Sunday, February 14, 2021

মুজনাই সাপ্তাহিক  









ডুয়ার্স : সামান্য আলোকপাত 
শৌভিক রায় 

আজকাল কথায় কথায় ডুয়ার্স শব্দটির ভীষণ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ডুয়ার্সে বেড়ানো নিয়ে হরেক কথা, নানা ধরণের  সূচী, পথের দু`পাশে 'ডুয়ার্সে স্বাগতম' জাতীয় বার্তা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুয়ার্স নিয়ে বহু গ্রূপ ইত্যাদি দেখে ধরে নেওয়া যায় যে, ডুয়ার্স সম্পর্কে সকলের কমবেশি জানা আছে। কিন্তু একটু বিশদে গেলে দেখা যায় যে, ডুয়ার্স ব্যাপারটি কি সে সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশেরই কোনো ধারণা নেই। আর এই দেখানদারির যুগে দার্জিলিং বা কার্শিয়াং পাহাড়ে গিয়ে ছবি তুলে 'ডুয়ার্সে বেড়ানো` শীর্ষক অ্যালবাম হরদম দেখে সত্যি হতাশ হই এই ভেবে যে, আমরা চিরদিন হুজুগেই মেতে রইলাম, কোনো কিছুর ভেতরে ঢুকবার চেষ্টা করলাম না। 

ডুয়ার্স আদতে কী ? কোথা থেকেই বা এল এই শব্দটি? এর জন্য একটু ভুগোল ও ইতিহাস জানা দরকার। 
ডুয়ার্স শব্দটি আসলে এসেছে ইংরেজি 'ডোর' (দরজা) বা হিন্দুস্থানী 'দ্বার`শব্দটি থেকে। ডোর বহুবচনে হয় 'ডোরস'। 'দ্বার`-এর সঙ্গেও 'এস' যোগ করে ইংরেজরা দিব্যি 'দ্বারস' বলে চালাতো। কালক্রমে সেই শব্দই ডুয়ার্স-এ পরিণত হয়। কিন্তু কিসের দ্বার বা দুয়ার? ভুটান থেকে সমতলে আসবার জন্য ভুটানিরা মোট ১৮টি গিরিপথ ব্যবহার করত। এই ১৮টি গিরিপথের মধ্যে কিছু ছিল বাংলায় আর বাকি আসামে। মোটামুটিভাবে তিস্তা নদীর পূর্ব থেকে আসামের ধানসিঁড়ি নদী পর্যন্ত এই দুয়ারগুলির বিস্তার ছিল। একটু দেখে নেওয়া যাক এই ১৮ দুয়ারের অবস্থান- 
১/ ডালিমকোট (বর্তমান কালিম্পঙ জেলায়), ২/ ময়নাগুড়ি বা জুমের কোর্ট (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৩/ চামুর্চি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৪/ লক্ষী বা ল্যাককি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৫/ বক্সা বা পাশাখা (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলায়), ৬/ ভল্কা বা ভুলকা (বর্তমান আলিপুদুয়ার জেলায়), ৭/ বরা (বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ৮/ গুমর ( বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ৯/ রিপো (বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ১০/ চেরাং ( বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ১১/ বাগ বা ছোট বিজনি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১২/ বুড়িগুমা (বর্তমান আসামের দরং জেলায়), ১৩/ কালিং (বর্তমান আসামের দরং জেলায়), ১৪/ শুরকুল্লা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৫/ বংসকা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৬/ চাপাগুড়ি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৭/ চাপাঘামা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৮/ বিজনি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়)। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রথম ১১টি স্থান ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল ডুয়ার্স ও বাকি ৭টি জায়গা আসাম ডুয়ার্স নাম পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ আর এভাবে ভাগ করা হয় না। বরং সংকোশ নদীকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বিভাজনকারী নদী হিসেবে ধরে নিয়ে সংকোশের পশ্চিম থেকে তিস্তা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগকে ডুয়ার্স বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। 

এই বিস্তীর্ণ ভূভাগ কিন্তু একটা সময়ে গহন অরণ্যে ঘেরা ছিল। হিংস্র পশু, খরস্রোতা নদী, অবিরাম বৃষ্টি এবং প্রায় জনমানবহীন এই ভূখণ্ড নিয়ে ইংরেজদেরকে খুব কিছু মাথা ব্যথা ছিল না। তাই তারা তাদের এই অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রথমদিকে সেভাবে মনোযোগী হয় নি। কিন্তু তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের সূচনা হলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চল সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বাড়ে। কালিম্পঙ সে সময় সিকিমের অংশ ছিল এবং কালিম্পঙের মধ্যে দিয়ে তিব্বতে পৌঁছনো যেত। ১৭০৬ সালে ভুটান রাজ্ সিকিমের হাত থেকে কালিম্পঙকে ছিনিয়ে নেন। ভুটানের সঙ্গে যেহেতু তিব্বতের সুসম্পর্ক ছিল, তাই ব্রিটিশরা ভুটানকে চটাতে চায় নি নিজেদের স্বার্থে। এদিকে তিস্তা নদী থেকে  সংকোশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, ধীরে ধীরে সেগুলিও ভুটান দখল করে। মাঝে কেটে যায় অনেকগুলি বছর। ইংরেজরা ক্রমশ কোচবিহারের গুরুত্ব বুঝতে পেরে কোচবিহারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং অবশেষে ১৮৬৫ সালে সিনচুলা সন্ধির মাধ্যমে ভুটানের হাত থেকে একটি বিরাট অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয় যার মধ্যে ছিল কালিম্পঙ, রংপুর, কামরূপ জেলার সীমা অবধি অংশ। 

