ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রত্নগর্ভা ভারতমাতার যে বীর সন্তানেরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য " মনে করে বীরদর্পে অংশগ্রহণ করে ছিলেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তাদের মধ্যে সেরা আইকন --- এ ব্যাপারে কারোরই কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। আজন্ম নির্ভীক, সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপরায়ন, পরোপকারী ইত্যাদি কোন বিশেষণই সুভাষের জন্য যথেষ্ট নয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজীর অবদান প্রশংসাতীতভাবে সত্য। বার্মার মান্দালয় জেল থেকে অসুস্থ সুভাষকে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। প্রবল প্রতাপশালী ইংরাজ সরকারের সুচতুর গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের ঘেরাটোপের জাল কেটে তিনি যেভাবে অন্তর্হিত হন, তা আজও দেশবাসীকে বিস্মিত করে। তিনি এটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে, গান্ধীজির নরম পন্থা অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলন করে ইংরাজ সরকারের গদি টলানো অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা অসম্ভব বটে। তাই এদেশ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধ শক্তির সাহায্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে ফেলতে হবে।
১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারি গভীর রাত্রে পাঠানের বেশ ধারণ করে সুভাষ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির বসুকে নিয়ে তদানীন্তন বিহারের গোমো স্টেশনে পৌঁছন। সেখান থেকে আব্বেহারের সাহায্য নিয়ে পৌঁছন পেশোয়ার।১৯৪১ সালের ২৬ শে জানুয়ারী রাশিয়া পৌঁছানোর জন্য নেতাজী তাঁর যাত্রা শুরু করেন। আগা খানের সমর্থকেরা তাঁকে আফগানিস্থানের সীমান্ত পার হতে সহায়তা করে। এভাবে সুভাষ কাবুল হয়ে পৌঁছন সোভিয়েত রাশিয়ায়।
মস্কোয় জার্মান অ্যাম্বাসেডরের সহায়তায় সেখান থেকে তিনি পোঁছে যান রোম। তারপর সেখান থেকে পৌঁছন জার্মানি। জার্মানিতে পৌঁছে "স্পেশাল ব্যুরো ফর ইন্ডিয়া"-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন, যারা আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত ছিল। নেতাজী বার্লিনে "ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার" প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হতে ৪৫০০ জন সৈনিকদের নিয়ে "ইন্ডিয়ান লিজিয়ন" গঠন করেন। ইতিমধ্যে অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। জার্মান তখন ইংরাজ বিরোধী শক্তি হিসেবে সুপরিচিত। ইন্ডিয়ান লিজিয়নের সকল সদস্যেদের উপস্থিতিতে হিটলার ও সুভাষ বসুর মধ্যে নিম্নলিখিত মর্মে একটি চুক্তি হয়,
বিনিময়ে জার্মান সেনাবাহিনীর সর্বময় কর্তা অ্যাডলফ হিটলার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী সুভাষকে সর্বত ভাবে সাহায্য করবেন।
