পুরীধাম জয়জগন্নাথ দর্শন
সম্পা দত্ত
প্রকৃতির রুপ অপরুপ রুপতার,
সাগরবেলায়, বালুতটে মন, ডাকে আরবার,,
নেশা লাগে চোখে, সূদুরের হাতছানি বারবার !!
ভ্রমণ পিয়াসী মন ছুটে যায়, চোখ খোঁজে কোন অজানায়!!
সব মানুষ ভ্রমণ বিলাসী। আমিও কম নই। কোথাও বেড়াতে যাবার আলোচনা উঠলেই মন নেচে গেয়ে ওঠে--- "মন মোর মেঘের সঙ্গী/ উড়ে চলে দীগ দীগন্তে পাণে/ নিঃসীম শূণ্যে ------"।
নুতন নুতন জায়গা, সেখানকার কৃষ্টি লোকাচার,পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে ভীষণ ভাললাগে। আর বেড়াতে যাওয়া সে কাছে পিঠে হলেও ক্ষতি নেই। প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়নলোভা হলেই যথেষ্ট।
পাহাড়, সাগর দুটোই টানে আমাকে। তবে কদিন আগেই পাহাড়ে ঘুরে আসার সুবাদে সাগরের দিকেই যাবার টিকিট কাটা হল। এমনি করেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সপরিবারে ও সাথে পারিবারিক বন্ধুর পরিবার নিয়ে জগন্নাথ দর্শণে বেড়িয়ে পড়লাম। জগন্নাথ ধাম পুরী।
নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে গৌহাটি এর্নাকুলাম এক্সপ্রেসে আমরা রওনা হলাম দুপুর ১২:৩০ মি: নাগাদ।
আমরা বড়রা বাদেও ছোটোরা ডালিয়া, ভাস্কর, পাপিয়া বন্ধু স্বপন দার ছেলে সৌরভ। দুপুর রাত দুবেলার খাবার নিয়ে। সবাই মজা করতে করতে ছুটন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চললাম।
আহা! প্রকৃতির ছুটন্ত রুপ যেন কত ব্যস্ততা। একসময় বিকেলের সূর্য দীগন্তরেখায় অস্তরাগের আবীর ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে রাত্রির নিঃস্তব্ধতা ডেকে পাটে বসলেন সূর্যদেব।
সবাই আনন্দ করে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আটটা তেই সবাই ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ল কেউ জেগে রইল। চলতি পথে হকার, মানুষজন সব মিলিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হল।
মাঝে মাঝে স্টশনের কলরব। পরদিন আবার একই গতিতে ট্রেন ছুটছে। আমরা প্রথমে ভুবনেশ্বর নামব, পরে পুরী যাব। কোলকাতা ছেড়ে ট্রেন চলতে লাগল। পথের দুপাশে অপরুপ ছোট ছোটো টিলা পাহাড় মেঘ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কটক স্টেশনে নামলাম সবাই ট্রেন লেট ছিল বলে। নেতাজীর জন্মস্থান বলে কথা মন কেমন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠল।
বেলা ১:৩০ মিঃ ভুবনেশ্বর স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখানে আমার ভাসুর, ভুবনেশ্বরেই চাকরী করেন ।ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, শঙ্কর বোস দাদা ।নিজ বাড়ি রাঁচীতে, তিনি সব ব্যবস্থা আগে থেকে করে রেখেছিলেন। আমাদের গাড়ি করে হোটেলে নিয়ে গেলেন। হোটেল লিঙ্গরাজ। অত্যাধুনিক সুসজ্জিত হোটেল। সবাই দাদাকে সেখানে সন্মান করেন। আমারাও ভীষণ যত্ন আত্তি পেলাম। বোসবাবুর পরিবারের লোক বলে কথা।দাদা আমাদের কোনো টাকা পয়সা দিতে দেননি হোটেলে থাকার। তিনি সব মিটিয়েছেন।
হোটেলে ফ্রেশ হলাম সবাই যে যার রুমে। সুপার ডিলাক্স রুম। একদিনের ট্রেন জার্নি, দুপুরে হোটেলের নীচে খেতে গেলাম। যেন স্বপ্নপুরী বাইরে সূর্যের আলো ঝলমলে অথচ রুমের ভীতরে নীলাভ মায়াবী আলো মায়াময় পরিবেশ। খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে কাছাকাছি জায়গা দেখতে বের হলাম। উদয়গিরি খন্ডগিরি গুহা পর্বত।
হোটেল থেকে ঠিক করে দেয়া ট্রেকার করে প্রথমে আমরা দাদা'র ফ্ল্যাট ঘুরে গুহাপর্বত দেখতে এলাম। অপূর্ব শিল্পীর শিল্পকীর্তী পাহাড় কেটে নানা রুপ দিয়েছে। উঁচু পাহাড়। অনেক গাছ তার উপড় বাঁদর লাফালাফি করছে, মানুষ দেখলে ওদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়। সেখানে উড়িয়া ফিল্মের স্যুটিং চলছিল। আমি ডালিয়া (ভাসুর ঝি ) দুজন নীচে থেকে গেলাম। বড় রা বাচ্চাদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠে গেল। কিছুক্ষন পর নীচ থেকে দেখছি স্লিপার রাস্তা দিয়ে দৌড়তে গিয়ে ভাস্কর, পাপিয়া, সৌরভ তিনজনেই হুমড়ি খেয়ে নীচে গড়িয়ে আসছে। সবাই কিংকর্তব্য বিমূঢ় উপায় নেই। পাপিয়া, সৌরভের অল্পের উপড় দিয়ে গেল কিন্তুু ভাস্করের মারাত্মক অবস্থা পা বেঁকে গেছে হাটতে পাচ্ছে না। সবাই অস্থির। গাড়ির চালক খুব ভাল মানুষ হেল্পফুল। বোসদা কে ফোন করা হল তিনি দ্রুত চলে এলেন ভুবনেশ্বরে #ক্যাপিটেল হস্ পিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করালেন। এক্স রে অষুুধ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। সবার মন খারাপ সমূদ্র, জগন্নাথ দর্শন আর হবেনা, অতএব ফিরতি টিকিট কাটতে হবে। আমি ডালিয়া, পাপিয়া ট্রেকারে বসে থাকলাম গাড়ি চালক আমাদের পাহার়া দিচ্ছেন। ওরা নার্সিং হোমে। খুব ভাল গাড়িচালক, বলছিল ম্যডাম ভয় পাবেন না আমি আছি।সত্যি সে খুব ভালো মাণুষ।
মন খারাপ করে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন ব্যথা কম থাকাতে আবার রওনা হলাম নন্দন কাননের উদ্দেশ্যে। পথে সকালের জলখাবার খেয়ে নিলাম । নন্দন কাননে পৌঁছলাম বারোটায়। সেখানে হুইল চেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা হেঁটে, ভাস্কর হুইল চেয়ারে করে ঘুরল। অনেক বড় নন্দন কানন, সম্পূর্ণ ঘুরতে তিনদিন সময় লেগে যাবে গাইডের কথা অনুসারে। আমরা জীব, জন্তুু, পাখি, ময়াল সাপ, বাঘ, সিংহ, শিম্পান্জী দেখলাম। খুব ভাল লাগছিল ঘুরে ঘুরে দেখতে, ক্যামেরা দিয়ে ছবিও তোলা হল।
