Tuesday, July 4, 2023


 

সম্পাদকের কথা 

প্রবল গরমের পর অবশেষে বর্ষা খানিকটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। যদিও নিত্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি সেই স্বস্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে মুহূর্তেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে অশান্তি আর হানাহানি। আজকাল প্রকৃতির সঙ্গে এই বঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একই রকম। সবেতেই প্রাবল্য। গরম পড়লে তা যেমন তীব্র হচ্ছে, বৃষ্টি হলেও সেই একই। রাজনৈতিক অবস্থাও  তেমনই। দম্ভ আর অহমিকার চূড়ান্ত প্রদর্শনে কত তরতাজা প্রাণ যে দুনিয়া থেকে অকালে বিদায় নিচ্ছে তার খবর কে আর রাখে! আমাদের ট্র্যাজেডি এখানেই। আমরা সব বুঝি, সব জানি। কিন্তু চোখে ঠুলি প`রে  সব উপেক্ষা করি। আমাদের স্থিতাবস্থাটিও চরম। প্রকৃতির চূড়ান্তকে আমাদের পক্ষে আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা পারতাম সেটাকে থামানোও আমাদের ইচ্ছে নয়।   


  মুজনাই অনলাইন আষাঢ়  সংখ্যা ১৪৩০ 

                                              রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন আষাঢ়সংখ্যা ১৪৩০


এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 


উমেশ শর্মা, সুবীর সিংহ রায়, গৌতমেন্দু নন্দী, 

পার্থ বন্দোপাধ্যায়, দেবর্ষি সরকার, রণিতা দত্ত, 

শ্রাবণী সেন, লীনা রায়, রীনা মজুমদার, 

অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, সৈকত দাম, কবিতা বণিক, 

মৌমিতা বর্মন, প্রতিভা পাল, সুনন্দ মন্ডল, 

বটু কৃষ্ণ হালদার, জনা বন্দোপাধ্যায়, চিত্রা পাল, 

চম্পা বিশ্বাস, শক্তিশঙ্কর পানিগ্রহী, মনোমিতা চক্রবর্তী, 

প্রদীপ কুমার দে, মাথুর দাস, দেবদত্তা লাহিড়ী, 

রীতা ভদ্র দত্ত, দীপাঞ্জন দত্ত, দেবযানী সেনগুপ্ত, 

সারণ ভাদুড়ী, শ্রেয়সী সরকার, এস সাহা (সঞ্জয়), 

অজয় অধিকারী, চন্দ্রানী চৌধুরী, অভিজিৎ সরকার, 

রীতা মোদক, বিপ্লব গোস্বামী, মজনু মিয়া, 

রেজাউল করিম রোমেল, সালমা আক্তার চাঁদনী, বাবলি বর্মন, 

বাবুল মল্লিক, অনুস্মিতা বিশ্বাস






শিল্পী- বাবুল মল্লিক 





এই সময়ের ভাবনা 


নতুন শতাব্দীতে খোঁজ নিও
উমেশ শর্মা 

নতুন শতাব্দীতে খোঁজ নিও 
কে কেমন আছি 
এখন হৃদয় জুড়ে, হৃদয়ের কাছে 
লেপমুড়ি দিয়ে কাছাকাছি আছে। 

নগরীর সহস্রভাগ দূর্ভোগে
জনতার ভীড়ের চাপে 
অসতর্ক টেলিস্কোপে 
ধরা যায় না খোপে খোপে
কি ঘটনা ঘটে চলেছে 
পঞ্চদশ শতাব্দীতে।

এখন শীতেরা বাঁধুক বাসা
ইডেনে গ্যালারি পেতে
আত্তি সপে সৃষ্টি ঘটুক 
আদিম আদিম ওম ঘাসে।

একটা শতক তো কম নয়
সবাই সরে আসি কাছাকাছি 
ভেদাভেদ ভাগাভাগি করে 
ঐ শতক বড়ো দাগা দিয়ে গেল 
তাই নতুন শতাব্দীতে খোঁজ নিও 
কে, কেমন আছি।



বিশ্বের ক্ষুধা 
সুবীর সিংহ রায়

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী সরল গদ্য। ক্ষুধার জন্য আকুতি মানুষের জন্মাবার পর থেকেই। ক্ষুধা নিবারণেই জীবন  চলমান পুষ্টি বৃদ্ধি ও সভ্যতার বিকাশ। ক্ষুধার কোনো আলাদা আলাদা মাতৃভাষা  নেই জাতধর্ম  নেই, সকল স্তরের মানুষের প্রাণে বেঁচে থাকার একটাই ধর্ম  হলো খাদ্যস্পৃহা ও খাদ্যগ্রহন। 
                                     
চিন্তার বিষয়  দু`দুটো মহা যুদ্ধোত্তর  বিশাল সময় পার করে আজো সারা পৃথিবী জুড়ে দিকে দিকে অভুক্ত পীড়িতের কান্না শোনা যায়। সভ্যতার অগ্রগতির পথে এ এক করুণ ছবি দৃশ্যমান। ক্ষুধার সূচক লাফিয়ে নামছে, খাদ্য অন্বেষণে ভ্রষ্ট নীড় মানুষের দল শহরে, অন্যদেশে ভীড় জমাচ্ছে। পথে ঘাটে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু অসমর্থ অশক্ত বৃদ্ধ  বৃদ্ধা খাদ্যাভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে... আধুনিক  ক্রমোন্নয়ন সভ্য দুনিয়ায় এ দৃশ্য চরম লজ্জার। সোমালিয়ায় ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের দল ধুকছে...  যুদ্ধ আক্রান্ত  ইউক্রেন বেলারুশ কুয়েত পাকিস্তান বাংলাদেশ ভারতের কিছু অংশ -- প্রভৃতি উন্নয়নশীল  দেশগুলিতে  এই সমস্যা তীব্র, প্রকট। GHI রিপোর্টে প্রকাশ এ পর্যন্ত ৯২৫ বিলিয়ন মানুষ  সারা বিশ্বে অপুষ্টিির শিকার, খাদ্য সংকটে রয়েছে, যারা দুনিয়াকে প্রশ্ন করে সম্পদশালী  পৃথিবীতে  কাদের সদিচ্ছার অভাবে, অক্ষম পরিচালনায়, সুশাসনের অভাবে দুর্নীতির জন্য এই সংকট ক্রম বর্ধমান ... 

সভ্যতার অগ্রগতির প্রশ্নে মানব সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সকলর অধিকার  রক্ষার জন্য  বিশ্ববিবেক জেগে উঠুক , শুভবুদ্ধির  প্রসার ঘটুুক-- অন্য চাই প্রাণ চাই... 




"ভাইরাল"--সমাজ মাধ্যমের এক অগ্রবর্তী শব্দ--- - ----
গৌতমেন্দু নন্দী

 "গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে..."

  হ্যাঁ, একসময় লোকমুখেই সব খবর ছড়িয়ে পড়ত সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে। কখনো ঢ্যাড়া পিটিয়েও
  রটিয়ে দেওয়া হোত "আজ কি তাজা খবর"।

          সেইসব "তাজা খবর" আজ ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়ানো হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে "অনলাইন" প্রক্রিয়ায়। সেইসব খবর "জনপ্রিয়তা" বা "জন- অপ্রিয়তা" কতটা পেল সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য হোল কতোটা দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক যেন ভাইরাসের মতো।  দ্রুত সংক্রমিত হয়ে ঢুকে পড়ছে জনমনে, জনচেতনায়---সমাজের বৃহত্তর পরিসরে অনায়াসে।

          "ভাইরাল" মানে ভাইরাসজনিত হলেও একটু পার্থক্য আছে। ভাইরাস একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ চর্বি যুক্ত তরল বা বিষ,ছোট আকারের সংক্রামক এজেন্ট। যা শুধু জ্বর,সর্দি সহ বিভিন্ন অসুখের উপসর্গের কারণ হয়ে শুধুমাত্র অস্বস্থিরই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু "ভাইরাল" স্বস্থি ও অস্বস্তি অর্থাৎ ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যেমন সুকীর্তির জন্য "ভাইরাল"-এর মহিমায় কেউ রাতারাতি "নায়ক" হয়ে যায় আবার কুকীর্তির জন্য একনিমেষে কেউ হয়ে যায় খলনায়ক। 
              এই "ভাইরাল"-এর কার্বন-মৌলের মতো বহুরূপতাও আছে। যেমন " মার্কেটিং","বিজ্ঞাপন " ও আত্ম উপস্থাপন"। যেমন সামাজিক ও"সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। কাকতালীয়ভাবেও ভাইরাস ও ভাইরাল আবার পরস্পর যেন সম্পর্কিত। কারণ কোভিডের সময় বিগত প্রায় তিনটি বছর করোনা ভাইরাসের দাপটে মনুষ্যজগৎ ঘরবন্দী হয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে "অনলাইন" শব্দের সঙ্গে অতিমাত্রায় পরিচিত ও সংযুক্ত হয়ে কখন যেন এই "ভাইরাল "এর প্রেমে পড়ে যায়। বিগত সেই বছরগুলো থেকেই যেন "অনলাইন "নামক নদী দিয়ে হুহু করে বইতে থাকে "ফেসবুক", ইউটিউব ",ইস্টাগ্রাম"এর স্রোত।
"করোনা ভাইরাস"ই যেন আমাদের অনেকটাই শিখিয়ে দিয়ে গেল এই " ভাইরাল" হতে।

              "ভাইরাল"এখন এই সময়ে "খনার বচন"এর মতোই।তবে মুখে মুখে নয়,অনলাইনে সমাজমাধ্যমে প্রচারিত। "ভাইরাস"--এই শব্দে আবার "ভাইরাল"-এর সঙ্গে সম্পর্কিত "Information" শব্দটিকেও পাওয়া যায়। "VIRUS " যেখানে Abbreviation.যেমন -
        V(Vital).I(Information).R(Resources). U(Under).S(Seize).
             
অনলাইনে এই "ভাইরাল" শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন সেথ গোডিন নামক এক মার্কিন লেখক। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের একটি লাইন----"Have the idea behind your online
experience go viral" 

   "ভাইরালিজম"এর এই যুগে নেচে,গেয়ে"টিক্ টক্", "ব্লগিং "এর সাহায্যে "ভাইরাল " হয়ে অসংখ্য "ফলোয়ার" তৈরি ক'রে রাতারাতি অনেকেই আজ "সেলিব্রিটি "। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই 
 যুগ আজ তাই অনেকের কাছেই "ভাইরাল যুগ"। 
        
যেখানে সমাজের একটা বড় অংশ যেমন প্রভাবিত, আলোড়িত এবং আলোকিত হয় তেমনি কেউ কেউ আবার বিতাড়িত হয়ে অখ্যাতির অন্ধকারেও ঢেকে যায়।




এই সময়ের গল্প 


রঙচুরি 
রণিতা দত্ত

কোনকালেই নিজের ওপরে কোন কনফিডেন্স নেই আমার |সেইজন্য ই হয়তো এই বছর বেয়াল্লিশেও এসেও কোন সঙ্গিনী জুটাতে অক্ষম আমি | অনেকেই আগবাড়িয়ে এসে আলাপ করে, উৎসাহ কৌতূহল দেখায় আমাকে নিয়ে কিন্তু আমিই যেন কেমন শামুকের মত গুটিয়ে পেঁচিয়ে থাকি | কিজানি কি সংকোচ, দ্বিধা সবসময় পিছুটান হয়ে দাঁড়ায় |ছবিটা ঠিকঠাক আঁকি এটুকু ই যা বিশেষ গুণ বলতে পারেন | একটি দৈনিক সংবাদ পত্রে পেইন্টিং আর্টিস্টের পাকাপোক্ত চাকরি অন্ততঃ করি |লোকজন ইদানিং নাম-টাম জানে আমার ওই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে । সোশ্যাল মিডিয়ায়তে আমার আঁকা ছবি দিই মাঝে মাঝে |মোটামুটি লম্বা চওড়া ফ্রেইন্ডলিস্টে ভালোই কমেন্ট পত্র আসে | সবার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। শুধু থাম্ব ইমপ্রেশন দিয়ে দায় সারি। সত্যি বলতে, গতে বাঁধা সবার মন্তব্য পড়াও হয় না । ওইতো একই কথা– বেশ ভালো, খুব ভালো,দারুণ, লাভলী, ইত্যাদি। মেকি স্তোক সূচক শব্দে আমার একপ্রকার বিরক্ত ই লাগে বলতে পারেন |

বছরখানেক হল নীলাঞ্জনা সেন নামে একজন আমার একজন ফেসবুক বন্ধু হয়েছেন। তিনি একটু খেঁটেখুঁটে বড়সড় করে মন্তব্য লেখেন। সেগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো। খুব আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে। যেন মনে হয় সত্যিই ছবিগুলো তিনি খুঁটিয়ে দেখেন। সম্ভবত তিনি রঙের মানে বোঝেন। তবে আমার ওই দায়সারা অভ্যাসবশত ওর মন্তব্যেও আলাদাভাবে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করিনি কখনো। মাঝে মাঝে দু-তিনবার আমাকে মেসেঞ্জারেও লিখেছে নীলাঞ্জনা ; যেমন একদিন লিখলেন __
–"মিঃ অনিন্দ্য , আপনার ছবি অফুরান এক মুগ্ধতা এনে দেয়, আপনার বন্ধু বলে আমার গর্ব অনুভব হয়। ছবিগুলো 'ন্যাশনাল এক্সিবিশন অফ পেইন্টিং, স্কাল্পচার এন্ড গ্রাফিক আর্টস' এ দেবার মতো।"
আমি লিখলাম
–"ধন্যবাদ"

বিনা দরকারে কারো সাথেই খুব একটা চ্যাট করিনা, মেয়েদের সাথে চ্যাট করতে আরো ভয় পাই।
এরপর আবার একদিন নীলাঞ্জনার মন্তব্য পাই ,
–"নকশিকাঁথা' ছবিতে রাইট কর্নারে ব্ল্যাক শেড এর মানে কী? নীল-সবুজ এর কম্বিনেশন টেক্সচার খুব ভালো লেগেছে। ওটাই আর একটু বেশি হতে পারত।"
সামান্য বিরক্ত হই,আমি এতো বছর ধরে আঁকছি, আমার ছবিতে কি রঙ কোথায় ব্যবহার করবো সেই কৈফিয়ত আমি ওনাকে দেবো কেন? নিজের পছন্দের রং সম্পর্কে কোন উত্তরও দিলাম না। তবু কেন জানিনা পরদিন স্টুডিওতে গিয়ে 'নকশিকাঁথার' সামনে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কেউতো কখনো বলে না! অবচেতনে ওনাকে সমর্থনও করলাম বোধহয়।

ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখলাম বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখে একটা সহজ সরল মাধুর্য আছে নীলাঞ্জনা সেনের | একেবারে কচি মেয়ে নন উনি , যদিও মেয়েদের বয়স বিধাতা ছাড়া কেউ গুনতে পারেননা ; তবে এটুকু অনুমান করতে আমার মত আনাড়ি ও পারলো যে উনি ত্রিশ উর্দ্ধ | নিজে ছবি আঁকেন বলে মনে হয় না। কারণ কোন আঁকা ছবি প্রোফাইলে দেখিনি কিন্তু ছবির ব্যাপারে গভীরতা এবং আমার ছবিতে দারুণ উৎসাহ দেখে একটু আশ্চর্য হই। 

বেশ কিছুদিন গেছে | আমি একটু ছুটিছাটা ম্যানেজ করে ফালুট,সান্দাকফু, মানভঞ্জন ঘুরে বেড়াচ্ছি, রঙ তুলি ক্যানভ্যাস নিয়ে এঁকে চলেছি | রজতশুভ্র শৃঙ্গে সূর্যের আলোর ঔজ্জল্য যেন সেক্সট্যান যন্ত্রের মত সময় বলে দেয় | আলো ছায়ার সে খেলা এসে ধরা দিয়ে যায় আমার ক্যানভাসে | ইমপ্রেশনিস্টদের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট ছবিতে সময়কে বেঁধে রাখা | দিনের বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিতে সূর্যালোকের খেলা বিভিন্ন ক্ষণস্থায়ী আবহ তৈরি হয় | নিজেই মুগ্ধ আমি, ছবিগুলোর একটা নিজস্ব অ্যালবাম বানিয়ে পোস্ট করলাম ফেসবুকে , যদিও ছবিগুলো বড় এক্সজিবিশন দর্শকদের প্রশংসা জিতবে নিশ্চিত ছিলাম তবুও কেন জানিনা ফেসবুকে ই পোস্ট করলাম | আমি কি কোন বিশেষ দর্শকদের মন্তব্য চাইছিলাম? জানিনা, গোয়াড় মন কি সবসময় সবকথা স্বীকার করে না 
বাধ্য ছেলের মত?