এই দখলে নেওয়ার পেছনে ইংরেজদেরকে ব্যবসা-বুদ্ধি কাজ করেছিল। সেটি কী তা জানতে হলে আর একটি দিকে আলোকপাত করতে হবে। কেননা যে ইংরেজরা ১৭৭৫ সালেও মনে করছে যে, এই অঞ্চল নিজেদের দখলে নেওয়া মানে বোকামি করা, সেই ইংরেজরা হঠাৎ করে ৫০/৬০ বছর যেতে না যেতে না যেতেই কেন এই অঞ্চল সম্পর্কে এত উৎসাহী হয়ে উঠল? শুধু কি তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য একমাত্র লক্ষ্য ছিল? নাকি আরও কিছু? অনুসন্ধান করা যাক সেই কারণ। 

সবুজ সোনা বা চা একটা সময় ছিল শুধুমাত্র চিনের নিজস্ব উৎপাদন। চীন সম্রাট শেঙ যে পানীয় খেয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন তা ছিল চা। চতুর্দশ শতকে সমগ্র চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।   সপ্তদশ শতকে ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীদের হাত ধরে চা পৌঁছে যায় ইউরোপে। উষ্ণ এই পানীয়টি ইউরোপ অত্যন্ত সমাদর পায়। ইংল্যান্ডে চা প্রায় জাতীয় পানীয়ের পরিণত হয়েছিল। ১৮৩৩ অবধি ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে ইউরোপে চা-চালানে একচেটিয়া রাজত্ব করত। কিন্তু এরপর ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি এসে গেলে তাদেরকে কড়া মোকাবিলার সম্মুখীন হতে হয়। ইতিমধ্যেই কিন্তু ব্যবসায়ী ইংরেজরা ভাবতে শুরু করেছিল যে, যদি তাদের অধীনে চা-বাগান থাকত তবে তাদের মুনাফা নিয়ে ভাবনা থাকত না। সেসময় ইংরেজদের ভাগ্যলক্ষ্মীও সহায় ছিল।হয়ত সেই কারণেই, ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস আসামের জঙ্গলে চা-গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে, ধূর্ত ইংরেজরা ১৮২৫ সালে দ্রুত আসাম দখল করে চা-চাষে উদ্যোগী হয়। তাদের উদ্যোগ সফল হয় ১৮৩৮ সালে।  সে বছর লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিলামে আসামের চা বিক্রি হয় এবং সুগন্ধের জন্য অচিরে সেই চা ইউরোপ সাড়া ফেলে। এর ফলে আসামের চায়ের এক নতুন দিগন্ত খুলে যায় ও দলে দলে ইংরেজ আসামে আসতে শুরু করে। আসাম তার চায়ের জন্য পৃথিবী-বিখ্যাত হয়ে ওঠে।  

