Saturday, January 23, 2021

 মুজনাই 

নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ বসু ১২৫তম জন্মজয়ন্তী 
বিশেষ সংখ্যা  

তাঁর জন্যই এই পাওয়া 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

গৌতম চক্রবর্তী, আফতাব হোসেন, অদিতি মুখার্জি (সেনগুপ্ত), স্বপন কুমার দত্ত,
মৌসুমী চৌধুরী, মাথুর দাস, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, বিপ্লব গোস্বামী,
সুস্মিতা পাল কুন্ডু, উমা শংকর রায়, রীনা মজুমদার,
পার্থ সারথি চক্রবর্তী, বিজয় বর্মন, রীতা মোদক 

প্রচ্ছদ শিল্পী- 
পরেশ সাগ্নিক বেরা 

প্রকাশক- রীনা সাহা 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- 
শৌভিক রায় 



মুজনাই সাপ্তাহিক 
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১২৫তম জন্মজয়ন্তী   
বিশেষ সংখ্যা 



স্বাধীনতা-সংগ্রামের ক্রান্তিলগ্নে জলপাইগুড়িতে আগমন

সুভাষের

গৌতম চক্রবর্তী


টাউন স্টেশনে সুভাষচন্দ্র

১৯৩৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। সকাল ৮-৪১ মিনিট। দার্জিলিং মেল টাউন স্টেশনে এসে থামল বেজে উঠল ব্যান্ডপার্টি। দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের আওয়াজে মুখরিত হল চারিদিক। মহিলাদের কন্ঠে শুরু হলো শঙ্খধ্বনি এবং উলুধ্বনি চারিদিকে মুখরিত হলো বন্দেমাতরম ধ্বনি। বৃষ্টির মধ্যেই জলপাইগুড়ি শহরে নামলেন সুভাষচন্দ্র বসুতিনি তখন ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র এবং জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাই জলপাইগুড়িতে সুভাষচন্দ্র এলেন কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করতে। তিনি তখনো নেতাজী হন নি। তবুও তাঁর আদর্শ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল জলপাইগুড়ি জেলার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, গোর্খা, নেপালী, বাঙালি সহ অন্যান্য অধিবাসীরাবাংলার গর্ব সুভাষচন্দ্রকে সম্মান জানাতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জনগণ আবেগতাড়িত হয়ে ছুটে এলেন জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে টাউন স্টেশন এর কাছে তৎকালীন বোদা রোডের পাশে জলপাইগুড়ি পুরসভার পক্ষ থেকে সম্মেলনের জন্য ৩০ বিঘা জমি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল পুরসভা শহরে এবং সম্মেলন স্থলে পানীয় জলের বন্দোবস্ত করেছিল শহরে নির্মিত হয়েছিল তোরণ। সুভাষচন্দ্রের আগমন উপলক্ষে বৈদ্যুতিক আলোতে চারিদিক হয়ে উঠেছিল ঝলমলে। জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেসের সভাপতি চারুচন্দ্র সান্যাল এবং বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত নেতাজিকে মাল্যদান করেছিলেন

পান্ডাপাড়ার সম্মেলনের প্রধান অতিথি সুভাষ

জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়াতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু এবং প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুএই সম্মেলন উপলক্ষে ব্যাপক জনসমাগম হয়পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্র-যুবরাও এই সম্মেলনকে ঘিরে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। বেশ কিছু যুবক আলিপুরদুয়ার শহর থেকে সাইকেলে করে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতা শোনার জন্য সুভাষচন্দ্রের দৃপ্ত ভাষণে জলপাইগুড়ির জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মাদনা দেখা দিলবঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের ভাষণে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ছাড়ো প্রস্তাবের স্বপক্ষে তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্য পেশ করেন। ভারতের ইতিহাসে প্রথম ইংরেজ ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গৃহীত হলো জলপাইগুড়ি শহরের বুকেই পরবর্তীকালে এই আওয়াজকে সঙ্গী করে জাতীয় কংগ্রেসের ডাকে ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলসম্মেলন চলাকালীন খবর আসে পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র বসু নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেনএই সম্মেলন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ঘোষিত হয়জলপাইগুড়িতে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি সর্বপ্রথম জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ দাবি করেছিলএই সম্মেলনে বাংলার সকল প্রগতিশীল সংগঠনের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল যাতে কৃষকদের সকল প্রকার ক্ষোভের কথা বিভিন্ন কমিশনের কাছে পেশ করা হয়

আপোষহীন লড়াই শুরু সুভাষের আহ্বানেই

আলিপুরদুয়ারের অধিকাংশ কংগ্রেসী জলপাইগুড়ির সম্মেলনে সুভাষচন্দ্রকে জানালেন কংগ্রেসের নিয়মতান্ত্রিক নীতির প্রতি তাদের অনাস্থার কথা তিনি তখন তাঁদেরকে কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেনসুভাষের আহ্বানে আপসহীন সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হল তিস্তা থেকে সংকো পর্যন্ত এলাকায় শুরু হল প্রস্তুতি। জেলা কংগ্রেসের একটা অংশ যেমন হিন্দু মহাসভার রাজনীতির সমর্থক ছিলেন তেমনি আর একটা অংশ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে ছিলেন। অবশ্য ১৯৪৬ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক মতাদর্শগত কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক মার্ক্সিস্ট দল গঠন করেসেই সময় জেলা কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির মধ্য থেকে জেলা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। কঠোর পুলিশি সন্ত্রাসে সারাদেশের সঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলাতেও ছাত্র আন্দোলনের আগুন ধূমায়িত হলশুরু হল বিভিন্ন রাজনৈতিক ধরপাকড় একদিকে কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধের শ্লোগান, অন্যদিকে হিব্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক প্রচার, পাড়ায় পাড়ায় শান্তিসেনা গড়ে তোলা, শান্তি মিছিল করা ইত্যাদি তখন ফরওয়ার্ড ব্লকের যুবকদের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে লাগল। সেই সময় কংগ্রেস পরিচালিত কৃষক আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বেও শুরু হয় তেভাগা আন্দোলন যার বীজ বপন হয়েছিল জলপাইগুড়িতেই।