এরপর সুভাষ হামবুর্গে ইন্দো-জার্মান মৈত্রী সমিতি তৈরী করে ভবিষ্যত কর্মপন্থার খসড়া তৈরি করেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন নেতাজী। পরিচিত হলেন সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে। ব্যাংককে জনসভায় ভাষণ দিলেন নেতাজী। সিঙ্গাপুর রেডিও থেকে দিলেন প্রথম বেতার ভাষণ।এরপর গ্রহণ করলেন সেনাবাহিনীর অভিনন্দন। সর্বাধিনায়ক নেতাজী ঘোষণা করেন, "চল দিল্লি, চল দিল্লি",। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন নেতাজী। ব্রিটিশের
বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছেন আপোষহীন সংগ্রামের। গঠন করেন মহিলাদের নিয়ে রাণী ঝাঁসি বাহিনী।
এবার যুদ্ধ ঘোষণা। ইতিমধ্যে ইম্ফলে পৌঁছে গেছে আজাদ হিন্দ বাহিনী। তিরধনুক থেকে মেশিনগান কিছুই বাদ নেই। শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আজাদী সৈনিক। রাতের অন্ধকারের মধ্যেও চলেছে আজাদ কনভয়। প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ, সামরিক বল কম থাকায় তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। ইম্ফলে পৌঁছে ওড়ালেন ভারতের জাতীয় পতাকা। কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা মিত্রপক্ষের কাছ থেকে না পাওয়ায় খাদ্য, জল কষ্টের কারণে পেছনে হঠতে বাধ্য হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নেতাজী সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এই স্বাধীনতা যুদ্ধের।
নেতাজীর এই অদম্য প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ না করলেও প্রভাবশালী ইংরাজ সরকারকে ভীত-সন্ত্রস্ত করতে বাধ্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংরেজরা এমনিতেই ছিল ব্যতিব্যস্ত। তার উপর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর এই হুংকার ইংরেজদের ভীতির কারণ হওয়ায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনঅনেক খানি পরিপুষ্টি লাভ করে।
ফুলেশ্বরীর স্বাধীনতা
মৌসুমী চৌধুরী
চটপট তৈরি হয়ে নিচ্ছিল ফুলেশ্বরী। সাতটা দশের শিয়ালদহ লোকালটা ধরতেই হবে তাকে। ভেতর ঘর থেকে শাশুড়ি চিৎকার করছেন,
-" আইজ না হয় না-ই গেলি। পোলা-মাইয়াডার ইস্কুল ছুটি। তরে একটু পাওনের লাইগ্যা এক্কে- রে ছটফটায় বাচ্চাদুইডা।"
- " না মা, আজ যেতেই হবে। আজ ছুটির দিন বলেই তো আমাদের ওভার-ডিউটি করতে হয়। ওসব তুমি বুঝবে না।"
কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে দৌড় লাগায় ফুলেশ্বরী। যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলে যায়,
--" চুমকি আর রাজুকে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিও। আজ ওদের জিলিপি আর বিস্কুট দেবে।"
ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি পুলক নস্কর। তাদের গাঁয়ের পঞ্চায়েত মেম্বারের চ্যালা। সব সময় তার পেছনে ছুঁকছুক করছে। শকুন নজরে ফুলেশ্বরীকে জরিপ করে পুলক বলল,
-- "আজও কাজে যাবি রে, ফুলি। আজ ২৩ শে জানুয়ারি না? বড় বড় নেতারা আসবেন আমাদের গাঁয়ের ইস্কুল মাঠে। তাঁরা তোদের দুয়োরে আসবেন, তোদের অভাব অভিযোগ শুনবেন।"
শুনে মটকা গরম হয়ে যায় ফুলেশ্বরীর। মুখ ঝমটে বলে,
--" তা পাঁচ বছর আমাদের দুঃখের কথা মনে পড়ে নি যখন, এখন আর কেন?"