এদিকে ১৮৪১ সালে ডঃ ক্যাম্পবেল দার্জিলিঙে নিজের বাড়িতে খানিকটা শখেই চা-গাছ পুঁতেছিলেন। সেই গাছ তরতরিয়ে বেড়ে ওঠায় ইংরেজরা বুঝেছিল যে, দার্জিলিঙের মাটি ও আবহাওয়া চা-চাষের অনুকূল। তাই দার্জিলিঙের সিভিল সার্জেন মেজর গ্রামলিনের হাত ধরে দার্জিলিঙে একের পার এক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ডুয়ার্সের মাটিও যে চা-চাষের অনুকূল সেটা বুঝতে ইংরেজরা বুঝতে পারে নি বলে  ডুয়ার্স এইসব ব্যাপার থেকে তখনও অনেকটা দূরে ছিল। অবশেষে ১৮৭৪ সালে ডুয়ার্স অঞ্চলে যখন চা-চাষে সাফল্য এলো, তখন ডুয়ার্সের গভীর জঙ্গল কেটে শুরু হল চা-বাগান প্রতিষ্ঠার কাজ। মাত্র কয়েক বছরেই ডুয়ার্সের নানা অঞ্চলে গড়ে উঠলো ১৯টি জনপদ শুধুমাত্র চা-বাগানকে কেন্দ্র করে। আর চা-বাগান তৈরির কাজে ছোটনাগপুর, নেপাল ও সিকিম থেকে নিয়ে আসা হল শ্রমিকদের। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ডুয়ার্সের চা-শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকেরা। বাকি ২০ শতাংশ শ্রমিক নেপাল ও সিকিম থেকে আনা হয়। অদ্ভুতভাবে ডুয়ার্সের নিজস্ব আদিবাসী  সম্প্রদায়ের মানুষেরা কিন্তু চা-শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত হন নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চা-বাগানের ইতিহাসে সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা যোগ দিচ্ছেন না এরকমটা কিন্তু দেখা যায় না। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ডুয়ার্সের ইতিহাস মূলতঃ চা-বাগান কেন্দ্রিক। একসময়ের ঘন অরণ্য যেমন চা-বাগান তৈরিতে কাটা হয়েছে, তেমনি বনজ সম্পদের লোভে বানিয়া ইংরেজরাও সেই অরণ্য বহুল অংশে নষ্ট করেছে। তবে এটা ঠিক যে, তাদের হাতে প`রেই ডুয়ার্স ভারত তথা পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে। ডুয়ার্স সম্পর্কে  সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়েছে। দেশবিভাগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ সারা দেশের সঙ্গে ডুয়ার্সকেও নিতে হয়েছে। ফলে আরও কমেছে অরণ্যভূমি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দূষণ বেড়েছে। ট্যুরিজমের নামেও কম নষ্ট হয় নি ডুয়ার্সের সৌন্দর্য ও সরলতা। চা-বাগানগুলির ধুঁকতে থাকা চেহারা ও তার সঙ্গে আদিবাসীদের দারিদ্র ও দুরাবস্থা ডুয়ার্সের অপূর্ব চিত্রের একদম বিপরীতে থাকা অসহায় এক ছবি। এখানকার জানা-অজানা অজস্র নদীও আজ নাব্যতা হারিয়ে বা বাঁধ নামক মনুষ্য-সৃষ্ট বাধায় স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে দিশেহারা। কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমান। আবার কখনও অতিবৃষ্টিতে বিপন্ন হচ্ছে ডুয়ার্সের জীবন। জঙ্গলে খাবারের অভাব হেতু পশুদের লোকালয়ে আগমন আজকাল প্রায় নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন অরণ্যে আজ আর বাঘ নামক ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণীটিকে দেখা যায় না। 

তবু ডুয়ার্স আমাদের গর্ব, আমাদের স্বপ্নের এক জায়গা যেন। কিন্তু যখন ডুয়ার্সের নাম করে না জানা তথ্য বা ঘটনা পরিবেশিত হতে দেখি তখন কষ্ট হয় বৈকি! উত্তর-সহ পশ্চিমবঙ্গের একটি বিরাট অঞ্চলের ফুসফুসের কাজ করা ডুয়ার্স যদি রক্ষা না পায়, তবে উত্তরের নীলপাহাড়, বেগবতী নদী, সবুজ অরণ্য আর সহজ-সরল মানুষের উত্তরবঙ্গ তার সবকিছুই হারাবে।        

মুজনাই সাপ্তাহিক


  










ডুয়ার্স 
অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত) 

হাজার কাজের ফাঁকে যখন হাঁপিয়ে ওঠে প্রাণ খুঁজে পেতে চায় একটু নিরিবিলি আর একঘেয়ে জীবনে একটূ মুক্ত অক্সিজেন পেতে যখন ছটফট করে মন, ঠিক তখনই গিরিরাজের পাদদেশে বিস্তীর্ণ বনভূমি, উঁচু-উঁচু পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। বুকভরা সতেজ চায়ের সুবাস মাখা সকালে রিসর্টের বারান্দায় বসে ময়ূরের কেকা ও অচেনা পাখীর দল উজ্জীবিত করে তোলে এই অবকাশ। আর অলস দুপুরে কুলকুল করে বয়ে চলা এক চিলতে নদী ও ঝিঁঝিঁর দল গান শুনিয়ে যায়। 

এমনই সকল উপলব্ধি হয় ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার ডুয়ার্স -এর বিভিন্ন পর্যটক স্থানে। 

ডুয়ার্স মানেই দরজা বা প্রবেশদ্বার।এটি পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশের পশ্চিমবঙ্গ ও অসম নিয়ে গঠিত।  ভুটান ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ, এই ডুয়ার্স এর জন্যই সম্ভবপর হয়েছে।
ডুয়ার্সে একটি সুন্দর চা বাগান আছে,  যার পেছনে পটভূমিতে হিমালয়ের অবস্থান।হিমালয়ের পাদদেশ তথা সমভূমি ও পর্বত অঞ্চলের মিলনস্থানে ডুয়ার্স এর অবস্থান।ডুয়ার্সকে সংকোশ নদী দুই ভাগে ভাগ করেছে। এই নদীর পূর্বকে  পুর্ব ডুয়ার্স বা অসম ডুয়ার্স এবং পশ্চিমের অংশকে, পশ্চিম ডুয়ার্স বা পশ্চিমবঙ্গ ডুয়ার্স বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার এবং অসমের ধুবড়ি, কোকড়াঝাড়, বরপেটা, গোয়ালপাড়া ও বঙাইগাঁও জেলা নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল গঠিত।

এই অঞ্চলের  প্রবাহমান নদীগুলি হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট বলে নদীগুলিতে সারাবছর জল থাকে। এখানকার প্রধান নদীগুলি হল তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা, কালজানি, বালাসন প্রভৃতি। রঙ্গিত তিস্তার প্রধান উপনদী।