নেতা
আফতাব হোসেন


১৯৯৮ পোখরান ।
অটল বিহারী বাজপেয়ি ক্ষমতায় ।

স্মাইলিং বুদ্ধ বা পোখরান ১ পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল । কিন্তু এটা ছিল অসম্পূর্ন । তাই দরকার ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ পারমানবিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করা ।কারন ঘাড়ের উপর চীনের বিষবাষ্প ঘন হচ্ছিল ।স্মাইলিং বুদ্ধ সাফল্যে পরবর্তীতে বড় কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন না হলেও  এনএসজি (নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ারস গ্রুপ) কর্তৃক কঠিন প্রাযুক্তিক অবরোধের মুখে পড়েছিল ভারত। আর এ কারণে পোখরান-১ এর পর ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পের অগ্রগতি স্লথ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বারংবার আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে হয় যে, ভারত পারমাণবিক পরীক্ষা সামরিক উদ্দেশ্যে করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না ! কিন্তু
বাধ সাধলেন চারজন ডেয়ার ডেভিল…
ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল রেজিমেন্টের প্রধান কর্নেল গোপাল কৌশিক, ‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ তথা DRDO এর পরিচালক ড. আবদুল কালাম এবং ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি’ বা ডিএইর প্রধান আর. চিদাম্বারাম, এনাদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে মার্কিন স্যাটেলাইটের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে পোখরান 2 নেয়ার পরিকল্পনা তৈরি করলেন অটল বিহারী বাজপেয়ি,যিনি মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ।এই পরিকল্পনা এতটা গোপন ছিল যে, ভারত সরকারের অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এ সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু এখানেও বাধ সাধেন সাধের মার্কিনিরা । পাকিস্তানের সাথে সাথ দিয়ে শোনা যায় হোয়াইট হাউস থেকে নাকি হুমকি দেওয়া হয়  যে এই পোখরান 2 হলে নাকি পাকিস্তান ভারতের ওপর পরমাণু হামলা করতে পারে আর তাতে মার্কিনী দের সায় থাকবে …

শোনা যায় অটলবিহারী বাজপেয়ি দুটো ফোন করেছিলেন
একটা ওয়াশিংটনে …
উওর দিয়েছিলেন - " জানি না পড়শী দেশ আমাদের ওপর হামলা করলে কি হবে…
কিন্তু আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন ওরা  আজ রাতে হামলা করলে কাল সকালে পৃথিবীর মানচিত্রে ওই দেশটা থাকবে না,"

আর দ্বিতীয় ফোনটা ছিল ডক্টর কালামকে : লেটস স্টার্ট …

রক্ত গরম হল ?

বাজপেয়ী জির স্পর্ধার উৎস খুঁজবেন না ?

চলুন
আর একটু পিছিয়ে যাই …

কংগ্রেস আমল …
ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় …

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যারপনায় ক্ষুব্ধ ছিলেন.. পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিক্সন বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ একটি ‘বাজে নজির’ স্থাপন করবে এবং ছোট দেশগুলোর ভবিষ্যত ঝুঁকির মুখে ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজের দেশের আইন লংঘন হবে জেনেও মুক্তিকামী বাঙালিদের দমনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমরাস্ত্র যুগিয়েছিলেন । নিক্সন তখন বলেছিলেন, “ভারত যতই বড় এবং যতই গণতান্ত্রিক দেশ হোক না কেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে তারা যদি প্রতিবেশী কোনো দেশে আগ্রাসন চালায়, বিশ্বের সব ছোট দেশের ভবিষ্যতই হুমকির মুখে পড়বে।”
ওনাদের সরাসরি প্রেস বিবৃতি ছিল " আমরা জাতিসংঘে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধিতা করেছি। তাছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা নারীরা বিপজ্জনক। ভারত ও ইসরায়েল দুই দেশই নারীর নেতৃত্বে যুদ্ধে নেমেছে।”  

এ সব শুনে  ইন্দিরা গান্ধীর মুচকি হেসেছিলেন আর তার কিছুদিন পর "স্বাধীন বাংলাদেশের" প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ।

আরো একটু রক্ত গরম হল জানি …
খুঁজবেন না এই শীতল নারী সাহসের পূর্বজ কে ?