দাঁত কিড়মিড় করে পুলক নস্কর বলে,
-" এত দেমাক ভালো নয় রে, ফুলি। তোর এই বাড়বাড়ন্ত কিসের জন্যি সব আমি জানি।"
ফুলেশ্বরীও বলতে ছাড়ে না,
-"নেতা দর্শণে তোমরা পেট ভরাও। আমার
খেটে খাওয়ার কপাল। তাই চললুম খাটতে।"
প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে ট্রেনটা ধরে ফুলেশ্বরী। তাদের গ্রাম থেকে চম্পাহাটি স্টেশনটা প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে।
আজ ডেইলি প্যাসেঞ্জারেরা অনেকেই নেই। মহিলা কামরাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। ফুলওয়া- লি বিনতা মাসী তাকে দেখে হাসল একটু। জালানার ধারে একটা সিট পেয়ে গেল সে। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল ক্লান্ত ফুলেশ্বরী।
সকাল থেকে ওঠা ইস্তক পা দু'খানাকে তো একেবারে বিশ্রাম দিতে পারে না! খুব ভোর ভোর উঠেই শুরু হয়ে যায় গৃহস্থালির কাজকর্ম। গরুদুটিকে জাবনা দিয়ে হাঁস মুরগিগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দেয়। বাতে পঙ্গু শাশুড়িকে নাইয়ে ধুইয়ে পরিষ্কার করে খেতে দেয়। ছেলে-মেয়ে দুটিকে ডেকে তুলে দেয়। ওরা টিউশন পড়তে যায়। তারপর সে রান্না চাপায়। রান্না করে সবকিছু গুছিয়ে রেখে নিজের খাবারটা বেঁধে নিয়ে আসে। বাইরের কেনা খাবার সে খায় না। তাতে শরীর থাকে না, আবার পয়সাও অনেক বেশি খরচ হয়।
বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামে। গায়ে কাঁটা দেওয়া সব দেশাত্মবোধক গান কানে আসতে থাকে ফুলেশ্বরীর। স্কুলের কথা মনেপড়ে তার। এই দিনটা বেশ সমারোহপূর্ণভাবে পালিত হত তাদের স্কুলে। মাষ্টারমশাইদের মুখে শুনেছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের কথা, দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কত কথা। পড়াশোনায় মোটামুটি হলেও পড়া বেশিদূর হয় নি তার। পাঁচবোনের মধ্যে সে ছিল সেজো। সুকুমারকে ভালোবেসে যখন সে সংসারে ঢোকে তখন তার বয়স মাত্র ষোল বছর...তা-র-প-র জীবন তাকে ক্ষমা করে নি। তার হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য পুরোটাই নিঙড়ে ছিবড়ে করেছে তাকে।
ট্রেন যাদবপুর স্টেশনে ঢুকতেই কানে আসে গানের কলি, "এদেশ তোমার দেশ, এদেশ আমার দেশ/ উত্তরে কাশ্মীর, দক্ষিণে কেরালা..."। কেরালা নামটি শুনেই যেন বুকের
মাঝে হাজার হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে ফুলেশ্বরীর। কেলারায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে সেখান থেকে আর ফেরে নি সুকুমার। সেখানকার মেয়ে বিয়ে করে সেখানে -ই থিতু হয়েছে। তখন চুমকির বয়স আট আর রাজুর পাঁচ। তারপরই দাঁতে দাঁত চেপে জীবনযুদ্ধ শুরু হল ফুলেশ্বরীর। চুমকি আর রাজুকে যে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলতেই হবে। কিন্তু সে পথেও বিস্তর কাঁটা! একদিন কাজ দেবার নাম করে তাদের পাড়ার পল্টু তাকে এনে ঢোকালো এক বাবুর বাড়িতে। সেই বাবুর কাজের লোক নয় দরকার ছিল শরীরী খিদে মেটাবার মেয়ে -মানুষ। তখন থেকে ফুলেশ্বরীর জীবন বয়ে চলল সেই খাতেই...
খুব গোপনে চার বছর ধরে কাজটি করে যাচ্ছে ফুলেশ্বরী। ছেলে-মেয়ে, শাশুড়ি বা পাড়া-প্রতিবেশি কেউ জানে না আসলে সে কি কাজ করে। এখন রোজ চম্পাহাটি থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে নামে ফুলেশ্বরী। কাছেই বিশেষ এলাকায় একটা ঘর নেওয়া আছে। সেখানেই সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত দেহ পসরা সাজায় সে। এখানে তার নাম জুলি। এই বাজারে তার ডাগর শরীরটার দাম বেশ ভালই। কেন কে জানে তার খদ্দেররাও বেশ সম্ভ্রান্ত। বেশির ভাগই শুধু শরীরী সুখ পেতে নয়, মনের জ্বালা জুড়োতেও যেন তার কাছে আসে!
সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ঘরে ঢুকে গেল ফুলেশ্বরী। কিছু খেয়ে নিয়ে সাজগোজ সেরে নিল। মানানসই মেকআপ করল মুখে, ডালিম রঙে রাঙিয়ে নিল ঠোঁট। তার গমরঙা ত্বক চকচক করে আজকাল। রূপচর্চায় শরীরকে বড় যত্নে রাখে সে। এটাই যে তার স্বপ্নপূরণের হাতিহার। সাজগোজ কমপ্লিট হলে আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয় ফুলেশ্বরী। আজ দত্তবাবুর আসবার কথা। আজ তাঁর ছুটির দিন যে। দত্তবাবু তার বাঁধা খদ্দের। অন্য কারও কাছে যান না তিনি। ছুটির দিনগুলো তার ঘরেই কাটান। বেলা গড়িয়ে সূর্য মাঝ আকাশে। কিন্তু অপেক্ষাই সার হল। দত্তবাবু তো নয়, কোন খদ্দেরই এলেন না। দত্তবাবু এলে একটু মোটা টাকা রোজগার হয়। একটা স্মার্টফোন চেয়েছিল চুমকি, পড়ার জন্য কাজে লাগবে। কিন্তু কয়েক মাস যাবত টাকাই যোগাড় করতে পারছে না ফুলেশ্বরী। আজও সারাদিনে তেমন রোজগারপাতি হল না। ছুটির দিনে খদ্দের বেশি আসে। কি যে হল আজ! সবাই কি সাধু পুরুষ বনে গেল নাকি? দুঃখেও মনে মনে হাসি পেল তার!
ঠিক সন্ধের মুখে হঠাৎ ঘরে ঢুকল বেঢ -প মাতাল এক খদ্দের। নতুন লোক। ঘরের টিমটিমে হলদে আলোয় চমকে উঠল ফুলেশ্বরী! কে ও? দাড়ির জঙ্গলে মুখ ঢাকা সুকুমারকে চিনতে ভুল হয় না তার... সুকুমার! আর এখানে? মনটা বড় দ্রব হয়ে আসে! কিন্তু এক লহমায় দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে সে!... নাহ্! এখন সে জুলি, চম্পাহাটির গন্ড গ্রামের ফুলেশ্বরী নয়!
অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ঘরে
ফিরছে ফুলেশ্বরী। চারদিক থেকে কানে ভেসে আসছে দেশাত্মবোধক গান আর নেতাজি সম্পর্কিত গরমা গরম সব ভাষণ। গানে আর শোভাযাত্রায় পালিত হচ্ছে "একনায়ক দিবস"। উদাস ফুলেশ্বরী হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির পথে। তাকে আঁচড়ে, কামড়ে, দলাই-মলাই করে এক মুঠো টাকা দিয়ে গেছে তার একদা ভালোবাসা -র মানুষ সুকুমার। মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলে জুলির খোলসে ঢাকা সেই আটপৌরে ফুলিকে চিনতে পারে নি সুকুমার!
বাড়িতে পা দিয়েই বাতাসে ভুরভুরে ফ্যানাভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ফুলেশ্বরী -র! গরম গরম আলু সিদ্ধ আর ফ্যানা ভাত নামিয়েছে চুমকি। গলার কাছে কি যেন একটা পাকিয়ে আসে! কলতলায় ধুধলের খোসায় সাবান লাগিয়ে সে জোরে জোরে কি যেন ঘষে তুলতে থাকে নিজের শরীর থেকে! নিজেকে হঠাৎ বড় দূষিত মনে হতে থাকে তার! ভারী বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস,
--" হে নেতাজি, এই এক দেহ দূষিত রক্তের বিনিময়ে ওই এক থালা ধোঁয়া-ওঠা-ফ্যানাভা -তেই স্বাধীনতা! কত লোকেই তো পলাতক হয় ছদ্মবেশে, তোমার মতো করে অন্তর্ধান হতে পারে ক'জন? হে মহাপ্রাণ, আমার মতো মেয়ে মানুষের পালাবার কি পথ নেই?"