এই স্থানে বালি কাঁকড় ও নুড়িপূর্ণ মাটি বিদ্যমান। ডুয়ার্সে স্থানে স্থানে কালো রঙের আর্দ্র মৃত্তিকা দেখা যায়।জৈব পদার্থ ও গাছের পাতা-পচা সার থাকায় এই মাটিতে চা, কমলালেবু প্রভৃতির চাষ ভালো হয়।

ডুয়ার্সের বেশির ভাগ অংশ ঘনবনাঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। এই বনাঞ্চলে ভারতীয় গণ্ডার ও হাতি প্রচুর সংখ্যায় বসবাস করে। এছাড়াও এখানে বাঘ, চিতা, হরিণও নানাধরনের পাখি দেখা যায়। এখানকার বনাঞ্চলগুলি  মধ্যে যেগুলি প্রধান সেগুলো হল:- 
গোরুমারা অভয়ারণ্য, বক্সা জাতীয় উদ্যান, জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য, কাজিরাঙ্গা ও
মানস জাতীয় উদ্যান।

এই অঞ্চলে বহু দর্শনীয় স্থান বা পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এই পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে প্রতি বছর বহু দেশ-বিদেশের পর্যটক আসে। প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলি হল :- বক্সাদুয়ার, 
জলদাপাড়া, জয়ন্তি পাহাড়  ও কাজিরাঙ্গা।

মুজনাই সাপ্তাহিক  











 সুন্দরী ডুয়ার্স

             লেখা-কুমকুম ঘোষ
             ছবি- দেবাশিস ঘোষ

 সুন্দরের দরজা এখানে হাট করে খোলা।
সবুজ চা বাগান। যুবতী নদীর রুখা শুখা রূপ । কিংবা শ্যামল অরণ্য।দূর পাহাড়ের সীমারেখা। । ভালোবাসা ভালোলাগা কিছু মুহূর্ত বন্দী করে রাখা ক্যামেরায়? নাহ্ ডিজিটিলের মায়া দুনিয়ায় নয়, ক্যামেরায় বন্দী ছবির মুহূর্ত - যাপন।রিল ক্যামেরার রোম্যান্সের ছত্রিশ সংখ্যা য় বন্দী প্যাশন ও রোমাঞ্চ।   ঝরাপাতার সাথে মন দেওয়া-নেওয়া।মার্চ মাসে জয়ন্তী নদীর নুড়ি পাথর ভরা শুকনো নদী খাত যেমন অবাক করে তেমনি মুগ্ধ করে এই অঞ্চলের ধীর স্থির অরণ্যের স্তব্ধতা।অচঞ্চল জীবন যাত্রা।   লাটাগুড়িতে আদিবাসী নৃত্য কিংবা গরুমারার জঙ্গলে যাত্রাপ্রসাদের ওয়াচ টাওয়ার।ডুয়ার্সের টানে বারবার ছুটে যাওয়া।
জয়ন্তী- ডুয়ার্সের রানীর অপরূপ রূপে অবগাহন এবং ফিরে ফিরে দেখা। নদীর নাম জয়ন্তী। নদীর নাম মূর্তি।


































মুজনাই সাপ্তাহিক  














শিল্পী- শ্রীময়ী মৈত্র, সপ্তম শ্রেণি 

মুজনাই সাপ্তাহিক  













বই

রীনা মজুমদার

বইটির প্রচ্ছদ জুড়ে তিনটি অক্ষর- ডু য়া র্স
আগে পরে কোন অলংকার রাখিনি তার
 বইয়ের গন্ধ শুঁকি আমি, বারবার
  সে বইয়ের পাতায়,
চায়ের গন্ধ জেগে থাকে-  জেগে থাকে প্রাণ
লাঙলের মুখে সোনালী ধানে নবান্নের ঘ্রাণ।
  বইয়ের পাতায়,
ঘাড় উঁচু করে দেখি শাল, সেগুন, শিরীষের ডালে
পিঠে রোদ দিয়ে হর্নবিল ডাকছে সঙ্গীকে,
যখন গাছের গোড়ায় লেগে থাকে সদ্য কুঠারের দাগ!
বুক পেতে নিই ব্যথার ভাগ,
 বিষাদবন্ধনে জঙ্গলের গন্ধ নিই আমি।
 বইয়ের পাতায় পাতায়,
 বয়ে চলে অরণ্যের বুক চিরে নেওড়া, মূর্তি
 রায়ডাক, জয়ন্তী, আংরাভাসার জলে--
 খেলা করে বন্যপ্রাণ, শুঁড়ের জলে নীলাকাশ হাসে
 রাতের আঁধারে জোনাকিরা আলো নিয়ে আসে
  বইয়ের ভাঁজে সে-নদীর গন্ধ লেগে থাকে। 

     বইটি উর্বর মাটি দিয়ে গড়া
প্রচ্ছদে তার তিনটি অক্ষর- 'ডুয়ার্স'।

 মুজনাই সাপ্তাহিক 










আমার ডুয়ারস

নন্দিতা পাল


আমার ডুয়ারস আমার মনের মাটি,

ঐ মাটিতে তিস্তার হাত ধরে স্কুলের পাঠ,

ব্যঙ্গের গান শুনতে শুনতে ছাতা হারিয়ে ভিজে চুপসে;