 কল্পনা করুন কিন্তু এমনটা হতেই পারে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বসে মাননীয়া গান্ধী আর মাননীয় বাজপেয়ি জি যখন এইসব জটিল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তখন হয়ত PMO অফিসের ঘরটায় দেওয়ালে একটা আঙ্গুল উঁচিয়ে থাকা খাঁকি ইউনিফর্মের লোকটার ফটো টা দেখছেন আমাদের দেশপ্রধানেরা । 
ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে কদম কদম বাড়ায়ে যা…
শুনছেন কোন এক আগস্ট মাসের কাহিনী । সেই ১৯৪৫ সালের …
কোন এক হাসপাতাল…
ডাক্তার ইয়োশিমির on duty…
তিনি বর্ণনা করেছেন 
-"তার চোখগুলো ফুলে গিয়েছিল। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। জ্বর ছিল গায়ে, ১০২.২ ডিগ্রি। পালস রেট হয়ে গিয়েছিল প্রতি মিনিটে ১২০। তাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য বিটা-ক্যাম্ফোর-এর চারটে আর দুটো ডিজিটামাইন ইনজেকশন দিয়েছিলাম। তারপরে ড্রিপ চালু করি। এছাড়া সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য সালফানামাইড ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝতেই পারছিলাম, এত কিছুর পরেও উনি হয়ত আর বেশিক্ষণ জীবিত থাকবেন না।"
হাসপাতালেই হাজির ছিলেন আরেক চিকিৎসক ডাক্তার ইয়োশিও ইশি। 
ওনার কথায় -"একটা বিষয় আমাকে বেশ অবাক করেছিল। পাশের ঘরে দুর্ঘটনায় আহত জাপানি সৈনিকরা ব্যথায় চিৎকার করছিল, কিন্তু ওনার থেকে একটা শব্দও বের হয়নি। অথচ আমি ডাক্তার হিসাবে বুঝতে পারছিলাম তার কতটা শারীরিক কষ্ট হচ্ছে," জানিয়েছিলেন ডাক্তার ইশি।
ওই অবস্থাতেও ওনার শেষ কয়েকটা কথা ছিল - -"হাবিবুর ইয়ে সর নহি ঝুঁকনা চাহিয়ে "।


চিনতে পারলেন ?
স্পর্ধার পূর্বজ কে ?
নারিশক্তির স্রষ্টা কে ?

চিনতে পারলেন , নেতা কে ?



খাদ্যরসিক নেতাজি 

অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত )

আমার আদর্শ নেতাজির সম্পর্কে লিখতে সাগরসম কালিও আমার মনে হয় কম পড়বে। শৈশব থেকেই মাতৃভূমির প্রতি ছিল তার অগাধ প্রেম। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর সাথে - সাথে খাদ্যরসিক হিসাবেও ওনার একটা পরিচয় আছে। 

আমরা সকলেই জানি প্রত্যেক বাঙ্গালীই ভ্রমণ পিপাসু এবং খাদ্যরসিক। নেতাজী বাঙালী খাবার খুউব পছন্দ করতেন। ডাল-ভাত, লুচি, কলা আর দৈ তাঁর প্রিয় খাদ্য তালিকার মধ্য ছিল। তিনি খিচুড়ি, ভাতে-ভাত ও মুগডাল ও পছন্দ করতেন। খাবারের ক্ষেত্রে তাঁর পছন্দ ছিল খুব সাধারণ এবং সেরকম বাছবিচার ছিলনা। মিষ্টির মধ্য তিনি রসগোল্লা, চমচম,  পিঠে-পুলি খুউব পছন্দ করতেন। ওনার খাবারের জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময় ছিলনা। তিনি লেবুর শরবত খেতে খুব ভালোবাসতেন। 

চা ওনার এতটাই প্রিয় ছিল যে দিনে বিশ থেকে তিরিশ কাপ চা ছিল ওনার স্বাভাবিক কোটা। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন উনি কফির আশক্ত হয়েছিলেন। তিনি সকাল থেকে রাত অবধি সুপারি চিবোতে ভালবাসতেন। পরবর্তী কালে তিনি দুপুরের খাবারের পরে সুপারির বদলে হরীতকী খাওয়া শুরু  করেন। 

তিনি গ্রাম্য পরিবেশ খুউব ভালবাসতেন, এবং গ্রামের খাবার, বিশেষত নারকেলের তৈরি খাবার যেমন মনোহরা, নারকেলের নারু,  ছাতুর বর্ফি খুব পছন্দ করতেন। মুরির মোয়া, তিলের নারু, তিলের চাক্তি ও তার খুউব প্রিয় ছিল। এই থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে আমার আদর্শ নেতাজি আদ্যপ্রান্ত বাঙালী ছিলেন।



নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
    স্বপন কুমার দত্ত

         ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রত্নগর্ভা ভারতমাতার যে বীর সন্তানেরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য " মনে করে বীরদর্পে অংশগ্রহণ করে ছিলেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তাদের মধ্যে সেরা আইকন --- এ ব্যাপারে কারোরই কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। আজন্ম নির্ভীক, সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপরায়ন, পরোপকারী ইত্যাদি কোন বিশেষণই সুভাষের জন্য যথেষ্ট নয়।
             
           ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর অবদান প্রশংসাতীতভাবে সত্য। বার্মার মান্দালয় জেল থেকে অসুস্থ সুভাষকে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। প্রবল প্রতাপশালী ইংরাজ সরকারের সুচতুর গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের ঘেরাটোপের জাল কেটে তিনি যেভাবে অন্তর্হিত হন, তা আজও দেশবাসীকে বিস্মিত করে। তিনি এটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে, গান্ধীজির নরম পন্থা অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলন করে ইংরাজ সরকারের গদি টলানো অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা অসম্ভব বটে। তাই এদেশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধ শক্তির সাহায্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে ফেলতে হবে।

            ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারি গভীর রাত্রে পাঠানের বেশ ধারণ করে সুভাষ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির বসুকে নিয়ে তদানীন্তন বিহারের গোমো স্টেশনে পৌঁছন। সেখান থেকে আব্বেহারের সাহায্য নিয়ে পৌঁছন পেশোয়ার।১৯৪১ সালের ২৬ শে জানুয়ারী রাশিয়া পৌঁছানোর জন্য নেতাজী তাঁর যাত্রা শুরু করেন। আগা খানের সমর্থকেরা তাঁকে আফগানিস্থানের সীমান্ত পার হতে সহায়তা করে। এভাবে সুভাষ কাবুল হয়ে পৌঁছন সোভিয়েত রাশিয়ায়।

          মস্কোয় জার্মান অ্যাম্বাসেডরের সহায়তায় সেখান থেকে তিনি পোঁছে যান রোম। তারপর সেখান থেকে পৌঁছন জার্মানি। জার্মানিতে পৌঁছে "স্পেশাল ব্যুরো ফর ইন্ডিয়া"-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন, যারা আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত ছিল। নেতাজী বার্লিনে "ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার" প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হতে ৪৫০০ জন সৈনিকদের নিয়ে "ইন্ডিয়ান লিজিয়ন" গঠন করেন। ইতিমধ্যে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। জার্মান তখন ইংরাজ বিরোধী শক্তি হিসেবে সুপরিচিত। ইন্ডিয়ান লিজিয়নের সকল সদস্যেদের উপস্থিতিতে হিটলার ও সুভাষ বসুর মধ্যে নিম্নলিখিত মর্মে একটি চুক্তি হয়, 
"আমরা ঈশ্বরের নামে পবিত্র শপথ গ্রহণ
করছি যে জার্মান রাষ্ট্রের নেতা ও রাষ্ট্রের সকল
নিয়মকানুন মানিয়া চলিব।" 
বিনিময়ে জার্মান সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা অ্যাডলফ হিটলার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী সুভাষকে সর্বত ভাবে সাহায্য করবেন।

           এরপর সুভাষ হামবুর্গে ইন্দো-জার্মান মৈত্রী সমিতি তৈরী করে ভবিষ্যত কর্মপন্থার খসড়া তৈরি করেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন নেতাজী। পরিচিত হলেন সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে। ব্যাংককে জনসভায় ভাষণ দিলেন নেতাজী। সিঙ্গাপুর রেডিও থেকে দিলেন প্রথম বেতার ভাষণ।এরপর গ্রহণ করলেন সেনাবাহিনীর অভিনন্দন। সর্বাধিনায়ক নেতাজী ঘোষণা করেন, "চল দিল্লি, চল দিল্লি",। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নেতাজী। ব্রিটিশের
বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছেন আপোষহীন সংগ্রামের। গঠন করেন মহিলাদের নিয়ে রাণী ঝাঁসি বাহিনী। 

এবার যুদ্ধ ঘোষণা। ইতিমধ্যে ইম্ফলে পৌঁছে গেছে আজাদ হিন্দ বাহিনী। তিরধনুক থেকে মেশিনগান কিছুই বাদ নেই। শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আজাদী সৈনিক। রাতের অন্ধকারের মধ্যেও চলেছে আজাদ কনভয়। প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ, সামরিক বল কম থাকায় তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। ইম্ফলে পৌঁছে ওড়ালেন ভারতের জাতীয় পতাকা। কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা মিত্রপক্ষের কাছ থেকে না পাওয়ায় খাদ্য, জল কষ্টের কারণে পেছনে হঠতে বাধ্য হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নেতাজী সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এই স্বাধীনতা যুদ্ধের।

            নেতাজীর এই অদম্য প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ না করলেও প্রভাবশালী ইংরাজ সরকারকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে বাধ্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংরেজরা এমনিতেই ছিল ব্যতিব্যস্ত। তার উপর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর এই হুংকার ইংরেজদের ভীতির কারণ হওয়ায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনঅনেক খানি পরিপুষ্টি লাভ করে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাই নেতাজীর অবদান অনস্বীকার্য।



