মুজনাই সাপ্তাহিক
আমার প্রিয় উত্তরি,
তুমি কেমন আছো এটা জিজ্ঞেস করতে আমার লজ্জ্বা লাগে। অনেক দিন থেকে ভাবি তোমায় দুটো কথা বলি, সময় হয়ে ওঠে না। কাল ক্রমে তুমিও এখন আর আগের মতো মিশতে চাও না। তাই এই চিঠি লিখে মুজনাইয়ের স্রোতকে দিলাম তোমাকে পৌছে দিতে। জন্মের থেকেই তোমার সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠা। সব দিয়েছিলে তুমি আমাকে। আমি তোমার কাছ থেকে নিয়েছি শৈশবের সবুজ মাঠ। তোমার পলাশ থেকে নিয়েছি যৌবনের মুঠ মুঠ রঙ। শাল, শিমুল, চিকরাশি থেকে নিয়েছি দৃঢ়তা। তিস্তা,তোর্ষা, মুজনাই থেকে নিয়েছি বয়ে চলার প্রেরণা। তোমার শৈলশিরা থেকে শিক্ষা নিয়েছি, যত বড় হও জীবনে স্নিগ্ধ, শীতল থাকার স্বভাব। আমি সব নিঙরে নিয়েছি তোমার। তুমি বাধা দেও নি। কিন্তু আমি যে প্রতিদানে তোমাকে কোনো কিছু দিতে অসফল থাকব, সেটা ভাবি নি সেদিন। উত্তরের শৈলশিরা থেকে শুরু করে দক্ষিণের কাঁটাতার বহু বিস্তীর্ণ তোমার বিস্তার। মন প্রাণ ভরে ওঠে এখনো এই যান্ত্রিক পৈশাচিক যুগে তোমায় দেখে। সত্যি তুমি অপরূপা, আর তাই তুমি আজ প্রতারণার শিকার, ধর্ষিতা। এখন সবুজ আচলে মুখ লুকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদ। যারা তোমার স্বাভিমান বাঁচাতে এসেছিল, তারাও প্রতারণার শিকার। শুরু থেকেই সবার নজর তোমার উপর। বৃটিশরা এল শুরু করল চা চাষ। যতদিন ছিল শুধু নিজেদের জন্যই করেছে। ভাবেনি তোমার কথা, তোমার ছেলে মেয়েদের কথা, প্রিয় জনদের কথা। তারপর ওরা চলে গেলে এল একদল রাজনেতা। ওরাও কিছু করেনি তোমার জন্য, যা করেছে ঐ সাগর পাড়ের জন্য। কিন্তু নিজের স্বার্থে তোমাকে কোনো ভাবে ছেড়ে দেয় নি। তোমার মনে আছে তখন একবার ওদের বিরুদ্ধে 1965-66 র দিকে তোমার কিছু প্রিয়জন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মধ্যে চারু মজুমদার, কানু স্যানাল,সরোজ দত্ত ও আরো অনেকে। ওরা হাতিয়ার তুলে নিল হাতে। চারুর নেতৃত্বে গঠিত হল শিলিগুড়ি গ্রুপ। তারই নেতৃত্বে লড়তে গিয়ে 1967 সালের 25শে মার্চ পুলিশের গুলিতে মারা গেল ১১ জন। তার মধ্যে সাত জনই মহিলা। সীমাশ্বরি, নয়নেশ্বরি, ফুল মাটি , সুরবালা বর্মন বাকিদের নাম মনে পড়ছে না। তখন তোমার সাগর পাড়ের বোনের গুণধর সন্তান সন্ততিরা এগিয়ে এল। ওরা বলল চারু নাকি বদমায়েশ। চারু না ওরাই নাকি আসল কমিউনিস্ট। মার্কসবাদ, লেলীনবাদ। যাইহোক চারুটাকে আর ভালো করে দাঁড়াতে দিল না। একে ঐ সময় বাঙলার মাথায় কাটা হাত। তার উপর আসল নকল কমিউনিজমের লড়াই। কি করবে বেচারা শেষে ধরা পড়ল কাটা হাতের কাছে। 