চা বাগানের ঢাল বেয়ে তর তর নেমে যাওয়া।

বন্ধুদের ডাকে খিলখিল ঝর্ণা নেমে আসে;

টাইগার হিলে সকাল দেখব বলে সারা রাত জেগে থাকা।

 

ডুয়ারস পায়ে পায়ে আমার সাথে হাঁটে,

মাদারিহাটের মাহুতের বাড়ির দাওয়ায়,

হলং এলে হাতির পিঠে চড়েই জঙ্গল।

এক ঝাঁক চড়াই শালিখ উঠোন জুড়ে থাকে-

ক্লান্ত ডুয়ারস সবুজ মাঠে আনমনা ঐ,

একমনে ভাওয়াইয়া গানে আমার মতই ভালবাসে।

 

অঝোর বৃষ্টিতে মন খারাপের দিন,

তোরসার আঁচলে নীলাম্বরী প্রথম প্রেম,

ভ্যাপসা গরমে পড়ার টেবিলে বসে আকাশকুসুম,

বৈরালির ঝিকমিকে মায়ের হাতের স্বাদ;

তাকালেই পাহাড় যেন দুহাত বাড়িয়েই ডাকে কাছে যাবার,

চোখ বন্ধ করলেই, ডুয়ারস আমার মনের মাঝেই আছে।

মুজনাই সাপ্তাহিক  










আমার প্রিয় উত্তরি, 

                          তুমি কেমন আছো এটা জিজ্ঞেস করতে আমার লজ্জ্বা লাগে। অনেক দিন থেকে ভাবি তোমায় দুটো কথা বলি, সময় হয়ে ওঠে না। কাল ক্রমে তুমিও এখন আর আগের মতো মিশতে চাও না। তাই এই চিঠি লিখে মুজনাইয়ের স্রোতকে দিলাম তোমাকে পৌছে দিতে। জন্মের থেকেই তোমার সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠা। সব দিয়েছিলে তুমি আমাকে। আমি তোমার কাছ থেকে নিয়েছি শৈশবের সবুজ মাঠ। তোমার পলাশ থেকে নিয়েছি যৌবনের মুঠ মুঠ রঙ। শাল, শিমুল, চিকরাশি থেকে নিয়েছি দৃঢ়তা। তিস্তা,তোর্ষা, মুজনাই থেকে নিয়েছি বয়ে চলার প্রেরণা। তোমার শৈলশিরা থেকে শিক্ষা নিয়েছি, যত বড় হ‌ও জীবনে স্নিগ্ধ, শীতল থাকার স্বভাব। আমি সব নিঙরে নিয়েছি তোমার। তুমি বাধা দেও নি। কিন্তু আমি যে প্রতিদানে তোমাকে কোনো কিছু দিতে অসফল থাকব, সেটা ভাবি নি সেদিন। উত্তরের শৈলশিরা থেকে শুরু করে দক্ষিণের কাঁটাতার বহু বিস্তীর্ণ তোমার বিস্তার। মন প্রাণ ভরে ওঠে এখনো এই যান্ত্রিক পৈশাচিক যুগে তোমায় দেখে। সত্যি তুমি অপরূপা, আর তাই তুমি আজ প্রতারণার শিকার, ধর্ষিতা। এখন সবুজ আচলে মুখ লুকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদ। যারা তোমার স্বাভিমান বাঁচাতে এসেছিল, তারাও প্রতারণার শিকার। শুরু থেকেই সবার নজর তোমার উপর। বৃটিশরা এল শুরু করল চা চাষ। যতদিন ছিল শুধু নিজেদের জন্যই করেছে। ভাবেনি তোমার কথা, তোমার ছেলে মেয়েদের কথা, প্রিয় জনদের কথা। তারপর ওরা চলে গেলে এল একদল রাজনেতা। ওরাও কিছু করেনি তোমার জন্য, যা করেছে ঐ সাগর পাড়ের জন্য। কিন্তু নিজের স্বার্থে তোমাকে কোনো ভাবে ছেড়ে দেয় নি। তোমার মনে আছে তখন একবার ওদের বিরুদ্ধে 1965-66 র দিকে তোমার কিছু প্রিয়জন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মধ্যে চারু মজুমদার, কানু স্যানাল,সরোজ দত্ত ও আরো অনেকে। ওরা হাতিয়ার তুলে নিল হাতে। চারুর নেতৃত্বে গঠিত হল শিলিগুড়ি গ্রুপ। তার‌ই নেতৃত্বে লড়তে গিয়ে 1967 সালের 25শে মার্চ পুলিশের গুলিতে মারা গেল ১১ জন। তার মধ্যে সাত জন‌ই মহিলা। সীমাশ্বরি, নয়নেশ্বরি, ফুল মাটি , সুরবালা বর্মন বাকিদের নাম মনে পড়ছে না। তখন তোমার সাগর পাড়ের বোনের গুণধর সন্তান সন্ততিরা এগিয়ে এল। ওরা বলল চারু নাকি বদমায়েশ। চারু না ওরাই নাকি আসল কমিউনিস্ট। মার্কসবাদ, লেলীনবাদ। যাইহোক চারুটাকে আর ভালো করে দাঁড়াতে দিল না। একে ঐ সময় বাঙলার মাথায় কাটা হাত। তার উপর আসল নকল কমিউনিজমের লড়াই। কি করবে বেচারা শেষে ধরা পড়ল কাটা হাতের কাছে। 