ফেরার তাড়া ছিল, বিকেলেই আমরা পুরী রওনা হব। খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে, দাদার কাছে বিদায় নিয়ে চললাম পুরীর উদ্দেশ্যে, প্রথমে কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখে নিলাম। অপূর্ব শিল্পের সৃষ্টিসম্ভার। পাথর কেটে কতরকম দেবদেবীর মূর্তি মন্দিরের দেয়ালে। রথের চাকা পাথর কেটে তৈরী। মন্দিরের ছায়া কোনোদিন মাটিতে পড়েনা গাইড সব সুন্দর করে বোঝাতে লাগল।
নাবিকরা দিক নির্নয়ের জন্যে মন্দির তৈরী করেন। সমুদ্র দূরে সরে গিয়েছে। এইসব নানারকম তথ্য সম্ভার বলতে লাগলেন।
মন্দির খুব ভাল লাগল। ভুবনেশ্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা মন্দির অপূর্ব পাথর শিল্প ।
মন্দির দেখে আবার চললাম, চলছে তো চলছে, সামনে আকাশ নীল হয়ে আসছে ফাঁকা ধূধূ নীল আর নীল, জিজ্ঞেস করতেই চালক বললেন সমুদ্র কাছে এগিয়ে আসছে । মনে মনে চাপা উত্তেজনা অনুভব করছি সমুদ্র দেখার, প্রথম দেখব তাকে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। ছোটোছোটো বাচ্চা বয়স্ক সবাই পাথরের জিনিষ ফেরী করছে। কিনে নিলাম নবগ্রহ, জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম' কে।
আবার চলা। এবার সাতটা বেজে গেল। চালক বলতে লাগলেন সামনে বীচ আছে চলুন দেখবেন। সামনে আসতেই আমরা নামলাম গাড়ি থেকে।
বীচে প্রচুর লোকের সমাগম। সমুদ্র ভীষণরকম তর্জন গর্জন করছে । পূর্ণিমায় ভরা জোয়ার। উথাল পাথাল ঊর্মিমালা। আমি অস্থির রকম ভয়ঙ্কর চিৎকার জুড়়লাম। ডালিয়া আমি দুজন দুজন কে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের অবুঝপনায় বড়রা হাসতে লাগল।কি গর্জন শব্দ চঞ্চল সে-- প্রথম সমুদ্র দেখার অনুভুতি আজও ভুলিনি।
ভাস্করের পা সামান্য ফুলে আছে। বেশিক্ষণ সেখানে থাকা হল না রাত হয়ে আসছে। আবার বসলাম গাড়িতে । এবার তিন ঘন্টা পর জগন্নাথধাম পুরীতে পৌঁছলাম। আমরা ভারত সেবাশ্রম সংঘে সবাই বসে সন্ধ্যা আরতি দেখলাম। ছেলেরা হোটেল দেখতে গেল। সী ফেস হোটেল স্বর্গদ্বারের পাশেই হোটেল হেভেন, সেখানে গিয়ে উঠলাম। খুব সুন্দর, রুম থেকেই সাগরের উচ্ছাস দেখা যায়। করিডরের সামনে লন, বসে বসে অগুণতি ঢেউ গোনো। কি অপরুপ রুপ।
সেদিন রাতে খেয়ে শুয়ে পড়লাম পরদিন সমুদ্রে স্নান জগন্নাথের পূজো অনেক কাজ। রাতেই হোটেলে পান্ডা এসে পরদিনের পূজোর ব্যবস্থা, টাকা পয়সা কত কি লাগবে হিসেব দিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে সমূদ্রে সূর্য ওঠা দেখলাম। কি অপূর্ব লাগছিল দেখতে, ডিমের লাল কুসুম সূর্য়টাকে। বেলা বাড়লে সমূদ্র স্নানে চললাম। পরম আত্মতৃপ্ততা। অনেক ভাললাগা। বালুতটে বসে সমুদ্র দেখা অসাধারণ। আমরা স্নানে নামতে পাপিয়া কে নিই নি ছোটো বলে। কিনাড়ায় বসে ছিল। হঠাৎ চোরাবালিতে পা ডুবে যাচ্ছিল আমার,, তল পাচ্ছিলাম না। তাই দেখে মেয়ের কি কান্না সবে ছ'বছর বয়স।কথিত আছে সমুদ্র কিছইু নেয় না, নিলেও ফিরিয়ে দেয়। সেদিন হঠাৎ এক মৃতদেহ ঢেউয়ের জোয়ারে কিনারায় ফিরে এসেছিল। পরে একজন টেনে ধরে সে যাত্রায় মুক্তি পেলাম।
স্নান সেরে মন্দিরে পূজো দিতে গেলাম। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি পা ব্যথা নিয়ে ভাস্কর সবার কোলে কোলে ঘুরছে।
সাম্প্রতিক কালে ও ভাল আছে,বড় হয়েছে, এখন একজন ডাক্তারি ছাত্র।
আবার পূজোর কথায় আসি। প্রচন্ড ভীড় ঠেলে মন্দিরে গর্ভগৃহে পৌঁছলাম সিংহদূয়ার দিয়ে। মন্দিরে ঢুকতে চারটি দরজা। ভিতরে তিনভাইবোনের দারুমূর্তি। কূপন কেটে ভোগ দেয়া হল। কথিত আছে জগন্নাথের ভোগ খেয়ে শেষ করা যায় না। ঠিক তাই আমরা ছোটোতিন হাড়ি ভোগ, এগারোজন মিলে খেয়ে ও শেষ করতে পারিনি। মাধব মিশ্রজীর তত্বাবধানে সব সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেল।
একটা অটো ভাড়া করে, মাসীর বাড়ি, গুন্ডিচা মন্দির, সিদ্ধবকুল,চৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ। চৈতন্য চারণ ভূমি পূরীধাম। সোনার গোপাল, আঠারোনালা, রাজবাড়ি সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কিছু জায়গায় পূজো দেয়া হল। গাইড দেখাতে লাগল জগন্নাথের ভোগঘর, পর পর হাড়ি বসিয়ে রান্নাহয়। সারাবছর নিজেদের জমির ফসল চাল ডাল উৎপাদিত করে জগন্নাথের ভোগ হয়। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় সেই ভোগ।
আবার ফিরলাম হোটেলে। রাতে সমুদ্র দেখে পাড় দিয়ে সবাই হাটলাম, বসে থাকলাম। পরম শান্তি। মনে হতে লাগল কাছে পিঠে হলে এখানেই বসে কাটিয়ে দিতাম সময়। যাই হোক আবার পরদিন স্নান খাওয়া শেষে, রওনা হলাম চিল্কার উদ্দেশ্যে। গ্রামের মেঠো পথ, শহর ছেড়ে এগোতে লাগল। নারকেল গাছ সমুদ্রে কিনারায় সার বেঁধে দাড়িয়ে। বঙ্গোপসাগরের সংগম মিলনস্থল, নদীর সাগরের মোহনা। চিল্কায় পৌঁছে বাঙালী হোটেল পেলাম, সেখানে টাটকা চিংড়ির ঝোল, সবজি ডাল চাটনি পাপড় দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম সকলে। হোটেলের পাচক কুচবিহারের লোক, আমরা কুচবিহার থেকে গেছি জেনে ভীষণ খুশি, দেশের বাড়ির লোক কত মজা পেলো। কাজু কিস্ মিস্ খেতে দিল, হাত ধুতে ওয়াশরুমে গেলে। কত গল্প করল সে, ------ পুরীতে অড়হড় ডালে প্রচলন। জগন্নাথ নাকি ভীষণ পছন্দ করেন।
খেয়ে আমরা চললাম জলবিহারে। ঘাটে ভুটভুটি সার দিয়ে দাড়ানো, দাম করে টিকিট কেটে বসে পড়লাম। ডালিয়ার জল দেখে ভয়। তবুও চললাম ছোট ছোটো সমান তালের ঢেউ কেটে চলছে। মাঝে মাঝে ডলফিনের উঁকি। হালকা হাওয়া দিচ্ছে:। অক্টোবরের শেষের দিক, ঠান্ডা সবে পড়ছে। সেখানে অনেক লাল কাঁকড়া দেখলাম। তিনঘন্টা চিল্কাহ্রদে চলল জলবিহার। বঙ্গোপসাগরের মোহনার বালুতটে শিশুসুলভ আচরণে প্রচুর ঝিণুক কুড়ালাম। যত্ন করে রেখে দিয়েছি সেগুলো। নুলিয়া বাচ্চাদের সাথে ছবি তুলল আমাদের বাচ্ছারা।
