Friday, October 3, 2025


 

মুনা 

অনলাইন আশ্বিন  সংখ্যা ১৪৩২

সম্পাদকের কথা

উমা ফিরে গেছেন। প্রতিবারই ফেরেন। নতুন নয় সেটি। কিন্তু তাঁর ফেরার সঙ্গে সঙ্গে যে বিষণ্ণতা গ্রাস করে আপামর বাঙালিকে, তার থেকে মুক্তি কোথায়? 

তাই মন উচাটন। নিজেদের শান্ত করার চেষ্টায় বেরিয়ে পড়ি আমরা কেউ `ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া`, কেউ বা আবার নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বহু দূরে। সেই টুকরো-টাকরা সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকা আমাদের অর্থাৎ আম-জনতার ছোট্ট ছোট্ট বেড়ানো নিয়েই মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩২। ছোট্ট প্রয়াস। তবে ইচ্ছে বিরাট।

সবশেষে শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা সবাইকে। মঙ্গল হোক সকলের। সমৃদ্ধি আসুক প্রত্যেকের।    



মুনা 

অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩২



রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি- দার্জিলিংয়ের পথে টয়ট্রেন 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


    এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা

চন্দ্রানী চৌধুরী, গৌতমেন্দু নন্দী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য,

অভিজিৎ সেন, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা বণিক, চিত্রা পাল, পিনাকী রঞ্জন পাল


অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩২



টিপু সুলতান সামার প্যালেস, ব্যাঙ্গালোর 

চন্দ্রানী চৌধুরী 


হাই টেক সিটি ব্যাঙ্গালোর মূলতঃ আই টি হাবের জন্যই বিশেষ ভাবে পরিচিত। তবে ব্যাঙ্গালোরের আরেকটি প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার ঐতিহাসিক স্থাপত্য যেগুলোর অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য কৃতিত্ব মনকে মোহিত করে তোলে। 

আজ গিয়েছিলাম দুটো জায়গায়। নিজেরা জায়গা গুলো খুঁজে বের করে করে যাচ্ছি। তাই একটু সময় হয়তো বেশি লাগছে। কিন্তু খুব ভালো করে ঘুরতে পেরেছি। কোনো তাড়া নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে আমরা ঘুরে বেড়িয়ে ধীরে সুস্থে ফিরেছি।






এখানকার স্থাপত্য গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বেঙ্গালুরু মেডিকেল কলেজের কাছে কৃষ্ণ রাজেন্দ্র মার্কেট মেট্রো স্টেশনের একদম কাছেই অবস্থিত 'টিপু সুলতানের সামার প্যালেস' বা "গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ"। আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে টিপু সুলতান সামার প্যালেসের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। 

এটি ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্যের এক অসাধারণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি গ্রীষ্মকালে মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের জন্য শীতল আরামদায়ক বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হত। টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর এই প্রাসাদটিকে ইংরেজরা তাদের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।






প্রাসাদের ইতিহাস 

টিপু সুলতানের সামার প্যালেসের ইতিহাস খুবই উল্লেখযোগ্য। টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলি ওয়াদিয়ারদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পর প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য বেঙ্গালুরু চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই ১৭৭৮  খ্রীষ্টাব্দে  তিনি বেঙ্গালুরু দুর্গের দেওয়ালের ভেতরে প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন।  কিন্তু প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হবার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
পরবর্তী কালে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে টিপু সুলতান এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন এবং এখানে রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম হত। আবার অনেকের মতে টিপু সুলতান এটিকে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

প্রাসাদের নির্মাণ কাজ 

প্রাসাদের চারপাশে একটি মনোরম বাগান রয়েছে। সামনের বিশাল লন পেরিয়ে আমরা মূল প্রাসাদে পৌঁছালাম।  প্রাসাদের সামনের অংশটি কর্নাটক সরকারের উদ্যান পালন বিভাগ রক্ষনাবেক্ষণ করে। 

দোতলা আয়তাকার প্রাসাদটি সম্পূর্ণ সেগুন কাঠের তৈরি। এটি একটি নীচু পাথরের প্ল্যাটফর্মের ওপরে নির্মিত প্রাসাদ। এখানে সুন্দর খিলান, স্তম্ভ, বারান্দায় খোদাই করা নানা ছবি রয়েছে যা সে যুগের স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। প্রাসাদের ছাদে ও দেয়ালগুলিতে কাঠের খোদাই করা সুন্দর ফুলের নকশা ঐতিহাসিক ঘটনা এবং যুদ্ধের ছবি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে।  তবে এখন সেগুলো অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপরের তলায়  পূর্ব ও পশ্চিম দিকে খোলা বারান্দা আছে যেখানে টিপু সুলতান দরবার পরিচালনা করতেন। নীচ তলায় চারটি ছোট ছোট ঘর সম্ভবতঃ সেগুলো মহিলাদের জন্য আর একটি বড় হলঘর রয়েছে। রয়েছে বিশাল সিঁড়ি যা মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের বিশেষ নিদর্শন। প্রাসাদে মোট ১৬০ টি কক্ষ রয়েছে। 





এখানে টিপু সুলতানের তৈরি একটি বিশাল সিংহাসনের ছবি রয়েছে। সোনার চাদর ও  মূল্যবান পান্নায় মোড়া এই সিংহাসন রাজা টিপু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেই  ব্যবহার করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর, ইংরেজরা সিংহাসনটি ভেঙে ফেলে এবং এর অংশগুলি নিলামে বিক্রি করে। এই প্রাসাদটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে টিপু সুলতানের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। 

জাদুঘর 

সামার প্যালেসে নীচতলায় একটি জাদুঘর আছে যেখানে টিপু সুলতান হায়দার আলি এবং তার পরিবারের ব্যবহৃত পোশাক, মুদ্রা, অস্ত্র, রূপার পাত্র, মুকুট রয়েছে। এছাড়াও আছে দুশো বছরের পুরোনো তৈলচিত্র, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের 
চিত্র যা টিপু সুলতানের রাজকীয় জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। রাজাকে দেওয়া বিভিন্ন উপহার সামগ্রী ও সেখানে রাখা হয়েছে। এখানে রাখা ফ্রেস্কো গুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে টিপু সুলতান এবং হায়দার আলির  যুদ্ধের বর্ননা দেয়। টিপু সুলতানের ডিজাইন করা একটি বাদ্যযন্ত্র আছে । এটাতে বাঘের নাম লেখা আছে যা একজন ব্রিটিশ সৈন্য কে হত্যা করে। এটাতে ফুঁ দিলে বাঘের গর্জন আর ইংরেজ সৈন্যর কাতর কন্ঠস্বর ভেসে আসে।  অবশ্য এখানে অরিজিনাল বাদ্যযন্ত্র টি নেই। অরিজিনাল বাদ্যযন্ত্র টি লন্ডনের জাদুঘরে রাখা আছে। 






কিভাবে যাবেন 

ভারতের যেকোনো জায়গা থেকে রেল সড়ক বা আকাশ পথে ব্যাঙ্গালোরে যাওয়া সম্ভব। সামার প্যালেসে যেতে অটো, বাস বা ক্যাব ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি  কৃষ্ণ রাজেন্দ্র মার্কেট মেট্রো স্টেশনের একদম কাছেই অবস্থিত।

সামার প্যালেস কখন খোলা থাকে

সামার প্যালেস সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে। সকাল ৮.৩০ থেকে বিকাল ৫.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে।

সামার প্যালেসের প্রবেশমূল্য 

সামার প্যালেসের ভেতরে যাবার জন্য টিকিটের দাম ২০ টাকা ( জনপ্রতি)। ওখানে পৌঁছে  অনলাইনে টিকিট কাটা যাবে জানতে পেরে আমরা অনলাইনে টিকিট কেটে নিয়েছিলাম।


(ছবি- লেখক)



বাঁকুড়া থেকে সড়কপথে কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটী
গৌতমেন্দু নন্দী

বাঁকুড়ার জয়পুরের ঘন জঙ্গলের বুক চিরে বিষ্ণুপুরকে পাশে রেখে সড়কপথে বাঁকুড়া থেকে দুই ঘন্টায় প্রায় ৮৫ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুর----গোটা বিশ্বের কাছে যে স্থানের পরিচিতি রামকৃষ্ণের পূণ্য জন্মস্থানের জন্য।  

 এখানে এসে চারপাশের ঘন সন্নিবেশিত হোটেল, দোকান আর বহিরাগত জনসমাগম দেখে বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না এই পবিত্র ভূমির মাহাত্ম্য সম্পর্কে। রাস্তার দুই পাশে দোকানগুলোতে  রামকৃষ্ণ ও সারদামণির অসংখ্য বিক্রয়যোগ্য ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলোই বলে দেয়  এই পবিত্র জনপদের গুরুত্ব ও
মাহাত্ম্য।  হুগলি জেলার অন্তর্গত শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মভূমি এই কামারপুকুরের আগে নাম ছিল "সুখলালগঞ্জ"। গ্রামের আদি জমিদার সুখলাল গোস্বামীর নামেই এই নাম। 




           
কথিত আছে মানিকরাজা গড়মান্দারন এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত কয়েকটি ঘর কর্মকারকে একসময় এখানে এনে বসতি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ঐ কামাররা মানিকরাজার অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত। আগ্নেয়াস্ত্র প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে কামারদের কাজ কমে যাওয়ায় রাজা তখন তাদের কাজ দিয়ে বনজঙ্গল কেটে একটি পুকুর খনন করান এবং বসতি স্থাপন করেন। সেই "কামারদের পুষ্করিনী" নাম থেকে কালে কালে সেই গ্রামের নাম হয়ে যায়  "কামারপুকুর"।

         ১৯৩৬-১৮৫৩ পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর রামকৃষ্ণ এখানে ছিলেন। এর পরেও বহুবার তিনি দক্ষিণেশ্বর 
থেকে কামারপুকুরে আসেন। রামকৃষ্ণ কথামৃতকার "শ্রীম" যখন এখানে আসেন সেই স্মৃতি তাঁর মণিকোঠায় চিরোজ্জ্বল ছিল------তাঁর উপলব্ধি  ছিল " আমি যখন প্রথম কামারপুকুরে আসি তখন এখানকার সমস্ত লোককে ঠাকুরের কথা জিজ্ঞেস করেছি, তাঁদের সকলকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে হতো কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ঠাকুরকে দর্শন ও স্পর্শ করেছেন....."





