Thursday, May 2, 2024

 


মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১



রূঢ়ের রাণীর আহ্বানে

আকাশলীনা ঢোল 

বাঙালি অত্যন্ত ভ্রমণপিপাসু। অবশ্য সব বাঙালির কথা বলতে পারব না, তবে অধিকাংশ বাঙালিই কিন্তু বেড়াতে যেতে, নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখতে ভালবাসে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। বেড়াতে যাওয়ার আকর্ষণে ছোটবেলার থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়িয়ে এসেছি। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু এখনকার ব্যস্ত জীবনে বেশ কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, তেমন হয়ে ওঠে না। বড় জোর একরাত্রির জন্য কাছাকাছি কোথাও যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু, তাই বলে তো আর ভ্রমণপিপাসু মনটাকে দমিয়ে রাখা যায় না। তাই, মনের তৃষ্ণা মেটাতেই ‘রূঢ়ের রাণীর’ আহ্বানে একরাতের জন্য এবার ঘুরে এলাম ‘ভারতের রূঢ়’ দুর্গাপুর থেকে। 

       কলকাতা থেকে প্রায় একশো আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল। এই স্থানে প্রচুর পরিমাণে কয়লা পাওয়া যাওয়ায় এখানে গড়ে উঠেছিল বহু শিল্প, কল-কারখানা। সেই কারণেই দুর্গাপুরকে বলা হয়ে থাকে ‘ভারতের রূঢ়’। কলকাতা থেকে রেলপথে বা সড়ক পথে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় দুর্গাপুর শহরে। এই শহরে একদিকে যেমন রয়েছে শিল্প-কারখানা, তেমনই রয়েছে বহু দেবদেবীর মন্দির, দামোদর-অজয়ের মতো নদ। এমনকি বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনারও সাক্ষী এই শহর। বসন্তের শেষ লগ্নে তার প্রাকৃতিক শোভাও চোখে পড়ার মতো। 

    মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আমরা গিয়েছিলাম দুর্গাপুরে। কলকাতা থেকে বাসে দুর্গাপুর সিটি সেন্টার, সেখান থেকে গাড়িতে দুর্গাপুর ভিড়িঙ্গি মোড়। থাকা-খাওয়া এবং বেড়ানোর জন্য গাড়ির বন্দোবস্ত কলকাতা থেকেই করে গিয়েছিলাম। হাতে সময় খুব কম, তাই হোটেলে পৌঁছে খানিক বিশ্রাম নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। 





হোটেল থেকে আমরা যখন বেরোই, তখন সূর্য মধ্যগগনে। কাজেই, মধ্যাহ্ন ভোজনের পর্বটি পথে সেরেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম দুর্গাপুর ব্যারেজের পথে। সেখানে রয়েছে দামোদর নদ, এবং সন্ধ্যাকালে নদীর ধারে সন্ধ্যারতির আয়োজনও করা হয়ে থাকে। ব্যারেজ দেখে, আমরা রওনা হলাম দেবী চৌধুরানীর গড়ের উদ্দেশ্যে। সেখানে রয়েছে ভবানী পাঠক টিলা। কথিত আছে ঘন জঙ্গলে ঢাকা দুর্গাপুর একটা সময় ছিল ভবানী পাঠকের রাজত্ব। অবশ্য রাঢ় অঞ্চলে দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠকের অবস্থান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, তবু এই বিশ্বাসের জেরেই হয়তো উক্ত অঞ্চলটির স্থানীয় নাম ‘গড় জঙ্গল’ হয়েছে। বর্তমানে সেখানে একটি পার্কও গড়ে উঠেছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম দুর্গাপুর ইস্কন মন্দিরের উদ্দেশ্যে। মন্দির যাওয়ার রাস্তাটি বড় সুন্দর। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছগুলি যেন সবুজ মাথা তুলে স্বাগত জানাচ্ছে। পথের মধ্যে নির্মিত রয়েছে শিল্পীর অপূর্ব সব শিল্পকর্ম। অবশেষে, আমরা পৌঁছে গেলাম ইস্কন মন্দিরে। অত্যন্ত পবিত্র ও মনোরম স্থান এটি। মন্দিরের বিগ্রহ হিসেবে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। মন্দির চত্বরে রয়েছে একটি রাস মঞ্চ। মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম কুমার মঙ্গলম পার্কের উদ্দেশ্যে। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নির্মিত এই পার্কে রয়েছে একটি সুবৃহৎ জলাশয়, সারি সারি ঝাউগাছ, নানা ধরনের ফুলের সমারোহ এবং লজ্জাবতী লতার লাজুক হাসি। জলাশয়ের জলে বোটিং- এরও ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ছোট ছোট দু-একটি রেস্তোরাঁ ও ছোটদের খেলার পৃথক জায়গা। পার্কে ভ্রমণের পর্ব শেষ হলে আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। 

