Friday, May 3, 2024


 

সম্পাদকের কথা 

প্রথমেই নতুন বছরের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা সকলের জন্য। সকলের শুভ হোক। ভাল থাকুন প্রত্যেকে। 

বছরের প্রথম মাস যেন সেই বছরের জন্মদাত্রী মা। এই ধারণা থেকেই এবারের ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল `মা`। আমরা আপ্লুত এত সংখ্যক লেখা পেয়ে। মা-কে নিয়ে ব্যক্তিগত গদ্য থেকে গল্প, কবিতা, স্মৃতিচারণা ইত্যাদিতে মুজনাইকে সমৃদ্ধ করেছেন মাননীয় লেখকরা। আমরা কৃতজ্ঞ। 

ক্রোড়পত্রের বিষয় বাদেও প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদিও পাঠিয়েছেন অনেকে। ধন্যবাদ তাঁদেরও। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে মুজনাইয়ের সৃষ্টি জল এভাবেই টলমল করে। অনুমান করা হয় `মজে নাই` থেকে সৃষ্ট শব্দ `মুজনাই`। ছোট্ট নদী হলেও সে সারা বছর পুষ্ট। আমাদের ছোট্ট পত্রিকাও এভাবেই সকলের ভালবাসায় ভরে থাকে সৃষ্টির প্রবাহ নিয়ে।


         

 মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

প্রচ্ছদ ছবি - বাবুল মল্লিক

ক্রোড়পত্রে ব্যবহৃত সংগৃহিত  ছবি- যামিনী রায়   

প্রকাশক- রীনা সাহা    

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪৩১ 


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

প্রশান্ত নাথ চৌধুরী, গৌতমকুমার ভাদুড়ি, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, সুদীপ দত্ত, 

গৌতমেন্দু নন্দী, উজ্জ্বল আচার্য, মৌসুমী চৌধুরী, উদয় সাহা,

 বেলা দে, লীনা রায়শ্রাবণী সেন, মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী,

অমলকৃষ্ণ রায়, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, সুজাতা কর, 

 রীনা মজুমদার, রণিতা দত্ত, আলপনা নাগ সরকার, অনিতা নাগ,

দেবদত্তা বিশ্বাস, সম্রাজ্ঞী, মিষ্টু সরকার, শান্তনা বর্মন, রীতা মোদক,

মনোমিতা চক্রবর্তী, বটু কৃষ্ণ হালদার, 

 উমেশ শর্মা, দেবর্ষি সরকার, রামকৃষ্ণ পাল, দীপায়ন ভট্টাচার্য,

শ্যামলী সেনগুপ্ত, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রানী চৌধুরী, রথীন পার্থ মণ্ডল,

 রবিনা সরকার, সুমন্ত সরকার, মগ্ননীল(দীপ মুখার্জী), পাপু মজুমদার,

বিনিময়  দাস, তপন বসাক, অলকানন্দা দে, মজনু মিয়া, বুদ্ধদেব দাস,

সঞ্জয় সাহা (এস.সাহা), জয়তী ব্যানার্জী, আকাশলীনা ঢোল,

 উৎপলেন্দু পালদেবযানী সেনগুপ্ত, প্রতিভা পাল, অর্পিতা রায় আসোয়ার,

রাজর্ষি দত্ত, পক্ষিরাজ, ভূমিকা ঘোষ, ছন্দা পাল, মাথুর দাস, তীর্থঙ্কর সুমিত,

রীনা সাহা ও শৌভিক রায় 


মুজনাই অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪৩১ 





মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



একটি উপন্যাস 

শৌভিক রায় 


ঢেঁকি শাক তোলা থেকে  বড়ি দেওয়া 

কিংবা বর্ষাদিনে রবি ঠাকুরের গান...... 

এরকম অনেক গল্প আমাদের মায়েদের থাকে 

কান বধির হলে সেই সব গান শুনি 

চোখ অন্ধ হলে দেখি মা-কে 


মায়েদের কিছু বলতে নেই, 

হয়ত বা করতেও নেই 

আধমহলা স্বপ্নপুরে এসে তাই নিত্য প্রেম তাঁদের 

নাটমন্দিরের কালাকানুর সাথে 


এভাবেই ঘুরে যায় মাস থেকে বছর 

পায়ে পায়ে ঘোরে কিচ্ছু উত্তরাধিকার 

মায়েরা গল্প বলেন কোনও এক না দেখা গ্রামের 

যেখানে আজও ভেসে বেড়ায় পুকুরের জলে দুপুরের হাঁস 

উঁকি দিয়ে দেখে ভীরু চোখের কেউ হয়ত বা!


মা তবু মা থেকে যান 

কারোর না হয়েও মা রয়ে যান অন্য মায়ের কাছে.... 