ফুলেশ্বরীর স্বাধীনতা 
         মৌসুমী চৌধুরী

         চটপট তৈরি হয়ে নিচ্ছিল ফুলেশ্বরী। সাতটা দশের শিয়ালদহ লোকালটা ধরতেই হবে তাকে। ভেতর ঘর থেকে শাশুড়ি চিৎকার করছেন,
-" আইজ না হয় না-ই গেলি। পোলা-মাইয়াডার ইস্কুল ছুটি। তরে একটু পাওনের লাইগ্যা এক্কে- রে ছটফটায় বাচ্চাদুইডা।"
- " না মা, আজ যেতেই হবে। আজ ছুটির দিন বলেই তো আমাদের ওভার-ডিউটি করতে হয়। ওসব তুমি বুঝবে না।" 
         কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে দৌড় লাগায় ফুলেশ্বরী। যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে যায়,
--" চুমকি আর রাজুকে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিও। আজ ওদের জিলিপি আর বিস্কুট দেবে।" 
     ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি পুলক নস্কর। তাদের গাঁয়ের পঞ্চায়েত মেম্বারের চ্যালা। সব সময় তার পেছনে ছুঁকছুক করছে। শকুন নজরে ফুলেশ্বরীকে জরিপ করে পুলক বলল,
-- "আজও কাজে যাবি রে, ফুলি। আজ ২৩ শে জানুয়ারি না? বড় বড় নেতারা আসবেন আমাদের গাঁয়ের ইস্কুল মাঠে। তাঁরা তোদের দুয়োরে আসবেন, তোদের অভাব অভিযোগ শুনবেন।"
     শুনে মটকা গরম হয়ে যায় ফুলেশ্বরীর। মুখ ঝমটে  বলে,
--" তা পাঁচ বছর আমাদের দুঃখের কথা মনে পড়ে নি যখন, এখন আর কেন?"
       দাঁত কিড়মিড় করে পুলক নস্কর বলে,
-" এত দেমাক ভালো নয় রে, ফুলি। তোর এই বাড়বাড়ন্ত কিসের জন্যি সব আমি জানি।"
        ফুলেশ্বরীও বলতে ছাড়ে না,
-"নেতা দর্শণে তোমরা পেট ভরাও। আমার
খেটে খাওয়ার কপাল। তাই চললুম খাটতে।"
     প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে ট্রেনটা ধরে ফুলেশ্বরী। তাদের গ্রাম থেকে চম্পাহাটি স্টেশনটা প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে।
 আজ ডেইলি প্যাসেঞ্জারেরা অনেকেই নেই। মহিলা কামরাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। ফুলওয়া- লি বিনতা মাসী তাকে দেখে হাসল একটু। জালানার ধারে একটা সিট পেয়ে গেল সে। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল ক্লান্ত  ফুলেশ্বরী।
         সকাল থেকে ওঠা ইস্তক পা দু'খানাকে তো একেবারে বিশ্রাম দিতে পারে না! খুব ভোর ভোর উঠেই শুরু হয়ে যায় গৃহস্থালির কাজকর্ম। গরুদুটিকে জাবনা দিয়ে হাঁস মুরগিগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দেয়। বাতে পঙ্গু শাশুড়িকে নাইয়ে ধুইয়ে পরিষ্কার করে খেতে দেয়। ছেলে-মেয়ে দুটিকে ডেকে তুলে দেয়। ওরা টিউশন পড়তে যায়। তারপর সে রান্না চাপায়। রান্না করে সবকিছু গুছিয়ে রেখে নিজের খাবারটা বেঁধে নিয়ে আসে। বাইরের কেনা খাবার সে খায় না। তাতে শরীর থাকে না, আবার পয়সাও অনেক বেশি খরচ হয়।
         বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামে। গায়ে কাঁটা দেওয়া সব দেশাত্মবোধক গান কানে আসতে থাকে ফুলেশ্বরীর। স্কুলের কথা মনেপড়ে তার।  এই দিনটা বেশ সমারোহপূর্ণভাবে পালিত হত তাদের স্কুলে। মাষ্টারমশাইদের মুখে শুনেছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের কথা, দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কত কথা। পড়াশোনায় মোটামুটি হলেও পড়া বেশিদূর হয় নি তার। পাঁচবোনের মধ্যে সে ছিল সেজো। সুকুমারকে ভালোবেসে যখন সে সংসারে ঢোকে তখন তার বয়স মাত্র ষোল বছর...তা-র-প-র জীবন তাকে ক্ষমা করে নি। তার হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য পুরোটাই নিঙড়ে ছিবড়ে করেছে তাকে।
          ট্রেন যাদবপুর স্টেশনে ঢুকতেই কানে আসে গানের কলি, "এদেশ তোমার দেশ, এদেশ আমার দেশ/ উত্তরে কাশ্মীর, দক্ষিণে কেরালা..."। কেরালা নামটি শুনেই যেন বুকের
মাঝে হাজার হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে ফুলেশ্বরীর। কেলারায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে সেখান থেকে আর ফেরে নি সুকুমার। সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে সেখানে -ই থিতু হয়েছে। তখন চুমকির বয়স আট আর রাজুর পাঁচ। তারপরই দাঁতে দাঁত চেপে জীবনযুদ্ধ শুরু হল ফুলেশ্বরীর। চুমকি আর রাজুকে যে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলতেই হবে। কিন্তু সে পথেও বিস্তর কাঁটা! একদিন কাজ দেবার নাম করে তাদের পাড়ার পল্টু তাকে এনে ঢোকালো এক বাবুর বাড়িতে। সেই বাবুর  কাজের লোক নয় দরকার ছিল শরীরী খিদে মেটাবার মেয়ে -মানুষ। তখন থেকে ফুলেশ্বরীর জীবন বয়ে চলল সেই খাতেই...
            খুব গোপনে চার বছর ধরে কাজটি করে যাচ্ছে ফুলেশ্বরী। ছেলে-মেয়ে, শাশুড়ি বা পাড়া-প্রতিবেশি কেউ জানে না আসলে সে কি কাজ করে। এখন রোজ চম্পাহাটি থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে নামে ফুলেশ্বরী। কাছেই বিশেষ এলাকায় একটা ঘর নেওয়া আছে। সেখানেই সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত  দেহ পসরা সাজায় সে। এখানে তার নাম জুলি। এই বাজারে তার ডাগর শরীরটার দাম বেশ ভালই। কেন কে জানে তার খদ্দেররাও বেশ সম্ভ্রান্ত। বেশির ভাগই শুধু শরীরী সুখ পেতে নয়, মনের জ্বালা জুড়োতেও যেন তার কাছে আসে!
          সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ঘরে ঢুকে গেল ফুলেশ্বরী। কিছু খেয়ে নিয়ে সাজগোজ সেরে নিল। মানানসই মেকআপ করল মুখে, ডালিম রঙে রাঙিয়ে নিল ঠোঁট। তার গমরঙা ত্বক চকচক করে আজকাল। রূপচর্চায় শরীরকে বড় যত্নে রাখে সে। এটাই যে তার স্বপ্নপূরণের হাতিহার। সাজগোজ কমপ্লিট হলে আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয় ফুলেশ্বরী। আজ দত্তবাবুর আসবার কথা। আজ তাঁর ছুটির দিন যে। দত্তবাবু তার বাঁধা খদ্দের। অন্য কারও কাছে যান না তিনি। ছুটির দিনগুলো তার ঘরেই কাটান। বেলা গড়িয়ে সূর্য মাঝ আকাশে। কিন্তু অপেক্ষাই সার হল। দত্তবাবু তো নয়, কোন খদ্দেরই এলেন না। দত্তবাবু  এলে একটু মোটা টাকা রোজগার হয়। একটা স্মার্টফোন চেয়েছিল চুমকি, পড়ার জন্য কাজে লাগবে। কিন্তু কয়েক মাস যাবত টাকাই যোগাড় করতে পারছে না ফুলেশ্বরী। আজও সারাদিনে তেমন রোজগারপাতি হল না। ছুটির দিনে খদ্দের বেশি আসে। কি যে হল আজ!  সবাই কি সাধু পুরুষ বনে গেল নাকি? দুঃখেও মনে মনে হাসি পেল তার!
          ঠিক সন্ধের মুখে হঠাৎ ঘরে ঢুকল বেঢ -প মাতাল এক খদ্দের। নতুন লোক। ঘরের টিমটিমে হলদে আলোয় চমকে উঠল ফুলেশ্বরী! কে ও? দাড়ির জঙ্গলে মুখ ঢাকা সুকুমারকে চিনতে ভুল হয় না তার... সুকুমার! আর এখানে? মনটা বড় দ্রব হয়ে আসে!  কিন্তু এক লহমায় দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে সে!... নাহ্!  এখন সে জুলি, চম্পাহাটির গন্ড গ্রামের ফুলেশ্বরী নয়!
       অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ঘরে
ফিরছে ফুলেশ্বরী। চারদিক থেকে কানে ভেসে আসছে দেশাত্মবোধক গান আর নেতাজি সম্পর্কিত গরমা গরম সব ভাষণ। গানে আর শোভাযাত্রায় পালিত হচ্ছে "একনায়ক দিবস"। উদাস ফুলেশ্বরী হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির পথে। তাকে আঁচড়ে, কামড়ে, দলাই-মলাই করে এক মুঠো টাকা দিয়ে গেছে তার একদা ভালোবাসা -র মানুষ সুকুমার। মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলে জুলির খোলসে ঢাকা সেই আটপৌরে ফুলিকে চিনতে পারে নি সুকুমার! 
           বাড়িতে পা দিয়েই বাতাসে ভুরভুরে ফ্যানাভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ফুলেশ্বরী -র! গরম গরম আলু সিদ্ধ আর ফ্যানা ভাত নামিয়েছে চুমকি। গলার কাছে কি যেন একটা পাকিয়ে আসে! কলতলায় ধুধলের খোসায় সাবান লাগিয়ে সে জোরে জোরে কি যেন ঘষে তুলতে থাকে নিজের শরীর থেকে!  নিজেকে হঠাৎ বড় দূষিত মনে হতে থাকে তার! ভারী বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস,
--" হে নেতাজি, এই এক দেহ দূষিত রক্তের বিনিময়ে ওই এক থালা ধোঁয়া-ওঠা-ফ্যানাভা -তেই  স্বাধীনতা! কত লোকেই তো পলাতক হয় ছদ্মবেশে, তোমার মতো করে অন্তর্ধান হতে পারে ক'জন? হে মহাপ্রাণ, আমার মতো মেয়ে মানুষের পালাবার কি পথ নেই?"