প্রথমে নীলাঞ্জনার কাছ থেকে মন্তব্য এল 'ক্লদ মোনে'র বিখ্যাত এক কোটেশন ---"ইমপ্রেশনিজম একধরনের অনুভূতি। সব বড় শিল্পীই কমবেশি ইমপ্রেশনিস্ট। এটা আসলে সহজাত একটা ব্যাপার।"
-
দু মিনিট যেতে না যেতে ই আবার নীল বুটি মোবাইল স্ক্রিনে লাফাচ্ছে,টাইপিং......একবার ভাবলাম অন্য কেউ মন্তব্য লিখছে, পরক্ষনেই নীলাঞ্জনার মন্তব্য, "ইমপ্রেশনিস্টরা খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির খুব কাছ থেকে আলো ও সময়ের এই খেলাকে প্রত্যক্ষ করেন এবং দ্রুত হাতে দৃশ্যমান স্ট্রোকের সাহায্যে উজ্জ্বল ও বিচিত্র সব রঙ ব্যবহার করে ক্যানভাসে ব্যাপারটিকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেন |পাহাড় ঘুরে গেলেন বুঝি?"

মেসেঞ্জারে লেখা পেলাম, "সেন্টপলসে ইংরেজি পড়াই |জানালে দেখা করতে পারতাম |আপসোস রয়ে গেল |"

আবার সেই দুশ্চিন্তা এল মাথায়, আমি যেন নিজেকে বেশি মেলে ধরছি নীলাঞ্জনার কাছে |লোকে বলে শিল্পী মানুষ বড্ডো খামখেয়ালি গোছের হয় | হবে হয়তো, আমি এবার ঠিক করলাম নীলাঞ্জনাকে একটু এড়িয়ে চলবো | 

একটি মৎসকন্যার ছবি এঁকে বেশ হৈচৈ ফেললাম ;নীল সমুদ্রের জলের নানান শেড, তারসাথে মৎসকন্যার নীলচে রুপোলি আঁশ অদ্ভুত ম্যাট ফিনিসিং এল গাউচের স্টাইলে ভেজা ক্যানভাসে রঙ শুকিয়ে ম্যাট ফিনিস করে এক্রিলিক রঙ ব্যবহার করে |যদিও আমি গাউচেস্টাইল ধার করেছি কিন্তু রঙ বেছেছি নিজের স্বচ্ছন্দের এক্রিলিক |
ওমা কোথাথেকে নীলাঞ্জনার মন্তব্য __"গাউচে পেইন্টিং করেছেন কখনো? গাউচে এক্রিলিক রঙ একই ক্যানভাসে ইউস করা যায়? আপনি কি এই ধরণের মিক্সিং পছন্দ করেন?"
যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। অদ্যিকালের গাউচ নিয়ে কি দরকার এত? মনে মনে আরো ভাবলাম তুমি কে হে আগ বাড়িয়ে এত জ্ঞান দেবার! ছবিটা আমি এঁকেছি আমাকেই বুঝতে দাও। এবার সৌজন্যমূলক ধন্যবাদটুকু আর দিতে ইচ্ছা করল না। 

মেসেঞ্জারে বার্তা এল –বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এ আপনার এক্সহিবিশনে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল। এরপর কখনো হলে আমায় জানাবেন। আপনার স্টুডিও স্ফটিকে একবার যাওয়ার ইচ্ছে রইল। একই শহরে থাকলে নিশ্চয়ই একদিন চলে যেতাম।

এবছর বইমেলার আগে বিখ্যাত কবি আফসানা আহমেদের কাব্যগ্রন্থ 'শেষ বিকেলের রোদ' এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেখবর পৌঁছে দিলাম নীলাঞ্জনা কমেন্ট বক্সে লিখলেন –কালো রং এত সুন্দর! শিল্পীর তুলিতেই সম্ভব। ছবির লোকায়ত দর্শন আরো বেশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। শুভেচ্ছা রইল, ভালো থাকবেন।
কমেন্ট দেখে মনে বেশ লাগলো। বুঝলাম আমার মন নীলাঞ্জনার প্রতি দুর্বল, আমি রিপ্লাই কোনদিন দেয়নি দিলে কথোপকথন দীর্ঘয়িত হয়, হয়তো বা গতি পায় |কিন্তু কোথায় যেন আবার শামুক চরিত্র এসে বাঁধ সাধে |বন্ধুদের তাড়া খেয়ে খেয়ে হদ্দ হচ্ছিলাম আমি | অনেক সাহস করে মেসেঞ্জারে লিখলাম -- "আমার ছবির এক্সিবিশন দেখতে আগামী ১২ই সেপ্টেম্বর একাডেমি অফ ফাইন আর্টে আসবেন | স্ফটিকেও আমন্ত্রণ রইলো |"

আগস্ট মাসটা যেন বড় দীর্ঘ মনেহয় | একটা দুটো ছবি পোস্ট করি ওনার মন্তব্য দেখতে |নিরাশ হয়ে দেখি নীলাঞ্জনা সেনের কোন কমেন্ট পড়েনি।একটা পুরনো ছবি পোস্ট করলাম। সারাদিন অনেক মন্তব্য এলেও যার অপেক্ষা করছি তিনি কিছু লিখলেন না। কাল রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ফেসবুকে দেখলাম
Nabonita Chakraborty is with Nilanjona Sen–
"আমাদের সকলের প্রিয় নীলাঞ্জনাদি আজ বালসোরে রেল দুর্ঘটনায় চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে । বড্ড তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। দিদি যেখানে থাকো ভালো থেকো।"
সাথে প্রাণবন্ত হাসি মুখের একখানা ছবি এটাচ করা।
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। দু-তিনবার ভালো করে লেখা এবং ছবি দেখলাম। এবার তাড়াতাড়ি মেসেঞ্জার ওপেন করে দেখি লেখা --"এতো দিনে কথা ফুটলো ।আসবো, সমালোচনা ও করবো কোমর বেঁধে!" নীলাঞ্জনাকে মেসেজ করে উত্তেজিত ছিলাম প্রদর্শনীর জন্য মন ঢেলে আঁকছি দিনরাত ভুলে | মেসেঞ্জার খুলে দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম।

বর্তমানে আমি একজন প্রেমিকের ছবি আঁকছি | এটাই আমার প্রদর্শনীর জন্য শেষ ছবি | একটা তীক্ষ্ণ কাঁটা বুকের কাছে বিঁধে আছে আমার, রক্তক্ষরণ শুধু রক্ত ক্ষরণ | আমি আমার তেলরঙ জলরঙ এক্রিলিক সব কৌটোয় লাল রঙ আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না | সব ফুরিয়েছে একসাথে, চোখ দুটো অজান্তে ঝাপসা হয়ে উঠছে।



এবং রবীন্দ্রনাথ

দু:খ ও রবীন্দ্রনাথ 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

আমরা প্রায়শই বলে থাকি,  "দু:খে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দু:খ কিসে? " কিন্তু আমরা জীবনে যতটা দু:খ পাই বা গড়পড়তায় একজন জীবনে  যতটা দু:খ পেয়ে  থাকেন,  সেটা  কবিগুরু  রবীন্দ্রনাথের জীবনের দু:খের এক'শ ভাগের এক ভাগও নয়।  দুঃখ কাকে বলে তার  প্রায় সবই কবিগুরু পেয়েছিলেন তার  এক জীবনে। 

পরম প্রিয়তমা স্ত্রী মারা গেলেন কবির ৪১ বছর বয়সে।  কবির  ছিল  তিন মেয়ে, দুই ছেলে। রথীন্দ্রনাথ, শমীন্দ্রনাথ আর বেলা, রাণী ও অতশী। স্ত্রী'র পর অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন রাণী। সে  আঘাত  ভুলবার   আগেই   কলেরায় মারা গেলো  ছোট  ছেলে  শমী। পুত্রশোকে কবি লিখলেন- "আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।" কবি'র মনে হলো এই জোৎস্নায় কবি বনে গেলে হবে না। বরং তাঁকে জেগে থাকতে হবে, যদি বাবার কথা মনে পড়ে শমী'র! যদি এসে কবিকে না পায়? তিনি  লিখলেন-
"আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।'

রাণীর জামাইকে পাঠিয়েছিলেন কবি বিলেতে ডাক্তারী পড়তে, না পড়েই ফেরত আসলো। বড় মেয়ের জামাইকে পাঠিয়েছিলেন  বিলেতে, ব্যারিস্টারী  পড়তে, না পড়েই  ফিরে  আসলো। ছোট মেয়ে অতশীর জামাইকেও আমেরিকায় কৃষিবিদ্যার উপর পড়াশোনা করতে। লোভী এই লোক কবিকে বার বার টাকা চেয়ে চিঠি দিতো। কবি লিখলেন- "জমিদারী থেকে যে টাকা পাই, সবটাই তোমাকে পাঠাই।" দেশে ফেরার কিছুদিন পর ছোট মেয়েটাও মারা গেলো।

সবচাইতে  কষ্টের  মৃত্যু  হয় বড়  মেয়ের।  বড় জামাই বিলেত থেকে ফেরার পর ছোট জামাইর সাথে ঝগড়া লেগে কবির বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে  বেলা  হয়ে  পড়েন  অসুস্থ।  অসুস্থ  এই মেয়েকে  দেখতে  কবিগুরু   প্রতিদিন গাড়ী করে মেয়ের  বাড়ী  যেতেন।  কবিকে  যত  রকম অপমান  করার  এই  জামাই  করতেন। কবির সামনে টেবিলে পা তুলে সিগারেট খেতেন। তবু কবি প্রতিদিনই যেতেন মেয়েকে দেখতে।

একদিন কবি যাচ্ছেন, মাঝপথেই শুনলেন বেলা মারা  গেছে।  কবি  শেষ  দেখা  দেখতে  আর গেলেন  না।  মাঝপথ  থেকেই  ফেরত   চলে আসলেন।  হৈমন্তীর  গল্প  যেন কবির মেয়েরই গল্প! শোক কতটা গভীর হলে কবির কলম দিয়ে বের হলো - "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥"

কবির মৃত্যু হলো অতিমাত্রায় কষ্ট সহ্য করে, প্রস্রাবের প্রদাহে। কি কারণে যেন কবির বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শেষ বিদায়টাও পাননি। দূর সম্পর্কের এক নাতনি ছিলো কবির শেষ বিদায়ের ক্ষণে।

কবি  জমিদার ছিলেন এইসব গল্প সবাই জানে। কবি'র  দুঃখের  এই  জীবনের  কথা  ক'জনই বা জানেন?

প্রথম যৌবনে যে গান লিখলেন,  এইটাই যেন কবির শেষ জীবনে সত্যি হয়ে গেলো-
"আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি।"



প্রবন্ধ 

বঙ্গসাহিত্যে পাশ্চাত্যের ধারা
দেবর্ষি সরকার

চিকেন বিরিয়ানিতে মস্তবড় চিকেন লেগপিস না থাকলে যেমন অতিশয়ক্তির সৃষ্টি হয় প্রত্যেক খাদ্যপ্রেমী মানুষের মনে ঠিক তেমনি অতিশয়ক্তির এক মিশেল অনুভূতির সৃষ্টি হয় বঙ্গ সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপটিকে মাথায় ঘাড়ে পিঠে বুকে হাতে কানে গলায় চোখে সোনার খাঁচায় বন্দি পাখির মত যক্ষের ধনের মতো যে সমস্ত মানুষগুলো আগলে রেখেছে তাদের যদি বলা যায় বা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায় যে বঙ্গীয় সাহিত্যেও আধুনিকতর পাশ্চাত্য সাহিত্যের মুক্ত বিচরণ সম্ভব হয়েছে। আমি মানছি আমাদের বাবা মায়েরা না থাকলে আমরা যেমন এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখতে পারতাম না তেমনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শনগুলো যদি না সৃষ্টি হতো তাহলে আজকের যুগান্তকারী সাহিত্যিক নিদর্শনগুলো মানব হৃদয়ের সবুজ আঙিনায় মুক্ত বিচরণ করতে পারত না। তাই কেবল ইংরেজি সাহিত্য তত্ত্ব নয় রবীন্দ্রনাথের পন্থা অনুসরণ করেই বলছি বিশ্ব নিখিলের আঙ্গিনায় বিশ্ব সাহিত্যের পদসেবা পূর্বক আজ বঙ্গ সাহিত্যে পাশ্চাত্য সাহিত্য তত্ত্বের যুগসন্ধিক্ষণ সম্পর্কে সামান্য আলোচনায় প্রবৃত্তি হলাম।