           গোপেশ্বর শিবমন্দিরের কাছে " কামারপুকুর " নামক সেই পুকুরটিকে চাক্ষুষ করতেই  এক অন্যরকম অনুভূতি টের পেলাম। মঠ প্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বারে স্থাপিত হয়েছে বিবেক তোরণ। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা গেল আম্র বৃক্ষ, তাঁতী পুকুর,খাঁ পুকুর,রঘুবীর মন্দির। মঠের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে যাত্রী নিবাস, গ্রন্থাগার, রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, হোটেল,লজ সহ অসংখ্য দোকান পাট, স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি।

        এখানে এসে শুনলাম ধর্মদাস লাহার নাম। হুগলি জেলার পশ্চিমাংশে কামারপুকুরের জমিদার ছিলেন তিনি। যিনি লাহাবাবু নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আর এক জমিদার সুখলাল গোস্বামীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ধর্মদাস লাহা ও সুখলাল গোস্বামীর ঐকান্তিক ইচ্ছে ও চেষ্টায় ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় সপরিবারে দেরিয়াপুর থেকে কামারপুকুর চলে আসেন এবং বসবাস করতে শুরু করেন। বালক গদাধর এই লাহা বাবুদের দুর্গাপ্রতিমার চোখ এঁকেছিলেন। লাহা বাবুদের বংশধরেরা  কয়েক ঘর নিয়ে আজও কামারপুকুরে বসবাস করছেন। তাঁদের কয়েকজনের সাথে কথাও  হল। এখানে রামকৃষ্ণের হাতের লেখা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।





কামারপুকুর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে আরও এক পূণ্যভূমি -----জয়রামবাটী। হুগলি জেলার কামারপুকুর এবং বাঁকুড়া জেলার  জয়রামবাটী যেন দুই জেলার সীমানা নির্ধারণ করে চলেছে।
         "যে গ্রামে জন্মিলা মাতাদেবী  ঠাকুরানী
          পূণ্যময়ী লীলা-তীর্থ নামে তারে গণি।
          শ্রী প্রভুর পদরেণু বিকীর্ণ যেখানে 
           বিধাতার সুদুর্লভ তপস্যা সাধনে...."
    
"জয়রামবাটী "---এই নামটিও  কামারপুকুরের মতো বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। শ্রী শ্রী মা সারদামণীর পূণ্য পাদস্পর্শে এই ছোট্ট  জনপদটিও আজ বিশ্বের কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ  তীর্থভূমিতে পরিণত। স্বয়ং মা সারদামণী এখানকার  ভূমির ধূলি নিজ মস্তকে ধারণ করে বলেছিলেন ---
  " জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী।"
        এখানে এসে তার প্রমাণ স্বরূপ দেখলাম দুই একজন বিদেশী মেমসাহেব মাটিতে বসে ভক্তির সঙ্গে মা এর প্রসাদ গ্রহণ করছেন।

         মূল প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ডানদিকে চোখে পড়ল সারদা মণির একসময়ের খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির সেই ঘর।  এর আগে  ছবিতে দেখা সেই পরিচিত ঘরটির পাশ দিয়েই  লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে শ্রী শ্রী মাতৃ মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। চারপাশে মনোরম সবুজ উদ্যানের মধ্যে  অবস্থিত সারদামণীর শ্বেত পাথরের মূর্তি সহ শ্বেত পাথরের মন্দিরটির ভেতরে প্রবেশ করতেই এক অব্যক্ত আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম শরীর ও মনে। 
 
      ১৮৫৩-১৮৫৯ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর জয়রামবাটীতে ছিলেন শ্রী শ্রী মা সারদা দেবী। এই জয়রামবাটীতে শ্রী রামকৃষ্ণ ও তাঁর পার্ষদরা সহ শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর বহু সন্ন্যাসী গৃহী সন্তানেরাও বহুবার এসেছেন। শ্রী রামকৃষ্ণ-ভক্ত গিরীশ চন্দ্র ঘোষ পুত্রশোকের আঘাত সামলাতে কিছু দিন জয়রামবাটীত মাতৃভবনে বাস করেছিলেন। 



একই সঙ্গে উচ্চারিত "কামারপুকুর--জয়রামবাটী" গোটা বিশ্বের কাছে আজও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উত্তরণের পীঠস্থান। বলা হয় "কামারপুকুর " ও "জয়রামবাটী"---এই দুটি জনপদ যেন "পুরুষ" ও "প্রকৃতি"। 

       কামারপুকুরে শ্রী রামকৃষ্ণের আবির্ভাবের সঙ্গে  যেমন "সত্যযুগ"এর সূচনা, তেমনি জয়রামবাটীতে  শ্রী শ্রী সারদা মায়ের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন এক "মাতৃযুগ" শুরু। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষ  এখানে ছুটে ছুটে আসেন। সেই টানেই এই দুই  পুণ্যভূমিতে আমারও ছুটে যাওয়া।


 

রিঞ্চেংপঙ 

শ্রাবণী সেনগুপ্ত

সে এক রূপকথার দেশ। এই জায়গাটির সন্ধান পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই। সেবার পুজোর ছুটিতে কোথায় যাব ভাবছি,আমাদের দুইজনের এই ছুটিটাতেই একসাথে বেড়াতে যাবার একমাত্র সুযোগ থাকে। আমার এক কলিগ তখন এই জায়গাটির কথা জানাল, সে শুনেছে তার এক বন্ধুর থেকে। নেট ঘেঁটে একটু দেখে নিলাম,জায়গাটি অবস্থিত পশ্চিম সিকিমে,গ্যাংটক থেকে প্রায় ১২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে,গিয়ালসিং থেকে ৮৯কিলোমিটার দক্ষিণে, নিকটবর্তী গ্রাম কালুক। বেশ,তো চল পানসি রিঞ্চেংপং। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিমানের টিকিট কাটা হল।তার আগে অবশ্যই কলিগের দেওয়া হোমস্টের মালিকের ফোন নম্বর এ ফোন করে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে নেওয়া হল।উনি বললেন যে, হোমস্টে থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন,ড্রাইভারের নাম সন্তু। যথা সময়ে বিমান নামল বাগডোগরা। সন্তুর গাড়িতে রওনা হলাম হোমস্টের উদ্দ্যেশে। রাস্তা সরানোর কাজ চলছিল জায়গায় জায়গায়।রাত্রি হয়ে আসছিল।জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাস্তা,দেখা পেলাম এক বুনো বেড়ালের। অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে সন্তু আমাদের পৌঁছে দিল রাত নয়টার সময়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা,হবেই ৫৫৭৬ফিট উচ্চতায়। হোমস্টের  ঘরে ঢুকেই পেয়ে গেলাম গরম খাবার,জল,সব। হোমস্টের মালিক এসে দেখা করে গেলেন।
         



পরেরদিন সকালে - 'সারপ্রাইজ,সারপ্রাইজ' তখন ঊষাকাল (ভোর ৪টে)। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক, "সামনের জানলাটা খুলে দিন তাড়াতাড়ি" ওই ভোরে কম্বলের তলা থেকে একটু বিরক্তি নিয়েই উঠলাম, তবে জানলা খুলতেই সব অসন্তুষ্টি চলে গেল। 'আহা কি দেখিলাম! '- শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা একদম  ঘরের দুয়ারে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়লে সোনার বরণ ধারণ করল সে। এরপর গেলাম ওই হোমস্টের রুফ টপে। ঐখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ স্পষ্ট দেখা যায়। চা, ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আলাপ হল মালিক আর মালকিনের সঙ্গে। অল্পবয়সী ছেলেটির ফোনে আমার কর্তার গলার আওয়াজ শুনেই এতো ভাল লেগেছিল যে সে নিজেদের বাসস্থানেই  আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। ওদের অন্য হোটেলে নয়।আলাপ হয়ে গেল ওদের সঙ্গে। সেখানেও লুকিয়ে রয়েছে এক গল্প। ওরা দুইজনে আদতে কলকাতার বাসিন্দা। হানিমুনে এখানে এসে পূর্ণিমার রাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে এতো ভাল লেগে যায়, তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেলে যে , সব কিছু থেকে দূরে  এখানে এসে থাকবে। তারপর এখানে এইবাড়িটিতে নিজেরা থেকে হোমস্টে হিসেবে শুরু করে তখন তারা গোটা দুয়েক হোটেলের মালিক। সত্যিই, এইখানে এলে মনে হয়  যেন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছি। হোমস্টেটির  সামনেই প্রসারিত মাঠ, তার একপাশে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি বৌদ্ধ মন্দির। এই বৌদ্ধমূর্তি তান্ত্রিক মতে নির্মিত। তার পাশে  রয়েছে শিক্ষকদের বাসস্থান।বেলার দিকে একটু উপর থেকে সারিবদ্ধভাবে নেমে এলো ক্ষুদে ছাত্রের দল। তারা মন্দির গৃহে শিক্ষক এবং অপেক্ষাকৃত বড়ো ছাএদের তত্বাবধানে দুই পঙক্তিতে বসে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করার সময় আমাদের সেখানে দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আবার দাদাদের ইশারায় পাঠে মনোনিবেশ করছিল। এই জায়গাটির বিশেষত্ব সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, নিস্তব্ধতা। একটি গাছে ঘেরা জলাশয় আছে (তখন একমাত্র পানীয় জলের উৎস) যেটিতে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের  সময় স্থানীয় আদিবাসীরা  বিষাক্ত ভেষজ দিয়ে সেটির জল পান করার অযোগ্য করে দেয়।এরফলে অর্ধেকের বেশী ব্রিটিশ সেনা মারা যায়। বৃটিশবাহিনী একটি চুক্তি করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এইটির জল এখনো বিষাক্ত। এটি বিখ পোখরি (বিষাক্ত হ্রদ) নামে পরিচিত। কিছুটা দূরে স্থানীয় বাজারে হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম, চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু বুনো গন্ধ, ঝিঁঝির ডাক। আমাদের পথ চলার সঙ্গী হয়েছিল এক লোমশ কুকুর।