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



আমার মা                        
গৌতমকুমার ভাদুড়ি

আমার মা খুব মিথ্যে কথা বলতেন। 
মা সম্পর্কে ডায়েরির পাতায় দুচার লাইন আর ফেসবুকের বাক্সে দুর্লভ মুহূর্তের দু’একখানা ছবি পোস্ট করার কালচারে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ফরমায়েশি কিছু কথা বলবার জন্য আমন্ত্রণ পাওয়াটা অনেকের মতো আমার কাছেও খুবই উত্তেজনার, আবেগেরও বটে। তবে একটা কথা খুব সত্যি যে আমাদের মতো সন্তানদের মায়েরা, অর্থাৎ আমরা যারা ডবল সাবালকত্বকেও বহুদিন অতিক্রম করেছি এবং স্বাভাবিক নিয়মে মাতৃহারাও হয়েছি, তাদের প্রত্যেকের মায়েরাই প্রায় একই রকম ছিলেন। সেসব মায়েদের ঘরে বাইরে কত যে সন্তান ছিল তার গোনাগুনতি ছিলনা কোনও। কিন্তু একান্তভাবে নিজের মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে শুরুটা করেছিলাম তা থেকে বিচ্যুত হলে চলবে কেন? সত্যিই আমার মা খুব মিথ্যে কথা বলতেন।
আমাদের শৈশবে মুখ্যত বাবার কাকা এক উকিলদাদুর কারণে আমাদের পরিবারেও পুজোআচ্চার পাশাপাশি জবরদস্তি কিছু সংস্কার চালু ছিল। প্রকাশ্যে আমরা কোনও অব্রাহ্মণ বয়স্ককে প্রণাম করতে পারতাম না, তিনিই গ্রহণ করতেন না। খেতে বসে কথা বলা নিষেধ ছিল ইত্যাদি। বিশেষভাবে রান্নাঘরে বর্ণনির্বিশেষ অবাধ বিচরণ গর্হিত বিবেচিত হত। মা এই কঠিন বিধিনিষেধগুলোকে একটু একটু করে মুছে দেবার চেষ্টা করত। 
আমার বন্ধু ছিল বাবলা।বলা নেই কওয়া নেই, সে মাঝে মাঝেই চলে আসত আমাদের বাড়িতে, একেবারে খাবার সময়।তখন আমরা মেঝেতে পিঁড়ি পেতে খেতে বসতাম।দাদু প্রায়ই স্নান সেরে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আমাদের খাওয়া দেখতেন। আমাদের দুটো কাকুও ছিল অনেকটা দাদুর ধাঁচে মানুষ।মাঝে মাঝে সমীর নামে একটি ছেলেও রান্নাঘরে আমাদের সঙ্গে বসে খেত, সে আমার ক্লাসমেট।মা তাদের বাবা বাবা বলে খাওয়াচ্ছে, বাবলা,সমীর সম্বোধন করে খুব হাঁকডাক তাদেরকে।যেন আমাদের মামাবাড়িরই কেউ তারা,সেটা মা সারাক্ষণই বুঝিয়ে দিত।দাদুর সন্দেহ না হয় তাই গল্পে গল্পে জানিয়ে দিত ওরা দুজনেই ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে। প্রকৃত পরিচয়ে ওরা দুজনেই কিন্তু যথাক্রমে আমজাদ হোসেন এবং আওলাদ হোসেন। এখনও তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেদিনের মতোই আছে।আমাদের ধার্মিক দাদু এবং কাকুরা এখন স্বর্গে আছেন। মাও বছর কয় আগে স্থানান্তরিত হয়েছে, কেবল মার এই মিথ্যে বলাটা তাঁরা কেউ ধরতে পারেননি।
আর একজন ছিলেন কাশেমালি দাদু। তিনি মাকে ঠাকুরঝি বলে ডাকতেন। তখনকার দিনে কিছু কিছু মানুষকে চা দেবার সময় তাদের জন্য নির্ধারিত কাপ ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল। মা কাশেমালি দাদুকে নিজের কাপেই চা দিত, বলত, বুড়ো মানুষ ,কদিনই বা বাঁচবে, আমি তো স্নানের সময় সব কাপই নিজে হাতে মেজে আনব। এটা সেসময়ে অনেকটাই ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে গণ্য হত।পাড়া জুড়ে অনেক বাড়িতেই মাকে তখন ভোগ রান্নার জন্য ডেকে নিয়ে যেত। কাশেমালি দাদু মার কাপে চা খাওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত একসময় সামান্য গুঞ্জন তুলেছিল।উপোস থেকে স্নান করে ভোগ রান্নায় কোনও দোষ নেই মার হয়ে বাবা সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকের অস্থির সময়ের প্রেক্ষিতে মার এই কাজগুলোকে খুব মনে পড়ে।
আমরা তখন আজকের চেয়ে আরও অনেকটাই আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটাতাম।তবে আমাদের চাইতেও গরিব পরিবার যে ছিল না তা নয়।মা কষ্ট করে হলেও দৈনিক রান্নার সময় খানিকটা চাল বেশি নিত।বলত ভাতটা একটু বেশি থাকলে ডাল তরকারি কোনদিন কম পড়ে না । আর আমাদের এমনই ভাগ্য ছিল যে প্রতিদিন একজন অন্তত অতিথি বাড়িতে আসবেই সে আমার বন্ধুবান্ধব হোক কি বাবার কাছে পরামর্শ নিতে আসা গ্রামের মানুষই হোক। মা তখন নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজেই করত, ভাগ্যিস তখন চালটুকু বেশি নিয়েছিলাম। এই দুপুরে একটা মানুষ না খেয়ে গেলে সেটা খুব খারাপ হত। নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল এটা আমাদের ছেলেবেলায়।
মার ছিল সিনেমা দেখার দারুণ নেশা।বেশির ভাগই ম্যাটিনি শো দেখতে যেত নিউ সিনেমায়। আমাদের দিদিমা এবং মার দু তিনটে সাগরেদ ছিল সিনেমাযাত্রী দলে।আমি বাড়ির বড়ো ছেলে, সব দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে মা খুব নিশ্চিন্তে যেত সিনেমা হলে।হাউসফুল হলেও কেমন করে যেন টিকিট যোগাড় করে ফেলত সবার জন্য। তখন টিকিট ব্ল্যাক হত। কোন একজন ব্ল্যাকার মাকে বিশেষ করে আমাদের দিদিমাকে খুব পছন্দ করত।বাবা বাবা করে আদর করে তার কাছ থেকে টিকিট পেত অনায়াসে। খুব মস্তান ছিল সেই ব্ল্যাকার।মা ছিল তার মাসিমা। আমরা তখনও সিনেমা দেখতে যেতাম না।তবে মা যেদিন করে সিনেমায় যেত,আমাকে ঘুষ দিত, আমি যেন কাউকে বিশেষ করে বাবাকে না জানাই। দশ কুড়ি পয়সা উপার্জন বাঁধা ছিল।
আমাদের ছোটবেলায় মাকে দেখেছি প্রায় সারাক্ষণই কিছু না কিছু আবৃত্তি করতে।মহাভারত থেকে অনর্গল কাহিনী বলে যেত সুর করে। আমরা রান্নাঘরে বসে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেসব শুনতাম। আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গেছিল অনেকগুলো জায়গা। আসলে মাকে বিকেলি আসরে অনেকের মাঝখানে পাঠ করতে হত, রোটেশনে যদিও সবাই পাঠ করত তবু মহাভারতখানা আমাদের বলে মার মুখস্থ করবার দায়িত্ব বেশি ছিল।রাত জেগেও মুখস্থ করতে দেখেছি।
আমার সম্পর্কে মার একটা খুব উচ্চ ধারণা ছিল। একেবারে শেষদিকে মা যখন প্রায় শয্যাশায়ী তখন ডাক্তারের চাইতেও আমাকেই বেশি ভরসা ছিল মার।আমি যা বলব সেটাই ঠিক।এমনকি ভূমিকম্প থামিয়ে দেবার ক্ষমতাও যে একমাত্র আমারই আছে মা সেটা বিশ্বাস করত।তখন ভূমিকম্পটা একটু বেশিই হচ্ছিল আমাদের এদিকে। মা বলত ,আজ তুই বাইরে যাস না,যদি ভুমিকম্প হয়! আমি সাহস দিয়ে বলতাম এই শঙ্খটা কাছে রাখো, ভূমিকম্পের আভাস পেলেই আমি অফিস বন্ধ করে চলে আসব। বাড়ি ফিরলে প্রথমেই বলত, তুই এসে গেছিস আর চিন্তা নেই।বলে শঙ্খটা ফেরত দিত।আমার উপস্থিতিতে ভূমিকম্প হলে আমি মাকে নিয়ে একটা দরজার চৌকাঠের তলায় দাঁড়াতাম।মা খুব শক্ত করে ধরে থাকত আমাকে, আর আমি মন্ত্র পড়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভূমিকম্প থামিয়ে দিতাম।বলত, এই জন্যই তোকে বাইরে যেতে দিইনা। আজ তুই না থাকলে সবার যে কি সর্বনাশ হত!এবং যথারীতি ভূমিকম্পের পর মার ইচ্ছায় আমরা সবাই চা খেতাম, সে দিন-রাত যাই হোক না কেন। মাঝ রাত্তির হলেও আমাকেই চা করতে হত।তখন সবাই খুব হৈহুল্লোড় করতাম আমরা। আমার কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করায় মার সে কি প্রয়াস !
জীবনের শেষ দিনেও মা মিথ্যে বলা ছাড়তে পারেনি। মার আয়ারা মাকে খুব শোষণ করত। তারা দুঃখের কথা বলে মার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে চাইত। মা রোজই বলত, সেদিন যে দশ টাকা দিলি,ওষুধ এনে ফুরিয়ে গেছে, আরও দশ টাকা দিবি বাবা? দিতাম। দুদিন বাদে আবার দশ টাকা। পরে দেখি আমারই নতুন নোট দিয়ে আয়ামাসি জর্দাপান কিনছে।অনেকবার ধরেছি হাতেনাতে,কিন্তু কি আর করব, গরিব মানুষ ,আর কতই বা নেয় অমন করে।উলটে খুশিই হতাম মার মিথ্যে বলায়। 
মাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতায় একদিন এই মিথ্যের প্রসঙ্গেই লিখেছিলাম -  
তারপর একদিন সেজেগুঁজে হাসপাতালে রওনা হল 
আমাদের মা।
দুদিনেই ফিরে আসব বলেছিল যাবার সময়
মিথ্যে কথা বলেছিল সেটা। 
সারাজীবন মিথ্যে কথাই বলেছিল মা ।     
এটুকুই বলবার সৌভাগ্য হল অনেকের জেঠিমা, অনেকের মাসিমা অনেকের বৌমা সেই মানুষটির কথা। আমার মা।  


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



তুমি কিছু দিয়ে যাও... 

মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস

     চুড়ির রিন ঠিন, শাঁখা পলার মিলে মিশে যাওয়া শব্দ কোনদিন মোছেনি।কুসংস্কারের গুচ্ছ তালে আমরা ঘুচিয়ে দিয়েছি অনেকেই। না, তোমাদের অস্ব্ত্তি ছিলনা সে সব শব্দের। বয়সের ক্লান্তি কোনদিন পড়েনি। শুধুই দেখেছি দিয়ে যাওয়া। দিতে গেলে যে শুধু মন নয়, অর্থের জোর বাস্তবিক, সেও কি পরিপূর্ণ ছিল! কিন্তু শিখেছি, না, হা-হুতাশ না কখনোই, বিশেষত আত্মজ আত্মজার সামনে টুঁ শব্দটি না। সুতরাং দু:খ সমুদ্র জমে যেত দু'টি উদার ভেজা হাতের অন্তরে। আমার শৈশব থেকে যৌবন কাল আশ পাশ পরিবেশ কেবল জানিয়েছে অন্ত:রঙ্গে বহি রঙ্গে কেবল নারীসত্তাটুকু ছাড়া সবটাই'বাবা' কেন্দ্রিক। আমিও জেনেছি, খুশি হয়েছি সেই শিশুকাল থেকে যৌথ বাড়ির আদরে বড় হতে হতে পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্য, আর নিজস্ব চেতনায় বাবাই আমার ধ্যান জ্ঞান ভালবাসা অভিমত উৎসার অভিজ্ঞতা। ধীরে নিজস্বী তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসাও তাঁরই মত। 
    ক্লান্ত চোখ নিয়ে পিছনে তাকাই। ঠিক তোমার চলে যাওয়ার আগে পরে কিছুদিন থেকেই নিজেকে বলেছি, "বাহিরে ভুল হানবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কি... " একটু একটু করে ক্ষরণ শুরু হল। উপলব্ধি অনুভবে সে আমার 'মা' হয়ে ওঠায় নয়, আমার অন্তর্গত সত্তা বহুদিন থেকে জানিয়েছে কষ্টে দীর্ণ হচ্ছে একজন। যে সারাদিন তোমার কথা ভাবছে। ক্ষণজন্মা রুগ্ন এক সন্তানের জন্য অহরহ সুস্থ রাখার কথা ভাবছে। 
পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকেই বাইরের জগতের একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলে তুমি। তৎকালীন সতের বছর বয়সে সরকারী চাকরী, অসাধারণ অভিনয়। ঐ অভিনয়েই প্রেমকে চেনা। আর গড়িয়ে যাওয়া সময় আনন্দে বিষাদে। বুঝতে পেরেছি অনেক পরে সেই কবেই অশ্রুজল শুকিয়ে ফেলেছিলেন এক বালিকা বধূ, প্রথম পুত্র সন্তানের অবহেলার মৃত্যুতে, সঙ্গে বিয়ের পর পর বাড়ি থেকে জ্যেষ্ঠা কন্যা বেরিয়ে গেছে জেনে তাঁর ব্রাহ্মণ পিতার ব্রাহ্মনত্বের অভিশাপ! সব জয় করে নিয়েছিল শিখর চূড়ার বুকভরা ভালবাসা, অদ্ভুত নিরাসক্তিতে দেখেছিল সে বালিকা বধূ মাত্র সতেরতেই, তার কুশপুত্তলিকা লকলক আগুনে দগ্ধ হচ্ছে, মেয়েকে অস্বীকৃতি কোন ব্রাহ্মণ পিতার। যার ঐ আস্ফালনটুকুই সার। আর অধিকার বজায় রাখার তীব্র বাসনা জ্যেষ্ঠা কন্যার প্রতি। শুধু অসবর্ণ বিবাহ নয়, বাকি নাবালক ছেলে মেয়েদের মানুষ করিয়ে নেওয়ার বাসনায় কর্মরতা জ্যেষ্ঠা কে বেঁধে রাখার অভিলাষী পিতার ক্রোধ আগুন হয়ে ঝরে পড়েছিল। 
 মেয়েও মুখ বুজে সহ্য করে লুকিয়ে, মার সঙ্গে দেখা করা, দারিদ্রতায় সঙ্গে থাকা আর শেষ বয়সে সেই অকারণ দোর্দণ্ড প্রতাপ মানুষটি জ্যেষ্ঠার হাত ধরে তারই নাম করতে করতেই বিদায় নিয়েছিল। কোথায় ধূলিস্যাৎ ততদিনে অভিমান কলুষতার প্রাচীর। 
সবটাই আমার মার সহ্যশক্তি। যেটা বড় হয়ে উঠতে উঠতে অনুভব করেছি বাস্তবিকই। 
    যৌথ বাড়ির নানা কূট কৌশলের শিকার হতে বড় করুণ চোখে দেখেছি তখন, প্রতিবাদের প্রশ্ন ই আসেনা। 'ডেঁপো' 'পাকা' এসব তকমা তখন বাতাসে ঘোরে। মা কে কখনো ছোট হতে দেখতে ইচ্ছে করেনি। তাই এ নীরবতা। বড় পরিবারের এ উঠোন পেরিয়ে অন্য উঠোন... রান্নাঘর, কয়লা উনুন, গুল ঘুঁটের থমথমে অবস্থায় মাকে দেখেছি রূপবতী সাবলীল। একটা ছুটির দিন কি অনায়াসে তুলে রাখা কাজ পর পর সাজানো। বিকেলে মাথা ঘষা চুল ফুলে উঠতে। একঢাল চুলে বারান্দা বা উঠোনে ছড়িয়ে বসতেন মোড়ায়,উলের গুটির রঙবেরঙ দুরূহ সব ডিজাইনের সোয়েটার বুনতেন, অবশ্য ই সেটা শীতের দুপুর। কমলা রঙের রোদ্দুরের দুপুর। বিকেলে অথবা সন্ধেয় প্রায়দিনই নাটকের রিহার্সাল। আমার একেবারে ছোট্ট বেলায় বাবার অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবে সন্ধে বেলার রিহার্সাল, আমিতো থাকব ই। সমস্ত পার্ট মুখস্থ করে নেওয়া আমারও স্বভাব ছিল যে! বয়স পাঁচ বছর না হতেই মা বাবার সঙ্গে নাটক করেছি। পড়াশুনো, শাসন সব শিখিয়ে তোলার জন্য কখনো চাপ ছিলনা, দেখে শেখা ছিল সেই সময়ের শিক্ষা। বাবা যেমন বাইরের সবটা দেখছেন আর মায়ের দায়িত্ব, ইচ্ছের দৌড় মার মতই। সত্যি বলতে কি গান ভালবাসতেন খুব। প্রথম সংগীত শিক্ষার মাষ্টার মশাই এলেন আমাকে শেখাতে মার তত্ত্বাবধানে। উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীতে ভালবাসা থাকলেই তো শুধু হবেনা, তাকে সুস্থ সুন্দর সুচারুভাবে আয়ত্ব করতে হয় মা জানতেন। আমার বাড়ির ছেলেদের, বড়দের, কোন কোন দিদির গানের গলা , ভাব অপূর্ব ছিল, কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা। মা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিলেন বলতে গেলে। পড়াশুনোর ফাঁকে গানের চর্চার এক বড় জায়গা তৈরি হল। রবীন্দ্র চর্চা আর গান তো শেখা সেই কোন ছোটবেলা থেকে। এখনো যে মনে মনে মার উপস্থিতি টের পাই ঐ রবীন্দ্রসংগীত চর্চায়, রবীন্দ্রভারতী তে জোড়াসাঁকোয় পৌঁছতে পেরে। ডিগ্রী নিতে পেরেছি ঐ মার আশীর্বাদ ছিল বলেই। 
    অদ্ভুত মিঠেল আর মোহময় স্বর তাঁর। একের পর এক মুখস্থ বলতেন, 'কচ দেবযানী'... বিদায় অভিশাপ, 'কর্ণ কুন্তী সংবাদ'। মুগ্ধ হতাম। লোডশেডিং তখন বাঁধাধরা। কোন অসুবিধে হতোনা। সবাই মিলে চাঁদের আলোয়, কখনো বা মোমবাতির আলোর মধ্যে গান কবিতার খেলা খেলেছি। 
আত্মীয়, বিশেষত, মামাবাড়ির দিকের দিদিমারা যখন উচ্চারণ করত, 'রুনু, তোর মেয়েটা তোর রঙ পায়নি'। মাকে লক্ষ্য করতাম মুখ ভার হয়ে যেত। মনে মনে রাগ হত তাঁর। ছোট্ট ক্ষুদে আমারও মার জন্য কষ্ট হত। 
আসলে বেশিরভাগ মায়েদেরই বোধহয় সন্তানের জন্য নিজেকে নি:শেষ করে দিয়েই সুখ। মা কে শেষপর্যন্ত আমি সেভাবেই পেয়েছি। অসুস্থ অবস্থাতেও আমার কন্যা জন্মের পর ভার টুকু নিতে চেয়েছেন অক্ষম শরীরেই। 
কত কথা যে মা কে বলা হয়নি! কত কথা তাঁরও বলার ছিল আমাকে। ফোনে (তখন ল্যান্ডফোন) ফিসফিস করে বলতেন,... 'পরে বলব তোকে... '
সেই পরে আর এলোনা। কত মানুষ ভাল মানুষের মুখোশে সত্যিকার যত্নে তুলে রাখার সম্পদকে অবহেলা করেছে। চরম অন্যায় করেছে। দায় আমিও এড়িয়ে যাইনা। 
সেই ষাটের দশকে'এক পশলা বৃষ্টি' নাটকের জন্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে পুরস্কার তুলে নেওয়া শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, আবৃত্তির কত না পুরস্কার, শংসাপত্র , নাটক অভিনয়ে প্রথমদিকের মহিলা অভিনেত্রী যিনি উত্তর থেকে কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে নাটক করে পুরস্কৃত হয়েছেন। অসুস্থতায় বিছানায় যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত নাট্যচর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চায় নিজেকে যুক্ত রাখার ইচ্ছে বজায় রেখে গেছেন। উৎসাহ দিয়ে গেছেন সন্তানকে। শেষ মহূর্ত  পর্যন্ত কষ্টমুক্ত রাখতে নিজের জমানো বুকের ব্যথা টুকু নিজের কাছেই রেখে দেওয়া মা আমার, ক্ষমা হয়ে নেমে আসুক তোমার আশীর্বাদ। 
     এখনো যে সহ্য করি, এখনো যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চোখ তুলে তাকাতে বা শব্দ করতে পারি, এখনো যে নিজেকে মানুষ হিসেবে আলাদা চোখে দেখি আর শত নেতিবাচক ভাবধারার বিরুদ্ধে অস্তিবাদী হতে পারি এবং সে শিক্ষাও দিতে পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আর ভালবাসি মানুষ, সে তোমার জন্যই। একথা অকপটে সব অর্থেই আকাশের মত, এই বিরাট প্রকৃতির গাঢ় সবুজ রঙের মতই সত্যি। এখনো কষ্ট ব্যথায় জ্বরে বিনিদ্র রাতে তোমাকেই ভাবি বার বার। তোমার নরম আঁচল রেখ আমারই জন্য। বাতাসের নিবিড় স্পর্শে শাশ্বত হোক তোমাকে খোঁজা। 


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



তাঁর জন্যই তো এইসব 

সুদীপ দত্ত 



একটি নদীর মৃত্যু 

দৃশ্যটা এখনও মনে পড়ে খুব। একটি ক্ষীণকায়া নদী। তার পাশে বাঁধান চাতাল । মা শুয়ে আছে সেখানে। কে যেন ঝটপট খুলে নিল মায়ের শাড়িটা। চোখ বুজে ফেললাম। এরকমটাই নাকী নিয়ম। সঙ্গে যাবে না কিছুই। সব বাঁধন খুলতে হবে এখানেই। 
একটু পরে বৈদ্যুতিক চুল্লীর মধ্যে শোয়ানো হল মা- কে। এরপর কয়েক হাজার ভোল্টের তড়িৎ প্রবাহ। বোধহয় তখনই মায়ের মুখে আগুন ছুঁইয়ে ছিলাম। অথবা আগে।  মনে নেই ঠিক।  আবারও চোখ বুজে ফেললাম। 
অনেকক্ষণ পর কী যেন। কী যেন ভাসিয়ে ছিলাম সেই ক্ষীণকায়া জলধারায়। শেষ স্মৃতি, শারীরিক। 
এই নদীকে নিয়েই কবিতা লেখা হয়! তুলনা করা হয় নারীর সঙ্গে! আমি তাকে অনন্তবার অভিশাপ দিই-- ফিরিয়ে দিয়ে যা সর্বগ্রাসী রাক্ষুসি। তুই মা- কে ফিরিয়ে দিয়ে যা।
অথবা, তোরও মৃত্যু হোক এক ফোঁটা জলের শীতল স্পর্শ ছাড়া।




ছবির মানুষ 

বাবার কোনও ছবি ছিল না বলে, 
আমি কখনও মায়ের চোখে প্রতিবিম্ব দেখিনি।
অথচ সূর্য  মরে গিয়ে, চাঁদ মরে গিয়ে 
রাত্রির নিশুত অন্ধকার, মায়ের সারা শরীরে 
খেলা করেছে সীলমোহরের যৌনতার মতো।
অথচ আমি তখন স্তন্যপানের জন্যে
অথচ  আমি  তখন উষ্ণতা আহরণের জন্যে
মায়ের বুকে মুখ রেখে অমৃতের সন্ধান করেছি। 
মা কখনও বলেনি যে 
আমি কখনও শুনিনি যে 
শূণ্য অমৃতকলস শুষ্ক নারীহীন 
শূন্য অক্ষিগোলক রামধনু ছবিহীন, তবে
বাবার কোনও ছবি না থাকলেও
ছবিহীন বাবা কত অনায়াসে 
ছবির মানুষ হয়ে ছু়ঁয়ে ফেলেছে
এপার ওপার মরে যাওয়া সমস্ত অবয়ব!