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধ্যান-ধারণা থাকলে জানতে পারা যাবে খ্রিস্টীয় দশম থেকে সপ্তদশ শতাব্দী অর্থাৎ চৈতন্য পরবর্তী কাল অবধি পয়ার, মহাপায়ার, রঘু ত্রিপদির বেড়াজাল ভেঙে কোনো আলাদা সাহিত্য তত্ত্বের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায় আরেক উজ্জ্বলতম পুষ্প বাংলা গদ্য ব্যাক্তি মস্তিষ্কে তথা হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা চলে, বাংলা গদ্যের হাত ধরেই বঙ্গীয় সাহিত্যে পাশ্চাত্য রীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তবে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা কুচবিহাররাজ নরনারায়ণের একখানি চিঠি হচ্ছে প্রাচীনতম বাংলা গদ্যের দৃষ্টান্ত। এর ভাষা একেবারে আধুনিক যুগের উপযোগী না হলেও একেবারে দুর্ব্যোধ নয়। 'তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতিরবীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে......" ষোড়শ শতাব্দীর পক্ষে এই বিশুদ্ধ গদ্যের ঠাট বিস্ময়কর বৈকি। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে চিঠিপত্র ও দলিলে বাংলা গদ্যের স্বাভাবিক বিকাশ ঢেকে গেল ফারসি শব্দের অযথা বাহুল্যে, 'আসামি মজুর কে হুজুর তলপ করিয়া হক ইনসাফ করিতে আজ্ঞা হয়' এই খিচুড়ি ভাষাই তার প্রমাণ।
তবে বর্তমানে প্রসঙ্গক্রমে বাংলা সাহিত্যের ষোড়শ শতাব্দীকে নিষ্ঠা সহকারে সামান্য দূরে সরিয়ে রেখে আমরা আমাদের মূল আলোচনায় সামিল হই। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় বিশ্ব সাহিত্য ভাষা বংশয সন্তান পাশ্চাত্য সাহিত্য দুরন্তপণায় নিজস্ব স্বাভাবিক ধ্যান ধারণা লাভ করেছিল খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় দেবদেবীর মাহাত্মকীর্তনের জন্য যে কতগুলি বিনামৌলিক স্বত্বাধিকারী মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম মঙ্গলকাব্য গোসানীমঙ্গলের হাত ধরে। কবি রাধা কৃষ্ণ দাস বৈরাগী যথার্থই ভাষার লালিত্যের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। কোচবিহার জেলার মহকুমা শহর দিনহাটা থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে গোসানীমাড়ি গ্রামে দেবীর এক প্রাচীনতম মন্দির আছে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই মন্দির নির্মাণ হয়েছিল বলে জানতে পারা যায়। কিন্তু গোসানী দেবী এরোও আগের থেকে পূজিতা হয়ে আসছে বলে জানতে পারা যায়। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে যে লৌকিক দেবদেবীর প্রথাগত নিজস্ব স্বভাব আছে গোসানী দেবীর ক্ষেত্রেও সেই স্বভাবগুলো স্বাভাবিক রয়েছে। দেবীর নিজস্ব কোন মূর্তি নেই কিন্তু রুপোর কৌটায় আবদ্ধ এককবএই দেবী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন। দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন করে মঙ্গল কাব্য রচনার রীতিতে গোসানি মঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। তার রচনাকালের দিক থেকে সবথেকে বড় আধুনিক মঙ্গলকাব্যের উদাহরণ হল গোসানী মঙ্গল কাব্য। কোচবিহাররাজ হরেন্দ্রনারায়নের রাজত্বকালে উনবিংশ শতাব্দীতে এই মঙ্গল কাব্য রচিত হয় তবে গোসানীমঙ্গল আকারের দিক থেকে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের থেকে নিতান্তই ক্ষুদ্র। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় পর্তুগিজদের হাত ধরে পাশ্চাত্য শব্দবাহী ইংরেজি শব্দ কিভাবে বাংলা সাহিত্যের স্থান বাছাই করে নিয়েছিল তা গোসানী মঙ্গলে পড়লে সহজে জানা যায়। নিচে একটি উদাহরণ দেওয়া রইল,
      ' কামানে পুরিয়া গোলা ফায়ার করিল।
        গোলাঘাটে শিলদ্বার ভগ্ন হয়ে গেল।। '
বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসের জনক শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য,সুসাহিতিক ডক্টর দ্বিগবিজয় দে সরকার, লেখক শ্রী তাপস দাস সহ পর্তুগিজ দলের ভারত ডিরেক্টর জেনারেল অফ আর্কিওলজি শ্রী এম এস ভ্যাটস সহ পর্তুগিজ ভূপর্যটক বুকনেন হ্যামিলটনের মত বহু স্বনামধর্ম মানুষের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শে আজও উজ্জ্বল গোসানীমঙ্গল।

বাংলাদেশে ষোড়শ শতাব্দী থেকে পর্তুগিজ বণিক ও বোম্বেটের দল আসতে শুরু করেছিল। তাদের সন্ত্রাসের কথা এখনো ইতিহাসে দুঃস্বপ্নের মতো বেঁচে আছে। তাদের পিছু পিছু মিশনারি সম্প্রদায়ও এদেশে এসে ছলে বলে কৌশলে বাংলার গ্রামে গ্রামে গির্জাঘর বানিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের ধরে ধরে খ্রিস্টান করতে শুরু করেছিলেন। এরা দেখলেন যে এ দেশের ভাষা না শিখলে ধর্মান্তিকরন ভালোভাবে চলবে না তাই কোন কোন ধর্মযাজক বহু পরিশ্রম করে কিছু কিছু ভাষা শিখেছিলেন তখন বাংলা ভাষার কোন ব্যাকরণ ছিল না। এরা নিজেরা চেষ্টা করে নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি মতো পর্তুগিজ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান সংকলন করেন। তার কিছু কিছু পর্তুগালের রাজধানী লিসবন নগরে রোমান অক্ষরে ছাপা হয়েছিল। কেউ কেউ হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করে এবং খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য যে দু একখানা পুস্তিকা লিখেছিলেন তারও কিছু কিছু রোমান অক্ষরে ওই লিসবন নগরে ছাপা হয়েছিল। রোমান অক্ষরে ছাপার কারণ তখনও ছাপার অক্ষরে বাংলা হরফের ব্যবহার শুরু হয়নি। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারী হালহেডের A grammar of Bengal language এ সর্বপ্রথম ধাতুতে খোদাই বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়। যাই হোক পর্তুগিজ মিশনারী যারা বাংলা ভাষা চর্চা ও তাতে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে দুজনের নাম করতে হয়। ১. মানোএল দা আসসুম্পসাউ, ২.দোম আন্তোনিও দো রোজারিও। এরমধ্যে মানোএল সাহেব ছিলেন খাটি পর্তুগিজ আর দোম আন্তোনিও বাঙালি ছিলেন পরে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হন। এই দুজনের দু একখানি গ্রন্থ পর্তুগিজ প্রভাবিত বাংলা গদ্যের সার্থক উদাহরণ তার মধ্যে দোম আন্তোনিয়র ভাষা বাংলা ভাষার অধিকঅনুগু কারণ তিনি বাঙ্গলার সন্তান কিন্তু মানোএলের ভাষায় বিদেশি শুলক অত্যন্ত জড়তা আছে যদিও তিনি বাংলা ব্যাকরণ অভিধান সংকলন করে এ ভাষার প্রতি কিছু গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। মানোএলের ব্যাকরণের পর্তুগিজ নাম vocabulario em idioma bengalla e portugueg(কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ) ১৭৩৩ সালে রচিত হয়। ১৭৪৩ সালে লিসবন থেকে রোমান অক্ষরে মুদ্রিত রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টতত্ত্ব বিষয়ক পুস্তিকা এতে তিনি খ্রিস্টান ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও কৃপা অর্থাৎ ঈশ্বর কৃপা বলে অন্য সমস্ত ধর্মকে বিশেষত হিন্দু ধর্মকে নস্যাৎ করেছেন। ঢাকা জেলার ভাওয়াল পরগনার গির্জার নেতা মানোএল পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা শুনেছিলেন তাই তার ভাষা ভঙ্গিমায় পূর্ববঙ্গের কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দের প্রভাব আছে। তার ভাষা সচ্ছন্দ নয় অনেক স্থানে তিনি খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব ব্যাপার কে বাংলা ভাষায় ভালো করে বোঝাতে পারেননি। যাই হোক মাঝে মাঝে তিনি বাংলা সাধু ভাষার ঢংটি মন্দ আয়ত্ত করেননি। এখানে মূল রোমান হরফে ছাপা গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃত হচ্ছে এবং তার সঙ্গে বাংলা অক্ষরে তার রূপান্তর করে দেখানো হলো,
' Sevilha xuhore eq grihoxto assilo,tahar nam cirilo,xei cirilo quebol aq putro jormilo, tahare eto doea corilo,ze cono din tahare xiqhao na dilo ebang xaxtio na dilo, xe zaha corite chahito,taha corito. '
' সেভিলা শহরে এক গৃহস্থ আছিল, তার নাম সিরিলো, সেই সিরিলো কেবল এক পুত্র জন্মাইল, তাহারে এত দয়া করিল যে কোনদিন তাহারে শিক্ষাও না দিল এবং শাস্তিও না দিল, সে যাহা করিতে চাহিত, তাহা করিত। '

শ্রীরামপুর মিশন থেকে কেরি মার্শম্যান প্রভৃতি মিশনারীদের নেতৃত্বে বাংলা ও অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় বাইবেল অনুদিত ও মুদ্রিত হয়ে সর্বত্র বিতাড়িত হতে লাগলো। এর জন্যই এদের এদেশে পদার্পণ হয়েছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ওল্ড টেস্টমেন্টের সম্পূর্ণ এবং নিউ টেস্টামেন্টের খানিকটা অনূদিত হয়ে ছাপা হয় তারপর সমগ্র বাইবেল ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ধর্ম পুস্তক নামে ছাপা হয়ে প্রচারিত হয় অবশ্য ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কিছু পরে কেরি st. Marthew's Gospal এর বাংলা অনুবাদ 'মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত' নামে প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত এই বাইবেল নানা সংস্করণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে অন্যান্য ভাষাতেও বাইবেল অনূদিত ও প্রচারিত হতে থাকে এমনকি কেরি ও অন্যান্য মিশনারিরা সংস্কৃতে বাইবেল অনুবাদ করে সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন ফল হয়েছিল হাস্যকর। সাম্প্রদায়িক ধর্মের প্রতি অত্যাশক্তি মানুষের কাণ্ডজ্ঞান যে হরণ করে নেয় এই ঘটনায় তার প্রমাণ। সে যাই হোক এই সাহেব বাংলা সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষায় বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন অথচ তার অনুদিত বাইবেলের ভাষা খট মট অমসৃণ, দুর্বোধ্য অনভ্যস্ত এবং বাঙালির কানে অতি অপরিচিত বলে মনে হবে। তার বাইরে অনেক সংস্করণ হয়েছিল কিন্তু ভাষার বিশেষ উন্নতি হয়নি। কেরি আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে মাটি করে ফেলেছেন। একটু দৃষ্টান্ত দেওয়া হল,
' তখন ঈশ্বর বলিলেন দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশের মধ্যে দিবারাত্রি বিভিন্ন করিতে ও তাহা হউক চিহ্ন ও কাল ও দিবস ও বৎসর নিরূপনের কারণ। তাহারাও দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশে উজ্জ্বল করিতে পৃথিবীর উপর। তাহাতে সেই মতো হইল। তারপর ঈশ্বর নির্মাণ করলেন দুই বড় দীপ্তি বড়তর দীপ্তি দিবসের কর্তৃত্ব করিতে ক্ষুদ্রতর দীপ্তি রজনীর কর্তৃত্ব করিতে তিনিও নির্মাণ করিলেন তারাগন।
 কেরী সাহেব এখানে বাংলা গদ্যের অন্বয় পর্যন্ত গোলমাল করে ফেলেছেন কারণ তিনি ঠিক ইংরেজি বাইবেলের বাক্য গঠনের হুবহু রীতি অনুসরণ করতে গেছেন। এ ভাষায় জড়তা আজ সকলেরই চোখে পড়বে, তাই অধুনা খ্রিস্টান মিশনারীগন বাঙালির জন্য আধুনিক বাংলায় বাইবেলের অনুবাদ প্রচার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তার দ্বারা উৎকৃষ্ট ফল লাভ হচ্ছে কিনা জানিনা কিন্তু এগুলি বেশ সুখপাঠ্য তা স্বীকার করতে হবে। সে যাই হোক সাহেবের এই বাইবেলি বাংলা এখন আমাদের কাছে যতই তুচ্ছ হোক না কেন একদা এই প্রাতঃস্মরণীয় মিশনারী বাংলা ও সংস্কৃত গ্রন্থাদি প্রচার করে বাঙালি জাতির উপকারই করেছিলেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিত মুন্সি ও কেরি সাহেবের গদ্যগ্রন্থ গুলি প্রধানত লেখা হয়েছিল বিলিতি সিভিলিয়ান কর্মচারীদের বাংলা শেখাবার জন্য। বিদেশী ছাত্রেরা কেরী ও বাঙালি অধ্যাপকদের কাছে অল্প দিনের মধ্যেই ভালো বাংলা শিখতেন কেউ কেউ সুন্দর বাংলা বক্তৃতা করতে পারতেন। একটু দৃষ্টান্ত, ' অনেক লোকের অনুমান যে আসীয়ীরদের বুদ্ধি ইউরোপীয়দের মত নহে। তন্নিমিত্ত তাহারা ইহারদের মতো নীতিজ্ঞ হইতে পারিবে না এই দুই এক বাক্য হইতে উৎপন্ন' কলেজের পরীক্ষায় তাদের বাংলাতে বক্তৃতা করতে হতো কেউবা প্রবন্ধ লিখবার মতো ভাষাজ্ঞান অর্জন করেছিলেন কিন্তু এই পুস্তিকাগুলি নানা কারণে জনসমাজে বেশি প্রচারিত হয়নি। দেখা যাচ্ছে যে কেরী সাহেবের সহকারীদের কেউ সংস্কৃত রীতি কেউ ফারসি রীতিতে কেউবা ইংরেজি ধরনের অন্বয় অনুসরণ করেছিলেন কেউ কেউ আবার মুখের অমসৃণ কথাকেই সাহিত্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ বাংলা গদ্যে যথার্থ রূপ কি হবে তাই নিয়ে কেরী ও তার সহকর্মীরা নানা ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন কিন্তু কেউ আদর্শ গদ্য নির্মাণ করতে পারেননি। সহজাত শিল্পবোধ ছিল বলেই ওরই মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় সাধু গদ্যরীতির কাঠামো অনেকটা ধরতে পেরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ রামমোহন সম্বন্ধে বলেছেন, 'কি রাজনীতি কি বিদ্যাশিক্ষা কি সমাজ কি ভাষা আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই।' ভাষার বিকাশের দিক থেকে তার কথা যথার্থ। রামমোহনের গদ্য সম্বন্ধে তার একজন ভক্ত স্থানীয় কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন 'দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন তাহাতে কোন বিচার বিবাদ ঘটিত বিষয় লেখার মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ পাইত এই জন্য পাঠকরা অনায়াসে হৃদয়ঙ্গম করিতেন কিন্তু সে লেখায় সত্যের বিশেষ পরিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না।' এ বিষয়ে ঈশ্বর গুপ্তের মন্তব্য চিন্তার উদ্রেক করবে। রামমোহনের গদ্যে সাবলীলতা ও সরসতার একান্ত অভাব তাকে বিতর্ক পুস্তিকার লেখকের পরিণত করেছে প্রথম শ্রেণীর প্রাবন্ধিকের গৌরব দিতে পারেনি।