এই ভ্রমণের বড়ো পাওনা সবসময় চোখের সামনে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গের দৃশ্যমানতা। দেবানুর (মালিক) মতে এইরকম প্রতিটা শৃঙ্গ প্রধানত দেখা যায় শীতকালে ,পরিষ্কার আকাশে,আমরা যখন গিয়েছিলাম সেই সময় প্রতিদিন এমন দৃশ্যমানতা থাকার কথা নয়। ও আরো বলল যে,স্থানীয় অধিবাসীদের মতে ভাল মানুষদের কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবসময় ধরা দেয়।জানিনা, আমরা মানুষ হিসেবে কতটা ভাল, তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু কখনোই আমাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করেনি। তবে এইখান থেকে এতো স্পষ্টভাবে এই পর্বতশৃঙ্গের প্রতিটি চূড়াকে এতো ভালভাবে আর কোথাও দেখিনি। মনে পড়ে, ফিরবার আগের দিন ওদের বালক পুত্রকে পড়াচ্ছিলাম ভঙ্গিল পর্বত,হিমালয়কে সাক্ষী রেখে। সেইদিন রাতে সবাই একসঙ্গে দেশী মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়েছিলাম ওই ঠান্ডায় চোখের সামনে ভঙ্গিল পর্বতের সারি দেখতে দেখতে। এ অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভুলবার নয়।ওখানকার খাবার সব অর্গানিক, দুধের পুরু সর, ভেজালের নাম নেই। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল ওদের সঙ্গে।রাতে রুফ টপে বসত জমাটি আড্ডা, সঙ্গী অবশ্যই রুমহিটার। ফেরার দিন নন্দিনী দিয়ে দিয়েছিল ওদের হাতে বানানো আচার,আর খাঁটি ঘি।উভয় পক্ষের চোখে জল ছিল,ওরা প্রণাম করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল আমাদের। এয়ারপোর্ট এ পৌঁছলাম সন্তুর গাড়িতেই। নামতেই আবার ফোন ঠিকমতন সময় পৌঁছেছি কিনা জানতে, আবার কলকাতায় ফিরে ফোন। এইসব ভালবাসা অমূল্য। কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া দুঃখ  হেরে যায় এইসব নিঃস্বার্থ ভালবাসার কাছে।



(ছবি- সংগৃহিত)             



 বিজনবাড়ির বিজনে

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য 


দার্জিলিঙ পাহাড়ের ঘুম থেকে যে রাস্তাটা উঠে গেছে সান্দাকফুর দিকে, তারই পথে অনেকটা এগিয়ে তবে দেখা পাওয়া যায় নিরিবিলি শান্ত পাহাড়ি গ্রাম বিজনবাড়ির। বছরের গোড়ার দিকে এই বিজনবাড়ির রেলিংয়ের পোখরেল পরিবারের বিবাহ অনুষ্ঠানে ছিল আমাদের সপরিবার নিমন্ত্রণ। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মোট দিন তিনেক ছিলাম বিজনবাড়িতে। বিজনবাড়ির ভেতরে রেলিং অঞ্চলের দিকটা যতটা নিরিবিলি আর কোলাহলহীন, মূল বিজনবাড়ি বাজার এলাকা ও শহুরে অংশটুকু আবার তুলনায় যথেষ্টই ঘিঞ্জি, এবং উন্নতও। অতটা ওপরে হওয়ার পরেও রাজ্য সরকারি বোর্ডের ভাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে রেলিং গ্রামে। তবে নামে গ্রাম হলেও আদতে কিন্তু এই গোটা রেলিং এলাকাই বেশ পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম ও সাধারণ বসবাসের উপযোগী সবরকম পরিষেবাযুক্ত। ক’বছর আগে গোটা পাহাড় এলাকার মধ্যে আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল বিজনবাড়ির রেলিং গ্রাম। তবে জায়গাটা নৈসর্গিক দিক দিয়ে এতটা স্বর্গীয় সুন্দর হলেও ঘুমের পর থেকে বিজনবাড়ি পৌঁছনোর রাস্তার অবস্থা ভীষণই ভয়াবহ। গোটা রাস্তাটাই অজস্র ছোট বড় খানাখন্দ আর ভয়ানক ভাঙাচোরা পথের কোনও কোনও জায়গায় আবার এই সময় মানে মার্চের মাঝামাঝি রাস্তার কাজ চলার জন্য গাড়িতে যাতায়াত করাই দুষ্কর। এখানকার নিয়মিত গাড়ি চালকদের কাছেই এ রাস্তার নাম এখন ‘ডান্সিং রোড’ অথবা ‘হজমলা রোড’, অর্থাৎ এ রাস্তায় কিছুক্ষণ চললেই পেটের যাবতীয় খাবার সম্পূর্ণ হজম হয়ে যেতে বাধ্য! আমি বাইরে গেলে ইচ্ছে করেই সাধারণ বাস বা শেয়ারের গাড়িতেই যাতায়াত করি, কারণ তাতে ওই পথের নিয়মিত যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষজনের সাথে আলাপের সুযোগ ঘটে যায় অনায়াসে, তাদের গল্প জানা যায় সহজে। কিন্তু এই ব্যক্তিগত পছন্দটুকু সরিয়ে রেখেও বলব অন্তত এই বিজনবাড়ির পথে নিজের শারীরিক নিরাপত্তা এবং মানসিক শান্তির খাতিরে নিজস্ব গাড়ি নয়, বরং পাহাড়ের দক্ষ গাড়ি চালক যারা কিনা এ রাস্তায় নিয়মিত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করছে তাদের সঙ্গে শেয়ার গাড়িতে যাওয়াই মঙ্গলজনক। তাতে পথের দুর্গমতা ও অসংখ্য চোরা বাঁক সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থেকে পথের স্বর্গীয় সৌন্দর্যটি পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। বিজনবাড়ি এখনও স্পট হিসেবে যথেষ্ট আনকোড়া এবং দুর্গম এবং বিজনবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটিও ভারী সুন্দর। এত ঘন সবুজে মোড়া পাহাড়ি রাস্তা দার্জিলিঙ পাহাড়ে খুব কমই আছে। এ রাস্তা তাই চোখে আরাম দেয়, মন দেয় ভিজিয়ে। শুধু এই প্রাণের আরামটুকুর জন্যেই বোধহয় হাজারো অসুবিধে সত্ত্বেও বার বার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে ছোট্ট শান্ত কোলাহলহীন এই পাহাড়ি জনপদটিতে।



বিজনবাড়িতে তিনটে দিন আমরা ছিলাম সাশিং ভ্যালি হোমস্টেতে। এই হোমস্টেটি গাড়ি চলাচলের রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উৎরাই নেমে গিয়ে প্রশস্ত খোলামেলা অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। হোমস্টের চারদিক সবুজ আচ্ছাদিত পাহাড়ে ঘেরা। এখানে থাকার দোতলা কটেজগুলো একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা গ্রাউন্ড জুড়ে সুন্দর করে বানানো। মাঝের খোলা অংশে আছে সুইমিং পুল, তার ওপারে ব্যাডমিন্টন খেলার বড় গ্রাউন্ড এবং আয়েস করে বসে রোদ পোহানো ও দূরের সবুজে মোড়া দিগন্তবিস্তৃত ঢেউখেলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য মাঠের মধ্যেই চেয়ার টেবিলওলা সুব্যবস্থা। বামদিকে ছড়ানো অনেকখানি অংশ জুড়ে হোমস্টেরই বিশাল ফার্ম। নিয়মিত দুধের জোগানের জন্য গরু মহিষ থেকে শুরু করে ছাগল মুরগি সবই আছে। এছাড়া অর্গ্যানিক ফল সব্জিরও ঢালাও চাষ হচ্ছে হোমস্টের ঘেরা এলাকার মধ্যেই। এর মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি আর পেঁপে গাছের ফলন তো আমরা নিজের চোখেই দেখলাম। এমনকি সকালের কাঠকয়লার আঁচে মাটির উনুনে সেঁকা মোটা মোটা রুটির সাথে রাই শাকের যে সব্জি হত প্রতিদিন তাও এদের খেতেরই। তবে মাটির উনুনের পাশাপাশি আজকাল গ্যাসের ব্যবহারও হয় ব্যস্ততার জন্য।