1972 সাল সাগর পাড়ের আলিপুর জেলে মারা গেল। এক বুক আশা নিয়ে। আর কানু সাথী হারা হয়ে ধিরে ধিরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। বয়সের ভারে চুপচাপ বসে দেখল তোমাকে নিয়ে কত প্রহসন। শেষে 2010 সালে রোগ ভোগে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তুমি আবার ভেব না আমি ওদের কোনো নিকট আত্মীয়। না না আমি তেমন কেউ না। তবে অল্প একটু বুদ্ধি শুদ্ধি দিয়ে যেটা বুঝি, চারু বোধহয় কাজটা ভালই শুরু করেছিল। না হলে ওর প্রতি সবার ওরকম হিংসা হবে কেন। যাক স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল চারুর। কিন্তু লোকটাকে তাড়িয়ে যারা এল মাসীকে দরদ দেখাতে, তাদের ভাল করেই আমি দেখলাম। কি করল ওরা শুধু প্রহসন ছাড়া। তোমার কি মনে হয়?
এরপর শুরু হল এক নতুন প্রহসন। এ আবার কেমন দরদ কিছু বুঝি না। তোমাকে অক্ষত ধরে রাখার ভাবনার পরিবর্তন হল। 80 র দশকে একদল উঠে এল। ওরা বলল "যে তোমার মাথা কেটে নিজের কাছে রাখবে। " পার্বত্য অংশ। ঘরের মধ্যে শুরু হল অংশীদারিত্বের লড়াই। ওরা বলে পার্বত্য গোটা উত্তর নাকি ওদের। শুরু হল আন্দোলনের নামে প্রহসন। আর ওদের আন্দোলনকে না প্রশ্রয় না তিরস্কার করে তোমার বোনের বুড়ো ছেলেরা যা করল। সেটা আর এক প্রহসন। এভাবেই ওরা ওদের দিন কাল পার করল। ওরা চলে গেল, তারপর এল তোমার বোনের এক মেয়ে। ওর মস্তিষ্কের প্রশংসা না করে পারা যায় না। যারা তোমার অংশীদারিত্বের লড়াই করছিল। ওদেরকেই শত শত অংশে ভাগ করে দিল। তুমি জানো এখন পার্বত্য, তড়াই, ডুয়ার্সে তোমার কত অংশীদার। সবাই তোমাকে টুকরো টুকরো করতে ব্যস্ত। ভয় পেয় না, আমার মনে হয় তোমার টুকরো হবে না। কারন তোমার বোনের মেয়েটা ভীষণ চালাক। ও শুধু তোমার অকর্মণ্য অংশীদারদের এলোমেলো করে রাখতে চায়। যাতে করে ও মাসীকে (তোমাকে) নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। আর অংশীদারিত্বের মোহে এরা এমন মোহান্ধ কিছুই বুঝতে পারে না। এসব দেখে নিজে খুব লজ্জ্বিত বোধকরি উত্তরি। তুমি দুঃখে মুখ লুকাও সবুজ আঁচলে। আমি লজ্জ্বায় মুগ লুকাই রাতের অন্ধকারে আর ভিড়ের মাঝে। আর কি তোমায় কোনোদিন আগের মতো করে পাব না উত্তরি!
সেই আগের মত শৈলশিরা থেকে কাঁটাতার, গোর্খালী থেকে ভাটিয়ালী, কুষাণ থেকে ভাওয়াইয়া। ঘুম(স্টেশন)থেকে ঘুঘুমাড়ি হয়ে সিতাই -----
শুধু একা বসে বসে ভেবে যাই -
ইতি
তোমার স্নেহ ধন্য
বিবেক।
কলমে- উমা শঙ্কর রায়
No comments:
Post a Comment