1972 সাল সাগর পাড়ের আলিপুর জেলে মারা গেল। এক বুক আশা নিয়ে। আর কানু সাথী হারা হয়ে ধিরে ধিরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। বয়সের ভারে চুপচাপ বসে দেখল তোমাকে নিয়ে কত প্রহসন। শেষে 2010 সালে রোগ ভোগে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তুমি আবার ভেব না আমি ওদের কোনো নিকট আত্মীয়। না না আমি তেমন কেউ না। তবে অল্প একটু বুদ্ধি শুদ্ধি দিয়ে যেটা বুঝি, চারু বোধহয় কাজটা ভাল‌ই শুরু করেছিল। না হলে ওর প্রতি সবার ওরকম হিংসা হবে কেন। যাক স্বপ্ন স্বপ্ন‌ই রয়ে গেল চারুর। কিন্তু লোকটাকে তাড়িয়ে যারা এল মাসীকে দরদ দেখাতে, তাদের ভাল করেই আমি দেখলাম। কি করল ওরা শুধু প্রহসন ছাড়া। তোমার কি মনে হয়? 
                       এরপর শুরু হল এক নতুন প্রহসন। এ আবার কেমন দরদ কিছু বুঝি না। তোমাকে অক্ষত ধরে রাখার ভাবনার পরিবর্তন হল। 80 র দশকে একদল উঠে এল। ওরা বলল "যে তোমার মাথা কেটে নিজের কাছে রাখবে। " পার্বত্য অংশ। ঘরের মধ্যে শুরু হল অংশীদারিত্বের লড়াই। ওরা বলে পার্বত্য গোটা উত্তর নাকি ওদের। শুরু হল আন্দোলনের নামে প্রহসন। আর ওদের আন্দোলনকে না প্রশ্রয় না তিরস্কার করে তোমার বোনের বুড়ো ছেলেরা যা করল। সেটা আর এক প্রহসন। এভাবেই ওরা ওদের দিন কাল পার করল। ওরা চলে গেল, তারপর এল তোমার বোনের এক মেয়ে। ওর মস্তিষ্কের প্রশংসা না করে পারা যায় না। যারা তোমার অংশীদারিত্বের লড়াই করছিল। ওদেরকেই শত শত অংশে ভাগ করে দিল। তুমি জানো এখন পার্বত্য, তড়াই, ডুয়ার্সে তোমার কত অংশীদার। সবাই তোমাকে টুকরো টুকরো করতে ব্যস্ত। ভয় পেয় না, আমার মনে হয় তোমার টুকরো হবে না। কারন তোমার বোনের মেয়েটা ভীষণ চালাক। ও শুধু তোমার অকর্মণ্য অংশীদারদের এলোমেলো করে রাখতে চায়। যাতে করে ও মাসীকে (তোমাকে) নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। আর অংশীদারিত্বের মোহে এরা এমন মোহান্ধ কিছুই বুঝতে পারে না। এসব দেখে নিজে খুব লজ্জ্বিত বোধকরি উত্তরি। তুমি দুঃখে মুখ লুকাও সবুজ আঁচলে। আমি লজ্জ্বায় মুগ লুকাই রাতের অন্ধকারে আর ভিড়ের মাঝে। আর কি তোমায় কোনোদিন আগের মতো করে পাব না উত্তরি! 
সেই আগের মত শৈলশিরা থেকে কাঁটাতার, গোর্খালী থেকে ভাটিয়ালী, কুষাণ থেকে ভাওয়াইয়া। ঘুম(স্টেশন)থেকে ঘুঘুমাড়ি হয়ে সিতাই -----
                       শুধু একা বসে বসে ভেবে যাই -
                                 ইতি 
                          তোমার স্নেহ ধন্য 
                                  বিবেক। 

কলমে- উমা শঙ্কর রায় 

মুজনাই সাপ্তাহিক  








ডুয়ার্স-সিম্ফনি
    মৌসুমী চৌধুরী 

বনজ শরীর এলিয়ে শুয়ে থাক তুমি
গলা সোনা রোদে, তোর্ষার চরে,
রাত ভর কুয়াশার চাদর মোড়া স্লেটরঙা পাহাড়ের গায়,
রাভা রমনীর গৃহস্থালিতে, আদিগন্ত সবুজ চা-গালিচায়,
ওড়াও রঙিন ওড়না বক্সার পাহাড়িয়া পথে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি ডানায়!
বিন্দুর পাহাড়ি ঝর্ণার রূপোরঙা তন্বী শরীরে
রূপসী তুমি, তীব্র রহস্যময়ী! 
তোমার মুখে শাল-সেগুন-শিশু-গামারীর সবুজ অন্ধকার 
চুরি যায় রাক্ষুসে থাবায়,
ডাকাতে-আলো এসে হা হা করে বনপথে আজ! 
বন্ধ চা-বাগান থেকে নোনা জল যেন
 মিশে যায় জয়ন্তীর নদীবুকে __
জোনাক জ্বলা সন্ধেতে জল আর পাথরে       
 যেন বেজে ওঠে করুণ সিম্ফনি তোমার !