অনেক মজা করে রোদে পুড়ে ঝিণুক কুড়িয়ে, আবার হোটেলে ফিরলাম। পরদিন আবার জগন্নাথ মন্দিরে ঠাকুর দর্শণে গেলাম। দর্শনীয় স্থান দেখলাম। প্রচুর কেনাকাটা করলাম সবাই,ঘরে ফেরার অপেক্ষায়, প্রিয়জনদের উপহার দেবার জন্য।সেখানে বাঙালী হোটেল বৌদির হোটেল, দারুন রান্না।
ঘরে ফেরার টান থেকেই যায়। অনেকদিন হল বাইরে। ফেরারদিন সকালে গেলাম ধবলগিরি বা ধৌলী, কলিঙ্গ যুদ্ধক্ষেত্র এইসব দর্শনীয় স্থান চাক্ষুষে দেখে নিতে। প্রতিটি জিনিষ অসাধারণ দেখতে। কাহিনি রচনায় অনেক কিছুই বাদ থেকে গেল । দুপুরে আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টিও অনবরত শুরু হল, তবুও সাগরনীল তার বুকে শত সহস্র ঊর্মমালাকে জায়গা করে দিচ্ছে। আমাদের ফেরার সময় স্টেশনে যাব। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে গাড়ি এগোচ্ছো দু চোখ দিয়ে সমুদ্র দেখছি। ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। চোখ দিয়ে জল চলে আসছিল আমার। আস্তে আস্তে পিছনে ফেলে এগিয়ে এলাম,, দূরে সরে যাচ্ছে পুরীর সমুদ্র, কি কষ্ট যন্ত্রণা চেপে স্টেশনে চলে এলাম । কোলকাতার ট্রেন। সেখানেএ দিন কয়েক থাকব। তারপর কুচবিহার ফিরব। সেখানে ও কত অজানা ইতিহাস আছে জানবার। পুরী একবার নয় বারবার যাওয়ার সুন্দর এক স্থান,,, হিন্দুদের পবিত্র সেরা চার ধামের এক সেরা তীর্থস্থান।
এরপর আবার নুতন করে কোলকাতার গল্প জমে উঠবে!!! সমুদ্দুরের কথাই স্মৃতির পাতায় সোনার অক্ষরে উজ্বল হয়ে থাক মনের মনি কোঠায়।
ভ্রমণ কাহিনী লেখা অনেক শক্ত কাজ। আমার চোখে দেখা অনুভুতি টুকুই ধরে রাখলাম। দেখতে দেখকে বারো বছর একযুগ পার হয়ে গেল। তবু ও তুমুল অসম্ভব স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে পুরী ভ্রমণ জগন্নাথ ধাম দর্শণ।
প্রণাম বাবা জয় জগন্নাথ !!
(ছবি- সংগৃহীত)
লাক্ষা মিনিকয় ভ্রমণ
প্রতিভা দে
আমার বাড়ি আসাম ।এখান থেকে গেলাম কেরল ।কেরল থেকে ভ্রমণ শুরু হলো । গিয়ে উঠলাম একটি দ্বীপে
সখানে শুধু বালি এমন যেন পাউডার।
কিন্তু পায়ে সেন্ডেল পরতে হয় করাল ঢুকে যেতে পারে।
আছরে পড়া সমুদ্রের ঢেউ বসে আছি পারে ।পারে ভেসে আসছে জেলি ফিস,
সামুক,ঝিনুক, একটা অক্টোপাসের বাচ্চা ও এসে ছিল অনেকেই ওটার সথে
ফটো নিল ,তার পর একজন বলল এমাছ কাঁচা খাওয়া যায় বলেই টেনে ছিড়ে খেতে শুরু করল ,জলথেকে তোলার সাথে সাথে মাছটা ও মরে গেল।
চারিদিকে শুধু নারকেল গাছ আমাদের একটা একটা ডাব খেতে দিল।
দুপুরে লাঞ্চ দিল ওখান কার অধিবাসীদের রান্না নিজে নিয়ে খেতে হয়
প্রচুর আইটেম মাছ, মাংস তরীতরকারী ও ছিল রাইতা দই দিয়ে তৈরী।খাওয়া দাওয়া র পর ওখান কার অধিবাসীদের নৃত্য গান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাট লো।
ফিরে এলাম জাহাজে।আমাদের জাহাজের নাম ছিলো"টীপুসুলতান"
আবার সারারাত ধরে জাহাজ চলল
সকাল সকাল আবার অন্য দ্বীপে
সে দ্বীপ ছিল সমুদ্র টা বেশি গভীর নয় বেশি দূর পর্যন্ত অনেকেই হেঁটে অন্য ছোট ছোট দ্বীপ গুলো ঘুরে এলো।
আবার তেমনি খাওয়া দাওয়া নৃত্য গীত
ক ইবু জাতী ,মিনিকয় দ্বীপের অধিবাসী।
আবার এলাম অন্য দ্বীপে
পৌঁছে গেলাম দ্বীপে ।বড় জাহাজ অনেক সময় আইলেন্ডর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না জলের লেভেল কম থাকে বলে
তখন জাহাজ থেকে নেমে বোটে করে কিনারায় যেতে হয়।জাহাজ থেকে নেমে বোটে ওঠা খুব রিসকি।কারণ সমূদ্রের ঢেউ এ দোলা বোটের উপর ঢেউ খাওয়া জাহাজ জাহাজের পাটাতন উচুতে তা থেকে নামতে হয়।জাহাজের লোকেরা সাহায্য করে নামতে ,না হলে দুটোর মাঝখানে পড়ে গেলে থেতো।
জাহাজে একজন নার্স থাকেন।কিছু ঔষধের ব্যবস্থা থাকে।
অনেক পেগনেন্ট মহিলা আইল্যান্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে না বলে শহরে যায় ।এমনকি জাহাজে সন্তান প্রসব করে ফেলে।খুব কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।
আর একটি আইল্যান্ড পৌঁছনোর পর দেখলাম সে এক অপূর্ব দৃশ্য।যত প্রটার
ছোট ছোট কড়ি শঙ্খ জীবন্ত হেঁটে চলছে।
জীওলজীর কিছু স্টুডেন্ড ওরা ও গুলো ধরে ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে।একটি ও জীবন্ত গুলো যাতে না মরে সে গুলো কে সাবধানে ছেড়ে দিচ্ছে।
কিছু মরে থাকা খোল তুলে নিলাম স্মৃতি হিসেবে।কিন্তু কোন ঝিনুক বা কিছু কমে যাচ্ছে বলে পাড় থেকে নেওয়া মানা করা হচ্ছে।
সেখান থেকে ঘুরতে গেলাম শহরে সর্বত্র নারকেল গাছের সারি তার ফাঁক দিয়ে চলছে আমাদের বয়ে নেওয়া ছোট ছোট গাড়ি মেটাডোর। নিয়ে গেল মিউজিয়াম জীবন্ত সামুদ্রিক প্রানী, মাছ যেমন শার্ক, তিমির বাচ্চা, অক্টোপাস,
অন্যান্য আরও অনেক সমুদ্রের করাল,
শঙ্খ শামুক দেখতে পেলাম।
কোথায় ও দেখতে পেলাম গেঞ্জি তৈরী শিল্প সেখানে কিছু কেনা কাটা করলাম।
আবার বোটে করে ছোট ছোট দ্বীপে নিয়ে গেল যেখানে জলের গভীরতা কম
এবং সামুদ্রিক সাপ।মাছ রঙিন মাছ ,বড় বড় মাছ সব চোখে দেখতে পেলাম।
সব অদ্ভুত দৃশ্য সেই সাথে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ পড়ে গেলে বাঁচাতে পারব কিনা সেই ভয়।
এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম আবার জাহজে।জাহাজ আবার শুরু করল চলতে ,বিশাল সমুদ্র আরব সাগর ।ভারতের পশ্চিমে লাক্ষা মিনিকয়