হোমস্টেতে থাকাকালীন প্রতিদিন সকালে আমাদের কাজ ছিল সকালের চা পান শেষে নীচের উৎরাই ধরে একটু হেঁটে আসা। হোমস্টের ছোট্ট কাঠের গেট ঠেলে বেড়োতেই ডানদিকে সোজা ওপরে উঠে গেছে গাড়িতে করে মূল রেলিং গ্রামে যাবার রাস্তা আর বামে এঁকেবেঁকে পায়ে হাঁটা পাহাড়ি মেঠো পথে নামতে নামতে প্রায় কিলোমিটার দুয়েক গেলেই কুলকুল শব্দে সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট রঙ্গিত। এই রঙ্গিত নদীর রিনরিনে জলের শব্দ সারারাত হোমস্টের বন্ধ ঘরের ভেতর থেকেও শোনা যায়। আমরা সাধারণত এই উৎরাই পথে নেমে আবার ডাইনে বেঁকে একেবারে নীচে গিয়ে ডানদিকে খেলার মাঠ ছাড়িয়ে পাশের নদীতে আর যেতাম না কারণ রঙ্গিতকে আমরা আরও ভাল করে দেখতে পেয়েছিলাম কনেবাড়ির রিসেপশনের দিন ওদের পারিবারিক রেলিং রঙ্গিত রিসর্ট থেকেই। আমাদের সকালের চা হাতে তাই রোজকার গন্তব্য ছিল হোমস্টের নীচের অংশের খোলা চাতাল মতো জায়গাটি যার ঠিক নীচ থেকে ধাপে ধাপে পাহাড়ের ঢেউখেলানো ঢাল বেয়ে নেমে গেছে ঝুমচাষের খেত। এই সময় অবশ্য খেতে ফসল ছিল না। বরং পোড়া খেতের ধাপে ধাপে গজিয়েছিল ঝাঁক ঝাঁক বেগনে রঙের খুদে খুদে পাহাড়ি ফুল। এই নাম না জানা অকিঞ্চিৎকর ছোট্ট বেগুনী, সাদা আর হলদে ফুলের ঝাড় আমাদের আসা যাওয়ার পাহাড়ি পথের ধার ঘেঁষেও ফুটে থাকতে দেখেছি অজস্র।



একটা আশ্চর্য জিনিস এখানে এসে প্রতি মুহূর্তেই ভীষণরকম অনুভব করলাম যে, শহুরে জনবসতির চাপ থেকে অনেক অনেক দূরের এই পাহাড়ি গ্রামে প্রকৃতির রূপে কোথাও এক বিন্দু কৃত্রিমতা নেই। পুরোটাই এখানে বড় আগোছালো ধরনের স্বাভাবিক, স্বকীয়, নিজস্ব, ঠিক যেমন এখানকার নির্বিবাদী সদাহাস্যময় মানুষগুলো। এই অঞ্চলের মনখোলা পাহাড়ি মানুষজনের আশ্চর্য স্বাভাবিক আত্মীয়তা আমাদের শহুরে চোখে কখনও এতটাই বিস্ময়ের উদ্রেক করে যে থেকে থেকেই একটা অস্বস্তিকর কুণ্ঠা বোধ হয় এই ভেবে যে, এতটা সরল দরাজ আবেগ আজও এভাবে টিকে আছে কী করে? আর এত সহজ বিশ্বাসভরা ভালবাসা পাওয়ার আমরাই কি আজ আদৌ যোগ্য! বিজনবাড়ির প্রকৃতি, মানুষজন তাদের সবটুকু উদারতা নিয়ে তাই শেষমেষ মনের মধ্যেটায় রয়ে গেল বড় আপন হয়ে, এবং, আবারও খুব তাড়াতাড়ি এই পাহাড়ি স্বর্গলোকে ফিরে আসার নিজের সাথেই নিজের করে ফেলা এক একান্ত গোপন অঙ্গীকার নিয়েও।



বিজনবাড়ির পোখরেল পরিবার পাহাড়ের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক জায়গার পাশাপাশি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের নিজস্ব ভাষার পরিসরে রেখে চলেছেন যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য অবদান। এবং এই যৌথ পরিবারটির অভিভাবকসম সদস্য শ্রদ্ধেয় শ্রী নরহরি পোখরেল মহাশয়ের সাথে ফিরে আসার দিন বসে অনেকটা সময় একান্তে কাটানোর যখন সুযোগ হল, বিজনবাড়ির ইতিহাস নিয়ে, তাঁর জীবন ও পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কথা হল বিস্তারে। এমনকি আলোচনা শেষে তাঁর গোর্খা অর্থাৎ নেপালি ভাষায় লিখিত সময় বা যুগের কালচক্র নিয়ে প্রকাশিত অধ্যাত্মবাদ বিষয়ক বই ‘ফনকো’ এবং বিজনবাড়ির পুরনো ইতিহাস নিয়ে লিখিত সত্য সাঁই সেবা সমিতি থেকে প্রকাশিত বহুল তথ্যসমৃদ্ধ ‘সংক্ষিপ্ত ইতিহাস‘ বইদুটি উপহারও দিলেন তিনি স্নেহভরে। পোখরেলদের যৌথ বাড়ির পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে বিজনবাড়ির একমাত্র নিত্যপুজোর যে শিবমন্দিরটি আছে, যেখানে পুজোর পত্তন হয় সেই ১৭৩০ সাল থেকে, বর্তমান সেই মন্দিরটি স্থাপিত হয় তাঁরই উদ্যোগে। আসলে কোনও জায়গাই তো শুধু তার ইঁট কাঠ পাথর আর প্রকৃতি নিয়ে নয়, সে জায়গাগুলো বেঁচে থাকে আসলে সেখানকার মানুষগুলোর দৈনন্দিনের অস্তিত্বে, তাদের একান্ত অনুভবে, তাদের প্রতি মুহূর্তের যাপনে। এই সব টুকরো টুকরো অনুভবের গল্প জুড়েই আমার বিজনবাড়ির স্মৃতি। আজও ফিরে দেখলে বুঝতে পারি, এই টুকরো টুকরো আলোছায়ামাখা স্মৃতিগুলোই যাত্রা শেষে আমার একমাত্র প্রাপ্তিও বটে যা কিনা নিঃসন্দেহে এ মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল




(ছবি- লেখক)



 

সামার ক্যাম্প

অভিজিৎ সেন               

                    

মুহূর্তও অনন্ত হয়ে ওঠে, সীমানাও অসীমকে ছুঁয়ে যায়, যাপিত সময় হয়ে ওঠে জীবনের রসদ, সৌন্দর্য কী করে আকর্ষণের কেন্দ্রবস্তু হয়ে ওঠে জয়ন্তীতে তিনদিনের "সামার ক্যাম্পে" না এলে বুঝতেই পারতাম না কখনো। কোচবিহার থেকে খুব বেশি দূরে নয় কাছেই জয়ন্তী পাহাড়,মাত্র ঘন্টা দুয়েকের পথ। সড়কপথে সহজেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়,আছে রেলস্টেশনও । সেখানের অতিবাহিত করা প্রতিটি মুহূর্ত কতটা রোমহর্ষক,আনন্দদায়ক এবং গতিশীল ছিল শব্দ চিত্রে সেই অনুভূতি ব্যক্ত করা বেশ কঠিন । চিত্রনাট্যের মতো তিন দিনের অনুভূতি এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি পূর্বে পায়নি। ২০২৫ এর জুন মাসের তিন থেকে পাঁচ তারিখ,এই তিন দিন তিন রাত আমাদের কাটাতে হয়েছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর অনুশীলনের এবং নিয়মানুবর্তিতার মধ্যদিয়ে । আমরা এখানে শুধু বেড়াতে আসিনি অন্য একটি উদ্দেশ্যে এসেছি। সকাল থেকেই বেশ গরম পড়েছে । নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট স্থানে আমরা জমায়েত হলাম। এরপর অভিভাবক সহ একশত জনের একটি দল নিয়ে ছুটে চললো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস গাড়িটি। তিনদিনের ঘোরার পাশাপাশি জয়ন্তীতে ক্যারাটের অনুশীলন এবং পরীক্ষা হবে, তাতেই অংশ নিতে এসেছি আমরা। কিছু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা এসেছে ব্যারাকপুর থেকে, আবার কেউ উত্তরপ্রদেশ থেকে। ব্যারাকপুর থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন রাশিয়ান শিক্ষার্থী ছিল। বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত নানা বয়সের শিক্ষার্থী এবং তাদের শিক্ষকগণ এসেছেন, নিজেদের দীর্ঘ দিনের ক্যারাটের অভিজ্ঞতাকে উপস্থিত করতে। অভিভাবকরা শুধু বেড়াতে যাচ্ছেন না, তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলেছেন কারণ এই ক্যাম্পটির মূল উদ্দেশ্য বাৎসরিক ক্যারাটে পরীক্ষা। সকল শিক্ষার্থী এখানে অংশ নিয়েছে, তবে পরীক্ষা দিয়েছে তারাই যারা‌ আগ্ৰহী এবং সানসি বা শিক্ষক যাদের উপযুক্ত মনে করেছেন । আমি তার মধ্যে একজন। মাত্র ২৫ জন আমাদের ডোজো থেকে সুযোগ পেয়েছি। এইভাবে বিভিন্ন ডোজো থেকে যারা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে তাদের সংখ্যা একশোর বেশি । এখানে ৫ থেকে শুরু করে ৫০ বছর বয়সি ছাত্রও আছে । 