মুজনাই সাপ্তাহিক  











সুন্দরী ডুয়ার্সে 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

চড়াই-উতরাই, বাঁক -ঢাল,  সবুজ সুন্দরী ডুয়ার্স
এ যেন এক অন্তিম অবসরের ঠিকানা 
উৎসব রজনীর গান ভেসে আসা পাহাড়ি বাতাস
ফুল ফোটানোর বাঁশি শোনা যায় এখানে। 

জলখেলায় মিশে একাকার মধুর কাকলি 
কচিকাঁচাদের নাচ দেখতে ভীড় জমায় বনময়ুরী
আলো আঁধারের খেলা চলে অবিরাম প্রান্তজুড়ে
বেল,জুঁই, চম্পা,চামেলি র গন্ধে ভরে ওঠে মন।

রবির রক্তছটা গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে 
উপত্যকার ঢাল বেয়ে সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠে 
দিগন্তে সাদাকালো মেঘ উঁকি দিয়ে যায়
বনবস্তিতে প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা চলে। 

ক্লান্তিহীন পথচলায় ছড়িয়ে পড়ে মধুর আবেশ
 পিচের রাস্তায় চিরুনি বুলিয়ে দেয় অদৃশ্য হাত
অনুভবি মনে দোলা দেয় পাহাড়ি বাতাস
চালসারলেভেল ক্রসিং জুড়ে শুধুই নীরবতা 
কুর্তি নদী পাড়ে অপেক্ষায় থাকে অর্ধনারীশ্বর, 
তার তুলিতে রঙ বদলায় সুন্দরী ডুয়ার্সে। 

মুজনাই সাপ্তাহিক  











কন্যের ডুয়ার্স যাত্রা

শ্রাবনী সেনগুপ্ত

 

ডুয়ার্স যাচ্ছে কন্যে

সঙ্গে আছেন বুড়ো চাকর

মাল বইবার জন্যে

শখ যে তার ছোট্টবেলার

দেখবে সে জঙ্গলের বাহার

ঝর্ণা আর পাখপাখালির

কলতানের ছন্দে ,

মাতবে মন আনন্দে

কিন্তু সংসারেরই চাপে

স্বপ্নটি তার পড়ে যাচ্ছিলো ফাঁকে

এবার যাহোক সময় সুযোগ করে ,

বসলো সে রেলগাড়িতে চড়ে,

নামলো এসে নিউ মাল জংশনে

সেখান থেকে ওয়াগনে করে

চললো কন্যে  ডুয়ার্সের অন্দরে

চারিদিকে সবুজের ঘনঘটা,

তারই মাঝে আলো-আঁধারির ছটা

পথে মিললো দেখা নাগরাকাটামাটিয়ালীচালসার

নামগুলি বেশমনে রয়ে যায় রেশ

হঠাৎ পথ আটকালো দাঁতাল এক হাতি

এবং তার গুটি কয়েক সঙ্গীসাথী

কন্যে ফটাফট ছবি তুললো ক্যামেরায়

বুড়ো চাকর খুশি বেজায়

বেশ কিছুক্ষন পরে,

হাতির দল চলে গেলো রাস্তার ওপারে

আবার শুরু হলো পথ চলা,

সৌন্দর্য তার ভাষায় যায়না বলা

অবশেষে থামলো গাড়ি

সামনে হোটেল  মস্ত ভারী,

মালপত্তর তাড়াতাড়ি নামিয়ে সেথায়

কন্যে আবার ঘুরতে চললো হেতায়  হোথায় 

চা বাগানের সবুজ আভায় চোখ ভরলো ,

অপূর্ব এক আবেশ মন কাড়লো

মূর্তি নদীর ছুটন্ত জলরাশি

যেন শিশুর মতন হাসিখুশি

পরদিন কন্যে চললো দেখতে জঙ্গল,

সঙ্গে টুরিস্ট আরো এক দঙ্গল

চারিদিকে শাল-মহুলের বৃক্ষ সারিসারি

তারমধ্যে দিয়ে চলেছে জঙ্গল সাফারি

দেখা মিললো একশৃঙ্গ গন্ডার,ময়ূরহরিনের

সবুজ পাতার ফাঁকে চিতার হলুদ-কালো শরীরের

শেষ হলো জঙ্গল সাফারি,

হোটেলে ফিরলো কন্যে

মন তার খুশি ভারী

এবার বাড়ি ফেরার পালা ,

বুড়ো চাকরির সঙ্গে কন্যে করলো এক শলা

যেভাবেই হোক প্রতিবছর আসবেই সে ডুয়ার্সে

মন ভরাবার জায়গা কন্যে পেয়েছে অবশেষে


মুজনাই সাপ্তাহিক  








ডুয়ার্সের ডায়রি 
পার্থ সারথি চক্রবর্তী

এক,

চারদিকে শুনশান সবুজ বনতলি
ঝি ঝি পোকার ডাক
অদ্ভূত ঘোর লেগে যায় প্রাণে
কাঁচতোলা গাড়ির ভেতর থেকে 
সবুজ যেন আরো সবুজ।
খুনিয়ার মোড়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে 
ভেসে আসে মাটির গন্ধ-
যেন বুনো পারফিউম ছড়িয়েছে
বাইসন আর হাতির দল