নেতাজী সুভাষ

মাথুর দাস


নেতা যদি নেতা হয় আদর্শে দৃঢ়, আর

লক্ষ্যটি স্থির থাকে, থাকে ত্যাগ অনিবার,

কেউ তাকে পারবে কি, না মেনে থাকতে ?

পারা যায় অবদান তার কিছু ঢাকতে ?


জীবনের সুখ সাধ সব কিছু করে দিয়ে বর্জন,

ধ্যান জ্ঞান যার শুধু ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ;

সুভাষ তেমনই নেতা, দৃঢ়চেতা সাহসী পাবক,

আতঙ্কে প্রহর গোনে ভারতের ব্রিটিশ শাসক ।


সু-ভাষে সুভাষিত সুভাষের বাণী সব,

ঝঙ্কার তোলে প্রাণে, আনে মনে বিপ্লব ;

স্বাধীনতা অর্জনে বীর-প্রাণ এতটাই বিস্তার,

শাসকও বুঝে গেছে শেষমেষ নেই আর নিস্তার ।


এখনো জানি তা-ই, মানি তাই এ যাবৎ,

সুভাষের সুবাসে সুবাসিত এ ভারত ।





প্রাণের মানুষ 


পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

আজও এলগিন রোড ধরে দক্ষিণ দিকের পথটা
যেখানে দক্ষিণে গিয়েও উত্তরে মিশে গিয়েছে,
হাওড়া ব্রীজের ঝমঝম শব্দে, লোকাল ট্রেনের 
কামরায় বিপরীতে বসা সুপুরুষ সাধুর চাহনি তে,
বেনামী এয়ারপোর্টের পরিত্যক্ত হেলিকপ্টারে,
তোমাকে খুঁজি। 