 



" এক যে আছে মা...."

রীনা সাহা 


   
           বারেবারে হাত ধোয়া,স্যানিটাইজ করা, সকাল থেকে রাত eye drop দেওয়া। বিরক্তির রঙ লাল? হবে হয়তো। তবে কালো চশমা পড়া মায়ের চোখের দিকে তাকালে সব বিরক্তি সাদা হয়ে যায়। 
    
       বাইরে থেকে দেখে মাকে এখন অন্ধ লাগে। তবু বেশ বুঝতে পারি কালো চশমার ভেতর থেকে  এক হৃদয়ের সঙ্গী খোঁজে মা, অকালমৃত ছেলেকে খোঁজে। দু'জনের কেউ বেঁচে নেই, তবুও খোঁজে।

       যে ছেলে বেঁচে নেই, তার সঙ্গে কিডনি ডোনার মায়ের একটা কিডনি পুড়ে ছাই। আর একটা ফ্যামিলি পেনশনে চলে। মোটা মাইনের রিটায়ার্ড বড় ছেলে, বৌমা আর মা। তবুও মায়ের ভাগের অর্ধেক পেনশন না হলে সংসার সুখের হয় না। পঁচাত্তরের মা যতটা খাবার খায় তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা দেয় , পাড়াপড়শির এ যুক্তি ধোপে টেকে না।

      হাতে পায়ে এখনও সচল মা, রান্নাঘরের সাইড হেল্পার। বড় ছেলের মার্বেল মোড়া বিল্ডিং হবে।ভালবাসায় অন্ধ মা, নিজের অংশ লিখে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ভুলেও ভাবেনি নিজের টিনশেডের ঘর আর বাথরুম পুরোনো হবার অজুহাতে ক'দিন বাদেই বেমানান হবে। 

       ইদানিং মায়ের দুচোখে পুরু ছানি, অপারেশন হবে। বৌমার আবদার, ছেলের আদেশ---- মেয়ের ফ্ল্যাট ছোট হলেও সেখানেই যেতে হবে। একেবারে দুচোখের ছানি কাটিয়ে, পুরোপুরি অন্ধত্ব সারিয়ে তবেই যেন বাড়ি ফেরে মা। নিজের বাড়িতে "survival of the fittest " হয়ে কতদিন থাকতে পারবে, বৌমার চার তলার ঠাকুরও হয়তো জানে না।

        এখনো কি মায়ের চোখে তেমনি রাগ থাকবে , যে রাগ ছেলেমেয়েদের ছোটবেলায় ছিল। পড়তে বসতে দেরি হলে বিছানা ঝাড়ার ঝাঁটা হাতে ঘরময় দাপিয়ে বেড়ানো কিংবা স্কুল থেকে বাবা ফিরে এলে বদমাইশির ফিরিস্তি দিয়ে মার খাইয়ে স্বস্তি পাওয়া---- মায়ের চোখের কালো চশমা খোলার অপেক্ষায় মেয়ে।

       নাতি- নাতনির ছোটবেলাও বড় হয়েছে, ঠাকুমার আদর- সোহাগে। কোটিপতি নাতি, আমেরিকায়। নাতনি ফ্রান্সে। বড় বালাই টাইম- ডিসট্যান্স। ঠাকুমার সাথে কথা হয় না। আমেরিকায় যখন দিন, ভারতে মাঝরাত। মেয়ে বোঝায়, মা বোঝে না।

       সাতদিন পার, মা এখন মুখ ধোয়। চোখে জল যায়। একটুআধটু জল লাগলেও ক্ষতি নেই, মা জানে। লুকিয়ে রাখা মোবাইল ঘাঁটে, ফাঁকা কল লগ। চোখে জল আসে। তড়িঘড়ি কালো চশমা,  ওয়াইপার খোঁজে।

           দশ বাই দশ ফুটের satin finish Dulux দেয়াল, গুমোট লাগে। তাই দুচোখে ড্রপ দেওয়া হলে এক মিনিট শুয়ে থেকে ছাদে উঠে যায়। হাজার স্কোয়ার ফিটের তেপান্তরের মাঠ। একান্নবর্তী পরিবারের পূর্ববাংলার মেয়ে, বড় বাড়ির মা, Parapet দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ের বাড়ির আকাশ থেকে নিজের বাড়ির আকাশ খোঁজে। সে আকাশ ছেলের ব্যূহে, বধ্যভূমি কুরুক্ষেত্রে।

           কালো চশমায় গান্ধারী মা, যদুবংশের কথা ভাবে। এ যুগের পরশুরামের বাক্যবাণে আধমরা মা। তবু নিজের বংশ ধ্বংস চায় না, অভিশাপ দেয় না। উপেক্ষায় বিদ্ধ মা উলুপীর মতো, পরশমণির ছোঁয়ায় বাঁচিয়ে তোলে অর্জুন। বেঁচে যায় বব্রুবাহন।

        বিদুরের খুদে তৃপ্ত মা, পরের জন্মে মা হলেও, সন্তান চায় না। তাঁর চোখের সবটা জুড়ে ছাদ আকাশের সূর্য এখন। হাতে ধরা কবচ কুণ্ডল। কর্ণের মতো ছেলে হোক ---- লড়াই করে ছিনিয়ে আনুক মায়ের বাড়ি, টিনশেডের সাম্রাজ্য।

           নিরীহ মা, " নিলোভনা " হতে পারেনি। চোখে চোখ রেখে বলতে পারেনি "A man can be destroyed but not defeated". দুর্বল মা, পুরু ছানির বাধা সরিয়ে অস্তিত্বের লড়াই লড়তে পারেনি। তাই Marmee March মায়ের চোখে সাদা চশমা ওঠার অপেক্ষায় মেয়ে।


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



"মা"--এই বিশ্বের এক পবিত্রতম উচ্চারণ

গৌতমেন্দু নন্দী


মা,  জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী--স্বর্গের থেকে সুন্দর, পবিত্র। মানবজীবনের অস্তিত্ব,তার  বেড়ে ওঠার মূলে বৈজ্ঞানিক সত্য হল গর্ভধারিনীর মাতৃজঠরে শিশুর দীর্ঘ সময়ের সযত্ন লালনোত্তর ভূপৃষ্ঠের বুকে সেই নবজাতকের আলোকিত হওয়া।

  সেই নবজাতকের  অবচেতনে তার  অস্ফুট উচ্চারণ "মা" এর মধ্য দিয়েই রচিত হয় মাতৃরূপী বটবৃক্ষের স্নেহছায়ায় মধুর,পবিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক--- এক নির্ভরতার সম্পর্ক। যে সম্পর্ক " জড়িয়ে আছে  ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যা রাতের তারায় ... বিশ্ব ভুবন মাঝে যাহার নেইকো তুলনা...." সেই মাতৃরূপের " ললাটের সিঁদুর নিয়ে ভোরের রবি ওঠে, আলতা পরা পায়ের ছোঁয়ায় রক্ত কমল ফোটে...…" 
      
মাতৃ স্নেহ প্রদীপ হয়ে আমার শিয়রে বেশি দিন জেগে থাকতে পারে নি। কৈশোরেই বঞ্চিত হয়েছি 
মাতৃ স্নেহ থেকে। অকাল মাতৃ বিয়োগ বিশ্বকবির জন্ম লগ্নেই। কৈশোরের সেই নিজস্ব অক্ষর উচ্চারণ  প্রতিটি পঁচিশে বৈশাখেই এখনও আমার স্মৃতিচারণ--

   " .....বিশ্ব মাঝে বিশ্ব কবির জনম শুভক্ষণ 
   আমার চোখে তখন শুধুই গভীর আঁধার ক্ষণ।
       চলছে যখন কবিগুরুর নৃত্য-গীতে বরণ
      বদ্ধ ঘরে আমি তখন করছি মা কে স্মরণ।
       বাল্য, কৈশোর ,যৌবন--জীবনের প্রান্তে 
      জীবন-মৃত্যুর দুটি সুর "পঁচিশ"এই পাই শুনতে.."
     
             কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথাতেই--------
 " যে মটিতে ভর দিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি
   আমার দুহাতের দশ আঙ্গুলে তাঁর স্মৃতি।
   আমি যা কিছু স্পর্শ করি সেখানেই হে জননী তুমি
   আমার হৃদয় বীনা তোমার হাতেই বাজে.....।."