দ্বীপ ছোট ছোট দ্বীপ ।সেখানে থাকে অনেক লোক।নারকেল, মাছ প্রধান ব্যবসা ,জীবিকা।
জাহাজ টিপু সুলতান বিরাট ।জাহাজটা
ঘুরে ঘুরে এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চলছি ।দুলছে দুলছে।
জাহাজ যখন ছাড়ে সেটাও উপভোগ্য
একটা একটা করে দড়ি ছাড়তে থাকে
বেলেন্স রেখে যাহাতে জাহাজ কোন দিকে বেশী কাৎ হয়ে পড়ে।যদি ও 60ডিগ্রী কাত পৃথিবীর তার মেরুদন্ড তে থাকে তাই জাহাজ ও ততটা হেলে থেকে চলে সেটা মাধ্যাকর্ষনের নিয়মে চলে।জাহাজের বেলেন্স সব সময় পরখ করা হয়।ছাড়া বা নোঙর করার সময়
মানুষ কে সাবধান করে দেওয়া হয়যাতে
মানুষ ঠিক বেলেন্স এ থাকে।
এক একটি দড়ির মূল্য একলাখ টাকা
ভিতরে রূমগুলো এয়ার কন্ডিশনার,
প্রচুর জল ,সমুদ্রের জল মোডিফাইড করে ব্যবহার যোগ্য করা হয়।
খাওয়ার জল পার থেকে কিনে নেওয়া।
মাঝ সমুদ্রের বালী হাঁস ,ডলফিন দৃশ্য গোচরে আসে।ফেনীল সমুদ্রে জল কেটে কেটে এগিয়ে যায়।
পাইলট বোট তীর থেকে ছাড়তে বা
পৌঁছে দিতে সাহায্য করে কারণ তাদের আলাদা ট্রেনিং থাকে কোথা দিয়ে জহাজ
ঠিক ভাবে চলতে পারবে উপযুক্ত গভীরতা না থাকলে জাহাজ আটকে যাবে।
এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘুরে এলাম। কেরলে খুব সুন্দর নারকেল গাছের বোট সাজানো সব নারকেলের পাতা দিয়ে রুমের মত।
অপরূপ সমুদ্র, সমুদ্রের বুকে এক বিষ্ময়কর যাত্রা সত্যি ভুলার নয়।
জাহাজের রেলিংয়ে দাড়িয়ে সমুদ্র তার বিশালতা, দৌড়দান্ত প্রতাপ স্বচক্ষে উপভোগ করার ভাগ্য হয়ে ছিল।
নীল সমুদ্র জায়গায় জায়গায় দেখলে মনে হয় কে যেন সিগ্রিন কালারে রং করে রেখেছে।
সেফটি ড্রেস পরিয়ে দিত স্নান করতে গেলে। ছোট পাতলা বোট দিয়ে নিজে
ড্রাইভ করার ব্যবস্থা ছিল।
সব সময় কিছু লোক পরখ করত কেউ যেন ডুবে না যায়।
জাহাজে সব কিছুই পাওয়া যায় তবে
দামটা একটু বেশি।
খেলার যায়গা আছে। একটা হেলিকপ্টার অনায়াসে নামতে পারে যাতে কেউ অসুস্থ হলে খবর করে নিয়ে যাওয়া যায়। কোন প্রকার বিপদ হলে
কাছে ধারের জাহাজ কে খবর পাঠানো যায় তেমন হকি টকির মত ব্যবস্থা।
লাইট সংকেত। কোন প্রকার অন্য জাহাজেসাথে টোক্কর না হয় তার জন্য লাইট সংকেত সামনের, পেছনের।
লাইফবোট খাবার বিস্কিট যদি টাইটানিক এর মত ঘটনায় পরে ।ছোট ছোট বোট বাধা থাকে ।
কম্পিউটার দ্বারা পরিচালিত।
কোথায় ও আগুন লাগলে কোথায় লেগে ছে সংকেত পৌঁছে যায় জাহাজের সকল কোনে।
এতো ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সকল সময়
এক ভয় ভালো লাগা সব নিয়ে এক
অপূর্ব অনুভূতির ভ্রমণ কোন দিন ভোলার নয়।
অরণ্যের ভেষজ ভালোবাসা
সেবারে কলেজে ফার্স্ট ইয়ার,না সেকেন্ড ইয়ার,
হ্যাঁ সেকেন্ড ইয়ারই হবে। মায়াশহর জলপাইগুড়িতে মেসে থাকি। ইচ্ছে করলে সপ্তাহান্তে
বাড়ি যাই নয়ত যাই না। কলেজ ও পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে এদিক ওদিক সাইকেল নিয়ে ঘুরে
বেড়াই একা নয়ত বন্ধুদের সাথে। সময়টা এপ্রিল- মে হবে।এক সন্ধ্যায় দোতলায় মেস
কাকিমার ঘরে কিরিদিং কিরিদিং ল্যান্ডফোন বাজে। মনে হল আমার ফোন এল নাতো! তখনও
মোবাইলের চল শুরু হয়নি। তাই মেসের কারও ফোন এলে মালকিন কাকিমার ঘরের ফোনেই আসে সে
ঘরের লোকের হোক বা কোনও বান্ধবীর। সে হাঁক দিয়ে ডাকে আমাদের। তাই ফোনের আওয়াজেই
সবার মনে সু ডাকত – ‘আমায় কেউ মনে করেছে না তো !’ সেদিনের ফোনটি ছিল কলকাতা থেকে
আমার এক জ্যাঠতুতো দিদির। ও আর ওর এক বান্ধবী আসবে শিলিগুড়ি আমাদের বাড়িতে ঘুরতে।
আমি বললাম আয় ভালো কথা, সে বলল আমাদের নর্থবেঙ্গল ঘোরাতে হবে। আমি বললাম অবশ্যই
ঘুরাব। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে লালিতপালিত হওয়ায় আলাদা করে তখনও
উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের কথা ভাবিনি । যখন যেখানে ইচ্ছে ও সুযোগ হয়েছে চলে গেছি- কখনো
মিরিক, কখনো দার্জিলিং- পাহাড়ই বেশি পছন্দের ছিল। অরণ্য মানে অভয়ারণ্য ঘোরার কথা
তেমন মাথায় আসেনি কোনদিন কারণ শিলিগুড়ি ছোট শহর হলেও চারিদিকে বনাঞ্চল পরিবেষ্টিতই
বলা চলে। আবার আমাদের বাড়ি যেখানে সেখান থেকে দু’পা পূবে গেলেই বৈকুন্ঠপুর ফরেস্ট।
যখন তখন চলে যাই বন্ধুবান্ধব মিলে জঙ্গলের ভিতরে কোনও নেপালি বস্তীতে মাছ ধরতে বা
ভুট্টা আনতে। আর শীতের সিজনে তো পিকনিক লেগেই আছে।
মঞ্জুদির ইচ্ছে নর্থবেঙ্গলের বনজঙ্গল ঘুরে
দেখবে। তা ঠিক হল জলদাপাড়া অভয়ারণ্য ঘুরতে যাব। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে বোঝা গেল
যেএভাবে এক-দু’দিনের নোটিশে সেখানে সরকারী ফরেস্ট বাংলো বুক হয় না। তার জন্য
তিনমাস আগে চিঠি লিখে আবেদন করতে হয় আর সৌভাগ্যক্রমে ঘর খালি পেলেও শেষমুহুর্তে
কোন না কোনো মন্ত্রী বা আমলার আগমনে তা খারিজ হবেই হবে। তবে ট্যুরিস্ট
ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে অভয়ারণ্যে ঢোকার মুখে একটি প্রাইভেট
ট্যুরিস্ট লজ আছে সেটা খালি থাকলে ঘর পেয়েও যেতে পারি। সেই ভরসাতেই মঞ্জুদি ও নমিতাদির সাথে শিলিগুড়ি থেকে
আলিপুরদুয়ারগামী বাসে চেপে বসলাম সকাল সকাল।যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে প্ল্যান করে নিচ্ছি যে যদি থাকার কোনও বন্দোবস্ত না
হয় তবে দিনে দিনে ঘুরেই চলে আসব। মাদারিহাটে নেমে লোকাল জিপে করে দশমিনিটের মধ্যে
পৌঁছে গেলাম অভয়ারণ্যের গেটে। জঙ্গলে গেলে নাকি ভূতে পায় ছোটবেলায় শুনেছি। সবুজ
রৌদ্রের ঘনঘোরে যেন আমাদেরও ভূতে পেয়েছিল সেদিন। নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন অচেনা