নেতাজী সুভাষ
মাথুর দাস
নেতা যদি নেতা হয় আদর্শে দৃঢ়, আর
লক্ষ্যটি স্থির থাকে, থাকে ত্যাগ অনিবার,
কেউ তাকে পারবে কি, না মেনে থাকতে ?
পারা যায় অবদান তার কিছু ঢাকতে ?
জীবনের সুখ সাধ সব কিছু করে দিয়ে বর্জন,
ধ্যান জ্ঞান যার শুধু ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ;
সুভাষ তেমনই নেতা, দৃঢ়চেতা সাহসী পাবক,
আতঙ্কে প্রহর গোনে ভারতের ব্রিটিশ শাসক ।
সু-ভাষে সুভাষিত সুভাষের বাণী সব,
ঝঙ্কার তোলে প্রাণে, আনে মনে বিপ্লব ;
স্বাধীনতা অর্জনে বীর-প্রাণ এতটাই বিস্তার,
শাসকও বুঝে গেছে শেষমেষ নেই আর নিস্তার ।
এখনো জানি তা-ই, মানি তাই এ যাবৎ,
সুভাষের সুবাসে সুবাসিত এ ভারত ।
প্রাণের মানুষ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজও এলগিন রোড ধরে দক্ষিণ দিকের পথটা
যেখানে দক্ষিণে গিয়েও উত্তরে মিশে গিয়েছে,
হাওড়া ব্রীজের ঝমঝম শব্দে, লোকাল ট্রেনের
কামরায় বিপরীতে বসা সুপুরুষ সাধুর চাহনি তে,
বেনামী এয়ারপোর্টের পরিত্যক্ত হেলিকপ্টারে,
তোমাকে খুঁজি।
খুঁজে ফেরে সহস্র মানুষের ক্লান্তিহীন চোখ।
সব নিঃশ্বাস ঢাকা পড়ে যায়, তোমার নিঃশাসে,
এক গভীর দীর্ঘনিঃশাসে তুমি বেঁচে আছ অন্তরে
তোমার মুঠো মুঠো রক্তবীজ ছড়ানো ছিটানো
সোনালী ধানের খেতে, নদীতে, সাগরে, পাহাড়ে।
তোমার পদচিহ্ন থেকে ধুলিকনা দিয়ে আজও,
মূর্তি গড়ে লক্ষ মানুষ। এক ফুতকারে উড়ে যায়
তোমরা মৃত্যু রহস্য, নিরুদ্দেশের সব ধারাপাত।
আজও এলগিন রোড ধরে দক্ষিণ দিকের পথটা ধরে, উত্তরে হেঁটে যাই। তোমার পথের খোঁজে।
মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক
বিপ্লব গোস্বামী
মৃত্যুতো হয় যে মানুষের
কোন দেবতার নয় ,
মানব কুলে জন্ম নিয়ে
মৃত্যুকে করিলে জয়।
প্রণাম হে মৃত্যুঞ্জয়।।
আপোষহীন লড়েছ তুমি
মহা বিপ্লবী দুর্জয়,
একে একে এগারো বার
শুধু একটি বার নয়।
কেটেছ কারাবাস কষ্টে
চেয়েছ জাতীর বিজয়।
সেলুট হে মৃত্যুঞ্জয়।।
স্বাধীনতা দেব আমি
বলেছিলে দাও রক্ত ,
স্বার্থান্বেষী সব দেয়নি সায়
ফিরিঙ্গীর যত ভক্ত।
কূটচালে তাড়ালো তোমায়
নেওনি মেনে পরাজয়।
প্রণাম হে মৃত্যুঞ্জয়।।
বীর গর্বে গড়ছ তুমি
আজাদ হিন্দ সেনা দল,
অস্ত্র হাতে বজ্রনাদে
দিয়েছ ডাক দিল্লী চল।
ফিরিঙ্গী সব ছাড়লো দেশ
কাঁপলো ওদের হৃদয়।
প্রণমি হে মৃত্যুঞ্জয়।।
প্রিয় সুভাষ ....আর একবার দিও ডাক ...