         জননী, জন্মভূমি আজ আক্রান্ত, অবহেলিত, অপমানিত। মূল্যবোধহীন, আত্মমগ্নতার কুশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজের বৃহৎ অংশ। কংক্রিট--নগরায়নের "ফ্ল্যাট কালচার"এ নির্বাসিত  বয়স্ক, অসুস্থ, সঙ্গীহারা মাতৃ সমাজের বড় অংশ। দশ মাস দশ দিনের গর্ভধারিনী যেমন একাকীত্বের যন্ত্রণা, অবহেলার শিকার তেমনি জননীরূপী এই জন্মভূমির মাটিও আজ তার সন্তানদের লোভ, ক্ষমতা,দম্ভের কারণে কলুষিত, দূষিত এবং রক্তাক্ত।

          তাই আজ এই বোধ জাগ্রত হোক এই সমাজ এই সভ্যতায়,এই দেশ এই বিশ্বে এবং উচ্চারণ         করি সবাই আজ-------

  "...জননী মোর জন্মভূমি তোমার পায়ে নোয়াই মাথা
 স্বর্গাদপী গরীয়সী স্বদেশ আমার ভারত মাতা।
   তোমার স্নেহ যায় বহে মা শত ধারায় নদীর স্রোতে ঘরে ঘরে সোনার ফসল ছড়িয়ে পড়ে আঁচল হোতে.."



মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 




মার হাতে স্টিয়ারিং 
উজ্জ্বল আচার্য 

আমরা সবাই যাত্রী। স্টিয়ারিং, হ্যাঁ, মার হাতে। জীবনের স্টিয়ারিং।এই পৃথিবীর জীবন পথে সকলের গন্তব্যই কিন্তু এক । এক অনিশ্চিত অজানা পথ। পথের শেষ কোথায় কি আছে শেষে কেউ জানে না। হামাগুড়ি থেকে শুরু করে মায়ের দু হাত ধরে হাঁটতে শেখা তারপর ক্রমশ জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।সবই হয় মায়ের সাথে থেকে মায়ের পাশে থেকে । মা এক বিষম শব্দ মা এক নির্ভরতা মা এক আশ্রয়স্থল মা এক শান্তির স্থল। মা এক স্বস্তি মা এক শান্তি মা এক সুখ মা এক পীড়ালাঘব শব্দ। মা এক ভরসা মা এক গতি মা এক আত্মনির্ভরতা মা এক যুদ্ধ জয়।
তখন কতই বা বয়স হবে ছয় বা সাত। মা  হাসপাতালে। আমার জন্য এক ভাই আনতে গেছে। বাড়িতে মা ছাড়া কি ভালো লাগে। কাকার সাথে মার সাথে দেখা করতে যাওয়া। ভাইকে দেখে মার সাথে কথা বলে যখন ফিরব মা তখন একটা ঠোঙ্গায় একটা কলা আর একটা ডিম আর হাতে দশ পয়সা দিয়ে দিল।ডিম কলা পয়সা পেয়ে সে কি যে আনন্দ। তখন কি আর ছাই বুঝতাম মা নিজে না খেয়ে হাসপাতালের খাবার ডিম আর কলা আমার জন্য রেখে দিয়েছে। এই সময় এইটুকু খাবার মার খুব দরকার। মায়েরা এরকমই হয়। দশ পয়সা তখন অনেক দামি দুধ মালাই পাওয়া যেত দশ পয়সায়। আর পাঁচ পয়সায় আইসক্রিম। পাশের বাড়িতে থাকত এক আইসক্রিমওয়ালা কাকু। মাসে এক দু'বার উপায় হতো ওনার কাছ থেকে পয়সা দিয়ে আইসক্রিম বা দুধ মালাই খাবার। তবে আইসক্রিম কাকুটি ছিল খুব ভালো। রাতে বাড়ি ফিরে এসে মাঝে মধ্যেই আমায় বলতো যা একটা গ্লাস নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে গ্লাস নিয়ে এলে আইসক্রিম কাকু বাক্স থেকে এক গ্লাস আইসক্রিম গলা জল আমায় দিত।মনের আনন্দে আইসক্রিম গলা জল খেয়ে খুব তৃপ্তি পেতাম সে সময়। ইস মার দেওয়া দশ পয়সায় আগামীকাল একটা দুধ মালাই খেতে পারব। কি যে আনন্দ হচ্ছে। 
ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। স্কুল বন্ধ।হঠাৎ সেদিন বন্ধু দীপঙ্কর বাড়িতে এসে বলল  সাহেবগঞ্জ যাবি? ওখানে একটা ক্লাবে স্পোর্টস এর অনুষ্ঠান হবে। তুই আর আমি নাম দেব। যদি পুরস্কার জিততে পারি বাড়িতে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দেব। খেলাধুলায় কোনদিনই আমি পারদর্শী ছিলাম না। স্কুলের খেলাধুলায় সেভাবে অংশগ্রহণও করতাম না।  তবু বন্ধু দীপঙ্করের পীড়াপীড়িতে সাহেবগঞ্জের ক্লাবে গিয়ে লংজাম্পে নাম দিলাম দুজনে। দীপঙ্কর যদিও বা কোয়ালিফাই করল আমি লং জাম্পের সময় মুখ থুবরে পড়ে গেলাম। নাক ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো।ক্লাবের কর্মকর্তাদের  তৎপরতায় সুস্থ হয়ে এসে বাড়িতে মাকে বললাম আমি কেন প্রাইজ পেলাম না মা?  আমার মা সংক্ষেপে উত্তর দিলেন -গাছে উঠতে পারিনা বড় ফলটা আমার! তোর দ্বারা খেলাধুলা হবে না, পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর।
অনেক দিন পরের কথা। আমার এক সিনিয়র দাদা ছিলেন জ্যোতির্ময়দা। তার পুরনো গাড়ি বিক্রি করবেন বলে আমায় দেখাতে নিয়ে গেছেন বাড়িতে। যদি আমি কিনি বা অন্য কাউকে প্রস্তাব দিই সে কারণেই। সকাল সকাল জোতির্ময়দার বাড়ি গেছি। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার সময় দেখি সেখানে এক বিছানা, আর বিছানায় এক বয়স্কা মহিলা। বয়স্কা মহিলার মুখটা করুণ। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে মাসিমা? এখানে কেন?
তুমি কি আমার ছেলের কাছে এসেছো?
আপনার ছেলে! জ্যোতির্ময়দা  আপনার ছেলে?
হ্যাঁ বাবা জ্যোতি আমার ছেলে।
তা আপনি গ্যারেজে কেন?
আসলে এটা তো একটা মস্ত বাড়ি, সিঁড়ি ভাঙ্গা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না রে বাবা। তাই জ্যোতি আমার এখানে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ছি ছি মাকে কেউ গ্যারেজ ঘরে রাখে? এত বড় লোক জ্যোতিদা। বড্ড নিচ মনে হল।জ্যোতিদা এত নিম্ন রুচির এত নিম্ন মানসিকতার  জানলে এখানে আসতামই না। কিছু না বলে গাড়ি না দেখেই বের হয়ে এলাম। জীবনে আর জ্যোতির্ময়দামুখো কখনো হইনি।
গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন দেবাশীষ বাবু। সদ্য পিতৃহারা সে। মা ছেলে বউয়ের সংসার। কিন্তু কিছু কিছু জীবন কেন যে এরকম জটিল করে তোলে নিজেদেরকে ভাবলে অবাক হই। শহরে এসে কাজের লোকের অভাবে সংসারে অশান্তি। বড্ড চাপ গিন্নির। দুবেলা অশান্তি। বাড়িতে মা সব কাজে হাত লাগাতো। এখানে লোকের বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কালচার। চেষ্টা করেও জুটছে না সব সময়ের জন্য কাজের মাসি। হঠাৎ স্ত্রীর পরামর্শে গ্রামের জমি জমা বিক্রি করে সবকিছু আত্মসাৎ করে মাকে নিয়ে এসে তুলল বাড়িতে। কাজের লোকের চিন্তা নাকি দূর হয় স্বামী-স্ত্রীর। বাইরে এরাই আবার মুখোশ পরে থাকে। মাতৃভক্তি পিতৃভক্তি নিয়ে বক্তব্য রাখে। জ্যোতির্ময়ের একমাত্র সন্তান এখন ড্রাগ এডিক্ট আর দেবাশীষের মেয়ে ক্লাস টুয়েলভ পাস করেই কোন লম্পট ছেলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। স্টিয়ারিং সঠিকভাবে চালনা করতে না পারলে কত অঘটনই না ঘটে যায় জীবনে।
একবার ক্লাস এইটে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় রেজাল্ট একটু খারাপ হয়েছিল। মা সন্ধ্যেবেলায় ডিম লাইটের চিমনি মুছতে মুছতে বলল -বেশি পাকিস না আর ফাঁকিবাজ হোসনা। ফাঁকি দিলে এমন ফাঁকে পড়বি জীবনে উঠতে পারবি না। বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়, মনে রাখিস কথাটা।ম্যাজিকের মত কাজ হল কথাটায় । বড্ড মন খারাপ হলো সেদিন। সত্যি তো সব মা-বাবাই চান ছেলে পড়াশোনা করুক। মানুষের মত মানুষ হোক। পড়াশোনা ছাড়া এই বয়সে আর আছে কি। বাবা সে সময় একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছিলেন। মার অনুমতি নিয়ে বাড়িতে ওটা চালানো হতো। দিনে দুবার। স্কুল থেকে ফিরলে আর রাতে ভাত খাবার সময়। সাকুল্যে আধঘন্টা। আমার প্রিয় খাবার ছিল রাতে আলু সেদ্ধ আর ঘি ভাত। মাধ্যমিক দেব সেবার। এক রাতে ঘি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাবা হয়তো আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। বাবা সেসময় পার্টি করতেন। আর সে কারণেই বাড়িতে সব সময় নেতা-মন্ত্রীর ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। বাবার  সময় অযথা কেটে যাচ্ছিল। বাবার সময় নষ্ট হচ্ছিল। মার মনে হল সংসারের ক্ষতি হচ্ছে এতে।
বাবাকে সেদিন বললেন তোমার দ্বারা পার্টি হবে না। ছেলেদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সংসারের প্রতি দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট খামতি দেখা যাচ্ছে। তুমি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছ ক্রমশ । আজ ছেলের ঘি এর কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ। ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু ভুলে যাবে। সংসারটার ক্ষতি হবে। সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। তোমার দ্বারাও পার্টি হবে না। তারপর থেকে বাবা অনেক চেঞ্জড।মার কাছে তার সন্তানেরা আসল হীরে মানিক। মায়েরা জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন সন্তানের জন্য । আর সন্তানেরও উচিত মার যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার। মার প্রতি কোন অন্যায় অবিচার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।মার আশীর্বাদ সন্তানের উপর থাকলে কোন অশুভ শক্তি কোন ক্ষতি করতে পারে না । মা তোমার প্রতি রইল অনেক শ্রদ্ধা ও প্রণাম। তোমার জন্যই পৃথিবীতে আজ এত কিছু পেয়েছি মা। খুব ভালো থেকো মা।