    সন্ধ্যাবেলায় আমরা রওনা হলাম দুর্গাপুরের মূল আকর্ষণ শিব শক্তি ধাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। দুর্গাপুরের গোপাল মাঠে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নির্মিত এই মন্দিরের উপাস্য দেবতা দেবাদিদেব মহাদেব। এছাড়াও সেখানে রয়েছে হর-পার্বতী, সিদ্ধিদাতা গণেশ, হনুমানজির বিগ্রহ। গর্ভগৃহের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিকৃতি। মন্দির গাত্রে রয়েছে সূক্ষাতিসূক্ষ পাথরের কাজ। সন্ধ্যাবেলায় নানা ধরনের আলোকসজ্জা মন্দিরের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করে। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যারতি দেখার জন্য সেখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়। আরতি শেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের বন্দোবস্ত রয়েছে। শিব শক্তি ধামে আরতি দেখে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম দুর্গাপুর রাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। এই মন্দিরে উপাস্য দেবতা শ্রীরামচন্দ্রের পাশাপাশি রয়েছে সীতা মাতা এবং পবনপুত্র হনুমানজির বিগ্রহ। মন্দিরের পরিবেশ খুবই মনোরম এবং সন্ধ্যাকালে উপস্থিত হওয়ায় সেখানেও আরতি দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। মন্দির দর্শন করে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। প্রথম দিনের ভ্রমণের পর্বটি এখানেই সমাপ্ত হল। 

    পরের দিন ফেরার জন্য ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল আগে থেকেই। তবু হাতে কিছুটা সময় হাতে থাকার কারণে সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে আমরা রওনা হলাম ভিড়িঙ্গি কালীবাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন সেই মন্দিরে রয়েছে মা কালী, মহাদেব এবং হনুমানজির বিগ্রহ। মন্দির দর্শনে আরও একটি বিরল দৃশ্যের সাক্ষী থাকেন ভক্তেরা, মন্দিরের একটি অংশে দেখা যায় হনুমানজির স্কন্ধে মা কালী উপবিষ্টা। কথিত আছে ১৮৫২ সালে অর্থাৎ সিপাহী বিদ্রোহের পাঁচ বছর আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিদ্ধপুরুষ তান্ত্রিক অক্ষয়কুমার রায়। বর্তমানে দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভক্ত আসেন বেনাচিতি বাজারের এই মন্দিরে। লোকবিশ্বাস রয়েছে যে, ভিড়িঙ্গি মন্দিরে এসে দেবীর কাছে কিছু প্রার্থনা করলে তা পূরণ হয়। মন্দির দর্শন করে আমরা পুনরায় হোটেলে ফিরে এলাম। আমাদের দুর্গাপুর ভ্রমণের পর্বটি এখানেই সমাপ্ত হল। 

    এবার ফেরার পালা। রূঢ়ের রাণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপস্থিত হলাম রেল স্টেশনে এবং গাড়িও রওনা হয়ে পড়ল সময় মতোই। আমাদের বিদায় জানাতেই যেন উপস্থিত ছিল রুক্ষ কঠিন মাটি, গাছের শুকনো ডালপালা আর শিল্পাঞ্চলের গরম লু হাওয়া। যে হাওয়ায় ভেসে আসছিল একটানা একটি গানের সুর- ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা/ মনে মনে’। ধীরে ধীরে সুর মিলিয়ে গেল ট্রেনের চাকার আওয়াজে। আর আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল মহানগরের দিকে।  


No comments:

Post a Comment