আওয়াজ করে গেট খুলে গেল। ভেতরেই সাজানো পরিসরে ছায়া রঙের একটি একটি বাংলো।আর কোনো
দিকে দিকে যাবার রাস্তা খোলা ছিল নাঅগত্যা সেই প্রাইভেট লজে গাছের মত বসে থাকা
ম্যনেজারের শরণাপন্ন হতেই সেও যেন অদ্ভুত কিছু দেখছে এমন বিস্ময়ে আমাদের দিকে
তাকিয়ে আছে। রাত্রিবাসের জন্য রুম পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাওয়াতেই নানারকম
সন্দেহপরবশ প্রশ্ন পাতার মত ঝরতে শুরু করল। কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পারস্পরিক
সম্বন্ধ কী, এখানেই কেন এসেছি ঘুরতে? ইত্যাদি ইতাদি ! মঞ্জুদি ও নমিতাদি আমার থেকে
মাত্র দু’তিন বছরের বড় হবে। বুঝতে পারলাম কৈশোর পেরনো তিনটি ছেলেমেয়ে কোনো
অভিভাবকহীন হয়ে ঘুরতে আসতে পারে তাও আবার এরকম বনেজঙ্গলে- এটা যেন সেই ম্যনেজারটি
মানতে পারছিল না। ম্যনেজারকে মরিয়া হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে সে যখন
রাজি হল তখন ঘটনাটিকে বেশ চ্যালেঞ্জিং ও অ্যাডভেঞ্চারাস্ মনে হয়েছিল। ঘরভাড়া কত
ছিল এখন আর মনে নেই তবে সেই কাঠের ঘরের বেশ কেমন একটা পুরোনো জল জল গন্ধ এখনও নাকে
ভেসে আসে। দুপুরে আলুভাজা, ডাল আর ডিমের ঝোলভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা একটু
ঘুরে দেখতে। বাংলো লাগোয়া মাঠেই চিড়িয়াখানা নয় তবে একটি খাঁচায় কতগুলো হরিণকে
বন্দি করে রেখেছে দেখে অবাক হলাম। আমরা যেমন বাড়িতে খাঁচায় হাঁস মুরগি পালি তেমনই।
আমি ভাবি জঙ্গলেও কেন এদের খাঁচাবন্দি করে রাখা? পর্যটকদের সহজ মনোরঞ্জনের জন্য এই
দৃষ্টিকটু ব্যবস্থা ! নিক্কনের ক্যামেরায় কয়েকটি ফোটো তুলতেই রিল শেষ হয়ে গেল।
লজের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে রিল কেনার জন্য মাদারিহাট যেতে
হবে। সুসজ্জিত গাছেদের দুপাশে সাক্ষী রেখে পাথুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছি
বাইরে জিপ ধরার জন্য। সে রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতা, সেই রাস্তার গায়ে লেগে থাকা
গাড়ির চাকার দাগ যেন চোখ ফেরাতে দেয় না! মনে হয় যেন এই পাতা আগে কখনো দেখিনি, এই
দাগ লেগে থাকা রাস্তা যেন অনেক দিনের চেনা ! বাইরে দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়,
দু’পা তফাতেই একটি ঘুমটি দোকান, আমার নেশা ধরে যায়। দিদিদের বলি তোরা কিছু মনে
করিসনা কিছুক্ষণ অন্য দিকে মুখ ঘুরে থাক আমি আসছি ওই দোকানটি থেকে। সেই বয়সের নেশা
তখন হয় নেভিকাট নয় তো নয়। মঞ্জুদিদিও বুঝতে পেরে মুচকি মুচকি হেসে বলে বুঝতে
পেরেছি, যা যা টেনে আয় ! আমি শুধু লজ্জাবতি হাসি হেসে ছুটে যাই আর ভাবি নিষিদ্ধ
পানের এই যে ছাড়পত্র পাওয়া বড়দের কাছ থেকে তাতে যেন আমিও অনেকটা বড় হয়ে গেলাম।
অভয়ারণ্যে রাত যেন নেমে আসে নিজের বিস্তার
বাড়িয়ে দিয়ে পুরোপুরি নির্ভয়ে। সেই রাত্রির ভয়ে বাংলোকে ঘিরে যে কটা হ্যালোজেন
লাইট আর হলদেটে বাল্ব তারা যেন জড়সড় হয়ে থাকে। ততক্ষণে অবশ্য ম্যনেজারের যাবতীয়
সন্দেহ ও জড়তা কেটে গেছে আমাদের নিয়ে। পরেরদিন ভোরে হলং বাংলো থেকে হাতি সাফারি
বুকিং হবে কিনা অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু খুব সহজেই ম্যনেজ হয়ে গেল ম্যানেজার সচলদার
উদ্যোগে। সন্ধ্যার চা’পানের আড্ডায় বেশ গুছিয়ে আড্ডা হল। জানলাম সে রাণাঘাটের লোক।
রাণাঘাটের প্রসঙ্গে কবি জয় গোস্বামীর কথা উঠতেই সচল দা উচ্ছলিত হয়ে উঠল। বলল জয়ের
সাথে তো আমার দাদার মত সম্পর্ক, দাঁড়াও দাঁড়াও তোমাদের জয়ের কবিতা শোনাচ্ছি।ছোটোবেলা
থেকেই আমার আবার একটু আধটু ডায়েরি লেখার শখ।উস্কানি পেয়ে আমিও খুলে ফেললাম আমার
মামার দেওয়া এল আই সি কোম্পানির ছোট ডায়েরিটা। তাতে টুকরো টাকরা লেখার মধ্যে যে
কয়েকটা কবিতা সেগুলি সবই প্রেমের কবিতা। সচলদার ভালো লাগলো কিনা বোঝা গেল না, তবে
দিদিরা যে ভাইয়ের গোপন ঘরের হদিশ পেয়ে বেশ ইন্টারেস্ট পেল বুঝতে পারলাম।
রাতের খাবারের ডাক পড়ল। লাল টকটকে দেশি মুরগির
ঝোল আর রুটি। আরও দুটো ফ্যামিলি ছিল সেই বনভোজনের আসরে। মোট দশ-বারো জন ভ্রমণ
পিপাসুর এই সমারোহে কোনও অবাঞ্ছিত কোলাহল
ছিলনা দেশি মুরগির ঝোলঝাল গন্ধ আর সেঁকা রুটির উষ্ণতা ছাড়া। এ দেখে বৃষ্টি কেন
চুপচাপ বসে থাকবে। সেও এল, সে ঝাঁপিয়ে এল অথচ গাছবন্দি থাকার ফলে তার আসার
পূর্বাভাস টের পাইনি। তবে কেউ কেউ পেয়েছিল। সন্ধ্যের মুখে যখন আমরা মাদারীহাট থেকে রিল নিয়ে
ফিরছিলাম তখন বাংলোর একটু আগেই বনের মধ্যে এক দল ময়ূরীর মাঝে দুটি ময়ূর পেখম তুলে
নাচছিল। ময়ূর তো কতই দেখেছি, কিন্তু ওদের ঘরে এসে ওদের এরকম মনোহরণ করা
নৃত্য-অনুষ্ঠান এর আগে দেখিনি।
পরদিন খুব ভোরে উঠে দেখি জিপ এসে গেছে আমাদের
নিতে। কোনমতে রেডি হয়ে চললাম হলং বাংলোর দিকে। গতরাতের বৃষ্টিভেজা হয়ে গাছগুলো যেন
সবুজে চুপচুপ করছে। চারিদিকে কৌতূহলী নজর পাক খাচ্ছে জিপের সব সওয়ারিদের, এই কিছু
দেখা গেল বুঝি, তবে না হলং বাংলো পর্যন্ত কিছুই দেখা যায়নি।পৌঁছে দেখি সেখানে
আমাদের অভ্যর্থনায় হাজির হয়ে আছে চারটে কুনকি হাতি, তাদের সাথে মাহুত বন্ধু পরিচয়
করে দিল, কি কি যেন নাম বলেছিল আজ আর মনে নেই। তাদের সবার কড়া পরা পিঠ ও কাঁধের
উপর চৌকো এক আসন বাঁধা। একেক হাতির উপর চারজন করে বসা যায়। আমাদের যে সাথী ছিল তার
আবার ছোট্ট একটি ছানা ছিল। আমাদের সাফারির দলটি হেলতে দুলতে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। অরণ্য