ক্যারাটের পরীক্ষাকে বলা হয় 'গ্রেডেশন'। অর্থাৎ নতুন বেল্ট পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষকদের সামনে। আমি নিজে একজন ছাত্র। আমি পরীক্ষা দিতেই জয়ন্তীতে "সামার ক্যাম্পে" যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে যোগ দিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আমার অবশিষ্ট জীবনের চলার পথে আলো দেখিয়ে যাবে। "Discipline and Dedication" এই দুটি শব্দ ক্যারাটের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যাই হোক আমরা যাত্রা শুরু করলাম আমাদের কোচবিহারের খাগড়াবাড়িতে অবস্থিত বীণাপানি ক্লাব ডোজো থেকে। ডোজো অর্থাৎ যে স্থানে প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়। এটাকে ক্যারাটে অনুশীলনের বিদ্যালয় বলা যেতে পারে। যেখানে সানসি অর্থাৎ শিক্ষক আমাদের ক্যারাটে অর্থাৎ খালি হাতে আত্মরক্ষার নানা কৌশল শিখিয়ে থাকেন । পাশাপাশি আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিও কিভাবে বৃদ্ধি পাবে তারও অনুশীলন করান । বিভিন্ন যোগব্যায়াম, দাচি (স্ট্যাঞ্চ) ঝুঁকি(পাঞ্চ),উঁকি (ব্লক) গিরি(কিক) ফাইট ও কাতা( ফর্ম বা প্যাটার্ন) অর্থাৎ পাঞ্চ, কিক, গিরি এবং ব্লকের সম্মিলিত রূপ । যেখানে কাল্পনিকভাবে আমাদের ধরে নিতে হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করছি, "কাতা" ক্যারাটের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের ক্যারাটের স্টাইলের নাম 'kyokushin' means"The ultimate truth" । ক্যারাটের জন্মদাতা হলেন Gichin Funakoshi এবং Kyokushin ক্যারাটের প্রতিষ্ঠাতা হলেন Sosai Masutatsu Oyama । প্রতিদিন নিয়ম করে তিন থেকে চার ঘণ্টা অনুশীলন করলে তবেই ক্যারাটির মতো সুন্দর ও বলিষ্ঠ শিল্পটির কিছুটা আয়ত্ত করা সম্ভব। ক্যারাটে নিজেকে,অন্যকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ক্যারাটে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সুগঠিত বলবান,শৃঙ্খলা পরায়ণ, প্রগতিশীল সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব । ক্যারাটে প্রশিক্ষিতরা কর্ম জীবনের সকল ক্ষেত্রেই যথেষ্ট সহিষ্ণু, পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, সাহসী ও সৎ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে থাকে। বিপথে পরিচালিত যুবসমাজকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম এই শিল্পকলাটি । যা সুন্দর সমাজ গঠনের একটি অন্যতম শর্ত। বছরে একবার "সামার ক্যাম্প" হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির মূল্যায়নের জন্য। এমন একটি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে আমরা চলেছি, গাড়ি চলেছে ছুটে কোচবিহারের খাগড়াবাড়ি হয়ে সোজা উত্তরে আলিপুরের দিকে । পথে জায়গায় জায়গায় অন্যান্য শিক্ষার্থীদের এবং অভিভাবকদের গাড়িতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। অভিভাবকের কাছে একই সাথে এটা একটি শিক্ষনীয় এবং দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের পরম সুযোগ। তাই তাদের উৎসাহ দেখে সত্যি বিস্মিত না হয়ে পারছিলাম না। গাড়ি বানেশ্বর এসে পৌঁছালে ড্রাইভার আচমকা ব্রেক করে থামিয়ে দিল। যাত্রীরা হইচই শুরু করলে ড্রাইভার বলে,'সামনে দেখুন দলবেঁধে মোহনেরা রাস্তা পার হচ্ছে' সত্যি এটা কখনো দেখিনি। শুনেছি অনেক। এমনকি রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে লেখা আছে। "এখানে গাড়ি ধীরে চালান"। তার কারণ মোহনেরা বা কচ্ছপেরা এভাবেই যাতায়াত করে। একটু একটু করে উত্তরের পাহাড়ি সবুজ অরণ্যের কোমল ছোঁয়া আমাকে অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। অদ্ভুত এক আবেশের মধ্যে আমি ধীরে ধীরে হারিয়ে চলেছি । গাড়ির জানালা দিয়ে প্রকৃতির অনাবিল অখন্ড সৌন্দর্যের প্রাণরস নিজের শ্বাসবায়ুর মধ্যে যতটা সম্ভব পূর্ণ করে নিচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে রাস্তার দু'ধারে বৃক্ষের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘন সবুজ অজস্র পত্ররাশি পথের দু'ধারে অদ্ভুত এক মায়াঞ্জন রচনা করে রেখেছে । তার উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ। দূর থেকে মেঘের রাজ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। ঘন নীল পাহাড়। সেই পাহাড়ের টানেই আমরা ছুটে চলেছি। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম কালজানি নদীর সেঁতুর কাছে । গাড়িটা এখানে এসে দাঁড়ালো। মিনিট পাঁচেক। 






আমি গাড়ি থেকে নেমে এলাম। কালজানি নদীর নির্মল শান্ত জলপ্রবাহ সুদূর থেকে শান্ত গতিতে রহস্যে মোরা মোহনার দিকে চলেছে নিরন্তর ছলাত্ ছলাত্ ধ্বনি তুলে । সমগ্র নদীকে আমরা চাক্ষুস করতে পারি না, নদীর মাঝপথের সাক্ষী হয়ে থাকি মাত্র, মানুষ তার সংক্ষিপ্ত জীবনকে নদীর প্রবাহের মধ্যেই বারে বারে তাই যেন খুঁজে চলে আজীবন । মানুষের জীবন কোন অজানা উৎস থেকে শুরু হয়েছে এবং আবহমান কাল ধরে বয়ে চলেছে আর এক অনন্ত রহস্যের দিকে। নদীর সাথে জীবনের সাদৃশ্য এখানেই, তাইতো নদী এবং তার প্রবাহ মানুষের জীবনের দোসর । নদীর তরঙ্গের মতো জীবন যাপনের সময়-রূপ তরঙ্গ-মালা কত যে স্মৃতি নিয়ে ভেসে যায়, তা কতোটা আনন্দের, কতোটা ভয়ের,কতোটা বেদনার, কতোটা অপ্রাপ্তির সব মিলিয়েই আমাদের জীবন। নদীর উৎস, নদীর উচ্চ, মধ্য, ও নিম্ন অববাহিকায় বয়ে যাওয়া, নদীর বাঁক নেওয়া, গ্রীষ্মে শুকিয়ে যাওয়া, বর্ষায় যৌবন ফিরে পাওয়া, শরতে, শীতে ধীর শান্ত গতিবেগে বয়ে যাওয়া, সাদা কাশে দুইতীর ভূমি ঢেকে থাকা, আবার কোন নদী গতি হারিয়ে মজা নদীতে পরিণত হওয়া, ফল্গুধারায় নদীর বয়ে যাওয়া, নদীর জলে ভেসে যাওয়া নৌকা ও মাঝি, নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া একতারা হাতে বাউল, দোতারায় গাইতে গাইতে চলে যাওয়া কোন অজানা এক গিদাল, নদীর ঘাট, প্রতিমা নিরঞ্জনের ঘাট, আবার কোথাও গড়ে ওঠা মন্দির, আবার কোথাও শ্মশান সব মিলিয়ে নদী আর জীবন এক ও অভিন্ন--সবই যেন মানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত...... আমাদের জীবন এমনই সুখে-দুখে চড়াই উৎরাই ধরে এগিয়ে চলা জীবন-- পৃথিবীর যেকোনো নদী এই সত্যটাই আমাদের সামনে প্রতি মুহূর্তে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। তাই নদী চিরকালই মানুষের চৈতন্য প্রবাহে,অবচেতনে জীবন্ত সত্তা হয়েই বেঁচে থাকবে আবহমানকাল ধরে । নদীর এই চলমানতার সঙ্গে জীবন-স্পন্দনের সুতো সর্বদাই যেন বাঁধা। বর্ষাকালে এই কালজানি নদী কী বিকট রূপ ধারণ করে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না ! নদীর কালগ্রাসে সব ধ্বংস হয়ে যায় আশেপাশের জমি,বাড়ি এবং গ্রামের পর গ্রাম । আবার গাড়িটি চলতে শুরু করল। যাত্রীরা যাত্রাকে আনন্দদায়ক করবার জন্য কেউ গান গাইছে কেউবা গাড়িতে বসে বসেই নৃত্যের মুদ্রায় হাত নাড়াচ্ছে। গাড়ি চলতে চলতে এবার আলিপুরদুয়ার জেলায় প্রবেশ করলো। হিমালয়ের পাদদেশ এখান থেকেই শুরু হয়েছে। ডুয়ার্সের মোহনীয় আকর্ষণ আমাদের মনকে একটু একটু করে ছুঁয়ে চলেছে। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। পাহাড়ি সৌন্দর্য এখান থেকে চোখে পড়ে। গাড়ি যতই এগোচ্ছে ততই লোক সংখ্যা বাড়িঘর কমতে শুরু করেছে। সবুজ নীরবতা ও বুনো আদিমতা একটু একটু করে যেন কোন এক রহস্যের গুহার দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাহাড়ি সংকীর্ণ পথ ধরে ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছি। দুধারে শুধুই সবুজ অরণ্যের বন্য আহ্বান। কিছুটা যেতেই রিজার্ভ ফরেস্টের শুরু। গাড়ি চেকপোস্টে এসে থেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে আমাদের একজন ক্যারাটে প্রশিক্ষক তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেন। তাদের অনুমতিপত্র দেখালেন। এরপর তারা আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন।। এখান থেকেই গভীর অরণ্যের সূচনা। আমরা গভীর অরণ্যের বুকে এবার ভেসে চলেছি। 