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
সুভাষ তোমার অটল স্বর
ছলাৎ ছলাৎ রক্ত !
নেতাজী আমরা তোমার দলে
তোমার ভীষণ ভক্ত |
তোমার ডাকে দিয়েছিল সাড়া
আবালবৃদ্ধ বনিতা --
স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্যাখে
'কদম কদম বড়ায়ে যা ....'
আজাদ হিন্দ পতাকা তলে
ভীড় জমায় দৈনিক ,
দলে দলে নওজোয়ান
সাহসী সব সৈনিক |
মেলালো পা একসাথে
উজাড় করা সামর্থ্য --
উদ্দীপনায় এগিয়ে চলা
'আর নয় দাসত্ব ...'|
তোমার স্বরে ভীষণ যাদু
জলদ গম্ভীর !
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও ...
গড়ব দেশ , হব স্বাধীন দেশের নাগরিক "|
"দিল্লী চলো" , হাঁক দিলে
দীপ্ত তেজস্বীতায় !
ধন্য তোমার সাহসিকতা
হৃদয় ছুঁয়ে যায় ;
অসম লড়াই , হার মানলে
স্বাধীনতার যোদ্ধা ,
বিপ্লবী তুমি দেশপ্রেমিক
তোমায় বিনম্র শ্রদ্ধা |
নতুন করে আবার শুরু
নতুন কৌশল --
স্বাধীনতার স্বপ্ন বোনে
প্রত্যয়ী দুই চোখ ;
অন্য পথে যেতে হবে
বিভুঁই বিদেশ --
বিমান দূর্ঘটনায় হারিয়ে গেলে
হলে নিরুদ্দেশ ...!
তোমার খবর বাতাসে ভাসে
কেউ বা বলে গুজব !
সত্যি না কি...ইচ্ছাকৃত
পায়নি কেউ খোঁজ ...
স্বাধীনতা এলো শেষে
স্বপ্নপূরণ কই !
সাধারণ মানুষ কাঁদে
তেমন নেতা নেই |
গড়তে হবে নতুন ভারত
ধরবে কে যে হাল !
জেগে ওঠো নেতাজী , একবার পাঠাও তোমার ডাক ...
সুভাষ তুমি ভারতমাতার অনন্য সন্তান ||
শুনছো সুভাষ
উমা শঙ্কর রায়
এ দেশ আজো বদলায় নি সুভাষ!
ঐ সময় আজো বদলায় নি -
যে সময়ে যে দেশে তুমি জন্মেছিলে,
আজো আমরা সেই সময় -সেই দেশে!
যে শুরুয়াতটা তুমি করেছিলে ---
ওরা জানতো ওটাতে হবে ওদের বদহজম -
ওরা তৈরি করলো গণতন্ত্র নামের মেকানিজম!
আমাদের ঘিরেছে ঐ মেকানিজমের
মেকি ঈজম!
এ দেশের মাটী এ দেশের জল তুমি ভালবাসতে
এই মাটী এই মানুষ আজো তোমায় ভালবাসে -
যারা সেদিন হতে চেয়েছিল
দেশের মালিক মাটীর মালিক
তারা তোমায় ভালবাসে নি!
উত্তরসূরিরা বা বাসবে কেন?
দেশ প্রেমে ও তোমার সন্দেহ ওদের!
তাইতো পরাক্রম দিবস!
দেখছো তোমার জন্মদিন এলে -
ওদের কেমন তোড়জোড় -
ফাইল ক্লাসিফায়েড আর আনক্লাসিফায়েড নিয়ে-
তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে -
রাজা কি বলে জান?
বিদেশ নীতির দোহাই দিয়ে বলে, থাম।
তুমি আমাদের অতীত, বর্তমান -
তুমি আমাদের স্বাধীনতা, ভালবাসা -
তুমি নিজেই নিজের ইতিহাস -
মৃত বলেও ওরা তোমার নামের
গ্রেপ্তারী পরোয়ানা করে নবীকরণ!