তার অপার ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের পরিক্ষকের মত হাজির। তার বৃক্ষেরা ফিসফিস করে একে
অপরকে সংকেত চালান করে, সাবধান করে দেয় অচেনা, অযাচিত গতিবিধি সম্বন্ধে। চারদিকে
ঘিরে থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে। পাতাদের সর্ সর্ আওয়াজে মৃদু শাসানীও থাকে। পর্যটক ভয় পায়না বরং রোমাঞ্চিত হয়, সহযাত্রীকে
উল্লাসে বলে ঐ দেখ ঐ দেখ বাইসন ছুটে যায়। লতা-পাতা, ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথের হাঁটা
সঙ্কেত ধরে ধরে এগোতে থাকে আমাদের সাফারি। আমাদের গন্তব্য নির্দিষ্ট, আমাদের
গতিবিধি সংরক্ষিত কারণ মাহুতবন্ধু সব জানে ! হাথি আমাদের সাথী সেও জানে, সেও জানে
তার পেশাদারিত্ব ! তারপরও সে ভোলেনা তার মাতৃত্ব। তার ছানা পিছিয়ে গেলে সেও
দাঁড়িয়ে পড়ে, ছানার ক্ষিধে পেলে তাকে স্তনপানও করাতে দ্বিধা বোধ করে না। আর আমরা
ঘাড় নিচু করে সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখি আর ক্যামেরাবন্ধি করি। মাঝে এক তিরতিরে
ঝোরা পেরতে গিয়ে সে এক কীর্তি! বাচ্চা হাতিটি বার বার পাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে আর
কাদামাটি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলে। জলের মাঝে মা হাতিটি দাঁড়িয়ে আছে, যতক্ষণ না তার
বাচ্চাটি পাড়ে উঠছে তার আগে সে উঠবে না। প্রথমে আমরা ভাবলাম বাচ্চা হাতিটি বুঝি সত্যিই পাড়ে উঠতে পারছে না, সবাই আহা
উঁহু করছি। কিন্তু পরে বুঝলাম যে সে মস্তি করেই কাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
পর্যটকদের একপ্রস্থ মনোরঞ্জন দেবার পর মা হাতিটি শূর তুলে এগিয়ে যেতেই তর-তর করে
পাড়ে উঠে গেল বাচ্চাটি। আমরা গিয়ে পড়লাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্যকে দ্বিধাবিভক্ত করে দেওয়া এক তৃণভূমির
সামনে। দূরেমানুষের থেকেও উঁচু উঁচু ঘাস আর ঘাস। এত হরিণ এত হরিণ যেন মনে হয়
গ্রামের কোনো মাঠে ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। আরও কিছুটা উত্তরে এগোতেই মাহুত বন্ধু দূরের
দিকে হাতের ইশারা করল। দেখতে পেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত জলাদাপাড়ার অধিপতিকে ! একশৃঙ্গ গণ্ডার তার শৃঙ্গ
উঁচিয়ে যেন আমাদের বলছে সার্থক তোমাদের সাফারি, দেখা হয়ে গেল এবার ভালয় ভালয় ফিরে
যাও । আমাদের ফিরতে হতই,আমরা ফিরে এসেছিলাম তবে সঙ্গে এনেছিলাম তাবিজে বন্দি করা
অরণ্যের ভেষজ ভালোবাসা । সেই তাবিজগুণে আজও ঘুরে বেড়াই পাহাড়ে জঙ্গলে।
(ছবি- শৌভিক রায়)
সঙ্গে লেপচাজগৎ
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
প্রতিবছরের মত এবারের চলতি বছরে গরমের ছুটিতে আমার দেওর,জা,ওদের ছেলে ঋষিকে নিয়ে কোচবিহারের বাড়ীতে এলো । ওরা এলে আমরা দু-চারদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাই । ঋষির আবদার তার জেঠুর কাছে পাহাড়ে যাবে সে এবারের ছুটিতে । সেইমত ভাই (দেওর ) কলকাতা থেকে অনলাইনে বুক করে রেখেছিল ।আমাদের এবারের গন্তব্য হল লেপচাজগত এবং আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা ।
যদিও আমরা মে মাসের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম, তবুও লেপচাজগৎ যাওয়ার সঠিক সময় অক্টোবর থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত । কারন ওইসময় ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমিদের কাছে উপরিপাওনা ।
লেপচাজগৎ হলো প্রকৃতিপ্রেমি ও নব-দম্পতিদের মধুচন্দ্রিমার জন্য আদর্শস্থান ।এখানকার স্বর্গীয় - সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হবেন না এমন মানুষ বোধহয় বিরল ।দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিমি. দূরত্বে অবস্থিত লেপচাজগৎ হলো একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম এবং রিজার্ভ ফরেস্ট অঞ্চল ।এখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের একটি লজ রয়েছে । এই স্থানটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এখনো ততটা প্রকাশ্যে আসেনি । তাই এখানকার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য অটুট ।
অবশেষে এক শুক্রবার নিউকোচবিহার রেলস্টেশন থেকে ৩-২৫ মি.এর উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে ৬-৪৫ মিনিটে পৌছলাম এন.জে.পিতে । সেইরাতটা শিলিগুড়ির একটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকাল ৮টা নাগাদ আগে থেকে বুক করে রাখা একটা ইনোভা করে দূগ্গা-দূগ্গা বলে বেরিয়ে পরলাম । ড্রাইভার তেনজিং বেশ হাসিখুশি প্রকৃতির । হিন্দিতে কথা বললেও ওর ভাঙা ভাঙা বাংলা শুনতে বেশি ভালো লাগছিল ।
আমাদের গাড়ি তিস্তবাজারের কাছাকাছি একটা রেঁস্তোরায় দাঁড়ালে প্রাতঃরাশ পর্ব মিটিয়ে রওনা হলাম । এরপর পৌঁছালাম ঘুম হিল স্টেশন । সেখানে কিছুসময় কাটিয়ে কিছু স্মৃতি মুঠোফোনে বন্দী করে গাড়ি ছুটলো লেপচাজগৎ এর দিকে যা কিনা ঘুম থেকে ৮ কিমি. দূরত্বে অবস্থিত ।প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি,শিলিগুড়ি থেকে ৬৮ কিমি. দূরত্বে "লেপচাজগৎ" সেইসব ভ্রমণবিলাসীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় যারা দার্জিলিং শহরের তথাকথিত কোলাহল ও জনবহুলতা এড়াতে চান । নিরিবিলিতে ছুটি কাটাতে চান প্রকৃতিরানীর রঙ রূপ গায়ে মেখে । বেশ কয়েকটি হোমস্টে রয়েছে এখানে । সেগুলি হলো,যথাক্রমে - কাঞ্চনকন্যা হোমস্টে,লেপচাজগৎ হোমস্টে,রেনু হোমস্টে,লেপচাজগৎ প্রাইভেট হোটেল,ফরেস্ট বাংলো.....