একটি মাত্র রাস্তা। বক্স রিজার্ভ ফরেস্ট । এক ধারে অগণিত সাল,সেগুন এবং অন্যান্য বৃক্ষের সারি । দূরে গাছে উঁচু ডালে বসে ময়ূর কেকাধ্বনি করছে । বানরগুলো ইচ্ছেমতো লাফালাফি করছে। সবুজ গভীর অরণ্য থেকে ছুটে আসা গন্ধ, মন মুগ্ধ করা এই গন্ধ বাতাসের তরঙ্গে দুলে দুলে আমাদের শ্বাসের সুরঙ্গ পথে মিশে সমগ্র চৈতন্যকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে এবং বুনো আবেশের আনন্দে আমরা হয়ে উঠছি আত্মহারা । অরণ্য যেন দুহাত বাড়িয়ে আমাদের বুকে টেনে নিচ্ছে। কত দিনের পুরনো আত্মীয় আমরা প্রাচীন অরণ্যের । সত্যি তো মানুষ এই আদিম প্রকৃতির বুকেই একদিন জন্মগ্রহণ করেছে। এটাই তার আতুরঘর,শৈশবের খেলাঘর। তারপর সে তার বুদ্ধিমত্তা পরিশ্রমে নিজেকে করেছে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার তাকে অরণ্যের সংহারকে পরিণত করেছে। একটু একটু করে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে অরণ্যের বুক থেকে। মানুষের ক্রমাগত লোভ অরণ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে চলেছে। অরণ্য না থাকলে মানুষের সভ্যতাও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, লোভী মানুষেরা সে কথা কবে বুঝবে ? কিন্তু আজ এই নির্জনে আত্মিয়ের মতো বৃক্ষগুলি আমাদের যেন সে পুরনো কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আরণ্যক সারল্য মানুষ কৃত্রিমতার চাপে হারিয়ে ফেলছে। অরণ্য আমাদের সে সারল্যই ফিরিয়ে দিতে তার প্রসারিত হাত সর্বদাই বাড়িয়ে রেখেছে। তাই তো মানুষ যখন বৈষয়িক চাপে বিষাক্ত হয়ে ওঠে তখন অরণ্যের কাছে ফিরে যায় প্রাণ বায়ুর জন্য, অরণ্যের সবুজ সারল্যের সংস্পর্শ পাওয়ার জন্যে । পথে যেতে যেতে কত নাম না জানা পাখি উড়ে গেল। কত অজানা ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। এখানে গাছ ফুল পাখি দেখলে মনে হয় না তারা কৃত্রিমতারা কোন বাঁধনে আটকে আছে, আমাদের সাজানো বাগান অথবা খাঁচায় ধরে রাখা কোন পাখির মত । তারা যেন মুক্ত আকাশের মতোই মুক্ত। তাই এই খোলা অরণ্যে প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারি আমরাও। গাড়ি যত এগোচ্ছে অরণ্য আরো গভীর থেকে গভীর হয়ে উঠছে। গাড়ির ড্রাইভার খুব সতর্কভাবে ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পথে যেতে যেতে ভেতরের যাত্রীদের চোখ এখন অরণ্যের প্রতিটি অংশে। মুহূর্তের জন্য কেউ চোখ সরিয়ে নিচ্ছে না। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সকলের চোখগুলো যেন দূরবীন হয়ে গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার মত শুধু সার্চ করে চলেছি। যদি কারো কিছু চোখে পড়ে। অর্থাৎ এখানে বাইসন, হাতি সহজেই চোখে পড়ে যায়। সবাই যেন বাজি ধরে বসে আছে। কে কার আগে সে দুর্লভ বস্তুটিকে দর্শন করে। কিন্তু আমাদের কারো চোখেই কিছুই পড়লো না এই করে করে আমরা জয়ন্তী পাহাড়ের ভুটান সীমান্তের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম, এখানেই আমাদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ হবে পরীক্ষাও দিতে হবে। এখানে হোমস্টের ব্যবস্থা আছে । প্রত্যেকটা কটেজ এক একটা ফ্যামিলিকে দেওয়া হয়েছে। এখানে সবগুলো কটেজ তিন মাস আগেই সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছিল। আমরা যেখানে উঠেছিলাম সে কটেজের মাত্র দশ হাত দূরে বয়ে যাচ্ছে জয়ন্তী নদী প্রবল স্রোতে। তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছ জয়ন্তী পাহাড়। যেখানে আছে মহাকাল ধাম। কি অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ের সেই দৃশ্য। সাদা মেঘের বুকে একটি দোলনার মতন যেন ভেসে আছে। সকাল বেলার সৌন্দর্য এক আর দুপুরের পাহাড় এক অপূর্ব নীল সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। আবার সাঁঝের হালকা আলোয় এই পাহাড় মায়াবী হয়ে ওঠ। সূর্য ডুবে গেলে আমরা গিয়ে নদীর পাড়ে বসলাম। তখন ওপারের পাহাড়টি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আবচ্ছা অন্ধকারে মনে হলো যেন দাঁড়িয়ে আছে এক প্রকাণ্ড ঐরাবত। আমাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষ সেখানকার হাতিদের আচরণের, স্বভাবের কথা আমাদের বলছিল। তারা বলল যে কোন সময় বন থেকে হাতি চলে আসে। হাতি এসে লবণ এবং,ভাত খেয়ে যায়। হাতি দল বেঁধে এলে শান্ত থাকে। দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সে পাগলের মত হয়ে যায়। তখন আশেপাশের যা থাকে সব ভেঙে তছনছ করে দেয়। তারা বলল কিছুদিন আগেই একটি হাতি তাদের রান্নাঘর তাদের,ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে চলে যায়। বন্যার কথা শুনতে চাইলে তারা বলে সে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এই নদী। এই সমস্ত এলাকা জলের তলায় চলে যায়। তখন তিন মাস আমরা উঁচু জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হই। এই সমস্ত অসুবিধা নিয়ে এখানকার মানুষ এ প্রকৃতিকে ভালোবেসে কিভাবে এক হয়ে আছে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। এত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও মানুষ এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়নি। খাদ্যের,ওষুধ পত্রের,বিদ্যা শিক্ষার সবকিছুতেই অভাব রয়েছে। তারা বলল সামান্য জিনিসের জন্য তাদেরকে যেতে হয় শামুকতলা বাজারে। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিল একটি মাত্র হাই স্কুল । জয়ন্তী নদীর পাড়ে ছোট ছোট ঘরগুলো কোনটি পাকা বাড়ি আবার কোনটি কাঠের তৈরি। কাঠের তৈরি ছোট ছোট কটেজে দেশি-বিদেশী পর্যটকদের ভীড়ে ঠাসা থাকে সিজন টাইমে ।‌‌ তবে বর্ষা কালে সব বন্ধ রাখা হয় । এ সময় হলো বন্য প্রানীদের প্রজনন কাল । এ সময় জয়ন্তী নদীও বিকট রূপ ধারণ করে।



জয়ন্তী নদী বর্ষাকাল ছাড়া ভিন্ন সময়ে প্রাণবন্ত কিশোরীর‌ মতো নৃত্যের ভঙ্গিতে কুলু কুলু স্বরে নূপুর নিক্বন ধ্বনির মতো তরঙ্গের পর তরঙ্গ ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছে। শান্ত স্নিগ্ধ জলরাশি জোছনার মত ছড়িয়ে আছে । নদীর শীতল জলের স্পর্শ এক মোহনীয় আকর্ষণে তাদের শরীর মন স্নিগ্ধ করে রাখে পর্যটকদের মনকে। তোদের পথ চলার ক্লান্তি মুহূর্তে দূর করে দেয় । কতো যে নাম না জানা বুনো পাখি শান্ত স্তব্ধতার বুকচিরে জেট প্লেনের গতিতে বন্য রহস্য থেকে আর এক বুনো রহস্যে মিলিয়ে চলেছে তার শেষ নেই। ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা সম্মোহিত হয়ে উড়ন্ত পাখিগুলোর ডানায় মনকে পাঠিয়ে দেয় রহস্যের অমীমাংসিত অরণ্যের গভীরে। তাই তো মানুষ দুঃসাহসীকতার প্রত্যয়ে ভর দিয়ে বারে বারে ছুটে আসে বন,পাহাড়,গহন অরন্যের টানে । এ টান মানুষের আদিম টান,যা আমাদের জিনের মধ্যদিয়ে বিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। সবুজে ঘেরা গভীর অরণ্য আমাদের রক্তপ্রবাহের মধ্যে উন্মাদনা ভরে দেয়। আমরাও কৃত্তিম‌ জীবন শৈলীর শেকল ভেঙ্গে অরণ্যের সবুজে, অরণ্যের স্তব্ধতায়, অরণ্যের হিংস্রতায়, অরণ্যের আদিম আলিঙ্গনে নিজেদের দিই মিশিয়ে। এ কয়েকটি দিন বা কয়েক ঘন্টা মুক্ত ভাবনাহীন, যন্ত্রণাহীন সময়ের স্রোতে ভেসে যাই। মনকে উড়িয়ে দিই ছকেবদ্ধ ফ্যাকাশে জীবনকে অরণ্যের দুরন্ত বন্য সবুজ ছন্দে।