এরপর ক্রমে ক্রমে বাংলা মায়ের সন্তান স্বরূপ যে সব বিখ্যাত অবিখ্যাত প্রাবন্ধিক, কবি, উপন্যাসিক মহাকাব্যেরকবিদের আবির্ভাব হয়েছিল বঙ্গ সাহিত্যের আঙিনায় তাদের নবজাগরিত মানব সত্তারশ্মী ও উদ্দীপ্ত সূর্যালোকের হাত ধরাধরি করে বিশ্ব সাহিত্য পরিবারের পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য ভাবনা রুপী বালকটি এসেছিল। বিশ্বকবির হাতেখড়ির পূর্বে প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝখানে বাংলা গদ্য সাহিত্যের আঙিনায় যে যুগান্তরকামী সাহিত্য প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল তিনি হলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিম তার উপন্যাস ও প্রবন্ধগুলির ভাষার লালিত্যোর ক্ষেত্রে যতই মাতৃপরায়ণ পুরাতন সাধুরিতির পরিপন্থি হোন না কেন সাহিত্য সম্রাটের লেখা প্রথম উপন্যাস ' The Rajmohan's wife ' অথবা প্রকাশিত উপন্যাসের ক্রোম অনুসারে তার লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস 'কপালকুণ্ডলার' প্রথম খন্ডে এক, দুই, তিন, সাত ও আট দ্বিতীয় খন্ডে এক ও সাত চতুর্থ খন্ডে দুই, তিন, চার, পাঁচ, সাত ও আট পরিচ্ছেদ সৃষ্টির আগে পাশ্চাত্য সাহিত্যের যুগবালকদের লেখা যুগশ্রেষ্ঠ সাংকেতিক উক্তিগুলি ব্যবহৃত হয়েছে তার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ লগ্ন থেকেই ভারত তথা আমাদের বঙ্গে পর্তুগিজ মিশনারীদের অনুকূল্যে তৎকালীন শিক্ষিত সমাজমন্ডলে পাশ্চাত্য সাহিত্য তত্ত্বের বিভিন্ন বই সম্পর্কে আলোচনা ও সেগুলি পুরোদমে পাঠ করা হতো নিঃসন্দেহে। এভাবে যুগের পর যুগ ধরে ভাষা ব্যবহারের প্রধান ক্ষেত্র এই সাহিত্যের আঙিনায় সেই ধারা পর্যায়ক্রমে চলে এসেছে বর্তমানেও আসছে ও ভবিষ্যতেও যে সেই ধারার জলে কেউ বাঁধের সৃষ্টি করবে সেটা বলা পাপ।

তথ্যসূত্র:
১. বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়
২. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩. গোসানীমঙ্গল, ডাঃ নিপেন্দ্রনাথ পাল সম্পাদিত
৪. The Rajmohan's wife, Bankim Chandra Chattopadhyay
৫. কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
৬. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, চতুর্থ খন্ড
৭. বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, পঞ্চম খন্ড
৮. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, ষষ্ঠ খন্ড
৯. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, সপ্তম খন্ড
১০. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অষ্টম খন্ড
১১. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, নবম খন্ড




বর্ষা যাপন 


ত্বমসি মম....
শ্রাবণী সেন

তুমি এলে শেষ যত মালিন্য দ্বন্দ্ব 
তুমি এলে চাঁদ হাতের মুঠোয় বন্দী
তুমি বললেই তর্কাতর্কি বন্ধ
তুমি চাইলেই তক্ষুনি হবে সন্ধি!

তুমি যেন ঠিক আষাঢ় বৃষ্টি বিন্দু 
 সাথে নিয়ে ফের হাওয়ার ঝলক হাল্কা 
 দৃষ্টি গভীর তলহীন নীল সিন্ধু 
মন দিয়ে আঁকো রঙ - তুলি বিনা কল্কা।

তুমি যদি চাও শীতের সকালে পদ্ম
তুমি গাইলেই স্বরলীন হন মান্না
তুমি চাইলেই নীরস তথ্য পদ্য
তুমি আছ বলে গাছের পাতায় পান্না!

তুমি আছ বলে হিমালয় ঢাকা বরফে
তুমি চাইলেই ক্ষীণানদী  দ্রুতছন্দা
তুমি ভালোবাসা লিখে দাও  মনহরফে
তুমি  চাও তাই সুবাস  রজনীগন্ধার। 




বারিসওয়ালা
  লীনা রায়

আলগা মুঠোর জাবদা খাতায়
পাওনা দেনার হিসেব তোলা,
ভোজবাজিটাই চাইছি ভীষণ
কোথায় রে তুই বারিসওয়ালা?
লুকোচুরি খেলছে যে রোদ
মেঘ ঢেকেছে মন জানালা,
নাছোড় গুমোট অষ্ট প্রহর
দিন রাত্তির একই খেলা।
আলগোছে জল ছিটিয়ে দিয়ে
ভাসিয়ে দে না মেঘের ভেলা,
কাক ভেজা হই সোহাগ জলে
রামধনু রং থাক না তোলা
বৃষ্টি শেষে খেলবো হোলি
কোথায় রে তুই বারিসওয়ালা?



 আষাঢ় নিজেই একটি কবিতা
   রীনা মজুমদার

আষাঢ় নিজেই নিজেকে নিয়ে লেখে কবিতা 
একদিকে আশা অপরদিকে তার সর্বনাশা

আষাঢ় নিজেই ছেলেবেলার শ্রেষ্ঠ কবিতা
শব্দেরা ভিড় করে - টিনের চাল, পুতুল খেলা
কাগজ, নৌকো, ধোঁয়ায় ঢাকা রান্নাঘর!
হারমোনিয়াম, রেডিও, জল থৈ থৈ পথ, রেইনিডে 
বই খোলা সামনে আর জানালায় চোখ 
  বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি...

আষাঢ়কে নিয়ে আমার আর কবিতা লেখা
হয় না... আষাঢ়ে শব্দগুলো নিয়ে তাই
অনুভবে আষাঢ়কে খুঁজে পাই, 
পড়ে নিই বারবার শৈশবের শ্রেষ্ঠ কবিতা

 আষাঢ় নিজেই একটি কবিতা
 আষাঢ় আসে আষাঢ় যায়...



মেঘলা জীবন 
 অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

আলোআঁধারি ঘরের সস্তা চৌকিতে রান্নার স্টোভ
ধিকিধিকি আগুনে ফুটছে খিদের ভাত ..
মাটির মেঝে যেন আস্ত এক নদী
রোকেয়াও তো নদী হতে চেয়েছিল,
বয়ে যেতে চেয়েছিল নিরিবিলি এক জীবনস্রোতে
যে তাকে ছায়া দিতে চেয়েছিল বৃক্ষ হয়ে
কথা রাখেনি সে..
ঘরের গা ঘেঁষা নদীটির পাড়ভাঙার মতোই
অতলে নিঃস্ব করে হারিয়ে গেছে..
অবিরাম ঝরছে ত্রাসের বর্ষা
ত্রাস আশ্রয়ে,পেটের ভাতে,ভালোমানুষির ছদ্মবেশে ..
ছোট্ট সহায়টুকু বেঁচে ছিল
বাসাবাড়ির ঠিকে কাজে,আত্মজর ওমে..
রাক্ষুসী নদীর ত্বর সইলনা
ভিটেমাটি ছাড়া করে
ডোবালো গভীরে আরও গভীর দুর্বিপাকে..
সোদামাটির গন্ধ মেশা ভাত ফোটার গন্ধে মিশছে হারিয়ে যাওয়া মায়ের গন্ধ,
মিশছে জল ছপছপ শৈশব কৈশোরের 
সুগন্ধী বর্ষা,
হঠাৎ উধাও হওয়া স্বামীর গন্ধও মিশছে তাতে,
মিশছে আঁতুরঘরের সদ্যজাতর গন্ধ..
সব গন্ধ ছাপিয়ে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে
জীবনের এক নতুন পরোয়ানা জারির কটূ গন্ধ,
অন্ধকারের সাতকাহন..
ধারে পাওয়া আশ্রয়ের ধারের স্টোভের আগুন
রোকেয়ার চোখজুড়ে তুষের আগুনের মতো
বুকচাপা প্রত্যয়ে উদ্যত
ওত পাতা ফন্দিকে ঝলসে দিতে..
প্রহর জানে জ্বলবে, পুড়বে সে নিজেই..
পাড়ভাঙা নদী আরেক পারে 
নতুন পলির অবয়বে 
রোকেয়া ও রোকেয়ার মতোই 
অগুনতি আরও রোকেয়ার 
বারোমাসী বুনবে গল্প কথায়..
দায়ী থাকবে নির্মম এক আষাঢ় মাস..



বৃষ্টি মানব
সৈকত দাম

হঠাৎ আঁধার নেমে এলে টেবিলে রাখা প্রিজমে,
উঠে দাঁড়াই .....
মনে হয় তোমার হাত ধরে নেমে আসি ,
রামধনুর সিঁড়ি বেয়ে .....
তারপর অভিমানী আঁতরের গন্ধটা অনুভব করতে করতে ,
এগিয়ে যাই কাঁচের দিকে ......
যে কাঁচের বাইরেটা তখন মল্লার ......

আমার ভেতরে বেড়ে উঠছে গাছ অনবরত,
যে গাছ বিচ্ছেদ মানে না ....
জড়িয়ে ধরছে ল্যাপটপ,
গিলে খাচ্ছে ID কার্ড .....
কফি মগে ঝরে পরছে পাতা ....
ধোঁয়া ওঠা আকাশ ধুয়ে দিচ্ছে sector 5 ....
ধুয়ে যাচ্ছে ডিটারজেন্ট মোড়া শরীর ,
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি আলেকজান্ডারের মতো ,
যেন সব জেতা শেষ .....
এর পর শুধু রক্ত জেতা বাকি , 
করপোরেট রক্ত ...
তাও ভেঙ্গে যায় প্রিজমে .....
অন্ধকারে খোলস ছাড়ে শামুক ,
আর প্রতি আষাঢ়ে "বৃষ্টি মানব" হয়ে যায় ......



আষাঢ় মেঘ
কবিতা বণিক

আষাঢ় মেঘের কালো চুলে বজ্রমানিক গাঁথা। 
কদম বনে চলছে তাই ফুল ফোটাবার কথা। 
এসো এসো মেঘ , বাজাও ডমরু , গুরু গর্জনে। 
মুক্তধারার বৃষ্টিধারা ঝরুক আষাঢ় দিনে। 
তৃষ্ণার্ত শুষ্ক ধরায় শান্তি আনুক সকল প্রাণে। 
শিখী চায় মেলতে পাখা আষাঢ় বাদল দিনে। 
ফটিক - জল ফটিক- জল চাতক ডেকে ফেরে। 
মেঘের বা্ঁধন খুলে, এসো আষাঢ় ,অঝোর ধারে।



বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
    মৌমিতা  বর্মন

             আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ছে
              বৃষ্টি  তে চারিদিক  থৈ  থৈ।
           গাছেরা  হয়েছে  গাঢ়  সবুজ
    আমার পাহাড়ী বৃষ্টি খুব  ভালো  লাগে
 তোমারো বৃষ্টি নিয়ে অনেক রোমান্টিসিজম আছে।
তুমি একবার বলেছিলে  বৃষ্টিতে তোমার নেশা  হয়।
      আমাকে ভালোবাসার  নেশা  হয়
   আমার শরীর  ছুঁয়ে যে পাহাড়ী বৃষ্টি নামে
    তাতে তোমার ভিজতে  ভালো  লাগে
   আমার কপাল, চিবুক  ঠোঁটে যে 
      বিন্দু বিন্দু জল লেগে থাকে
         তাতে তুমি ডুবে যেতে পারো।
মহাসাগরের  অতল  গভীর  তুমি ছুঁয়ে আসতে পারো
                        একলহমায়।

       আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ছে
   তোমার কাছে তাই বৃষ্টি পাঠালাম।
ঘুম, ঘুম  নেশা  জড়ানো  বৃষ্টি মাখা  দিন।
যদি  কাজের ফাঁকে একটু সময়  মেলে
দেখে  নিও নীল খামে ভিজে  আছে  দুটি চোখ
বৃষ্টি কেমন ভিজিয়েছে  ঠোঁট।
যদি  এই শরীর  ছুঁয়ে নেমে যেতে পারো
পাহাড়ী নদীর  মত-
তবে এই বৃষ্টির দিনে
তোমার ঠোঁটের কৌমার্য্য ভেঙে
আমিও নেশাতুর  হবো।



আষাঢ়ের জলছবি…
প্রতিভা পাল
  
বৃষ্টিও কি ঝরে পড়ার মুহূর্ত 
মুহূর্তে ভুলে যায় বর্ষার কান্না হয়ে ?
হন্যে হয়ে খুঁজতে গিয়ে শব্দরা 
জলের কাছে গচ্ছিত রাখে দিনের যত ঋণ?      
আষাঢ়ের আকাশে 
আবছা হঠাৎ রোদের মতো 
সময়ও কী ভীষণ তাৎক্ষণিক, 
বহমান, অন্তর্লীন !
মেঘের অহংকারে বৃদ্ধ হয় অভিজ্ঞতা ;
অপেক্ষাদের অজানা শোক
আল্পনা আঁকে জলজ স্বপ্নের !
রাত্রি যখন বর্ষাতি হয় মনের অববাহিকায়,
আগলে রাখে চোখের দু'কোণ দ্রাব্যতা মেপে, 
বিরহী কোনও স্বরলিপির সুরে-
অঝোর-শ্রাবণ কারণ খোঁজে জীবন জানার,
মেঘলা মেঘের অকারণ অবাধ্যতায়…..