দুই,

মূর্তির চরে চাঁদ বালি ছুঁয়েছে,
ছড়িয়ে দিয়েছে অকৃপণ আলো
গতকালের অন্ধকার আজ উধাও,
চাঁদের প্রতিবিম্ব সাথে নিয়ে 
মূর্তির কুলকুল শব্দ ভেসে আসে-
নস্টালজিক সুরে, নেশা জাগায়!
ফেলে আসা সময় সামনে ভাসে-
নদীর প্রবাহে, জোৎস্নার আবহে-
পাথরের সঙ্গে নদীর জলের যেন প্রেম


তিন,

শহুরে ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে
নিরীহ সবুজকে পাশে রেখে ছুটে চলা
মন থেকে বেরিয়ে আসা গান-
শোনে মাটি আর আকাশ 
কোথাওবা বাইসনের দৌড়, বা দাঁতাল হাতি,
ময়ূরের ডাকে থমকে দাঁড়ানো
এক অপূর্ব জগত 
কারো লোভ আর লালসার শিকার হয়ে-
কোথাও ফালা ফালা হয় সবুজ।


চার,

গর্বের চা বাগানে মৃত্যু মিছিল 
ভেলভেটের ঢেউ ছাপিয়ে-
বাতাসে শোনা যায় কান্না
চা-শ্রমিকের কষ্ট আর বঞ্চনার কান্না।
সুখের পানীয়র তলায় যেন -
থিতিয়ে আছে পোড়া ত্বকের হাহাকার
হাজার আলোতে, প্রচারের স্পটলাইটেও-
কাটছে না অন্ধকার!
ডুয়ার্সের গর্ব, চা বাগানের চিৎকার!

মুজনাই সাপ্তাহিক  









এই তো কাছেই

চিত্রা পাল

 

     এই তো কাছেই অথচ এতোদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্য স্থানের দিকে। আমি বলছি বক্সাফোর্টে যাবার কথা। বক্সা ফোর্ট আমাদের ডুয়ার্সের মধ্যেই। জলপাইগুড়ি শহর থেকে রাজাভাতখাওয়া  পৌঁছতে আড়াইঘন্টা মতো লাগে, তবে আমাদের একটু বেশীই লাগলো।ওখান থেকে গেলাম সান্তালাবাড়ি। সান্তালাবাড়ি থেকে বক্সাফোর্ট তিনমাইল মতো। সেই পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে হবে। খানিকদূর অবধি গাড়ি গিয়ে আর যায় না, তারপরে পদব্রজে। সমতলের থেকে এখানে হাঁটা ব্যতিক্রমী। ধীরে ধীরে ওপরে ওঠা। সহজেই হাঁপ ধরে যায়।  কিন্তু যাবার আনন্দে তাকে পাশ কাটিয়ে চলেছি আমরা। চারদিকে সবুজ। পাহাড়ি ঝোরা পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুল  কুল করে। নানারকমের ফার্ন গাছের সঙ্গে বাঁশ গাছের ঝোপঝাড় বেশ বেশি। খানিক দূর গিয়ে পাহাড়িয়া পথের ধারে ছোট্ট চাএর দোকানে বসে চা খেয়ে আবার চলা। বক্সার এই বনাঞ্চলে অনেক রকমের পাখি দেখা যায়। ময়না কোয়েল ধনেশ তো আছেই, তার সঙ্গে আছে সবুজ বুনো পায়রা। শুনেছি অনেক বিপন্ন প্রজাতির পাখীর ও বাস এখানে। পাখীদের কলকাকলিতে মুখর এ বনভূমি। এই পথে যেতে যেতে দেখা হলো এখানকার পোষ্ট অফিস। এখানে এখনও ডাকহরকরা সমতল থেকে ডাকের বোঝা পিঠে বয়ে নিয়ে আসে। এসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম বক্সা ফোর্টে।

     এই সেই ফোর্ট যেখানে বিপ্লবীদের শাস্তি স্বরূপ রাখা হতো। শুনেছি আন্দামানের পরেই কুখ্যাতি ছিলো এই জেলের। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৫০ সালে এখানে বন্দী হয়ে ছিলেন। সামনের ফলকে উৎ্‌কীর্ণ রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা।  সামনে শহিদবেদীতে ফুল দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে এ প্রজন্মের আমরা ক্ষণিক বিরতিতে নিঃশব্দ নিস্তব্ধ হয়ে আমাদের প্রণতি জানালাম। যদিও ফোর্ট এখন ধ্বংস স্তূপ। তবু বিপ্লবী বীরদের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে আপনি নত হয় মস্তক। তারপরে আবার সেই আরণ্যক পথে অবতরণ। বনস্পতির প্রাচুর্য্য এ পথের বড় সম্পদ।