            আমরা পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট স্থানে। পৌঁছানোর পর আমরা নির্দিষ্ট হোম স্টেটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ক্যারাটের পোশাক পড়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ালাম । বিশেষজ্ঞ শিক্ষক এসেছেন, তাঁর বাড়ি শ্রীলঙ্কায়। তিনি হলেন শিহান। অর্থাৎ প্রধান শিক্ষকের । কিছুক্ষণ পর আমরা সারিবদ্ধ ভাবে নদীর পাথর ও বালুর মাঝে প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। দু ঘন্টা ধরে প্রশিক্ষণ দিলেন "শিহান"। আমরা নতুন নতুন কৌশল তাঁর কাছ থেকে শিখলাম। এরপর নদীর স্রোতের মাঝে কখনো দাঁড়িয়ে কখনো শোয়া অবস্থায় নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কৌশল আমাদের করতে হলো। সাহস, শক্তি ও ধৈর্য এবং কৌশলের সমন্বয় আমাদের প্রশিক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য। এভাবেই সময় ধরে যেমন প্রশিক্ষণ হত তেমনি ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ এবং ডিনার নির্দিষ্ট সময়ে করতে হবে। ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠে ক্যারাটে পোশাক যেটাকে জাপানি ভাষায় "গ্যি " বলে তা পরিধান করে সাড়ে চারটার মধ্যেই দলবদ্ধ ভাবে নির্দিষ্ট স্থানে প্রশিক্ষণ নিতে চলে গেলাম। ৭ টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেবার পর আমরা ফিরে এলাম। আবার বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত। লাঞ্চের পর আবার বিকেল চারটা থেকে ছটা পর্যন্ত। এই পর্যায়ে ক্রমে তিন দিন ধরে প্রশিক্ষণ এবং তিনদিনের দিন পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে শেষের দিন রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বনফায়ারের মধ্য দিয়ে আমাদের তিনদিনের "সামার ক্যাম্প" সমাপ্ত হলো। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা, তাদের অভিভাবকরা কেউ নৃত্য,গান,কবিতা পাঠ করছিল। সমস্ত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্প থেকে পাওয়া নির্দিষ্ট টিশার্ট পরিধান করে উপস্থিত হতে হয়েছে। আমিও সেখানে স্বরচিত একটি কবিতা পাঠ করলাম। আমি সত্যিই আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম রাশিয়ান ছেলেটি যে গ্রেডেশনের পরীক্ষা দিতে এসেছিল এখানে, সে যথাযথ উচ্চারণসহ সুর তাল সহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে রে" সহ মোট দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন গভীর দরদভরা আবেগ দিয়ে উপস্থিত করল, সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেছে সকলে। আশ্চর্য হয়ে গেছি এই কারণেই যেখানে বঙ্গসন্তানেরা বাংলা গান ভুলে গিয়ে ভোজপুরি সংগীতের মাদকতায় উন্মাদের মতো নৃত্য করে আজকাল যে কোন অনুষ্ঠানে,সেখানে রাশিয়ান ছেলেটির এই গান গাওয়া আমার কাছে একটি মহার্ঘ্য উপহার ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দৃশ্য আমাকে বাঙালি হিসেবে, বাংলাভাষী হিসেবে গর্ববোধ করে আবার। এমন মধুর এমন কোমল এমন প্রাণের বাংলা ভাষার চর্চা যদি বিদেশী মানুষটি অত্যন্ত যত্ন সহকারে করতে পারে তবে বর্তমানে বাঙালিরা সে কথা কী করে ভুলে যাচ্ছে ? কী করে অস্বীকার করছে বাংলা ভাষাকে, একশ্রেণীর বাঙালি। যাই হোক তিনদিনের "সামার ক্যাম্পে" না গেলে আমি এমন একটি শিক্ষা পেতাম না।

ক্যারাটে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে এখানকার বহু কাহিনী বহু ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত গল্প শুনেছি। লোক জীবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রূপকথার কথা শুনিয়েছে আমাকে চায়ের দোকানের মজনু তামাং নামের ষাটোর্ধ্ব প্রবীন ব্যক্তিটি। এখানে ভুটিয়া, নেপালি, আদিবাসী, খ্রিস্টান এবং বিহারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা একত্রে বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে। আমার হোমস্টে থেকে কিছুটা দূরে বাজার। সেখানে সকালে সহজেই চা, কফি পাউরুটি ডিম পাওয়া যায় । সন্ধ্যায় চাউমিন,মমো । কিন্তু রাত আটটার পর থেকেই ধীরে ধীরে অরণ্যের নীরবতা নেমে আসে গাঢ় অন্ধকারের সাথে। সে অন্ধকার পথে হেঁটে চলেছি নিজের বাসস্থানের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ পাশের জঙ্গলটি নড়ে উঠলো, তারপর দেখলাম একটি হরিণ চোখের সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেল। কিছুক্ষণ আমি, দীপ ও আদিত্য(শিক্ষার্থী) নির্জন নদীর তীরে গিয়ে বসলাম পাথরের উপর। পেছন থেকে ভারী বুটের শব্দ শুনতে পেলাম। দেখলাম পাঁচজন সশস্ত্র বিএসএফ জাওয়ানরা আমাদের পাশ দিয়ে নদী পার হয়ে অন্ধকারে এক একজন একটি পাথরের উপরে বসলো। চোখ রয়েছে তাদের ভুটান সীমান্তে পাহাড়ের দিকে। জানলাম রাতে এই পথ দিয়েই চোরাকারীরা পশুর চামড়া, হাতির দাঁত,মাদক, আরো বহু কিছু পারাপার করে অবৈধভাবে । এমনকি এই পথ দিয়ে যেতে পারে দেশের শত্রু। তাঁরা আমাদের ধীরে ধীরে বলল কথা না বলতে, আলো না জ্বালাতে এবং নদীর প্রবাহে পাথর না ছুড়তে। বুঝলাম তাতে চোরা চালানকারীরা সচেতন হয়ে যাবে। বুঝে যাবে এখানে সীমান্তরক্ষীরা আছে। শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা তাঁরা এভাবেই সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে। আমরা ফিরে এলাম ঘরে। মাত্র চোখটা লেগেছে। রাত তখন দুটো হবে হঠাৎ চিৎকার। আমরা জেগে উঠলাম। বৈদ্যুতিক আলো জ্বালালাম ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এলাম। আলো জ্বালালাম । এবার চোখের সামনে যা দেখতে পেলাম তা দেখে যেমন আনন্দ পেলাম তেমনই প্রতিটি মুহূর্ত ভয়ের শিহরণ আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বয়ে গেল সেই মুহূর্ত গুলো। একটি দলছুট পাহাড় প্রমাণ হাতি পাগলের মতো ঘরের সামনের পথ দিয়ে ছুটে চলে গেল। আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এরপর একদল লোক দূর থেকে ছুটে আসছে হাতে তাদের আগুনের মশাল। তারা আমাদের দেখে ঘরে চলে যেতে বললো, আমরা লোকেদের দেখে তাদের কথা শুনে স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ফিরে গেলাম। স্বাভাবিকভাবেই সে রাতে ঘুম আসেনি। ভোরের দিকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলাম। কিন্তু চারটায় ঘড়িতে এলাম বেজে উঠলো। আর বিছানায় নয়। জেগে উঠলাম। প্রস্তুত হলাম ক্যারাটে অনুশীলনের নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার জন্যে, ঠিক তখনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে প্রবল বেগে বৃষ্টি হতে শুরু করল। পাশাপাশি ভয়ানক বজ্রপাত। ভুটানকে বজ্রপাতের দেশ বলা হয়। আমরা তো ভুটান সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছি। সেই ভয়ানক শব্দের বজ্রপাত আমাদের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। শিহানের নির্দেশ এলো--অনুশীলনের সময় এক ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আমরা জয়ন্তী হাই স্কুলে পরিবেশ সচেতনতা শিবিরে, প্লাস্টিক বর্জন, অরণ্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একটি আলোচনা সভায় সমস্ত শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক, নিকটবর্তী বিএসএফ ক্যাম্পের কমান্ডার, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান এবং স্থানীয় টুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই তিন দিন চলে গেল। এবার আমাদের ফেরার পালা। 

              এক দুর্দান্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ অনুশাসনের শিক্ষা নিয়ে জয়ন্তীর অপূর্ব মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যকে পুনরায় দুচোখে উপভোগ করতে করতে গাড়ি করে আমরা বনের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি । যতই এগিয়ে চলেছি মন, যেন ততই বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যেন কোন এক পরম আত্মীয়ের স্নেহের আঁচলের আশ্রয় ছেড়ে আবারও বর্ণহীন ছকে বাঁধা  শ্বাসরোধী বিষাক্ত এবং কৃত্রিম জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে খাঁচার পাখির মত বন্দী করতে চলেছি এই অরণ্যের মুক্ত জীবন ছন্দকে পিছনে রেখে। সবুজ অরণ্যের হাতছানি আমাদের রক্তের কণায় কণায় বয়ে যাবে তবুও অনবরত। আমাদের এই টান কখনোই ছিন্ন হবে না। জয়ন্তীর অপূর্ব মেঘে ঢাকা স্বর্গীয় সৌন্দর্য আমাদের মনে যে আবেশঘন মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সৌন্দর্যের টানেই মন আবারও ফিরে যাবে এই উদার উন্মুক্ত সবুজ অরণ্যের রহস্যে হারিয়ে যেতে............. এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা...........