 আহ্লাদী 
     সুনন্দ মন্ডল

নামল আষাঢ় বর্ষা ঘন
উথাল পাথাল মন।
চাতক পাখির সুখের গানে 
পিচ্ছিল হল বন।

আমরা সুখী বৃষ্টি ছোঁয়ায়
বাদল মেঘের ডাকে।
আবাদি মন চাইছে সবুজ
তীব্র রোদের ফাঁকে।

ছায়ায় ঘেরা মেঘের চাদর
জড়িয়ে ধরার বুক।
নতুন গানে ধানের টানে
আহ্লাদী উৎসুক।



প্রিয় বর্ষা ঋতু আমার চোখের তারায় ভাসে
বটু কৃষ্ণ হালদার

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে /ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে ।বর্ষা ঋতুর আগমনই কবি সুনির্মল বসু এঁকেছেন প্রকৃতির মায়াবী রূপের ছবি। বর্ষা সবচেয়ে আদরের ঋতু। সজল মেঘ মেদুরের অপরূপ বর্ষার সঙ্গে রয়েছে বাঙালি জাতির আজন্ম কাল হৃদয়ের বন্ধন ।কৃষিপ্রধান ভাইদের জীবনে এনে দেয় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ।বজ্রবিদ্যুৎ ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রুক্ষ অবক্ষয় শুষ্ক মরু প্রান্তরে এনে দেয় সবুজ সতেজ প্রাণের সঞ্চার ।রৌদ্র জলের মাখামাখি তে প্রকৃতি রানী সেজে ওঠে নবরূপে। শস্য শিশুর কল কল উচ্ছ্বাসে তার চোখে লাগে অনাগত দিনের বিভোর স্বপ্নের নেশা ।প্রকৃতি রানীর আঁচলভরে ওঠে নতুন দিনের স্বপ্ন বিভোর হয়ে ।বর্ষাকাল শস্য-শ্যামলা আনন্দঘন নবান্ন উৎসব এর নেপথ্য মঞ্চ ।আবার তারই অপ্রসন্ন অভিমানী দৃষ্টিতে ঘরে ঘরে অন্তহীন সংহার রূপে মানুষ আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত ।শ্যাম ঘন বরষা একদিকে যেমন গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আশীর্বাদ, অন্যদিকে আবার দরিদ্র পল্লীবাসী অনাহারী ফুটপাতবাসী দের কাছে দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ জীবন প্রবাহের এক অপরিহার্য কল্যাণী ঋতু।
কবিগুরু লিখেছেন "এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়"কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থ ব্যঞ্জনাময় বিস্তৃত ।বর্ষাকাল হলো অবকাশের নিষ্প্রয়োজন ঋতু। ঋতু শুধু অর্থনৈতিক জীবনে নয় সাংস্কৃতিক ভাগবত জীবনের ও বর্ষা ঋতু রয়েছে এক অনন্য ভূমিকায় ।বর্ষার সরস সজল স্পর্শ শুধু রুক্ষ ধূসর প্রান্তকে অসীম কানে স্পন্দিত করে নি প্রেমিক মনকে দুর্বল করে তোলে। প্রেমিকার নিঠুর ঠোঁটের ভাজে উর্বর ভাষা য় উন্মাদনার চেতনা সঞ্চারিত হয় ক্ষণে ক্ষণে । বর্ষা উৎসব আনন্দে রচিত হয়েছে কাব্য, গান ,উপন্যাস ও অজস্র প্রেমের কবিতা  আলো আঁধারের খেলা অনুষ্ঠিত হয়  বিমোহিত করে প্রকৃতি রানী কে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগের অধিক বর্ষাকাল সংঘটিত হয়। নদী নালা খাল বিল পুকুর ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমি লতা, শাপলাদের সমাবেশে সেজে ওঠে প্রকৃতি কন্যা।বর্তমানে আমাদের দেশে ঋতুচক্র আবর্তিত হয়। ছয়টি ঋতুর সমাহার ।দ্বিতীয় এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋতু হলো বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের দাবদাহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাতক পাখির মতো এক পশলা বৃষ্টির জন্য তাকিয়ে থাকে ঐ দূর আকাশের দিকে ।
বর্ষার আগমনী গান "আমি বর্ষা অমলিন গ্রীস্মের প্রদাহ শেষ করি, মায়ার কাজল চোখে, মমতার বর্ম পুট ভরি"।প্রকৃতি যেন নিজের তিস্নার্ত বুক ভরানোর জন্য বর্ষাকে আহবান করে।জেলেদের মাতান উল্লাসে জাল ফেলে নদীতে ।জল ভরে উঠে আসে রুপালি মাছ । জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কলা গাছ কেটে ভেলা বানায় ছোট্ট শিশুর।কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে শৈশব। ডুব দিয়ে হার মানায় পানকৌড়িকে। এই বর্ষা প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে বৃষ্টির ।ফলে সতেজ হয়ে ওঠে গাছপালা। এ সময় নানা ধরনের ফুলের ফুল ও ফলের সমারোহ সেজে ওঠে প্রকৃতি রানীর প্রাণের ডালা। কদম ,রজনীগন্ধা ,কেয়া ,জুই ,গন্ধরাজ, হাসনুহানার গন্ধে প্রকৃতিকে বিমোহিত করে তোলে। আম, জাম ,কাঁঠাল পেয়ারা সহ বিভিন্ন হলে সম্মোহিত হয় প্রকৃতি।বাংলা মাস অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। 
যতদূর দৃষ্টি যায় পাংশুটে আকাশে মেঘের জাল বোনা ।প্রকৃতির নিথর নিস্তব্ধ তৃণভূমিতে জেগে ওঠে প্রাণের হিল্লোল।আকাশ দিগন্ত বিস্তার ধূসর মেঘ পুঞ্জিতে।সজল দিগন্ত ভেসে চলে বলাকার সারি ।কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় জনহীন পথঘাট ক্ষুদ্র পবনের মত্ততা ভবনে ভবনে রুদ্ধ দুয়ার।থেকে থেকে দীপ্ত দামিনীর চমক উদ্ভাস কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে চারিদিক গতিময় আর্তিকার
মহা উল্লাস।বর্ষাকাল রূপ-বৈচিত্র্যে তুলনাহীন মানুষের মনে সঞ্চয় করে অনন্ত বিরাজময় বেদনা ।বর্ষার এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে ধ্বংসের প্রলয় ডমরু। এক পদপাতে সৃজনের প্রাচুর্য অন্য পাতে ধ্বংসের তাণ্ডব। এক চোখে অশ্রু অন্য চোখে হাসি ।বর্ষা আমাদের কাছে অতি আদরের ও অনন্ত বেদনার ঋতু রূপে পরিচিত। তাইতো বর্ষা হলো প্রেম কবিতা,কবির ভাষায় বলা যায়:_
ওরে বন্ধু জীবন সাথী,আয় ফিরে আয় ঘরে
তুই যে আমার বৃষ্টি রানী,রাঙা মাটির পরে"
মুখখানি তোর লুকিয়ে রাখিস,কিসের অভিমান? 
তুই না এলে তুলবে চাষী,গোলায় পোড়া ধান"
একে একে যাচ্ছে ফিরে,যাদের আয়ু অল্প 
খাপরার চাল হচ্ছে খালি,শুনে যা সেই গল্প "
জল জোয়ারে শূণ্য উনূন,শিশুর শুকনো মুখ 
অশ্রুধারায় চলছে ভিজে,শূন্য মায়ের বুক " 
পথের পথিক যায়নি হাটে,ফিরছে অভিমানে 
উষ্ণ বায়ুর ভীষণ দাপট,ক্লান্তি মনও প্রাণে"
ওই পাহাড়েরে চূড়ায় খেলিস, লুকোচুরি খেলা
মাঠ ঘাট সব ভরিয়ে দে,যেথা ভাসবে রঙিন ভেলা "





ভ্রমণ 

গোসাবা ও স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন
       জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্তমানে সুন্দরবনের পর্যটকদের আকর্ষণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত গোসাবার  স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের বেকন বাংলো। আমপান ও বুলবুল নামক ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বাংলোটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলাকার বাসিন্দারা বাংলো সংস্কারে সরব হন। কয়েক বছর আগে বাংলো সংস্কারে উদ্যোগী হন গোসাবার বিডিও সৌরভ মিত্র। বহু বছর ধরে এই বাংলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। শেষে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যাধরী নদী ঘাটের কাছেই এই বাংলো ইতিহাসের এক সুন্দর সাক্ষ্য বহন করছে।







গত মে মাসের ২৬ তারিখ কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে সুন্দরবন রওনা দি। সোনাখালি থেকে লঞ্চ ছাড়ে। লাঞ্চের পর আমরা পৌঁছাই গোসাবায়। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে গোসাবায় জনবসতি ও জনকল্যাণকর কাজের জন্য স্কটল্যান্ডের স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের নাম উল্লেখ্য। তিনি ১৯০৩--১৯০৭ সালের মধ্যে এই এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা নেন।





 আমরা গোসাবায় পৌঁছাই দুপুর চারটেয় । ঘাট থেকে সামান্য হেঁটে সাহেবের পুরোনো কাঠের বাংলাটি দেখি। এরপর সাহেবের তৈরী মূল বাংলোটির আদলে নির্মিত বাংলো ও বাংলো সংলগ্ন পার্কটিতে যাই। পড়ন্ত রোদে পার্কের মনোরম পরিবেশ ছিল উপভোগ্য। পার্কের মধ্যে পুকুরটি সংস্কার করে ছোট বড় অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। ফুলের দৃশ্য মনোহারী। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের মূর্তিযুগল পার্কের গুরুত্ব ও শোভা বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া বাঘ, হরিণ ও আদিবাসীদের নানান মূর্তিও পার্কে বেশ সুন্দর ভাবে স্থাপিত। সব মিলিয়ে পার্কটি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথ ও সাহেবের ব্যবহৃত দ্রব্য সামগ্রী, ছবি ও বই নিয়ে সংগ্রহশালা নির্মাণের পরিকল্পনাও প্রশাসনের আছে। 

স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই গোসাবায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের বিশেষ আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গোসাবায় আসেন। কবিগুরুর সম্মানার্থে নির্মিত তাঁর মূর্তি ও স্মৃতি ফলকটি এই পার্কে লক্ষিত হয়। গান্ধীজী গোসাবা যাননি। তিনি তাঁর সেক্রেটারী মহাদেব দেশাইকে প্রেরণ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এক সপ্তাহ গোসাবায় ছিলেন। ফিরে গিয়ে মহাদেব দেশাই তাঁর গোসাবা ভ্রমণের কথা চারটি অধ্যায়ে গান্ধীজীর সাপ্তাহিক পত্রিকা 'হরিজন'এ লিখেছিলেন।  গোসাবায় স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের উন্নয়নমূলক কাজের উদ্যোগ দেখে তাঁর খুবই ভালো লাগে।






 স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী ছিলেন।  তিনি বাংলাকে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান বলে ভাবতেন। দূরদর্শী সাহেব গোসাবায় পা রেখে গ্রামীণ সমাজকল্যাণের প্রতি আগ্রহী হন। স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন প্রকৃত জনদরদী ও সংস্কারক ছিলেন। তখন দেশে জাতীয় আন্দোলন চলছে। স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন গোসাবার গ্রামীণ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর উদ্যোগে ত্রিশ বছরের জঙ্গল পরিষ্কার করে দশ হাজার মানুষের বাসযোগ্য ভূমির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে যুগে সুন্দরবনে এরকম জনকল্যাণমূলক কাজ বিরল। স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের প্রচেষ্টায় কোঅপারেটিভ সোসাইটি,ডাক্তারখানা, স্কুল সবই  গোসাবায় গড়ে উঠেছিল।






স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন গোসাবায় ও সমগ্র সুন্দরবনে কোঅপারেটিভ সোসাইটির প্রবর্তন করেন। শিক্ষিত জনগণ এর দায়িত্ব নেন। স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন ১৫ জনকে নিয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি স্থাপন করেন গোসাবায়। ১৯১৮ সালে তিনি কনসিউমার্স কোঅপারেটিভ সোসাইটি চালু করেন। ১৯১৯ এ  হ্যামিল্টন সাহেব ধান, তরকারি ও ফলসমূহের উৎপাদনের জন্য সেন্ট্রাল মডেল ফার্ম স্থাপন করেন। ১৯২৩ এ তিনি কোঅপারেটিভ প্যাডি সেলস সোসাইটি,১৯২৪ এ গোসাবা সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক,১৯২৭ এ জামিনি রাইস মিল,১৯৩৪ এ রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ইনস্টিটিউট এবং আরো দু বছর পর স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন গোসাবায় এক টাকার নোট প্রবর্তন করেন।

           একজন বিদেশী বাংলার নদী উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে ভালোবেসে তাঁর জনহিতকর কীর্তির নিদর্শন স্থাপন করেছেন--এ কথা জেনে ভীষণ ভালো লাগে। গোসাবার পার্ক ও বাংলো পরিদর্শন করে ছাত্রীদের নিয়ে লঞ্চে ফিরে যাওয়ার সময় বিদ্যাধরী নদীবক্ষে সুন্দর সূর্যাস্ত মুগ্ধ করে। এক অভূতপূর্ব অনুভূতির রেশ নিয়ে সকলে গোসাবা থেকে ফিরে আসি।



 চলে যাওয়া দিনগুলো

        চিত্রা পাল

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন বাইরে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ, ঘরের ভেতরেও তার আভাস। পাখার হাওয়াতেও সেই গরম, তবে একটু কম ।মোটা পর্দার আড়ালে আধ ছায়া ঘরে ভেসে আসে ফেলে আসা সময় এর ছবি। অতীতে পৌঁছে দিতে এই আলো আধাঁরি আবহের জুড়ি মেলা ভার।

এখন সেই ভ্রমণের দিনগুলো মনেপড়ছে,  আমার দেশ থেকে বহু বহু দূর সেই দেশের কথা, সেই উত্তর গোলার্ধের নরওয়ে দেশের বার্গেন শহরের কথা। যেখানে খাঁড়ির ধারে আজও রয়েছে সারিবদ্ধ প্রাচীন বাড়ি। আমরা গিয়েছিলাম আগষ্টমাসে। ওখানকার অধিবাসীদের কাছে তখন মনোরম আবহাওয়া, আর আমাদের কাছে শীতকাল। রাতে ডিনার টেবিলে বসে আগামীকালের বেড়ানোর বিষয় শুনলাম। শুনলাম সেই অসাধারণ ট্রিপ হবে আগামীকাল।আমরা কল্পলোকের মায়াজালে জড়িয়ে নিলাম নিজেদের।

  ওয়েকিং বেল শুনেই তড়াক লাফ দিয়ে বিছানা ত্যাগ করে চটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমরা ট্রেনে করে ঘুরে বেড়াবো সেই স্বপ্নলোকে।টুরিষ্ট কোচে করে আমরা এলাম ভস(Voss)রেলস্টেশনে। এখানে একটু বলে রাখি নরওয়ে রাজ্যের এই ভস শহর বোতলজাত জলের জন্য বিখ্যাত। ভস রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো ঠিক সকাল দশটায়। পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলেছি। একেবারে পাশে নীচ দিয়ে চলেছে রাস্তা সাইকেলারোহীদের জন্য। পথের ধারে ছোট ছোট কাঠের বাড়ী।সামনে পাহাড়ের গায়ে লেপটে আছে মেঘ সাবানের ফেনার মতো। এ পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। দূরে পর্বতরাজি, গায়ে হিমানীসম্প্রপাত। নীচের সমুদ্রখাঁড়ি থেকে মেঘেরা দল বেঁধে উঠছে পাহাড়ের গায়ে,উঠতে উঠতে এ ওর গায়ে মিশে যাচ্ছে হাসতে হাসতে মিলে যাওয়া সখীদের মতো। ট্রেনে আমরা যাচ্ছিভস(Voss)থেকে মিরডাল(Myrdal).মিরডাল নরওয়ে রাজ্যের অন্যতম পাহাড়ি রেলওয়ে জংশন স্টেশন। এখান থেকে অন্য ট্রেনে  যাব ফ্লা। এ এক আশ্চর্য বনপথে গমন। দু নয়ন ভরে শুধু দেখার শুধু দেখার। যাবার পথে এক ঝর্ণার ধারে ক্ষণিক বিরতি দিলো ট্রেন ওই ঝর্ণা দেখার জন্য।  আমরা ট্রেন  থেকে ঝুলতে ঝুলতে নেমে লোহার পাটাতন দেওয়া রেলিং দিয়ে ঘেরা (যেটা শুধুমাত্র এই ঝর্ণা  দেখার জন্যই করা) স্পটে দেখলাম  ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণাকে।নানাভাবে ঝর্ণা লেন্স বন্দী হলে  আবার সবাই এর ট্রেনে উঠে পড়া। ট্রেন চলছে তার আপন আনন্দে, আপন ছন্দে।এজন্যেই  সাধারণে এ জার্নির নাম দিয়েছে beautiful Train journey।  

