Friday, May 3, 2024


 

মুনা 

অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪৩১

ক্রোড়পত্র 



ঠিকানা
 উদয় সাহা

অতি বিলাসিতা কখনোই পছন্দ ছিলনা ৷ তাই ভ্যাপসা গরমে এনবিএসটিসি-র নীল সাদা বাসে একটি জানালার পাশের সিট পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে ঋদ্ধিমা ৷ আজ সারাদিন ভীষণ ধকল গেছে ওর। খুব সকালে বাস ধরে শিলিগুড়ি ; সেখান থেকে নাসিং হোম ; সেখান থেকে আবার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখন সব সেরে ফিরতি বাসে বাড়ি ফেরার পথ। মাঝে বিরতি বলতে দুপুরের খাবার সময়টুকু কোনোরকম। তাই বাসে উঠেই সিটে বসে জানলার দিকে মুখ করে অল্প ঘুমোবার চেষ্টা করে ঋদ্ধিমা। যদিও গরম, তবু জানালা দিয়ে ছুটে আসা বাতাসটুকুতে শান্তি। 

চোখ বন্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছে না৷ অবচেতনে এখন শুধুই চিকিৎসার খরচ, মাসিক খাইখরচা, ব্যাঙ্কের ইএমআই আরো অনেক কিছু৷ মা এর শরীরটাও সুবিধের নয়৷ সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতা। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে গোশালা মোড় এসে গেছে, ঋদ্ধিমা বুঝতেই পারেনি৷ চোখ খুললে সে দেখতে পায় বাস ততক্ষণে ভিড়ে ঠাসা৷ তিল ধারণের জায়গা নেই৷ ওর সিটের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো কম বয়েসি ছেলে৷ পরনে ইউনিফর্ম। স্পষ্টত দুজনেই সিভিক ভলান্টিয়ার। বয়স খুব বেশি হলে ছাব্বিশ- সাতাশ। 
বাসে ওঠার পর থেকেই অনর্গল কথা বলে চলেছে। প্রথমত গরম, তার উপর ভিড়ে ঠাসা বাসে কানের সামনে এত কথা! খানিকটা বিরক্তি বোধ করল ঋদ্ধিমা৷ 

ওই দুজন সিভিক ভলান্টিয়ার এখনো কথা বলছে৷ শুনতে না চাইলেও কানে আসছে ঋদ্ধিমার৷ কাজের সূত্রে ওরা বন্ধু৷ বিভিন্ন বিষয় ঢুকে পড়েছে ওদের কথায়৷ বসবার একটাও সিট নেই। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকা৷ ওরাও বাড়ি ফিরছে ডিউটি শেষে। বাড়ি ফেরার আনন্দ যে কী! ঋদ্ধিমা জানে৷ প্রতি শনিবার ওর বাবা পথ চেয়ে থাকতো ওর জন্য৷ মেয়ে একটা সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরবে৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঋদ্ধিমা শুনছে ওদের কথা। ওদেরও বেতনের সাথে সামান্য কিছু ডি.এ. জোটে৷ উপরি পরিশ্রমে আরো কিছুটা টাকা বাড়তি পায় ওরা৷ সব রকমের কথাই বিনা দ্বিধায় সরল মনে ভিড় বাসে আলোচনা করছে ওরা। 
এর মাঝেই ওই দুজনার একজন বলে, ' বেতনটা তো আজও পেলাম না বন্ধু... এই দিকে আগামী সপ্তাহে পহেলা বৈশাখ। আসলে প্রথম মাস তো তাই অপেক্ষাটা বেশি৷ সেই সাথে আনন্দটাও৷ জীবনের প্রথম উপার্জন, বন্ধু। এবার তাই পহেলা বৈশাখে মা কে একটা গিফট্ দেবো। আর কিচ্ছু চাই না, ব্যস...'

এতক্ষণ জানলার বাইরে চোখ ছিল। কান ছিল উড়ে আসা ওদের কথায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ঋদ্ধিমা তাকিয়ে আছে সেই ছেলেটির দিকে, যে কিনা প্রথম বেতন দিয়ে... ঋদ্ধিমা এক লহমায় তেরো বছর পেছনে চলে গেল। সে ও ঠিক একইরকম ভেবেছিল৷ স্বপ্নের স্কুলের চাকরি ; প্রথম বেতন ; বাবা-মা এর জন্য উপহার। ঋদ্ধিমার বাবার খরচের হাতটা ভীষণ বেপরোয়া। তাই ইচ্ছে থাকলেও কখনো বেতনের পুরোটা বাবার হাতে তুলে দিতে পারে নি৷  এসব ভেবে নিজেকে খুব অপরাধী বোধ হয় তার৷ বাবা নেই আজ চার বছর। মা এর হাতেও যে একগুচ্ছ টাকা একসাথে তুলে দিতে পেরেছে, তা নয়৷ দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো৷ মা-বাবা আর নিজেকে নিয়ে তিলে তিলে গড়া এই ছোট্ট সংসারকে সব কিছুর আগে রেখে আর কিছুই তেমন করা হয় নি। তবে বছরের প্রথম দিনে বাড়ির সবাইকে উপহার দিতে কখনো ভুল হয়নি ওর। 

' নতুন চাকরি পেয়েছ৷ অভিনন্দন তোমাদের। তোমরা কোথায় নামবে? ' ঋদ্ধিমা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে ওদের।
'এই তো, দিদি ঘোকসাডাঙ্গা ' 
'আচ্ছা, তোমাদের কথাগুলো আড়ি পেতে শুনছিলাম। ভালো লাগলো। আসলে আমাদের সবার ঠিকানাগুলো এক... যাইহোক, এমনটাই থেকো। লড়াইটা চালিয়ে যেও৷ আবার কখনো নিশ্চয়ই দেখা হবে '
'আসছি,দিদি' বলে নেমে যায় ওরা

এক মিনিট আগেই ঘড়িতে সময় দেখছিল ঋদ্ধিমা। আবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে টাচ করল। ওর স্ক্রিনসেভারে মা এর একখানা উজ্জ্বল ছবি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ঋদ্ধিমা৷ জানলা দিয়ে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আসছে৷ ভালো লাগছে। 

No comments:

Post a Comment