বেলা ১ টা নাগাদ পৌছালাম স্বর্গ- সুন্দরী " লেপচাজগৎ"-এ । আসার পথে প্রকৃতির পরতে পরতে সাজিয়ে রাখা সৌন্দর্য্যে চক্ষুসার্থক হয়েছিল । রাস্তার দুপাশে পাইনের সারি আহাঃ কি সুন্দর ।
বেশ ঠান্ডা এখানে । আমরা গিয়ে উঠলাম আগে থেকে অনলাইনে বুক করে রাখা রেনু হোমস্টেতে । পাহাড়ের কোলে সুন্দর ছিমছাম সাজানো পাশাপাশি দুটো ঘর বরাদ্দ ছিল । পরিপাটি করে গোছানো ঘরদুটি । ফ্রেশ হয়ে জঙ্গলে খানিকটা ঘুরে গেলাম ভিউ পয়েন্টে ।যেখান থেকে সূ্র্যোদয়- সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখা যায় ।বেশকিছু স্থানীয় মানুষদের সাথে পরিচয় হলো । ওরা কত অবলিলায় পাহাড়ে ওঠানামা করে ।বেশকিছুক্ষন ট্রেকিং করে পৌছালাম ।চারদিকে মেঘে ছেয়ে আছে ।দু- একজন পর্যটকদের সাথে আমরাও অপেক্ষা করছিলাম যদি এই মেঘযুক্ত আকাশে একটু দেখা পাই ।কিন্ত মেঘেদের দৌরাত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা এযাত্রায় হবে না ভেবে নিরাশ হয়ে যখন ফিরব ভাবছি ঠিক তখনি করূণাময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘার আবির্ভাব হলো পাহাড়ের বুকে আকাশফুঁড়ে ।আমরা প্রায় একসঙ্গেই সবাই চেচিয়ে উঠলাম কা- ঞ্চ- ন- জ- ঙ্ঘা.....
ফিরে এলাম হোমস্টেতে । রাত বাড়ার সাথে ঠান্ডা পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মে মাসেও ।তাই লেপ- কম্বল সম্বল করে সুখনিদ্রায় গেলাম হোমস্টের সাজানো শয্যায় সে রাতের মত নৈশভোজের পরে ।
পরদিন সকালে গরমজলে স্নান সেড়ে চা খেয়ে হোমস্টেকে বিদায় জানিয়ে ওদেরই ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে রওনা হলাম জোড়পোখরির পথে । দুধারে পাইনের সারিকে পেছনে রেখে আমাদের গাড়ি শুখিয়াপোখরি পৌছালো ।এটা একটা ছোট গ্রাম যাকে কেন্দ্র করে বাজার বসেছে,সেদিন ছিল হাটবার । দোকানিরা নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পশড়া সাজিয়ে বসেছে ।হাটটা ঘুরে দেখে একটা দোকান থেকে চা দিয়ে গলা ভিজিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল ।পৌছালাম জোড়পোখরি নামের অপূর্ব সুন্দর জায়গায় ।এখানেও একটা টুরিস্টলজ রয়েছে যেটা অনলাইন বুক করা যায় ।এমন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হচ্ছিল এখানে এসে ।পাহাড়ের গায়ে,লজের কানায় কানায়,ফুলেদের জলসায় মেঘেদের অবাধ আনাগোনা আমরা প্রাণ ভরে উপোভোগ করছিলাম ।বলাই বাহুল্য সঙ্গে থাকা ক্যামেরা আর মুঠোফোনে বন্দী হচ্ছিল মেঘেদের দেশে আমাদের বিভিন্ন পোজে ছবি তোলা ।বয়স একধাক্কায় অনেকটা কমে এসেছিল আমাদের ।তখন সবাই আমরা ঋষির সমবয়সি ।গাড়ি আবারও এগিয়ে চলল জোড়পোখরিকে পেছনে ফেলে । পৌছালাম নেপালের সীমান্ত বর্ডারে ।জায়গাটা স্থানীয় লোকমুখে সীমানা বাজার নামে পরিচিত চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতের কবর ।তার চারপাশেই গড়ে উঠেছে বাজারটি।কিছু কিউরিও সপ,খাবরের দোকান,গরম পোষাকের বিকিকিনি চলছে । পর্যটকদের কেনাকাটার বহরও কম নয়,আমিও সেদলে ভিড়ে গিয়ে কিনে ফেললাম দু-একটা মোমেন্টোস্ ।ঠান্ডার কামড় এখানে দ্বিগুন । এরপর গাড়িতে উঠে পথ ধরলাম সেদিকে যেদিক গেছে নেপালের পশুপতি । পৌঁছালাম নেপালের প্রবেশদ্বারের কাছে । এখানে বাইরের গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ ।যথাস্থানে পরিচয় পত্র ......দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে ওখানকার গাড়ি করে পার হলাম নেপালের প্রবেশ দ্বার ।এখানে মহাদেবের একটি মন্দির আছে যা পশুপতি মন্দির নামে পরিচিত ।ভগবান শিবকে পশুপতি নামে ডাকেন নেপালের বাসিন্দারা ।
মন্দির ঘুরে আমরা গেলাম পশুপতি মার্কেটে ।এখানে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ।দেশি - বিদেশি নানান সামগ্রির দোকান । কসমেটিক্স খুব সস্তা এখানে। ড্রাইভার তেনজিং অপেক্ষা করছিল,আমরা ফিরতেই একগাল সরল হাসি হেসে বলল "আইয়ে ম্যাডাম" ।গাড়ি এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্য মিরিকের পথে ।বিকেল চারটায় পৌছালাম ।হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম মিরিক লেকে ।এর আগেও একবার মিরিকে এসেছিলাম,খুব ভালোলেগেছিল । কিন্তু এবারে আগের সেই মিরিককে আর পেলাম না । পর্যাপ্ত রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে জায়গাটার সৌন্দর্য্য নষ্ট হতে বসেছে । লেকের ধারের অপরিচ্ছন্নতাই তার প্রমান । দুএকটা ছবি তুলে সন্ধ্যা নামার কিছু পরেই ফিরে এলাম হোটেলের আরামদায়ক ঘরটাতে ।পথের ক্লান্তিতে সবাই তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পরলাম ।পরদিন সকালে স্নান,ব্রেকফাস্ট সেড়ে বেড়িয়ে পরলাম ।একে একে মিরিক কটেজ,মনাস্ট্রি ,সৌরিনি টি গার্ডেন দেখে পাহাড় ছেড়ে নেমে এলাম সমতলের বুকে ভাড়ার গাড়ি চোড়ে ।ঘরে ফেরার পালা,মনখারাপিয়া বাঁশি বেজে উঠলো সবার মনে,ঋষির মুখ ভার ।ওর বাবা-মায়ের সাথে আমরাও ওকে কথা দিলাম,আবার আসবো পাহাড়ে,,,,অন্যকোন পাহাড়ের দেশে,,,যেথায় মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াব,,,পাইনের সারি,,,সূর্যোদ়য- সূর্যাস্ত,,,বুক ভোরে শ্বাস নেব ক'টা দিন ।দূর থেকে ভেসে আসবে পাহাড়িয়া বাঁশির সুর....