 এসে গেলাম ফ্লা। একেবারে ফিয়র্ডের ধারে এই ফ্লা। ফ্লা তে এসে উঠে পড়লাম লঞ্চে ফিয়র্ড ঘুরে বেড়াবো বলে। লঞ্চেই হলো চা খাওয়া, ফ্লা থেকে অনেকে ওখানকার বিখ্যাত বেকারির কিছু নমুনা নিয়ে এসেছিলো সেইসব সহযোগে। ফিয়র্ড থেকে চারপাশের সৌন্দর্য একেবারে মনোমুগ্ধকর। এবার আমরা চলেছি বাসে হ্যামার। বাস চলেছে মসৃণ গতিতে,সামনে পথ খুলে যাচ্ছে কাল ফিতের মতো। পথের পাশে ফ্রকের ঝালরের মত আঁকাবাঁকা ফিয়র্ড । তার ওপারে তুষারমাখা পর্বতশ্রেণী, যেন ওড়নার ঘোমটায় ঢাকা এক লাবণ্যময়ী তার অপার সরলতা নিয়ে চেয়ে আছে কোন সুদূরে।সবুজ বনপথে যেতে যেতে এক বাঁকে এসে বিরতি পাওয়া গেলো খানিক। সেখানে ছোট স্রোতস্বিনী , তার ওপরে একখানা সরু ব্রীজ।ব্রীজের ওপর থেকে দেখলাম  একজন নদীর জলে ছিপ ফেলে বসে আছে মাছের আশায়। তীরে অনাবিল পরিচ্ছন্ন সবুজ। নদীতীরে দুদিকে দুটো কাঠের বেঞ্চ আর মাঝখানে টেবিল এমন দু চারটে সেট রাখা। যে কেউ ইচ্ছে করলে বসে থাকতে পারে এ বিহ্বল নির্জনতায়। সৌন্দর্য উপভোগের এমন ব্যবস্থা বোধ হয় এদেশেই সম্ভব।

আসলে কোনও দেশ তার পরিবেশ তার প্রকৃতি নিয়েই সে নিজের মত। তার সমস্ত আয়োজনের মধ্যে গিয়ে না দাঁড়ালে,ছবি দেখে তাকে বোঝা যায় না ভেতর থেকে।  নিজের দেশ থেকে বহু দূরে ওই ছোট্ট স্রোতস্বিনীর ধারে অফুরাণ সবুজের মাঝে ওই বিরলতায় নিশ্চিন্তে বসে থাকার আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আজ আবার সেই সবুজ বনভূমি দেখতে পাচ্ছি, এই ঘোর ঘোর গ্রীষ্মে সেই  ভাবনাতেও কি আরাম।





শিল্পী- অনুস্মিতা বিশ্বাস 


   


গল্প 

অনুভব
চম্পা বিশ্বাস 

             বাইরের গেটে সাইকেলের শব্দ হতেই বছর চারেকের রাজু এক ছুটে ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ায় । রতন গেট খুলে সাইকেল নিয়ে ভেতরে আসতেই ছোট্ট রাজু বলে ওঠে -- বাবা, মা কালকে সারারাত বাড়ি ফেরেনি । একথা শুনে রতন তাড়াতাড়ি সাইকেল রেখে অবাক হয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করে -- মা কখন বেড়িয়েছে আর কোথায় গেছে তুই জানিস ? ছেলে পরিষ্কার জানায় -- না তো বাবা ! 
রতন -- ঠাকুমা কোথায় ? 
রাজু -- ঘরে শুয়ে আছে। 
এবার রতন মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায় । 

           রতন পেশায় ড্রাইভার। একজন মালিকের গাড়ি চালায় সে । গতকাল বিকাল পাঁচটা নাগাদ মালিককে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়ে আজ সকাল সাতটায় বাড়ি ফিরে এসে শোনে এই দুঃসংবাদ।  কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে মাকে প্রশ্ন করে -- মীনা কোথায় গো মা ? কি হয়েছে গো ? 
মা -- কাল  তুই বের হওয়ার ঘন্টা খানেক পর বৌমা বের হয় , বলে একটু কাজ আছে ,  আসছি। তারপর আর আসেনি । তুই একটু খোঁজ কর না বাবা , কি হল ? আমার মোবাইলটা তো নষ্ট হয়েছে কয়েক দিন হল , তাই তো তোকে ফোন করা গেল না । 

        ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায় রতন।  নিজেকে একটু সামলে নিয়ে এবার একে একে আত্মীয় স্বজনদের কাছে ফোন করে সে । কিন্ত কোনও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতেই তো মীনা যায়নি । এমনকি বাপের বাড়ির লোকও তো কোনও খোঁজ খবর জানে না ওর । এবার কি করবে ও ! কিছুই বুঝে উঠতে পারে না । 

        কোথায় যেতে পারে ভাবতে গিয়ে মনে পরে  ওদের পাড়ারই একটি বাড়িতে মীনা মাঝে মাঝে যেত । ঐ বাড়ির মেয়েটির সাথে মীনার বন্ধুত্ব ছিল। আর একথা মীনার মুখেই শুনেছিল ও । তাই আস্তে আস্তে পা বাড়ায় ঐ বাড়ির দিকে । ওদের বাড়িতে গিয়ে শোনে -- ঐ মেয়েটির দাদার সাথে গতকাল মীনা পালিয়ে বিয়ে করেছে । ঐ বাড়িতে ওদের ঢুকতে দেয়নি । মুহুর্তে ওর পায়ের তলার মাটি যেন নড়ে ওঠে । ওদের এই সাত বছরের সংসারের কত স্মৃতি সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আর ওর ছোট্ট ছেলে রাজুর কথা ভেবে দুচোখ জলে ভরে ওঠে । বাড়ি ফিরলেই ছোট্ট রাজুর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভেবে , পা যেন ওখানেই শক্ত হয়ে আটকে আসে । নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে । নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে কি করে মীনা চলে গেল আর কেনোই বা নিজের সন্তানকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলল কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না রতন। বাড়ি এসে মাকে সব জানায় সে । ছোট্ট রাজু বারংবার প্রশ্ন করে জানতে চায় ওর মা কোথায় ? কিন্ত কোনও উত্তর নেই ওর । এবার সে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে বিয়ে করে জলপাইগুড়ি শহরেই একটি ঘর ভাড়া নিয়ে আছে ওরা । 

               এবার শুরু হয় রতনের নতুন লড়াই। ছোট্ট রাজাকে বোঝাতে হয় ওর মা আর আসবে না । আর ছেলের সবকিছুই খেয়ালও  তাকেই রাখতে হয় । বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব তো ওর আছেই।  এভাবেই চলে রতনের ছোট্ট সংসার -- মা আর রাজুকে নিয়ে । সময়ের সাথে সাথে ছোট্ট রাজুও বেড়ে ওঠে বাবা আর ঠাকুমার সহচর্যে।  কিন্ত ওর মা আর ফিরে আসে না ওদের জীবনে । আস্তে আস্তে মায়ের স্মৃতির আবছা হয়ে আসে রাজুর জীবনে । রাজু আজ অনেকটা বুঝতে শিখেছে । ভালো রেজাল্ট করে , বড়ো হয়ে বাবার পাশে দাঁড়াবে এই আশায় গভীর মনোযোগী হয়ে ওঠে পড়াশোনায়। এভাবেই রাজু প্রতি বছর ভালো রেজাল্ট করে , আজ মাধ্যমিকের দোরগোঁড়ায় দাঁড়িয়ে । 

              এদিকে বিয়ে করে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই রাজুর মা অনুভব করে তার ভুল। কিন্ত ফিরে আসার কোনও পথই যে আর খোলা নেই। ক্ষণিকের ভুলের কারণে নিজের সন্তানের সামনে এসে দাঁড়ানোর মুখ যে তার নেই। তাই সে মাঝে মাঝে এসে গোপনে দূর থেকে ছেলেকে একবার চোখের দেখা দেখে যায় । ছেলে তা বুঝতেও পারে না । 

            আজ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিন।  বাবা , ঠাকুমার আশীর্বাদ নিয়ে রাজু পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয় । দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে প্রায় তিন মাস অতিক্রান্ত। টিভিতে ঘোষণা করা হচ্ছে রেজাল্ট আর প্রথম দশজন স্থানাধিকারীর নাম। রতন আজ সকাল থেকেই কাজে না গিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখে -- কখন রেজাল্ট বের হবে আর তারপরেই ওর ছেলের রেজাল্ট সে জানতে পারবে । 

           অবশেষে আসে সেই ক্ষণ ! প্রথম থেকে দশম স্থানাধিকারীর নাম ঘোষণা চলছে । নবমে এসে রতনের চোখ আটকে যায় । এ যে রাজুর নাম ই দেখছে আর শুনছে ! যুগ্মভাবে নবম হয়েছে রাজু । কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন আসা শুরু হয় রতনের। আর মুহুর্তে সাংবাদিকরা এসে উপস্থিত হয় তার এই ছোট্ট বাড়িতে । চলে ছবি তোলা , মিষ্টি মুখের পালা । আর সকলেই রাজুর সাথে কথা বলতে চায় । আর রাজু হাসি মুখে সকলের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে । সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাজু জানায় তার অনুপ্রেরণা হল তার বাবা আর ঠাকুমা । অনেক কষ্ট করে তাকে তার বাবা মানুষ করেছে । আর মায়ের অস্তিত্ব তার জীবনে নেই। 

         টিভির পর্দায় আজ যখন রাজুর সাক্ষাৎকার চলছে তখন গর্বিত হওয়ার বদলে তার মা নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে থাকে টেলিভিশনের পর্দায় । 




চাঁদ ধরবো বলে
শক্তিশঙ্কর পানিগ্ৰাহী

                           
অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে মোবাইল অনকরে রাতুল দেখল এখন ৯টা ২০বাজে।ভেতরে একটা প্রবল ঝড় চলছে ---যেন মেনে নিতে পারছে না।উল্টোদিকে মুখ করে বাসস্ট্যান্ডে চেয়ারে বসে পড়লো। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হলো। আজকে বুকুনের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল ,কিন্তু একদিন ও দেখা করতে যেতে পারলো না। কত ভেবেছিল পরীক্ষার আগে গিয়ে গোটা কয়েক পেন কিনে দিয়ে আসবে।আগে তো যেতেই পারলো না---শেষদিনে বেরোতে বেরোতে চারটে বেজে গেল। একটা পনেরয় পরীক্ষা শেষ --না হয় আরো আধঘন্টা অপেক্ষা করতে পারে---এত সময় থাকবে না।কেতকীর কাছে থাকে,  ওর মা দিদার সঙ্গে।আমার কাছে আসার জন্য ছটফট করে কিন্তু আঠারো না হলে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না--তাই নীরব আছে।রনিতা ও বুকুনকে ভালোবাসে ।উচ্চমাধ্যমিক হয়ে গেল আর ক'মাস পরে আঠারো হয়ে গেলে আমার কাছেই চলে আসবে।
প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল কেতকী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে--তখন বুকুন দুবছর।মা কে সামান্য ওষুধ খাওয়ানো নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি করে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল। তারপর বহুচেষ্টা করেও মানভাঙাতে পারিনি।আসলে ওঠা অভিমান ছিল নাকি---অযুহাত তৈরি করে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা ছিল আজও বুঝে উঠতে পারিনি। অনেকেই বারণ করেছিল---ওই মেয়ে ঘর করবে না ; তখন শুনিনি।এখনো মনে পড়ে সেই বৃষ্টি ভেজা ট্রাম ভ্রমণের কথা,C Uথেকে তখন আমরা হেঁটে ধর্মতলায় এসে ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরতাম ; সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল ।দৌড়ে ট্রামে উঠে বসতে যাবো --ধাঁ করে এক কিশোরী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জায়গা দখল করে বসলো কিছু বলতে যাবো ---মুখ টা দেখেই সব রাগ অনুরাগে পরিনত হলো।অবাধ্য চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টি ভেজা জল ,চোখের মাঝে চোখ আটকে যায়, ভিজে ওড়না লেপ্টে জড়িয়ে আছে উন্নত বক্ষ জুড়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বললো ---'ব‍্যাগটা দেবে ?  ওই শুরু হলো কথা--এরপর  অপেক্ষা, মিলন অভিসার ,মান  ---চললো পদাবলী কীর্তন।অবশেষে টোপর উঠলো মাথায় । কলেজে ঋতিকা অনেক দিন আমার পিছু নিয়েছিল কিন্তু আমি জায়গা দিইনি।এখন আর ফোন ও করে না।ওর ছেলেটা প্রতিবন্ধী --কথা স্পষ্ট নয়, তাছাড়া ডানহাত নুলো ,কিন্তু বাম হাতে এতসুন্দর পেইন্টিং করে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।পড়াশোনায় ও খুব ভালো।শ‍্যামপুকুরে থাকে, প্রতিবন্ধী ছেলের জন্মদিয়ে এখন ঘরছাড়া সুকান্ত  ঋতিকাকে ফেলে শিখাকে বিয়ে করে দিব‍্য আছে।প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে ঋতিকা হিমশিম খাচ্ছে।
রণিতা অফিস করে অনেক বার আমার বাড়িতে এসে আড্ডা দিয়েছে ,কয়েক বার রান্না ও করে দিয়েছে--বুকুনকে ও ভালোবাসে কিন্তু আমি কোনো দিন বলতে পারছি না --রণিতা আমরা একসাথে থাকতে পারিনা ?রণিতা বিয়ে করেনি--ক‍্যানসার আক্রান্ত মাকে ফেলে বাবা দাদার মতো সে চলে যেতে পারেনি।তাছাড়া বাবা মায়ের সম্পর্কের অবনতি ওর শৈশব কে তচনচ করে দিয়েছিল--তাই বিয়ের কথা শুনলে ও আ‌ঁতকে ওঠে।তাছাড়া  কেতকীর ঐ টানাটানা চোখ ,একরাশ ঘনকালো চুল --হাওয়ায় উড়ে এসে যখন গালবেয়ে মুখের অর্ধেক টা ঢেকে দিত তখন আমার মতো অনেকেই চোখ ফেরাতে পারতো না।অন্য কারুর কথা ভাবতে গেলেই আমার চোখে ঐ ছবিটাই ফুটে ওঠে।শুধু অপেক্ষায় আছি কবে ফিরে আসবে।
হঠাৎ বাসস্ট‍্যাণ্ডে একটা অল্টো এসে দাঁড়ালো--নামলো বুকুন---আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ভেবে আমি   কাছে উঠে গেলাম--বুকুন আমি সময় করে উঠতে পারিনি বাবা--প্রাইভেট ফার্ম তো ছুটি পাওয়া খুব ই মুসকিল।তবে এবার তো কলেজে যাবি কোনো অসুবিধা হবে না।
----বাবা ,ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না । প্রীতম আঙ্কেল ব‍্যাঙ্গালোরের কলেজে পড়ার ব‍্যাবস্থা করেছেন---মা-আমি এখন তো আঙ্কেলের সঙ্গে থাকবো।
----ও আচ্ছা --গলাটা বড্ড ভারি হয়ে গেল ।চিৎকার করে জোর করে বুকুন কে টেনে নিয়ে বলতে পারলাম না --তুই যাবিনা আমার কাছে থাক,কারণ আমার সামান্য মাইনের টাকায়  বুকুনের ম‍্যানেজম‍্যাণ্ট পড়া হবে না।
----বাবা তুমি বাড়ি যাও আমরা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।তাকলাম কালো গ্লাসের ভেতরে কেতকী আর প্রীতম। বুকুন টা টা করে চলে গেল, আমি ও অস্ফুটে বললাম তুই অনেক বড় হ বুকুন।ব‍্যাগের মধ্যে থেকে গেল ওর জন্য কেনা ক‍্যাটবেরি সেলিব্রেশন।ওটা মনে হয় আর দরকার হবে না।