 


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



ডোনার
মৌসুমী চৌধুরী 

"সরি টু সে  মিসেস সেন , বাস্তবটাকে  অ্যাকসেপ্ট করুন, প্লিজ। আপনার শরীরে সুস্থ ডিম্বাণু উৎপন্ন হচ্ছে না। অনেক ওষুধ প্রয়োগ করেও সেটা পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগ ডোনারের ব্যবস্থাও তো আপনারা করেছিলেন। আপনার হাসবেন্ডের শুক্রাণু দিয়ে ডোনারের  ডিম্বাণুর নিষেক ঘটানো সম্ভব হল না প্রথম দু'বার। শেষ দুটো প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দু'বারই ভ্রূণ আপনার জরায়ুতে ইমপ্ল্যান্ট করবার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই মিসক্যারেজ হয়ে গেল! অর্থদন্ড হল আপনার, চার চারটে এক্সপেরিমেন্ট ফেইলিওর হল আমাদের!" 
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থেমেছিলে- ন ডঃ বি.এম মুখার্জি তারপর আবার বলতে শুরু করেছিলেন,
—" মন খারাপ করেবন না। মা হবার জন্য অন্য রাস্তা বেছে নিন এবার। বেটার টু গো ফর অ্যাডপশান। সেটা মানতে না পারলে আবার নতুন কোন ডোনারের খোঁজ করুন।"

         ডঃ মুখার্জির কথাটা শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মল্লিকা। তার পৃথিবী যেন নিমেষেই আলোহীন, নিকষ কালো! তার সাতাশ বছরের জীবনে সে শুধু একটাই জিনিস চেয়েছিল। একজনের মতো হতে চেয়েছিল সে। হ্যাঁ, একদম মায়ের মতো হতে চেয়েছিল। মায়ের মতো স্বাদে- গন্ধে অতুলনীয় রান্না করতে, চটপট হেলদি ব্রেকফাস্ট বানাতে, জ্বরে মাথায় মায়ের মতো শীতল জলপট্টি দিতে, পা মচকে গলে হলুদ চুনের টোটকা দিতে, সন্তানের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কঠিন কঠিন সব পাঠ্য বিষয়কে মুশকিল আসান করে তুলতে ... সব সব সবকিছুই মায়ের মতো করতে চেয়েছিল মল্লিকা!  আসলে আদ্যন্ত একজন মা হতে চেয়েছিল সে। অথচ তার সন্তান তার শরীরের অংশই হবে না? হবে না তার নাড়ি ছেঁড়া ধন ? বায়োলজিক্যালি সে কারও মা-ই হতে পারবে না? দমকে দমকে বুক ফাটা কান্না বেরিয়ে আসতে থাকে মল্লিকার ভিতর থেকে।
         গত তিন বছর ধরে ডঃ বি. এম মুখার্জির ক্লিনিকে আই.ভি.এফ পদ্ধতিতে ইনফার্টিলিটির ট্রিটমেন্ট চলছিল মল্লিকার। তার শরীর থেকে  সুস্থ ডিম্বাণু পাওয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু নানা মেডিক্যাল টেস্টের পর ডাক্তারেরা কনফার্ম হয়েছিলেন বেবী ক্যারি করতে কোন রকম অসুবিধেই নেই মল্লিকার। কৃষ্ণেন্দুর শুক্রাণুও সুস্থ ও সক্রিয়। তাই ডিম্বাণু ডোনারের সাহায্য নিয়েছিল তারা। ডোনারের ডিম্বাণু ও কৃষ্ণেন্দুর শুক্রাণু নিয়ে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতিতে মল্লিকাকে সন্তান সুখ দিতে চেষ্টা করছিলেন অভিজ্ঞ ডাক্তার- দের টিম। কিন্তু তাঁদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। ভাঙা টুকরো টুকরো মন নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরে এসেছিল মল্লিকা আর কৃষ্ণেন্দু।

   শীতের বেলা বড্ড তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। পশ্চিমের বারান্দায় বসে মল্লিকা দেখছিল কমলা রঙা আলো ছড়িয়ে দিয়ে চোখের সামনে দিগন্তরেখায় ডুবে যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল  দিন। ধীরে ধীরে ফিকে শ্লেট রঙে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা আকাশটা। হঠাৎ দূরে ফুটপথে নজর পড়ে তার। ছেঁড়া-ন্যাকড়া পরা ভিখিরি এক মা পরম যত্নে চুল আঁকড়ে দিচ্ছে তার বাচ্চা মেয়েটার। একটা স্বর্গীয় মা মা আলো যেন ঠিকরে পড়ছে ভিখিরি মায়ের মুখ থেকে। সহসা তাকে খুব ধনী আর নিজেকে খুব গরীব মনে হতে লাগল মল্লিকার। সমস্ত বুকটা হু হু করে উঠল। দৌড়ে ঘরে গিয়ে বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। এখন শোবার ঘরটা অন্ধকার। অনেকক্ষণ শুয়ে আছে মল্লিকা। ঠাকুরঘর থেকে শাঁখ আর ঘন্টা বাজানোর শব্দ পেল। বোধহয় চম্পা মাসী সন্ধে দিচ্ছে। উত্তরের ব্যালকনির দরজাটা আর ঘরের জানালাগুলো খোলা। সেদিক দিয়ে বাইরের স্ট্রীট লাইটের আলো আর তিরতিরে উত্তুরে বাতাস ঘরে ঢুকে লুটেপুটি খাচ্ছে। সন্ধে ঘন হতেই খোলা জানালার দিয়ে দূরের হাইরাইজ আবাসনগুলোর আলোকিত খোপ খোপ জানালা দেখা যাচ্ছে। আনমনে সেই আলোর দিকে তাকিয়ে  মল্লিকা ভাবছিল ওই আলো, হাসি, গান ক্রমশঃ কি তার থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে? কতদিন ছাদ আর বারান্দার গাছগুলোর পরিচর্চা করা হয় নি! কত্তদিন রেওয়াজেও বসেনি সে! জীবন কেমন যেন থেমে গেছে। সব ইচ্ছেগুলো হঠাৎ যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে! কৃষ্ণেন্দুও কেমন থম মেরে গেছে আজকাল। তিন বছর বিয়ে হয়েছে তাদের। আগে কখনও এমন দেখেনি হুল্লোড়বাজ, আড্ডাবাজ কৃষ্ণেন্দুকে। নিজেকে বড় অপরাধী মনেহচ্ছে মল্লিকার। কৃষ্ণেন্দুর চোখে চোখ রাখতে পারছে না। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বুক খালি করে বেরিয়ে আসে। তখনই  দরজা খোলার খুট করে একটা শব্দ হতে সেই চেনা মিষ্টি বকুলফুল ফ্লেভারের পারফিউমের গন্ধটা নাক ছুঁয়ে দিল মল্লিকার আর তার কপালে সেই চিরন্তন শীতল স্পর্শ... মা-আ-আ-আ। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল সে। তার ভিতরের সমস্ত নোনা জল যেন গল গল করে বেরিয়ে আসছে। 
  চিরটাকাল মেয়ের সমস্ত লড়াইয়ের পাশে থেকেছেন অপরাজিতা। আজ মেয়ের এই কান্নায় বড় অসহায় বোধ করতে লাগলেন তিনি। মেয়েকে ঘিরেই তো তাঁর জীবন আবর্তিত হয়ে চলেছে আজও। মনটাকে এক লহমায় শক্ত করে নিয়ে তিনি বললেন,
— " বী ব্রেভ, মলি! কান্নায় তো কোন সলিউশন উঠে আসবে না। ওঠ। শক্ত হ।
চল তো আজ দু'জনে একটু রেওয়াজে বসি। বহুদিন এই সব নানা চক্করে তোতে -আমাতে ডুয়েট গাওয়া হয় না।"।

— " নাহ্। ভালোলাগছে না,মা। কিচ্ছু ভালোলাগে না আজকাল।"

— "না না ওঠ। শরীর ও সর্বোপরি মন দুইই তো সুস্থ রাখতে হবে, মা। চল চল... আর আমি তো আছি সোনা। একটু ভাবতে দে আমাকে।"
বলতে বলতে নিজের বড় ট্রলিটা টেনে ঘরের এক কোণে রাখেন অপরাজিতা। 