(ছবি- লেখিকা)
পাহাড়ি কন্যা ঝালং বিন্দু
দেবযানী সিন্হা
আমার প্রানের শহর আলিপুর দুয়ার। প্রতিদিন সূর্য দেখার মতো আমার চোখ মুগ্ধ হয়ে পাহাড় দেখে।আমার শহরের উত্তরপ্রান্ত জুড়ে বিস্তীর্ণ পাহাড়।
পাহাড়ের সাথে আমার ভালোলাগার সম্পর্ক চিরন্তনী। যখনি ব্যস্তদিনের ফাঁকে ছুটি পেয়েছি তখনি ছুট্টে গেছি পাহাড়ের কাছে।
বছর বারো আগের কথা লক্ষ্মীপূজোর ঠিক পরের দিন পরিবারের কজন মিলে বেড়িয়ে গেলাম পাহাড়িকন্যা ঝালং বিন্দুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে।আলিপুরদুয়ার থেকে নিজস্ব গাড়িতে সকাল ছটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো।সকালের হাল্কা ঠাণ্ডাগরম আবহাওয়ায় ছুটছে গাড়ি। নিমতিতে হাইরোডের পাশে খাবারের দোকানে সকালের খাবার খেয়ে কিছু শুখনো খাবার সাথে নিয়ে ঘন বনের মাঝরাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে দূর পাহাড়ের হাতছানিতে।নিমতি পাড় হয়ে চাবাগান আর চাফুলের মৃদু গন্ধ হাসিমারা ছোট্ট গাঁ ঘেষে চলে এলাম মাদারিহাট তারপর বীরপারা বাইপাস হয়ে সেনাছাউনির পাশ দিয়ে চলে এলাম খুনিয়ামোর, ক্রমশ আরো এগিয়ে যাচ্ছি গভীরতম বনের বুক চিরে পিচঢালা রাস্তায়।ডান দিকে সুদীর্ঘ গাছের বনভূমি চাপরামারি।মনে হচ্ছে যেন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে চলেছি পাহাড়ি কন্যার ডাকে।এই মনোমোহিনী দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে চলেছি খুশি আর আনন্দের মেলবন্ধনে।
পাহাড়ি পথের ধারে নানা রকমের জানা অজানা গাছের সারি।রোদ্রছায়া মাখা আমেজে আমরা চলেছি ঝালং এ।কিছুদূর অন্তর অন্তর পাহাড়ি ঝরনা। মন চাইছিল একটু ছুঁয়ে আসি।আবার ভয় হচ্ছিল এই দুর্গম গিরিতে জনমানবহীন পথে কোনো জন্তুজানোয়ার এসে পড়ে। পাহাড়ের কোলে অপূর্ব সুন্দরী ঝালং,ছোটো ছোটো বাড়ি বিভিন্ন ফুলে সাজানো, বিশেষ করে নানা রঙের অর্কিড মন মাতাল করে দেয়।ঝালং এর জলঢাকা হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট তার কথা না বললেই নয়,আমাদের এক পরিচিত ব্যক্তির কল্যানে যন্ত্রদানবের কাছে যাওনা সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। অনবরত টারবাইন ঘুরছে অতি দ্রত গতিবেগে, সে এক মহাজাগতিক ভয়ংকর অনুভূতি। বৃহৎ যন্ত্রদানব যার কোনো বিরাম নেই।উচ্চরব শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেহে প্রান এলো।বিশাল আকৃতির পাইপলাইনের জলোচ্ছ্বাস শুধুই চোখেমুখে ভয় স্নায়ু কে গ্রাস করছে।
তারপরের গন্তব্য স্থল ভুটান সীমান্তে ভারতের শেষ জনপদ যেন কোনো শিল্পির তুলিতে আঁকা পাহাড়ি গ্রাম বিন্দু।ঝালং থেকে বিন্দু ১১ থেকে ১২কিমি দূরত্ব। বিন্দু চোখজুড়ানো ভালোলাগা।সে এক মনোরম অনুভূতি। জলঢাকার সাদাফেনা মিশ্রিত জলস্রোতের রুপ, বিশাল বিশাল আকৃতির পাথর আর ভয়াবহ তীক্ষ্ণ গর্জন মনকে উদ্বেল করে তোলে। দুপুরের খাবার এই পাহাড়ের কোলের ছোট্ট হোটেলে গরম গরম ভাত ডিমকারি হলো আবার কয়েক জন চাউমিন মোমো খেলো।জলঢাকা নদীর ওপর অবস্থিত হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রোজেক্ট বিন্দু।সবাই মিলে বাঁধের ওপর দিয়ে হেটে গেলাম ভুটানের মাটিকে একটু স্পর্শ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সেনা সুরক্ষা বল সর্বদা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে এই পাহাড়ি কন্যার যত্নে।
সারাদিন সবুজঘেরা পাহাড়ের আলিঙ্গনে থেকে অবশেষে ঘরে ফেরা কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের পথ বেয়ে সমতলে নেমে আসা আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এর পরেও অনেকবার গিয়েছি কিন্তু সেই প্রথম দেখার স্মৃতি আজও মধু মিশ্রিত।
(ছবি- শৌভিক রায়)
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
অনিমেষ সরকার
ভ্রমন বিষয়টা শুনলেই মনটা ময়ুরের মত নাচতে শুরু করে দেয়৷ সেটা যেখানেই হোক না কেনো৷ বাড়ি থেকে কিছুটা দুরত্বে অথবা সুদূর বিদেশে ৷ মাঝে মধ্যে মন আর শরীরকে চাঙ্গা করতে ভ্রমনে যাওয়া সবচেয়ে ভালো ওষুধ৷ খুব বেশি পাহাড় দেখিনি তবে আমার গ্রাম থেকে কিছুটা দুরে অবস্থিত ভাঙ্গা পাহাড়ে গিয়েছিলাম ৷ কথায় আছে No one can replace the taste of tour. সুতারং অভিজ্ঞতাটা ভালো বইকি খুবই ভালো ৷ বাড়ি থেকে এই রাত তিনটে বেরিয়ে পরলাম , ভাঙ্গা পাহাড়কে দেখব বলে সকালের আলোয়৷ বাইকে করে দুজনে সোয়েটার চাপিয়ে মালবাজারে টুনবাড়ি মোর থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই আরও চারকিমি পথ, মাথ ঘাট জঙ্গল চাবাগানের গলি পেরিয়ে অবশেষে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে পৌছলাম৷
ভাঙ্গা পাহাড় কোনো একসময় উচু পাহাড় ছিল চা চাষ করতে গিয়ে কা ধাপ ধাপ করে কেটে পাহাড় সমতল সমান অবশেষ রয়েছে৷ পাঁচটায় দেখলাম সূর্যদয় অভুতপুর্ব আনন্দ হল৷ হিম করা বাতাস আর ওখানে একটা মন্দির আছে , সকাল থেকে গান বাজছে ভক্তি গীত মনে হচ্ছে তামিল ভাষার৷ গুরুজি তামিল ভাষী তা আগেই একবার বলেছিলেন ৷ মুহুর্তগুলোকে উপভোগ করতে করতে কখন যে সুর্য প্রখর হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি ৷ তবে একটা কথাই যাই বলুন দেশ বিদেশ যাই হোক ভ্রমন কিন্তু মানুষের রক্তে মিশে গেছে৷৷