খুঁজে ফেরে সহস্র মানুষের ক্লান্তিহীন চোখ।
সব নিঃশ্বাস ঢাকা পড়ে যায়, তোমার নিঃশাসে,
এক গভীর দীর্ঘনিঃশাসে তুমি  বেঁচে আছ অন্তরে
তোমার মুঠো মুঠো রক্তবীজ ছড়ানো ছিটানো 
সোনালী ধানের খেতে, নদীতে, সাগরে, পাহাড়ে।

তোমার পদচিহ্ন থেকে ধুলিকনা দিয়ে আজও, 
মূর্তি গড়ে লক্ষ মানুষ।  এক ফুতকারে উড়ে যায়
তোমরা মৃত্যু রহস্য, নিরুদ্দেশের সব ধারাপাত। 
আজও এলগিন রোড ধরে দক্ষিণ দিকের পথটা ধরে,  উত্তরে হেঁটে যাই। তোমার পথের খোঁজে। 




মৃত‍্যুঞ্জয়ী মহানায়ক

   বিপ্লব গোস্বামী

মৃত‍্যুতো হয় যে মানুষের
  কোন দেবতার নয় ,
মানব কুলে জন্ম নিয়ে
মৃত‍্যুকে করিলে জয়।
  প্রণাম হে মৃত‍্যুঞ্জয়।।

আপোষহীন লড়েছ তুমি
   মহা বিপ্লবী দুর্জয়,
একে একে এগারো বার
শুধু একটি বার নয়।
কেটেছ কারাবাস কষ্টে
চেয়েছ জাতীর বিজয়।
সেলুট হে মৃত‍্যুঞ্জয়।।

    স্বাধীনতা দেব আমি
     বলেছিলে দাও রক্ত ,
স্বার্থান্বেষী সব দেয়নি সায়
     ফিরিঙ্গীর যত ভক্ত।
কূটচালে তাড়ালো তোমায়
   নেওনি মেনে পরাজয়।
     প্রণাম হে  মৃত‍্যুঞ্জয়।।

    বীর গর্বে গড়ছ তুমি
  আজাদ হিন্দ সেনা দল,
    অস্ত্র হাতে বজ্রনাদে
  দিয়েছ ডাক দিল্লী চল।
ফিরিঙ্গী সব ছাড়লো দেশ
কাঁপলো ওদের হৃদয়।
  প্রণমি হে মৃত‍্যুঞ্জয়।।


প্রিয় সুভাষ ....আর একবার দিও ডাক ...
সুস্মিতা পাল কুন্ডু


সুভাষ তোমার অটল স্বর
ছলাৎ ছলাৎ রক্ত !
নেতাজী আমরা তোমার দলে
তোমার ভীষণ ভক্ত |

তোমার ডাকে দিয়েছিল সাড়া
আবালবৃদ্ধ বনিতা --
স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্যাখে
'কদম কদম বড়ায়ে যা ....'

আজাদ হিন্দ পতাকা তলে
ভীড় জমায় দৈনিক ,
দলে দলে নওজোয়ান 
সাহসী সব সৈনিক |

মেলালো পা একসাথে 
উজাড় করা সামর্থ্য --
উদ্দীপনায় এগিয়ে চলা
'আর নয় দাসত্ব ...'|

তোমার স্বরে ভীষণ যাদু
জলদ গম্ভীর !
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও ...
গড়ব দেশ , হব স্বাধীন দেশের নাগরিক "|

"দিল্লী চলো" , হাঁক দিলে
দীপ্ত তেজস্বীতায় !
ধন্য তোমার সাহসিকতা
হৃদয় ছুঁয়ে যায় ;

অসম লড়াই  , হার মানলে
স্বাধীনতার যোদ্ধা ,
বিপ্লবী তুমি দেশপ্রেমিক
তোমায় বিনম্র শ্রদ্ধা |

নতুন করে আবার শুরু
নতুন কৌশল --
স্বাধীনতার স্বপ্ন বোনে
প্রত্যয়ী দুই চোখ ;

অন্য পথে যেতে হবে
বিভুঁই বিদেশ --
বিমান দূর্ঘটনায় হারিয়ে গেলে
হলে নিরুদ্দেশ ...!

তোমার খবর বাতাসে ভাসে
কেউ বা বলে গুজব !
সত্যি না কি...ইচ্ছাকৃত 
পায়নি কেউ খোঁজ ...