ওদের কর্ম ওদের বলে -
তুমি ওদের ত্রাশ --
দেশনায়ক
রীনা মজুমদার
আপোষহীন সংগ্রামের ইস্পাতকঠিন
দেশনায়ক আমাদের ঘরের ছেলে সুভাষ,
তোমার অসামান্য জীবনদর্শন ও কর্মধারা
মুক্তি আন্দোলনের অবিস্মরণীয় অধ্যায়
ভারতের মুক্তিসাধনার সংগ্রামী কাহিনী
ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
একটি প্রদীপ যখন হাজার প্রদীপ জ্বালে
ঘরে ঘরে অমূল্য বাণী শক্তির আলো আনে
অজানা দুর্গম পথে তরুণদের মাতৃস্নেহে
তোমার তেজ-দীপ্ত জীবন মুক্তির বীজ বোনে।
সে পথের প্রেরণা তোমার কখনো বিবেকানন্দ
কখনো, নিবেদিতার গ্রন্থ-- "The Master as I saw Him"
হে বীর, দেশনায়ক হে মহাপুরুষ, মহারথী
তোমার আদর্শে ধন্য এ মহাভারত।
নেতাজি
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
নিজের জীবন তুচ্ছ করে,
দেশের জন্য লড়ার পণ-
চোখে চোখ রেখে জীবনপণ।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্বাধীন সরকার-
কেড়ে নেয় ব্রিটিশের ঘুম,
কত নরনারী অনাহারে, অর্ধাহারেও
সাড়া দেন তাঁর ডাকে-
আন্দামানে স্বাধীনতার ধ্বজা
'দিল্লি চলো' র অমোঘ আহ্বান-
নাড়িয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদের ভিত।
সব 'জয়' তাৎক্ষণিক নয়-
কিছু 'জয় ' থাকে পরাজয়ের কালগহ্বরে।
নেতাজি তুমি আসল নেতা, হৃদয়ের নেতা,
তোমায় আমাদের শতকোটি প্রণাম।
ফিরে এসো নেতাজী
বিজয় বর্মন
সেই ছোট্ট বেলা,
দিল্লি চলো ডাক,দেশ, রাজ্য, বাংলাদেশ,
কোনো কিছুরই বোধ ছিল না,
একটা বয়েজ চকলেট,
লম্বা সারিতে লেফ,রাইট ,বন্দে মাতরম গান,
শিশু মনে স্বাধীনতায় সমর্পণের কিছু কথা,
ইতিহাস যেন জগদ্দলে চাপা,
শিলালিপি ঘষে ছেড়া পাতা,
তেইশের কুয়াশায় আমিও মিশে যাই,
তোমরা আমায় রক্ত দাও,আমি তোমাদের,
স্বাধীনতা দেবো,
হাট মিছিলের অনেক স্মৃতি ,
বাতার মাথায় লাল গামছা, ইনকিলাবি চিৎকার,
খিলান, পুকুর পাড় ধরে আমরা কজন,
বাড়িঘর মাথায় তোলার জোগাড়,
কোনো দিন বুঝিনি,
রাজনীতি আর দেশপ্রেম,
মিলেমিশে একাকার যাপনে জন্মদিন,
অপেক্ষায় আমার, দিল্লি যাবার আশা,
নেতাজী তো নেই !
বদলা
রীতা মোদক
মাগো তুমি ভয় পেও না
আমরা তোমার দামাল ছেলের দল,
পাল্টা জবাব দিতে মাগো--
আমাদেরও আছে বল।
শহীদ ভাইদের রক্ত ছুঁয়ে
শপথ নিলাম আজ,
বদলা নেব তাজা প্রাণের
শত্রুর মাথায় পড়বে বাজ।
যুদ্ধ যুদ্ধ ডাক এসেছে
এগিয়ে যাবো রাইফেল হাতে
জয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনবো
ভারত মাতা থেকো সাথে।
No comments:
Post a Comment