—  এই বুড়ো হাড়েও একটু বাতাস লাগুক দেখিনি। দিন-রাত তোর বাবার ফাই-ফরমাশ খেটে খেটে জীবন আমার একেবারে কয়লা হয়ে গেল রে। গলা থেকে সুর তো বিদায় নিতে বসেছে। চল আজ মায়ে-ঝিয়ে একটু প্রাণ খুলে গাই।"
  পরিবেশটাকে হালকা করবার চেষ্টা  করেন অপরাজিতা। 

           মা এলে যেন এক ঝলক তাজা আনন্দ বাতাস বয়ে যায় মল্লিকার মনে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— " কে আমার মাকে বুড়ো বলে শুনি? 
কার এত বড় সাহস? তুমি তো এভার
গ্রীন, মা! ছেচল্লিশেও ইউ আর লুকিং লাইক ছত্রিশ।"

— " সেকি! একেবারে দশ বছর কমিয়ে দিলি? এটা একটু বেশি হয়ে গেল না? হাঃ হাঃ হাঃ... "
শব্দ করে হাসতে থাকেন  অপরাজিতা। 

— " মোটেও না।  তোমাকে আমাকে একসঙ্গে দেখলে আজও বন্ধুরা বলে কাকীমাকে দেখতে তোর দিদির মতো লাগে! 
  দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে মল্লিকা। 

— " নে নে কথা রেখে এবার তানপুরাটা নিয়ে আয় তো। নয়তো তুই বোস, চম্পাকে দিয়ে যেতে বলি।" 
  অপরাজিতা তাড়া লাগান মেয়েকে।

— "তোমার জীবনীশক্তি অফুরান, মা। আচ্ছা, তুমি আজই চলে যাবে না তো ?"
মল্লিকা জিজ্ঞেস করে। 

— "না রে। ক'দিন থাকব বলেই এসেছি।
 কিছুদিন মেয়ের আদর খেয়ে যাই।"
  হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে নিজের জামা-কাপড়গুলো বের করতে থাকেন তিনি । 

—"সত্যিইইইই??? ইয়া হু... তা তোমার পোষ্য, তোমার বাগান, তোমার অফিসের কি হবে? "
আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে মল্লিকা।

— " সব কিছু থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়েছি। আমার এই সোনাটার জন্য।"
বলে মল্লিকার চিবুক ছুঁয়ে আদর করেন অপরাজিতা। 

  আজ সকালে উঠে বহুদিন পর তার ছাদ বাগানে এসেছে মল্লিকা। ছাদেই নানা সাইজের টবে তার বহু গাছ। বোগেনভিলিয়া গাছে ঝেঁপে ডীপ পিঙ্ক কালারের ফুল এসেছে। বেলি ফুটেছে থোকা থোকা। চোখ বুজে বাতাসে ছড়ানো তার মিষ্টি গন্ধটা নাকে টেনে নিল। এছাড়া রয়েছে নিম, লেবু, লাউ মাচা প্রভৃতি। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে যেন মর্নিং প্রেয়ার করছে। সকালের নরম রোদে সবকিছু ভারী ভালোলাগে মল্লিকার। শখ করে একটা বড় সিমেন্টের টবে সবেদা গাছ লাগিয়ে -ছে কৃষ্ণেন্দু। ভালো ফলও হয় তাতে। সবেদা গাছটার তলায় মৃদু মৃদু বাতাসে আলো-ছায়া এক্কা-দোক্কা খেলছে৷ সববেদার ডালে বাসা বেঁধেছে একটা চড়ুই পরিবার। তারাই কিচিরমিচির করছে। হঠাৎ মল্লিকা দেখে খুব ছোট্ট  তিনটি চড়ুই ছানা হাঁ করে মুখ উঁচু করে আছে আর চড়ুই মা ঠোঁটে করে তুলে তাদের খাবার খাইয়ে দিচ্ছে! কী সুন্দর দৃশ্য! বিভোর হয়ে চেয়ে থাকে সে। চড়ুই মাও কত ভাগ্যবতী। সেও মা! চোখ জলে ভরে ওঠে মল্লিকার। ভগবান শুধু তাকেই মাতৃত্বের সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। অভিমান গাল বেয়ে নেমে আসতে থাকে৷ সহসা মল্লিকা অনুভব করে করে তার পিঠে কোমল হাতের সেই পরিচিত স্পর্শ। এই স্পর্শই তাকে বার বার কঠিন পরিস্থিতির মুখেও আগলে ধরে...



— " আপনার নাম? 
— "অপরাজিতা দত্তগুপ্ত।'

"আপনার ঠিকমতো পিরিয়ড হয় তো?"
— হ্যাঁ।

— "ফ্লো কেমন?  ক'দিন থাকে?"
  সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করেন ডঃ মুখার্জি। 

—" ফ্লো ভালোই। ওই মোটামুটি পাঁচদিন 
  থাকে।"

— " আগে কাউকে কখনও এগ ডোনেট করেছেন ?"
ডঃ মুখার্জি জানতে চান।
— " নাহ্..."

— " বয়স কত আপনার? বাচ্চা আছে?"
 পর পর প্রশ্ন করেন ডঃ মুখার্জি। 
— " ছেচল্লিশ। হ্যাঁ, একটি মেয়ে আমার।
 আপনার পেশেন্ট মল্লিকা সেন আমারই মেয়ে। আমি আমার মেয়েকেই ডিম্বাণু 
ডোনেট করতে চাই।"

এবার সোজাসুজি অপরাজিতার চোখে
চোখ রেখে ডঃ মুখার্জি বলে ওঠেন,
— " মিসেস দত্তগুপ্ত , 'ল'জ্ রিলেটেড টু ডোনেশন অফ এগ ইন ইন্ডিয়া'-তে 
এগ-ডোনারের বয়স কিন্ত পঁয়ত্রিশ উল্লেখ আছে। আর মা তাঁর মেয়েকে এগ ডোনেট করতে চাইছে এক্ষেত্রে  কোন লিগ্যাল ইসু হলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।"

— " সেটা আমরা জানি, ডাক্তারবাবু। লিগ্যাল ব্যাপারগুলো আমরাই দেখে নিচ্ছি। আপনি পরবর্তী ধাপের দিকে এগিয়ে চলুন।" 
এবার সোজাসুজি উত্তর দেয় মল্লিকা।
— " ওওকে।"
 তাহলে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে নিই, 
— "আপনার মাকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে উর্বরতার ওষুধ খেতে হবে। এই ওষুধগুলি সাধারণত মৌখিকভাবে বা সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হবে, যা ডিম্বাশয়ের ফলিকলগুলিকে উদ্দীপিত করবে। এটি একটি নিয়মিত চক্রের চেয়ে বেশি ডিম্বাণু পরিপক্ক করে।"

— "ঠিক আছে কোন অসুবিধে নেই।"
    অপরাজিতা উত্তর দেন।

 একটু থেমে ডাক্তারবাবু আবার বলতে
শুরু করেন,
— " ডিম্বাশয় উদ্দীপিত হওয়ার পরে, আপনার ডিম্বাণু এবং ফলিকুলার বিকাশের নিরীক্ষণের জন্য আপনাকে  আমাদের এখানে ৫-৭ বার আসতে আসতে হবে। আর এটিই সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ অংশ।"
 — "ঠিক আছে, তাই আসব।"
অপরাজিতা সম্মতি জানান। 

    সুরেলা রিংটোনে ফোনটা অনেকক্ষণ থেকে বেজে চলেছে। বাগানের অর্কিডগুলোর পরিচর্চা করছিল মল্লিকা। আজকাল প্রায় সময়ই গাছদের সঙ্গে  কাটায় সে। মন ভালো থাকে। মাঝে মাঝে যেতে হয় ডঃ মুখার্জির ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকে। বাকী সময়টা গান শোনে, বই পড়ে। মা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসে রয়েছেন তার কাছে। তিনি আর চম্পা মাসী মিলে সংসারের সব কাজ সামলে নিচ্ছেন। 
ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে মল্লিকা। দেখে ডঃ মুখার্জির ক্লিনিক থেকে ফোন, 
— "হ্যালো... "
— "মিসেস্ মল্লিকা সেন ম্যাডাম
    বলছেন?
— " হ্যাঁ, বলছি।"
—" অভিনন্দন ম্যাডাম! আপনি কনসিভ
 করেছেন। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট এসে গেছে। তিন সপ্তাহ হয়েছে..."
        মল্লিকা ফোন রেখে ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। অপরাজিতাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে হু হু করে কেঁদে ফেলে সে। 
 


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



ঠিকানা
 উদয় সাহা

অতি বিলাসিতা কখনোই পছন্দ ছিলনা ৷ তাই ভ্যাপসা গরমে এনবিএসটিসি-র নীল সাদা বাসে একটি জানালার পাশের সিট পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে ঋদ্ধিমা ৷ আজ সারাদিন ভীষণ ধকল গেছে ওর। খুব সকালে বাস ধরে শিলিগুড়ি ; সেখান থেকে নাসিং হোম ; সেখান থেকে আবার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখন সব সেরে ফিরতি বাসে বাড়ি ফেরার পথ। মাঝে বিরতি বলতে দুপুরের খাবার সময়টুকু কোনোরকম। তাই বাসে উঠেই সিটে বসে জানলার দিকে মুখ করে অল্প ঘুমোবার চেষ্টা করে ঋদ্ধিমা। যদিও গরম, তবু জানালা দিয়ে ছুটে আসা বাতাসটুকুতে শান্তি। 