শত্রু নাশ
মনোমিতা চক্রবর্তী

শত্রু কত রকমেরই না হয় ।আমার তিরিশ বছরের জীবনে যেমন অনেক বন্ধু পেয়েছি ,তেমনি শত্রু সংখ্যা ও কিন্তু কম নয়। যতবার শত্রুর মুখোমুখি হয়েছি,শত্রুদের এড়িয়ে গেছি।
 কিন্তু এবার যে শত্রুর পাল্লায় পড়েছি একে দেখছি এড়িয়ে গেলে চলবে না ।
না একদম এড়িয়ে গেলে চলবে না।মাঝে মাঝে তো মনে হয় ওকে ডেড বডিতে পরিণত করে দিই ।কিন্তু মুশকিল হলো এই শত্রুটি বেশ চালাক চতুর গোছের ।দেখা হলেই চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন আমায় বোকা বানিয়ে নিমিষে উধাও হয়ে যায় ও।
 আমি যে বদলা নিতে চাই এটা হয়তো ও বুঝে গেছে, তাই হয়তো আমাকে দেখলেই প্রত্যেকবার পালিয়ে বাঁচে।

 আমি আজীবন নিরীহ গোছের ছেলে। কারো সাতে পাঁচে বিশেষ থাকি না ।সেখানে কিনা আমি মনে মনে কাউকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছি !এটা ভেবে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই ।

তবে একটা ঘটনার পর আমি বুঝেছি যে অপমান এবং শত্রুপক্ষের বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে গেলে একজন নিরীহ ব্যক্তিও কাউকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে পারে। 
কি ভাবছেন তো,কি এমন ঘটনা ?
তবে শুনুন ।
তিন মাস হয়েছে বিয়ে করেছি ।ঘরে এসেছে আমার ডানা কাটা সুন্দরী ,কচি বউ ।
জানি ,আমি অতটা দেখতে সুন্দর নই।তবে আমার স্ত্রী ভাগ্য নিয়ে অনেকেই আমায় ঈর্ষা করেন ।তাদের ঈর্ষার ব্যাপারটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি।
অনেক বন্ধুই আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করতে ,একবার হাত মেলানোর ছলে আমার স্ত্রী কি ছুঁতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। যেটা আমার একদম পছন্দ না।
কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারি না তাদের ।
স্ত্রীকেও সবটা খুলে বলতে পারিনা ।পাছে ও ভুল বোঝে আমায়, এই চিন্তায় ।
 বললাম যে সবে বিয়ে হয়েছে আমাদের ।দুজন দুজনকে বোঝা এখনো ঢের বাকি ।
আমি স্বয়নে ,স্বপনে সব সময় শত্রুকে মারার পরিকল্পনা করছি।
আসলে আমার শত্রু যে সাহসটা দেখিয়েছে না, সেটা জাস্ট সহ্য করা যায় না।
 তার সাহসের কথাও বলছি শুনুন।
 আমি তো বললাম আমার স্ত্রী একেবারে ডানা কাটা সুন্দরী পরী।তাকে দেখে পাগল হয়ে যায় প্রায় সকলেই। তো এই শত্রু করেছে কি ,সেদিন চুপিচুপি আমাদের বাড়িতে এসে হাজির ।
সেদিন অবশ্য বাড়িতে আমি ছিলাম না। 
বাড়ি ফাঁকা দেখে ভীষণ সাহসী হয়ে গিয়েছিল শত্রুটি সেদিন ।
এমন সাহস ওর যে ও সোজা চলে গেছিল আমাদের বেডরুমে। বেডরুমে গিয়ে আমার ঘুমন্ত সুন্দরী ডানা কাটা স্ত্রীকে দেখে ওকে ছোঁয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন ও আমার স্ত্রীকে চুম্বন করেছিল। 
আর এমন চুম্বন করেছিল যে চুম্বনের জ্বালায় আমার স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল ।বেচারার কাঁচা ঘুম ভাঙলে এমনি বিরক্ত হয় তার উপর মুখ ধুয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতে দেখে ওর বাঁদিকের ভ্রুটা কেমন যেন বিশ্রী রকম হয়ে গেছে ।
আমি বাড়ি ফিরতেই আমার সুন্দরী কচি বউয়ের কি কান্না !
যেমন করেই হোক যে তার এই অবস্থা করেছে তাকে শাস্তি দিতেই হবে এবং প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে।
সেই থেকে তক্কে তক্কে আছি ।ব্যাটাকে ধরে আচ্ছা সে শাস্তি দেবো। শাস্তি মানে মেরেই ফেলবো ওকে ।মেরে ওর ডেড বডি আমার স্ত্রীর পায়ের কাছে ফেলে দেব ।নাহলে আমার নামটাই পাল্টে দেবো বলে প্রতিজ্ঞা করেছি।ব্যাটার এত বড় সাহস ,আমার স্ত্রীকে চুম্বন করে। ওর মুখের বারোটা আজ বাজাবো আমি ।দারা তোকে দেখাচ্ছি মজা।
হ্যাঁ ঐ তো ব্যাটা বারান্দার কোনাতেই লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছে। ভেবেছে আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে এই সুযোগে যদি আজও কিছু করা যায়।
ওতো আর জানেনা আমার স্ত্রী আজ বাড়িতে নেই, বাজারে গেছে। 

আমি ইচ্ছে করে টিউবলাইট টা অফ করে নাইট বাল্ব জ্বালিয়ে রেখেছি। আর সাথে দরজাটিও খোলা রেখেছি, যাতে সহজে আমাদের বেডরুমে ঢুকতে পারে ।
আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে ওর কান্ড দেখছি ।
ও কখন ঘরে ঢোকে এই অপেক্ষায় আছি। 
 ওকে মারার জন্য অস্ত্র টাও হাতে নিয়ে নিয়েছি।
ভাগ্যিস আমার স্ত্রী আজ বাড়িতে নেই। না হলে এই দৃশ্য দেখলে ও ভয় পেয়ে যেত আর কি।

 একি, এখানেই তো ছিল। এক্ষুনি কোথায় গেল ?
আলোটা জ্বালানোর পরেই উধাও হয়ে গেল নাকি? 
আলোটা জ্বালালাম কারণ শিওর হতে হবে তো? ওকেই যে মারবো আমি।
যদি ভুল করে অন্য কোথাও অস্ত্র চালাই, এই ভয়ে আলোটা জ্বালিয়েছিলাম আর কি ।
তা ব্যাটা আচ্ছা বদমাশ দেখছি তো।
বিচ্ছুও বটে !
ঐ তো আবারও দেখলাম মনে হল। ওই তো ওই দিকটাতেই তো রয়েছে ঘাপটি মেরে ।
বাড়ির কেউ দেখছে নাকি আমায় এই ভেবে মুখটা ফেরাতেই আবার দেখি শত্রু টি উধাও।
 কিছুক্ষন বাদে আবারো একঝলক দেখলাম মনে হলো মুহূর্তের জন্য মনে হল আমি ভুল দেখছি নাতো ?অমনি বুঝলাম না ভুল দেখিনি, সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় তার আসার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। এবার আমি নিশ্চিত ওই ব্যাটাই আসছে এদিকে।

 আর কোন সন্দেহ রইল না। এবার তাকাতেই দেখি ব্যাটা একা নয়। আজ আবার সঙ্গী নিয়ে এসেছে একটা। 
বুঝে গেছি আজ আমার হাতে ডবল মার্ডার হবে।

এই দাঁড়া বিচ্ছুর মহা বিচ্ছু তখন থেকে ব্যাটা আমাকে বিরক্ত করেই ছাড়ছিস।তবে এইবার হাতের অস্ত্র না মানে হাওয়াই চটিটা দিয়ে শত্রুকে এবং শত্রুর সঙ্গীকে এমন মার মারলাম যে ব্যাটারা দুজনেই কুপোকাত। মানে একদম ডেড বডি। 
আমার মুখে তখন শান্তির হাসি ।  
ডেড বডি দুটো নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছি ।কখন আমার স্ত্রী আসবে আর তার শত্রুদের মানে মৃত আরশোলা দুটো তার পায়ের সমর্পণ করব।




একটা খাস্তা কঙ্কাল 
প্রদীপ কুমার দে 

সন্ধ্যাবেলায় লোডশেডিং হয়ে গেল। প্যান্ট জামা গায়ে সেঁটে বেড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎই যেন সব কালো অন্ধকারে মুড়ে গেল। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, পিছন থেকে ডাক এলো,
--  কি প্রদীপবাবু রাগ করেছেন ?

ঘুরে দেখি পিছনে কাকের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে নিলয়দা। উনি আমার প্রতিবেশী এবং লেখালেখি করার সুবাদে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ওনার ব্যবহার এযাবৎ আমাকে ভীষণই পীড়া দিত তাই এড়িয়ে চলতাম। একবছর ধরে এড়িয়ে চলছি ওনাকে আর অবশ্যই উনিও আমাকে। উনি পিছুডাক দিয়েছেন, আমি উত্তর দিয়েই দিলাম,
--  এ বয়সে আর রাগ?

--  তাহলে চলেন না আমার ঘরে, বসে আমি আর আপনি মিলে কবিতা আর গল্প পাঠ করি ?

--  এই লোডশেডিং অন্ধকারে আলো কোথায় পাবেন?

--  আপনার সাথে অনেকদিন পর দেখা হল তাই জানেন না, আমি একটা এমার্জেন্সি লাইট কিনেছি। অসুবিধা হবে না। 

--  কি বলেন ?  এমার্জেন্সি আলো?  তাতে কি হবে?

--  প্রচুর আলো। কোন অসুবিধা হবে না, বলছি তো। নচেৎ অন্ধকারে কোথায় যাবেন?
কথাগুলো বলে দাঁত বার করে হাসলো নিলয়দা।

চললাম ওনার সাথে। ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। উনি ঘরে আমাকে নিয়ে ঢূকেই দরজায় চিটকানি দিয়ে দিলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই কিরকম একটা পচা গন্ধ নাকে এল। আমি বললাম,
--  নিলয়দা আগে লাইটটা জ্বালান।

--  হ্যাঁ এই যে …

আমি একপাশে অপেক্ষায়। লাইট কই। একটু অন্ধকার সহ্য করে নিলে যা হয় চোখ যেন কিছু দেখতে পেল। দেখি কই নিলয়দা তো নেই। ওমাঃ কি দেখছি? একটা লিকলিকে কঙ্কাল তার সরু সরু আঙুল দিয়ে একটা বই তুলে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম,
--  নিলয়দা? নিলয়দা?

বিকট শব্দ হল। কেমন ' হে -হে ' শব্দে নেকো সুরে হাসলো কেউ।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। অন্ধকারে দরজার চিটকিনি খুঁজতে লাগলাম। মুখে রামনাম।

বরাত জোরে বেঁচে গেলাম। হঠাৎই আলো চলে এল। ঘরে আলোর সুইচ অন করাই ছিল। আলো জ্বলতেই দেখি বিছানায় শায়িত একটি লিকলিকে কঙ্কাল।

চিটকিনি খুলে পড়িমড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি। আওয়াজে নীচের ফ্ল্যাটের বৌদি বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
--  কি ভয় পেয়েছেন তো? ইদানীং আমরা সব্বাই পাচ্ছি।




কবিতা 


ছবি

মাথুর দাস


ক্লিক্-ক্ল্যাক্ তোলা ছবি

ঠিকঠাক রাখি অ্যালবামে,

ছবি তুলি হাজারো,

চাপ দিয়ে সেল-এর বোতামে ।


আঁকা ছবি রাখা থাকে

যত্নে কত যে সংগ্রহশালায়,

মায়াময় ছায়াছবি

কায়া ধরে পর্দায় ত্বরিতে পালায় ।




সকাল
দেবদত্তা লাহিড়ী 

 কাল আসবে বলে কথা দেয়নি কখনও।
তবু দিন কাটে তার ই অপেক্ষায়।
কালো কাটাবে বলে তার জন্ম অনিবার্য
এমন টা স্বপনকল্প নামে উড়িয়ে দিতে
স্পর্ধা দেখায় যে সেই তো রাত।
রাতের সঙ্গী পিশাচ সিদ্ধ।
আলোর ভয় লুকিয়ে আস্ফালন নিত্য।
নির্বিবাদী কীট পতঙ্গ নর্দমা থেকে উঠে এসে
পদ তলে সেলাম ঠোকে ভিড় করে বসে।
শীর্ণ নিভু আলো ক্ষমতা হারায়,
অভুক্ত হাত এগিয়ে দেয় কুয়াশার দিকে।
ডানা ছেঁটে দেবদূত সেই কুয়াশা ঘিরে হাঁটে
তার উড়ান হবেই বলে আলো হাত বাড়িয়েই রয়।
তারপর, একদিন সব অন্যরকম -
তারপর একদিন কি সকাল হয়?