(ছবি- লেখক)


 

"দেখা হয় নাই দুই পা ফেলিয়া... "
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


সোনালী শরৎকালের আকাশে নীল সাদা পেঁজা তুলোর মেঘ যেন শিল্পীর হাতে আঁকা রঙিন ক্যানভাসের এক উড়ন্ত চাদর। একটু ভোরের দিকে পুজোর মাঠে, তা সেই "তরুণ দলের" মাঠই হোক বা দেশবন্ধু পাড়ার "দিশারি" ক্লাবের মাঠে শিশির বিন্দুতে সেজে ওঠে কালচে সবুজ দূর্বা ঘাসের রঙিন কার্পেট। 

তিস্তা বঙ্গের বিভাগীয় শহর জলপাইগুড়ি,  গোটা উত্তরবঙ্গের শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান।  কোলকাতা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর, শারদোৎসবের প্রাক্কালে বর্ণময় শোভায় সেজে ওঠে। সুন্দরী  তিস্তা নদী ও শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া করলা নদীর ঘেরাটোপে এই জনপদে, আনন্দময়ীর আগমনে, আনন্দে দশদিক  ছেয়ে যায়। কোলকাতা থেকে দার্জিলিং মেল,  পদাতিক এক্সপ্রেস, উত্তর বঙ্গ এক্সপ্রেস বা তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে  রাতের ট্রেনে চেপে বসলেই পরদিন সকালেই  পৌছে যাওয়া যায় বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহরে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের অতিথি নিবাস" তিস্তা আবাস " ছাড়াও গোটা কুড়ি হোটেল রয়েছে শহরজুড়ে। আগেভাগে বুকিং করা থাকলে তো ভালোই। না থাকলেও এ শহর অত্যন্ত অতিথিবৎসল। এখানে সবারই জন্য আশ্রয় রয়েছে। ১৫ কিলোমিটার দূরে তিস্তা নদীর পার করলেই গরুমারা, লাটাগুড়ি, বাতাবাড়ি, চালসা, মেটেলি, মালবাজার, ওদলাবাড়িতে শ'য়ে শ'য়ে রিসর্ট ও হোম স্টে রয়েছে। 





পঞ্চমী তিথি বা দেবীর বোধনের আগেই মন্ডপ গুলোতে প্রতিমা এসে যায়। বর্ণময় আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে মন্ডপ সহ গোটা শহর।  এই শহরের একটা বিষয় লক্ষণীয় সেটা হল, এই শহরের প্রবেশ পথগুলোতে প্রথম মন্ডপের আলোক সজ্জা শেষ হতে না হতেই আর একটা মন্ডপের আলোক সজ্জা শুরু হয়ে যায়। শহরের সব পূজোগুলোতে আড়ম্বরপূর্ণ উদবোধনের ঘটা না থাকলেও, 'তরুণদল', 'দিশারি ', 'জাগ্রত সংঘ','অরবিন্দ ব্যায়ামাগার পাঠাগার ও ক্লাব', 'শহরতলী' 'শান্তিপাড়া নেতাজী মর্ডান ক্লাব', ' রায়কত পাড়া বারোয়ারী ',  ' নরেন ভিলা"  পান্ডাপাড়া সার্বজনীন ", 'পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি দূর্গাপজা কমিটি ' প্রভৃতি পুজো গুলোতে স্থানীয় মন্ত্রী বিধায়করা ফিতে কেটে উদবোধন করে থাকেন।

আদরপাড়ায় "রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের " দুর্গাপূজার দিকে সব দর্শনার্থীদের আগ্রহ বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়।অষ্টমী তে কুমারী পুজো এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া রোজ সন্ধ্যায় সুবিশাল মাঠ জুড়ে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানোর বিষয়টা ধারাবাহিক ভাবে শহরবাসীকে মুগ্ধ করে। 

বৈচিত্রপূর্ণ আদরপাড়া ক্লাব ও পাঠাগার এবং প্রগতি ব্যামাগারের  বনদূর্গা খুবই দর্শনার্থীদের মনকে টানে। জলপাইগুড়ির প্রাচীন বাড়ির  পুজোগুলোর মধ্যে, 'নিয়োগী বাড়ির দুর্গাপুজো', ' কল্যাণী হাউসের দুর্গাপুজো'  এবং 'ভুঁইয়া বাড়ির' দুর্গাপূজার বিশেষ  নাম আছে।  

"নিয়োগী বাড়ির দুর্গাপুজোয়" সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। "ভুঁইয়া বাড়ির দুর্গাপুজো " তে সাত সাগরের জল মা'কে দান করা হয়। একবার এই বাড়ির  পুজো চলাকালীন মায়ের মূর্তির সামনে জীবন্ত সাপ এসে উপস্থিত হয়েছিল। জলপাইগুড়ি শহর ছাড়াও ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজারেও মহা সাড়ম্বরে দেবী দূর্গার আরাধনা হয়। কথিত আছে নিষ্ঠার সাথে দেবী দূর্গার পুজো করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়।

জলপাইগুড়ির রাজবাড়ীর দুর্গাপূজারও এক ঐতিহাসিক পটভূমি আছে।  রাজবাড়ীর মৃম্ময়ী মূর্তির কিছু বিশেষত্ব আছে।প্রাচীন কাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে জলপাইগুড়ি র  রাজবাড়ী সংলগ্ন মন্দিরে মহা সাড়ম্বরে দূর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। আরও ২৫ /৩০ টি পুজোর সাথে সাথে এই পুজোর আকর্ষণ একদমই আলাদা। সাধারণত মা দূর্গার ডান পাশে লক্ষী ও গনেশ এর মূর্তি এবং বাম পাশে সরস্বতী ও কার্তিকের মূর্তি থাকে।  কিন্তু জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর ক্ষেত্রে মা দূর্গার ডান পাশে প্রথমে গনেশ পরে লক্ষীর মূর্তি থাকে। লক্ষী এবং বিজয়ার মূর্তির মাঝে একজন পুরুষ দেবতার মূর্তি থাকে।  কেউ কেউ এই মূর্তিকে ব্রহ্মা 'র মূর্তি বলে থাকেন। অনুরূপ ভাবে দেবী দূর্গার বাম পাশে সাধারণত সরস্বতী ও কার্তিক এর মূর্তি দেখা গেলেও রাজবাড়ীর প্রতিমায় বাম পাশে সরস্বতী ও পরে কার্তিকের মূর্তি দেখা যায়।  কার্তিকের পাশে  দেবী জয়া পূজিত হন। প্রতিমার বর্ণ, গঠন ছাড়াও এই মন্দিরে,  লক্ষী,গনেশ,কার্তিক, সরস্বতী ছাড়াও জয়া ও বিজয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।  জয়া কে উৎকর্ষতার প্রতীক অর্থাৎ সরস্বতী হিসাবে পূজিত হন। বিজয়া তিনি যাকে ছাড়া বিজয়  অসম্ভব।  শ্রীহীন বা লক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়,  তাই বিজয়া লক্ষী হিসেবে পূজিত হন। 

দুর্গোৎসবের সময়ে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে পূজিত হন দূর্গারূপিনী চামুন্ডা অর্থাৎ মহাকালী।  ইনি কালরাত্রি কৌশিকী। কালরাত্রির ললাট থেকে করালবদনা চামুন্ডার জন্ম। চামুণ্ডা হলেন মহামায়া। মহামায়া দ্বার না ছাড়লে প্রকৃতির দর্শন হয় না।

জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর গৃহদেবতা বৈকুন্ঠনাথ  ও দশভুজা ভগবতী একই আসনে অধিষ্ঠিতা। দশভুজার দশটি হাতে শূল,শর, শক্তি, চক্র  ডান দিকের হাত গুলিতে শোভা পায়।  বাম দিকের হাত গুলিতে শোভিত পাশ, খেটক, ধনু, কুঠার এবং অঙ্কুশ শোভা পায়।  দেবী ডান হাতে শুল ধারণ করে অসুরের বুকে বিধিঁয়েছেন। মহিষের কাটা গলা থেকে অসুরের জন্ম। অসুরের বামবাহু কামড়ে ধরেছে একটি বাঘ। বাঘ এবং সিংহের উপর স্থাপিত দেবীর ডান পা। দেবী নানা অলংকারে সজ্জিত।  দেবীর মুখ ডিম্বাকৃতি। চোখ দুটি কোটরগত এবং ভীষনা। তৃতীয় নেত্র টি ও খুবই স্পষ্ট। 

আজও নবমী পুজোর রাতে গোপনে কি যেন বলি দেওয়া হয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক উমেশ শর্মা মহাশয়ের " উত্তরবঙ্গের মূল নিবাসীদের সংস্কৃতি,  ইতিহাসের আলোকে  বৈকুন্ঠপুরের  পূজা পার্বণ  ও লোকাচারের ধারা  বইটিতে তার উল্লেখ আছে। কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে এখানে নরবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু আসলে এটি একটি কুলোর উপর কুশ ও আতপচালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের রূপ দিয়ে তাকে বলি দিয়ে করলায় বিসর্জন দেওয়া হয়।

 এক ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিবছর জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর দূর্গাদেউলে। এই পূজো দেখতে দেশ বিদেশের বহু দর্শনার্থীরা জলপাইগুড়িতে  আসেন। বিজয়া দশমীতে রাজবাড়ী সংলগ্ন পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।  বিসর্জনের ঘাটে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয়।

(ছবি- সংগৃহিত)