চোখ বন্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছে না৷ অবচেতনে এখন শুধুই চিকিৎসার খরচ, মাসিক খাইখরচা, ব্যাঙ্কের ইএমআই আরো অনেক কিছু৷ মা এর শরীরটাও সুবিধের নয়৷ সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতা। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে গোশালা মোড় এসে গেছে, ঋদ্ধিমা বুঝতেই পারেনি৷ চোখ খুললে সে দেখতে পায় বাস ততক্ষণে ভিড়ে ঠাসা৷ তিল ধারণের জায়গা নেই৷ ওর সিটের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো কম বয়েসি ছেলে৷ পরনে ইউনিফর্ম। স্পষ্টত দুজনেই সিভিক ভলান্টিয়ার। বয়স খুব বেশি হলে ছাব্বিশ- সাতাশ। 
বাসে ওঠার পর থেকেই অনর্গল কথা বলে চলেছে। প্রথমত গরম, তার উপর ভিড়ে ঠাসা বাসে কানের সামনে এত কথা! খানিকটা বিরক্তি বোধ করল ঋদ্ধিমা৷ 

ওই দুজন সিভিক ভলান্টিয়ার এখনো কথা বলছে৷ শুনতে না চাইলেও কানে আসছে ঋদ্ধিমার৷ কাজের সূত্রে ওরা বন্ধু৷ বিভিন্ন বিষয় ঢুকে পড়েছে ওদের কথায়৷ বসবার একটাও সিট নেই। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকা৷ ওরাও বাড়ি ফিরছে ডিউটি শেষে। বাড়ি ফেরার আনন্দ যে কী! ঋদ্ধিমা জানে৷ প্রতি শনিবার ওর বাবা পথ চেয়ে থাকতো ওর জন্য৷ মেয়ে একটা সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরবে৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঋদ্ধিমা শুনছে ওদের কথা। ওদেরও বেতনের সাথে সামান্য কিছু ডি.এ. জোটে৷ উপরি পরিশ্রমে আরো কিছুটা টাকা বাড়তি পায় ওরা৷ সব রকমের কথাই বিনা দ্বিধায় সরল মনে ভিড় বাসে আলোচনা করছে ওরা। 
এর মাঝেই ওই দুজনার একজন বলে, ' বেতনটা তো আজও পেলাম না বন্ধু... এই দিকে আগামী সপ্তাহে পহেলা বৈশাখ। আসলে প্রথম মাস তো তাই অপেক্ষাটা বেশি৷ সেই সাথে আনন্দটাও৷ জীবনের প্রথম উপার্জন, বন্ধু। এবার তাই পহেলা বৈশাখে মা কে একটা গিফট্ দেবো। আর কিচ্ছু চাই না, ব্যস...'

এতক্ষণ জানলার বাইরে চোখ ছিল। কান ছিল উড়ে আসা ওদের কথায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ঋদ্ধিমা তাকিয়ে আছে সেই ছেলেটির দিকে, যে কিনা প্রথম বেতন দিয়ে... ঋদ্ধিমা এক লহমায় তেরো বছর পেছনে চলে গেল। সে ও ঠিক একইরকম ভেবেছিল৷ স্বপ্নের স্কুলের চাকরি ; প্রথম বেতন ; বাবা-মা এর জন্য উপহার। ঋদ্ধিমার বাবার খরচের হাতটা ভীষণ বেপরোয়া। তাই ইচ্ছে থাকলেও কখনো বেতনের পুরোটা বাবার হাতে তুলে দিতে পারে নি৷  এসব ভেবে নিজেকে খুব অপরাধী বোধ হয় তার৷ বাবা নেই আজ চার বছর। মা এর হাতেও যে একগুচ্ছ টাকা একসাথে তুলে দিতে পেরেছে, তা নয়৷ দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো৷ মা-বাবা আর নিজেকে নিয়ে তিলে তিলে গড়া এই ছোট্ট সংসারকে সব কিছুর আগে রেখে আর কিছুই তেমন করা হয় নি। তবে বছরের প্রথম দিনে বাড়ির সবাইকে উপহার দিতে কখনো ভুল হয়নি ওর। 

' নতুন চাকরি পেয়েছ৷ অভিনন্দন তোমাদের। তোমরা কোথায় নামবে? ' ঋদ্ধিমা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে ওদের।
'এই তো, দিদি ঘোকসাডাঙ্গা ' 
'আচ্ছা, তোমাদের কথাগুলো আড়ি পেতে শুনছিলাম। ভালো লাগলো। আসলে আমাদের সবার ঠিকানাগুলো এক... যাইহোক, এমনটাই থেকো। লড়াইটা চালিয়ে যেও৷ আবার কখনো নিশ্চয়ই দেখা হবে '
'আসছি,দিদি' বলে নেমে যায় ওরা

এক মিনিট আগেই ঘড়িতে সময় দেখছিল ঋদ্ধিমা। আবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে টাচ করল। ওর স্ক্রিনসেভারে মা এর একখানা উজ্জ্বল ছবি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ঋদ্ধিমা৷ জানলা দিয়ে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আসছে৷ ভালো লাগছে। 


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 




মা 

বেলা দে 

"মা"  শব্দ উচ্চারণে অন্তস্থল ছুঁয়ে ওঠে নির্ভীক প্রাণময়তা, সান্ত্বনার এক দৃঢ়তম অঙ্গীকার। যে দিতে পারে সমস্ত জাগতিক ঝড়ঝাপটা সরিয়ে এক পরিষ্কার আকাশ।  আজ যে মায়েরা ঝান্ডা উড়িয়ে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ উত্তাল ক'রে হেঁটে চলে গর্ভধারিণীরা গ্রাম শহর, একদিন তারা এমনটা ছিল না। লালপেড়ে শাড়িতে একমাথা সিঁদুর রাঙিয়ে পর্দানসীন গৃহবধু, কাকভোরে নিত্যকার পূজাপাটের
পর পা রেখেছে হেঁশেলঘরে। হেঁশেল থেকে আতুরঘর তার পরিধিবিস্তার, আমার গর্ভধারিণী  ছিলেন ঠিক এমনই, সপ্তম সন্তানের কনিষ্ঠা হয়েআমি যা দেখেছি দাদা-দিদিরা দেখেছে অনেক বেশি। ধানউঠান জুড়ে থেকেছে শালপাট, ত্রিপলঝাঁটা, আর কাকতাড়ানো লাঠি। ধানসেদ্ধ শুকনো  থেকে ধান ভাঙা সব মায়ের নিত্যকর্মের মধ্যে। দাদা-দিদিরা হাত বেটেছে বড় হয়ে। সেই লালভোরে ঘুম ভেঙেই ছরাঝাট আর কাঠের উনুনে গরম গরম মুড়ি ভাজা, কি স্বাদেই না খেয়েছি কাঠাভরা টাটকা  মুড়ি, রকমারী বিস্কুটে স্বাদবদল সেকালে কোথায়!  ছিল তৃপ্তি বেকারির জিরে বিস্কুট আর পাউরুটি।  সুতরাং সকাল সন্ধের জলখাবারে ভরসা মায়ের শিল্পী হাতের গরম গরম ভাজা স্বাদেলা  মুড়ি। অথচ একসময় মা ছিল বিক্রমপুরের ডাকসাইটে  জজবাড়ির মেয়ে,  যৌথ পরিবারে জ্যাঠামশাই  জজ, কাকা লন্ডনে বসত করা ডাক্তার, মেম বিয়ে করে সেখানে থাকলেও সপরিবারে যাতায়াত করেছেন এদেশে। মায়ের বাবা ঢাকা থানার বড় দারোগা। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হলে প্রথম গ্রামদর্শন বাবার হাত ধরে। কুলো ব্যবহার করা  জানতো না বলে ঠাকুমা বলে বসেছে ১২ বছরের  মেয়েকে " বয়স তো পাহাড়ের সমান কাজের বেলায় ঠনঠন। গ্রামে একমাত্র কুয়ো বাবার বাড়িতে, মুসলিম রমনীরা জল নিতে এলে কুয়ো ছুঁতে দেয়নি, দিনভর কলস কলস জল মাকেই তুলে দিতে হয়েছে দিন মাস বছর। সব সয়েছে মা নীরবে নি:শব্দে, জন্ম থেকেই মাতৃহীন আমার মা কে ঈশ্বরই বোধকরি সহনশীলতায় মজবুত করে দিয়েছে, আজীবন এভাবেই কেটেছে তাঁর পুরুষসিংহ বাবার সাথে।উঠোনে পাটকাঠির আতুর ঘরে বসে সন্তানদের রান্না করে খাইয়ে দিয়েছে কোনো দায়ভার ছিল না বাবার। ধরিত্রীর মতন  সহনশীল মা আমার শেষকালে ভেঙে পড়েছে  রোগযন্ত্রণায় ভুগে ভুগে, প্রায়শই বলতো মা আক্ষেপের সুরে" জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো, ঘর বা ঘরের মানুষটার কোনো দোষ নেই রে সব আমার কর্মফল। এক মা কতটা শক্তি ধারণ  করতে পারে সে নিজেও জানে না,  মা না হওয়া ইস্তক নারীও বোঝে না ময়দানের অবস্থান। 

আজ অনুভব করি শুধু নিয়েই গেলাম মায়ের কাছ থেকে।  কিছুই দেওয়া হল না। আবার পরজন্মে মা হয়ে এসো আমার জড়িয়ে রেখো বুকের ওমে।