নিভৃত যাপন 
রীতা ভদ্র দত্ত 

কবিতা আমার গহীন মনের নিভৃত যাপন 
গোধুলি রাঙা মেঘতলে হরিয়ালী ক্ষেত,
ডুবুরি মনের সিন্ধু সেচন মুক্তা যেন, 
হঠাৎ  বৃষ্টি, কিম্বা রোদ জীবন ভর।

কবিতা শরীর, নিঁখুত গড়ন,আখর যাপন
প্রভাত বেলার শিশির শিক্ত কুন্দ কুসুম, 
মেঘ মদির কোনো স্বপ্নের দেশ কবির যেন, 
এক জীবনের ভালোবাসা ভরা মুক্তি ডোর।

কবিতা শায়র বর্ষা রাতের ফুলেল বাসর
দোলন চাঁপার গন্ধে আবিল মায়াবী রাত,
অভিসারে চলা শ্রীরাধিকার চপল চরণ যেন
চন্ডিকবির বিরহ-মিলনের প্রিয় পদাবলী সুর।

কবিতার সাথে দু:খ সুখের অভিমানী ঘর কন্না,
পাহাড়িয়া মেঘ ভর করে  ভাসা সুখের চুনী পান্না।



সবুজের কোলে মাথা রেখে
দীপাঞ্জন দত্ত 

ঐখানে যাবো, আরো একবার যেতে চাই।
যেখানে ছিল নীলাভ এক খরোস্রোতা নদী।
চারিদিকে সবুজ পাহাড়।
পাহাড়ে ঘেরা জনহীন প্রান্তর।
 জীবন যেখানে ধাবিত হয়, নতুন জন্মলাভের আশায়।
 
পাহাড়টার গায়ে দেখেছি প্রাণময়তার ছোঁয়া,
আবার সেই ছোঁয়া পেতে চাই। 
আর সেই গাঢ় নীলাভ জলে ভাসিয়ে দেব আমার সব গ্লানি।
মন্দ হয় না, নিজেকে যদি না ফেরাই।
সবুজের কোলে মাথা রাখার পর
শান্তি শান্তি আর শান্তি,,,,

একাই যাবো সেই পাহাড়ের কোলে।
আমায় ডাকছে।

যেখানে সবুজে, পাগল করার মতন নিজের জীবন আঁকা যায়।
এই কোলাহলে আর থাকতে চাই না।

হে চির সবুজ! 
আমি একাই যাবো তোমার কাছে।



সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
দেবযানী সেনগুপ্ত

নিরালা নিঝুম চা বাগিচা
কথকতা বুনে চলে।
শান্ত দিঘির  স্তব্ধ জলে
 অতীতের স্মৃতি ভাসে।
 দিকচক্রবালে সূর্য তখন
 অস্তাচলের পথে ,
একলা পথিক ঘরে ফিরে চলে 
ক্লান্তির গান গেয়ে।
 বৃষ্টি গাছেরা চারপাশ ঘিরে
 স্তব্ধ প্রহর গোনে ,
পাখি- পাখালির কলরব ওঠে-
 পাতার আড়াল থেকে।
 আকাশের কোণে দূরে উঁকি দেয়
 সাজবাতির রূপকথা।
 জনহীন বাড়ি স্বজনবিহীন
 একা একা দিন গোনে !
সন্ধ্যা আসছে  ধীর লয়ে  তালে-
 মন্দ-মধুর তানে,
 দূর দিগন্ত সুর তোলে আজ
 পূরবীর রাগিনীতে।।



তুমিও দেখোনি ! আমি জানি
 সারণ ভাদুড়ী

হ্যাঁ ,তুমিও কেঁদেছো !
 আমি দেখেছি!
 কপল বয়ে নেমে আসা তোমার চোখের নোনা ।
- তুমিও ভীত !
  আমি দেখেছি!
 নরকের কিট যারা তোমায় তিল তিল করে মেরেছে ,
- না আমিও দেখিনি মূর্চ্ছে যাওয়া আমার মায়ের মুখ 
তুমিও দেখোনি ,আমি জানি ।
মরতে গিয়ে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছো
 তোমার সব গুনগুলো...
 মাটিতে বসেছো ভিক্ষা পাত্র নিয়ে ।
" রাজ লক্ষ্মী আজ ভিক্ষা পাত্র নিয়ে!"---
একি শোভা দেবে?
আমি তো সেদিন ই চলে গিয়েছিলাম যবে,
ভীত তোমায় কাঁদতে দেখেছিলাম ।
আমি তো সেদিন থেকেই মৃত যবে,
তোমায় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম...।



দাগ 
শ্রেয়সী সরকার

ভোরের আলো অনেক দূরে চক্রবৃহের কানন তখনো আঁধার ,
তারা খসে যাবার অপেক্ষা শুধু মাত্র
আমি রাতকানা পাখি , কদম ফুলের গন্ধে বিভোর।
সুরের সুবাসে , ব্যস্ত ট্রামলাইনএ জলনুপুরের শব্দ শুনতে !
অবিরত বৃষ্টিধারার মত নৃত্য পরিবেশন
আমার জীবন পাতায় একে ওঠে তোমার ভঙ্গিমা ,
ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছি , হটাত বানভাসি আসে ,
কোথায় কখন বুঝে উঠতে পারিনি!
চিত্রিত সেই পত্র ছিন্ন ভিন্ন ,
রক্তের ফোঁটার মত , বয়ে গেছে বহুদূর
আমি এক নতুন জলসা ঘরের পথে 
অজ্ঞান চৈতন্য , তবু ফেলে আসা দাগ খুঁজে বেড়ায়।।



 পাহাড়ি নদীর রূপকথা
              এস,সাহা (সঞ্জয় )

তিস্তা, আমাকে কি তোমার মনে আছে ?
মনে না থাকারই কথা ।
তোমার কাছে থেকে কবেই চলে এসেছি কোন শৈশবে!
অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি কর্মব্যস্ততার যান্ত্রিকতায়।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো!
যখন ওই পাহাড়ি নদীর জীবন ই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।
একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেই তোমার কথা মনে পড়ে।
তোমার কথাটা মনে পড়াটাই আমার কাছে হয়ে ওঠে, চাবাগানের বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার মত। 
শহর ছেড়ে অনেকটা দূর পাহাড়ি পথে ছোট্ট কুঠির ছায়া আসতে থাকে পাথুরে নদীর ধার বেয়ে।
টোটো আদিবাসীরা গুটি কয়েক কুঠির শুকনো পাতায় ছাইতে থাকে....
অন্তরে গভীর ভালোবাসা আর পাহাড়ি বনলতা চারিদিকে ভাসে বনপক্ষীরা ডাকে কোমল সুরে।
গাঁয়ের মরদ হাঁড়িয়া খেয়ে বাড়িতে করে মাতলামি,
বধূরা চলে চায়ের বাগানে পিঠে সাজি নিয়ে চা পাতা তুলতে...
শ্রাবণের ধারা বাগানে সবুজ পাতায় ভরা 
কোমল হাতে ছেঁড়ে দুটি পাতা একটি কুড়ি সযত্নে তুলে রাখে পিঠে বাধা ঝুড়িতে ।
চারিদিকে জনহীন, বাড়ি ফেরার তারা!

বিজলি আকাশে চমক দেয় এসে!
কত সোনালী রোদ্দুর, বসন্তের কত উতল, মাতাল মধুর হাওয়া, কত রঙের পাহাড়ি প্রজাপতি ওড়া কমলা বিকেল।
সবুজ পাইন গাছের সতেজ, সজীব নিঃশ্বাস।
       জোৎস্না রাতের পাহাড়ি নদীর রূপকথা।





উন্মত্ত 
অজয় অধিকারী

অশ্রাব্য কুটিল স্বপ্নেরা অদম্য,
রক্তচোষা লোভাতুর স্বাপদের লালায় ঝরে পড়া বিষের ঘ্রানে মত্ত,
উন্মত্ত চেতনারা সব,
সায়ানাইড এর বাস্পে বিভোর।

পদাতলে আরাধ্যার সৃষ্টি মাড়িয়ে,
উন্নয়নের সড়ক ধরেছে,
খামখেয়ালি মনন আর মোহো লাভের তারি,
ছেঁড়া একটা জামা,
আর তার ছেঁড়া বুক পকেট, উঁকি দিচ্ছে ছেঁড়া হৃদপিন্ড,
উচ্চতার নেশায় বুঁদ লালিত্য বিহীন সেই হৃদপিন্ড,
শিরায় শিরায় তার উন্মত্ততা।।

সর্বগ্রাসী কুহেলিকার লিপ্সায়
আমাজন ও হয়েছে নিশ্বেস,
আর কত, আর কত তার উদ্যোম!
সর্বহারা ভবঘুরের দলে পা মিলিয়েও, চেতনারা চির উন্মত্ত।

উন্মত্ত উন্মাদ সেই কবি,
সলিল সমাধি প্রাপ্ত ডুবোজাহাজের গোপন কক্ষে বসেও,
স্বপ্নরা তার অদম্য,
নাছোড়বান্দা সে অশরীরী,

চেতনারা তবু উন্মত্ত!!!




ফিরে আয়
চন্দ্রানী চৌধুরী 

আকাশে তারাদের ভিড়ে খুঁজে চলেছি অবিরাম 
মনে পড়ে  সেই ‘রান্নাবাটির দিন’ 
একসাথে পথচলা ভালোবাসা কথা বলা 
শেষ হল আজ 
একদিন ছিল আমাদের সোনাভরা মেয়েবেলা 
তারপর 
জীবনের গতি দিক বদল করলে 
আজীবন ছুঁয়ে থাকার শপথ 
মিথ্যে হয়ে যায় 
অচেনা পথের স্রোতে হারিয়ে যায় দিশা

আয় বন্ধু ফিরে আয় 
আগের মতো খানিক কাটাই খোলা ছাদে 
জ্যোৎস্না রাতে দেদার খুশি ছড়াই
পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না কষে 
তুই আমি মিলে 
ভেসে যাই আনন্দে , গানে, হাসিতে , খুশিতে 
ভুলে থাকি দুঃখ, ব্যথা, ক্ষোভ, অভিমান ।



ত্রিভুজ
অভিজিৎ সরকার

ত্রিভুজের‌ মাথায় দাড়িয়ে রয়েছে বাবা
আমি আর মা সমতলে
আমদের বট বৃক্ষের ন্যায় ‌ছায়া প্রদান করছে,
বাবা আস্তে আস্তে সমতলে নেমে আসছে
আমি উপরে ওঠার চেষ্টা করছি,

উপরে ওঠার চেয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকা বড়ো দুর্গম
মাথার উপর দাড়িয়ে থাকতে প্রতিনিয়ত এক খেলা খেলতে হয়,

সে এক মজাদার খেলা,
এই খেলায় রক্তকে জল করতে জানতে হয়।



কালের রথ
রীতা মোদক

খট খট শব্দ
মন্থর গতি
লাঠি হাতে হেঁটে চলে
ঠনঠনে বুড়ি এক
ঝর ঝর বৃষ্টি
কর্দমাক্ত পথ
তারই মাঝে হেঁটে চলে
লিকলিকে বুড়ি 
কখনো কোমরে হাত দিয়ে থেমে যায়
নিজের জং ধরা রথখানি
পড়শীরা ফেলে যায়
কেউ হেসে গড়াগড়ি খায়
তিনি ধরবেন আজ জগন্নাথের রথ?
দূর থেকে খোল করতাল আর 
হরি ধ্বনির আওয়াজ আসে কানে 
এদিকে রাজপথে ভক্ত সমাগম
জগন্নাথ বলরাম আর সুভদ্রা 
চলছেন আপন আপন স্বর্ণ রথে
দড়িতে টান পড়লে
ঠনঠনে বুড়ির লাঠির শব্দের মত
রথ এগোয় মন্তর গতিতে
বুড়ি থেমে গেলে রথ ও থেমে যায় 
রাশি রাশি ফুল ফল
 আর ভক্তের হরি ধ্বনিতে ও 
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে জগতের নাথ
প্রাণপণে হেঁটে আসে তুত্তুরে বুড়ি
চারদিকে প্রহরী , 
 নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়ি
কাঁপা কাঁপা হাতে
রশি ছুঁতে চায় সে
কৃপা চায় জগন্নাথে
হঠাৎ কোথা থেকে 
 এক বালক আসে ছুটে 
বুড়ি ছুঁয়ে দ্যায় রথের রশি
জয় জগন্নাথ ধ্বনি শুনে
কালের রথ চলছে --- গড়গড়িয়ে





ছড়া 


গ্ৰাম ভালোবাসি 
বিপ্লব গোস্বামী

গ্ৰাম ভীষণ ভালোবাসি
তাইতো গ্ৰামে থাকি,
ভালোবাসি গ্ৰামের মানুষ
গ্ৰামের পশু-পাখি।

গ্ৰামের মানুষ সহজ সরল
ভালোবাসি তাই,
নিঃস্বার্থ-খাঁটি ভালোবাসা
গ্ৰামের মাঝেই পাই।

ভালোলাগে গ্ৰামের মেলা
পূজা-পার্বন উৎসব,
ভালোলাগে ধামাইল আর
গ্ৰামের নৃত‍্য যত সব।

ভালোলাগে গ্ৰামের মাঠ
নদ-নদী আর পাহাড়,
ভালোলাগে পুষ্প কানন
নানা রঙ্গের বাহার।

ভালোবাসি গ্ৰামের কৃষ্টি
ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি,
দাগ কাটে গ্ৰামের প্রেম
ভালোবাসা আর প্রীতি।



আষাঢ় মাইসা বৃষ্টি 
মজনু মিয়া 

আষাঢ় মাইসা বৃষ্টি আহা
ঝমঝমাইয়া পড়ে, 
আমার ভাঙা ঘরে-
থালা বাসুন দিয়া ঢাকি
তবু্ও তা ঝরে।

ঘুম আসে না শুইলে পরে 
বৃষ্টি ফোটা ঝরে,
মন আনচান করে-
কোথায় গেলে শান্তি পাবো
বলছি বন্ধু তরে।

জামাই আইছো ভিজছ কেন?
নাহাও আইসা ঘরে,
তোমার বাড়ি চরে-
খবর রাইখো তলায় না যেন্
বানের জলে পড়ে।




সাম্য  দ্রোহ প্রেমের কবি
রেজাউল করিম রোমেল 

তুমি সাম্যের কবি
চির উজ্জ্বল রবি ,     
তুমি মহান                                             
চির অম্লান।  

তুমি বিপ্লবী                                             
তুমি বিদ্রোহী                                             
গীতিকার সুরকার উপন্যাসিক                
গল্পকার নাট্যকার তুমি সফল সাংবাদিক।

তুমি গায়েন স্বরলিপিকার                        
প্রেমের কবি তুমি চলচ্চিত্রকার              
তুমি সকল জাতির সকল ধর্মের                    
প্রেরণা সকল বর্ণের।   

বিদ্রোহী কবি কাজী 
নজরুল ইসলাম যার নাম,                             
চির স্মরণীয় ও বরণীয় তুমি                  
ভুলবেনা এ মানবজাতি তোমার নাম।





বর্ষাকালে 
সালমা আক্তার চাঁদনী

বর্ষাকালে চারপাশে অথই পানির চলাচল, 
কৃষকের মুখে হাসি ফসল ফলাতে বারে বল।

বছর শেষে সুখ কুড়িয়ে ঘরে তুলে সোনালী ফসল,
যা খেয়ে বেঁচে থাকে এতবড় জনবল।

বর্ষা এলে জেলে খুশি ইলিশ ধরবে  পদ্মাতে,
এখন বুঝি অভাব অনটন থাকবেনা আর ঘরেতে।

জাল নিয়ে জেলে ভাই ছুটে চলে নদীর পাড়,
তার কাঁধে যে চলে বউ ঝি মা বাবা ও তার বার।


বিকেল বেলা নীল আকাশে দেখা যায় মেঘের গর্জন, 
ধান তুলতে যায় বউ ঝিরা উঠুনে সব তর্জন। 


দিন শেষে হাসি খুশি থাকে অসহায় গায়ের লোক,
বর্ষা এলেই অভাব মুছে আরো মুছে মনের দুখ।




 আমার মা
বাবলি বর্মন

সবাই বলে ঠাকুর বড়ো
আমি বলি মা।
সবার থেকে আপন যিনি ,
তিনি আমার মা।
মা হছে সব চেয়ে আপন,
মা হছে সব চেয়ে প্রিয়।
মায়ের মতো এই দুনিয়ায় 
আর আপন আমি যানি হবে না কেও।
যত ই আসুক বন্ধু বান্ধব 
হবে না কেউ মায়ের চেয়ে প্রিয়।
বন্ধু তো আজ আসবে 
কাল যাবে ফিরে।
মা কিন্তু কোনো দিন
আমায় একা ফেলে যাবে না ফিরে।
বন্ধু আমার শত্রু হতে পারে
মা কিন্তু কোনো দিন হবে নারে!
মা আমার মা তুমি আমার বেচেঁ থাকার 
আমার এক মাএ ভরʼসা।


মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা ১৪৩০