-যাপন।
কাব্যগ্রন্থের মুদ্রণ, কাগজ ও প্রচ্ছদ মনোগ্রাহী। কবিতাগুলির মতোই ঝকঝকে স্মার্ট প্রচ্ছদ এঁকেছেন সেঁজুতি বন্দোপাধ্যায়। কবি মৌমিতা পালের কিছু কবিতায় যেভাবে যৌনতা খেলা করেছে তার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে প্রচ্ছদ ছবি। মলাটে বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের ছোট্ট ও শক্তিশালী ভূমিকা কাব্যগ্রন্থটিকে নিঃসন্দেহে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কবি মৌমিতা পালের কাব্যগ্রন্থ আসলে সময়ের সঙ্গে কবির নিজস্ব আলাপচারিতা আর তা এমন একটি স্তর অতিক্রম করেছে যেখানে পাঠক নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন কবিতার বাক্যের মধ্যে। তবে শেষ কথা কবি ও পাঠকের একান্ত নিজস্বই থাকবে কেননা 'সব সত্যি বলতে নেই/ স্বীকারোক্তি দিলে কবিতার স্বাধীনতা নষ্ট হয়'।
No comments:
Post a Comment