স্বাধীনতা এলো শেষে
স্বপ্নপূরণ কই !
সাধারণ মানুষ কাঁদে
তেমন নেতা নেই |

গড়তে হবে নতুন ভারত
ধরবে কে যে হাল !
জেগে ওঠো নেতাজী , একবার পাঠাও তোমার ডাক ...
সুভাষ তুমি ভারতমাতার অনন্য সন্তান ||



শুনছো সুভাষ

উমা শঙ্কর রায়

এ দেশ আজো বদলায় নি সুভাষ! 
ঐ সময় আজো বদলায় নি -
যে সময়ে যে দেশে তুমি জন্মেছিলে, 
আজো আমরা সেই সময় -সেই দেশে! 
যে শুরুয়াতটা তুমি করেছিলে ---
ওরা জানতো ওটাতে হবে ওদের বদহজম -
ওরা তৈরি করলো গণতন্ত্র নামের মেকানিজম! 
আমাদের ঘিরেছে ঐ মেকানিজমের 
                                            মেকি ঈজম! 
এ দেশের মাটী এ দেশের জল তুমি ভালবাসতে 
এই মাটী এই মানুষ আজো তোমায় ভালবাসে -
যারা সেদিন হতে চেয়েছিল 
দেশের মালিক মাটীর মালিক 
তারা তোমায় ভালবাসে নি! 
উত্তরসূরিরা বা বাসবে কেন? 
দেশ প্রেমে ও তোমার সন্দেহ ওদের! 
তাইতো পরাক্রম দিবস! 
দেখছো তোমার জন্মদিন এলে -
ওদের কেমন তোড়জোড় -
ফাইল ক্লাসিফায়েড আর আনক্লাসিফায়েড নিয়ে-
তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে -
রাজা কি বলে জান? 
বিদেশ নীতির দোহাই দিয়ে বলে, থাম। 
তুমি আমাদের অতীত, বর্তমান -
তুমি আমাদের স্বাধীনতা, ভালবাসা -
তুমি নিজেই নিজের ইতিহাস -
মৃত বলেও ওরা তোমার নামের 
গ্রেপ্তারী পরোয়ানা করে নবীকরণ! 
ওদের কর্ম ওদের বলে -
                  তুমি ওদের ত্রাশ --




দেশনায়ক
        রীনা মজুমদার

আপোষহীন সংগ্রামের ইস্পাতকঠিন
দেশনায়ক আমাদের ঘরের ছেলে সুভাষ,
তোমার অসামান্য জীবনদর্শন ও কর্মধারা
মুক্তি আন্দোলনের অবিস্মরণীয় অধ্যায়
ভারতের মুক্তিসাধনার সংগ্রামী কাহিনী
ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

একটি প্রদীপ যখন হাজার প্রদীপ জ্বালে
ঘরে ঘরে অমূল্য বাণী শক্তির আলো আনে 
 অজানা দুর্গম পথে তরুণদের মাতৃস্নেহে
তোমার তেজ-দীপ্ত জীবন মুক্তির বীজ বোনে।
সে পথের প্রেরণা তোমার কখনো বিবেকানন্দ
কখনো, নিবেদিতার গ্রন্থ-- "The Master as I saw Him"

হে বীর, দেশনায়ক হে মহাপুরুষ, মহারথী
     তোমার আদর্শে ধন্য এ মহাভারত।



 
নেতাজি 
পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

নিজের জীবন তুচ্ছ করে,
দেশের জন্য লড়ার পণ-
চোখে চোখ রেখে জীবনপণ।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্বাধীন সরকার-
কেড়ে নেয় ব্রিটিশের ঘুম,
কত নরনারী অনাহারে, অর্ধাহারেও
সাড়া দেন তাঁর ডাকে-
আন্দামানে স্বাধীনতার ধ্বজা
'দিল্লি চলো' র অমোঘ আহ্বান-
নাড়িয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদের ভিত।
সব 'জয়' তাৎক্ষণিক নয়-
কিছু 'জয় ' থাকে পরাজয়ের কালগহ্বরে।
নেতাজি তুমি আসল নেতা, হৃদয়ের নেতা,
তোমায় আমাদের শতকোটি প্রণাম।




ফিরে এসো নেতাজী
বিজয় বর্মন

সেই ছোট্ট বেলা,
দিল্লি চলো ডাক,দেশ, রাজ্য, বাংলাদেশ,
কোনো কিছুরই বোধ ছিল না,
একটা বয়েজ চকলেট,
লম্বা সারিতে লেফ,রাইট ,বন্দে মাতরম গান,
শিশু মনে স্বাধীনতায় সমর্পণের কিছু কথা,

ইতিহাস যেন জগদ্দলে চাপা,
শিলালিপি ঘষে ছেড়া পাতা,
তেইশের কুয়াশায় আমিও মিশে যাই,
তোমরা আমায় রক্ত দাও,আমি তোমাদের,
স্বাধীনতা দেবো,

হাট মিছিলের অনেক স্মৃতি ,
বাতার মাথায় লাল গামছা, ইনকিলাবি চিৎকার,
খিলান, পুকুর পাড় ধরে আমরা কজন,
বাড়িঘর মাথায় তোলার জোগাড়,

কোনো দিন বুঝিনি, 
রাজনীতি আর দেশপ্রেম, 
মিলেমিশে একাকার যাপনে জন্মদিন,
অপেক্ষায় আমার, দিল্লি যাবার আশা,
নেতাজী তো নেই !



বদলা 
রীতা মোদক 


মাগো তুমি ভয় পেও না
আমরা তোমার দামাল ছেলের দল,
পাল্টা জবাব দিতে মাগো--
আমাদেরও আছে বল।

শহীদ ভাইদের রক্ত ছুঁয়ে 
শপথ নিলাম আজ, 
বদলা নেব তাজা প্রাণের 
শত্রুর মাথায় পড়বে বাজ। 

যুদ্ধ যুদ্ধ ডাক এসেছে
এগিয়ে যাবো রাইফেল হাতে
জয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনবো
ভারত মাতা থেকো সাথে।






                
    

No comments:

Post a Comment